মৃতের কথোপকথন/চন্দ্রগুপ্ত, অশোক

উইকিসংকলন থেকে

চন্দ্রগুপ্ত, অশোক

চন্দ্রগুপ্ত

 কি কুক্ষণেই তুমি কলিঙ্গদেশে পা দিয়েছিলে, অশোক! কি কুক্ষণেই করুণার মোহ তোমার বীরহৃদয় অভিভূত ক’রে ফেলেছিল! তা না হ’লে, ভারতের ভাগ্য আজ যে আর এক রকম হ’ত না, কে জানে! সামান্য অকিঞ্চিৎকর ঘটনার মধ্যে কি না বিপুল ভবিতব্যই নিহিত থাকে!

অশোক

 যথার্থ। তা না হলে, ভারত তার অন্তরের ধন খুঁজে পাবে কি রকমে? কি রকমে ভারতের প্রতিভা ভারত ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে? কি রকমে অর্দ্ধ-জগৎ শিক্ষায় দীক্ষায় ভারতের শিষ্যত্ব গ্রহণ কর‍্বে? ধন্য সে মুহূর্ত্ত যখন ভগবান তথাগত বালিকা মূর্ত্তি ধ’রে আমার সম্মুখে উপস্থিত হলেন, আমার আসুরী অজ্ঞান-অন্ধকার দূর করে দিয়ে, সেখানে দিব্য জ্ঞানের স্নিগ্ধ-জ্যোৎস্না ফুটিয়ে তুল‍্লেন! ধন্য আমার সে কলিঙ্গ অভিযান!

চন্দ্রগুপ্ত

 তোমার ব্যক্তিগত জীবনের পক্ষে তা মঙ্গলকর হ’লেও হ’য়ে থাক‍্তে পারে, আমি জানিনে, সে প্রশ্নও তুল্‌ছি নে। কিন্তু দেশের পক্ষে তার মত ঘোরতর অমঙ্গলকর বোধ হয় আর কিছু হয় নি। চণ্ডাশোকের নাম যেদিন হলো প্রিয়দর্শী, রাজা যেদিন ভিক্ষু-ধর্ম্ম অবলম্বন কর‍্লে, যোদ্ধারা সব অসির পরিবর্ত্তে ভিক্ষাপাত্র, বর্ম্মের পরিবর্ত্তে চীর ধারণ কর‍্তে আরম্ভ করলে, সেই দিনই জান‍্লেম, চন্দ্রগুপ্তের প্রয়াস বিফল হতে চলেছে। বিচ্ছিন্ন ভারতকে এক ক’রে শক্তিমান মহারাষ্ট্রে পরিণত ক’রে আমি তুলেছিলেম, তুমি যুগযুগান্তরের জন্যে সে কাজ পেছিয়ে দিয়েছ।

অশোক

 তোমার আদর্শে তোমার পথে আমিও কিছুদিন চলেছিলেম, কিন্তু ভগবান আমার সে ভুল ভেঙে দিলেন। তোমার পদাঙ্ক অনুসরণে চল্‌লে ভারতের দুর্ভাগ্য বই সৌভাগ্য হ’ত না। তাতে হয়ত ভারত একটা বিপুল আসুরী শক্তি হ’য়ে দাঁড়াত, জগতের পক্ষে তা হ’ত একটা বিভীষিকা। আর শুধু ঐহিক আসুরিক শক্তিতে কে কতদিন বড় হতে পারে? যত বড় সে হবে, তার পতনও অবশ্যম্ভাবী, ততই দারুণ। কিন্তু আমি ভারতকে যে শক্তির সন্ধান দিয়েছি, আমি যে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছি, তা দেহ গেলেও, রাষ্ট্র গেলেও অটুট রয়েছে, অটুট থাকবে। ধর্ম্মের সাম্রাজ্য ভারতের এখনও টলে নি, এখনও তা দেশে দেশে আদর্শে শিক্ষায় দীক্ষায় মানব জাতির অন্তরের ধনরূপে প্রতিষ্ঠিত। এ কি আমার ব্যক্তিগত লাভ শুধু?

