বিষয়বস্তুতে চলুন

রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/৭

উইকিসংকলন থেকে

(৭)

ত্রিলোচন ও হেড়ম্ব-রাজ

 শিবের বরে রাণী হীরাবতীর পুত্র জন্মিল, তাঁহার নাম হইল ত্রিলোচন। পুত্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে তাঁহার ললাঠে একটি চক্ষু দেখা গিয়াছিল। অরাজক রাজ্যে এতদিনে রাজা আসিলেন, রাজার অভাবে কত না দুঃখ ঘটিয়াছিল! রাজ্যবাসী সকলের আনন্দের সীমা রহিল না। মাসান্তে মন্ত্রীবর ত্রিলোচনের মাথার উপর রাজচ্ছত্র ধরিলেন এবং ত্রিলোচনের নামে মুদ্রা প্রস্তুত করাইলেন। শিবের আদেশ মত চন্দ্রধ্বজা ও ত্রিশূলধ্বজা শোভিতে লাগিল। যত দিন যাইতে লাগিল ততই ত্রিলোচনের উদ্দেশে নানা দেশ হইতে ভেট আসিতে লাগিল। কিরাতেরা তাহাদের বার্ষিক ভেট লইয়া উপস্থিত হইল।

 ত্রিলোচন কলায় কলায় বাড়িতে লাগিলেন, তাঁহার মধুর চরিত্রে সকলে মোহিত হইয়া গেল। শিব দুর্গা হরির প্রতি ভক্তিতে তাঁহার মন ভরা, পুণ্য কর্ম্মে সদা তাঁহার মতি। ত্রিপুরের পাপে যে রাজ বংশ ক্ষয় হইতে চলিয়াছিল, ত্রিলোচনের পুণ্যবলে সেই বংশ অক্ষয় ও উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।

 দেখিতে দেখিতে ত্রিলোচনের বার বছর বয়স হইয়া গেল। তখন তাঁহার বিবাহের উদ্যোগ চলিতে লাগিল। আশে পাশে বিস্তর ক্ষুদ্র রাজ্য হইতে ত্রিলোচনের বিবাহের জন্য প্রস্তাব আসিতে লাগিল। রূপে গুণে এরূপ পাত্র একান্ত দুর্ল্লভ, রূপে তিনি ছিলেন কন্দর্প তুল্য, যুদ্ধে অগ্নিতুল্য, ক্ষমায় পৃথিবী সদৃশ, বাক্যে বৃহস্পতিসম। নানা যন্ত্র শিক্ষায় তাঁর ছিল অসাধারণ জ্ঞান, বিদেশাগত ব্রাহ্মণের নিকট হইতেও শাস্ত্র পাঠে তিনি জ্ঞান লাভ করেন। তাঁহার বৈষ্ণব চরিত্র ও সাধুর আচারে সকলের মন মোহিত হইয়াছিল।

 ত্রিপুরের মৃত্যুর পর পার্শ্বস্থ যে হেড়ম্বরাজ্যে (কাছাড়) প্রজারা ভিক্ষা করিতে যাইত সেই দেশে ত্রিলোচনের সুখ্যাতি ছড়াইয়া পড়িল। হেড়ম্বরাজ মনে মনে ভাবিলেন এমন পাত্রে যদি কন্যা দিতে পরিতাম, আমি ত বুড়া হইয়া পড়িতেছি! আশে পাশে যে সব রাজ্য তাহারা ম্লেচ্ছ, কোচ ইত্যাদি। আমি ত পুত্রহীন, আমার অভাবে এ রাজ্য কে দেখিবে? যদি এমন সোনার চাঁদ ছেলে পাই তবে বুড়া বয়সে শান্তি পাইতে পারি। এইরূপ ভাবিয়া এক ব্রাহ্মণকে বিবাহের দূতরূপে হেড়ম্বরাজ ত্রিপুরা রাজ্যে পাঠাইয়া দেন।

