মা/প্রথম খণ্ড/তেরো

উইকিসংকলন থেকে

—তেরো—

 দরজায় শব্দ হতে মা খুলে দিয়ে দেখেন রাইবিন ৷

 রাইবিন বললো, তুমি একা, মা?

 হাঁ।

 তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। আমার একটা থিওরী আছে।

 মা উদ্বেগে, আশঙ্কায়, রাইবিন কি যেন বলে ভেবে তার দিকে চাইলেন।

 রাইবিন বললো, সব কিছুর মুলে চাই টাকা। এই ইস্তাহারগুলোর টাকা জোগায় কে?

 মা বললেন, জানিনে তো!

 রাইবিন বললো, তারপর, দ্বিতীয় জিগ্যাস্য, এসব লেখে কারা? শিক্ষিত লোকেরা, কর্তারা। কর্তারা এই সব বই লিখে ছড়ায় এবং এই বইয়েতে তাদেরই বিরুদ্ধে কথা থাকে। এখন আমায় বল, মা, কেন, কোন্ স্বার্থে কর্তারা তাদের অর্থ এবং সময় ব্যয় করে, তাদের নিজেদের, বিরুদ্ধেই লোক ক্ষেপিয়ে তোলে?

 মা ভীত হ’য়ে বলেন, তোমার কি মত?

 রাইবিন বলে, আমার মত! যখন ঠিক পেলুম জিনিসটা, আমার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো।

 কি—কি ঠিক পেলে?

 প্রবঞ্চনা, প্রতারণা—হাঁ, ঠিক তাই। জানিনে ভালো ক’রে, তবু অনুভব করি—কর্তারা কোন একটা লীলা করছেন। আমি ওসব চাই নে। আমি চাই সত্য এবং সত্য কি তা’ আমি বেশ জানি। কর্তাদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলবনা আমি। আমি জানি, ওদের সুবিধার জন্য যখন দরকার হবে, তখন ওরা আমাকে সামনে ঠেলে দেবে, তারপর আমার হাড় মাড়িয়ে ওরা ওদের ঈপ্সিত স্থানে পৌঁছাবে।

 মা ব্যথিত সুরে বললেন, হা ভগবন, পেভেলরা কি তবে এ সব কথা বোঝেনা? না না, আমি এ বিশ্বাস করতে পারিনে। তাদের লক্ষ্য—সত্য, সম্মান, বিবেক···কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই তাদের।

 কাদের কথা বলছ, মা?

 সকলের কথা, প্রত্যেকের কথা। মানুষের রক্ত নিয়ে কারবার যারা করে, তারা সে মানুষ নয়।

 রাইবিন মাথা নীচু করে বলে, তারা না হতে পারে, মা, কিন্তু তাদের পেছনে তো এমন একদল লোক থাকতে পারে, যাদের উদ্দেশ স্বার্থসিদ্ধি—এমনি এমনি কেউ আর নিজেদের বিরুদ্ধে লোক ক্ষ্যাপায় না। তুমি আমার কথা ঠিক জেনে রেখো, মা, কর্তাদের কাছ থেকে কখনও কিছু ভালো পাওয়া যাবে না।

 মা ভয় পেয়ে বলেন, তা’ তোমার মতটা কি বলত?

 আমার মত! কতাদের কাছ থেকে তফাৎ থাকো, বাস— এইমাত্র!

