বিষয়বস্তুতে চলুন

রবীন্দ্রনাথ (১৯৬০)/৪

উইকিসংকলন থেকে

নানা কারণে ১৩০২ সালে ‘সাধনা’ কাগজখানি উঠিয়া গেল। তখন চৈতালির আরম্ভ হইয়াছে— ১৩০২-এর চৈত্র মাসেই চৈতালির অধিকাংশ কবিতা রচিত হইয়াছে।

 এই সময়ের কতকগুলি চিঠি হইতে বেশ বুঝিতে পারি এই জীবনের মধ্যে কবি অসম্পূর্ণতা কোথায় বোধ করিতেছিলেন। কেবলমাত্র কবির বা শিল্পীর জীবনের মধ্যে, আপনার দিকে, আপনার ভোগের দিকে সমস্ত টানিয়া রাখিবার ভাব আছে। সেই জন্য অধিকাংশ কবির জীবনে কাব্যটাই প্রধানতঃ দেখিবার বিষয়, জীবনটা নয়। এক দিক দিয়া দেখিতে গেলে জীবনের বিচিত্রতার মধ্যে কবিদের যেমন প্রবেশ এমন কোনো মহাপুরুষেরও নয়— কল্পনার তীব্র আলোকের দ্বারা ইঁহারা মানব-প্রকৃতির যত জটিলতা যত রহস্যের ভিতরে গিয়া পৌঁছেন এমন আর কেহই যাইতে পারেন না— তথাপি ইঁহাদের জীবনটা সকল হইতে নির্লিপ্ত আপনার ভাবলোকের মধ্যেই অবস্থান করে। তাহার কারণ জীবনকে কবিরা সৃষ্টির দিক্ হইতে দেখেন, তাই পুরাপুরি বাস্তবের মধ্যে ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া ভালোয় মন্দে উত্থানে পতনে জীবনকে বড় করিয়া, শক্ত করিয়া, সত্য করিয়া গড়িবার সাধনা তাঁহাদের অবলম্বন করা কঠিন হয়। ততটুকু বাস্তব ইঁহাদের পক্ষে প্রয়োজন যতটুকু নহিলে ভাব আপনার জোর পায় না, আপনার প্রতিষ্ঠা পায় না। ব্রাউনিঙের Abt Vogler নামক কবিতায় মিডিভ্যাল গায়কের ন্যায় শিল্পীদের জীবনে কল্পনায় অকস্মাৎ সমস্ত বাস্তব আপনার সীমারূপ পরিহার করিয়া অখণ্ড-গীতস্বর্গলোকে উঠিয়া পড়ে বটে, কিন্তু কল্পনার পরিপূর্ণ মুহূর্তের অবসানে অবসাদের অতলতায় তলাইয়া যায়— জীবনের চারি দিকে তখন আনন্দের কোনো বার্তাই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

 সেই জন্য আমার মনে হয় যে, শিল্পপ্রাণ জীবন কখনোই আধ্যাত্মিক জীবনের স্থান অধিকার করিতে সমর্থ হয় না— শিল্প মানুষের চরম আশ্রয় নহে। আত্মার যাত্রাপথে সমস্ত খণ্ড আশ্রয় একে একে খসিয়া পড়িতে বাধ্য।

 অথচ ইহাও দেখা যায় যে, মানুষ যখনই কোনো খণ্ড সত্যকে নিত্য সত্যের আসন দেয়, তখন তাহার পক্ষ হইয়া অনেক বাজে ওকালতি করিয়া থাকে। ইউরোপের একদল শিল্পী আর্টের বাড়া আর কিছুই দেখিতে পান না— ধর্মকে ‘ডগ্ মা’ অর্থাৎ মত মাত্র মনে করিয়া ইঁহারা বলিতে চান যে আর্টেই জীবন্ত ধর্মের প্রকাশ—কারণ সমস্ত জিনিসকে তাহার নিত্য সত্যে ও নিত্য সৌন্দর্যে দেখাই আর্টের প্রধানতম কাজ।

 রবীন্দ্রনাথও এক সময়ে এই আর্টের জীবনের খুব ভিতরে ছিলেন বলিয়া এ-সকল কথা ঠিক এই দিক দিয়াই ভাবিতেন। তাহার প্রমাণ একটি পত্রে পাই:

 ‘সমস্ত প্রকৃতির সঙ্গে আমার যে খুব একটা নিগূঢ় অন্তরঙ্গ সত্যিকার সজীব সম্পর্ক আছে... সেই প্রীতি সেই আত্মীয়তাকেই... আমি যথার্থ সর্বোচ্চ ধর্ম ব’লে জ্ঞান এবং অনুভব করি।... আমার যে ধর্ম এটা নিত্য ধর্ম, এর উপাসনা নিত্য উপাসনা। কাল রাস্তার ধারে একটা ছাগমাতা গম্ভীর অলস স্নিগ্ধভাবে ঘাসের উপর বসে ছিল এবং তার ছানাটা তার গায়ের উপর ঘেঁষে পরম নির্ভয়ে গভীর আরামে পড়ে ছিল— সেটা দেখে আমার মনে যে একটা সুগভীর রসপরিপূর্ণ প্রীতি এবং বিস্ময়ের সঞ্চার হল আমি সেইটেকেই আমার ধর্মালোচনা বলি— এই সমস্ত ছবিতে চোখ পড়বা মাত্রই সমস্ত জগতের ভিতরকার আনন্দ এবং প্রেমকে আমি অত্যন্ত প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎভাবে আমার অন্তরে অন্তরে অনুভব করি— এ ছাড়া অন্যান্য যা কিছু dogma আছে যা আমি কিছুই জানি নে এবং বুঝি নে এবং বোঝবার সম্ভাবনা দেখি নে তা নিয়ে আমি কিছুমাত্র ব্যস্ত হই নে।’

 অথচ শিল্প দর্শন ধর্ম প্রভৃতি সমস্তই যে অধুনা ক্রমশ মিলিবার পথে চলিয়াছে এবং এ-সকল ভিন্ন ভিন্ন সাধনার সমন্বয় করাই যে পরিপূর্ণ জীবনের আদর্শ হইয়া উঠিতেছে, ইউরোপীয় কোনো কোনো ভাবুকের লেখায় আজকাল এমনতর আভাস পাওয়া যায়। তাহার কারণ এই যে, খুব সম্প্রতি নানা কারণে ইউরোপীয় মন বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছে যে বৈচিত্র্যকে সাজাইলেই তাহাকে মেলানো হয় না— তাহাতে বৈচিত্র্যের ভেদচিহ্নগুলি সমানই থাকিয়া যায়। একমাত্র আধ্যাত্মিকতার অখণ্ড বোধের মধ্যেই সমস্ত ভেদের বিলোপ এবং সমস্ত বৈচিত্র্যের মিলন ঘটিতে পারে।

