মহাভারত (রাজশেখর বসু)/স্ত্রীপর্ব/জলপ্রাদানিকপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

স্ত্রীপর্ব

॥ জলপ্রাদানিকপর্বাধ্যায়॥

১। বিদুরের সান্ত্বনাদান

 শত পুত্রের মৃত্যুতে ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত শোকাকুল হলেন। সঞ্জয় তাঁকে বললেন, মহারাজ, শোক করছেন কেন, শোকের কোনও প্রতিকার নেই। এখন আপনি মৃত আত্মীয়সুহৃদ্‌গণের প্রেতকার্য করান। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমার সমস্ত পুত্র অমাত্য ও সুহৃৎ নিহত হয়েছেন, এখন আমি ছিন্নপক্ষ জরাজীর্ণ পক্ষীর ন্যায় হয়েছি, আমার চক্ষু নেই, রাজ্য নেই, বন্ধু নেই; আমার জীবনের আর প্রয়োজন কি?

 ধৃতরাষ্ট্রকে আশ্বাস দেবার জন্য বিদুর বললেন, মহারাজ, শুয়ে আছেন কেন, উঠুন, সর্ব প্রাণীর গতিই এই। মানুষ শোক ক’রে মৃতজনকে ফিরে পায় না, শোক ক’রে নিজেও মরতে পারে না। —

সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনান্তাঃ সমচ্ছ্রয়াঃ।
সংযোগা বিপ্রয়োগান্তা মরণান্তঞ্চ জীবিতম্॥
অদর্শনাদাপতিতাঃ পুনশ্চাদর্শনং গতাঃ।
ন তে তব ন ত্বেষাং ত্বং তত্র কা পরিবেদনা॥
শোকস্থানসহস্রাণি ভয়স্থানশতানি চ।
দিবসে দিবসে মূঢ়মাবিশন্তি ন পণ্ডিতম্॥
ন কালস্য প্রিয়ঃ কশ্চিন্ন দ্বেশ্যঃ কুরুসত্তম।
ন মধ্যস্থঃ ক্বচিৎ কালঃ সর্বং কালঃ প্রকর্ষতি॥

— সকল সঞ্চয়ই পরিশেষে ক্ষয় পায়, উন্নতির অন্তে পতন হয়, মিলনের অন্তে বিচ্ছেদ হয়, জীবনের অন্তে মরণ হয়। মানুষ অদৃশ্য স্থান থেকে আসে, আবার অদৃশ্য স্থানেই চ’লে যায়; তারা আপনার নয়, আপনিও তাদের নন; তবে কিসের খেদ? সহস্র সহস্র শোকের কারণ এবং শত শত ভয়ের কারণ প্রতিদিন মূঢ় লোককে অভিভূত করে, কিন্তু পণ্ডিতকে করে না। কুরুশ্রেষ্ঠ, কালের কেউ প্রিয় বা অপ্রিয় নেই, কাল কারও প্রতি উদাসীনও নয়; কাল সকলকেই আকর্ষণ ক’রে নিয়ে যায়।

 তার পর বিদুর বললেন, গর্ভাধানের কিছু পরে জীব জরায়ুতে প্রবেশ করে, পঞ্চম মাস অতীত হ’লে তার দেহ গঠিত হয়। অনন্তর সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হয়ে ভ্রূণরূপে সে মাংসশোণিতযুক্ত অপবিত্র স্থানে বাস করে। তার পর বায়ুর বেগে সেই ভ্রূণ ঊর্ধ্ব পাদ অধঃশিরা হয়ে বহু কষ্ট ভোগ ক’রে যোনিদ্বার দিয়ে নির্গত হয়। সেই সময়ে গ্রহগণ তার কাছে আসে। ক্রমশ সে স্বকর্মে বদ্ধ হয় এবং বিবিধ ব্যাধি ও বিপদ তাকে আশ্রয় করে, তখন হিতৈষী সুহৃদ্‌গণই তাকে রক্ষা করেন। কালক্রমে যমদূতেরা তাকে আকর্ষণ করে, তখন সে মরে। হা, লোকে লোভের বশে এবং ক্রোধ ও ভয়ে উন্মত্ত হয়ে নিজেকে বুঝতে পারে না। সৎকুলে জন্মালে নীচকুলজাতের এবং ধনী হ’লে দরিদ্রের নিন্দা করে, অন্যকে মূর্খ বলে, নিজেকে সংযত করতে চায় না। প্রাজ্ঞ ও মূর্খ, ধনবান ও নির্ধন, কুলীন ও অকুলীন, মানী ও অমানী সকলেই যখন পরিশেষে শ্মশানে গিয়ে শয়ন করে তখন দুষ্টবুদ্ধি লোকে কেন পরস্পরকে প্রতারিত করে?

