যাঁদের দেখেছি/চার

উইকিসংকলন থেকে

চার

 অমৃতলাল ছিলেন আমার পিতৃবন্ধু। বাবার মুখে তাঁর কথা শুনেছি এবং বাবার কেতাবের আলমারিতেও দেখেছি অমৃতলালের দ্বারা উপহৃত ও তাঁর নিজের হাতে সই করা ‘বিবাহ-বিভ্রাট’ প্রভৃতি পুস্তক।

 কিন্তু তাঁর সঙ্গে পরিচিত হবার ও বাক্যালাপ করবার সুযোগ পাই প্রায় যৌবন-সীমা পার হয়ে। তবে তরুণ বয়সেই একবার তাঁর পাশে ব’সে অভিনয় দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল বটে। সে হচ্ছে ১৯০৭ খৃষ্টাব্দের কথা। “কোহিনূর থিয়েটারে”র প্রথম অভিনয়-রজনী, অভিনেয় নাটক ছিল ক্ষীরোদপ্রসাদের “চাঁদবিবি”। রঙ্গালয়ে তেমন জনতা তার আগে আর কখনও দেখি নি। বহুকষ্টে চার টাকা দিয়ে দোতলার ‘ড্রেস-সার্কেলে’র একখানি টিকিট কিনে আসন গ্রহণ করলুম। অভিনয় আরম্ভের খানিকক্ষণ পরে আর একটি ভদ্রলোকের সঙ্গে যখন অমৃতলাল এলেন, প্রেক্ষাগারে তখন কোন আসনই খালি নেই। কাজেই তাঁদের দুজনের জন্যে তাড়াতাড়ি অতিরিক্ত আসনের ব্যবস্থা করা হ’ল এবং অমৃতলাল বসলেন একেবারে আমার পাশেই। তাঁর রুপালী, চিকণ, দীর্ঘ কেশদাম, শ্মশ্রুগুম্ফহীন মুখ ও বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষু আমার কাছে অপরিচিত ছিল না, কারণ তাঁকে একাধিকবার দেখেছি রঙ্গমঞ্চে ও বক্তৃতামঞ্চে। অমৃতলাল সেদিন প্রায় ঘণ্টাখানেক ব’সে অভিনয় দেখলেন এবং দেখতে দেখতে পাশের বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করতে লাগলেন— সাধারণ আলাপ নয়, রীতিমত রসালাপ। বাংলাদেশে আজকাল বোধ হয় সংলাপ করবার শক্তির অভাব হয়েছে। আগে রবীন্দ্রনাথ ও নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে চমৎকার সংলাপ শুনেছি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই শক্তির অধিকারী ছিলেন, কিন্তু ব্যাধি ও বার্ধক্য তাঁর কণ্ঠকে প্রায় বন্ধ ক’রে ফেলেছে। অমৃতলালও অপূর্ব সংলাপের দ্বারা যে কোন আসর একেবারে জমিয়ে তুলতে পারতেন।

 অমৃতলাল প্রথমে ছিলেন নট, তারপর হন নাট্যকার। গিরিশ্চন্দ্রের চেয়ে বয়সে ছোট হয়েও তাঁরও আগে তিনি করেছিলেন নাটক-রচনার জন্যে লেখনীধারণ। বাংলা নাট্যসাহিত্যে প্রহসনে অমৃতলালের জুড়ি কেউ আছেন ব’লে জানিনা। কিন্তু কেবল প্রহসন নয়, তিনি পাঁচ-পাঁচখানি নাটকও রচনা ক’রে গিয়েছেন। গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর ও অমৃতলাল মিত্রের সমকক্ষ না হ’লেও অভিনয়েও তাঁর শক্তি ছিল অসাধারণ। যদিও নিছক গম্ভীর রসে তাঁর দক্ষতা ততটা খুলত না, কিন্তু ‘সিরিয়ো-কমিক’ ভূমিকায় তিনি বিশেষ নিপুণতার পরিচয় দিতে পারতেন। নীলকমল (সরলা), বিহারী খুড়ো (তরুবালা) ও নিতাই (খাসদখল) প্রভৃতি ভূমিকায় তাঁর অভিনয় হ’ত অতুলনীয়। “প্রফুল্ল” নাটকের রমেশের ভূমিকাতেও তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কবিতা রচনাতেও তাঁর হাতযশ ছিল এবং সেক্ষেত্রে তাঁর রচনাশক্তি আধুনিক না হলেও সুমিষ্ট ঘরোয়া শব্দ চয়ন ক’রে তিনি কবিতাগুলিকে উপভোগ্য ক’রে তুলতেন। গান রচনাতেও তাঁর বাহাদুরি ছিল যথেষ্ট এবং তাঁর কয়েকখানি গান অত্যন্ত বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এই হ’ল তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

 ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে আমার রচিত একখানি দুই অঙ্কের কৌতুকনাটিকা (প্রেমের প্রেমারা) মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনয়ের জন্যে নির্বাচিত হয়েছিল। অমৃতলাল তখন উক্ত রঙ্গালয়ের সঙ্গে কোনদিক দিয়ে সম্পর্কিত না হয়েও, পালাটি যেদিন পাঠ করা হয় সেদিন দৈবক্রমে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নাটিকা খানি শুনে খুসি হয়ে তিনি তার মহলার ভার নিজের হাতেই গ্রহণ করতে চান, কোনরকম পারিশ্রমিক না নিয়েই। বলা বাহুল্য, “মিনার্ভার” কর্তৃপক্ষ সাগ্রহে সম্মত হয়েছিলেন তাঁর প্রস্তাবে। সেই সময়েই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় স্থাপনের সুযোগ হয়।

 গিরিশ-যুগে মহলা দেবার পদ্ধতি সম্বন্ধে অনেক কথাই শ্রবণ করেছি, যদিও এ-বিষয়ে বিখ্যাত গিরিশ-অর্ধেন্দু কিভাবে মহলা দিতেন তা দেখবার সৌভাগ্য আমার হয় নি। গিরিশচন্দ্রকে ‘গুরুদেব’ ব’লে স্বীকার করতেন অমৃতলাল এবং গিরিশচন্দ্র যখন ষ্টার থিয়েটারে ছিলেন, তখন গিরিশচন্দ্রের নির্দেশে অনেক সময়ে তিনিই মহলার ভার গ্রহণ করতেন। সুতরাং গিরিশচন্দ্রের সমসাময়িক একজন বিখ্যাত নাট্যাচার্যের মহলা দেওয়ার পদ্ধতি দেখতে পাব ব’লে আমার মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

 তখনকার কয়েকজন প্রসিদ্ধ নট-নটীই আমার নাটকে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন— যেমন মন্মথনাথ পাল (হাঁদুবাবু), কার্তিকচন্দ্র দে, কুসুমকুমারী, চারুশীলা ও শ্রীমতী সুশীলাসুন্দরী প্রভৃতি। শেষোক্ত অভিনেত্রী ছাড়া আর সকলেই এখন স্বর্গত। প্রেক্ষাগারের প্রথম সারের আসনে ব’সে অমৃতলাল মহলা দেখতে লাগলেন এবং দেখতে দেখতে হাস্য-পরিহাসের সঙ্গে বলতে লাগলেন নাট্যশিল্প সম্বন্ধে জ্ঞানগর্ভ নানা কথা। নট-নটীদের প্রবেশ ও প্রস্থান হওয়া উচিত কি রকম, সংলাপের স্বাভাবিকতা ও অস্বাভাবিকতা, মৌলিক কথার সঙ্গে অঙ্গভঙ্গির সঙ্গতি প্রভৃতি নিয়ে এক-একবার মতামত প্রকাশ করেন এবং এক-একবার আলবোলার নলে মুখ লাগিয়ে ধূমপান করতে থাকেন।

 এক জায়গায় চারুশীলার ভূমিকায় একটি গানে ‘আমার হৃদয়দোলা দোদুল দোলে’ এই জাতীয় কি কথা ছিল।

 অমৃতলাল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চারু, হৃদয়-দোলা কেমন ক’রে দোলে দেখাও তো!’

 চারুশীলা লাজুক হাসি হেসে বললেন, ‘আজ্ঞে, আপনি দেখিয়ে দিন না!’