 কবীরের বচন আছে:

জো তন পায়া  খণ্ড দেখায়া
তৃস্না নহীঁ বুঝানী।
অমৃত ছোড়  খণ্ড রস চাখা
তৃস্না তাপ তপানী।

অর্থাৎ যে তনুলাভ করিয়াছে সে খণ্ড দেখিয়াই চলিয়াছে, তাহার তৃষ্ণা আর মিটে না। অমৃত ছাড়িয়া সে খণ্ডরসই পান করিতেছে, তৃষ্ণা তাহাকে সন্তপ্ত করিয়াই চলিয়াছে।

 খণ্ডতাকে জোড়া দিয়া বড় আকার দান করিবার দিকে আপনার চেষ্টাকে প্রয়োগ করিবার জন্য ইউরোপে শিল্পসাধনাও অন্যান্য সাধনার ন্যায় আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সম্মিলিত হইয়া পূর্ণ হইয়া উঠে নাই । সে “অমৃত ছোড় খণ্ডরস চাখা”। হয়তো তাহার ভিতরকার কারণ, ইউরোপ যে ধর্ম পাইয়াছে তাহার অসম্পূর্ণতা; যে জন্য উত্তরোত্তর বিকাশমান জ্ঞানের সাধনা ও সৌন্দর্যের সাধনার সঙ্গে সে ধর্ম আপনার যোগকে স্থাপিত করিতে অক্ষম হইয়া বরাবর বাহিরেই পড়িয়া গিয়াছে। বাস্তবিকই খ্রীস্টধর্মের মধ্যে অদ্বৈততত্ত্বের অভাব থাকিবার জন্য সে কিছুই মিলাইতে পারিতেছে না— ভেদবুদ্ধির দ্বন্দ্বযুদ্ধে তত্ত্বের রাজ্য খণ্ড খণ্ড হইয়া যাইতেছে— সেইজন্যই আধুনিক কালে কি আর্টে, কি দর্শনে, খ্রীস্টধর্মকে নূতন করিয়া গড়িয়া সকল বিরোধের মিলনসেতুস্বরূপ দাঁড় করাইবার জন্য পুনরায় ইউরোপের মধ্যে বিপুল প্রয়াস লক্ষিত হইতেছে ।

 আমার এত কথা বলিবার অভিপ্রায় আর কিছুই নয়, কেবল এই যে, আর্টের জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি যদি আধ্যাত্মিক জীবনে না হয় তবে মাঝখানের অভিব্যক্তিটাই আমরা দেখিতে পাই খুব জাঁকালো রকম— তখন এমন একটা নদীর দীর্ঘ বিচিত্র ধারা আমরা দেখি যাহার কোনো শান্তিসমুদ্রের মধ্যে অবসান ঘটে নাই, হঠাৎ এক জায়গায় যাহার ধারা বালুমরুর মধ্যে শোষিত হইয়া গিয়াছে।

 সুতরাং আর্টের ভিতর হইতে মানবজীবনের পরিপুর্ণতার আদর্শ দেখিতে পাইলেও এ ভুল যেন না করি যে ইহাই পর্যাপ্ত— ধর্মের আর কোনো প্রয়োজন নাই, সে ‘ডগ মা’ অথবা শুষ্ক মত মাত্র। ইহা মনে রাখিতে হইবে যে, অনুভূতি এবং প্রকাশ এক জিনিস এবং জীবন অন্য জিনিস। আর্টের প্রকাশও এক জায়গায় থামিয়া নাই— জীবনের গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে সেও বিচিত্র হইয়াই চলে। আর্টের স্বাভাবিক পরিণাম আধ্যাত্মিকতায় ছাড়া হইতেই পারে না— নদীর যেমন স্বাভাবিক অবসান সমুদ্রে।

 আমার বিশ্বাস ‘সোনার তরী’ ও ‘চিত্রা’র জীবন হইতে বিদায় লইবার প্রধান কারণ কেবলমাত্র শিল্পময় জীবনের অসম্পূর্ণতা কবিকে ভিতরে ভিতরে বেদনা দিতেছিল।

 ইহার সঙ্গে আর একটি কারণও আমার মনে হয়, বড় কর্মক্ষেত্রের অভাব। অবশ্য পরিপূর্ণ জীবনের অভাববোধেরই তাহা অন্তর্গত। জমিদারি ব্যবস্থার কর্ম খুব বড় করিয়া করিলেও তাহাতে সম্পূর্ণ আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা হয় না। সে কর্মের মধ্যে স্বার্থের একটা সংকীর্ণ দিক আছে, সুতরাং অনেক বিষয়ে আপনাকে কষ্ট দিয়া এবং আপনার আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করিয়া চলিতে বাধ্য হইতে হয়। যে কর্ম সমস্ত মানুষের যোগে সম্পন্ন হয়, যাহা কোনো সংকীর্ণ প্রয়োজনের সীমায় আবদ্ধ নহে, যাহার ফল দূর ভবিষ্যতের মধ্যে নিহিত, যাহার নিকটে সম্পূর্ণভাবে আত্মোৎসর্গ করিয়া মানুষ মঙ্গলের আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া উঠে, তেমন একটি বিস্তীর্ণ কর্মের ক্ষেত্র কবির পক্ষে একান্ত প্রয়োজন ছিল। আমাদের দেশে নাকি তেমন কোনো বৃহৎ কর্মের প্রতিষ্ঠান নাই, সেইজন্য আমরা পরে দেখিতে পাইব যে তাঁহাকে নিজের চেষ্টায় সেই রকম একটি কর্মক্ষেত্র, একটি তপস্যার ক্ষেত্র রচনা করিতে হইয়াছে।

