যাঁদের দেখেছি/আট

উইকিসংকলন থেকে

আট

 সাহিত্যে, শিল্পে, সঙ্গীতে— এমন কি অভিনয়েও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবারের দান অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ না করলেও বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকত ঠাকুর-পরিবারের বিস্ময়কর অবদান। ঊনবিংশ শতাব্দীর উত্তরার্ধে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ওখানে আরো যে কয়জন কৃতী মানুষ দেখা দিয়েছেন, তাঁরা হচ্ছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ও স্বর্ণকুমারী। বাংলা দেশের যে কোন পরিবার এতগুলি শক্তিধরকে লাভ করতে পারলে চিরস্মরণীয় হ’তে পারত।

 ১৩৪৪ সালের শেষের দিকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরেই গগনেন্দ্রনাথ ইহলোক ত্যাগ করেন। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর দেশব্যাপী সাড়া পড়ে গিয়েছিল এবং ছোট বড় প্রত্যেক পত্রিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁর সাহিত্যসাধনা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা। কিন্তু শিল্পী গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর কোন সাময়িক পত্রিকাতেই তাঁর আর্ট নিয়ে বিশিষ্ট আলোচনা আমার দৃষ্টিগোচর হয় নি। এর কারণ কি বাঙালী লেখক ও পত্রিকাওয়ালাদের চিত্রকলা সম্বন্ধে অপরিসীম অজ্ঞতা? না চিত্রকলার প্রতি অবহেলা? অথচ সূক্ষ্মবিচারে প্রমাণিত হবে, সাহিত্যে ও চিত্রকলায় যথাক্রমে শরৎচন্দ্রের ও গগনেন্দ্রনাথের প্রতিভা হচ্ছে তুল্যমূল্য।

 গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন তুলি-কলমের ঐন্দ্রজালিক অবনীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ সহোদর। কনিষ্ঠের মত তাঁরও প্রাচ্য চিত্রকলা-পদ্ধতির উপর শ্রদ্ধা ছিল যথেষ্ট এবং ঐ পদ্ধতিতে মাঝে মাঝে তিনিও তুলিকা-চালনা ক’রে উচ্চশ্রেণীর নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্বাধীন মন কোন এক বিশেষ পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে চায় নি। চেষ্টা করলে তাঁর হাতের কাজের ভিতর থেকে জাপানী, চৈনিক ও য়ুরোপীয় প্রভাবও আবিষ্কার করা যেতে পারে। কিন্তু তিনি যেখান থেকে যা-কিছু গ্রহণ করেছেন, দেশী ছাঁচে ঢেলে একেবারে নিজের ক’রে নিতে পেরেছেন। বিলাতী চিত্রকর হুইস্‌লারের (‘আর্ট ফর্ আর্টস্ সেক্’ মন্ত্রের উদ্ভাবক) উপরে পড়েছিল জাপানী প্রভাব, কিন্তু তাঁর ছবি হ’ত য়ুরোপীয় ছবিই।

 গগনেন্দ্রনাথ ‘কিউবিজম্’ নিয়ে আশ্চর্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। য়ুরোপীয় আর্টে ‘কিউবিজম্’ অনেক সময়ে যন্ত্রণাদায়ক উপসর্গের মত হয়ে ওঠে। কিন্তু ‘কিউবিষ্ট’দের পদ্ধতি তিনি এমন সংযত ও যথাযথ ভাবে ব্যবহার করেছেন যে, তাঁর ছবিগুলি কেবল বাংলার উপযোগী হয়েই ওঠে নি, সেইসঙ্গে প্রকাশ করেছে বিচিত্র সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যও। ডক্টর এইচ কজিনসও স্বীকার করেছেন, ‘য়ুরোপের ‘কিউবিষ্ট’রাও এমন চমৎকার ছবি আঁকতে পারে না।’