 তারপর কিছুক্ষণ চুপ-চাপ থেকে ধীরে ধীরে বলে, আমি চ’লে যাচ্ছি, মা, লোকদের সঙ্গে গিয়ে মিশব, তাদের সঙ্গে কাজ করব। এ কাজের যোগ্য আমি। লিখতে পড়তে জানি, খাটতে পারি, বোকাও নই। আর সব চেয়ে বড়ো কথা, লোকদের কি বলতে হবে তা আমি জানি। জানি, কর্তাদের বিশ্বাস করা চলে না। জানি, মানুষের আত্মা আজ কলুষিত, বিদ্বেষ-বিষ-দুষ্ট, সবাই পেট বোঝাই করবার জন্য ব্যগ্র— কিন্তু খাবার কই? তাই তারা পরস্পর খাওয়া-খাওয়ি করে।···আমি যাবো গ্রামে···পল্লিতে···আর লোকদের জাগাবো। তাদের আজ নিজেদের হাতে কাজ নেওয়া দরকার, নিজেদের হাতে একাজ করা দরকার। তারা একবার বুঝুক, তারপর নিজেরাই নিজেদের পথ খুঁজে নেবে। আমি যাচ্ছি শুধু তাদের বোঝাতে, তাদের একমাত্র আশা তারা নিজেরা, তাদের একমাত্র বুদ্ধি তাদের নিজেদের বুদ্ধি, এই হচ্ছে সত্য।

 মা ধীরে ধীরে বলেন, তোমায় ধরবে ওরা।

 ধরবে, আবার ছেড়ে দেবে। আবার আমি এগিয়ে চল্‌বো।

 চাষীরাই তোমার বাঁধবে, তোমায় জেলে দেবে।

 দিক, কিছুকাল জেলে থেকে আবার বেরুব, আবার চলবো। চাষীরা একবার বাঁধবে, দু’বার বাঁধবে, তারপর তারা বুঝবে, আমাকে বাঁধা উচিত নয়, আমার বক্তব্য শোনা উচিত। আমি তাদের ডেকে বলবো, বিশ্বাস করতে বলেছিনে তোমাদের, শুধু কথাগুলো শোন। আমি জানি, তারা যখন শুনবে, তখন বিশ্বাস করবে।

 মা বলেন, তুমি মারা পড়বে, রাইবিন।

 রাইবিনের কালো গভীর চোখ দু’টো উজ্জ্বল হ’য়ে উঠলো। মার দিকে চেয়ে বললো, খৃস্ট বীজের সম্বন্ধে কি বলেছিলেন জানো: ‘তুমি মরবেনা, নতুন অঙ্কুরে জেগে উঠবে।’ আমি বিশ্বাস করিনে, আমি এতো সহজে মরবো। আমি বুদ্ধি রাখি, সোজা পথে চলি; কাজেই গতি আমার অপ্রতিহত। শুধু জানিনে, কেন আমার প্রাণে ব্যথা জাগে। হাঁ···আমি যাবো···তাড়িখানায় যাবো···লোকদের কাছে যাবো।···কিন্তু এণ্ড্রি কই? এখনো আসছেনা যে! এরি মধ্যে আবার কাজে লেগেছে বুঝি!

 হাঁ। জেল থেকে বেরুতে না বেরুতেই ওদের কাজ।

 এইতো চাই। তাকে আমার কথা বোলো।

 বলবো।

 এবার উঠি।

 কারখানার কাজ ছাড়বে কবে?

 ছেড়ে দিয়েছি তো!

 যাচ্ছ কখন?

 কাল ভোরে।

 রাইবিন চলে গেলো। মা একা বসে রইলেন। চারদিকে ঘন অন্ধকার। তার দিকে চেয়ে মা শিউরে উঠলেন, এই অন্ধকারের জীব আমি চিরজীবন।···

 এণ্ড্রি এলে মা রাইবিনের কথা বললেন। শুনে এণ্ড্রি নেচে উঠলো, যাচ্ছে?—চমৎকার! সত্যের ডঙ্কা বাজিয়ে যাক সে গ্রামে গ্রামে, লোকদের জাগিয়ে তুলুক,—আমাদের সঙ্গে এখানে থাকা তার পক্ষে কষ্টকর।

 মা বললেন, কর্তাদের কথা বলছিল সে। সত্যিই কি তাই? কর্তারা কি তোমাদের প্রবঞ্চিত করছেন না?

