বিষয়বস্তুতে চলুন

যাঁদের দেখেছি/তিন

উইকিসংকলন থেকে

তিন

 বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক উপন্যাস “দুর্গেশনন্দিনী” রচনা ক’রে বঙ্কিমচন্দ্র বিস্মিত করেছিলেন বাঙালীদের। স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস “দীপনির্বাণ”ও বাংলাদেশে অল্প উত্তেজনার সৃষ্টি করে নি। কারণ ওখানি হচ্ছে বাংলাদেশে মহিলা-রচিত প্রথম উপন্যাস। বোধকরি তা রচিত হয় “দুর্গেশনন্দিনীর” কিছুকাল পরেই; তবে এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।

 বাঙালীদের মধ্যে কেবল প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক ব’লেই স্বর্ণকুমারী দেবীর এত নাম নয়। তাঁর রচনা-শক্তি ছিল বহুধা বিভক্ত। তিনি উপন্যাস লিখেছেন, ছোট গল্প লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, বিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তক লিখেছেন, গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন এবং বহুকাল ধ’রে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পত্রিকা “ভারতী” সম্পাদনা করেছেন।

 তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দিদি। রবীন্দ্রনাথের আরো কয়েকজন অগ্রজ রচনাশক্তির জন্যে খ্যাতিলাভ করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁরাও স্বর্ণকুমারীর মত সাহিত্যের নানা বিভাগে হস্তার্পণ করতে পারেন নি। তরুণ বয়স থেকে প্রাচীন বয়স পর্যন্ত তাঁর প্রায় সারা জীবনটাই কেটে গিয়েছিল সাহিত্য-সাধনার ভিতর দিয়েই।

 এমন অনেক মহিলা লেখিকা আছেন যাঁদের রচনার মধ্যে কৃতিত্বের প্রমাণ থাকলেও নারীত্বের পরিচয় পাওয়া যায় না। বোধ হয় তাঁরা মনে মনে নিজেদের পুরুষের সমকক্ষ ভেবে সাবধানে আপন আপন নারীত্বকে গোপন রাখবার চেষ্টা করেন। স্বর্ণকুমারীর রচনায় এই কৃত্রিমতা ছিল না, তার সর্বত্রই প্রকাশ পেয়েছে লেখিকার সুমধুর নারীত্ব। বর্তমান কালে শ্রীমতী নিরূপমা দেবীর রচনার মধ্যেও এই গুণটি বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করি।

 “ভারতীর” সম্পাদিকারূপে তিনি বহু নবীন লেখক তৈরি ক’রে গিয়েছেন। তখনকার অধিকাংশ উদীয়মান লেখক নানাদিক দিয়ে তাঁর কাছে ঋণী— এখানে তাঁদের নাম দেবার চেষ্টা করলুম না, কারণ সে ফর্দ হবে অত্যন্ত দীর্ঘ। আজকালকার নবীন লেখকরা কলম ধ’রেই দক্ষিণা দাবি করেন। কিন্তু সে যুগে যাঁরা অল্পবিস্তর খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁদেরও সাহিত্য-সেবা ছিল স্বার্থহীন। পারিশ্রমিক তো দূরের কথা, তখনকার “ভারতী”, “সাহিত্য”, “প্রদীপ”, “সাধনা”, “বঙ্গদর্শন” (নবপর্যায়) ও “প্রবাসী” প্রভৃতি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় স্থানলাভ করতে পারলেই শক্তিশালী নবীন লেখকরা নিজেদের ভাগ্যবান ব’লে মনে করতেন। এই শ্রেণীর লেখকরা তখন বোধ হয় সব চেয়ে বেশী উৎসাহ ও সহানুভূতি লাভ করতেন স্বর্ণকুমারীর কাছ থেকেই। অন্ততঃ নিজের কথা তো জানি, কখনো মুখে এবং কখনো বা পত্রে তাঁর কাছ থেকে যে কত উৎসাহ ও কত মূল্যবান উপদেশ পেয়েছি, সে কথা আজও ভুলতে পারি নি। তখন আমার বাড়ী থেকে বালীগঞ্জে আসা-যাওয়ার পথ সুগম ছিল না এবং টেলিফোন প্রভৃতিরও এত সুবিধা ছিল না, কিন্তু প্রতি মাসে অন্ততঃ চারপাঁচখানি পত্র লিখে আমার সঙ্গে তিনি সংযোগ স্থাপন করতেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তখনকার অন্যান্য যে সব উদীয়মান লেখক স্বর্ণকুমারীর সংসর্গে এসেছিলেন তাঁরাও একবাক্যে আমার উক্তিরই প্রতিধ্বনি করবেন। কারণ প্রত্যেক নবীন লেখককেই তিনি সমান ভালোবাসতেন। “ভারতী”তে আশ্রয় পেয়েই আমি সর্বপ্রথমে পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তার আগেও আমি কয়েকখানি ছোট-বড় পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলুম বটে, কিন্তু সে ছিল আমার হাত-মক্সের যুগ।

