বিষয়বস্তুতে চলুন

মৃণালিনী (১৮৭৪)/চতুর্থ খণ্ড/পরিশিষ্ট

উইকিসংকলন থেকে

পরিশিষ্ট।

―――

 হেমচন্দ্র মনোরমার দত্ত ধন উদ্ধার করিয়া তাহার কিয়দংশ জনার্দ্দনকে দিয়া তাঁহাকে কাশী প্রেরণ করিলেন। অবশিষ্ট ধন গ্রহণ কর্ত্তব্য কি না, তাহা মাধবাচার্য্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন। মাধবাচার্য্য বলিলেন, “এই ধনের বলে পশুপতির বিনাশকারী বখ্‌তিয়ার খিলিজিকে প্রতিফল দেওয়া কর্ত্তব্য। এবং তদভিপ্রায়ে ইহা গ্রহণও উচিত। দক্ষিণে, সমুদ্রের উপকূলে অনেক প্রদেশ জনহীন হইয়া পড়িয়া আছে। আমার পরামর্শ যে তুমি এই ধনের দ্বারা তথায় নূতন রাজ্য সংস্থাপন কর, এবং তথায় যবনদমনোপযোগী সেনা সৃজন কর। তৎসাহায্যে পশুপতির শত্রুর নিপাত সিদ্ধ করিও।”

 এই পরামর্শ করিয়া মাধবাচার্য্য সেই রাত্রেই হেমচন্দ্রকে নবদ্বীপ হইতে দক্ষিণাভিমুখে যাত্রা করাইলেন। মৃণালিনী, গিরিজায়া এবং দিগ্বিজয় তাঁহার সঙ্গে গেলেন। মাধবাচার্য্যও হেমচন্দ্রকে নূতন রাজ্যে স্থাপিত করিবার জন্য তাঁহার সঙ্গে গেলেন। রাজ্যসংস্থাপন অতি সহজ কাজ হইয়া উঠিল, কেননা যবনদিগের ধর্ম্মদ্বেষিতায় পীড়িত এবং তাহাদিগের ভয়ে ভীত হইয়া অনেকেই তাহাদিগের অধিকৃত রাজ্য ত্যাগ করিয়া হেমচন্দ্রের নবস্থাপিত রাজ্যে বাস করিতে লাগিল। মাধবাচার্য্যের পরামর্শেও অনেক প্রধান ধনী ব্যক্তি তথায় আশ্রয় লইল। এইরূপ অতি শীঘ্র ক্ষুদ্র রাজ্যটী সৌষ্ঠবান্বিত হইয়া উঠিল। ক্রমে ক্রমে সেনা সংগ্রহ হইতে লাগিল। অচিরাৎ রমণীয় রাজপুরী নির্ম্মিত হইল। মৃণালিনী তন্মধ্যে মহিষী হইয়া সে পুরী আলো করিলেন।

 গিরিজায়ার সহিত দিগ্বিজয়ের পরিণয় হইল। গিরিজায়া মৃণালিনীর পরিচর্য্যায় নিযুক্তা রহিলেন, দিগ্বিজয় হেমচন্দ্রের কার্য্য পূর্ব্ববৎ নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। কথিত আছে যে বিবাহ অবধি এমন দিনই ছিল না, যেদিন গিরিজায়া এক আধ ঘা ঝাঁটার আঘাতে দিগ্বিজয়ের শরীর পবিত্র করিয়া না দিত। ইহাতে যে দিগ্বিজয় বড়ই দুঃখিত ছিলেন এমত নহে। বরং একদিন কোন দৈবকারণ বশতঃ গিরিজায়া ঝাঁটা মারিতে ভুলিয়া ছিলেন, ইহাতে দিগ্বিজয় বিষণ্ণ বদনে গিরিজায়াকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “গিরি, আজি তুমি আমার উপর রাগ করিয়াছ না কি?” বস্তুতঃ ইহারা যাবজ্জীবন পরমসুখে কালাতিপাত করিয়াছিল।

 হেমচন্দ্রকে নূতন রাজ্যে স্থাপন করিয়া মাধবাচার্য্য কামরূপে গমন করিলেন। তথায় হেমচন্দ্রের সাহায্যে বখতিয়ার খিলিজি পরাভূত হইয়া দূরীকৃত হইলেন। এবং প্রত্যাগমন কালে অপমানে ও কষ্টে তাঁহার প্রাণবিয়োগ হইল। কিন্তু সে সকল ঘটনা বর্ণিত করা এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে।

 রত্নময়ী এক সম্পন্ন পাটনীকে বিবাহ করিয়া হেমচন্দ্রের নূতন রাজ্যে গিয়া বাস করিল। তথায় মৃণালিনীর অনুগ্রহে তাহার স্বামীর বিশেষ সৌষ্ঠব হইল। গিরিজায়া ও রত্নময়ী চিরকাল “সই” “সই” রহিল।

 মৃণালিনী মাধবাচার্য্যের দ্বারা হৃষীকেশকে অনুরোধ করাইয়া মণিমালিনীকে আপন রাজধানীতে আনিলেন। মণিমালিনী রাজপুরীমধ্যে মৃণালিনীর সখীর স্বরূপ বাস করিতে লাগিলেন। তাঁহার স্বামী রাজবাটীর পৌরহিত্যে নিযুক্ত হইলেন।

 শান্তশীল যখন দেখিল, যে হিন্দুর আর রাজ্য পাইবার সম্ভাবনা নাই তখন সে আপন চতুরতা ও কর্ম্মদক্ষতা দেখাইয়া যবনদিগের প্রিয়পাত্র হইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। হিন্দুদিগের প্রতি অত্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা শীঘ্র সে মনস্কাম সিদ্ধ করিয়া অভীষ্ট রাজকার্য্যে নিযুক্ত হইল।

 হেমচন্দ্রের স্থাপিত রাজ্যের এক্ষণে কোন চিহ্ন নাই। কিন্তু বঙ্গদেশে সমুদ্রের উপকূলে যে সকল জনপদ ছিল তাহার কিছুরই এক্ষণে চিহ্ন নাই।

সমাপ্তোঽয়ং গ্রন্থঃ।