যোগাযোগ/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
◄  ৩৬
৩৮  ►

৩৭

 এতদিন মধুসূদনের জীবনযাত্রায় কখনো কোনো খেই ছিঁড়ে যেত না। প্রতি দিনের প্রতি মুহূর্তই নিশ্চিত নিয়মে বাঁধা ছিল। হঠাৎ একটা অনিশ্চিত এসে সব গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছে। এই যে আজ আপিস থেকে বাড়ির দিকে চলেছে, রাত্তিরটা যে ঠিক কী ভাবে প্রকাশ পাবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। মধুসূদন ভয়ে-ভয়ে বাড়িতে এল, আস্তে আস্তে আহার করলে। আহার করে তখনই সাহস হল না শোবার ঘরে যেতে। প্রথমে কিছুক্ষণ বাইরের দক্ষিণের বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। শোবার সময় নটা যখন বাজল তখন গেল অন্তঃপুরে। আজ ছিল দৃঢ় পণ—যথাসময়ে বিছানায় শোবে, কিছুতেই অন্যথা হবে না। শূন্য শোবার ঘরে ঢুকেই মশারি খুলেই একেবারে ঝপ করে বিছানার উপরে পড়ল। ঘুম আসতে চায় না। রাত্রি যতই নিবিড় হয় ততই ভিতরকার উপবাসী জীবটা অন্ধকারে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। তখন তাকে তাড়া করবার কেউ নেই, পাহারাওআলারা সকলেই ক্লান্ত।

 ঘড়িতে একটা বাজল, চোখে একটুও ঘুম নেই। আর থাকতে পারল না, বিছানা থেকে উঠে ভাবতে লাগল কুমু কোথায়? বঙ্কু ফরাশের উপর কড়া হুকুম, ফরাশখানা তালাচাবি দিয়ে বন্ধ। ছাদ ঘুরে এল, কেউ নেই। পায়ের জুতো খুলে ফেলে নীচের তলায় বারান্দা বেয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। মোতির মার ঘরের সামনে এসে মনে হল যেন কথাবার্তার শব্দ। হতে পারে কাল চলে যাবে আজ স্বামীস্ত্রীতে পরামর্শ চলছে। বাইরে চুপ করে দরজায় কান পেতে রইল। দুজনে গুন গুন করে আলাপ চলছে। কথা শোনা যায় না কিন্তু স্পষ্টই বোঝা গেল দুটিই মেয়ের গলা। তবে তো বিচ্ছেদের পূর্বরাত্রে মোতির মায়ের সঙ্গে কুমুরই মনের কথা হচ্ছে। রাগে ক্ষোভে ইচ্ছে করতে লাগল, লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে একটা কাণ্ড করে। কিন্তু নবীনটা তাহলে কোথায়? নিশ্চয় বাইরে।

 অন্তঃপুর থেকে বাইরে যাবার ঝিলমিল-দেওয়া রাস্তাটাতে লণ্ঠনে একটা টিম্‌টিমে আলো জ্বলছে, সেইখানে এসেই মধুসূদন দেখলে একখানা লাল শাল গায়ে জড়িয়ে শ্যামা দাঁড়িয়ে। তার কাছে লজ্জিত হয়ে মধুসূদন রেগে উঠল। বললে, “কী করছ এত রাত্রে এখানে?”

 শ্যামা উত্তর করলে “শুয়ে ছিলুম। বাইরে পায়ের শব্দ শুনে ভয় হল, ভাবলুম বুঝি—

 মধুসূদন তর্জন করে বলে উঠল, “আস্পর্ধা বাড়ছে দেখছি। আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেয়ো না, সাবধান করে দিচ্ছি। যাও শুতে।”