 অমৃতলাল তখনি দেখিয়ে দিলেন, তাঁর জরাজীর্ণ দেহেও সেই সরস ভঙ্গি হ’ল অপূর্ব।

 তারপর ১৩৩৪ সালের শেষের দিকে মিনার্ভা থিয়েটারে যখন অমৃতলালের শেষ নাটক “যাজ্ঞসেনী” খোলবার আয়োজন হয়, তখন তার মহলায় আমি নিয়মিতরূপে হাজির থাকতুম। সেই সময়েই তাঁর মহলা দেবার পূর্ণশক্তি আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলুম। কি পুরুষ-ভূমিকা, কি নারী-ভূমিকা, কি কবিতায়, কি গদ্যে সংলাপ, কি অঙ্গবিন্যাস, কি ভাবাভিব্যক্তি,—প্রত্যেক দিকেই থাকত তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টি এবং প্রত্যেক বিষয়টি তিনি তাঁর নিজের দেহের ও কণ্ঠস্বরের সাহায্যে বিশদ ক’রে তুলতে পারতেন— এমন কি আলোকপাত, দৃশ্যপট ও অঙ্গ সংস্কার বা দেহ-সজ্জা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ না ক’রে ছাড়তেন না।

 “যাজ্ঞসেনী”র মহলার সময়ে এক-একদিন তাঁর সঙ্গে ছোটখাটো আলোচনা করবারও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হইনি।

 একদিন কথাপ্রসঙ্গে বললুম, ‘আপনি এ পালাটিতে মাঝে মাঝে গদ্য, আবার মাঝে মাঝে ভাঙা অমিত্রাক্ষর ছন্দও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আজকালকার অনেক সমালোচক ভাঙা অমিত্রাক্ষর ছন্দ মোটেই পছন্দ করেন না।’

 মুখ থেকে আলবোলার নলটি সরিয়ে অমৃতলাল বললেন, ‘সমালোচকরা পছন্দ না করলে হবে কি, কিন্তু অভিনয়ের পক্ষে ভাঙা অমিত্রাক্ষরের উপযোগিতা যে কতখানি, অত-বড় সাহিত্যিক দ্বিজেন ঠাকুর পর্যন্ত অনেকদিন আগেই তা স্বীকার ক’রে গিয়েছেন। এই ছন্দটি প্রথমে প্রবর্তন করেন আর একজন সাহিত্যিকই, তিনি মহাত্মা কালিপ্রসন্ন সিংহ। তারপর যথাক্রমে রাজকৃষ্ণ রায় আর গিরিশচন্দ্র নাটক রচনায় এই ছন্দটিকে ব্যবহার করেন। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের দ্বারা বার বার ব্যবহৃত হয়েছে ব’লেই এই ছন্দটির প্রচলন এতটা বেড়ে উঠেছে, আর সেই জন্যেই তার নাম দেওয়া হয়েছে “গৈরিশী-ছন্দ।”

 আমি বললুম, ‘কিন্তু কি গিরিশচন্দ্র, কি রাজকৃষ্ণ রায়, আর কি কালিপ্রসন্ন সিংহ, এঁরা কেহই এ-ছন্দের জন্য বাহাদুরি নিতে পারেন না।’

 —‘কেন পারেন না?’

 —‘কারণ এ ছন্দের প্রবর্তক হচ্ছেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা মাইকেল মধুসূদনই।’

 অমৃতলাল সোজা হয়ে ব’সে বললেন, ‘আপনি কি বলছেন!’

 —‘আজ্ঞে হ্যাঁ। মাইকেল তাঁর দ্বিতীয় নাটক ‘পদ্মাবতী’তে সর্বপ্রথমে অভিনয়ের উপযোগী ভাষা খোঁজবার জন্যে ভাঙা অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে স্থানে স্থানে অল্প-স্বল্প পরীক্ষা করেছিলেন। সুতরাং তাঁকেই অনায়াসে এর প্রবর্তক বলা চলে।’

 অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে অমৃতলাল আবার বললেন, ‘আপনি কি বলছেন! এটা কি আপনার শোনা কথা?’

 —‘আজ্ঞে না, নিজের চোখে দেখেই বলছি। আপনিও “পদ্মাবতী” নাটক খুঁজলে অন্ততঃ নয়-দশ জায়গায় ভাঙা অমিত্রাক্ষর ছন্দের নমুনা দেখতে পাবেন।’

 অমৃতলাল উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘দেখব, আজই বাড়ীতে গিয়ে দেখব। কি আশ্চর্য, চোখের সামনে থেকেও এত-বড় কথাটা আজ পর্যন্ত গুপ্তকথা হয়েই আছে, আমাদের কারুরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে নি!’

