মৃতের কথোপকথন/সুলতান মামুদ, ফেরদৌসী

উইকিসংকলন থেকে

সুলতান মাহ‍্মুদ, ফের‍্দৌসী

মাহ‍্মুদ

 বলিহারী তোমার কবিত্বশক্তি, ফের‍্দৌসী! সাধে কি তোমায় সভাকবি ক’রে আমি নিয়েছিলেম। যে সব অসাধারণ অভিনব বিশেষণে তুমি আমায় বিভূষিত করেছ, যে স্তুতির ছটায় আমাকে গৌরবান্বিত করেছ, তা কখনও ভুলবো না! ধন্যবাদ সেজন্য! এমন বেসাতি আমি কোন দিন করিনি তোমায় কিনে, অর্থ আমার এমন সার্থক কোন দিন হয় নি!

ফের‍্দৌসী

 তোমার মত অর্থগৃধ নরপিশাচ, লুঠ তরাজ করেই যার সারাজীবন কেটে গিয়েছে, সে অর্থের সার্থকতা ছাড়া আর কি বুঝতে পারে? মাহ‍্মুদ, তুমি ভারবাহী বলীবর্দ্দ মাত্র। তোমার সভায় জ্ঞানী গুণীজন অনেক জমায়েত করেছিলে বটে, কিন্তু জ্ঞানের গুণের রসভোগও করনি, তার মর্য্যাদাও বুঝ‍্তে পার নি।

মাহ‍্মুদ

 আমি তা চাই ও নি। আমি চেয়েছিলেম আমার জন্যে বাহার-অলঙ্কার। বিদেশীর ভাণ্ডার থেকে হীরা জহরৎ যেমন কেড়ে এনেছি গজনীকে সাজিয়ে তোলবার জন্যে, রমণী-রত্ন দিয়ে যেমন আমার হারেম সমৃদ্ধ করেছি, সেই রকম তোমাদের মত কথার কলমের বাহাদুর সব জোগাড় করেছি আমার দরবারের শোভাবর্দ্ধনের জন্য। তার বেশী নয়। সে কথা যাক্, কিন্তু ফের‍্দৌসী, তুমি অন্ততঃ বল্‌তে পার‍্বে না, অর্থলিপ্সা আমার চেয়ে তোমার কিছু কম। কথার মূল্য ত দেখি অর্থ দিয়েই তুমি যাচাই কর। আহা বেচারী, দু’চার খণ্ড ধাতুর জন্যে কি কাতরই না তোমরা হয়ে পড়।

ফের‍্দৌসী

 কবির কথার মূল্য অর্থ দিয়ে নির্দ্ধারণ হয় না, কবির দুঃখ সে জন্য নয়। কবির দুঃখ মানুষের মূর্খতার জন্য, তোমার মত যে বীরপুরুষ তার মাথায় এতটুকু মগজের অভাবের জন্য, তার প্রাণে এক ফোঁটা রসানুভূতির অভাবের জন্য। কাব্যের মত বেহেস্তের ধন, তোমার হাতে কি সম্মান পেয়েছে—তোমার ভিক্ষামুঠি তারই চিহ্ণ। অর্থের জন্য আমি কাতর হই নি। কাব্যের লাঞ্ছনা দেখে আমি মর্ম্মাহত হয়েছিলেম। আবুসিনা বুঝেছিল তোমাদের কদর, তাই সে তোমার হাতে কোন মতে ধরা দেয় নি। মাহ‍্মুদ, তোমার গজনীসহ সমস্ত সাম্রাজ্যটি ঢেলে দিলেও তাতে আমার একটি গজলের যথেষ্ট সম্মান করা হয় না।

মাহ‍্মুদ

 সাবাস। কথার বীর বট তোমরা। কিন্তু আওরাতেরও সেই বীরত্ব। কবি ও নারী, একই ধরণের জীব। জগতের রূঢ় ঝড়ঝাপ‍্টা, কর্ম্মজীবনের দারুণ রোদ গ্রীষ্ম, পৃথিবীর ধুলামাটি তোমাদের সহ্য হয় না, শোভাও পায় না। তাই ত রাজা বাদসার কাজ তোমাদেকে আওতায় রেখে রক্ষা করা, পোষণ করা, অবসর সময়ে তোমাদের মুখের দুই চারিটা খুবসুরৎ বোলি শুনে দেহ মনকে বিশ্রাম দেওয়া, দিলকে খুসী করা।