চন্দ্রগুপ্ত

 সবল দেহ সজীব প্রাণ বিনা কোন অন্তরাত্মার সম্পদ সমর্থ কার্যকরী হ’তে পারে না। সুঠাম রাষ্ট্র বিনা একটা জাতির প্রতিভা পূর্ণাঙ্গ হ’য়ে ফুটে উঠতে পারে না। তোমার কল্পনার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তুমি জগতের উপর ভারত প্রতিভার সূক্ষ্ম প্রভাবই দেখ‍্চ কেবল—কিন্তু চেয়ে দেখ ত বাস্তবের দিকে। অন্যান্য দেশ তোমার ভাবের দ্বারা ভাবজগতে যতই অনুপ্রাণিত হোক না কেন, বস্তু-জগৎ তারা কখনো তাই বলে ভুলে যায় নি। ভারত তোমার পথে এক চক্ষু হয়ে চলেছে, তাই সে আজ দীন দরিদ্র দুর্ব্বল পরপদানত শতখণ্ডে বিদীর্ণ। শরীরকেই বাঁচিয়ে বর্ত্তিয়ে রাখ‍্বার যার যোগ্যতা নাই, তার আবার অন্তরের ধন খোঁজ কর‍্বার সামর্থ্য বা তাবসর কোথায়? তাই ত দেখ, বাহিরের জীবনে পঙ্গু হ’য়ে ভিতরের জীবনেও সে পঙ্গু হয়ে গেছে। ধর্ম্মের জীবন্ত বিকাশ কোথায় ভারতে? ভারতবাসীর ধর্ম্ম? সে ত কেবল আচার-পালন, কায়ক্লেশে কতকগুলি নিয়ম মেনে চলা। বাহিরের অসামর্থ্য তার ভিতরে জাগিয়ে তুলেছে ভয়, তাই ধর্ম্মাচরণ করে সে পাপের ভয়ে,—গভীর জীবন্ত সত্য উপলব্ধির জোরে নয়। প্রাণশক্তি যেখানে ক্ষীণ, শরীরই যেখানে জার্ণ শীর্ণ, অন্তরাত্মাও সেখানে বিকশিত হ’তে পারে না।

অশোক

 কিন্তু দৈহিক বল, রাষ্ট্রনৈতিক বলই যে শক্তির গোড়া তা আমি মানিনে। গোড়ায় চাই অন্তরাত্মার বল। এই বল যার আছে, তার প্রাণে দেহে দেখা দেয় নূতন এক শক্তি। ধর্ম্ম-বলই যে দেহে প্রাণে কি সামর্থ্য এনে দেয় তার প্রমাণ কি তুমি দেখ‍্ছ না? সমস্ত বৌদ্ধ যুগটা তোমার সম্মুখে। এই যুগে জ্ঞানে, কর্ম্মে, শিল্পে, বাণিজ্যে ভারত যে কত বড় জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, তার চিহ্ন ত এখনও অটুট হয়ে বর্ত্তমান, সেই যুগের শিক্ষা দীক্ষা আধুনিক মানুষকে কতখানি অনুপ্রাণিত করেছে, তার প্রমাণ ত দুর্ল্লভ নয়। তবে ইদানীন্তনকালে ভারতের যে পরাধীনতা, যে বিচ্ছিন্নতা, যে দৈন্যদারিদ্রা তার কারণ অন্যত্র খুঁজ‍্তে হ’বে। আমি বলি, ধর্ম্মকে সত্যের পথ হারিয়েই এমন হয়েছে।

আমি যে আদর্শ দিয়েছিলেম, তা থেকে যেদিন সে বিচ্যুত হয়েছে, সেদিন থেকেই ভারতের পতনের আরম্ভ। বাইরের পতন ঐ ভিতরের পতনের ফল মাত্র।