 সাধনা কাগজখানিতে রবীন্দ্রনাথের যে অত উৎসাহ ছিল তাহার ও প্রধান কারণ, সকল দিক হইতে দেশকে ভাবাইবার ও মাতাইবার একটা আকাঙ্ক্ষা তাঁহার মনকে অধিকার করিয়াছিল। সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন— সকল বিষয়েই একজন লোকের একাধারে লেখনী চালনা করার মতো বিস্ময়কর ব্যাপার কোনো দেশের কোনো সাহিত্যিকের জীবনের ইতিহাসে দেখা গিয়াছে কি না সন্দেহ। দেশে কোনো বড় অনুষ্ঠান কি প্রতিষ্ঠান ছিল না এ কথা বলা অন্যায় হইবে। কন্গ্রেস কন্ফারেন্স প্রভৃতি ছিল। কিন্তু ইহাদের প্রতি তাঁহার অন্তরের শ্রদ্ধা বা অনুরাগ ছিল না, সেইজন্য ইহাদের মধ্যে নিজের স্থান করিয়া লইতে তিনি কখনোই আগ্রহ বোধ করেন নাই। প্রথমতঃ, দেশের ইতিহাসের সঙ্গে ইহাদের কোনো সম্বন্ধ নাই, পশ্চিমের ইতিহাসের অন্ধ অনুকরণের উপরেই ইহাদের প্রতিষ্ঠা; দ্বিতীয়তঃ, দেশের যথার্থ মঙ্গলকর্মের সঙ্গে ইহাদের কোনো যোগ ছিল না, কেবল ‘আবেদন আর নিবেদনের থালা বহে বহে নতশির’। সুতরাং এমন শূন্য ভিক্ষাবৃত্তির দ্বারা কর্মের অভাবের দীনতাকে দূর করা চলে না বলিয়াই কন্গ্রেস কন্ফারেন্স প্রভৃতির উপরে, সাধনাতে লিখিবার কালে, কবির সুতীব্র একটি অবজ্ঞা ছিল।

 আমার তো কবির পূর্বজীবনের সঙ্গে বিচ্ছেদের এই দুইটিই প্রধান কারণ বলিয়া মনে হয়— আর্টের জীবনে সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি মিলিতেছিল না, এবং একটি বড় ত্যাগের ক্ষেত্রে আপনাকে উৎসর্গের দ্বারা জীবনকে বড় করিয়া পাইবার তৃষ্ণা জাগিতেছিল।

 আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে ‘চিত্রা’র সময়ের দু-একটি চিঠির ভিতরেও এই কথার সাক্ষ্য পাই। একটা চিঠির কিছু অংশ এইখানে দিলাম:

 ‘হৃদয়ের প্রাত্যহিক পরিতৃপ্তিতে মানুষের কোনো ভালো হয় না, তাতে প্রচুর উপকরণের অপব্যয় হয়ে কেবল অল্প সুখ উৎপন্ন করে এবং কেবল আয়োজনেই সময় চলে যায়, উপভোগের অবসর থাকে না। কিন্তু ব্রতযাপনের মতো জীবন যাপন করলে দেখা যায় অল্প সুখও প্রচুর সুখ এবং সুখই একমাত্র সুখকর জিনিস নয়। চিত্তের দর্শন স্পর্শন শ্রবণ মনন-শক্তিকে যদি সচেতন রাখতে হয়, যা কিছু পাওয়া যায় তাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করবার শক্তিকে যদি উজ্জ্বল রাখতে হয়, তা হলে হৃদয়টাকে সর্বদা আধপেটা খাইয়ে রাখতে হয়— নিজেকে প্রাচুর্য থেকে বঞ্চিত করতে হয়।··· কেবল হৃদয়ের আহার নয়, বাইরের সুখস্বাচ্ছন্দ্য জিনিসপত্রও আমাদের অসাড় ক’রে দেয়— বাইরে সমস্ত যখন বিরল তখনি নিজেকে ভালো রকমে পাওয়া যায়।···

 ‘কিন্তু তপস্যা আমার স্বেচ্ছাকৃত নয়, সুখ আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয়, তবু বিধাতা যখন বলপূর্বক আমাকে তপশ্চরণে প্রবৃত্ত করিয়েছেন তখন বোধ হয় আমার দ্বারা তিনি একটা বিশেষ কিছু ফল পেতে চান— শুকিয়ে গুঁড়িয়ে পুড়ে ঝুড়ে সবশেষে বোধ হয় এ জীবনের থেকে একটা কিছু কঠিন জিনিস থেকে যাবে। মাঝে মাঝে তার আবছায়া রকম অনুভব পাই।’

 কল্পনা, কথা, কাহিনী, ক্ষণিকা এ কাব্যগুলি প্রায় একই সময়ের লেখা— ১৩০৪ হইতে ১৩০৭ এর মধ্যে। ১৩০৮-এ নৈবেদ্য প্রকাশিত হইয়াছে। কল্পনা কথা প্রভৃতিতে দেশবোধের সূচনা মাত্র আছে; নৈবেদ্য হইতে তাহার প্রকৃত আরম্ভ। কল্পনা কথা প্রভৃতির রচনার মধ্যে বর্তমানের বন্ধন হইতে আপনাকে ছিন্ন করিয়া প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের মধ্যে এবং কাব্য পুরাণের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবার একটা চেষ্টা লক্ষ করা যায়।

 এই চেষ্টার ভিতরে একটি বেদনা আছে। সন্ধ্যার ছায়াটি পড়িয়া আসিয়াছে, রূপকথার রাজপ্রাসাদের ভগ্নমহাল-মালার ন্যায় পশ্চিমদিগন্তে অস্তমান রবির সিন্দুররাগ অস্পষ্টপ্রায়, অন্ধকারসমুদ্রের উপরে শুভ্রপালখচিত স্বপ্নতরীর মতো দু-একটি তারা ভাসিয়া উঠিতেছে— সেই সময়ে অজানালোকের সৌন্দর্যরহস্যের অস্পষ্ট-আভাসের যেমন এক দিকে আনন্দ, অন্য দিকে তেমনি চিরপরিচিত দিবসের বিদায়ের একটি ম্লান বিষাদ— ‘কল্পনা’য় অতীতকালের স্বপ্নসৌন্দর্যবয়নের মধ্যে সেই রকমের একটি মিশ্রিত পুলকবেদনা জড়িত হইয়া আছে।

 সত্যই সন্ধ্যা আসিয়াছে। ‘চিত্রা’ ‘সোনার তরী’র জীবনের কাছে বিদায়! এখন নূতন জীবনের যাত্রায় পক্ষ বিস্তার করিয়া দিতে হইবে, কিন্তু হায়, কোন্ পথে কোন্ ভাবলোকে যে নূতন করিয়া উড়িতে হইবে তাহার কোনো ঠিকঠিকানা নাই।

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা,
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা ।

বাস্তবিক বড় একটি সকরুণ বিষাদের সঙ্গে ‘কল্পনা’য় বারবার পিছন ফিরিয়া গত জীবনের সমস্ত প্রিয় জিনিসগুলির দিকে কবিকে তাকাইতে হইতেছে:

কোথা রে সে তীর ফুলপল্লবপুঞ্জিত,
কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা।

