মৃতের কথোপকথন/ঈশা খাঁ, কেদার রায়

উইকিসংকলন থেকে

ইশা খাঁ, কেদার রায়

ইশা খাঁ

 গৃহ-কলহই আমাদের কাল হয়েছে। নতুবা মানসিংহের সাধ্য কি দ্বাদশ আদিত্যের সম্মুখে দাঁড়াতে সাহস পায়? আমাদের এক একজন আলাদা আলাদা ভাবে কেউ ত সে মহাবীরের চেয়ে খাট ছিল না। আমরা প্রত্যেকেই বারবার প্রত্যক্ষ প্রমাণিত করে দিয়েছি তোমারই সে গরিমাময় গর্ব্বান্বিত কথা—তথাপি সিংহঃ পশুরেব নান্যঃ। তবুও আমাদের জয় টিক‍্লো না। বঙ্গ রাজ্য এক হ’লো না, স্বাধীন হ’লো না।

কেদার রায়

 কেন হবে? পাপের উপর কখন পুণ্যের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। যে লোক নারীর মর্যাদা রক্ষা কর‍্তে জানে না; নিজের লালসার পরিতৃপ্তির জন্য অবলার জাতি ধর্ম্ম নষ্ট কর‍্তে পারে, সে হাজার বীর হোক্, শত যুদ্ধে জয়ী হোক্, তাকে দিয়ে কোন মহৎ কার্যা হতে পারে না, তার সব প্রয়াস ক্ষণভঙ্গুর হতে বাধ্য, অপরের প্রয়াসকেও সে বার্থ ক’রে দেয় পরিণামে।

ইশা খাঁ

 তোমার ভগ্নীর কথা বলছ? কিন্তু সে ত আমার ধর্ম্মপত্নী। আমি তাঁকে ধর্ম্মতঃ গ্রহণ করবার জন্যে তোমাদের কাছে হাত পেতেছিলেম। আমার আবেদন তোমরা যে শুধু প্রত্যাখান কর‍্লে তা নয়, সে আবেদনের প্রত্যুত্তরে আমার রাজ্য আক্রমণ কর‍্লে। আত্মরক্ষার জন্য তাই আমাকে দাঁড়াতে হ’লো। আর তোমার ভগ্নীর অমতে আমি কিছু করি নি। তার প্রমাণ, তোমারই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে নিজের জীবন দিয়েছে।

কেদার রায়

 তুমি বিদেশী, তুমি বিধর্ম্মী—হিন্দুনারীর প্রাণের কথা বুঝবার তোমার সামর্থ্য কোথায়? তুমি জোর করে তাকে হস্তগত কর‍্লে সে নারী হয়ে আর কি করতে পারে? দুষ্ট ঘটনার চক্রে যে অবস্থায় সে পড়ে গেল, উদ্ধার নাই দেখে সময়ের কর্ত্তব্য সে করে গেছে শুধু। তার ত দ্বিতীয় পথ ছিল না।

ইশা।

 সে তোমাদের সমাজের গুণে। যাহোক্, কেদার তুমি বীর বটে, কিন্তু তদনুরূপ তোমার মনের প্রসার কই? জাতের উপরে মানুষ, সমাজের উপরে দেশ। তাই ত আমি বলছিলেম, এ সামান্য কথাটা বুঝ‍্তে না পেরে, এক এক আদিত্য হয়েও আমরা আমাদের সাধারণ শত্রুর কিছু কর‍্তে পারি নি, আমাদের সবাইকার যে ইষ্ট তার সাধনায় সিদ্ধ হইনি। অতি সহজেই শত্রু এক জনের বিরুদ্ধে আর এক জনকে দাঁড় কর‍্তে পেরেছে।

কেদার রায়

 তোমারই পথ তবে প্রশস্ত ছিল। নারীর কুলশীল নষ্ট কর‍্তে তুমি পশ্চাৎ পদ হও নি, এই তোমার সমাজ-নীতি। আর রাজনীতি? নিজের? ঔদার্য্য দেখিয়ে তুমিই মানসিংহকে বন্ধু ভাবে আলিঙ্গন করেছ, তুমিই সম্রাটের হাত থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করেছ, সব রকমেই মোগল তোমার কাছ থেকে সুবিধে করে নিয়েছে।

ঈশা খাঁ

 আমি চেয়েছিলেম আমার জীবনের কর্ম্মের সঙ্গিনী। তাই আমি দেখি নি, তার কুল গোত্র জাতি ধর্ম্ম। আমি দেশকে চেয়েছিলেম, তাকে সেবা করবার জন্যে শত্রুর সাথে বুঝ‍্তেও যেমন অগ্রণী ছিলেম তেমনি আবার প্রয়োজন অনুসারে সন্ধি কর‍্তেও বিমুখ হই নি। কেদার, তোমার হিন্দু রাজ্যের স্বপ্ন মহৎ হতে পারে, কিন্তু তার সম্ভাবনা খুবই কম। বঙ্গদেশের চাই জাতি ধর্ম্মের ঐক্য, চাই বিভিন্ন শক্তি-কেন্দ্রের ঐক্য। তোমাদের দিকে আমি ত বন্ধুত্বের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেম, তোমরা গ্রহণ কর নি। সার্ব্বাঙ্গীন ঐকোর জন্য আমি অপেক্ষা কর‍্ছিলেম। যত দিন তা হয়নি, তত দিন মোগলের সাথে সন্ধি দরকার ছিল, বৃথা শক্তি ক্ষয় কর‍্তে আমি চাই নি। আর বিজিত হয়ে আমি সন্ধি করি নি, আমি জয়া হয়েই সন্ধি করেছি।