চন্দ্রগুপ্ত

 সে ভিতরের পতনও আরম্ভ হয়েছে তোমার নূতন ধর্ম্ম দিয়ে, তোমার অন্তরাত্মার নূতন প্রেরণা দিয়ে। বৌদ্ধযুগের যে কৃতিত্ব তুমি দেখাচ্ছ, তাতে বৌদ্ধধর্ম্মের অধিকার কতখানি, সেটা বিচারের বিষয়। তোমার ধর্ম্মের আদর্শ ত সন্ন্যাস, বৈরাগ্য, নির্ব্বাণ—নির্ব্বাণের চর্চ্চার ফলে সৃষ্টি, এটা কোন ন্যায়? জাতীয় প্রচেষ্টা বল, শিল্পকলা বল, —সব রকম সৃষ্টিই ত তোমার ধর্ম্মের বিরোধী। তা নয়, ভারতের জীবন তখনও ছিল, আমি যে নবপ্রাণ জাতির মধ্যে উদ্বুদ্ধ ক’রে দিয়েছিলেম তার জের তখনও ছিল— যতদিন ছিল ততদিন ভারত সৃষ্টি করেছে। তবে তোমার ধর্ম্ম একটা নূতন ভাবতরঙ্গ এনে দিয়েছিল, কতকগুলি নূতন বিষয় চোখের সামনে তুলে ধরেছিল, ভারতের জীবন্ত প্রাণ সেগুলিকে আশ্রয় ক’রে আত্মসাৎ ক’রে নিজেকে প্রকাশ করেছে মাত্র। তার আরও প্রমাণ, এই প্রাণ যতদিন ভারতের ছিল ততদিন সৃষ্টি হয়েছে, তারপর তোমার ধর্ম্ম যখন অতিমাত্র সে প্রাণকে অভিভূত ক’রে ফেল্‌লে, তখন ভারতবাসী বাস্তবিকই বুঝ‍্লে সব ঝুটা, কিছুই নয়, বৈরাগ্য নির্ব্বাণই সার—কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্ত—তখন সত্যসত্যই তাকে কৌপীন প’রে, দীনদরিদ্র অল্পপ্রাণ অক্ষম হ’য়ে পড়তে হ’ল। যার যেমন শ্রদ্ধা। লক্ষ্মীকে ভারতবর্ষ যেদিন থেকে তুচ্ছ তাচ্ছীল্য করেছে, সে দিন থেকে লক্ষ্মীও তাকে পায়ে ঠেলেছে। পূর্ব্বের কিছু সুকৃতি ছিল, তাই ক্ষয় হয়েছে তোমার বৌদ্ধ যুগের ঐশ্বর্য্যে।

অশোক

 কিন্তু এ একটা ব্যাখ্যা মাত্র—বাস্তবকে সহজভাবে না দেখে, বিকৃত ক’রে দেখা—গুণের ভাগটি সমস্ত নিজের কোলে নিয়ে, দোষের ভাগটি অপরের উপর চাপিয়ে দেওয়া তথাগত যে অন্তরের প্রেরণা ভারতবর্ষে জাগিয়ে দিয়েছিলেন, তার শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি সর্ব্বস্বত্যাগী শ্রমণের জীবনে। কিন্তু সেই প্রেরণাই অন্যদিকে শিল্পী-প্রতিভা খুলে দিয়েছে, কর্ম্মীর কর্ম্মকে নতুন ছাঁচে ঢেলে দিয়েছে। নির্ব্বাণ হচ্ছে চরম লক্ষ্য। কিন্তু যে সাধনায় সেই চরম সিদ্ধি, সেই সাধনাই অন্তরের শ্রেষ্ঠ শুদ্ধ প্রেরণা সব ফুটিয়ে তোলে, ঐ এক লক্ষ্যে চালিয়ে দেয়, জীবনের সব ধারাকে বিকশিত করে ঐ এক অভিব্যঞ্জনায়। নির্ব্বাণ অর্থ এমন নয় যে রাজা রাজ্যপালন ছেড়ে দেবেন, শিল্পী তাঁর শিল্পকর্ম্ম বন্ধ রাখ‍্বেন, গৃহী তাঁর গৃহকর্ম্মে বিরত হবেন। তা নয়। সবাই আপন আপন কর্ম্ম কর‍্বে, কিন্তু সে সব কর্ম্মকে ঐ সুদূরের সুরে গেঁথে দিতে হবে। এবং সকলের শেষে কর্ম্মশেষ হ’য়ে গেলে, সকল প্রেরণা ক্রমে ক্ষয় হ’য়ে গেলে তখন চরম শান্তিতে আপনাকে স্তব্ধ ক’রে দিতে হবে।