 এণ্ড্রি বললো, তাই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ বুঝি, মা?···তা’ যা’ বলেছে, টাকা নিয়েই যত গোলমাল। ওঃ, টাকা যদি থাক্‌তো, মা!···আমরা এখন আছি ভিখের ওপর···এইতো ধরো নিকোলাই, পঁচাত্তর রুবেল মাইনে পায়, তার পঞ্চাশ রুবেলই আমাদের দেয়। অন্যান্য সবাইও তাই। ছাত্ররা খেতে পায় না, তবুও একটি একটি ক’রে কোপেক জমিয়ে আমাদের পাঠায়। কর্তাদের কথা বলছিলে, হাঁ, তাদের মধ্যেও রকমফের আছে বৈকি! কেউ আমাদের ঠকাবে, ছেড়ে যাবে, আবার কেউ আমাদের সঙ্গে থাকবে, সেই উৎসব-দিবসে আমাদের সহযাত্রী হবে। সে উৎসব-দিবস···জানি তা দুরে, বহু দুরে। কিন্তু পয়লা মে আমরা একবার তার অনুষ্ঠান ক’রে আনন্দ করব।

 তার কথায়, তার আনন্দে মার মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর হয়। এণ্ড্রি ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতে লাগলো, তারপর আবার বললো, জানো, মা, প্রাণের মধ্যে মাঝে মাঝে এমন এক আশ্চর্য ভাব জাগে! যেখানে যাও, মনে হবে, সকল মানুষ তোমার কমরেড—সবার মাঝে একই আগুন দীপ্ত, সবাই আনন্দময়, সবাই ভালো। কথা নেই, অথচ সবাই সবাইকে বোঝে। কেউ কাউকে বাধা দিতে চায় না, অপমান করতে চায় না, তার আবশ্যকও বোধ করে না। সবাই একতাবদ্ধ, প্রত্যেকটি প্রাণ গায় তার নিজের গান। সমস্ত গানের তরঙ্গ সম্মিলিত হ’য়ে প্রবাহিত হয় এক বিশাল, বিরাট, মুক্ত-স্রোতা আনন্দের নদী। যখন তুমি এই কথা ভাববে, মা, যখন ভাববে, এ হ’বে, এ না হ’য়ে পারে না, তখন বিস্ময়বিমুগ্ধ প্রাণ আনন্দে গলে যাবে। এতো আনন্দ যে, তা’ তুমি সামলাতে পারবে না, চোখ সজল হ’য়ে উঠবে।···কিন্তু এ স্বপ্ন হ’তে যখন জেগে উঠবে, যখন সংসারের দিকে চাইবে, দেখবে সব-কিছু তোমার চারপাশে ঠাণ্ডা, নোঙরা,—সবাই শ্রান্ত, ক্ষুধার্ত, কর্মব্যস্ত সংসারের চল্‌তি পথে মানবজীবন কাদার মতো মথিত হচ্ছে, পদদলিত হচ্ছে।···হাঁ···ব্যথা পাবে সন্দেহ নেই, কিন্তু তবু তোমায় মানুষকে অবিশ্বাস করতে হবে, ভয় করতে হবে, ঘৃণা করতে হবে। মানুষ বিভক্ত, জীবন মানুষকে দু’টুক্‌রো করে রেখেছে। তুমি তাকে ভালোবাসতে চাইবে, কিন্তু কি ক’রে বাসরে? কি ক’রে ক্ষমা করবে সে মানুষকে, যে তোমায় আক্রমণ করছে বন্য পশুর মতো। বুঝছেনা যে তোমার মধ্যেও একটা আত্মা আছে, তোমার মুখে—মানুষের মুখে আঘাত দিচ্ছে। তুমি ক্ষমা করতে পারোনা—তোমার নিজের কথা ভেবে নয়, মানবজাতির কথা ভেবে। নিছক ব্যক্তিগত অপমান আমি ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু অত্যাচারীকে অপমান করার আস্কারা দিতে পারি না, মানুষকে মারার, হাত পাকাবার জন্য আমার পিঠ পেতে দিতে পারি না।···