 যতদূর মনে পড়ে, “ভারতী”তে আমার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় ১৩১৫ সালে। উড়িষ্যার শিল্প-সম্পর্কীয় প্রবন্ধ। আমি ঐ শ্রেণীর আরো কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেছি শুনে স্বর্ণকুমারী চিঠি লিখে আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আহ্বান করলেন।

 বালীগঞ্জের ‘সানি-পার্কে’ তাঁর সুসজ্জিত বাসভবন। নির্দিষ্ট দিনে বৈকালবেলায় সেখানে গিয়ে হাজির হলুম। বেয়ারা একতলার একখানা হল-ঘরে নিয়ে গেল। দেওয়ালে শ্রেষ্ঠ চিত্রকরদের আঁকা ছবি, মেঝের উপরে কার্পেট পাতা, সোফা, কৌচ, চেয়ার, টেবিল ও আধুনিক গৃহসজ্জার অন্যান্য মূল্যবান উপকরণের অভাব নেই। যেখানে যেটি মানায় তাই দিয়ে পরিপাটি ক’রে সাজানো।

 স্বর্ণকুমারী দেবী এলেন। বয়স তখন তাঁর পঞ্চাশ পার হয়েছে বোধ হয়, মাথার চুল সাদা হয়ে এসেছে, কিন্তু তখনো তিনি অপরূপ সুন্দরী। যেমন চমৎকার গঠন, তেমনি সুশ্রী মুখ-চোখ, গায়ের রংও পাকা ডালিমের মত। তাঁর মত রূপবতী লেখিকা আমি বাংলাদেশে আর দেখি নি।

 তাঁর সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাবার্তা হবার পর বেয়ারা একথালা খাবার নিয়ে এল। বাড়ীতে তৈরি খাবার।

 স্বর্ণকুমারী বললেন, ‘খাও। তোমার জন্য তৈরি ক’রে রেখেছি।’ তারপর স্নেহময়ী জননীর মত সামনে ব’সে আমাকে একে একে সব খাবার না খাইয়ে ছাড়লেন না।

 তারপর অনেকবার গিয়েছি তাঁর কাছে, কিন্তু কোনবারই খাবার না খেয়ে ফিরি নি। তাঁর কড়া হুকুম ছিল, যাবার আগে তাঁকে চিঠি লিখে জানাতে হবে। একবার কোন খবর না দিয়ে গিয়ে হাজির হয়েছিলুম ব’লে তাঁর সে কি রাগ, কি ভর্ৎসনা! বললেন, ‘এখানে কি খাবারের দোকান আছে, এখন তোমাকে কি খাওয়াই বল তো? কোন খবর পাই নি, তোমার জন্যে খাবারও তৈরি ক’রে রাখি নি।’ তখনকার বালীগঞ্জে এখনকার মত সারি সারি খাবারের দোকান ছিল না।

 আমি বললুম, ‘যেদিন আসি, সেইদিনই তো খাবার খেয়ে যাই, একদিন না-হয় নাইই বা খেলুম!’

 তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘না, ও-সব আমি পছন্দ করি না। এবার খবর না দিয়ে এলে আমি তোমার সঙ্গে দেখাই করব না।’

 এমনি আদর-যত্ন ও মিষ্ট ব্যবহার তাঁর কাছ থেকে লাভ করতেন প্রত্যেক নবীন লেখকই, তিনি কেবল মৌখিক উপদেশ দিয়েই কর্তব্য শেষ করতেন না। তাঁর বাইরে ছিল নব্য বাংলার হাল-ফ্যাসনের সাজ, কিন্তু মনে মনে ছিলেন তিনি চিরন্তন বাংলার খাঁটি গৃহলক্ষ্মীর মত।

 রবীন্দ্রনাথের একটি আশ্চর্য অভ্যাস ছিল। লোকের সঙ্গে আলাপ করবার সময়ে একাসনে একভাবে স্থির হয়ে ব’সে তিনি কাটিয়ে দিতে পারতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই অভ্যাস ছিল স্বর্ণকুমারীরও। তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেও তাঁকে একটু এদিকে বা একটু ওদিকে ফিরে বসতে দেখিনি। তাঁর কোন দৈহিক চাঞ্চল্য ছিল না, প্রসন্নমুখের দৃষ্টি ছিল প্রশান্ত, তিনি কথা কইতেন ধীরে ধীরে মৃদু স্বরে এবং তাঁর গলার আওয়াজও ছিল সুমিষ্ট।

 স্বর্ণকুমারীর বাড়ীতেই মাঝে মাঝে আর একটি হাস্যমুখ তরুণের সঙ্গে দেখা হ’ত, সেই পরিচয় পরে পরিণত হয় বন্ধুত্বে। তখন ছিলেন তিনি প্রাচ্য চিত্রকলার শিক্ষার্থী। এখন তাঁর নাম ভারতবিখ্যাত। তিনি হচ্ছেন শ্রীঅসিতকুমার হালদার। তিনি কেবল লক্ষ্ণৌ চিত্র-বিদ্যালয়ের সর্বাধ্যক্ষ নন, তাঁর হাতে কলমও চলে ভালো।

 সুধাকৃষ্ণ বাগচী নামে এক যুবক স্বর্ণকুমারীকে একবার ভারি বিপদে ফেলেছিল। তার লেখবার সাধ ছিল, কিন্তু সাধ্য ছিল না। তার একখানা পা ছিল কাঠের আর সে যা তা কথা কইতে পারত অনর্গল। কেমন ক’রে সে স্বর্ণকুমারীর স্নেহলাভ করে, তিনি তাকে নিজের বাড়ীতেই আশ্রয় দেন। হঠাৎ পূজার “ভারতী”তে সুধাকৃষ্ণের এক রচনা দেখে আমার চক্ষু স্থির। লেখাটি বঙ্কিমচন্দ্রের “কমলাকান্তের দপ্তর” থেকে বেমালুম চুরি! পত্রে সে কথা স্বর্ণকুমারীকে জানালুম। উত্তরে তিনি লিখলেন—‘হেমেন্দ্র, লজ্জায় আমার মুখ দেখানো দায় হয়ে উঠেছে। হয়তো সবাই ভাবছে “ভারতী”র মত পত্রিকার সম্পাদিকা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা পড়েন নি! কিন্তু কি করব বল, বঙ্কিমচন্দ্রের রচনার ল্যাজা-মুড়ো বাদ দিয়ে সুধাকৃষ্ণ এমনভাবে আমাকে শোনালে, আমি কিছুই ধরতে পারি নি। সুধাকৃষ্ণকে আমার বাড়ী থেকে চ’লে যেতে বলেছি।’ এই সুধাকৃষ্ণ বড় গুণী ছেলে। পরে সে “জাহ্নবী”র (নবপর্যায়) সম্পাদক হয় এবং আমার একখানি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি চুরি ক’রে নিজের নামে পুস্তকাকারে ছাপিয়ে দেয়। সে এখন ইহলোকে নেই।