চন্দ্রগুপ্ত

 এটাও তোমার নির্বাণ-ধর্ম্মের ব্যাখ্যা মাত্র। কিন্তু এতে প্রমাণ হয়, আমার রক্ত তোমার শরীরে বর্ত্তমান, ভারতের ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের প্রভাব হ’তে তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত হ’তে পার নি। সে কথা থাক্‌, কিন্তু তোমার কথাই যদি সত্য হবে, তবে অর্থনীতিক রাষ্ট্রনীতিক ক্ষেত্রেও তোমার নির্ব্বাণধর্ম্মের সৃষ্টি ফুটে উঠ‍্লো না কেন? এখানে নির্ব্বাণের সৃষ্টি কিছু হয় নি, সকল সৃষ্টিরই নির্ব্বাণ হয়েছে। তোমার প্রভাবে দেশবাসী যখন পরিচ্ছদের মধ্যে একখানা মলিন কার্পাস বস্ত্র, গন্ধদ্রব্যের মধ্যে একটুকু চন্দন বা কর্পূরই সার কর‍্লে, তখন ভারতের পণ্যজীবী সম্প্রদায়ে কি হাহাকার পড়ে গিয়েছিল তার খবর রাখ কি? কত মণিমাণিক্য, কত বহুমূল্য কৌষেয় ক্ষৌম বস্তু, কত গন্ধানুলেপন, কত দ্রব্য-সম্ভারেই না ভারত ঐশ্বর্য্যান্বিত ছিল, দেশ-বিদেশের সাথে কত বাণিজ্য সম্বন্ধ ছিল, সে সকলই একে একে লোপ পেতে চল্‌লো। সৌন্দর্য্য সাধনার অভাবে সারা দেশ হতশ্রী হয়ে পড়‍্ল! আর রাষ্ট্রনীতিক ক্ষেত্রে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা খসে পড়তে লাগ‍্লো, দুর্ভিক্ষ দেখা দিল, সমাজের যত নিম্নস্তরের লোক—শঠ, দস্যু, লুঠেরা— তারা সুযোগ পেলে। প্রত্যন্ত দেশের রাজশক্তি—পশ্চিমে যবন দক্ষিণে চোল পাণ্ডা, পূর্ব্বে বঙ্গ আবার যুদ্ধ ঘোষণা কর‍্তে আরম্ভ কর‍্লে; তখন আর বাহুবল নাই, আছে অহিংসা, কারুণ্য, মৈত্রী, তাই উৎকোচ দিয়ে তাদের শান্ত করবার চেষ্টা করতে হ’ল। ভারতের বিপুল দুর্ভাগ্যের আরম্ভ এই রকমে।

অশোক

 ভোগের জীবন পশুর জীবন। আমি সমাজে একটা ত্যাগের তপশ্চরণের আদর্শ প্রতিষ্ঠা ক’রে দিয়েছিলেম, তাতে যদি কারো অনর্থক অর্থ-লাভের উপায় বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে, তাতে আমি দুঃখিত নই। ঐশ্বর্য্যের উপর আকর্ষণ পারত্রিক মঙ্গলের অন্তরায়। ভারত যে ভোগভূমি নয়, ভারতের আছে একটী ত্যাগী তপস্বী আত্মসম্বুদ্ধ অন্তরাত্মা, এই সত্যটি সারা দেশের লোকের প্রাণে প্রাণে গেঁথে দেওয়া দরকার হয়েছিল, তাই শরীরের প্রসাধনের জালজঞ্জাল সব নষ্ট যে হয়েছে, তা মঙ্গলের ছাড়া অমঙ্গলের নয়। তারপর যে অরাজকতার কথা বল্‌ছ তা আমি থাক্‌তে হয় নি। আমার পরে আমার কাজটি চালাবার মত লোকের উদ্ভব হ’ল না, নতুবা এই নতুন ধর্ম্ম যদি আরও সম্যকরূপে প্রচারিত হ’ত, বিদেশীর প্রাণ যদি এই ছাঁচে ঢেলে গড়া হ’ত, তবে দেখতে, কি শান্তির, কি যদৃচ্ছাসন্তুষ্টির, কি অধ্যাত্মমুখী জীবন মানব সমাজে ফুটে উঠ‍্তো।