 শ্যামাসুন্দরী কয়দিন থেকে একটু একটু করে তার সাহসের ক্ষেত্র বাড়িয়ে বাড়িয়ে চলছিল। আজ বুঝলে, অসময়ে অজায়গায় পা পড়েছে। অত্যন্ত করুণ মুখ করে একবার সে মধুসূদনের দিকে চাইলে—তার পরে মুখ ফিরিয়ে আঁচলটা টেনে চোখ মুছলে। চলে যাবার উপক্রম করে আবার সে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ডেকে বলে উঠল, “চালাকি করব না ঠাকুরপো। যা দেখতে পাচ্ছি তাতে চোখে ঘুম আসে না। আমরা তো আজ আসি নি, কতকালের সম্বন্ধ, আমরা সইব কী করে?” বলে শ্যামা দ্রুতপদে চলে গেল।

 মধুসূদন একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তার পরে চলল বাইরের ঘরে। ঠিক একেবারে পড়ল চৌকিদারের সামনে, সে তখন টহল দিতে বেরিয়েছে। এমনি নিয়মের কঠিন জাল যে, নিজের বাড়িতে যে চুপি চুপি সঞ্চরণ করবে তার জো নেই। চারি দিকেই সতর্ক দৃষ্টির ব্যূহ। রাজাবাহাদুর এই রাত্রে বিছানা ছেড়ে খালি পায়ে অন্ধকারে বাইরের বারান্দায় ভূতের মতো বেরিয়েছে এ যে একেবারে অভূতপূর্ব। প্রথমে দূর থেকে যখন চিনতে পারে নি, চৌকিদার বলে উঠেছিল, “কোন্ হ্যায়?” কাছে এসে জিভ কেটে মস্ত প্রণাম করলে; বললে, “রাজাবাহাদুর, কিছু হুকুম আছে?”

 মধুসুদন বললে, “দেখতে এলুম ঠিকমতো চলছে কি না।” কথাটা মধুসূদনের পক্ষে অসংগত নয়।

 তার পরে মধুসূদন বৈঠকখানাঘরে গিয়ে দেখে, যা ভেবেছিল তাই, নবীন বসবার ঘরে গদির উপর তাকিয়া আঁকড়ে নিদ্রা দিচ্ছে। মধুসূদন ঘরে একটা গ্যাসের আলো জ্বেলে দিলে, তাতেও নবীনের ঘুম ভাঙল না। তাকে ঠেলা দিতেই ধড়ফড় করে জেগে সে উঠে বসল। মধুসূদন তার কোনোরকম কৈফিয়ত তলব না করেই বললে, “এখনই যা, বড়োবউকে বল্ গে আমি তাকে শোবার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছি।” বলে তখনই সে অন্তঃপুরে চলে গেল।

 কিছুক্ষণ পরেই কুমু শোবার ঘরে এসে প্রবেশ করলে। মধুসূদন তার মুখের দিকে চাইলে। সাদাসিধে একখানি লালপেড়ে শাড়ি পরা। শাড়ির প্রান্তটি মাথার উপরে টানা। এই নির্জন ঘরের অল্প আলোয় এ কী অপরূপ আবির্ভাব। কুমু ঘরের প্রান্তের সোফাটির উপরে বসল।

 মধুসূদন তখনই এসে বসল মেজের উপরে তার পায়ের কাছে। কুমু সংকুচিত হয়ে তাড়াতাড়ি ওঠবার চেষ্টা করবামাত্র মধুসূদন হাতে ধরে তাকে টেনে বসালে; বললে, “উঠো না, শোনো আমার কথা। আমাকে মাপ করো, আমি দোষ করেছি।”

 মধুসূদনের এই অপ্রত্যাশিত বিনতি দেখে কুমু অবাক হয়ে রইল। মধুসূদন আবার বললে, “নবীনকে মেজোবউকে রজবপুরে যেতে আমি বারণ করে দেব। তারা তোমার সেবাতেই থাকবে।”

 কুমু কী যে বলবে কিছুই ভেবে পেলে না। মধুসূদন ভাবলে, নিজের মান খর্ব করে আমি বড়োবউয়ের মান ভাঙব। হাত ধরে মিনতি করে বললে, “আমি এখনই আসছি, বলো তুমি চলে যাবে না।”

 কুমু বললে, “না, যাব না।”