 স্বর্ণকুমারী একবার আমার উপরেও রাগ করেছিলেন। প্রায় সাঁইত্রিশ বৎসর আগেকার কথা। গোমো জংসনে ডি-কষ্টা নামে এক অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোকের মস্ত একখানি বাংলো ছিল, সেইখানে গিয়ে আমি দুই মাসকাল কাটিয়ে এসেছিলুম। বাংলো খানির অবস্থান বড় চমৎকার, একেবারে আমার মনের মত। কাছে লোকালয় নেই। চারিদিকে নিবিড় বনানীর মর্মরমুখর শ্যামলতা। বাংলোর হাতা যেখানে শেষ হয়েছে, সেইখান থেকেই আরম্ভ হয়েছে পাহাড়ের পর পাহাড়, এবং তাদের কোল ঘেঁষে চ’লে গিয়েছে নদীতে যাবার পায়ে হাঁটা পথ। আরো দূরে তাকালে সর্বদাই দেখা যায় মেঘচুম্বী পরেশনাথ পাহাড়, শিখরে যার শুভ্র মন্দিরমুকুট। চোখের সামনেই দেখতুম বনে বনে মৃগযুথের নয়নমোহন বিচরণ। সেখান থেকে ফিরে এসে স্বর্ণকুমারীর কাছে বাংলোখানির বর্ণনা ক’রে বলেছিলুম, বাড়ীখানা ডি-কষ্টা সাহেব বিক্রী করতে চান। আমার মুখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে বাংলোখানি কেনবার জন্যে তিনি উৎসাহিত হ’য়ে উঠলেন। তার কয়েকদিন পরেই স্বয়ং বাংলোখানি দেখে এসে তিনি আমাকে যে চিঠি লিখেছিলেন তার মর্মার্থ হচ্ছে এই: ‘হেমেন্দ্র, তুমি কি আমাকে ডাকাতের হাতে সমর্পণ করতে চাও, না হিংস্র জন্তুর জঠরে পাঠাতে চাও? যা দেখে এলুম, তা বাংলো না বাঘের বাসা? পালিয়ে আসবার পথ পাই না। এ তোমার সাংঘাতিক কবিত্ব!’

 স্বর্ণকুমারী সম্বন্ধে আরো অনেক গল্প বলতে পারি, কিন্তু আপাততঃ এখানে স্থানাভাব। কেবল তাঁর সঙ্গে শেষ-দেখার কথা ব’লে এ-প্রসঙ্গ শেষ করব।


 শুনেছি কুচবিহারের রাজকন্যার সঙ্গে তিনি নিজের পুত্রের বিবাহ দিয়েছিলেন ব’লে তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কারণ তাঁর পরিবারের কেউ যে ব্রাহ্মণেতর জাতির সঙ্গে বিবাহের সম্পর্ক স্থাপন করেন, এটা তিনি পছন্দ করতেন না। কথাটা কতখানি সত্য তা জানি না। কিন্তু স্বর্ণকুমারীর মনেও যে শেষ পর্যন্ত নিজের ব্রাহ্মণত্বের গর্ব পুরোপুরি বিদ্যমান ছিল, নীচের কাহিনীটিই তার প্রমাণ।

 বৈদ্যবাটী যুবক সমিতি স্বর্ণকুমারীর জন্যে এক অভিনন্দন-সভার আয়োজন করে এবং আমি সেখানে একটি স্বরচিত কবিতা পাঠের জন্যে আহূত হই। স্বর্ণকুমারী তখন অতি প্রাচীনা। সভার শেষে তিনি আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘হেমেন্দ্র, তোমার “ঝড়ের যাত্রী” উপন্যাস পড়লুম।’

 শুধোলুম, ‘আপনার কেমন লাগল?’

 —‘উপন্যাস হিসাবে ভালোই লাগল, কিন্তু তুমি বামুনের মেয়েকে নায়িকা ক’রে নমঃশূদ্র নায়কের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছ কেন?’

 —‘আমার কি করা উচিত ছিল?’

 —‘বৈদ্য জাতের মেয়ের সঙ্গে নমঃশূদ্র ছেলের বিবাহ দিলে না কেন?’

 আমি জাতে বৈদ্য। আমাদের জাতের মেয়ের সঙ্গে নমঃশূদ্রের বিবাহ দিলে তাঁর কোনই আপত্তি থাকত না, কারণ তিনি নিজে ব্রাহ্ম হ’লেও ব্রাহ্মণ-কন্যা!