মিবাররাজ/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 বিকাল বেলা, একলিঙ্গদেবের মন্দিরের পশ্চাতে একটা উচ্চ প্রশস্ত ভূমিতে পশ্চিমের এক খণ্ড লাল মেঘের আলোর মধ্যে দাঁড়াইয়া একটী বালিকা ভীল গ্রামের দিকে উৎসুক নেত্রে চাহিয়াছিল। হঠাৎ আকাশের সেই লাল মেঘখানার মত তাহার মুখখানি হাসি হাসি হইয়া উঠিল, সে তাড়াতাড়ি পাশের কামিনী গাছের ঝোপের আড়ালে আসিয়া দাঁড়াইল। একটু পরেই গুহা নদীর ধার দিয়া সেই উচ্চ ভূমিতে আসিয়া দিদি দিদি করিয়া ডাকিতে ডাকিতে চারিদিকে তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল, অবশেষে কামিনী গাছের কাছে আসিয়া তাহার চোখ টিপিয়া ধরিল বলিল—“কেমন জব্দ” —দিদি খিল খিল করিয়া হাসিয়া চোখ ছাড়াইয়া লইয়া তাহার দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইল, তাহার নূতন বেশ দেখিয়া বলিল—

 “এ কি গুহা, একি ভাই?”

 গুহা হাসিয়া বলিল “রাজবেশ। দেখছিস কি আমি রাজা হয়েছি”

 “আমরি কি রাজ বেশেরই শ্রী।”

 বালিকা হাসিয়া বঁচিল না। হাসিটা শেষ হইলে গুহার সাজটা ভালরূপে নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিল—

 “গুহা সত্যি যদি তুই রাজা হ’স! এই ঘাসের মুকুটটা তাহলে সোনার মুকুট হয়ে পড়বে? এই সুন্দর দুধের শরীর জরির পোষাকে এঁটে চারি পাশের লোকজনের মধ্যে সোনার সিংহাসনে গ্রামভারী চালে বসে থাকবি? ওমা সে কি বিশ্রী”!

 সে চেহারাটা সত্যবতীর বড়ই খারাপ লাগিল, চেহারাটাকে একেবারে ধ্যাঁচ করিয়া দিবার অভিপ্রায়ে আরো বার দুই তিন ধরিয়া ক্রমাগত সে ছিছি করিয়া উঠিল কিন্তু তাহাতেও মন না উঠায় শেষে গুহাকে আদর করিয়া, তাহার খালি বুকে আস্তে আস্তে হাত বুলাইতে বুলাইতে আবার বলিল “এ আমাদের কেমন গুহা, ছি সে কি বিশ্রী?” ইহার পর সে চেহারা খানির ভাল হইবার আর কোনই যেন সম্ভাবনা রহিল না।

 কিন্তু গুহা বলিল “কেন বিশ্ব কেন! আমি রাজা হব তুই রাজার বোন হবি, মা রাজার মা হবেন সে কি বিশ্রী হল?”

 দিদি বলিল “তা রাজা হয়ে যদি তুই আমাদের ভুলে যাস? এইত স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ রাজা হয়ে যশোদাকে ভুলে গিয়েছিলেন।”

 বুঝি এই আশঙ্কাতেই গুহার রাজমূর্ত্ত টা সত্যবতীর এত থারাপ লাগিয়াছিল। এ কথায় গুহার হাসিমুখ গোমসা হইয়া গেল, সে বলিল।

 “কি এক ঠাট্টা! ও কথা আমার একটুও ভাল লাগেনা।”

 দিদি হাসিয়া গুহর দুই গাল ধরিয়া টিপিয়া দিল, তাহার পর মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিল “যেমন ভাই তেমনি বোন? তুই রাজাও হলি, আর আমাদের ভুলেও গেলি”?