 বাংলা চিত্রকলায় তাঁর একটি অভিনব দান হচ্ছে, সামাজিক ব্যঙ্গচিত্র। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ চিত্রকর হোগার্থের মত তিনিও নিজের সমাজের অবিচার ও ব্যভিচার প্রভৃতি নিয়ে অনেকগুলি অসাধারণ ছবি এঁকে গিয়েছেন, তার প্রত্যেকখানি শিল্পীর সূক্ষ্ম দৃষ্টি, মুক্ত মন, গভীর চিন্তাশীলতা ও রসমধুর কল্পনার পরিচয় দেয়। প্রত্যেক ছবিতেই পটুয়ার তুলি যে গল্প বলতে চেয়েছে, কোন সেরা লেখকের কলমও তা আরো ভালো ক’রে ফোটাতে পারত না। কেবল বিষয়বস্তুর জন্যে নয়, রেখার খেলার জন্যেও ছবিগুলিকে অনন্যসাধারণ বলতে পারি। এক-একটি তুলির টান যেন রেখায় লেখা এক-একটি কবিতা। শেষোক্ত বিশেষত্বটি গগনেন্দ্রনাথের যে কোন চিত্রে বর্তমান। তিনি ছিলেন যথার্থ কবি-মনের অধিকারী।

 অনেক বছর আগেকার কথা। কিছুকাল গভর্নমেণ্ট আর্ট স্কুলে গিয়ে চিত্রবিদ্যা শিক্ষা করেছিলুম। সেই সময়ে স্কুল-বাড়ীর উপরতলায় প্রাচ্য চিত্রকলার প্রথম প্রদর্শনী খোলা হয়। সেখানে দেখানো হয় প্রাচীন ও আধুনিক দুই রকম ছবিই। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য চিত্রের মধ্যে প্রথম যে যে পার্থক্য চোখে পড়ল তা হচ্ছে এই: বিলাতী ছবি দেখাতে চায় রঙের ঘটা এবং দেশী ছবিতে পাওয়া যায় রেখার সমারোহ। এবং বিলাতী শিল্পীরা হচ্ছেন প্রকৃতির অনুকারী, আর দেশী শিল্পীরা প্রতিকূল না হ’লেও অনুকারী নন।

 বিলাতী পদ্ধতিতে শিক্ষিত এক শিল্পী বন্ধুর সঙ্গে প্রদর্শনীর ছবিগুলি দেখছিলুম। একখানি প্রাচীন চিত্র দেখতে দেখতে আমাদের দুজনের মধ্যে তর্ক বেধে গেল। বন্ধু সে ছবির ভিতরে দেখবার মত কিছুই খুঁজে পেলেন না। আমি চিত্রকরের সূক্ষ্ম তুলির কাজের প্রশংসা করছিলুম। সেই সময়ে একজন প্রিয়দর্শন ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন ঠিক আমাদের পিছনে। মুখ টিপে হাসতে হাসতে তিনি আমাদের তর্কাতর্কি শুনছিলেন। হঠাৎ তিনি বললেন, ‘এই ছবিখানির একটা বিশেষত্ব দেখবেন?’ তাঁর হাতে ছিল একখানা আতশী-কাঁচ, সেখানা তিনি ছবির উপরে ধরলেন। যা দেখলুম, বিস্ময়কর! ছবিখানি খুব ছোট। ছবির মূর্তি আরো। ছোট— দুই ইঞ্চির বেশী বড় হবে না। কিন্তু অতটুকু মূর্তির মাথার চুলগুলি আঁকতে ব’সে পটুয়া কেবল খানিকটা কালো রং বুলিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত হন নি, একমনে ব’সে ব’সে সযত্নে প্রত্যেক চুলগাছি আলাদা আলাদা ক’রে এঁকেছেন! সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকার্য নগ্ন চক্ষে ধরা পড়ে না! বিশেষজ্ঞের মুখে শুনেছি প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকররা অতি সূক্ষ্ম কাজ করতেন যে-রকম তুলি নিয়ে, তাতে থাকত কেবল কাঠবিড়ালের একগাছি চুল! অবাক হয়ে দুই বন্ধুতে দাঁড়িয়ে রইলুম। তারপর ফিরে দেখি, সেই ভদ্রলোক আর একদল দর্শকের কাছে গিয়ে সকলকে আর এক খানা ছবির বিশেষত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। জনসাধারণের অজ্ঞতা দূর করবার জন্যে যাঁর এতটা আগ্রহ, তাঁর নাম জানবার জন্যে মনে জাগল কৌতূহল। শুনলুম তাঁর নাম গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 সেই দিনই প্রদর্শনীতে তাঁর হাতে আঁকা ছবি দেখি সর্বপ্রথমে। মনের মধ্যে আজও জেগে আছে তার সবুজ স্মৃতি। একরত্তি ছবি, তারও সব জায়গায় পড়েনি চিত্রকরের তুলির স্পর্শ। পদ্মানদীর চরে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এক নারীমূর্তি—শ্বেত বসন, কাঁকালে কলসী। সামান্য বিষয়বস্তু, মাত্র গুটিকয় রেখা, কিন্তু তার মধ্যেই পাওয়া গেল অসামান্য ও ইঙ্গিতময় সৌন্দর্যের আশ্চর্য মাধুর্য। একাধারে রেখাচিত্র এবং রেখাকাব্য।