 “ভ্রষ্টলগ্ন” কবিতাটিতে আপনার সেই সৌন্দর্যের মধ্যে গূঢ়নিবিষ্ট মাধুর্যময় জীবনটি রূপকথার রাজবালার নানা সাজসজ্জা অলঙ্কার প্রসাধন- সখীদের নানা মধুর লীলার রূপকে মণ্ডিত হইয়া যখন ব্যর্থতার কান্না কাঁদিতেছে তখন তাহার মধ্যে বড় একটি করুণা আছে! যে নূতন জীবন নবীন পথিকের মতো রাজপথে দেখা দিতেছে, ইচ্ছা থাকিলেও সেই প্রাসাদের শতসহস্র বেষ্টন ভেদ করিয়া তাহার কাছে আত্মপরিচয় দেওয়া ঘটিয়া উঠিতেছে না, লগ্ন বারবার ভ্রষ্ট হইয়া যাইতেছে— শেষকালে হতাশ প্রাণ কাঁদিয়া বলিতেছে:

রয়েছি বিজন রাজপথ-পানে চাহি,
বাতায়নতলে বসেছি ধূলায় নামি,
ত্রিযামা যামিনী একা বসে গান গাহি,
‘হতাশ পথিক, সে যে আমি, সেই আমি।’

 পূর্বজীবনকে বিদায় দিবার এই দীর্ঘনিশ্বাস সকল কবিতার মধ্যেই আছে।

 “বিদায়” কবিতাটিতে যখন ‘সময় হয়েছে নিকট এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে,’ তখন মনে জাগিতেছে:

অরুণ তোমার তরুণ অধর,
করুণ তোমার আঁখি
অমিয়রচন সোহাগবচন
অনেক রয়েছে বাকি।

 “অশেষ” কবিতাটিতেও ঐ ক্রন্দন। সমস্ত কাজকর্ম চুকাইয়া যখন জীবনের বিশ্রামের সময় উপস্থিত, তখন কেন— ‘আবার আহ্বান’? কতদিন বসিয়া বসিয়া কত বিচিত্র আয়োজনে জীবনটিকে এক রকম করিয়া পূর্ণ করা হইয়া গিয়াছে— তাহার স্বাভাবিক পরিণাম ছিল একটি স্তব্ধবিরল বিশ্রামের মধ্যে— কেন সেই বিশ্রাম হইতে তাহাকে বঞ্চিত করিয়া নূতন পথে আবার ঠেলিয়া দেওয়া?

রহিল রহিল তবে— আমার আপন সবে,
আমার নিরালা,

মোর সন্ধ্যাদীপালোক, পথ-চাওয়া ছুটি চোখ,
যত্নে গাঁথা মালা।···
রাত্রি মোর, শান্তি মোর, রহিল স্বপ্নের ঘোর,
সুস্নিগ্ধ নির্বাণ—
আবার চলিনু ফিরে বহি ক্লান্ত নত শিরে
তোমার আহ্বান।

 এখানে একটি কথা বলিয়া রাখি যে, কবির জীবনের তরফ হইতেই এ-সকল কবিতাকে যে পড়িতে হইবে তাহা মনে করা ভুল। ‘অশেষ’ কবিতাটি যে কবির জীবনের এক অবস্থা হইতে অবস্থান্তরে যাইবার বেদনাকে প্রকাশ করিতেছে মাত্র তাহা নহে। আমরা যেখানেই যে আশ্রয়কে শেষ মনে করিয়া দাঁড়ি টানিতে চাহিয়াছি সেখানেই সেই শেষের মধ্যে অশেষের ডাক আসিয়া পৌঁছিয়াছে— সে কি কর্মে কি ধর্মে, কি রাষ্ট্রচেষ্টায় কি শিল্পসৃষ্টিতে, কি বিজ্ঞানে কি দর্শনে— আমাদের কোথাও থামিবার জো নাই— মত হইতে মতান্তরে, কত অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের ভাঙাগড়া কত বিদ্রোহ-বিপ্লবের মধ্য দিয়া, কত বৃহৎ হইতে বৃহত্তর সত্যের আবিষ্কারে আমাদিগকে ক্রমাগতই যাত্রা করিতে হইতেছে। সেইজন্যই কোনো পাশ্চাত্য কবি বলিয়াছেন:

 Out of the fruition of success shall come forth something which will make a greater struggle necessary. কৃতকার্যতার সার্থক মূর্তির ভিতর হইতে এমন কিছু বাহির হইয়া পড়িবেই পড়িবে যাহা গভীরতর দ্বন্দ্বকে জাগাইয়া তুলিবে।

 জীবনে আমাদের খণ্ড-সফলতার ক্ষণ-সমাপ্তির মধ্যে অনেকবার ক্রন্দন করিয়া বলিতে হয়:

আবার চলিনু ফিরে  বহি ক্লান্ত নত শিরে
তোমার আহ্বান।

 ‘কল্পনা’র এই বিদায়ের বিষণ্ণ সুর অকস্মাৎ “বর্ষশেষে”র ঝড়ের কবিতায় কবির বীণাতন্ত্রে ‘খরতর ঝঙ্কারঝঞ্ঝনা’য় আহত হইয়া লুপ্ত হইয়া গেল। পুরাতন ক্লান্ত বর্ষের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিরও পুরাতন কাব্যজীবনকে বিদায় দেওয়া হইল।

 প্রতি বৎসরে যে ‘নূতন’ বসন্তের আবেশহিল্লোলে মর্মরিত কূজনে গুঞ্জনে আসিয়া উপস্থিত হয়, সেবার বর্ষশেষের ঝড়ের দিনে সেভাবে তাহার আবির্ভাব হয় নাই। জীবনেরও মধ্যে সেই ঝড়েরই মতো সে নূতনের কি আশ্চর্য কি ভয়ংকর আবির্ভাব!