 মধুসূদন নীচে চলে গেল। মধুসূদন যখন ক্ষুদ্র হয়, কঠোর হয়, তখন সেটা কুমুদিনীর পক্ষে তেমন কঠিন নয়। কিন্তু আজ তার এই নম্রতা, এই তার নিজেকে খর্ব করা, এর সম্বন্ধে কুমুর যে কী উত্তর তা সে ভেবে পায় না। হৃদয়ের যে-দান নিয়ে সে এসেছিল সে তো সব স্খলিত হয়ে পড়ে গেছে, আর তো তা ধুলো থেকে কুড়িয়ে নিয়ে কাজ চলবে না। আবার সে ঠাকুরকে ডাকতে লাগল, “প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢ়ুম্।”

 খানিক বাদে মধুসূদন নবীন ও মোতির মাকে সঙ্গে নিয়ে কুমুর সামনে উপস্থিত করলে। তাদের সম্বোধন করে বললে, “কাল তোমাদের রজবপুরে যেতে বলেছিলাম, কিন্তু তার দরকার নেই। কাল থেকে বড়োবউয়ের সেবায় আমি তোমাদের নিযুক্ত করে দিচ্ছি।”

 শুনে ওরা দুজনে অবাক হয়ে গেল। একে তো এমন হুকুম প্রত্যাশা করে নি, তার পরে এত রাত্তিরে ওদের ডেকে এনে এ কথা বলবার জরুরি দরকার কী ছিল।

 মধুসূদনের ধৈর্য সবুর মানছিল না। আজ রাত্তিরেই কুমুর মনকে ফেরাবার জন্যে উপায় প্রয়োগ করতে কার্পণ্য বা সংকোচ করতে পারলে না। এমন করে নিজের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ সে জীবনে কখনো করে নি। সে যা চেয়েছিল তা পাবার জন্যে তার পক্ষে সব চেয়ে দুঃসাধ্য মূল্য সে দিলে, তার ভাষায় সে কুমুকে বুঝিয়ে দিলে, তোমার কাছে আমি অসংকোচে হার মানছি।

 এইবার কুমুর মনে বড়ো একটা সংকোচ এল, সে ভাবতে লাগল এই জিনিসটাকে কেমন করে সে গ্রহণ করবে? এর বদলে কী আছে তার দেবার? বাইরে থেকে জীবনে যখন বাধা আসে তখন লড়াই করবার জোর পাওয়া যায়, তখন স্বয়ং দেবতাই হন সহায়। হঠাৎ সেই বাইরের বিরুদ্ধতা একেবারে নিরস্ত হলে যুদ্ধ থামে কিন্তু সন্ধি হতে চায় না। তখন বেরিয়ে পড়ে নিজের ভিতরের প্রতিকূলতা। কুমু হঠাৎ দেখতে পেলে, মধুসূদন যখন উদ্ধত ছিল তখন তার সঙ্গে ব্যবহার অপ্রিয় হোক তবুও তা সহজ ছিল; কিন্তু মধুসূদন যখন নম্র হয়েছে তখন তার সঙ্গে ব্যবহার কুমুর পক্ষে বড়ো শক্ত হয়ে উঠল। এখন তার ক্ষুব্ধ অভিমানের আড়াল থাকে না, তার সেই ফরাশখানার আশ্রয় চলে যায়, এখন দেবতার কাছে হাত জোড় করবার কোনো মানে নেই।

 মোতির মাকে কোনো ছুতোয় কুমু যদি রাখতে পারত তা হলে সে বেঁচে যেত। কিন্তু নবীন গেল চলে, হতবুদ্ধি মোতির মাও আস্তে আস্তে চলল তার পিছনে; দরজার কাছে এসে একবার মুখ আড় করে উদ্বিগ্নভাবে কুমুদিনীর মুখের দিকে চেয়ে গেল। স্বামীর প্রসন্নতার হাত থেকে এই মেয়েটিকে এখন কে বাঁচাবে?

 মধুসূদন বললে, “বড়োবউ, কাপড় ছেড়ে শুতে আসবে না?”