 বিবাহের দূত আসিয়া মন্ত্রিগণের নিকট হেড়ম্বরাজের ইচ্ছা জানাইতেই সকলের আনন্দের সীমা রহিল না। এ বিবাহে সকলেরই একমত, এরূপ উত্তম প্রস্তাব ছাড়া উচিত নয়। দূত হেড়ম্বরাজ্যে ফিরিয়া গেলেন। হেড়ম্বরাজ কন্যার বিবাহের দিন স্থির করিলেন। দেখিতে দেখিতে শুভদিন ঘনাইয়া আসিল। হেড়ম্বরাজ্য বিবাহের সাজসজ্জায় মহা আড়ম্বরে শোভিত হইল। এদিকে ত্রিপুরেশ্বর ত্রিলোচন, মন্ত্রী সেনাপতি পাত্রমিত্র সভাসদ লইয়া হেড়ম্বরাজ্য উদ্দেশে যাত্রা করিলেন। শত শত হাতী ঘোড়ায় শোভাযাত্রা চলিল, অগণন কিরাত সেনায় শোভাযাত্রা অতি দীর্ঘ হইয়া পড়িল। দূর হইতে দেখিয়া মনে হইল যেন এক যুদ্ধের অভিযান চলিয়াছে। পথে দিন কয় কাটিয়া গেল, তারপর হেড়ম্বরাজ্য মিলিল। একদিন প্রভাতে দুই রাজার সাক্ষাৎ হইল। ত্রিলোচনকে দেখিয়া হেড়ম্বরাজ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেন। রূপে ভুবন আলো করিতেছে এমন বর আসিয়াছে দেখিয়া রাজ্যে আনন্দের আর সীমা ধরে না। হেড়ম্বরাজ কহিয়া উঠিলেন—আমার বড় ভাগ্য যে শিব-পুত্র ত্রিলোচন আমার রাজ্যে আসিয়াছেন।

 ত্রিলোচনের থাকিবার জন্য এক বিপুল শিবির রচনা হইল। সমস্ত লোকজন লইয়া সেই কৃত্রিম ত্রিপুর নগরীতে ত্রিলোচন রাজঠাটে অভ্যর্থনা পাইলেন। শুভদিনে শুভক্ষণে হেড়ম্বরাজার কন্যার সহিত তাঁহার বিবাহ হইল। সাত দিন ধরিয়া মহা উৎসব চলিল—বাদ্যভাণ্ড নৃত্যগীতে সর্ব্বত্র মুখরিত। হেড়ম্বরাজ মঞ্চের উপর বসিয়া অগণিত লোকের ভোজন-আনন্দ দেখিলেন। তারপর বিদায়ের পালা আসিল। এখন রাজকন্যাকে বিদায় দিতে হইবে, হেড়ম্বরাজের চোখে জল আসিল। কন্যাকে বহু যৌতুক দিলেন, কত মূল্যবান বস্ত্র, অলঙ্কার, কত ঘোড়া, কত হাতী, কত দাস দাসী সঙ্গে দিয়া কন্যাকে বিদায় দিলেন। হেড়ম্বরাজ নিজ রাজ্য হইতে কতক দূর কন্যার সঙ্গে চলিয়া আসিলেন তারপর চোখের জলে মেয়ের নিকট বিদায় মাগিয়া রাজ্যে ফিরিলেন।

 এইরূপে মহা ধূমধামে ত্রিলোচনের বিবাহ সমাপ্ত হইল। ত্রিপুররাজ্য এতদিনে লক্ষ্মীযুক্ত হইল, গাছে গাছে ফুল ফুটিল, ক্ষেতে ফসল হইল, প্রজার সকল কষ্ট দূর হইল—দুঃখের দিন কাটিয়া গেল। সকলের মুখেই হাসি, দুঃখের রাত্রি প্রভাত হইয়াছে, সোনার সূর্য্য উঠিয়াছে। এমনিভাবে কয়েক বছর কাটিয়া গেল, শুভদিনে রাজ-রাণী এক পুত্র প্রসব করিলেন। হেড়ম্বরাজ এই সংবাদ শুনিয়া পরমানন্দ পাইলেন—আমার পুত্র নাই, এত বড় রাজত্ব কে ভোগ করিবে? এদিকে আমার আয়ু ত প্রায় ফুরাইয়া আসিয়াছে। যাক্ বিধাতা মুখ তুলিয়। চাহিয়াছেন, এই দৌহিত্রই হইবে আমার উত্তরাধিকারী। একেই আমি এ রাজসিংহাসনে বসাইব।

 যেমন চিন্তা তেমনি কাজ। হেড়ম্বরাজ নাতি দেখিতে চাহিলেন। কুমারকে লইয়া ত্রিপুরবাহিনী হেড়ম্বরাজ্যে পৌঁছিল। কুমারের থাকার জন্য পাকাপাকি ব্যবস্থা হইল, কুমার দিনে দিনে হেড়ম্বরাজ্যে বাড়িতে লাগিলেন। সে দেশ এমনি তাঁহার গা-সহা হইল যেন জন্মভূমি আর ত্রিপুরা রাজ্য না দেখিতে দেখিতে ইহা হইয়া পড়িল দূরের দেশ। এইভাবে হেড়ম্বরাজের মনের ইচ্ছা পূরণ হইল। হেড়ম্বরাজ্যের ভাবী রাজা হইয়া কুমার ক্রমেই বড় হইতে লাগিলেন।