চন্দ্রগুপ্ত

 হাঁ, মানব সমাজ তবে হ’য়ে পড়‍্তো ভিক্ষুকের সমাজ—দুর্ব্বল, দুঃস্থ, কুৎসিত। কিন্তু তা যে একেবারে হয় নি, সে তোমার চেষ্টার ত্রুটির ফলে নয়। তুমি থাক‍্লে হয়ত আরও কিছু কর‍্লেও কর‍্তে পার‍্তে—কিন্তু বাস্তবিক ও-রকমটি হয় না, মানুষের প্রাণের সত্যকে কতদিন তুমি চেপে দাবিয়ে রাখ‍্তে পার? মানুষের প্রাণ চায় মুক্ত প্রসার, শক্তির খেলা, ঐশ্বর্য্যের অভিব্যক্তি। সামাজিক জীবনে তাই চাই লক্ষ্মীর, কার্ত্তিকেয়ের প্রতিষ্ঠা, চাই বর্দ্ধিষ্ণু অর্থ-প্রতিষ্ঠান আর সমর্থ রাষ্ট্র।

অশোক

 তবে সমাজ-ব্যবস্থায় ধর্ম্মের মোক্ষের স্থান নাই, কেবল কাম ও অর্থই সব? সাধারণ মানুষ ত কাম ও অর্থই চায়, চায় প্রাণের বাসনার খেলা, তাই সাধারণ সমাজের গঠনও সেই রকম হয়েছে। কিন্তু মানুষ মানুষ, কারণ এই প্রাকৃত সমাজকে ভেঙ্গে বদ‍্লে একটা আদর্শের ছাঁচে ঢেলে গড়‍্তে চায়— কামে ও অর্থে পরিতৃপ্ত না হ’য়ে মানুষ তার জীবনে ফুটিয়ে তুল‍্তে চায় অন্তরাত্মার—ধর্ম্মের, মোক্ষের ব্যঞ্জনা।

চন্দ্রগুপ্ত

 অন্তরাত্মা, ধর্ম্ম, মোক্ষ— এ সব নাম মাত্র—এ সবের অর্থ কি? এ সবের মধ্যে প্রাণের খেলার স্থান নাই? চরম লক্ষ্য যদি মোক্ষই— নির্ব্বাণই হয়, তবুও ধর্ম্ম বল্‌তে সন্ন্যাস বৈরাগ্য বা তোমার অষ্টাঙ্গ সাধনাটুকুই কেবল বুঝায় না। ধর্ম্ম অত সহজ বস্তু নয়। ধর্ম্মের ধারা বহুল জটিল। অন্তরাত্মার প্রকাশ নানাভঙ্গিমা সমাজের এক একটি অঙ্গ এক একটি ধারাকে আশ্রয় ক’রে চলেছে, আর সকলে মিলেই ফুটিয়ে তুলেছে একটা পূর্ণ সার্ব্বাঙ্গীন ধর্ম্মের আদর্শ। তুমিই ত স্বীকার করেছ, ধর্ম্মের সাধনা নানা জনের পক্ষে নানা রকম। ব্রাহ্মণের যেমন এক ধর্ম্ম, তেমনি আছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম, তেমনি আছে বৈশ্যের ধর্ম্ম, তেমনি আছে আবার শূদ্রের ধর্ম্ম। ত্যাগ, সংযম, প্রীতি, এ সব এক বিশেষ শ্রেণীর কর্ত্তব্য। এ সব হচ্ছে তাঁদের ধর্ম্ম, যাঁরা সমাজের অন্তরের সম্পদকে বাঁচিয়ে বর্ত্তিয়ে রাখ‍্তে চান। কিন্তু সমাজের দেহ- প্রাণকেও বাঁচিয়ে বর্ত্তিয়ে রাখা চাই—ধনে ঐশ্বর্য্যে শক্তিতে—তাই প্রয়োজন আবার আর এক শ্রেণীর লোক। এই দুটি বিভাগ দুই রকম ধাতুর লোকের উপর ন্যস্ত; অথবা এই দুই রকম কাজ একই সাধকের বিভিন্ন অবস্থায় হতে পারে। কর্ত্তব্য হিসাবে, স্বভাব হিসাবে এই বর্ণ বিভাগ ও আশ্রম বিভাগ যদি না থাকে, তবে সমাজে এসে পড়ে গোলমাল, বিশৃঙ্খলা —পরিণাম তার ধ্বংস।