 মা চুপ করে শুনতে থাকেন। এণ্ড্রির চোখ জ্বলছে। দৃঢ়কণ্ঠে সে বলতে লাগলো, নোঙরা যা’ তা’ আমাকে আঘাত না দিলেও তাকে আমি ক্ষমা করবোনা। আমি একা নই দুনিয়ায়। আজ যদি আমি আমাকে অপমানিত হতে দিই—হয়তো আমি তাকে হেসে উড়িয়ে দিতে পারি, গায়ে না মাখতে পারি, কিন্তু অপমানকারী যে, সে আজ আমার ওপর শক্তি পরীক্ষা ক’রে বর্ধিত-স্পর্ধায় কাল আর একজনের পিঠের চামড়া তুলবে। এই জন্যই আমরা বাধ্য হই, মানুষে মানুষে তফাৎ করতে— যারা অত্যাচারী তাদের দূরে রাখতে, যারা সত্যের জন্য লড়াই করছে তাদের আপনার বলে টেনে নিতে।···বিপদই হচ্ছে এইখানে। দু’রকম চোখ নিয়ে তোমার দেখতে হবে, দু’রকম প্রাণ নিয়ে তোমায় অনুভব করতে হ’বে,—একটা বলে, সবাইকে ভালোবাসো, আর একটা বলে, হুঁসিয়ার, ও তোমার দুশমন। কেন? কারণ এটা অদ্ভুত হলেও সত্য যে, মানুষ আজও এক-সমতলে দাঁড়িয়ে নেই। মানুষের মধ্যে সাম্য আনতে হ’বে আমাদের, সকল মানুষকে এক সারিতে দাঁড় করাতে হবে আমাদের, মাথা দিয়ে বা হাত দিয়ে মানুষ যতকিছু সুখ-সুবিধার সৃষ্টি করেছে সব আজ নিখিল মানুষের মধ্যে সমান ভাবে বেঁটে দিতে হবে। মানুষকে আর পরস্পরের ভয়ের এবং হিংসার গোলাম, লোভের এবং বোকামির দাস ক’রে রাখবোনা।

 এমনি কথাবার্তা প্রায়ই চলতো মা এবং এণ্ড্রির মধ্যে। পড়াও চললো মার। চোখ তাঁর ক্ষীণদৃষ্টি। এণ্ড্রি বললো, আসছে রববার শহরে নিয়ে গিয়ে তোমার চশমা কিনে দেব।

 তিন-তিনবার মা জেলে পেভেলের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, কিন্তু পারেন নি। জেলের কর্তা অতিরিক্ত বিনয়ের সঙ্গে, ‘এখন হবে না, এই আসছে হপ্তায়’ বলে ফিরিয়ে দিয়েছে। মা এণ্ড্রিকে বললেন, খুব নম্র কিন্তু লোকটা।

 এণ্ড্রি হেসে বললে, হাঁ, বিনয়ের অভাব নেই, হাসিরও অভাব নেই। ওদের যদি বলা হয়, দেখো, এই লোকটা সাধু, জ্ঞানী, কিন্তু ও থাকলে আমাদের বিপদ। ওকে ফাঁসিতে লটকাও। বাস, আর কথা নেই। ওরা হাসতে হাসতে তাকে ফাঁসিতে লটকাবে, এবং ফাঁসিতে লটকিয়ে ওরা হাসতে থাকবে।

 মা বললেন, কিন্তু আমাদের ওখানে যে লোকটি খানাতল্লাশী করতে গিয়েছিল সে একটু ভাল।

 এণ্ডি বললো, মানুষ ওরা কেউই নয়, মা। মানুষকে আঘাত দেবার,. অভিভুত করার, তাকে রাষ্ট্রের চাহিদা মতো গড়ে নেবার যন্ত্র ওরা। কর্তারা যেমন খুশি ওদের চালান। ওরা না ভেবে, কেন, কি দরকার এ প্রশ্ন না ক’রে কর্তাদের হুকুম তামিল করে যায়।

 অবশেষে মা একদিন ছেলের দেখা পেলেন। অনেক কথা হলো। মা শেষটা বললেন, কবে ছেড়ে দেবে তোকে? কেন জেল হ’ল তোর? ইস্তাহার তো আবার বেরিয়েছে কারখানায়।

 পেভেলের চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বেরিয়েছে? কবে? কতো?