 কুমু ধীরে ধীরে উঠে পাশের নাবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলে— মুক্তির মেয়াদ যতটুকু পারে বাড়িয়ে নিতে চায়। সে-ঘরে দেওয়ালের কাছে একটা চৌকি ছিল সেইটেতে বসে রইল। তার ব্যাকুল দেহটা যেন নিজের মধ্যে নিজের অন্তরাল খুঁজছে। মধুসূদন মাঝে মাঝে দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকায় আর হিসেব করতে থাকে, কাপড় ছাড়বার জন্যে কতটা সময় দরকার। ইতিমধ্যে আয়নাতে নিজের মুখটা দেখলে মাথার তেলোর যে-জায়গাটাতে কড়া চুলগুলো বেমানান-রকম খাড়া হয়ে থাকে বৃথা তার উপরে কয়েকবার বুরুশের চাপ লাগালে, আর গায়ের কাপড়ে অনেকখানি দিলে ল্যাভেণ্ডার ঢেলে।

 পনেরো মিনিট গেল; বেশ-বদলের পক্ষে সে-সময়টা যথেষ্ট। মধুসূদন চুপি চুপি একবার নাবার ঘরের দরজার কাছে কান দিয়ে দাঁড়াল, ভিতরে নড়াচড়ার কোনো শব্দ নেই—মনে ভাবলে কুমু হয়তো চুলটার বাহার করছে, খোঁপাটা নিয়ে ব্যস্ত। মেয়েরা সাজ করতে ভালোবাসে মধুসূদনেরও এ-আন্দাজটা ছিল, অতএব সবুর করতেই হবে। আধঘণ্টা হল—মধুসূদন আর-একবার দরজার উপর কান লাগালে, এখনও কোনো শব্দ নেই। ফিরে এসে কেদারায় বসে পড়ে খাটের সামনের দেয়ালে বিলিতি যে-ছবিটা ঝোলানো ছিল তার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ এক সময়ে ধড়ফড় করে উঠে রুদ্ধ দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ডাক দিলে, “বড়োবউ, এখনও হয় নি?”

 একটু পরেই আস্তে আস্তে দরজা খুলে গেল। কুমুদিনী বেরিয়ে এল, যেন সে স্বপ্নে-পাওয়া। যে-কাপড় পরা ছিল তাই আছে; এ তো রাত্রে শোবার সাজ নয়। গায়ে একখানা প্রায় পুরো হাত-ওয়ালা ব্রাউন রঙের সার্জের জামা, একটা লালপেড়ে বাদামি রঙের আলোয়ানের আঁচল মাথার উপর টেনে-দেওয়া। দরজার একটা পাল্লায় বাঁ হাত রেখে যেন কী দ্বিধার ভাবে দাঁড়িয়ে রইল—একখানি অপরূপ ছবি। নিটোল গৌরবর্ণ হাতে মকরমুখো প্লেন সোনার বালা—সেকেলে ছাঁদের— বোধ হয় এককালে তার মায়ের ছিল। এই মোটা ভারী বালা তার সুকুমার হাতকে যে-ঐশ্বর্যের মর্যাদা দিয়েছে সেটি ওর পক্ষে এত সহজ যে, ওই অলংকারটা ওর শরীরে একটুমাত্র আড়ম্বরের সুর দেয় নি। মধুসূদন ওকে আবার যেন নতুন করে দেখলে। ওর মহিমায় আবার সে বিস্মিত হল। মধুসূদনের চিরার্জিত সমস্ত সম্পদ এতদিন পরে শ্রীলাভ করেছে এ-কথা না মনে করে সে থাকতে পারলে না। সংসারে যে-সব লোকের সঙ্গে মধুসূদনের সর্বদা দেখাসাক্ষাৎ তাদের অধিকাংশের চেয়ে নিজেকে ধনগৌরবে অনেক বড়ো মনে করা তার অভ্যাস। আজ গ্যাসের আলোতে শোবার ঘরের দরজার পাশে ওই যে মেয়েটি স্তব্ধ দাঁড়িয়ে তাকে দেখে মধুসূদনের মনে হল, আমার যথেষ্ট ধন নেই; মনে হল, যদি রাজচক্রবর্তী সম্রাট হতুম তা হলেই ওকে এ-ঘরে মানাত। যেন প্রত্যক্ষ দেখতে পেলে, এর স্বভাবটি জন্মাবধি লালিত একটি বিশুদ্ধ বংশমর্যাদার মধ্যে—অর্থাৎ এ যেন এর জন্মের পূর্ববর্তী বহু দীর্ঘকালকে অধিকার করে দাঁড়িয়ে। সেখানে বাইরে থেকে যে-সে প্রবেশ করতেই পারে না—সেখানেই আপন স্বাভাবিক স্বত্ব নিয়ে বিরাজ করছে বিপ্রদাস— তাকেও ওই কুমুর মতোই একটি আত্মবিস্মৃত সহজ গৌরব সর্বদা ঘিরে রয়েছে।