অশোক

 কিন্তু এ কি দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত সত্যের সমন্বয় করার অসম্ভব চেষ্টা নয়? ভগবান তথাগত এই জন্যেই কি ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন না? এক দিকে ত্যাগ অহিংসা আর এক দিকে ভোগ হিংসা, এই দুই ধারা একই সমাজের বুকে স্থান পেলে সে সমাজ যে খণ্ডিত হয়ে পড়বে, সে সমাজই যে ধ্বংস পাবে তা’ত আশ্চর্য্য নয়। দুটি বিরোধী ধর্ম্মের মধ্যে সামঞ্জস্য চলে না, এদের একটীকেই বরণ ক’রে নিতে হবে। নতুবা গোঁজামিল দিয়ে দুই শত্রুকে একসঙ্গে বেঁধে রাখবার চেষ্টা করলে তার মধ্যে দ্বন্দ্বের বীজ থেকে যাবে। তা ছাড়া সমাজে এ রকম ভেদনীতি বৈষম্য অনর্থক মনান্তর সৃষ্টি করে। শূদ্রের বেদপাঠে অধিকার নাই, আশ্রমের পর আশ্রম পার না হয়ে গেলে মোক্ষসাধনা কেউ কর‍্তে পারবে না—এই যে অন্যায় অসঙ্গত ব্যবস্থা, এরই জন্যে ব্রাহ্মণ্যসমাজের এমন দুর্ব্বলতা ও এমন অধঃপতন।

চন্দ্রগুপ্ত

 বৈষম্য প্রকৃতির নিয়ম—তুমি আমি তা সৃষ্টিও করি নি, তা উল্টাতেও পারি না। প্রত্যেক মানুষের আছে পৃথক পৃথক স্বভাব, এবং সেই স্বভাবকে ভিত্তি করেই যে স্বধর্ম্ম গড়ে ওঠে তাই হয় সতা আর স্বাভাবিক। নিরীহ সাত্ত্বিক কিছু সকলে হতে পারে না, একেবারে সাধু ব’নে যেতে পারে না। কারো থাকে জ্ঞানের বল, কারো থাকে বা শরীরের জোর। কারো প্রতিভা খোলে স্থূল বস্তু নিয়ে নাড়াচাড়া করায়, আর কারো প্রতিভা খোলে সূক্ষ্ম বস্তু নিয়ে। মানুষে মানুষে এ বৈষম্য স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু বৈষম্য থাকলেই যে দ্বন্দ্বও থাকবে এমন কোন কথা নেই। ব্যক্তিগত জীবনে কখন কোন অবস্থায় সে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে, সেটা তার অন্তরে সাধনার কথা। কিন্তু সমাজে সমষ্টিগত জীবনে এ রকম দ্বন্দ্বের স্থান নেই। সামাজিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্যই হচ্ছে এই রকম নানা স্বভাবের জন্য নানা ক্ষেত্র সৃজন ক’রে, একটা উচ্চতর উদ্দেশ্যের লক্ষ্যের সুরে সবগুলিকে বেঁধে রাখা। তোমার আধ্যাত্মিক সাধনা সেই চরম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হ’তে পারে। কিন্তু অধিকারীর স্বভাব অনুসারে সেই সাধনার নানা স্তর ও ভঙ্গী আছে। তাই ত বৈশ্য-শক্তির ক্ষত্রিয়-শক্তির উদ্ভবও প্রয়োজন। আর কিছুর জন্যে না হোক্, সমষ্টিগত আধ্যাত্মিক সাধনার জন্যেই দরকার ঐ দুই শক্তি। দৈন্যের পীড়ন থেকে মুক্ত যে সমাজে আছে প্রাচুর্য্য, অরাজকতা উচ্ছৃঙ্খলতার পরিবর্ত্তে যেখানে চলছে সুনিয়ম ও শান্তি—বৈশ্য ও ক্ষত্রিয় শক্তি যেখানে গড়ে তুলেছে একটা সজীব সুনিবদ্ধ জীবন-আয়তন, সেখানেই ত সম্ভব জ্ঞানের চর্চ্চা, অধ্যাত্মের সাধনা। সমাজের যে অধ্যাত্ম-চূড়া তার গোড়া বেঁধে দিয়েছে একটা সমর্থ বৈশ্য ও ক্ষত্রিয় শক্তি। রাষ্ট্রশক্তি আর কিছু না করুক, তা দেশের গড়ে দেয় ধর্ম্মজীবনের আধিভৌতিক বনিয়াদ।