 রক্ষী বাধা দিয়ে বললো, ওসব কথা বলা নিষেধ, পারিবারিক কথা বলো। অগত্যা পেভেল বললো, তুমি এখন কি করছ, মা? মা ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠে বলেন, আমিই কারখানায় এইসব বয়ে নিয়ে যাই —টক, ঝোল, খাবার...

 পেভেল বুঝলো।— চাপা হাসির বেগে তার মুখের শিরাগুলো কাঁপতে লাগলো। বল্‌লো, তা হ'লে একটা ভালো কাজ পেয়েছ তুমি, মা। সময় তোমার মন্দ কাটছেনা।

 মা বলেন, ইস্তাহার বেরুবার পর আমাকেও খুঁজে দেখেছিল।

 রক্ষী বল্‌লো, আবার ঐ কথা।

 এম্‌নি করে সময় উত্তীর্ণ হল। মা-ছেলে চোখের জলের মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্ন হলেন, বিদায় নিলেন।

 বাড়ি এসে মা এণ্ডিকে বলেন, আচ্ছা এণ্ডি, ওরা কেমন ক'রে পারে, বলতো? আমার তো পেভেলের জন্য মুখে অন্ন রোচে না। আর ওরা দেখি ছেলেদের জেলে পাঠিয়ে দিব্যি আছে, খায়-দায়, হাসি-গল্প করে, যেন কিছুই হয়নি।

 এণ্ড্রি বল্‌লো, এইটেই তো স্বাভাবিক। আইন আমাদের ওপর যতটা কড়া, ওদের ওপর ততটা নয়। আর আমাদের চাইতে আইনের দরকারও ওদের বেশি। এইজন্যেই আইন যখন ওদের নিজেদের মাথায় ঘা দেয়, ওরা কাঁদলেও জোরে কাঁদেনা—নিজের লাঠি নিজের মাথায় পড়লে তত লাগেনা! ওদের কাছে আইন রক্ষা-কর্তা, আর আমাদের কাছে আইন শৃঙ্খল—যা’ আমাদের হাত-পা বেঁধে পঙ্গু, দুর্বল ক’রে রেখেছে, আমাদের আঘাত দেবার শক্তি লোপ করেছে।

 দিন তিনেক পরে নিকোলাই কারামুক্ত হয়ে পেভেলদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ঘরে আলো দেখতে পেয়ে সে এসে ঢুকলো, বলো, আমি সোজা জেল থেকে আসছি, মা।

 তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত, দৃষ্টি বিষণ্ণ, সন্দিগ্ধ! মা কোনদিনই তাকে পছন্দ করতেন না, কিন্তু আজ এই ছেলেটির দিকে চেয়েও কেমন এক দরদে তাঁর প্রাণ ভরে গেলো, বল্‌লেন, শুকিয়ে আধখানা হ’য়ে গেছিস যে, বাবা! দাঁড়া, চা করে দিচ্ছি।

 এণ্ড্রি রান্নাঘর থেকে ব’লে উঠলো, আমিই কচ্ছি চা!

 মা তখন বলেন, ফেদিয়া মেজিন কেমন আছে রে? কবিতা লিখছে, না?

 নিকোলাই মাথা নেড়ে বলে, হাঁ, কিন্তু আমি ছাই কিছু বুঝিনা তা’। একটা খাঁচায় রেখেছে তাকে, আর সে গান করছে। একটা জিনিস আমি খাঁটি বুঝেছি—আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার।

 মা সমবেদনার সুরে বলেন, ইচ্ছে থাকবে বা কেন! কিসের, মায়ায় সে শূন্যপুরীতে যাবি?

 নিকোলাই বললো, সত্যিই শূন্যপুরী, মা। শুধুই পোকা-মাকড়ের বাসা। এখানে আজকের রাতটা থাকতে পারি, মা?