 মধুসূদন এই কথাটাই কিছুতে সহ্য করতে পারে না। বিপ্রদাসের মধ্যে ঔদ্ধত্য একটুও নেই, আছে একটা দূরত্ব। অতিবড়ো আত্মীয়ও যে হঠাৎ এসে তার পিঠ চাপড়িয়ে বলতে পারে “কী হে, কেমন?” এ যেন অসম্ভব। বিপ্রদাসের কাছে মধুসূদন মনে মনে কী-রকম খাটো হয়ে থাকে সেইটেতে তার রাগ ধরে। সেই একই সূক্ষ্ম কারণে কুমুর উপরে মধুসূদন জোর করতে পারছে না—আপন সংসারে যেখানে সব চেয়ে তার কতৃত্ব করবার অধিকার সেইখানেই সে যেন সব চেয়ে হটে গিয়েছে। কিন্তু এখানে তার রাগ হয় না— কুমুর প্রতি আকর্ষণ দুর্নিবার বেগে প্রবল হয়ে ওঠে। আজ কুমুকে দেখে মধুসূদন স্পষ্টই বুঝলে, কুমু তৈরি হয়ে আসে নি—একটা অদৃশ্য আড়ালের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, কী সুন্দর। কী একটা দীপ্যমান শুচিতা, শুভ্রতা। যেন নির্জন তুষারশিখরের উপরে নির্মল উষা দেখা দিয়েছে।

 মধুসূদন একটু কাছে এগিয়ে এসে ধীর স্বরে বলল, “শুতে আসবে না বড়োবউ?”

 কুমু আশ্চর্য হয়ে গেল। সে নিশ্চয় মনে করেছিল, মধুসূদন রাগ করবে, তাকে অপমানের কথা বলবে। হঠাৎ একটা চিরপরিচিত সুর তার মনে পড়ে গেল—তার বাবা স্নিগ্ধ গলায় কেমন করে তার মাকে বড়োবউ বলে ডাকতেন। সেই সঙ্গেই মনে পড়ল, মা তার বাবাকে কাছে আসতে বাধা দিয়ে কেমন করে চলে গিয়েছিলেন। এক মুহূর্তে তার চোখ ছলছলিয়ে এল—মাটিতে মধুসূদনের পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে উঠল, “আমাকে মাপ করো।”

 মধুসূদন তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে তুলে চৌকির উপরে বসিয়ে বললে, “কী দোষ করেছ যে তোমাকে মাপ করব?”