 গুহা গম্ভীরভাবে বলিল “সত্যিই আমি রাজা হইয়াছি। ভীলরাজ তার রাজ্য আজ হইতে আমাকে দিয়াছেন।”

 সে সংক্ষেপে তখন সমস্ত ঘটনা বলিয়া গেল। বালিকার মুখ হঠাৎ কেমন মলিন হইয়া পড়িল, চোখ ছল ছল করিয়া উঠিল, তাহার চোখের জলের কুয়াশায় গুহার মাথার ঘাসের মুকুট, গলার পাতার মালা, কপালের রক্ত ফোঁটা, হাতের রাজদণ্ড ক্রমশ স্ফীত হইতে হইতে গুহার আকৃতি খানি তাহার মধ্যে অতি ক্ষুদ্র হইয়া পড়িল, ক্রমে অস্পষ্ট হইয়া গেল, ঢাকিয়া যাইতে লাগিল, শেষে একেবারে মিলাইয়া গেল, —সত্যবতী চমকিয়া চোখের পাতা বন্ধ করিয়া আবার চোখ খুলিয়া গুহার দিকে চাহিল, আস্তে আস্তে বলিল

 “গুহা তুই রাজা হইয়াছিস, হয়ত আমাদের মত দীন হীন লোক আর তোর আপনার থাকিবে না। যদি তাই হয়—হোক; কিন্তু আশীর্ব্বাদ করি সুখে থাক; রামের মত ন্যায়বান হইয়া প্রজা পালন কর।”

 গুহা ব্যথিত করুণ দৃষ্টিতে দিদির দিকে চাহিয়া বলিল “দিদি আমি কি এত অবিশ্বাসের কাজ করেছি —যে আমার স্নেহ মমতার উপর তোমার এই সন্দেহ—”

 বালিকা কষ্টের স্বরে বলিল “সন্দেহ! না ভাই—কিন্তু সত্যি যদি”

 কি বলিতে গিয়া বাধিয়া গেল, যুবক ব্যথিত হইয়া বলিল “সন্দেহ না—আমি সত্যই তোমাদের পর করিব?”

 বালিকা বলিল “না না তা বলিতেছি না। আমি বলিতেছি তুই পর না করিলেও লোকেত পর বলিতে পারে—”

 গুহা আশ্চর্য্য হইল, ক্রুদ্ধ হইল, গুহা রাজা হইয়াছে বলিয়া তাহার আপনার লোককে লোকে তাহার পর বলিবে? সে রোষকম্পিত স্বরে আরক্তিম লোচনে বলিল—“লোকে তোমাদিগকে পর বলিবে?”

 কটীর বাণফলকে তাহার হাত পড়িল, বলিল—

 “যদি আমি মানুষ হই ত এতদিন এই যে বাণ পশুবক্ষ বিদ্ধ করিয়াছে সে দিন ইহা সেই হতভাগ্যের শোণিত পান করিবে”

 সত্যবতী বলিল “কিন্তু যদি—সত্যি”—

 হঠাৎ থামিয়া গেল, কামিনীগাছের ঝোপের ওপিঠ হইতে দুইটা চক্ষু তাহার চোখে পড়িল—এস্তে সে বলিল

 “কে আসিয়াছে?” গুহা সেই দিকে চাহিয়া বলিল— “কেও”

 উত্তর হইল “মুইডা তালগাছ” ভীলপুত্র কিছু বেশী রকম লম্বা ছিল বলিয়া উহাকে সবাই বলে তালগাছ।

 যুবক বলিল “তুই ডা এখন এখানে যে?”

 ‘ভীল পুত্র বলিল “কথাডা আছে এ দিকে আয় যুবক বলিল “একটু পরে শুনিব—এখন যা”

 সে বলিল “উঁহু” তা হইবু না—এদিকে আয়’

 সত্যবতী বুঝিলেন তাহার সাক্ষাতে সে বলিতে চাহে, আর তিনিও নির্জ্জনে গিয়া একবার প্রাণ খুলিয়া কাঁদিবার অবসর খুঁজিতেছিলেন,—যে কথা গুহাকে বলিতে চান তাহা বলিবার আগে, একাকী কাঁদিয়া সবল হইবার ইচ্ছা করিতেছিলেন। সত্যবতী আস্তে আস্তে চলিয়া গেলেন, গুহা ঝোপ ঘুরিয়া তালগাছের কাছে আসিয়া দাড়াইল।