 অমৃতলাল ছিলেন অত্যন্ত সামাজিক মানুষ। গত যুগের প্রায় প্রত্যেক অভিনেতাই—এমন কি গিরিশচন্দ্র ও অর্ধেন্দুশেখর পর্যন্ত— সত্যকার সামাজিক অনুষ্ঠানকে সাধ্যমত পরিহার ক’রেই চলতেন। কিন্তু অমৃতলালকে দেখেছি আমরা বহু সভা-সমিতিতে এবং সাহিত্যিক ও শিল্পীদের বৈঠকে। যে কোন সভা তাঁর উপস্থিতিতে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠত, কারণ রসালো ভাষায় বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা ছিল তাঁর অসামান্য। ছোট-বড় বৈঠকেও তাঁর মুখ, দিয়ে নির্গত হ’ত যে বাক্য-স্রোত, তা রসের স্রোত বললেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি একাধারে ছিলেন সুরসিক ও সুপণ্ডিত। তাই তাঁর লঘু কৌতুক-ভাষণের মধ্যেও লাভ করা যেত যথেষ্ট চিন্তার খোরাক।

 অধিকাংশ স্থলেই লক্ষ্য করেছি, গত যুগের বড় বড় বা ছোট ছোট অভিনেতারা আধুনিক যুগের অভিনেতাদের তেমন আমল দিতে চান না। কিন্তু অমৃতলাল ছিলেন একেবারেই এ দলের বাইরে। এ কালের অভিনেতাদেরও তিনি অত্যন্ত স্নেহ ও সহানুভূতির চোখে দেখতেন এবং নিজে পুরাতন ধারায় অভ্যস্ত হয়েও কোন দিন তিনি নবযুগের অভিনয়-ধারাকে নিন্দা বা ব্যঙ্গ করতেন না। তিনি সবচেয়ে বেশী প্রশংসা করতেন নবযুগের প্রবর্তক শিশিরকুমারকেই। ১৩১৫ সালের পয়লা আশ্বিনে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ভবনে অর্ধেন্দুশেখরের যে স্মৃতি-সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে বক্তৃতা দিতে উঠে অমৃতলাল বলেছিলেন, ‘পার্টে জীবন দেবার ক্ষমতা ছিল তার (অর্ধেন্দুর) অপূর্ব। এ যুগে দেখতে পাই তা একমাত্র শিশিরের আছে। ‘ষোড়শী’র জীবানন্দের মত wretched part-এ dignity দেওয়া একমাত্র শিশিরেরই সম্ভব।’ “নাট্যমন্দিরে” শিশিরকুমারের বৈঠকে এসেও মাঝে মাঝে তাঁকে আসন গ্রহণ করতে দেখেছি।

 সুরাদেবীর প্রসাদে অমৃতলালের অরুচি ছিল না। একাধিকবার তাঁর কাছে গিয়ে বুঝেছি, তিনি মদ্যপান করেছেন, কিন্তু কখনো তাঁকে মত্ত অবস্থায় দেখিনি। তবে দ্বিজেন্দ্রলালের মত আমাদের চোখের সামনে বসে কোন দিন তিনি সুরার প্রসাদ গ্রহণ করেন নি। যে রামকৃষ্ণদেবকে গিরিশচন্দ্র সাক্ষাৎ ভগবানের অবতার ব’লে পূজা করতেন, তাঁর এবং দক্ষিণেশ্বরের অন্যান্য ভক্তগণের সম্মুখেও তিনি অম্লানবদনে সুরাপান করতে লজ্জিত হন নি। কিন্তু অমৃতলালের বোধ করি কিঞ্চিৎ চক্ষুলজ্জা ছিল। যদিও কাগজেকলমে তিনি এ গোপনতাকে প্রশ্রয় দেন নি। “অমৃত-মদিরা”য় স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন:

‘আমি আর গুরুদেব যুগল ইয়ার,
বিনীর বাড়ীতে গিয়ে খেতাম বিয়ার।’

 ‘গুরুদেব’ হচ্ছেন গিরিশচন্দ্র। ‘বিনী’ হচ্ছেন আগেকার সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিনোদিনী।

 “যাজ্ঞসেনী” অমৃতলালের কেবল শেষ নাটক নয়, শ্রেষ্ঠ নাটক। ঐ পালাটি অভিনীত হবার কিছুদিন পরেই তিনি পৃথিবীর নাট্যশালা থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।