অশোক

 তা আমি মানি নে। যে রাষ্ট্র ভোগশক্তির, বাহুবলের উপর প্রতিষ্ঠিত তার সমাজের প্রতি অঙ্গে রেখে যায় সেই ভোগবাসনার সেই আসুরী শক্তির ছাপ। তার মধ্যে একটা জাতিগত ধর্ম্ম-শৃঙ্খলা গড়ে উঠ‍্তে পারে না। সমস্ত জাতিটাকে যদি আধ্যাত্মিক ছাঁচে ঢালতে হয়, তবে গোড়া থেকে আরম্ভ করতে হবে, রাষ্ট্রকে একেবারে সম্পূর্ণ নূতন ভিত দিতে হবে। উচ্চ নীচ, ব্রাহ্মণ শূদ্র, পুরুষ নারী প্রত্যেকে যে পুরস্পর বিরোধী ধর্ম্ম নিয়ে চলবে, তা হ’লে হবে না। সবাইকে একই আদর্শে একই পথে একই ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াতে হবে—তবেই সমাজে একটা সঙ্ঘবদ্ধ অটুট জমাট ধর্ম্মশক্তি বাঁধবে।

চন্দ্রগুপ্ত

 তুমি চিরকালই একরোখা একচোখো মানুষ রয়ে গেলে, অশোক! এক সময়ে একটি ভাবের বেশী তোমার মাথায় স্থান পায় না। যখন প্রথমে তুমি ছিলে যোদ্ধা, সম্রাট—তখন তোমার মত আর কেউ বোধ হয় এমন বোঝে নি যে বলং বলং বাহুবলং। আবার যখন তুমি হঠাৎ সাধু হয়ে পড়লে, তখন ত্যাগ অহিংসা করুণা মৈত্রীকে চরম ক’রে আঁকড়ে ধরলে। কিন্তু এই দুইএর কোন ভাবই স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। শক্তি ও প্রীতির সামঞ্জস্য আছে, হতে পারে। আদর্শ মানুষে, আদর্শ সমাজে উভয়েরই সমান স্ফূর্ত্তি। বাহুবল ঘৃণ্য নয়, বাহুবলের সাথে অন্তরাত্মার বলের দ্বন্দ্বই থাক‍্বে এমন কোন কথা নেই। বাহুবলও অন্তরাত্মার বলেরই অভিব্যক্তি হতে পারে। ভারতের প্রাচীন সাধনা দেহের সাথে আত্মার, ঐহিকের সাথে পারত্রিকের একটা সমন্বয় চিরদিনই করে এসেছে। তোমার তথাগত একটা নতুন তথ্য এনে সে সাধনাকে ভেঙ্গে দিয়ে একটা অযথা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তবুও বুদ্ধদেব তাঁর সাধনা নিয়ে একটা আলাদা ক্ষেত্র তৈরী করে তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন—তুমি কিন্তু এক ক্ষেত্রের ধর্ম্মকে আর এক ক্ষেত্রের উপর চাপিয়ে দিয়ে, মঠের সন্ন্যাসের যে সাধনা তাকে সমষ্টিগত জাতীয় জীবনের সাধনায় প্রয়োগ করে ধর্ম্মশঙ্কর সাধনাবিপর্যয় এনেছ মাত্র।