 ঠাকুরবাড়ীতে সর্বপ্রথমে “ফাল্গুনী”র যে অভিনয় আয়োজন হয়, সেখানে চিত্রকর গগনেন্দ্রনাথকে দেখেছিলুম অভিনেতারূপে। তাঁর নাট্যানুরাগও বংশানুক্রমে লব্ধ। বাংলাদেশে প্রথমে যে কয়টি নাট্য-প্রতিষ্ঠান নাট্যকলাচর্চার সূত্রপাত করেছিল, জোড়াসাঁকো নাট্যশালা তাদের মধ্যে একটি প্রধান স্থান অধিকার ক’রে আছে। সেখানে গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘বাবুবিলাস’ নাটক প্রণেতা), গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর) প্রভৃতির চেষ্টায় অভিনয়ের আসর বসত। গগনেন্দ্রনাথও যে সখ ক’রে তাঁদের অনুগামী হবেন, এ হচ্ছে স্বাভাবিক ব্যাপার। কেবল তিনি নন, তাঁর আর দুই সহোদরও (সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ), রঙ্গমঞ্চের উপরে আবির্ভূত হয়েছেন।

 “ফাল্গুনী” পালায় গগনেন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন রাজার ভূমিকা। রঙ্গমঞ্চের উপরে রাজা সেজে আরো কত লোককেই নামতে দেখেছি, কিন্তু সকলকেই নকল রাজা ব’লে মনে হয়েছে। গগনেন্দ্রনাথই প্রথম আমাদের দেখিয়েছিলেন সত্যিকার রাজাকে। তাঁর চলা-ফেরা, ভাবভঙ্গি ও কথাবার্তা সমস্তই হয়েছিল রীতিমত রাজমহিমাব্যঞ্জক। যেমন তাঁকে মানিয়েছিল, তেমনি তাঁর অভিনয়ও হয়েছিল চমৎকার। তারপরেও অন্য পালায় তাঁর নাট্যনৈপুণ্য দেখে বেশ বুঝতে পেরেছি, তিনি ছিলেন একজন উচ্চশ্রেণীর অভিনেতা।

 গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ করবার সুযোগ পেয়েছি ঠাকুরবাড়ীর বহু বৈঠকেই। মাঝে মাঝে আর্ট ও সাহিত্য নিয়েও তাঁর সঙ্গে করেছি অল্পস্বল্প আলোচনা। একদিন ‘কিউবিজ্‌মে’র প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘য়ুরোপের ‘কিউবিষ্ট’রা সকলকে অবাক ক’রে দেবার চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু তাঁদের পদ্ধতি একেবারে নতুন কিছু নয়। অজন্তার ছবি তো কতকাল আগেকার জিনিষ, কিন্তু যার চোখ আছে সে অজন্তার চিত্রাবলীর মধ্যেও স্থানে স্থানে ‘কিউবিজ্‌ম্’কে খুঁজে বার করতে পারবে।’