২। ভীমের লৌহমূর্তি

 ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এসে বহু সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তুমি শোকে অভিভূত হয়ে বার বার মূর্ছিত হচ্ছ জানলে যুধিষ্ঠিরও দুঃখে প্রাণত্যাগ করতে পারেন। তিনি সকল প্রাণীকে কৃপা করেন, তোমাকে করবেন না কেন? বিধির বিধানের প্রতিকার নেই এই বুঝে আমার আদেশে এবং পাণ্ডবদের দুঃখ বিবেচনা ক’রে তুমি প্রাণধারণ কর, তাতেই তোমার কীর্তি ধর্ম ও তপস্যা হবে। প্রজ্জ্বলিত অগ্নির ন্যায় যে পুত্রশোক উৎপন্ন হয়েছে, প্রজ্ঞারূপ জল দিয়ে তাকে নির্বাপিত কর। এই ব’লে ব্যাসদেব প্রস্থান করলেন।

 ধৃতরাষ্ট্র শোক সংবরণ ক’রে গান্ধারী, কুন্তী এবং বিধবা বধূদের নিয়ে বিদুরের সঙ্গে হস্তিনাপুর থেকে যাত্রা করলেন। সহস্র সহস্র নারী কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের সঙ্গে চলল। এক ক্রোশ গিয়ে তাঁরা, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মাকে দেখতে পেলেন। কৃপাচার্য জানালেন যে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র প্রভৃতি সকলেই নিহত হয়েছেন। তার পর কৃপাচার্য হস্তিনাপুরে, কৃতবর্মা নিজের দেশে, এবং অশ্বত্থামা ব্যাসের আশ্রমে চ’লে গেলেন।

 ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুর থেকে নির্গত হয়েছেন শুনে যুধিষ্ঠিরাদি, কৃষ্ণ, সাত্যকি ও যুযুৎসু তাঁর অনুগমন করলেন। দ্রৌপদী ও পাঞ্চালবধূগণও সঙ্গে চললেন। পাণ্ডবগণ প্রণাম করলে ধৃতরাষ্ট্র অপ্রীতমনে যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করলেন এবং ভীমকে খুঁজতে লাগলেন। অন্ধরাজের দুষ্ট অভিসন্ধি বুঝে কৃষ্ণ তাঁর হাত দিয়ে ভীমকে সরিয়ে দিলেন এবং ভীমের লৌহময় মূর্তি ধৃতরাষ্ট্রের সম্মুখে রাখলেন। অযুত হস্তীর ন্যায় বলবান ধৃতরাষ্ট্র সেই লৌহমূর্তি আলিঙ্গন ক’রে ভেঙে ফেললেন। বক্ষে চাপ লাগার ফলে তাঁর মুখ থেকে রক্তপাত হ’ল, তিনি ভূমিতে প’ড়ে গেলেন; তখন সঞ্জয় তাঁকে ধ’রে তুললেন। ধৃতরাষ্ট্র সরোদনে উচ্চস্বরে বললেন, হা হা ভীম!

 কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, শোক করবেন না, আপনি ভীমকে বধ করেন নি, তাঁর প্রতিমূর্তিই চূর্ণ করেছেন। দুর্যোধন ভীমের যে লৌহমূর্তি নির্মাণ করিয়েছিলেন তাই আমি আপনার সম্মুখে রেখেছিলাম। আপনার মন ধর্ম থেকে চ্যুত হয়েছে তাই আপনি ভীমসেনকে বধ করতে চান; কিন্তু তাঁকে মারলেও আপনার পুত্রেরা বেঁচে উঠবেন না। আপনি বেদ ও বিবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন, পুরাণ ও রাজধর্মও শুনেছেন, তবে স্বয়ং অপরাধী হয়ে এরূপ ক্রোধ করেন কেন? আপনি আমাদের উপদেশ শোনেন নি, দুর্যোধনের বশে চ’লে বিপদে পড়েছেন।

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মাধব, তোমার কথা সত্য, পুত্রস্নেহই আমাকে ধৈর্যচ্যুত করেছিল। আমার ক্রোধ এখন দূর হয়েছে, আমি মধ্যম পাণ্ডবকে স্পর্শ করতে ইচ্ছা করি। আমার পুত্রেরা নিহত হয়েছে, এখন পাণ্ডুর পুত্রেরাই আমার স্নেহের পাত্র। এই ব’লে ধৃতরাষ্ট্র ভীম প্রভৃতিকে আলিঙ্গন ও কুশলপ্রশ্ন করলেন।