 মা বলেন, ছেলে মার কাছে থাকবে তারও কি আবার অনুমতি নিতে হয়, বাবা!

 নিকোলাই আপন মনে কত কি ব’লে চলে। এণ্ড্রি রান্নাঘর থেকে আসতে তার মুখের দিকে চেয়ে বলে, আমার মনে হয়, এমন কতকগুলো লোক আছে, যাদের মেরে ফেলা উচিত।

 এণ্ড্রি গম্ভীরভাবে বললো, তাই নাকি! কিন্তু কেন শুন্‌তে পারি কি?

 যাতে তারা চিরদিনের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

 বটে! কিন্তু জ্যান্ত লোকগুলোকে ঠাণ্ডা করার অধিকার তোমায় কে দিলে?

 দিয়েছে তারা নিজেরা।······তারা যদি আমায় আঘাত দেয়, আমার অধিকার আছে জবাবে তাদের আঘাত করার, তাদের চোখ উপ্‌ড়ে ফেলার। আমায় ছুঁয়ো না, আমিও তোমায় ছোঁব না। আমায় যেমন খুশি চলতে দাও, আমি চুপ-চাপ থাকবো, কাউকে ছোঁবও না। হয়তো বনে চ’লে যাবো, নদী-তীরে কুঁড়ে বেঁধে একা থাকবো।

 এণ্ড্রি বললো, যাও না, খুশি হয় তাই গে থাকো।

 এখন?···নিকোলাই ঘাড় নেড়ে বলে, এখন তা অসম্ভব।

 কেন? অসম্ভব কেন? আটকাচ্ছে কে তোমায়?

 আটকাচ্ছে মানুষ। আমরণ তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে হ’বে আমায়—অন্যায় এবং ঘৃণার বাঁধনে। শক্ত সে বাঁধন! আমি তাদের ঘৃণা করি, তাই তাদের ছেড়ে যাবো না। তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াবো, তাদের জ্বালিয়ে মারবো আজীবন। তারা আমার শত্রুতা করেছে, আমিও তাদের শত্রুতা করব! কৈফিয়ৎ যদি দিতে হয় তো দেব আমার নিজের কাজের কৈফিয়ৎ। আমার বাবা বদি চোর হয়··· বলতে বলতে থেমে গেলো নিকোলাই। তারপর হঠাৎ উষ্ণ হ’য়ে ব’লে উঠলো, আইছে-গবর্ভব ব্যাটার মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব, দেখে নিয়ো।

 এণ্ড্রি ব্যগ্র-কৌতূহলে বললো, কেন বলো তো?

 ব্যাট। স্পাই, লোকের সর্বনাশ ক’রে বেড়াচ্ছে। ব্যাটার জন্য আজ আমার বাবা পর্যন্ত স্পাই হবার মতলব করছেন।

 এণ্ড্রি বুঝলো, নিকোলাইর প্রাণে কী মর্মন্তুদ ব্যথা, কী অসহ্য যাতনা—এর সান্ত্বনা নেই। যুক্তিতে এ প্রশমিত হয় না, শুধু বললো, ভাই, আমরাও ভুক্তভোগী, আমরাও একদিন অমনি ক’রে ভাঙা কাঁচ মাড়িয়ে রক্তাক্ত পদে চলেছি জীবন-পথে, অন্ধকারে আমরাও অমনি আলোর জন্য হা-হা করেছি।

 নিকোলাই বললো, তুমি আমায় বোঝাতে চেয়ো না, বন্ধু, বোঝাবার কিছু নেই। আমার বুকে হাত দিয়ে দেখো—মনে হচ্ছে যেন ক্ষুধার্ত ক্রুদ্ধ নেকড়ের দল গর্জন করছে।