কেদার রায়

 বিদেশীর বিধর্ম্মীর সাথে আবার সন্ধি কি? বঙ্গদেশ হিন্দুর বাঙ্গালীর রাজত্ব—তুমি ইশা খাঁই হও, আর দিল্লিতে সম্রাট আকবরই হোন, তোমরা সকলেই ভিন্ন দেশের ভিন্ন জাতির, এ দেশের সাথে তোমাদের নাড়ীর টান হতে পারে না। আমাদের দেশে ধর্ম্ম-ভেদ, জাতি-সঙ্কর তোমরাই এনেছ। দেশের প্রাণ হচ্ছে সমাজ, সেই সমাজে যেখানে ঐক্য নেই, সেখানে রাষ্ট্রেও ঐক্য থাক‍্তে পারে না। বঙ্গদেশের সমাজে তোমাদেরই দৌলতে ফাটল ভাঙ্গন ধরেছে। বিভিন্ন বহুল কেন্দ্রে কখন ঐক্য হয় না, ঐক্যের জন্য চাই এক শক্তির কেন্দ্র, এক প্রেরণার উৎস; একই দেহে একটা সজীব মাথাই দরকার, তার বেশী নয়। বহু কেন্দ্র বহু শক্তি যেখানে, তাদের মধ্যে মিলমিশ হওয়া অসম্ভব; যদিই বা মিলমিশ হয় তবে সেটা ক্ষণিক, তা সাময়িক সুবিধা এনে দিতে পারে কিন্তু তাতে প্রাণের চিরন্তন মিল হয় না, বৃহৎ কিছু সাধিত হয় না। শ্রীপুরকে আমি বঙ্গের সমাজের রাষ্ট্রের একমাত্র শক্তি-কেন্দ্র করে তুল‍্তে চেয়েছিলেম।

ইশা খাঁ

 তুমি চেয়েছিলে শ্রীপুর, প্রতাপাদিত্য চেয়েছিল যশোহর, সীতারাম চেয়েছিল মহম্মদপুর, শোভাসিংহ চেয়েছিল বর্দ্ধমান, তাই ত একের পর একে সবাইকে ব্যর্থ-মনোরথ হতে হয়েছে। আমাদের উচিত ছিল এক কেন্দ্রের লোভ ত্যাগ করে বহু কেন্দ্রকে একই লক্ষ্যে সংগ্রথিত করা। সেই উদ্দেশ্যেই আমি তোমার ভগ্নির পাণিগ্রহণ কর‍্তে চেয়েছিলেম, সেই উদ্দেশ্যেই সম্পূর্ণ প্রস্তুত হবার পূর্ব্বে শত্রুর সাথে সহজেই সন্ধি করি। অবস্থা না বুঝে, বাস্তবের দিকে না তাকিয়ে কেবল গায়ের জোরে কতদূর এগুতে পার, তার পরিচয় তোমার নিজের পরিণাম।

কেদার রায়

 ভগবান বিমুখ ছিলেন, হয়ত আমার সে চরম সামর্থা ছিল না— কিন্তু বাঙ্গলার শিক্ষাদীক্ষার সমাজের ধর্ম্মের অটুট একত্ব বজায় রাখতে হবে, বাঙ্গালীর শক্তিকে এক কেন্দ্রগত হয়ে উঠ‍্তে হবে। যে অবস্থার দিকে তাকায়, আগে হতেই সন্ধির জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়ে, সে শক্তিকেও পাবে না, সুবিধাকেও সৃষ্টি কর‍্তে পারবে না। আমি প্রাণ দিয়েছি, সন্ধি করি নি। প্রাণ দিয়ে প্রাণ জাগাতে হয়। নতুবা সন্ধি আরম্ভ করলে তার কি শেষ আছে?

ইশা খাঁ

 তুমি বঙ্গের ভাবুক প্রাণ। কিন্তু আমিও এই বঙ্গেরই সন্তান। আমার অতীত যাই হোক না কেন, এই মাতৃভূমির জন্যেই আমি এনেছি আমার অতীতের সম্পদ। তা গ্রহণ কর‍্লে দেশের উপচয় ব্যতীত অপচয় হবে না, আর তা গ্রহণ করতেই হবে, অব্যর্থকে খোদার দানকে অস্বীকার করবার জো নেই।

কেদার রায়

 তোমার কথার প্রমাণের জন্য আমি এখনও অপেক্ষা করছি।