রথচক্র ঘর্ঘরিয়া এসেছ বিজয়ীরাজসম
গর্বিত নির্ভয়—
বজ্রমন্ত্রে কি ঘোষিলে বুঝিলাম নাহি বুঝিলাম—
জয় তব জয়।

ফুলের মতো জীর্ণ পুষ্পদলকে ধ্বংস ভ্রংশ করিয়া পুরাতন জীবনের পর্ণপুটকে দীর্ণবিকীর্ণ করিয়া এই ‘নূতন’ জীবনের মধ্যে পরিপূর্ণ আকারে প্রকাশিত! তাহার উদার আমন্ত্রণে সমস্ত বিতর্ক-বিচার, সমস্ত বন্ধনক্রন্দন, সমস্ত খিন্ন জীবনের ধিক্কার লাঞ্ছনাকে একেবারে দূরে অপসারিত করিয়া প্রাণ ছুটিয়া বাহির হইয়াছে:

লাভক্ষতি-টানাটানি, অতি সূক্ষ্ম ভগ্ন-অংশ-ভাগ,
কলহ সংশয়—
সহে না সহে না আর জীবনেরে খণ্ড খণ্ড করি
দণ্ডে দণ্ডে ক্ষয়।

যে পথে অনন্ত লোক চলিয়াছে ভীষণ নীরবে
সে পথপ্রান্তের
এক পার্শ্বে রাখো মোরে, নিরখিব বিরাট স্বরূপ
যুগযুগান্তের।

“বৈশাখ” কবিতাটির মধ্যেও এই রুদ্রের আহ্বান:

জ্বলিতেছে সম্মুখে তোমার
লোলুপ চিতাগ্নিশিখা লেহি লেহি বিরাট অম্বর,
নিখিলের পরিত্যক্ত মৃতস্তূপ বিগত বৎসর
করি ভস্মসার—
চিতা জ্বলে সম্মুখে তোমার।

 দুঃখসুখ, আশা ও নৈরাশ্যের দ্বারা ক্রমাগত জীবনকে খণ্ডিত করিয়া আপনার দিকে তাহাকে টানিয়া রাখিবার যে বেদনা কবিকে পীড়ন করিতেছিল, সেই আপনার বন্ধন হইতে মুক্তিলাভের জন্য সমস্ত ‘কল্পনা’র কবিতাগুলির মধ্যে কি কান্না! সেই আপনার সমস্ত সুখদুঃখের উপরে বৈশাখের রুদ্ররৌদ্রবিকীর্ণ বিস্তীর্ণ বৈরাগ্যের গেরুয়া অঞ্চল পাতিয়া দিয়া আপনাকে দগ্ধ করিয়া নিঃশেষ করিয়া ফেলিবার আকাঙ্ক্ষাই ‘হে ভৈরব হে রুদ্র বৈশাখ’এর গম্ভীর ছন্দে প্রকাশ পাইয়াছে।

 স্বদেশের প্রতি অনুরাগের এবং তাহার নিকটে আত্মসমর্পণ করিবার আকাঙ্ক্ষার আভাস ‘কল্পনা’র অনেক কবিতার মধ্যে বিদ্যমান। “মাতার আহ্বান” “ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ” প্রভৃতি কবিতা দৃষ্টান্তস্বরূপে উল্লেখ করা যাইতে পারে। কিন্তু স্বদেশবোধ এখনও অতি ক্ষীণ। কেবল আপনার পূর্বজীবনের সঙ্গে বিচ্ছেদজনিত যে বিষাদ ও বৈরাগ্য কবির অন্তরে নামিয়াছে তাহাই যেন একটা বড় বাণী বলিবার উপক্রম করিতেছে— ‘বর্ষশেষে’র রুদ্রক্রন্দনচ্ছন্দে যে বাণীর খানিকটা পরিচয় পাওয়া গিয়াছে।

 বিশ্বের মূলে ঐশ্বর্য এবং বৈরাগ্য যে দুই রূপ এপিঠ ওপিঠের মতো পরস্পরের সঙ্গে পরস্পর লাগিয়া আছে, তাহার প্রথমটির সঙ্গে এতদিন কবির ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল, দ্বিতীয়টির ছবিও যে তাঁহার জানা ছিল না তাহা নহে— কিন্তু এখনকার মতো এমন মুখামুখি পরিচয় হয় নাই। ‘বর্ষশেষে’ সেই শেষোক্ত রূপই ‘নূতন’ হইয়া কবির নিকটে পরিপূর্ণ আকারে প্রকাশ পাইয়াছিল, ‘বৈশাখে’ সেই রূপই তপঃক্লিষ্ট তপ্ততনু লইয়া তাহার যজ্ঞকুণ্ডে সমস্ত সুখদুঃখকে আহুতি দেওয়াইল। এ রূপ অন্নপূর্ণার রূপ নয়, এ রূপ শিবের রূপ, এ রূপ রিক্ততার রূপ!—

ওগো    কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ,
আরো কি তোমার চাই!
ওগো   ভিখারী, আমার ভিখারী চলেছ
কী কাতর গান গাই!

 এই পরমরিক্ত কাঙাল রূপ আমাদের জীবনকেও নিঃশেষে রিক্ত না করিয়া ছাড়েন না। জীবনকে যতক্ষণ ইহার কাছে ফেলিয়া না দিই ততক্ষণ সে কী ক্ষুদ্র, কী বন্ধনে জর্জরিত, তাহার ভার কী দুঃসহ— তাহার চারি দিকে কোথাও কোনো ফাঁক নাই— আপনাকে লইয়া তাহার কী কান্না! অথচ ভোগের মধ্যে কবির জীবন অত্যন্ত বেশি জড়িত বলিয়া সহজে এই রিক্ততাকে বরণ করিবার শক্তিও তাঁহার নাই, তিনি কেবলই কাঁদিয়া গাহিতে থাকেন:

সখি, আমারি দুয়ারে কেন আসিল,
নিশিভোরে যোগী ভিখারী!
কেন করুণ স্বরে বীণা বাজিল!

আমি   আসি যাই যতবার চোখে পড়ে মুখ তার—
তারে   ডাকিব কি ফিরাইব তাই ভাবি লো ।

সেইজন্ম ইতিহাসের মধ্যে যেখানে মানুষ অনায়াসেই ত্যাগ করিয়াছে, বিনা বিতর্কে বৃহৎ ভাবের আনন্দে প্রাণ দিয়াছে, সেইখানে মানুষের শক্তির সেই বৃহৎ লীলাক্ষেত্রে মানুষের বিরাট মূর্তিকে দেখিবার জন্য কবির চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিল।

 ‘কথা’ কাব্যটির প্রায় সকল ঐতিহাসিক চিত্রগুলিই এই ত্যাগের কাহিনী। বৌদ্ধযুগে এবং শিখ ও মাহারাট্টা জাতিদের অভ্যুদয়কালে মধ্যযুগে ভারতবর্ষের উপর দিয়া ধর্মের বড় বড় প্লাবন বহিয়া গিয়াছিল। ইতিহাস তাহার কথা অল্পই লিখিয়া থাকে, তাহার কারণ ভারতবর্ষের অন্তরতম জীবনের ভিতর হইতে ইতিহাস এখনও তৈরি হইয়া উঠে নাই। ঐ-সকল যুগে ভারতবর্ষ তখনকার জাতীয় জীবনবীণাকে ত্যাগের সুরে খুব কঠিন করিয়া বাঁধিবার চেষ্টা করিয়াছিল।