 কুমু বললে, “এখনও আমার মন তৈরি হয় নি। আমাকে একটুখানি সময় দাও।”

 মধুসূদনের মনটা শক্ত হয়ে উঠল; বললে, “কিসের জন্যে সময় দিতে হবে বুঝিয়ে বলো।”

 “ঠিক বলতে পারছি নে, কাউকে বুঝিয়ে বলা শক্ত—”

 মধুসূদনের কণ্ঠে আর রস রইল না। সে বললে, “কিছুই শক্ত না। তুমি বলতে চাও, আমাকে তোমার ভালো লাগছে না।”

 কুমুর পক্ষে মুশকিল হল। কথাটা সত্যি অথচ সত্যি নয়। হৃদয় ভরে নৈবেদ্য দেবার জন্যেই সে পণ করে আছে, কিন্তু সে নৈবেদ্য এখনও এসে পৌঁছল না। মন বলছে, একটু সবুর করলেই, পথে বাধা না দিলে, এসে পৌঁছবে; দেরি যে আছে তাও না। তবুও এখনও ডালা যে শূন্য সে-কথা মানতেই হবে।

 কুমু বললে, “তোমাকে ফাঁকি দিতে চাই নে বলেই বলছি, একটু আমাকে সময় দাও!”

 মধুসুদন ক্রমেই অসহিষ্ণু হতে লাগল—কড়া করেই বললে, “সময় দিলে কী সুবিধে হবে। তোমার দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে স্বামীর ঘর করতে চাও!”

 মধুসূদনের তাই বিশ্বাস। সে ভেবেছে বিপ্রদাসের অপেক্ষাতেই কুমুর সমস্ত ঠেকে আছে। দাদা যেমনটি চালাবে, ও তেমনি চলবে। বিদ্রূপের সুরে বললে, “তোমার দাদা তোমার গুরু!”

 কুমুদিনী তখনই মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “হ্যাঁ, আমার দাদা আমার গুরু।”

 “তাঁর হুকুম না হলে আজ কাপড় ছাড়বে না, বিছানায় শুতে আসবে না। তাই নাকি?”

 কুমুদিনী হাতের মুঠো শক্ত করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

 “তাহলে টেলিগ্রাফ করে হুকুম আনাই,— রাত অনেক হল।”

 কুমু কোনো জবাব না দিয়ে ছাতে যাবার দরজার দিকে চলল।

 মধুসূদন গর্জন করে ধমকে উঠে বললে, “যেয়ো না বলছি।”

 কুমু,তখনই ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, “কী চাও, বলো।”

 “এখনই কাপড় ছেড়ে এস।” ঘড়ি খুলে বললে, “পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি।”

 কুমু তখনই নাবার ঘরে গিয়ে কাপড় ছেড়ে শাড়ির উপর একখানা মোটা চাদর জড়িয়ে চলে এল। এখন দ্বিতীয় হুকুমের জন্যে তার অপেক্ষা। মধুসূদন দেখে বেশ বুঝলে এও রণসাজ; রাগ বেড়ে উঠল, কিন্তু কী করতে হবে ভেবে পায় না। প্রবল ক্রোধের মুখেও মধুসূদনের মনে ব্যবস্থাবুদ্ধি থাকে; তাই সে থমকে গেল। বললে, “এখন কী করতে চাও আমাকে বলো।”

 “তুমি যা বলবে তাই করব।”

 মধুসূদন হতাশ হয়ে বসে পড়ল চৌকিতে। ওই চাদরে-জড়ানো মেয়েটিকে দেখে মনে হল, এ যেন বিধবার মূর্তি—ওর স্বামী আর ওর মাঝখানে যেন একটা নিস্তব্ধ মৃত্যুর সমুদ্র। তর্জন করে এ সমুদ্র পার হওয়া যায় না। পালে কোন্ হাওয়া লাগলে তরী ভাসবে? কোনো দিন কি ভাসবে?

 চুপ করে বসে রইল। ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া ঘরে একটুও শব্দ নেই। কুমুদিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল না—আবার ফিরে বাইরে ছাতের অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে ছবির মতো দাঁড়িয়ে রইল। রাস্তার মোড় থেকে একটা মাতালের গদ্‌গদ কণ্ঠের গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, আর প্রতিবেশীর আস্তাবলের একটা কুকুরের বাচ্ছাকে বেঁধে রেখেছে, রাত্রির শান্তি ঘুলিয়ে দিয়ে উঠছে তারই অশ্রান্ত আর্তনাদ।