অশোক

 কিন্তু মানুষের এই সাধারণ জীবনের মধ্যেই ত সেই অসাধারণ জীবন ফুটিয়ে ধর‍্তে হবে—কারণ সেই জীবনের, সেই জগতের সত্যই সতা। আমার কর্ত্তব্যই ছিল তাই। ভগবান তথাগত ব্যক্তির অন্তরের জীবনের যে সত্য দিয়েছেন, আমি তাকে সমাজের দেশের জীবনে মূর্ত্ত করে ধরতে চেয়েছি।

চন্দ্রগুপ্ত

 সেখানেই ত তোমার ভুল। তুমি ভুলে যাচ্ছ, তুমি রাজা। যে কাজের কথা তুমি বলছ তা ত রাজার কাজ নয়। সে কাজ ভিক্ষুর, সাধু-সন্ন্যাসীর, ধর্ম্ম-প্রচারকের। তোমার যদি সে কাজেরই উপর টান হয়েছিল, তবে রাজদণ্ড পরিত্যাগ করে, ব্যবহারিক জীবনের ক্ষেত্র থেকে দূরে সরে তা করা উচিত ছিল। বুদ্ধদেব নিজে তাই করেছিলেন। রাজ-সিংহাসনে বসে রাজ-ধর্ম্মই পালন করতে হয়। রাজা হচ্চেন ক্ষত্রশক্তির কেন্দ্র— তাঁর উপর ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম চাপিয়ে, তুমি দুটি বিভিন্ন কর্ম্মক্ষেত্রকে একসঙ্গে জড়িয়ে মিশিয়ে গোলমাল পাকিয়েছ।

অশোক

 রাজধর্ম্ম কি যুদ্ধ বিগ্রহ, ভোগ ব্যসন নিয়ে? দেশের সমাজের যিনি শীর্ষ স্থানে, তিনি যে পথে চলবেন, যে পথ ধরিয়ে দেবেন, সর্ব্বসাধারণে ত সেই পথেই তাঁকে অনুসরণ করবে? রাজা নিজে যদি অসুর হন, তবে প্রজাকে দেবতা হতে বলা কি সম্ভব?

চন্দ্রগুপ্ত

 সৃষ্টির বৈচিত্র্যই মহাসত্য। অসুরের সত্য আছে, দেবতার সত্য আছে, এ জগতের সত্য আছে, ও-জগতের সত্য আছে—প্রত্যেক মানুষের পৃথক পৃথক সত্য আছে। সব সত্যকে একাকার ক’রে নয়, প্রত্যেকের সত্যকে ফুটিয়ে ফলিয়ে সার্থক ক’রে ধর‍্তে পারে যে সত্য, তাই পূর্ণ সত্য।

অশোক

 দার্শনিক তত্ত্ব হিসাবে তোমার কথা সত্য হতে পারে। কিন্তু সেটা হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক লীলা—মানুষের মানুষত্ব প্রকৃতির লীলায় মানুষের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করা।

চন্দ্রগুপ্ত

 মানুষের আদর্শ প্রকৃতির ধর্ম্মকে এড়িয়ে বা জোরজবরদস্তি করে চলতে পারে না প্রকৃতিকে পরিপূর্ণ করাই মানুষের সার্থকতা।

অশোক

 প্রকৃতির জয় করাই মানুষের সাধনা, তাতেই প্রকৃতির যথার্থ পরিপূরণ।