 সে কী রকমের ত্যাগ? যে ত্যাগের আবেগে নারী আপনার লজ্জা ভুলিয়া একমাত্র পরিধেয় বসন প্রভু বুদ্ধের নামে উৎসর্গ করিয়া দিয়াছে, আপনার ভোগের উৎসৃষ্ট অংশ হইতে কিছু দেওয়াকে ত্যাগ মনে করে নাই— যে ত্যাগ নৃপতিকে ভিখারীর বেশ পরিধান করাইয়া দীনতম সন্ন্যাসী সাজাইয়াছে, পূজারিনী রাজদণ্ডের ভয়কে তুচ্ছ করিয়া পূজার জন্য প্রাণ বিসর্জন করিয়াছে— যে ত্যাগের আনন্দে ভক্ত অপমানকে বর বলিয়া জ্ঞান করিয়াছেন, শূরেরা বীরেরা প্রাণকে তৃণের মতোও মনে করেন নাই— সেই-সকল ত্যাগের কাহিনীই ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের ভিতর হইতে রবীন্দ্রনাথ জাগাইয়া তুলিলেন।

 আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইহার পূর্বে কবির ঐতিহাসিক চেতনা জিনিসটারই অভাব ছিল। ব্যক্তিগত সুখদুঃখের ঘাতপ্রতিঘাতকে একটা বড় কালের অভিপ্রায়ের মধ্যে ফেলিয়া বিশ্ব মানবের বড় বড় ভাঙাগড়ার ব্যাপারের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিবার কোনো চেষ্টা তাঁহার রচনার পূর্বে লক্ষিত হয় নাই। তাহার কারণ আমাদের জাতীয় জীবনের পরিধি তখন অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিল— আমাদের নাটকে উপন্যাসে আমরা ‘ঘোরো’ দিক হইতেই মানবজীবনকে চিত্রিত করিতাম— আমাদের দেশে ধর্মে ও সমাজে যে-সকল আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছিল তাহাদেরও কারণকে খুব দূরে, দেশের অতীত ইতিহাসের অন্তর্গত করিয়া, দেখিতে পাইতাম না; মনে করিতাম তাহা যেন ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি। সাহিত্য সমালোচনাও করিতাম এমন ভাবে যাহাতে সাহিত্য জিনিসটাও একান্তই লেখকবিশেষের সম্পত্তির মতো হইয়া উঠিত— তিনি ইচ্ছা করিলেই যেন তাহার পরিবর্তন করিতে পারেন। সমস্ত দেশের মানসাকাশে যে ভাবহিল্লোল জাগিয়া উঠে তাহারই বাষ্প যে জমাট বাঁধিয়া সাহিত্যরূপ ধারণ করে, সমস্ত দেশের সকল চেষ্টা ও চিন্তার সঙ্গে সাহিত্যকে এমন করিয়া যুক্ত করিয়া দেখিতেই জানিতাম না।

 রবীন্দ্রনাথ যদিচ নিজের অন্তরতর অভাববশতঃ প্রাচীন ইতিহাসের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন, তথাপি এ কথা নিঃসন্দেহ জানিতে হইবে যে, সমস্ত দেশে এই দিকে একটা নাড়াচাড়া চলিতেছিল। পাশ্চাত্য সভ্যতার একটা উগ্র প্রতিক্রিয়া অনেক দিন হইতে আরম্ভ হইয়াছিল— আমাদের সমাজ যে ব্যক্তিপ্রধান নয়, আমাদের দেশে ব্যক্তি যে সমাজের অধীন— এ সকল কথা বলিয়া সমাজের গৌরব-গান নব্য হিন্দুদলের মধ্যে গাওয়াও হইতেছিল অতিমাত্রায়— অর্থাৎ দেশ যে একটা কাল্পনিক পদার্থমাত্র নহে, একটা সত্য বস্তু, ইহা অনুভব করিবার একটা আয়োজন চলিতেছিল!

 রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিক জীবনের কথা বলিবার সময়ে এ সকল বিষয়ে আলোচনা করা যাইবে। কবির নিজের জীবন আপনার পথ আপনি কেমন করিয়া কাটিয়া চলিয়াছে তাহাই আমরা দেখিতেছিলাম। কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে, মহাকাল যে চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন না, এ দেশের মধ্যেও নানা ছোটখাট আন্দোলন-উদ্যোগে একটা পরিবর্তনস্রোত অনেক মানুষের হৃদয়ের উপর দিয়া প্রবাহিত হইতেছিল, সে কথা যেন আমরা ভুলিয়া না যাই।

 ‘কল্পনা’ ‘কথা’ও ‘কাহিনী’র মধ্যে যেমন এই একভাবের অবিচ্ছিন্ন ধারা দেখা গেল, ‘ক্ষণিকা’র মধ্যেও মোটামুটি এই ভাবেরই ধারা বহিয়া চলিয়াছে; তথাপি এ কাব্যখানির বিশেষ একটু স্বাতন্ত্র্য আছে। একটি উজ্জ্বল কৌতুকলীলার তরঙ্গে ‘ক্ষণিকা’র সমস্ত কবিতাগুলি টলমল করিতেছে— এমন স্বচ্ছ এমন অনায়াস প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের আর কোনো কাব্যের মধ্যে দেখা গিয়াছে কিনা সন্দেহ। ইহার মধ্যেও পূর্বোল্লিখিত কাব্যগুলির ন্যায় গতজীবনের সঙ্গে বিচ্ছেদের একটা কান্না আছে। কিন্তু:

তোমারে পাছে সহজে বুঝি
তাই কি এত লীলার ছল?
বাহিরে যবে হাসির ছটা
ভিতরে থাকে আঁখির জল।

 আমার মনে হয়, সূর্যাস্ত এবং সন্ধ্যার অন্ধকারের সন্ধিস্থলে আকাশ যেমন অকস্মাৎ অত্যন্ত সুতীব্ররূপে রাঙা হইয়া উঠে, সেইরূপ ‘ক্ষণিকা'য় নির্বাপিত প্রায় কবিজীবনশিখা আকস্মিক ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁদিয়া আপনাকে নিঃশেষে প্রকাশ করিয়াছে।