 সময় একটা অতলস্পর্শ গর্তের মতো শূন্য হয়ে যেন হাঁ করে আছে। মধুসূদনের সংসারের কলের সমস্ত চাকাই যেন বন্ধ। কাল তার আপিসের অনেক কাজ, ডাইরেকটারদের মীটিং,—কতকগুলো কঠিন প্রস্তাব অনেকের বাধা সত্ত্বেও কৌশলে পাস করিয়ে নিতে হবে। সে-সমস্ত জরুরি ব্যাপার আজ তার কাছে একেবারে ছায়ার মতো। আগে হলে কালকের দিনের কার্যপ্রণালী আজ রাত্রে নোটবইয়ে টুকে রাখত। সব চিন্তা দূরে গেল, জগতে যে কঠিন সত্য সুনিশ্চিত সে হচ্ছে চাদর দিয়ে ঢাকা ওই মেয়ে, ঘরের থেকে বেরিয়ে যাবার পথে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে। খানিক বাদে মধুসূদন একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, ঘরটা যেন ধ্যান ভেঙে চমকে উঠল। দ্রুত চৌকি থেকে উঠে কুমুর কাছে গিয়ে বললে, “বড়োবউ, তোমার মন কি পাথরে-গড়া?”

 ওই বড়োবউ শব্দটা কুমুর মনে মন্ত্রের মতো কাজ করে। নিজের মধ্যে তার মায়ের জীবনের অনুবৃত্তি হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই ডাকে তার মা কতদিন কত সহজে সাড়া দিয়েছিলেন, তারই অভ্যাসটা যেন কুমুরও রক্তের মধ্যে। তাই চকিতে সে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। মধুসূদন গভীর কাতরতার সঙ্গে বললে, “আমি তোমার অযোগ্য, কিন্তু আমাকে কি দয়া করবে না?”

 কুমুদিনী ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “ছি ছি, অমন করে ব’লো না।” মাটিতে পড়ে মধুসূদনের পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, “আমি তোমার দাসী, আমাকে তুমি আদেশ করো।”

 মধুসূদন তাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলে, বললে, “না, তোমাকে আদেশ করব না, তুমি আপন ইচ্ছাতে আমার কাছে এস।”

 কুমুদিনী মধুসূদনের বাহুবন্ধনে হাঁপিয়ে উঠল। কিন্তু নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলে না। মধুসূদন রুদ্ধ প্রায় কণ্ঠে বললে, “না, তোমাকে আদেশ করব না, তবু তুমি আমার কাছে এস।” এই বলে কুমুদিনীকে ছেড়ে দিলে।

 কুমুদিনীর গৌরবর্ণ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে চোখ নিচু করে বললে, “তুমি আদেশ করলে আমার কর্তব্য সহজ হয়। আমি নিজে ভেবে কিছু করতে পারি নে।”

 “আচ্ছা, তুমি তোমার ওই গায়ের চাদরখানা খুলে ফেলো—ওটাকে আমি দেখতে পারছি নে।”