 এণ্ড্রি বলে, একদিন এ দূর হ’বে—সম্পূর্ণভাবে না হলেও, হবে। শিশুর হামের মতো এও মানুষের একটা ব্যাধি। সবাই আমরা এতে ভুগি। যারা শক্তিমান্ তারা ভোগে বেশি। যারা দুর্বল, তারা ভোগে কম। এ ব্যাধি কখন আসে, জানো? যখন মানুষ নিজেকে চিনেছে কিন্তু জীবনের পূর্ণ পরিচয় পায়নি, জীবন-যাত্রায় নিজের স্থান খুঁজে পায়নি। তা না পেয়ে নিজের দামও কষতে পারেনি। তখন তার কেবলই মনে হয়, দুনিয়ার বুকে অপূর্ব চিজ সে, কেউ তাকে মাপতে পারে না কেউ তার দাম তলিয়ে দেখে না, সবাই চায় তাকে হজম ক’রে ফেলতে। পরে সে বুঝতে পারে, অন্যান্য বহু মানুষের মধ্যে যে প্রাণ তাও তারই মতো···তখন থেকে তার মন নরম হ’তে থাকে, ব্যাধি উপশম হ’তে থাকে। লজ্জা জাগে, বোঝে যে, মন্দিরশীর্ষে উঠে একা নিজের ঘণ্টাটি বাজিয়ে লোককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা বৃথা—মন্দিরের বড় ঘণ্টা তার ক্ষুদ্র ঘণ্টাধ্বনিকে ডুবিয়ে দিয়ে বেজে উঠে। বড় ঘণ্টার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাগতে হ’লে চাই ছোট ছোট ঘণ্টাগুলির একত্র সম্মিলন। আমি কি বলতে চাচ্ছি, বুঝতে পাচ্ছ নিকোলাই?

 হাঁ, কিন্তু বিশ্বাস করি না।


 খাবার এলো। খেতে খেতে এণ্ড্রি নিকোলাইকে বোঝাতে লাগলো, কারখানায় কেমন ভাবে সোশিয়ালিস্ট মতবাদ প্রচারিত হয়েছে। নিকোলাই সব শুনলো, তার মুখ আবার গম্ভীর হয়ে উঠলো, বললো, বড্ডো ধীরে চলছে কাজ, বড্ডো ধীরে। আরও তাড়াতাড়ি হলে ভালো হয়।

 এণ্ড্রি বলে, মানুষের জীবনটা তো ঘোড়া নয়, নিকোলাই, যে, চাবুক ক’ষে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে।

 নিকোলাই সেই একই সুরে বলতে লাগলো,···কিন্তু বড্ডো ধীরে, ধৈর্য থাকে না আমার। কি করি, কি করি! তার অঙ্গভঙ্গিতে গভীর নৈরাশ্য ফুটে ওঠে।

 এণ্ড্রি বলে, আমরা করব জ্ঞান লাভ এবং জ্ঞান বিস্তার।

 যুদ্ধ করব কবে? নিকোলাই সহসা প্রশ্ন করলো।

 এণ্ড্রি হেসে বলে, যুদ্ধ কখন করতে হবে তা জানি না, কিন্তু এটা জানি যে তার আগে আমাদের বহু প্রাণ আহুতি দিতে হবে, জানি যে, হাতের ছুরি শানাবার আগে শানাতে হবে মগজের বুদ্ধিকে।

 এবং প্রাণকে—নিকোলাই যোগ করে।

 হাঁ, প্রাণকেও।

 কিছু পরে নিকোলাই উঠে শুতে গেলো। মা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ওর মনের মধ্যে কী একটা ভীষণ চক্রান্ত ঘুরছে, এণ্ড্রি।

 হাঁ, মা, ওকে বোঝা বড়ো শক্ত, ব’লে এণ্ড্রিও বিছানায় গেলো। শুনতে পেলো, মা বলছেন, ভগবন্, পৃথিবীর যত মানুষ সবাই তো দেখছি কাঁদছে নিজ নিজ ব্যথায়। কোথায় মানুষ সুখী, কোথায় মানুষ আনন্দিত?

 এণ্ড্রি বললো, আসচে, মা, সে শুভদিন আসচে, যে-দিন মানুষ সুখী হবে, আনন্দিত হবে।···