 এখানে একটি কথা বলা আবশ্যক। ‘ক্ষণিকা’তেই প্রথমে কবি বাংলা কথিত ভাষা ব্যবহার করেন। কথিত ভাষার একটা সুবিধা এই যে, তাহা কৌতুক কিম্বা করুণাকে ব্যঞ্জিত করিবার পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল। ঠিক ‘মনের কথা-জাগানে’ ভাষা। সংস্কৃতের স্থূল শব্দের দ্বারা কৌতুক করা চলে না। দ্বিতীয় সুবিধা এই যে, কথিত ভাষায় হসন্তওয়ালা শব্দ আমরা ব্যবহার করিয়া থাকি বলিয়া ছন্দটাকে খুব বাজাইয়া তোলা যায়— সুর পদে পদে হসন্তের উপলখণ্ডে প্রতিহত হইয়া কলধ্বনি করিতে থাকে। যথা:

দিঘির্ জলে ঝলক্ ঝলে
মানিক্‌ হীরা,
শর্‌ষে-ক্ষেতে উঠ্‌ছে মেতে
মৌমাছিরা।

‘ক্ষণিকা’ হইতে কবিতার এই রচনাভঙ্গী অবলম্বন করিয়া আজ পর্যন্ত কবি তাহাই রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন।

 ‘ক্ষণিকা’ এই নামের দ্বারা এবং মুখবন্ধের প্রথম কবিতাটিতেই কবি যেন বলিতে চান যে, তিনি কেবল ক্ষণিকের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে তৃপ্ত:

ধরণীর পরে শিথিল-বাঁধন
ঝলমল প্রাণ করিস যাপন।

কিন্তু কথাটা কি সত্যই তাই! জীবনদেবতার কবি কি অনন্তের অনুভূতিকে বিদায় দিয়া ক্ষণিক সুখের উৎসবকেই পর্যাপ্ত বলিয়া মনে করিতে পারেন? এখানেও:

তোমারে পাছে সহজে বুঝি
তাই কি এত লীলার ছল?
বাহিরে যবে হাসির ছটা
ভিতরে থাকে আঁখির জল।

কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক বড় গম্ভীর প্রকৃতির, এ-সকল কৌতুকের চাপল্য তাঁহারা সহ্য করিতে অক্ষম। ইহার মধ্যে যে-একটি মুক্ত প্রাণের হাওয়া বহিয়াছে, সৌন্দর্যমুক্ত প্রকৃতির একটি ভারশূন্য লঘু আনন্দলীলা যে খেলিয়া গিয়াছে, সে খেলায় যোগ দিতে ইঁহারা চান না, ইঁহাদের বয়সোচিত গাম্ভীর্য তাহাতে রক্ষা হয় না।

ওরে মাতাল, দুয়ার ভেঙে দিয়ে
পথেই যদি করিস মাতামাতি,
থলিঝুলি উজাড় ক’রে ফেলে
যা আছে তোর ফুরাস রাতারাতি,
অশ্লেষাতে যাত্রা ক’রে শুরু
পাঁজিপুঁথি করিস পরিহাস,
অকারণে অকাজ লয়ে ঘাড়ে
অসময়ে অপথ দিয়ে যাস,
হালের দড়ি নিজের হাতে কেটে
পালের পরে লাগাস ঝোড়ো হাওয়া,
আমিও তাই তোদের ব্রত লব—
মাতাল হয়ে পাতাল-পানে ধাওয়া।

এ কী অদ্ভুত রকমের কথাবার্ত।! ইহার মধ্যে যে-একটি কথা আছে, অনেক দিনের সঞ্চিত নানা আবর্জনার যে তার চিত্তের উপরে জমিয়া তাহাকে সহজ আনন্দে যোগ দিতে দিতেছে না:

সেই বুক-ভাঙা বোঝা নেব না রে আর তুলিয়া
ভুলিবার যাহা একেবারে যাব ভুলিয়া—

সে কথাটা চাপাই পড়িয়া গেছে। এ রকম কৌতুকের আস্ফালনের ভিতর হইতে সেই অন্তরের কথাটুকু বাহির করা তাই শক্ত। গম্ভীর প্রকৃতির লোকদের বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না।

 কবি আপনিই বলিয়াছেন:

গভীর সুরে গভীর কথা
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই—
ঠাট্টা ক’রে ওড়াই, সখি,
নিজের কথাটাই।

 ‘ক্ষণিকা’র প্রথম ভাগে সকল কবিতার মধ্যেই নিজের বেদনাকে এই ঠাট্টা করিয়া ওড়ানোর একটা ভাব আছে। আপনার মনের সঙ্গে একটা ‘বোঝাপড়া’ আছে— কাজ কি পিছন ফিরিয়া তাকাইবার, আপনার সুখদুঃখ লাভক্ষতি গণনা করিবার:

মনেরে আজ কহ যে
ভালোমন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

তাই ভোগের জীবন এবার গতপ্রায়। আপনাকে আর নানার মধ্যে ঘুরাইবার আকাঙ্ক্ষা নাই— ভারবর্জিত, মুক্ত, সহজ এবং আনন্দিত হইবার জন্য প্রাণ ব্যাকুল।—

তোমরা নিশি যাপন করো,
এখনো রাত রয়েছে ভাই!
আমায় কিন্তু বিদায় দেহ—
ঘুমতে যাই, ঘুমতে যাই।

 যৌবনের আবেগে ‘ছিন্ন-রসারসি’ অনেকবার যে সিন্ধুপানে ভাসিয়া যাওয়া গিয়াছে সে তীব্র আবেগ শান্ত হইতেই কবি গ্রামের প্রান্তে, কূলের কোলে, বটের ছায়াতলে, ঘাটের পাশে বাসা বাঁধিলেন। কাব্যটির এইখানেই যথার্থ আরম্ভ। এইখানে অকাজে কবি ভারশূণ্য প্রাণে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন:

গাঁয়ের পথে চলেছিলেম
অকারণে।
বাতাস বহে বিকালবেলা
বেণুবনে।

কখনো মনটিকে কল্পনার দূর বৃন্দাবনের মধ্যে লইয়া গিয়া সেখানকার মধুর গোষ্ঠলীলাকে উপভোগ করিতেছেন; কখনো ‘কালিদাসের কালের’ লোধ্রকুরুবক শৌরসেনীর কল্পনাকে গাঁথিয়া তুলিতেছেন; কখনো:

নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ
প্রবাল দিয়ে ঘেরা,
শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে
সাগর-বিহঙ্গেরা—

সেইখানে বিশ্বসৌন্দর্যের বাণিজ্যে বাহির হইয়া পড়িতেছেন। গ্রামের কত সৌন্দর্য যে চক্ষে পড়িতেছে— ‘ভাঙনধরা কুলে আ-ঘাটাতে ব’সে রইলে, বেলা যাচ্ছে বয়ে’, সে সময় আপনারই অন্তরের তৃপ্তিতে এমন ভরপুর যে আর কিছুরই প্রয়োজন অনুভূত হইতেছে না:

ভাঙন-ধরা কূলে তোমার
আর কিছু কি চাই?
সে কহিল ভাই,
নাই নাই নাই গো আমার
কিছুতে কাজ নাই।

···

আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ।

শরৎকালের নদীর বালুচরে চখাচখীর নির্জন ঘর, সন্ধ্যায় কুটিরদ্বারে ‘অতিথি’র রিনিঠিনি শিকল নাড়ার শব্দে বধূর ত্রস্তব্যস্ত ভাব, ‘মনের কথা-জাগানে’ বাতাসখানির স্পর্শ, দুপরে ‘ক্লান্ত-কাতর গ্রামে' ঝাউয়ের অবিরাম শব্দে— আকাশে অতিসুদূর বাঁশির তানে— কাতর একটি বিরহবেদনার ব্যাপ্ত বৈরাগ্য, ‘দুটি বোনে’র গুঞ্জনধ্বনি ও কলহাস্য, ‘মেঘলা দিনে ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ’, নববর্ষায় ‘শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ’, নদীকূলে— কেতকীবনে— বকুলতলে— বর্ষাপ্রকৃতির কত বিচিত্র রূপ:

ওগো প্রাসাদের শিখরে আজিকে
কে দিয়েছে কেশ এলায়ে
কবরী এলায়ে?
ওগো নবঘন নীলবাসখানি
বুকের উপরে কে লয়েছে টানি,
তড়িৎশিখার চকিত আলোকে
ওগো কে ফিরিছে খেলায়ে?

 এত বিচিত্র সৌন্দর্য, কোনো দেশের কোনো গীতিকবির হাতে কি এমন স্বচ্ছ এমন উজ্জ্বল প্রকাশে ধরা দিয়াছে! ‘ক্ষণিকা’র শেষের দিকে বিপুলবিরতিপূর্ণ এই একটি ব্যাপ্ত সৌন্দর্যের মধ্যে আমরা ক্রমেই নিবিড়তর গভীরতর লোকে প্রবেশ করি। প্রকৃতির ‘আবির্ভাব’ কল্পনার ‘বর্ষশেষে’র নূতনের আবির্ভাবেরই মতো:

উত্তাল তুমুল ছন্দে
নবঘনবিপুলমন্দ্রে

জলভরা বরষায় তাহার গান শেষ করিল!

আজি আসিয়াছ ভুবন ভরিয়া
গগনে ছড়ায়ে এলোচুল,
চরণে জড়ায়ে বনফুল।
ঢেকেছ আমারে তোমার ছায়ায়
সঘন সজল বিশাল মায়ায়,
আকুল করেছ শ্যাম সমারোহে
হৃদয়সাগর-উপকূল
চরণে জড়ায়ে বনফুল।

 বসন্তের যে-সমস্ত বিচিত্র আয়োজনের মধ্যে এই সৌন্দর্যের আরাধ্যা দেবীকে পূর্বে কবি আহ্বান করিতেন সে আয়োজন ভাঙিয়া চুরিয়া গিয়াছে— ‘ক্ষণিকা’র সর্বত্র অতি সামান্য বিষয়ে নিতান্ত তুচ্ছতার মধ্যে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের আবাহন।—

এই ক্ষণিকের পাতার কুটিরে
প্রদীপ-আলোকে এস ধীরে ধীরে,
এই বেতসের বাঁশিতে পড়ুক
তব নয়নের পরসাদ!

এই গভীর সৌন্দর্যের মধ্যে-যে কবি আসিয়া পড়িলেন, এইখানেই ‘নৈবেদ্যে’র আরম্ভ—এইখানেই প্রকৃতি ছাড়িয়া প্রকৃতির অধীশ্বর যিনি তাঁহার পরিচয় অল্পে অল্পে ফুটিয়া উঠিল।

অসীম মঙ্গলে মিলিল মাধুরী,
খেলা হ’ল সমাধান
চপল চঞ্চল লহরীলীলা
পারাবারে অবসান।

 বিচিত্রতার জীবনের এইখানেই শেষ এবং একের সঙ্গে একের গভীরের সঙ্গে গভীরের মিলনের আরম্ভের এইখানেই সূত্রপাত। তাই ‘ক্ষণিকা’র শেষ কবিতা “সমাপ্তি”তে জিজ্ঞাসা হইতেছে:

চিহ্ন কি আছে শ্রান্ত নয়নে
অশ্রুজলের রেখা?
বিপুল পথের বিবিধ কাহিনী
আছে কি ললাটে লেখা?
রুধিয়া দিয়েছ তব বাতায়ন,
বিছানো রয়েছে শীতল শয়ন,
তোমার সন্ধ্যা-প্রদীপ-আলোকে
তুমি আর আমি একা।

 আমরা দেখিতেছি যে, ‘কল্পনা’তে ‘ক্ষণিকা’তে পূর্বজীবনের সৌন্দর্য ভোগের অবশেষকে যেন একেবারে ঝুলি ঝাড়িয়া নিঃশেষ করিয়া দেওয়া হইল। মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইবার সময় নাড়ী কাটার যে বেদনা শিশু পায়, পূর্বজীবনের সঙ্গে বিচ্ছেদের সেই প্রকারের বেদনা এই কাব্যগুলির মধ্যে রহিয়া গিয়াছে। ‘তপস্যা আমার স্বেচ্ছাকৃত নয়, সুখ আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয়’— পূর্বে একটি পত্রাংশে এই কথাগুলি যে বলা হইয়াছিল, ‘কল্পনা’ ‘ক্ষণিকা’ই সেই কথার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। ‘কল্পনা’র কারুখচিত প্রাচীনকালের সৌন্দর্যের সুনিপুণ রচনার নীচে এবং ‘ক্ষণিকা’র কৌতুকহাস্যোজ্জ্বল তরল সৌন্দর্যপ্রবাহের তলায়, যে পূর্বজীবনের, আর্টের জীবনের একটি সমাধি তৈরি হইয়াছে, সে খবর ঐ দুই কাব্যের ভিতর হইতে কে পড়িতে পারে? ঐ দুই কাব্যে বেদনার মেঘ অতি নিবিড় বলিয়াই অলংকারের রশ্মিচ্ছটা অমন আশ্চর্য ভাবে বিচ্ছুরিত হইবার সুযোগ পাইয়াছে।