ফের‍্দৌসী

 কথার মহিমা তুমি কি বুঝবে দস্যু। কথার যে ছন্দ যে সুর যে চিত্র কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তা খোদার কারিগরির মতনই সমান সুন্দর সমান আজব। কবির বাণীর ভিতরে সমস্ত বিশ্ব ধরা দিয়েছে। বাণী থেকেই দুনিয়ার সৃষ্টি, কবির বাণী খোদার দৃষ্টিকে মূর্ত্ত করে ধরেছে। কবির কথা খোদার আঁখির রোসনাই।

মাহ‍্মুদ

 তোমাদের সৃষ্টি হাওয়ায়, আসমানে, শূন্যে।, যাকে তুমি দস্যু বল্‌ছ, ফের‍্দৌসী, সে তোমার চেয়ে বড় কাব্য সৃষ্টি করেছে। তবে আমার কাব্য কাগজে নয়, আমার কাব্য পৃথিবীর বুকে; তুমি কলম ধরে লিখেছ, আমি অসি দিয়ে এঁকেছি। তুমি সাজিয়েছ হরফ, আমি সাজিয়েছি মানুষ, দেশ। কা’র সৃষ্টি বেশী জীবন্ত, দৃঢ়, মহিমাময়? কা’র মধ্যে খোদার দান বেশী জাজ্বল্যমান?

ফের‍্দৌসী

 তার প্রমাণ কার সৃষ্টিটি বেশী স্থায়ী? তোমার সৃষ্টি তোমার সাথেই লোপ পেয়েছে, মাহ‍্মুদ। এত যত্ন, এত চেষ্টা, এত পরিশ্রম তার চিহ্ণ ও কিছু আজ দেখ‍্তে পাও কি? কিন্তু আমার সৃষ্টি যুগযুগান্তর ধরে, দেশে দেশে এখনও মানুষের আনন্দের বস্তু হয়ে আছে। তোমার সৃষ্টিতে ছন্দের চাইতে দ্বন্দ্বেরই মাত্রা বেশী। তোমার সৃষ্টি ক্ষণিকের ভঙ্গুর জিনিষ নিয়ে। তোমার সৃষ্টি অতি বাহিরের, কেবল দেহের।

মাহ‍্মুদ

 কিন্তু তবুও তোমরা ত আমাদেরই প্রতিধ্বনি। আমরা বাস্তবে যা করি, তাই তোমরা কথায় বাঁধ। আমরা করি কাজ, তোমরা দাও তার ব্যাখ্যা। আমি যে সাহ‍্নামা জগতের মধ্যে এঁকে দিয়েছি, ফের‍্দৌসী, তোমার সাহ‍্নামা তার তর্জ্জমা।

ফের‍্দৌসী

 তোমাদের কাজ কবির শুধু অবলম্বন, আশ্রয়, ছুতা। গোবরে পদ্মফুল ফোটে, তাতে গোবরের নিজের মাহাত্ম্য কিছু আছে কি? কবি দেখেন একটা অলৌকিক লোক, তার পরিচয় সাধারণের চোখে ধ’রে দেবার জন্যে, তিনি যেখানে যে উপকরণ সুবিধামত পান তাই সংগ্রহ করেন। ক্ষুদ্রকে বিরাট, ক্ষণিককে চিরন্তন, অসুন্দরকে সুন্দর করেন বলেই কবি কবি। বাস্তবই যে সত্য তা নয়, মাহ‍্মুদ।

মাহ‍্মুদ

 আমি স্বীকার করি, তোমরা সুন্দরের পূজারী। কিন্তু আমরা শক্তির বিগ্রহ। তাই ত বল‍্ছিলেম তোমরা আওরাতের তুল্য। সেই হিসেবেই তোমরা দেশে দেশে যুগে যুগে লোকের মনোহরণ করতে পেরেছ। কিন্তু সুন্দর নয়, শক্তিই জগতের সার বস্তু। শক্তিই মানুষকে সৃষ্টিক্ষম মরদ কর‍্তে পারে, শক্তিই মানুষের মনুষ্যত্বের পরিমাপ। তোমাদের প্রভাব ভাবে, প্রাণে, কিন্তু আমাদের কাজের প্রভাব মানুষের রক্তমাংসের মধ্যে, পৃথিবীর দেহ-কোষের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে।

ফের‍্দৌসী

 বাহুর শক্তিই একমাত্র শক্তি নয়—সে ত পশুর শক্তি। কবির যা সুন্দর, তারই মধ্যে নিহিত শক্তির উচ্চতম নিবিড়তম প্রকাশ। স্রষ্টারই তপঃশক্তি কবির সৌন্দর্য্য-সৃষ্টির মূলে, তারই এককণা নীচে নেমে এসে তোমাদের মত বীরকর্ম্মীর বাহুকে শক্তিমান ও উদ্ধৃত করে তুলেছে।