বিষয়বস্তুতে চলুন

মিবার-গৌরব-কথা/অটল প্রতিজ্ঞা

উইকিসংকলন থেকে

অটল প্রতিজ্ঞা।

যে বংশে মহাত্মা চণ্ড জন্মগ্রহণ করিয়া মিবারের ইতিহাসে আত্মত্যাগের অপূর্ব্ব দৃষ্টান্ত দেখাইয়া গিয়াছেন; সেই বংশেই আর একজন রাজকুমার পিতার মনস্তুষ্টির জন্য স্বেচ্ছায় জন্মভূমি হইতে চিরনির্ব্বাসিত হইয়াছিলেন। তিনি মিবার-রাজ রাণা রাজসিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র ভীম সিংহ। রাজপুতের রসনা হইতে একবার যে বাক্য উচ্চারিত হইত প্রাণান্তেও তাহার বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম হইত না। রাজপুতের প্রতিজ্ঞা অটল প্রতিজ্ঞা।

 সেকালে রাজপুত বংশে পুত্র ভূমিষ্ঠ হইলে পিতা সন্তানের হস্তে অমরধব নামে এক প্রকার তৃণের বলয় পরাইয়া দিতেন। পিতা এইরূপ বলয় পরাইয়া দিলে, পুত্রের আর কোন অমঙ্গল হইবে না এইরূপ বিশ্বাস ছিল। ভীমসিংহের পিতা রাজসিংহের অনেক রাণী ছিলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে একজনকে রাণা রাজসিংহ অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। ভীম যখন ভূমিষ্ঠ হয় তাহার অল্পক্ষণ পরেই রাজসিংহের সেই প্রিয়তমা রাণীরও একটি পুত্র ভূমিষ্ঠ হইল। রাণা একেবারে দুই পুত্রের জন্ম সংবাদ পাইলেন। তিনি একগাছি অমরধব লইয়া পুত্রের মুখ দেখিতে গেলেন এবং যদিও ভীম অগ্রে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল, তথাপি সেই প্রিয়তমা রাণীর পুত্রের হস্তে অমরধব পরাইয়া তাহার মুখে চুম্বন দিয়া তাহাকে কোলে লইলেন। সেইক্ষণ হইতে কনিষ্ঠ ভ্রাতা জয়সিংহ পিতার আদর যত্নের অধিকারী হইল। অভাগা ভীম জন্মাবধি পিতৃস্নেহে একপ্রকার বঞ্চিত ছিল। দেখিতে দেখিতে শােভায়, সৌন্দর্য্যে, বীরদর্পে ভীম পূর্ণাবয়ব হইয়া উঠিল। জয়সিংহও বীরশিশু; কিন্তু ভীম সকল বিষয়েই তাহা হইতে শ্রেষ্ঠ একথা সকলেই বুঝিত, কেবল পিতা রাজসিংহ বুঝিতেন না। যদি বা তাহাদিগের পার্থক্য বুঝিতে পারিতেন, তবে মনে মনে ভীমের সকল শ্রেষ্ঠতা জয়সিংহ কেন পাইল না বলিয়া ক্ষুব্ধ হইতেন! কিন্তু পাছে জয়সিংহের প্রতি তাঁহার এত স্নেহ দেখিয়া ভীমের হিংসা হয় এই ভয়ে সর্ব্বদা সাবধান থাকিতেন। তাঁহার মনে সর্ব্বদাই চিন্তা, সর্ব্বদাই আতঙ্ক হইত যে তাঁহার মৃত্যুর পর দুই ভ্রাতা রাজ্য লইয়া ঘোর বিবাদ করিয়া মিবার ভূমি শ্মশান করিবে। ভীমসিংহের হস্তে হয় ত জয়সিংহ প্রাণ হারাইবে! কিন্তু কি উপায় করিবেন কিছুই বুঝিতে পারিতেন না। একদিন ভাবিতে ভাবিতে তাঁহার হৃদয় এমন উত্তেজিত হইয়া উঠিল যে তিনি পুত্রদ্বয়কে তৎক্ষণাৎ নিকটে ডাকিলেন। তখন তাহারা আর বালক নয়, যৌবনের কান্তিতে দুজনেই পরম সুন্দর। বীর ভীম পিতার চরণ বন্দনা করিয়া বক্ষ স্ফীত করিয়া দাঁড়াইল।

 পিতা দুজনের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ভীম তুমি একদিন মিবারের রাণা হইবে, এই আশা যদি হৃদয়ে পোষণ কর, তবে এই তরবারি দিতেছি আমার সাক্ষাতেই ভ্রাতার প্রাণবধ কর। ভবিষ্যতে যেন ইহার রক্তে এবং বীরগণের রক্তে মিবার ভূমি কলঙ্কিত না হয়।” ভীমের বড় বড় উজ্জ্বল চক্ষু দুইটী জ্বলিয়া উঠিল, তিনি পিতার দিকে চাহিলেন দেখিলেন গভীর আবেগে পিতার দেহ কাঁপিতেছে। ভ্রাতার দিকে চাহিয়া দেখিলেন, সেও পিতার মুখের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া আছে! ভীমের চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল! তিনি গদ্গদ স্বরে বলিলেন, “মহারাজ! স্থির হউন! পিতঃ আপনি ব্যথিত হইবেন না। আজ আপনার চরণ স্পর্শ করিয়া বলিতেছি, মিবার সিংহাসনের আশা আমি জন্মের মত বিসর্জ্জন দিলাম। আমি ভ্রাতার কেশ এ হস্তে স্পর্শ করিব না। জয়সিংহই রাণা হইবে। সে আপনার দেহের অধিকারী; দুর্ভাগা আমি চিরদিনই আপনার হৃদয় হইতে নির্ব্বাসিত। আজ আপনার রাজ্য এই পবিত্র মিবার ভূমিও ত্যাগ করিয়া যাইব। জন্মভূমি ত্যাগ না করিয়া আমি জলস্পর্শ করিব না। দুঃখিনী জননী রহিলেন দয়া করিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা দিবেন।” এই বলিয়া পিতার চরণ ধূলি মস্তকে লইয়া ভীমসিংহ আপনার অশ্বটি আনিয়া লম্ফপ্রদান পূর্ব্বক তাহাতে আরোহণ করিয়া, চিরদিনের মত মিবার রাজ্য ত্যাগ করিয়া চলিলেন। তখন দারুণ গ্রীষ্মকাল, পথে ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত্ত হইয়া এক নদীতটে বসিলেন। জল পান করিবেন এমন সময় পিতার নিকট প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ হইল,—অমনি একলম্ফে ঘোড়ায় উঠিলেন, এবং মিবার রাজ্যের সীমা পার হইয়া তবে জল পান করিয়া প্রাণ রক্ষা করিলেন।—যতদিন জীবিত ছিলেন ভীম আর মিবার রাজ্যে পদার্পণ করেন নাই—সুদুর কাবুলে তাঁহার মৃত্যু হয়।