 সসংকোচে কুমুদিনী চাদরখানা খুলে ফেললে। গায়ে ছিল একখানি ডুরে শাড়ি, সরু পাড়ের। কালো ডোরার ধারাগুলি কুমুদিনীর তনুদেহটিকে ঘিরে, যেন তারা রেখার ঝরনা— থেমে আছে মনে হয় না, কেবলই যেন চলছে—যেন কোনো একটি কালো দৃষ্টি আপন অশ্রান্ত গতির চিহ্ন রেখে রেখে ওর অঙ্গকে ঘিরে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে, কিছুতে শেষ করতে পারছে না। মুগ্ধ হয়ে গেল মধুসূদন, অথচ সেই মুহূর্তে একটু লক্ষ্য না করে থাকতে পারলে না যে, ওই শাড়িটি এখানকার দেওয়া নয়। কুমুদিনীকে যতই মানাক না কেন, এর দাম তুচ্ছ এবং এটা ওর বাপের বাড়ির। ওই নাবার ঘরের সংলগ্ন কাপড় ছাড়বার ঘরে আছে দেরাজওয়ালা মেহগিনি কাঠের মস্ত আলমারি, তার আয়নাদেওয়া পাল্লা—বিবাহের পূর্ব হতেই নানা রকমের দামি কাপড়ে ঠাসা। সেগুলির উপরে লোভ নেই—মেয়ের এত গর্ব! মনে পড়ে গেল সেই তিনটে আংটির কথা, অসহ্য ঔদাসীন্যে তাকে কুমু গ্রহণ করে নি, অথচ একটা লক্ষ্মীছাড়া নীলার আংটির জন্যে কত আগ্রহ। বিপ্রদাস আর মধুসূদনের মধ্যে কুমুর মমতার কত মূল্যভেদ। চাদর খোলবামাত্র এই সমস্ত কথা দমকা ঝড়ের মতো মধুসূদনকে প্রকাণ্ড ধাক্কা দিলে। কিন্তু হায় রে, কী সুন্দর, কী আশ্চর্য সুন্দর। আর এই দৃপ্ত অবজ্ঞা, সেও যেন ওর অলংকার। এই মেয়েই তো পারে ঐশ্বর্যকে অবজ্ঞা করতে। সহজ সম্পদে মহীয়সী হয়ে জন্মেছে—ওকে ধনের দাম কষতে হয় না, হিসেব রাখতে হয় না—মধুসূদন ওকে কী দিয়ে লোভ দেখাতে পারে।

 মধুসূদন বললে, “যাও তুমি শুতে যাও।”

 কুমু ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল—নীরব প্রশ্ন এই যে, তুমি আগে বিছানায় যাবে না?

 মধুসূদন দৃঢ়স্বরে পুনরায় বললে, “যাও আর দেরি কোরো না।” কুমু বিছানায় যখন প্রবেশ করলে মধুসূদন সোফার উপরে বসে বললে, “এইখানেই বসে রইলুম, যদি আমাকে ডাক তবেই যাব। বৎসরের পর বৎসর অপেক্ষা করতে রাজি আছি।”

 কুমুর সমস্ত গা এল ঝিম ঝিম করে—এ কী পরীক্ষা তার! কার দরজায় সে আজ মাথা কুটবে? দেবতা তো তাকে সাড়া দিলেন না। যে-পথ দিয়ে সে এখানে এল সে তো একেবারেই ভুল পথ। বিছানায় বসে বসে মনে-মনে সে বললে, “ঠাকুর, তুমি আমাকে কখনও ভোলাতে পার না, এখনও তোমাকে বিশ্বাস করব। ধ্রুবকে তুমিই বনে এনেছিলে, বনের মধ্যে তাকে দেখা দেবে বলে।”

 সেই নিস্তব্ধ ঘরে আর শব্দ নেই; রাস্তার মোড়ে সেই মাতালটার গলা শোনা যায় না; কেবল সেই বন্দী কুকুরটা যদিও শ্রান্ত তবু মাঝে মাঝে আর্তনাদ করে উঠছে।

 অল্প সময়কেও অনেক সময় বলে মনে হল, স্তব্ধতার ভারগ্রস্ত প্রহর যেন নড়তে পারছে না। এই কি তার দাম্পত্যের অনন্তকালের ছবি? দু পারে দুজনে নীরবে বসে—রাত্রির শেষ নেই—মাঝখানে একটা অলঙ্ঘনীয় নিস্তব্ধতা! অবশেষে এক সময়ে কুমু তার সমস্ত শক্তিকে সংহত করে নিয়ে বিছানা থেকে বেরিয়ে এসে বললে, “আমাকে অপরাধিনী কোরো না।”

 মধুসূদন গম্ভীরকণ্ঠে বললে, “কী চাও বলো, কী করতে হবে?” শেষ কথাটুকু পর্যন্ত একেবারে নিংড়ে বের করে নিতে চায়।

 কুমু বললে, “শুতে এস।”

 কিন্তু একেই কি বলে জিত?