 তিনি হাস্যরঞ্জিত মুখে শিষ্ট ও মিষ্ট ভাবে সকলের সঙ্গে আলাপ করতেন বটে, কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের মতন মজলিসী মানুষ ছিলেন না। তাঁর হাবভাবে একটা আভিজাত্যের ভাবও থাকত, জনতার ভিতরেও তিনি নিজেকে আলাদা ক’রে রাখতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত “বিচিত্রা”র সাপ্তাহিক আলোচনা-সভায় কোন দিনই তাঁকে অনুপস্থিত দেখি নি, কিন্তু সাধারণতঃ তিনি থাকতেন নির্বাক শ্রোতা হয়ে। কেবল অভিনয়ের আয়োজন হ’লে অংশ গ্রহণ করতেন।

 তাঁর সদাশয়তা ও গুণগ্রাহিতার একটি দৃষ্টান্ত জানি। পৃষ্ঠদেশে দারিদ্র্যের ভার নিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন প্রথম জীবনে যখন একান্তভাবে সাহিত্যসাধনায় নিযুক্ত হয়ে আছেন, তখন তিনি নানাভাবে তাঁকে সাহায্য করবার চেষ্টা করেছেন।

 কিন্তু পৃথিবীতে তাঁর জীবনের শেষ কয়েক বৎসর কেটে গিয়েছে দারুণ এক ট্রাজেডির ভিতর দিয়ে। দেহ লোপ পাবার আগেই মৃত্যু হয়েছিল শিল্পী গগনেন্দ্রনাথের। শেষ জীবনে তিনি পক্ষাঘাত রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁকে চোখে দেখলে কিছু বোঝবার যো ছিল না, দেহ যেন স্বাস্থ্যসুন্দর—চলছেন, ফিরছেন, হাসছেন, গাড়ীতে চ’ড়ে বেড়াতে যাচ্ছেন। কিন্তু কথা কইতেও পারতেন না, ছবি আঁকতেও পারতেন না।

 তাঁর পুত্র শ্রীকনকেন্দ্রনাথ একদিন বললেন, ‘বাবার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তাঁর কোন খাবার খেতে ইচ্ছে হয়েছে। কি খেতে চান সেটা তিনি বার বার লিখে জানাবার চেষ্টা করছেন কিন্তু লিখতে পারছেন না।’

 তাঁর সঙ্গে শেষ যেদিন দেখা হয়, সেদিনের কথাও ভুলি নি। দোতলার বৈঠকখানায় অবনীন্দ্রনাথের কাছে ব’সে আছি আমরা কয় বন্ধু। এ কথা সে কথা হচ্ছে। এমন সময়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন গগনেন্দ্রনাথ। দেখলে কিছুতেই সন্দেহ হয় না যে তাঁর দেহের মধ্যে বাস করছে জীবন্ত মৃত্যু। চিত্রশিল্পী চারু রায় ও আমি গাত্রোত্থান ক’রে তাঁর কাছে গিয়ে প্রণাম করলুম। আমাদের দেখে তাঁর সৌম্য মুখ প্রসন্ন হাস্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, তিনিও সাগ্রহে আমাদের কি বলতে উদ্যত হলেন, কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না,— কেবল তাঁর মুখ দিয়ে নির্গত হ’ল একটা অব্যক্ত শব্দ।

 ব্যাধি ও বার্ধক্যে জর্জরিত হয়ে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা অবনীন্দ্রনাথেরও শেষ জীবন দুঃখময় হয়ে উঠেছে। কেবল ব্যাধি ও বার্ধক্যের দুঃখ নয়, সৃষ্টি করতে না পারার দুঃখ। সেদিন আমাকে দেখে বললেন, ‘হেমেন্দ্র, বড় কষ্ট! লিখতে চাই, আঁকতে চাই, কিন্তু লিখতেও পারি না, আঁকতেও পারি না।”

 শিল্পীর পক্ষে এ হচ্ছে চরম ট্রাজেডি। এই ট্রাজেডির দুঃখ ভোগ করতে করতেই গগনেন্দ্রনাথকে ত্যাগ করতে হয়েছিল মর্তধাম।