মৃণালিনী (১৮৭৪)/তৃতীয় খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
উপনয়—বহ্নিব্যাপ্য ধূমবান্।
গিরিজায়া গীত গায়িল।
“কাহে, সোই জীয়ত মরত কি বিধান?
ব্রজ কি কিশোর সোই, কঁহা গেল ভাগই,
ব্রজজন টুটায়ল পরাণ।”
সংগীত ধ্বনি হেমচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশ করিল। স্বপ্নশ্রুত শব্দের ন্যায় কর্ণে প্রবেশ করিল।
গিরিজায়া আবার গায়িল।
“ব্রজ কি কিশোর সোই, কঁহা গেল ভাগই,
ব্রজবধূ টুটাল পরাণ।”
হেমচন্দ্র উন্মুখ হইয়া শুনিতে লাগিলেন।
গিরিজায়া আবার গায়িল।
“মিলি গেই নাগরী, ভুলি গেই মাধব,
রূপবিহীন গোপকুঙারী।
কে জানে পিয় সই, রসময় প্রেমিক,
হেন বঁধূ রূপকি ভিখারী॥”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “একি! মনোরমে, এযে গিরিজায়ার স্বর! আমি চলিলাম এই বলিয়া লম্ফ দিয়া হেমচন্দ্র শয্যা হইতে অবতরণ করিলেন। গিরিজায়া গায়িতে লাগিল।
“আগে নাহি বুঝনু, রূপ দেখি ভুলনু,
হৃদি বৈষ্ণু চরণ যুগল।
“যমুনা সলিলে সই, অব তনু ডারব,
আন সখি ভখিব গরল॥”
হেমচন্দ্র গিরিজায়ার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। ব্যস্তস্বরে কহিলেন,
“গিরিজায়ে! একি, গিরিজায়ে! তুমি এখানে? তুমি এখানে কেন? তুমি এদেশে কবে আসিলে?”
গিরিজায়া কহিল “আমি এখানে অনেক দিন আসিয়াছি।” এই বলিয়া আবার গায়িতে লাগিল।
“কিবা কাননবল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই,
নবীন তমালে দিব ফাস।”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তুমি এদেশে কেন এলে?”
গিরিজায়া কহিল, “ভিক্ষা আমার উপজীবিকা। রাজধানীতে অধিক ভিক্ষা পাইব বলিয়া আসিয়াছি।
“কি বা কানন বল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই,
নবীন তমালে দিব ফাস।”
হেমচন্দ্র গীতে কর্ণপাত না করিয়া কহিলেন, “মৃণালিনী কেমন আছে, দেখিয়া আসিয়াছ?”
গিরিজায়া গায়িতে লাগিল।
“নহে—শ্যাম শ্যাম শ্যাম শ্যাম, শ্যাম নাম জপয়ি’
ছার তনু করব বিনাশ।”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার গীত রাখ। আমার কথার উত্তর দাও। মৃণালিনী কেমন আছে, দেখিয়া আসিয়াছ?”
গিরিজায়া কহিল, “মৃণালিনীকে আমি দেখিয়া আসি ঞনাই। এ গীত আপনার ভাল না লাগে অন্য গীত গায়িতেছি।
এজনমের সঙ্গে কি সই, জনমের সাধ ফুরাইবে।
কিবা জন্মান্তরে, এ সাধ মোর পুরাইবে॥”
গি। “কি বলিব?”
হে। “মৃণালিনীকে কেন দেখিয়া আইস নাই?”
গি। “গৌড়নগরে তিনি নাই।”
হে। “কেন? কোথায় গিয়াছেন?”
গি। “মথুরায়।”
হে। “মথুরায়? মথুরায়? কাহার সঙ্গে গেলেন? কি প্রকারে গেলেন? কেন গেলেন?”
গি। “তাঁহার পিতা কি প্রকারে সন্ধান পাইয়া লোক পাঠাইয়া লইয়া গিয়াছেন। বুঝি তাঁহার বিবাহ উপস্থিত। বুঝি বিবাহ দিতে লইয়া গিয়াছেন।”
হে। “কি? কি করিতে?”
গি। “মৃণালিনীর বিবাহ দিতে তাঁহার পিতা তাঁহাকে লইয়া গিয়াছেন।”
হেমচন্দ্র মুখ ফিরাইলেন। গিরিজায়া সে মুখ, সেই ভীম কান্তিযুক্ত মুখমণ্ডল দেখিতে পাইল না; আর যে হেমচন্দ্রের স্কন্ধস্থ ক্ষত মুখ ছুটিয়া বন্ধনবস্ত্র রক্তে প্লাবিত হইতেছিল তাহাও দেখিতে পাইল না। সে পূর্ব্বমত গায়িতে লাগিল।
“বিধি তোরে সাধি শুন, জন্ম যদি দিবে পুনঃ,
আমারে আবার যেন, রমণী জনম দিবে।
লাজভয় তেয়াগিব, এ সাধ মোর পুরাইব,
সাগর ছোঁচে রতন নিব, কণ্ঠে রাখ্বো নিশি দিবে।”
হেমচন্দ্র মুখ ফিরাইলেন। বলিলেন, “গিরিজায়ে, তোমার সম্বাদ শুভ। উত্তম হইয়াছে।”
এই বলিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে পুনঃ প্রবেশ করিলেন।
হেমচন্দ্র যে কেন গিরিজায়াকে বলিলেন, তোমার সম্বাদ শুভ তাহা গিরিজায়া বুঝিল না। যে ক্রোধভরে, হেমচন্দ্র, এই মৃণালিনীর জন্য গুরুদেবের প্রতি শরসন্ধানে উদ্যত হইয়ছিলেন, সেই দুর্জ্জয় ক্রোধ হৃদয়মধ্যে সমুদিত হইল। অভিমানাধিক্যে, দুর্দ্দম ক্রোধাবেগে, হেমচন্দ্র গিরিজায়াকে বলিলেন, “তোমার সম্বাদ শুভ।”
গিরিজায়া তাহা বুঝিতে পারিল না। মনে করিল, এই ষষ্ঠ লক্ষণ। কেহ তাহাকে ভিক্ষা দিল না; সেও ভিক্ষার প্রতীক্ষা করিল না; “শিকলী কাটিয়াছে” সিদ্ধান্ত করিয়া গৃহাভিমুখে চলিল।