৩। গান্ধারীর ক্রোধ

 তার পর পঞ্চপাণ্ডব গান্ধারীর কাছে গেলেন। পুত্রশোকার্তা গান্ধারী যুধিষ্ঠিরকে শাপ দিতে ইচ্ছা করেছেন জেনে দিব্যচক্ষুষ্মান মনোভাবজ্ঞ মহর্ষি ব্যাস তখনই উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর পুত্রবধূকে বললেন, গান্ধারী, তুমি পাণ্ডবদের উপর ক্রুদ্ধ হয়ো না। অষ্টাদশ দিন যুদ্ধের প্রতিদিনই দুর্যোধন তোমাকে বলত, মাতা, আমি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি, আমাকে আশীর্বাদ করুন। তুমি প্রতিদিনই পুত্রকে বলতে, যে পক্ষে ধর্ম সেই পক্ষেই জয় হবে। কল্যাণী, তুমি চিরদিন সত্য কথাই বলেছ। পাণ্ডববা অত্যন্ত সংশয়াপন্ন হয়ে পরিশেষে তুমুল যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, অতএব তাদের পক্ষেই অধিক ধর্ম আছে। মনস্বিনী, তুমি পূর্বে ক্ষমাশীলা ছিলে, এখন ক্ষমা করছ না কেন? যে পক্ষে ধর্ম সেই পক্ষেরই জয় হয়েছে। তোমার পূর্ববাক্য স্মরণ ক’রে পাণ্ডুপুত্রদের উপর ক্রোধ সংবরণ কর।

 গান্ধারী বললেন, ভগবান, আমি পাণ্ডবদের দোষ দিচ্ছি না, তাদের বিনাশও কামনা করি না; পুত্রশোকে আমার মন বিহ্বল হয়েছে। দুর্যোধন শকুনি কর্ণ আর দুঃশাসনের অপরাধেই কৌরবগণের ক্ষয় হয়েছে। কিন্তু বাসুদেবের সমক্ষেই ভীম দুর্যোধনের নাভির নিম্নদেশে গদাপ্রহার করেছে, সেজন্যই আমার ক্রোধ বর্ধিত হয়েছে। যিনি বীর তিনি নিজের প্রাণরক্ষার জন্যও যুদ্ধকালে কি ক’রে ধর্মত্যাগ করতে পারেন?

 ভীম ভীত হয়ে সানুনয়ে বললেন, দেবী, ধর্ম বা অধর্ম যাই হ’ক, আমি ভয়ের বশে আত্মরক্ষার জন্য এমন করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার পুত্রও পূর্বে অধর্ম অনুসারে যুধিষ্ঠিরকে পরাভূত করেছিলেন এবং সর্বদাই আমাদের সঙ্গে কপটাচরণ করেছেন, সেজন্যই আমি অধর্ম করেছি। তিনি দ্যূতসভায় পাঞ্চালীকে কি বলেছিলেন তা আপনি জানেন; তার চেয়েও তিনি অন্যায় কার্য করেছিলেন — সভামধ্যে দ্রৌপদীকে বাম ঊরু দেখিয়েছিলেন। রাজ্ঞী, দুর্যোধন নিহত হওয়ায় শত্রুতার অবসান হয়েছে, যুধিষ্ঠির রাজ্য পেয়েছেন, আমাদের ক্রোধও দূর হয়েছে।

 গান্ধারী বললেন, বৃকোদর, তুমি দুঃশাসনের রুধির পান ক’রে অতি গর্হিত অনার্যোচিত নিষ্ঠুর কর্ম করেছ। ভীম বললেন, রক্ত পান করা অনুচিত, নিজের রক্ত তো নয়ই। দ্রাতার রক্ত নিজের রক্তেরই সমান। দুঃশাসনের রক্ত আমার দন্ত ও ওষ্ঠের নীচে নামে নি, শুধু আমার দুই হস্তই রক্তাক্ত হয়েছিল। যখন দুঃশাসন দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করেছিল তখন আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তাই আমি ক্ষত্রধর্মানুসারে পালন করেছি। আপনার পুত্রেরা যখন আমাদের অপকার করত তখন আপনি নিবারণ করেন নি, এখন আমাদের দোষ ধরা আপনার উচিত নয়।

 গান্ধারী বললেন, বৎস, আমাদের শত পুত্রের একটিকেও অবশিষ্ট রাখলে না কেন? সে বৃদ্ধ পিতামাতার যষ্টিস্বরূপ হ’ত। তার পর গান্ধারী সক্রোধে জিজ্ঞাসা করলেন, সেই রাজা যুধিষ্ঠির কোথায়? যধিষ্ঠির কাঁপতে কাঁপতে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, দেবী, আমিই আপনার পুত্রহন্তা নৃশংস যুধিষ্ঠির, আমাকে অভিশাপ দিন। গান্ধাবী নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। তাঁর চরণ ধারণের জন্য যুধিষ্ঠির অবনত হলেন, সেই সময়ে গান্ধারী তাঁর চক্ষুর আবরণবস্ত্রের অন্তরাল দিয়ে যুধিষ্ঠিরের অঙ্গুলির অগ্রভাগ দেখলেন; তার ফলে যুধিষ্ঠিরের সুন্দর নখ কুৎসিত হয়ে গেল। অনন্তর কৃষ্ণের পশ্চাতে অর্জুনও গান্ধারীর কাছে এলেন। অবশেষে গান্ধারী ক্রোধমুক্ত হয়ে মাতার ন্যায় পাণ্ডবগণকে এবং কুন্তী ও দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিলেন।