রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
রামতনু লাহিড়ীর যৌবন-সুহৃদগণ বা
নব্যবঙ্গের প্রথম যুগের নেতৃবৃন্দ।

 শিক্ষকশ্রেষ্ঠ ডিরোজিওর প্রতিভার জ্যোতির দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া হিন্দুকালেজের যুবক ছাত্রগণ কিরূপে তাঁহাকে আবেষ্টন করিয়াছিল, এবং তাঁহাকে গুরুরূপে বরণ করিয়াছিল আশা করি তাহা সকলে এক প্রকার হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছেন। এরূপ ব্যাপার তৎপূর্ব্বে বা তৎপরে বঙ্গদেশে আর কখনও দৃষ্ট হয় নাই। বালকদিগের মধ্যে আবার কতকগুলি যে তাঁহার দিকে বিশেষরূপে আকৃষ্ট হইয়া ছিল তাহা এক প্রকার উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহারা বিদ্যালয়ে তাঁহার সঙ্গলাভ কলিয়া তৃপ্ত না হইয়া তাঁহার ভবনে সর্ব্বদা গতায়াত

রেভারেণ্ড কৃষ্ণ মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়
 করিত। অনেকে সেজন্য গুরুজনের হস্তে কঠিন নিগ্রহ সহ্য করিত তথাপি যাইতে বিরত হইত না। এই সকল বালকের চিত্তেই ডিরোজিওর প্রভাব প্রধানরূপে কার্য্য করিয়াছিল। ইহাদের সকলেই তাঁহার একাডেমিক এসোশিএসনের সভ্য হইয়াছিল; ইহাদের অনেকে রোগশয্যার তাঁহার সেবা করিয়াছিল। রামতনু লাহিড়ী মহাশয় এই দলের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন বলিলে অভুক্তি হয় না। তিনি প্রতিভা বলে ও বিদ্যাবুদ্ধিতে, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বা রামগোপাল ঘোষের সমকক্ষ ছিলেন না; বরং অনেক বিষয়ে ইহাদিগকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও উপদেষ্টার ন্যায় জ্ঞান করিতেন। কিন্তু তাহা হইলেও চরিত্রের গুণে লাহিড়ী মহাশয় ইহাদের সকলের গভীর প্রীতি ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ইহাদের সকল কার্য্যে তিনি সঙ্গে থাকিতেন; সকল চিন্তা ও শ্রমের অংশী হইতেন; এবং ডিরোজিওর উপদেশের অনুসরণে সকলের অগ্রগণ্য ছিলেন বলিলে অত্যুক্তি হয় না। পঠদ্দশার পরে ও যৌবনের কার্য্যক্ষেত্রে ইহাদের বন্ধুতা অক্ষুণ্ণ ছিল। কেবল যৌবনে কেন ইহাদের অধিকাংশের সহিত বাৰ্দ্ধক্যেও লাহিড়ী মহাশয়ের অতি গভীর প্রীতি ও প্রগাঢ় আত্মীয়তা বিদ্যমান ছিল। বাল্যের সহাধ্যায়ীদিগের মধ্যে সেরূপ প্রগাঢ় বন্ধুক্ত বর্ত্তমান সময়ে অসম্ভব হইয়াছে।

 অতঃপর লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবন-সুহৃদগণের মধ্যে কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তির জীবনচরিত সংক্ষেপে উল্লেখ করিতে যাইতেছি।

কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।

 ইনি ডিরোজিওর শিষ্যগণ ও লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবন-সুহৃদগণের মধ্যে সর্ব্বাগ্রগণ্য ব্যক্তি। ১৮১৩ সালে কলিকাতার ঝামাপুকুর নামক স্থানে বর্ত্তমান বেচুচাটুর্য্যের স্ত্রীটে মাতামহের আলয়ে ইহার জন্ম হয়। ইহাঁর মাতামহের নাম রামজয় বিদ্যাভূষণ। বিদ্যাভূষণ মহাশয় কলিকাতার তৎকালপ্রসিদ্ধ ধনী, যোড়াসাঁকো নিবাসী, শান্তিরাম সিংহের ভবনে সভাপণ্ডিত ছিলেন। এই শাস্তিরাম সিংহ মহাভারত-প্রকাশক সুবিখ্যাত কালীপ্রসন্ন সিংহের পিতামহ। কৃষ্ণমোহনেয় পিতার নাম জীবনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁহার নিবাস ২৪ পরগণায় নবগ্রাম নামক গ্রামে ছিল। জীবনকৃষ্ণ কুলীন ব্রাহ্মণের সস্তান ছিলেন; এবং বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের দুহিতা শ্রীমতী দেবীর পাণিগ্রহণ করিয়া শ্বশুরা লয়েই বাস করিতেন। সেখানে তাঁহার কৃষ্ণমোহন ব্যতীত আর দুইটা পুত্র ও একটী কন্যা জন্মে। পুত্র দুইটির নাম ভূবনমোহন, ইনি সর্ব্বজ্যেষ্ঠ, সর্ব্বকনিষ্ঠ কালীমোহন। ইনি কৃষ্ণমোহনের পদবীর অনুসরণ করিয়া পরে খ্রীষ্টধর্ম্ম অবলম্বন করিয়াছিলেন। কন্যাটীর শিবনারায়ণ দাসের লেন নিবাসী হরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সহিত বিবাহ হইয়াছিল। তাঁহার পুত্র মন্নুলাল চট্টোপাধ্যায় পরে গবর্ণমেণ্টের অধীনে উচ্চপদ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন।
 বংশবৃদ্ধি হওয়াতে জীবনকৃষ্ণের শ্বশুরালয়ে বাস করা ক্লেশকর হইয়া উঠিল। তিনি ক্রমে শ্বশুরালয় ত্যাগ করিয়া গুরুপ্রসাদ চৌধুরির লেনে একটী স্বতন্ত্র আবাসবাটী নির্ম্মাণ পূর্ব্বক তাহাতে বাস করিতে লাগিলেন। তিনি কুলীনের সন্তান, সেরূপ বিদ্যাসাধ্য কিছুই ছিল না, সুতরাং তাঁহাকে অতি ক্লেশে নিজ পরিবার প্রতিপালন করিতে হইত। এরূপ শুনিয়াছি, পতিপরায়ণ স্বধর্ম্মনিরতা শ্রীমতী দেবী গৃহকার্য্য সমাধা করিয়া বিশ্রামার্থ যে কিছু সময় পাইতেন, সেই সময়ে কাটনা কাটিয়া, বেটের দড়ি পাকাইয়া, পৈতার সুতা প্রস্তুত করিয়া কিছু কিছু উপার্জ্জন করিতেন, তদ্দ্বারা পতির সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিবার পক্ষে অনেক সহায়তা হইত। সে সময়ে ভারতবন্ধু হেয়ার কালীতলাতে স্কুল সোসাইটীর অধীনে একটী পাঠশালা স্থাপন করিয়াছিলেন। ১৮১৮ কি ১৮১৯ সালে শিশু কৃষ্ণমোহন সেই পাঠশালাতে ভর্ত্তি হইলেন। হেয়ার তাঁহার পাঠশালাগুলির তত্ত্বাবধানকার্য্যে কিরূপ মনোযোগী ছিলেন, তাহা অগ্রে বর্ণনা করিয়াছি। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই কৃষ্ণমোহনের প্রতিভার পরিচয় পাইয়া, তাঁহাকে ১৮২২ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত স্কুল সোসাইটীর স্কুলে, বর্ত্তমান সময়ে তন্নামপ্রসিদ্ধ হেয়ার স্কুলে, লইয়া গেলেন। ১৮২৪ সালে যখন মহাবিদ্যালয় বা হিন্দুকালেজ নবপ্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজের নবনির্ম্মিত গৃহে প্রতিষ্ঠিত হইল, তখন কৃষ্ণমোহন স্কুলসোসাইটীর অবৈতনিক ছাত্ররূপে হিন্দুকলেজে প্রবেশ করিলেন।
 এই সময়ে বিদ্যা শিক্ষা বিষয়ে তাঁহার যেরূপ মনোযোগ ছিল, তাহা শুনিলে আশ্চর্য্যান্বিত হইতে হয়। কোনও দিন তাঁহার উদরে অন্ন যাইত কোনও দিন বা যাইত না, কিন্তু সেজন্য কেহ তাঁহাকে বিষন্ন বা স্বকার্যসাধনে অমনোযোগী দেখিতে পাইত না। এমন কি তিনি স্বীয় জননীর সহিত এই নিয়ম করিয়াছিলেন, যে একবেলা তিনি রন্ধন করিবেন, সে সময়ে মা নিজ শ্রমের দ্বারা অর্থোপার্জ্জন করিবার চেষ্টা করিবেন। তিনি স্কুল হইতে আসিয়া রন্ধনকার্য্যে নিযুক্ত হইতেন; অথচ বিদ্যালয়ে কেহই তাঁহাকে শিক্ষা বিষয়ে অতিক্রম করিতে পারিত না।
 ডিরোজিও হিন্দুকালেজে পদার্পণ করিবামাত্র অপরাপর বালকের ন্যায় কৃষ্ণমোহনও তাঁহার দিকে আকৃষ্ট হইলেন। তিনি তখন প্রথম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন। ডিরোজিও তাঁহাকে স্বীয় শিষ্যদলের মধ্যে অগ্রগণ্য বলিয়া বরণ করিয়া লইলেন। একাডেমিক এসোসিএশন যখন স্থাপিত হইল, তখন কৃষ্ণমোহন তাঁহার যুবকসভ্যগণের মধ্যে একজন নেতা হইয়া দাড়াইলেন। ১৮২৮ সালে তাঁহার পিতা বিষম কলেরা রোগে অকালে কালগ্রাসে পতিত হন। ১৮২৯ সালে নবেম্বর মাসে তিনি হিন্দুকালেজ হইতে উত্তীর্ণ হইলেই হেয়ার তাঁহাকে নিজ স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক নিযুক্ত করিলেন। ১৮৩১ সালে বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর Reformer “রিফরমার” নামে এক সংবাদ পত্র বাহির করেন; তাহার প্রতিদ্বন্দিতা করিয়া উক্ত বৎসরের মে মাসে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় Inquirer নামে এক কাগজ বাহির করেন। এই কাগজে তৎকালোচিত রীতি অনুসারে হিন্দুধর্ম্ম ও হিন্দুসমাজের প্রতি কটুক্তি বর্ষণ করিতে ক্রটী করিতেন না। এই হিন্দুধর্ম্ম ও হিন্দুজাতিবিদ্বেষ তাঁহার অন্তরে বহুদিন ছিল। ১৮৫০ সালে তিনি একখানি বিদ্রপপূর্ণ পুস্তিকা রচনা করিয়াছিলেন, তাহাতে রাধাকান্ত দেবকে গাধা কাস্ত নামে অভিহিত করিয়াছিলেন।
 ১৮৩০ সালে আলেকজাণ্ডার ডফ এদেশে আসিলেন, এবং কালেজের সন্নিকটে বাসা লইয়া খ্রীষ্টধর্ম্ম প্রচার আরম্ভ করিলেন। ইহার বিবরণ পূর্ব্বে দিয়াছি; এবং ঐ সকল বক্তৃতা শুনিতে যাওয়াতে হিন্দুকালেজের ডিরোজিওর শিষ্যগণ কালেজকমিটীর কিরূপ বিরাগভাজন হইয়াছিলেন তাহাও কিঞ্চিৎ বর্ণন করিয়াছি। কৃষ্ণমোহন বন্ধুগণ সমভিব্যাহারে, ঐ সকল বক্তৃতা শুনিতে যাইতেন এবং তদ্ভিন্ন ডফ ও ডিয়ালটির (Dealtry) বাসায় গিয়া তর্কবিতর্ক করিতেন।
 তৎপরে ১৮৩১ সালের আগষ্ট মাসে যে ঘটনা ঘটির তাঁহাকে গৃহ হইতে তাড়িত হইতে হয় তাহার বিবরণ অগ্রেই দিয়াছি।
 কৃষ্ণমোহন গৃহ হইতে তাড়িত হইয়া দক্ষিণারঞ্জনের ভবনে সে রাত্রে আদরে গৃহীত হইলেন। তিনি এই ভবনে ঠিক কতদিন ছিলেন তাহা বলিতে পারি না। বোধ হয় তাঁহাকে কয়েক দিনের মধ্যেই এই আশ্রয় স্থান পরিত্যাগ করিয়া স্বতন্ত্র বাসা করিতে হইয়াছিল। কারণ দক্ষিণারঞ্জনের বন্ধুগণ তাঁহার ভবনে আসিলে, তাঁহার পিতা বিরক্ত হইতেন, এজন্য পিতাপুত্রে মধ্যে মধ্যে ঘোর বিবাদ উপস্থিত হইত। একবার দক্ষিণারঞ্জনের পিতা স্বীয় পুত্রের অনুপস্থিতিকালে তাঁহার কোনও বন্ধুকে অপমান করাতে দক্ষিণারঞ্জন পিতৃগৃহ ছাড়িয়া গিয়াছিলেন, তখন ডিরোজিও তাঁহাকে বুঝাইয়া নিবৃত্ত করেন। এই বন্ধু হয়ত কৃষ্ণমোহন।
 যাহা হউক, গৃহ হইতে তাড়িত হইয়া কৃষ্ণমোহন ভাসিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহার উৎসাহ কিছুতেই মন্দীভূত হইল না। তিনি দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত তাঁহার Inquirer পত্রিকা চালাইতে লাগিলেন; এবং অসংকোচে ডফ ডিয়েলটি, প্রভৃতি খ্রীষ্টীয় প্রচারকদিগের ভবনে গতায়াত এবং তাঁহাদের সহিত পানভোজন করিতে লাগিলেন। এইরূপে এক বৎসর কাটিয়া গেল। ১৮৩২ সালের ২৮ আগষ্টের ইন্‌কোয়ারারে সংবাদ বাহির হইল, যে হিন্দুকালেজের অন্ততম ছাত্র ও কৃষ্ণমোহনের বন্ধু মহেশ চন্দ্র ঘোষ খ্রীষ্টধর্ম্মাবলম্বন করিয়াছেন। কলিকাতা সমাজে তুমুল আন্দোলন উঠিল। তৎপরবর্ত্তী অক্টোবর মাসের ১৭ই দিবসে কৃষ্ণমোহন স্বয়ং খ্রীষ্টধর্ম্মে দীক্ষিত হইলেন। তিনি গৃহ-তাড়িত হওয়ার পর কিছু দিন কতিপয় ইউরোপীয়ের সহিত খুব মিশিতেন। তন্মধ্যে কাপ্তেন কর্ব্বিন (Captain Corbin) নামে একজন সেনাদল-ভুক্ত কর্ম্মচারী প্রধান ছিলেন। তাঁহার ভবনে তিনি তাঁহাদের সহিত সমবেত হইয়া খ্রীষ্টধর্ম্ম সম্বন্ধীয় গ্রন্থ সকল পাঠ করিতেন। এতদ্ভিন্ন সে সময়ে কর্ণেল পাউনি (Colonel Powney) নামক একজন খ্রীষ্টভক্ত কর্ণেল কলিকাতাতে ছিলেন, তাঁহার ও তাঁহার বন্ধুগণের সহিত সমবেত হইয়া কৃষ্ণমোহন একবার ষ্টীমার যোগে সাগর দ্বীপে গিয়াছিলেন। অনেকে অনুমান করিয়াছেন তাঁহার খ্রীষ্টীয়ধর্ম্ম গ্রহণ ইহাদেরই প্রভাবে।

 যাহা হউক ইহার পরে কৃষ্ণমোহনের জীবনে সংগ্রামের পর সংগ্রাম উন্নতির পর উন্নতি চলিতে লাগিল। তাঁহার প্রণয়িনী বিন্ধ্যবাসিনী দেবী প্রথমে তাঁহার সহচারিণী হইতে চান নাই। অবশেষে অনেক দিন অপেক্ষা করার পর ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে আসিয়া তাঁহার সঙ্গে যোগ দিলেন। ১৮৩৭ সালে কৃষ্ণমোহন খ্রীষ্টীয় আচার্য্যের পদে উন্নীত হইলেন। তাঁহার প্রথম আচার্যোর কার্য্য তাঁহার বন্ধু মহেশ চন্দ্র ঘোষের মৃত্যু উপলক্ষে। ১৮০৯ সালে তাঁহার কনিষ্ঠ সহোদর কালীমোহনকে নিজধর্ম্মে দীক্ষিত করিলেন। ঐ সালেই তাঁহার জন্য হেদুয়ার কোণে এক ভজনালয় নির্ম্মিত হইল। তিনি সেখানে থাকিয়া 
রাম গোপাল ঘোষ
তাঁহার অবলম্বিত ধর্ম্ম যাজন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এইখানে অবস্থান কালে সুপ্রসিদ্ধ প্রসন্নকুমার ঠাকুরের একমাত্র পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর খ্রীষ্টধর্ম্ম অবলম্বন করেন; এবং তাঁহার কন্যা কমলমণিকে বিবাহ করেন।

 ১৮৪৫ সাল হইতে গবর্ণর জেনেরাল লর্ড হার্ডিঞ্জ বাহাদুরের প্ররোচনায় তিনি “সর্ব্বার্থ সংগ্রহ” নামে জ্ঞান-গর্ভ মহা-কোব স্বরূপ গ্রন্থ সকল প্রণয়ন করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার কার্য্যে প্রীত হইয়া, ১৮৪৬ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁহাকে একখান এলফিনষ্টোন প্রণীত ভারতবর্ষের ইতিহাস উপহার দিয়াছিলেন। ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে মহাত্মা বাটন বা বেথুনের মৃত্যু হইলে তাঁহার নামে যে সভা স্থাপিত হয়, কৃষ্ণমোহন তাহার সভাপতি নির্ব্বাচিত হন। ১৮৫২ সালে তিনি বিশপ কালেজের অধ্যাপকের পদে মনোনীত হইয়া শিবপুরে গিয়া বাস করেন। ১৮৬১-৬২ সালে হিন্দু ষড়দর্শন বিষয়ে প্রভূত গবেষণাপূর্ণ এক গ্রন্থ প্রকাশিত করেন। ১৮৬৮ সালে শিবপুরে তাঁহার, জীবনের সুখ দুঃখের সাঙ্গনী বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মৃত্যু হয়। ঐ ১৮৬৭-৬৮ সালে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নিযুক্ত হন। ১৮৭৫ সালে Aryan Witness “আর্য্য শাস্ত্রের সাক্ষ্য” নামে এক পুস্তক প্রকাশ করেন। ১৮৭৬ সালে লর্ড নর্থব্রুকের পরামর্শে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁহাকে ডাক্তার উপাধি প্রদান করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি ভারতসভার সভাপতিরূপে মনোনীত হন। ১৮৮০ সালে কলিকাতার অধিবাসিগণ তাঁহাকে মিউনিসিপালিটাতে আপনাদের প্রতিনিধিরূপে বরণ করেন। মিউনিসিপালিটীতে সকলে তাঁহাকে নির্ভীক সত্যনিষ্ঠ ও অধর্ম্ম-বিদ্বেষী লোক বলিয়া জানিত। তিনি স্বকর্ত্তব্য-সাধনে কখনই অপরের মুখাপেক্ষা করিতেন না। এইরূপে চিরদিন তিনি স্বদেশে বিদেশের লোকের আদরসন্ত্রম পাইয়া সকলের সন্মানিত হইয়া কাল কাটাইয়া গিয়াছেন। ১৮৮৫ সালে কৃষ্ণমোহন স্বৰ্গারোহণ করেন!

রামগোপাল ঘোষ।

 ডিরোজিওর শিষ্যদলের অগ্রণীদিগের মধ্যে ডাক্তার কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেই রামগোপাল ঘোষ সর্ব্বাপেক্ষা অধিক কৃতী ও যশস্বী হইয়া ছিলেন; সুতরাং তাঁহার জীবনচরিত সংক্ষেপে বর্ণন করা যাইতেছে।  ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতার বর্তমান বেচু চাটুর্য্যের স্ট্রীট নামক গলিতে, স্বীয় পিতামহ দেওয়ান রামপ্রসাদ সিংহের ভবনে ইহার জন্ম হয়। ইহার পিতার নাম গোবিন্দ চন্দ্র ঘোষ। পৈতৃক নিবাস বাগাটা গ্রামে। ঐ গ্রাম হুগলী জেলার অন্তর্গত প্রসিদ্ধ ত্রিবেণী তীর্থের সন্নিকটে অবস্থিত। তাঁহার পিতামহ কলিকাতার কিং হামিল্টন কোম্পানির (King Hamilton & Co) আফিসে কর্ম্ম করিতেন। কলিকাতার চীনাবাজারে তাঁহার পিতার একখানি দোকান ছিল। সেখানে তিনি সামান্য ব্যবসায় বাণিজ্য করিতেন।

 রামগোপালের শৈশবকালের শিক্ষা সম্বন্ধে অধিক কিছু জানি না। সে সম্বন্ধে দুই প্রকার জনশ্রুতি আছে। এক জনশ্রুতিতে বলে, তিনি প্রথমে শারবরণ (Sherburne) সাহেবের স্কুলে ইংরাজী শিক্ষা আরম্ভ করিয়াছিলেন। ঐ সময়ে একটা ঘটনা ঘটে, যাহাতে তিনি হিন্দুকালেজে ভর্ত্তি হইতে পান। সে ঘটনাট এই, তাঁহার কোনও স্বসম্পৰ্কীয়া বালিকার সহিত হিন্দুকালেজের অন্যতম ছাত্র, ও পরবর্ত্তী সময়ের ডিরোজিওর শিষ্যদলের অন্ততম সভ্য হরচন্দ্র ঘোষের বিবাহ হয়। বালক হরচন্দ্র অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক রামগোপালের মেধার পরিচয় পাইয়া, তাঁহার দিকে আকৃষ্ট হন; এবং তাঁহাকে হিন্দুকালেজে ভর্ত্তি হইবার জন্য উৎসাহিত করেন। রামগোপাল তাঁহার উৎসাহে উৎসাহিত হইয়া স্বীয় পিতাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তোলেন। তাঁহার পিতার এরূপ অর্থ সামর্থ্য ছিল না যে তিনি হিন্দুকালেজের বেতন দিয়া পুত্রকে পড়াইতে পারেন। এই সময়ে মিষ্টর রজার্স (Mr. Rogers) নামক কিং হামিণ্টন কোম্পানির আপীসের একজন কর্ম্মচারী শিশু রামগোপালের বেতন দিতে স্বীকৃত হন। তাহাই ভরসা করিয়া তাঁহাকে হিলুকালেজে ভর্ত্তি করিয়া দেওয়া হয়। অপর জনশ্রুতি এই যে রজার্স সাহেবের সাহায্যে তিনি প্রথম হইতেই হিন্দুকালেজে পড়িতে আরম্ব করেন।

 যাহা হউক তাঁহাকে অবিক দিন বেতন দিয়া পড়িতে হয় নাই। তাঁহার পাঠে মনোযোগ, ও অসাধারণ মেধা দেখিয়া মহামতি হেয়ার তাঁহাকে ত্বরায় অবৈতনিক ছাত্রদলে প্রবিষ্ট করিয়া লইলেন। ক্রমে ক্রমে রামগোপাল ডিরোজিওর শ্রেণীতে উন্নীত হইলেন। এখানে আসিয়া রামতনু লাহিড়ীর সহিত তাঁহার সন্মিলন ও আত্মীয়তা হইল। যে কতিপয় বালক ডিরোজিওর দিকে বিশেষরূপে আকৃষ্ট হইয়াছিল, রামগোপাল তাঁহাদের মধ্যে একজন। রামগোপালের আশ্চর্য্য ধীশক্তির পরিচয় পাইয়া ডিরোজিও তাঁহাকে বিশেষ স্নেহের চক্ষে দেখিতেন; এবং ছুটীর পর তাঁহার সঙ্গে মিলিত হইয়া তৎকালপ্রসিদ্ধ ইংরাজী দর্শনকার ও সুকবিদিগের গ্রন্থাবলী পাঠ করিতেন। একদিন সুবিখ্যাত দর্শনকার লকের (Locke) গ্রন্থাবলী পড়িবার সময় রামগোপাল বলিয়া উঠিলেন, “লকের মস্তক প্রবীণের ন্যায় কিন্তু রসনা শিশুর ন্যায়।” অর্থাৎ লক্ অতি প্রাঞ্জল ভাষাতে গভীর মনোবিজ্ঞানতত্ত্ব সকল প্রকাশ করিয়াছেন। এই উক্তিতে ডিরোজিও অতিশয় সস্তুষ্ট হইয়াছিলেন। ইহার পরে রামগোপাল অনুগত শিষ্যেয় ন্যার ডিরোজিওর অনুবর্ত্তন করিতেন। একাডেমিক এসোসিএশন যখন স্থাপিত হইল, তখন তিনি তাঁহার সভ্যগণের মধ্যে একজন অগ্রণী হইয়া উঠিলেন। এই খানেই তাঁহার বক্তৃতাশক্তির প্রথম বিকাশ হইল। তিনি সুন্দর হৃদয়গ্রাহী ইংরাজীতে নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করিতে শিখিলেন। এখন হইতেই তাঁহার যশ চারিদিকে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। পূর্ব্বে বলিয়াছি সার এডোয়ার্ড রায়ান, (Sir Edward Ryan) মিষ্টর ডবলিউ. ডবলিউ বার্ড (Mr. W. W. Bird) প্রভৃতি তৎকালপ্রসিদ্ধ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণ একাডেমিকের অধিবেশনে উপস্থিত হইতেন। সার এডওয়ার্ড রায়ান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন, এবং বার্ড মহোদয় পরে বাঙ্গালার ডেপুটী গবর্ণরের পদে উন্নীত হইয়াছিলেন। এই সভাতে রামগোপালের বাগ্মিতা ও বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় পাইয়া ইহাঁরা চমৎকৃত হইয়াছিলেন, এবং তদবধি সর্ব্ববিষয়ে রামগোপালের উৎসাহদাতা দিলেন।

 রামগোপাল কালেজের সমগ্র পাঠ সাঙ্গ করিতে পারিলেন না। সেই সময়ে মিষ্টার জোসেফ নামে একজন ধনবান য়িহুদী বাণিজ্য করিবার আশয়ে কলিকাতাতে আগমন করেন। তাঁহার একজন ইংরাজীভাষাভিজ্ঞ দেশীয় সহকারীর প্রয়োজন হয়। তিনি কলবিন কোম্পানির আফিসের মিষ্টার এগুীরসনের (Anderson) নিকট স্বীয় অভাব জ্ঞাপন করেন; এণ্ডারসন মহামতি হেয়ারের নিকট লোক চাহিয়া পত্র লেখেন। হেয়ার রামগোপালকে উত্তমরূপে চিনিতেন। যে কার্যের জন্য লোকের প্রয়োজন রামগোপাল যে সে কার্য্যে সুদক্ষ হুইবেন, ইহা তাঁহার প্রতীতি হইয়ছিল, সুতরাং তিনি রামগোপালকে মনোনীত করিলেন। ১৮৩২ সালে কালেজ হইতে উত্তীর্ণ হইবার পূর্ব্বেই রামগোপাল মিষ্টর জোসেফের সহকারীরূপে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। অনুমানে বোধ হয় তাঁহার এত শীঘ্র কালেজ পরিত্যাগ করিবার ইচ্ছা ছিল না; কারণ তিনি বিষয়কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াও কোনও প্রকারে সময় করিয়া কিছুকাল কালেজে আসিতেন এবং কোন কোনও বিষয় ছাত্রদিগের সহিত সমভাবে শিক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেন।

 রামগোপাল অপেক্ষাকৃত স্বল্পবেতনে মিষ্টর জোসেফের আফিসে কর্ম্ম লইয়াছিলেন। কিন্তু ত্বরায় তাঁহার পদবৃদ্ধি হইল। কিছুদিন পরে মিষ্টর কেলসল (Kelsall) নামে অপর এক ধনী আসিয়া জোসেফের সহিত যোগ দিলেন; এবং রামগোপাল তাঁহাদের সম্মিলিত কারবারের মুচ্ছুদ্দি হইলেন; তাঁহার ধন দিন দিন বাড়িয়া যাইতে লাগিল। ক্রমে জোসেফ ও কেলসল এই উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিল; তখন রামগোপাল (Kelsall, Ghose & Co, নামে) স্বাধীন বাণিজ্য করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এই ভাবে কয়েক বৎসর গেল; তিনি ঐশ্বর্য্যশালী হইয়া উঠিলেন। অবশেষে কেলসলের সঙ্গেও তাঁহার বিবাদ ঘটিল। এই বিবাদের সমগ্র কারণ কেহই অবগত নহে। এইমাত্র জানা আছে যে, তিনি মিষ্টর কেলসলের সহিত বিবাদ করিয়া, ইংরাজসমাজের রীতি অনুসারে তাঁহার প্রদত্ত সমুদয় উপহার সামগ্রী ফিরিয়া দিয়া, নিজে ঘোষ কোম্পানি (R. G. Ghose & Co) নাম লইয়া স্বতন্ত্রভাবে সওদাগী কাজ চালাইতে লাগিলেন। ইহা সম্ভবতঃ ১৮৪৮ সালে ঘটিয়াছিল। এ কার্য্যেও তাঁহার প্রভূত অর্থাগম হইয়াছিল।

 একদিকে যখন তাঁহার বৈষয়িক উন্নতি হইতে লাগিল, অপর দিকে তিনি আত্মোন্নতি ও যথাসাধ্য স্বদেশের কল্যাণ সাধন বিষয়ে উদাসীন রহিলেন না। তাঁহার একটা বড় গুণ এই ছিল যে, তিনি বন্ধুণণের প্রতি অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন। একদিন বন্ধুরা বাটীতে না আসিলে অস্থির লইয়া উঠিতেন; তাহাদিগকে খুঁজিতে বাহির হইতেন। যতক্ষণ অর্থ দিয়া সাহায্য করিবার সাধ্য থাকিত করিতেন, না পারিলে অপর কোনও প্রকারে সহায়তা করিবার চেষ্টা করিতেন। তিনি বিষয়কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলে একবার তাঁহার প্রিয়বন্ধু রামতনু লাহিড়ীর বড় অর্থকৃচ্ছ, উপস্থিত হইয়াছিল। তখন নিজের আয় সামান্য, অধিক অর্থ সাহায্য করিতে না পারিয়া তিনি মিষ্টর জোসেফকে বলিয়া রামতনু বাবুকে তাঁহার পারসীশিক্ষকরূপে নিযুক্ত করিয়া দিলেন। এতদ্ভিন্ন যখন যে বাল্যবন্ধুর বিপদ ঘটিয়াছে, রামগোপাল বুক দিয়া পড়িয়াছেন। উত্তরকালে তাঁহার বাল্যবন্ধু রসিককৃষ্ণ মল্লিক শেষ পীডায় পীড়িত হইয়া কলিকাতা আসিলে, রামগোপাল স্বীয় গঙ্গাতীরস্থ বাগানবাটীতে তাঁহাকে রাখিয়া, তাঁহার চিকিৎসা ও শুশ্রূষার সমুচিত ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। যেমন সহৃদরতা তেমনি সত্যপরায়ণতা। ঠিক সময়টা জানিতে পারি নাই, শুনিয়াছি তাঁহার পিতামহের যখন মৃত্যু হইল, তখন তাঁহার স্বসমাজস্থ লোকেরা তাঁহাকে হিন্দুধর্ম্মবিদ্বেষী ও স্বজাতিচ্যুত বলিয়া গোলযোগ করিবার উপক্রম করিলেন। ইহাতে তাঁহার পিতা ভীত হইয়া, তাঁহাকে অশ্রুপূর্ণলোচনে একবার এই কথা বলিবার জন্য অনুরোধ করিলেন যে তিনি হিন্দুধর্ম্ম ও হিন্দু সমাজবিরুদ্ধ আচরণ কিছু করেন না। রামগোপাল পিতার কাকুর্তি মিনতিতে ক্লিষ্ট হইয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন,—“আপনার অনুরোধে আমি সর্ব্ববিধ কার্য্য করিতে এবং সকল ক্লেশ সহিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু মিথ্যা বলিতে পারিব না।” তাঁহার এই সত্যপরায়ণতার কথা দেশে রাষ্ট্র হইয়া গেল; তিনি স্বদেশবাদিগণের চক্ষে অনেক উর্দ্ধে উঠিয়া গেলেন। এই সময়ে আর একটা ঘটনা ঘটিয়াছিল। একবার তাঁহার বাণিজ্য কার্য্যের মধ্যে সংকটকাল উপস্থিত হয়। তখন এরূপ সম্ভাবনা হইয়াছিল, যে তিনি হয়ত নিজের কারবারের দেনা শুধিতে গিয়া একেবারে নিঃস্ব হইয়া যাইবেন। সে সময়ে তাঁহার বন্ধুদিগের মধ্যে অনেকে তাঁহাকে স্বীয় বিষয় বিনামী করিয়া রাখিতে পরামর্শ দিয়াছিলেন। রামগোপাল ঘৃণার সহিত বলিলেন,—“আমার সর্ব্বস্ব যায় সে ও ভাল, আমি উত্তমর্ণদিগকে প্রতারণা করিতে পারিব না।”

 তাঁহার সহৃদয়তা ও সত্যপরারণতার ন্যায় আত্মোন্নতির বাসনা ও পরোপকার প্রবৃত্তি প্রবল ছিল। তাঁহার ১৮৩৮ সালের লিখিত দৈনিক লিপি আমার সম্মুখে রহিয়াছে; তাহাতে দেখিতেছি এমন দিন যায় নাই, যে দিন তিনি কিছু না কিছু না পড়িতেছেন, বা জ্ঞানোন্নতি সাধনে নিযুক্ত না আছেন। যে দিন কিছু ভাল বিষয় পড়িতেছেন না সে দিন দুঃখ করিতেছেন। তিনি বিষয় কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলেও প্রতিদিন তাঁহার বন্ধুগণের মধ্যে দুই চারি জন তাঁহার ভবনে আসিতেন, তাহাদের সঙ্গে সদালাপে ও সৎগ্রন্থ পাঠে সুখে কাল কাটিত।

 এই সময়ে তাঁহার কতিপয় বন্ধু মিলিয়া আত্মোন্নতির জন্য যে যে উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন, সংক্ষেপে তাহার কিছু কিছু উল্লেখ করিতেছি। একাডেমিক এসোসিয়েসন ত ছিলই। ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তাহা হেয়ারের স্কুলে উঠিয়া আসে। কিন্তু তাহার পূর্ব্ব প্রভাব আর রহিল না। তথাপি রামগোপাল প্রভৃতি ডিরোজিওর শিষ্যগণ তাহাকে ১৮৩৯ সাল পর্য্যন্ত জীবিত রাখিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ক্রমে তাহা কালগর্ভে বিলীন হইয়া যায়। এতদ্ভিন্ন ডিরোজিওর শিষ্যদল সমবেত হইয়া “লিপি-লিখন সভা” (Epistolary Association) নামে এক সভা স্থাপন করেন। তাহার সভ্যগণ পরম্পরের সহিত চিঠিপত্রে নানা বিষয়ের আলাপ করিতেন। এ সভা কিছুদিন চলিল। তংপরে তাঁহারা অনুমান ১৮৩৮ সালে “সাধারণ জ্ঞানোপার্জন সভা” (Society for the Acquisition of General Knowledge) নামে এক সভা স্থাপন করিলেন। ইহার বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে। রামগোপাল এই সভার একজন প্রধান উৎসাহী সভ্য ছিলেন। এই সভার সভ্যগণ পূর্বপ্রচারিত “জ্ঞানান্বেষণ’ নামক মাসিক পত্রিকা সম্পাদন করতেন। রামগোপাল তাহার লেখকগণের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন।

 কিন্তু রাজনীতি ক্ষেত্রে সুবক্তারূেপই রামগোপালের প্রধান খ্যাতি আছে। নিম্নলিখিত ঘটনাসংযোগে তিনি রাজনীতিক্ষেত্রে প্রথম পদার্পণ করেন; পুর্বেই উক্ত হইয়াছে যে ১৮৪২ সালে দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংলণ্ড হইতে আসিবার সময় জর্জ টমসন (George Thomson) নামক একজন সুবিখ্যাত বক্তাকে সঙ্গে করিয়া আসেন। এই জর্জ টমসন সে সময়কায় একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।

 টমসন ১৮০৪ সালে ইংলণ্ডের লিবারপুল নগরে জন্মগ্রহণ করেন। দুই বৎসর বয়সের সময়ে ইহার পিতামাতা ইহাঁকে লণ্ডন নগরে আনেন। পিতামাতার অবস্থা মন্দ বলিয়া টমসন বিদ্যালয়ের শিক্ষা লাভ করেন নাই বলিলে হয়। যাহা কিছু শিখিয়াছিলেন ঘরে বসিয়া। যৌবনে পদার্পণ করিরাই দাসত্ব প্রথার দিকে ইহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ইনি তাহার বিরুদ্ধে বক্তৃতাদি করিতে আরম্ভ করেন। ১৮৩০ সালে বিবাহিত হইয়া ১৮৩৪ সালে দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করিবার জন্য আমেরিকা গমন করেন। ১৮৩৬ সালে ইংলণ্ডে প্রত্যাগত হইয়া ভারতহিতৈষী কতিপয় সাধুপুরুষের সহিত সন্মিলিত হন। তৎপরে ১৮৪২ সালে দ্বারকানাথ ঠাকুর মহাশয় ইংলণ্ডে গমন করিলে তাঁহার সহিত সন্মিলিত হইয়া এদেশে আগমন করেন। জর্জ টমসন এদেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা পরিজ্ঞাত হইবার জন্য ও রাজনীতির চর্চা বিষয়ে এদেশীয়দিগকে উৎসাহিত করিবার মানসে এদেশে আসিয়াছিলেন। তাঁহার ন্যায় বক্তা সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহার বক্তৃতা যাঁহার শুনিয়াছিলেন তাঁহারা বলেন যে, তাঁহার এক এক বক্তৃতাতে তৎকালীন সমাজ অগ্নিময় হইয়া যাইত। তাঁহার উৎসাহে ও সাহায্যে কলিকাতায় ফৌজদারী বালাখানা নামক স্থানে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটী নামে একটি সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহাকে বর্ত্তমান ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিএশনের পূর্বপুরুষ মনে করা যাইতে পারে। জর্জ টমসন এদেশে পদার্পণ করিবামাত্র ডিরোজিওর শিষ্যদল তাঁহার চারিদিকে আবেষ্টন করিলেন। রামগোপাল তাঁহাদের অগ্রগণ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। ফৌজদারী বালাখানা হইতে জর্জ টমসনের ও রামগোপাল ঘোষের রব বজ্রনির্ঘোষে উত্থিত হইতে লাগিল। এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া তদানীন্তন স্ত্রীরামপুরস্থ পত্রিকা ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়া (Friend of India) একবার লিখিলেন—“এখন দুই দিকে বজ্রধ্বনি হইতেছে, পশ্চিমে বালা হিসারে ও কলিকাতায় ফৌজদারী বালাখানাতে।”

 এই সময় হইতে রামগোপাল রাজনীতি সম্বন্ধীয় সমুদয় প্রশ্নের সহিত সংসৃষ্ট হইয়া পড়িলেন। রাজনীতি বিষয়ে প্রখর দৃষ্টি রাখিতেন এবং সময়ে সময়ে রঙ্গমঞ্চে আরোহণ করিয়া অগ্নিময় ভাষা উদ্গীরণ করিতেন। গবর্ণর জেনেরল লর্ড হাডিঞ্জের স্মৃতি স্থাপনের জন্য কলিকাতার টাউনহলে ১৮৪৭ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর এক সভা হয়। তাহাতে টর্টুন্‌ (Turton) হিউম, (Hume) কলভিল (Colville) প্রভৃতি কতিপয় সুবাগ্মী প্রসিদ্ধ ইংরাজ বারিষ্টার প্রস্তরনির্ম্মিত মূর্ত্তি প্রভৃতি স্মৃতিচিহ্ন স্থাপনের বিরোধী হইয়া দণ্ডায়মান হন। হার্ডিঞ্জ বাহাদুর এদেশে শিক্ষা বিস্তারের বিশেষ সহায়তা করিয়াছিলেন এজন্য এদেশীরগণ তাঁহার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞ ছিলেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রামগোপাল ঐ সভাতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁহারা যখন দেখিলেন, যে উক্ত ইংরাজগণের প্রতিকুলতাবশতঃ প্রস্তাবটা নষ্ট হইবার উপক্রম হইয়াছে, তখন তাঁহার এক সংশোধিত প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। প্রথমে ইংরাজগণ হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু যখন রামগোপালের প্রজ্বলিত অগ্নিসম তেজময় ও ওজস্বিনী ভাষা জাগিয়া উঠিল, তখন সকলকেই মৌনাবলম্বন করিয়া শুনিতে হইল। দেখিতে দেখিতে রামগোপালের অদ্ভুত বক্তৃতা-শক্তি সমগ্র সভাকে অভিভূত করিল; এবং অবশেষে অধিকাংশের মতে তাঁহারই প্রস্তাব গৃহীত হইল। তাহার ফল স্বরূপ হার্ডিঞ্জ বাহাদুরের অশ্বারোহী মূর্ত্তি এখন গবর্ণমেণ্ট হাউসের সন্মুখস্থ ময়দানে বিদ্যমান রহিয়াছে। এই বক্তৃতা এরূপ ওজস্বিনী হইয়াছিল যে পরদিন ইংরািজদিগের মুখপাত্র স্বরূপ প্রধান সংবাদপত্রে লিখিল—“ভারতবর্ষে একজন ডিমস্থিনিস্ দেখা দিয়াছে, একজন বাঙ্গালি যুবক তিনজন সুদক্ষ ইংরাজ বারিষ্টারকে ধরাশায়ী করিয়াছে।”

 ১৮৫১ সালে যখন বর্ত্তমান ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিএশন স্থাপিত হয় তখন তিনি ইহার কমিটীভুক্ত হন। ১৮৫৩ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সনন্দ পুনর্গ্রহণের সময় এক মহাসভা হয়, তাহাতে রামগোপাল এক বক্তৃতা করেন। ইহাতে যেমন ওজস্বিত, তেমনি সাহসের পরিচয় দিয়াছিলেন। পরবর্তী সময়ের লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর হেলিডে (Sir Frederick Halliday) মহোদয় এদেশীয়দিগের বিরুদ্ধে তৎপূর্ব্বে পার্লমেণ্টের নিযুক্ত কমিটীর নিকট সাক্ষ্য দিয়াছিলেন। রামগোপাল এই বক্তৃতাতে সেই সাক্ষ্যকে সুতীক্ষ্ন বিচারছুরিকার দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলেন। তাহাতে তাঁহার প্রতিভার খ্যাতি বহুগুণ বাড়িয়া গিয়াছিল। তৎপরে ১৮৫৮ সালে ভারতেশ্বরী ভিক্টোরিয়া স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করিলে আনন্দসূচক এক সভা হইয়াছিল, তাহাতে রামগোপাল বাগ্মিতার দ্বারা সকলকে চমৎকৃত করিয়াছিলেন। তৎপরে হিন্দুপেটিয়টের হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্মরণার্থ সভাতে, লর্ড ক্যানিংএর সম্বৰ্দ্ধনার্থ সভাতে, তিনি যে সকল বক্তৃতা করেন, তাহাও স্মরণয়োগ্য। কিন্তু তাঁহার যে বক্তৃতা কলিকাতাবাসী হিন্দুগণের স্মৃতিতে চিরদিন জাগরূক থাকিবে, যে জন্য তাঁহারা চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকিবেন, তাহা নিমতলার শ্মশান-ঘাট সম্বন্ধীয় বক্তৃতা। ১৮৬৪ সালে কলিকাতার মিউনিসিপালিটী নিমতলার বর্তমান শ্মশানঘাটকে গঙ্গাতীর হইতে স্থানান্তরিত করিবার সংকল্প করেন। এই সময়ে রামগোপাল সমগ্র কলিকাতাবাসী হিন্দুগণের পক্ষ হইয়া উত্থিত হইয়াছিলেন; এরং প্রধানতঃ তাঁহারই অগ্নিময় বক্তৃতার গুণে ঐ প্রস্তাব স্থগিত হয়।

 রামগোপাল যে কেবল বক্তৃতার দ্বারাই রাজনীতির আন্দোলনে সহায়তা করিতেন তাহা নহে। সময়ে সময়ে লেখনী ধারণও করিতেন। ১৮৪৯-৫০ সালে গবর্ণর জেনেরালের ব্যবস্থাপক সভাতে কয়েকখানি আইনের পাণ্ডুলিপি উপস্থিত হয়। ভারতবাসী ইংরাজদিগকে এদেশীয়দিগের সহিত বিরোধস্থলে কোম্পানির ফৌজদারী আদালতের ও দণ্ডবিধির অধীন করাই ঐ সকল পাণ্ডুলিপির উদ্দেশ্য ছিল। এদেশীয়দিগকে ইংরাজদ্বিগের অত্যাচার হইতে রক্ষণ করা ঐ আইনের লক্ষ্য ছিল। ইহাতে কলিকাতাবাসী ইংরাজগণ ঐ সকল পাণ্ডুলিপির “কালা আইন” (Black Acts) নাম দিয়া তদ্বিরুদ্ধে ঘোর আন্দোলন করেন। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে এদেশে ইলবার্ট বিলের যে আন্দোলন উঠিয়াছিল, ইহা যেন কতকটা তাঁহার অনুরূপ। ইংরাজগণ গবর্ণমেণ্টের প্রতি গালগিালি বর্ষণ আরম্ভ করিলেন। তখন দেশের এমনি অবস্থা যে, সেই উৎকৃষ্ট আইনগুলির সপক্ষে বলিবার জন্য কেহই ছিল না। তখন কেবলমাত্র রামগোপাল ঘোষ লেখনী ধারণ করিলেন; এবং “A few Remarks on certain Draft Acts, commonly called Black Acts” নামে একখানি পুস্তিক প্রকাশ করিলেন। ইহাতে কলিকাতাবাসী ইংরাজগণ তাঁহার প্রতি এমনি চটিয় গেলেন যে, তাঁহারা সমবেত হইয়া তাঁহাকে Agri-Horticultural Societyর সহকারী সভাপতির পদ হইতে অধঃকৃত করিলেন। এই সভা ১৮২১ সালে শ্রীরামপুরের স্ববিখ্যাত উইলিয়াম কেরীর উদ্যোগে স্থাপিত হয়। শুনিতে পাওয়া যায়, তাঁহাকে উক্ত পদ হইতে অবিচার পূর্ব্বক সরাইয়া দেওয়াতে বিরক্ত হইয়া মিষ্টর সিসিল বীডন উক্ত সভার সভ্যপদ পরিত্যাগ করেন। ইনিই পরে সার সিসিল বীডনরূপে বঙ্গদেশের লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরের পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন।

 কেবল রাজনীতি বিষয়ে নহে, দেশের সর্ব্ববিধ সদনুষ্ঠানে রামগোপাল উৎসাহদাতা ছিলেন। মহামতি হেয়ারের যে সুন্দর শ্বেত-প্রস্তরময় মূর্ত্তিটী এক্ষণে প্রেসিডেন্সি কলেজের সম্মুখস্থ প্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান আছে; তাহা প্রধানতঃ তাহারই চেষ্টাতে নির্ম্মিত হইয়াছিল। ১৮৪১ সালে, ১৭ই জুন কাশিমবাজারের রাজা কৃষ্ণনাথের আহ্বানে মেডিকেল কলেজে এক সভার অধিবেশন হয়, তাহাতে মহাত্মা হেয়ারের একটা প্রস্তরময়ী মূর্ত্তি নির্ম্মাণের প্রস্তাব উপস্থিত হয়। সেই সভাতেই অনেকে এই প্রস্তাবের বিরোধ ছিলেন। কিন্তু রামগোপাল উদ্যোগী হইয়া নিজের এক মাসের আর দিয়া, হেয়ারের শিষ্যবৰ্গকে এক এক মাসের আয় এই জন্য ব্যয় করিতে অনুরোধ করিয়া এক প্রার্থনাপত্র প্রকাশ করেন। শুনিতে পাওয়া যায়, তাঁহার দৃষ্টান্ত ও আগ্রহে হেয়ারের শিষ্যগণের অনেকেই এক এক মাসের আয়-দিয়াছিলেন। এইরূপে সংগৃহীত অর্থের দ্বারা হেয়ারের প্রস্তর-মূর্ত্তি নির্ম্মিত হইয়াছিল। ঐ মূর্ত্তি প্রথমে সংস্কৃত কলেজের প্লাঙ্গণে স্থাপিত হয়। তৎপরে প্রেসিডেন্সি কালেজ গৃহ নির্ম্মিত ইইলে, তাহার প্রাঙ্গণে স্থাপিত হইয়াছে।

 বৃদ্ধাবস্থাতে রামগোপাল বিষয়কর্ম্ম হইতে অবসৃত হইয়া একান্তে বাস করিতেন। তখন আত্মীয় স্বজনকে ও স্বীয় ৰন্ধুবান্ধবকে বিবিধপ্রকারে সহা য়তা করা তাঁহার প্রধান কার্য্য ছিল। তখনও স্বদেশের সর্ব্ববিধ উন্নতির বিষয়ে তাঁহার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল। যৌবনকালে তিনি যে স্বাধীনচিত্ততার ও সংসাহসের পরিচয় দিয়াছিলেন, উত্তর কালে কিয়ৎপরিমাণে তাহার বিপর্য্যয় ঘটিলেও তাহা তাঁহাকে একেবারে পরিত্যাগ করে নাই। ১৮৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি মানবলীলা সম্বরণ করেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব্বে তিনি একটি মহৎকার্যা করিয়াছিলেন। তাঁহার বন্ধুগণের নিকটে ঋণ স্বরূপ তাঁহার প্রায় ৪০,০০০ হাজার টাকা পাওনা ছিল; তিনি সেই সকল ঋণের সমুদয় কাগজপত্র পোড়াইয়া ফেলিয়া, আপনার বন্ধুদিগকে অণৃণী করিয়া গেলেন।


রসিককৃষ্ণ মল্লিক।

 দুঃখের বিষয় ইহার জীবনচরিত সম্বন্ধে অধিক কিছু সংবাদ সংগ্রহ করিতে পারি নাই। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ও রামগোপাল ঘোষের পর ইনিই ডিরোজিও-দলের অগ্রণীদিগের মধ্যে প্রধান ছিলেন। বরং এরূপ শুনিয়াছি ষে একাডেমিকেয় বক্তৃতাদি যাহারা শুনিতে আসিতেন, তাঁহারা রামগোপালের উন্মাদিনী বক্তৃতা অপেক্ষা রসিকের গভীর চিন্তা ও বিজ্ঞতাপূর্ণ বক্তৃতা ভাল বাসিতেন। রামতনু বাবুর মুখে সর্ব্বদা তাঁহার নাম শুনিতাম। তাঁহার সারাজীবনে যেন একদিনের জন্যও রসিক তাঁহাকে পরিত্যাগ করেন নাই। চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে রসিক যাহা বলিয়া গিয়াছেন তাহা গুরুবাক্যের ন্যায় তাঁহার হৃদয়ে বদ্ধমূল ছিল। আমাদের ন্যায় নব্যদলের কোনও মত যদি রসিকের মতের বিরুদ্ধ হইত, তাহা হইলে লাহিড়ী মহাশয় তাহা কাণে তুলিতেন না; বলিতেন “তোমরা কি রসিকের চেয়ে ভাল বোঝ?” এই বাল্য-সুহৃদ অথচ গুরুতুল্য রসিককৃষ্ণ মল্লিকের জীবনচরিত সম্বন্ধে অধিক কথা যে পাঠকগণকে শুনাইতে পারিলাম না. এজন্য দুঃখিত রহিলাম। তাঁহার পরিবায়স্থ ব্যক্তিগণের নিকট যাহা কিছু সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি তাহা নিম্নে দিতেছি।

 অনুমান ১৮১০ সালে কলিকাতার সিন্দুরীয়া পটী নামক স্থানে রসিককৃষ্ণের জন্ম হয়। তাঁহার পিতার নাম নবকিশোর মল্লিক। নবকিশোর মল্লিকের সহরে সুতার কারবার ছিল। প্রাচীন কলিকাতার সুবিখ্যাত শেঠবংশীয়গণ এই তিলি জাতীয় বণিকদল ভুক্ত ছিলেন। সুতরাং একথা বোধ হয় বলিতে পারা যায় যে, ইহার কলিকাতার সর্ব্বাপেক্ষা প্রাচীন অধিবাসী ছিলেন।

 সেকালের রীতি অনুসারে রসিককৃষ্ণ কিছুদিন গুরুমহাশয়ের পাঠশালে পড়িয়া ও সামান্যরূপ ইংরাজী শিখিয়া হিন্দুকালেজে প্রেরিত হন। অল্পকাল মধেই সেখানে বিদ্যা বুদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৮৭৮ সালে ডিরোজিও যখন হিন্দুকালেজে আসিলেন, রসিককৃষ্ণ বোধ হয় তখন হিন্দুকলেজের প্রথম শ্রেণীতে পাঠ করেন। তিনিও আকৃষ্ট হইয়া ডিরোজিও দলে প্রবিষ্ট হইলেন; এবং অপর সকলের ন্যায় আত্মীয় স্বজনের হস্তে নিগ্রহ সহ্য করিতে লাগিলেন।

 এরূপ জনশ্রুতি, কালেজে পাঠকালে নিম্নলিখিত ঘটনাটা ঘটে। তৎকালে কলিকাতা সুপ্রিমকোটে হিন্দু সাক্ষীদিগকে তামা, তুলসী ও গঙ্গাজল স্পর্শ করিয়া শপথ পূর্ব্বক সাক্ষ্য দিতে হইত। তামা তুলসী গঙ্গাজল আনিবার জন্য একজন উড়িয়া ব্রাহ্মণ নিযুক্ত ছিল। আমরা প্রথমে কলিকাতাতে আসিয়া তাহাকে যখন দেখিয়াছি, তখন তাহার বৃদ্ধাবস্থা। ঐ উড়িয়া ব্রাহ্মণ একখানি তাম্রকুণ্ডে করিয়া তুলসী ও গঙ্গাজল লইয়া সাক্ষীদের সন্মুখে আনিয়া ধরিত, তাহা স্পর্শ করিয়া হিন্দু সাক্ষাদিগকে শপথ করিতে হইত। যখন এই নিয়ম ছিল, তখন একবার কোনও মোকদ্দমাতে সাক্ষী হইয়া বালক রসিককৃষ্ণকে সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত হইতে হয়। তিনি সাক্ষ্য দিতে দাঁড়াইলে উড়িয়া ব্রাহ্মণ প্রথামত তাম্রকুণ্ড লইয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু মধ্যে এক বিষম সংকট উপস্থিত। রসিককৃষ্ণ তামা তুলসী গঙ্গাজল স্পর্শ করিতে চাহিলেন না; স্থিরভাবে দণ্ডায়মান হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। আদালত শুদ্ধ লোক বিস্ময়ে মগ্ন হইয়া গেল। বিচারপতি কারণ জিজ্ঞাসা করতে রসিক বলিলেন—“আমি গঙ্গা মানি না।” যখন ইণ্টারপ্রিটার উচ্চৈঃস্বরে ইংরাজীতে অনুবাদ করিয়া জজকে শুনাইলেন— “I do not believe in the sacredness of the Ganges” তখন একেবারে চারিদিকে ইস্ ইস্ শব্দ উঠিয়া গেল; হিন্দু শ্রোতৃগণ কাণে হাত দিলেন। অৰ্দ্ধ দণ্ডের মধ্যে এই সংবাদ সহরে ছড়াইয়া পড়িল। “মল্লিকদেয় বাটীর ছেলে প্রকাশ্য আদালতে দাঁড়াইয়া বলিয়াছে গঙ্গা মানি না; ঘোর কলি উপস্থিত, দেখ কালেজের শিক্ষার কি ফল!” সম্প্রতি কুমারী কলেটের লিখিত যে রামমোহন রায়ের জীবনচরিত বাহির হইয়াছে, তাহাতে রামমোহন রায়ের একজন শিষ্যের বিষয়ে এইরূপ একটা ঘটনার উল্লেখ আছে। বালক রসিককৃষ্ণই বোধ হয় সেই শিষ্য। রসিককৃষ্ণের বিষয়ে এইরূপ গল্প, লাহিড়ী মহাশয়ের ও ডাক্তার কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শোনা গিয়াছে। রসিককৃষ্ণের যে রামমোহন রায়ের প্রতি প্রগাঢ় আস্থা ছিল তাহার প্রমাণও আছে। রাজার মৃত্যুর পর ১৮৩৪ সালে তাঁহার স্মরণার্থ কলিকাতাতে এক সভা হয়। তাহাতে বাঙ্গালী বক্তার মধ্যে তিনিই ছিলেন।

 ডিরোজিও কালেজ ত্যাগ করার পরও তাঁহার শিষ্যদল সংস্কার কার্য্যে কিরূপ সাহসিকতা প্রদর্শন করিতেন তাহা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। রসিকও যে সে বিষরে তাঁহার বন্ধুদের সঙ্গী হইতেন তাহাতে সন্দেহ নাই। ক্রমে বাড়ীর লোক ভীত ও উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। রসিককৃষ্ণের জননী কোনও প্রকারে তাঁহার মতিগতি ফিরাইতে না পারিয়া, পাড়ার নির্ব্বোধ বৃদ্ধা স্ত্রীলোকদিগের প্ররোচনায়, তাঁহার মন ফিরাইবার জন্য, তাঁহাকে পাগলাগুঁড়ো খাওয়াইলেন। হেয়ারের জীবনচরিতে প্যারীচাঁদ মিত্র লিখিয়াছেন, এবং রসিককৃষ্ণের পরিবারস্থ ব্যক্তিদিগের মুখেও শুনিয়াছি যে, এই ঔষধ খাইয়া তিনি সমস্ত রাত্রি সচেতন হইয়া ছিলেন। সেই অবস্থাতেই তাঁহাকে কাশীতে প্রেরণ করিবার আয়োজন হইতে লাগিল। নৌকা প্রস্তুত, তাঁহার হাত পা দড়িতে বাঁধা। তিনি চেতনালাভ করিয়া কোনও প্রকারে আপনাকে বন্ধন মুক্ত করিয়া পিতৃগৃহ হইতে পলায়ন করিলেন। পলায়ন করিয়া চোরবাগানে এক বাসা করিলেন। সেই বাসা ডিরোজিও দলের এক আড্ডা হইয়া দাঁড়াইল। লাহিড়ী মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি তিনি সর্ব্বসা সেখানে যাইতেন। সেই বাটীতে হিন্দুসমাজের কেল্লা ভগ্ন করিবার সকল প্রকার পরামর্শ স্থির হইত। ইহারই পরে বোধ হয়, দক্ষিণারঞ্জনের অর্থেও উৎসাহে “জ্ঞানান্বেষণ’ নামক দ্বিভাষী পত্রিকা বাহির হয়, এবং রসিকের প্রতি তাঁহার সম্পাদকতার ভার অর্পিত হয়।

 রসিককৃষ্ণ কালেজ হইতে বাহির হইয়া কিছুদিন হেয়ারের স্কুলে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু ঠিক কতদিন ঐ কার্য্যে ব্রতী ছিলেন তাহা বলিতে পারি না। যাহা হউক ত্বরায় তাঁহার পদবৃদ্ধি হয়। ১৮৩৪ সালের পর যখন হিন্দু কালেজের কৃতবিদ্য যুবকগণকে ডেপুটী কালেক্টরী পদ দেওয়া হইতে লাগিল, তখন তিনিও ডেপুটী কালেক্টরী পদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। উক্ত পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া তিনি অনেক দিন বৰ্দ্ধমানে বাস করেন। এই
শিব চন্দ্র দেব
কালের মধ্যে তাঁহার ধর্ম্মভীরুতার বিশেষ সুখ্যাতি প্রচার হয়। এরূপ শুনিয়াছি বৰ্দ্ধমানের রাজসংসারের লোক অনেকবার তাঁহাকে উৎকোচাদি দ্বারা বশীভূত করিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন, কিছুতেই তাঁহাকে স্বকর্ত্তব্যসাধনে বিমুখ করিতে পারেন নাই। রসিককৃষ্ণ ঘূণাপূর্ব্বক সেই সকল প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিতেন; এবং ন্যায়বিচার হইতে রেখামাত্র বিচলিত হইতেন না।

 বৰ্দ্ধমানে বাসকালের আর একটা স্মরণীয় ঘটনা এই যে, সেই কালের মধ্যে কিছুদিন লাহিড়ী মহাশয় বৰ্দ্ধমান স্কুলের শিক্ষকরূপে সেখানে বাস করিয়াছিলেন। তখন প্রায় প্রতিদিন দুই বন্ধুতে একত্র বাস করিতেন। লাহিড়ী মহাশয় স্বীয় বন্ধুর পরামর্শ না লইয়া কোনও কাজ করিতেন না। তখন হইতেই রসিককৃষ্ণ তাঁহার guide, philosopher and friend to of অধিকার করিয়াছিলেন। রসিককৃষ্ণের ছবি সেই যে তাহার মনে মুদ্রিত হইয়া গেল, সারা জীবনে আর তাহা একদিনের জন্যও হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হয় নাই।

 অনুমান ১৮৫৮ সালে রসিককৃষ্ণ পীড়িত হইয়া কলিকাতায় আসিলেন। তখন তাঁহার প্রিয়বন্ধু রামগোপাল ঘোষ তাঁহাকে কামাৱাহাটীস্থ স্বীয় বাগানবাটীতে রাখিয়া তাঁহার চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রুষাতে প্রবৃত্ত হইলেন। দুঃখের বিষয় সে রোগ হইতে রসিককৃষ্ণ আর আরোগ্য লাভ করিতে পারিলেন না। অকালে ভবলীলা সম্বরণ করিলেন। মৃত্যুকালে বন্ধুদ্বয় রামগোপাল ঘোষ ও প্যারীচাঁদ মিত্রকে স্বীয় বিষয় বিভবের একজিউটার ও পরিবারগণের রক্ষক ও অভিভাবক নিযুক্ত করিয়া গেলেন। তাঁহার পরিবারস্থ ব্যক্তিগণের মুখে শুনিয়াছি, তাঁহারা সমুচিতরূপেই চিরদিন ঐ ভারবহন করিয়া আসিয়াছেন; এবং সকল প্রকার আপদ বিপদে চিরদিন তাঁহাদের সহায়তা করিয়াছেন।

শিবচন্দ্র দেব।

 এই সাধুপুরুষ কলিকাতার চারি ক্রোশ উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গাতীরস্থিত কোন্নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়া বহুকাল সেই গ্রামকে অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। রেলওয়ে ষ্টেশন, পোষ্ট আফিস, ইংরাজী স্কুল, বাঙ্গালা স্কুল, ডিস্‌পেন্সরী, ব্রাহ্মসমাজ প্রভৃতি কোন্নগরের উন্নতির যে কিছু চিহ্ন অদ্যাপি বিদ্যমান রহিয়াছে, তাহার সকলি ইঁহার চেষ্টার ফল। ইঁহার কথা কোন্নগরের লোক বহুদিন ভুলিতে পরিবে না। ইঁহার স্বলিখিত সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত হইতে ইঁহার জীবনবৃত্তান্ত সংকলন করিতেছি।

 ১৮১১ সালে ২৭শে জুলাই কোন্নগর গ্রামে শিবচন্দ্র দেবের জন্ম হয়। ইঁহার পিতা ব্রজকিশোর দেব, কমিসরিয়েটে সরকারের কাজ করিতেন। ঐ কাজে তখন বিলক্ষণ আয় ছিল। সুতরাং ব্রজকিশোর দেব সে সময়কার একজন সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন। তিনি বহুকাল সরকারী কাজ করিয়া বৃদ্ধাবস্থায় পেনশন লইয়া কার্য্য হইতে অবসৃত হন। সংসারের শৃঙ্খলা, সুবন্দোবস্ত ও সকল কার্য্যের সুনিয়মের জন্য তিনি গ্রামের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি সর্ব্বদা একটা ঘড়ি নিকটে রাখিতেন, এবং তদনুসারে সকল কাজ যথা সময়ে করতেন। তাঁহার সমুদয় কাজ কর্ম্ম ধায়িক হিন্দুগৃহস্থের আদর্শ স্থানীয় ছিল।

 শিবচন্দ্র ব্রজকিশোরের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। প্রথমে তদানীন্তন রীতি অনুসারে গ্রাম্য পাঠশালাতে শিবচন্দ্রের শিক্ষারম্ভ হয়। দশ বৎসর বয়সে তিনি গৃহে বসিয়াই একজন আত্মীয়ের সাহায্যে ইংরাজী শিখিতে আরম্ভ করেন। একাদশ বৎসর বয়ঃক্রমকালে তাঁহার জননীর মৃত্যু হয়। তৎপরে কিছুদিন গোলমালেই কাটিয়য়ায় সে সময়ের মধ্যে তাহার বিদ্যাশিক্ষার বিষয়ে কেহই বিশেষ মনোযোগ করেন নাই। ত্রয়োদশ বর্ষ বয়সে তাহার বিশেষ আগ্রহে তাঁহার পিতা তাঁহাকে কলিকাতায় আনেন; এবং ১৮২৫ সালের ১লা আগষ্ট দিবসে, চতুর্দশ বর্ষ বয়সে, তাঁহাকে হিন্দুকালেজে ভর্ত্তি করিয়া দেন। হিন্দুকালেজে তিনি ছয় বৎসর পাঁচ মাস কাল অধ্যয়ন করিয়াছিলেন; এবং প্রথম শ্রেণীতে উঠিয়া ১৬ টাকা বৃত্তি পাইয়াছিলেন। এই সময়েই তিনি ডিরোজিওর শিষ্যদলভূক্ত হইয়া তাঁহার যৌবনসুহৃদগণের সতি সম্মিলিত হন। সে বন্ধুতায় স্মৃতি চিরদিন তাঁহার হৃদয়ে লেখা ছিল। উত্তরকালে যখন তিনি পলিতকেশ বৃদ্ধ তখনও তাঁহার নিকটে বসলে সময়ে সময়ে দেখা যাইত যে, ডিরোজিওর সামান্য সামান্য উক্তিগুলি তাঁহার মনে উজ্জ্বল রহিয়াছে, যেন কল্যকার ঘটনা।

 কালেজে পাঠের সময়ে পরলোকগত কেশবচন্দ্র সেন মহাশয়ের পিতৃব্য হরিমোহন সেন মহাশয়ের সহিত তাঁহার প্রগাঢ় বন্ধুতা জন্মে; এবং সে সময়ে উভয় বন্ধুতে মিলিয়া আরব্য উপন্যাস বাঙ্গালাতে অনুবাদ করিয়া মুদ্রিত করেন। কালেজ ছাড়িয়া তিনি কয়েক বৎসর প্রথমে জি, টি, সরভে অফিসে ৩০ টাকা বেতনে কম্পিউটারের কাজ করেন। তংপরে ১৮৩৮ সালে ডেপুটী কালেক্টারের পদে উন্নীত হইয়া বালেশ্বর গমন করেন। ১৮৪৪ সালে বালেশ্বর হইতে মেদিনীপুরে বদলী হন। ১৮৫০ সালে কলিকাতার সন্নিকটস্থ আলিপুরে চব্বিশ পরগণার ডেপুটী কালেক্টর হইয়া আসেন।

 ১৮৫৭ সালে যখন সিপাই বিদ্রোহ উপস্থিত হয়, তখন শিবচন্দ্র বাবুকে অকারণ একটু বিপদে পড়িতে হইয়াছিল। সে সময়ে একদিন তিনি রেলগড়িতে কলিকাতায় আসিতেছিলেন। সেই গাড়িতে কয়েকজন ইউরোপীয় ভদ্রলোক ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে মিউটনীর কথা উপস্থিত হয়। তখন শিবচন্দ্র বাবু স্বাধীনভাবে স্বীয় মত প্রকাশ করেন। সেই ইংরাজ ভদ্রলোক গুলি কলিকাতাতে পৌঁছিয়াই এই কথোপকথনের বিষয় গবর্ণমেণ্টের গোচর করেন। এই সামান্য কারণে গবর্ণমেণ্ট তাঁহার নিকট কৈফিয়ং চাহিয়া পাঠান।

 ইহার পর তিনি আরও অনেক পদে উন্নীত হইয়া দক্ষতার সহিত অনেক কার্য্য করিয়া ১৮৬৩ সালে বিযয় কর্ম্ম হইতে অবসৃত হন। অপরাপর লোকের পক্ষে বিষয় কর্ম্ম হইতে অবসৃত হওয়ার অর্থ সম্পূর্ণরূপে বিশ্রামসুখ ভোগ কর; কিন্তু শিবচন্দ্র দেব মহাশরের পক্ষে তদ্বিপরীত ঘটিল। পেনশন লইয়া কোন্নগরে বাস করিয়াই তিনি স্বীয় বাসগ্রামের সর্ব্ববিধ উন্নতিসাধনে মনোনিবেশ করিলেন।

 পূর্ব্ব হইতেই স্বদেশের উন্নতি-সাধনে তিনি মনোযোগী ছিলেন। মেদিনীপুরে বাস কালে সেখানে একটী ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করিয়াছিলেন। তৎপরেও কলিকাতাতে বদলী হইয়াই স্বীয় বাসগ্রামের উন্নতির দিকে তাঁহার দৃষ্টি পতিত হয়। তৎপূর্ব্বে ১৮৫২ সালে গ্রামবাসিগণকে সমবেত করিয়া কোন্নগর হিতৈর্ষিণী সভা নামে একটী সভা স্থাপন করেন। ১৮৫৪ সালে তাঁহারই প্রযত্নে ও তাঁহার বন্ধুগণের সাহায্যে একটা ইংরাজী স্কুল স্থাপিত হয়। ইহার পূর্ব্বে উক্তগ্রামে হার্ডিঞ্জ বাহাদুরের সময়ের স্থাপিত একটী মডেল বাঙ্গালা স্কুল মাত্র ছিল। ইংরাজীস্কুল স্থাপিত হওয়ার পর ১৮৫৬ সালে গবর্ণমেণ্ট বাঙ্গালা স্কুলটী তুলিয়া দেন। কিন্তু গ্রামমধ্যে একটী বাঙ্গালা স্কুল থাকা আবশ্যক বোধে ১৮৫৮ সালে প্রধানতঃ তাঁহার উদ্যোগে আবার একটী বাঙ্গালা স্কুল স্থাপিত হয়।

 স্কুল দুইটী স্থাপন করিয়া তিনি গ্রামবাসিগণের ব্যবহারার্থ একটী সাধারণ পুস্তকালয়ের অভাব অনুভব করিতে লাগিলেন। তদনুসারে প্রধানতঃ তাঁহার চেষ্টাতে, ১৮৫৮ সালে একটা সাধারণ পুস্তকালয় স্থাপিত হইল।

 এখানেই তাঁহার শ্রমের বিরাম হইল না। হিন্দুকালেজে পাঠকালে তিনি স্ত্রীশিক্ষার আবশ্যকতা বড়ই অনুভব করিয়াছিলেন; এবং ১৮২৬ সালে হুগলী জেলার গোপালনগরের বৈদ্যনাথ ঘোষের কন্যার সহিত তাঁহার পরিণয় হইলে, তিনি স্বীয় বালিকা পত্নীকে বাঙ্গালা লিখিতে ও পড়িতে শিখাইতে আরম্ভ করেন। প্রৌঢ়াবস্থাতেও তাঁহার সে উৎসাহ মন্দ্রীভূত হয় নাই। যখন যেখানে গিয়াছেন, সর্ব্বত্রই পণ্ডিত নিযুক্ত করিয়া আপনার কন্যাদিগের শিক্ষার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। তৎপরে মহাত্মা বেথুন কলিকাতাতে তাঁহার সুপ্রসিদ্ধ বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিলে, দলপতিদিগের মহা আন্দোলন সত্ত্বেও তিনি আপনার এক কন্যাকে ঐ স্কুলে ভর্ত্তি করিয়া দিয়াছিলেন। স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে এরূপ যাঁহার উৎসাহ, তিনি যে স্বীয় বাসগ্রামের বালিকাগণের শিক্ষার উপায় বিধান না করিয়া স্থির থাকিবেন ইহা সম্ভব নহে। ১৮৫৮ সালে তিনি গবর্ণমেণ্টের নিকট এই প্রস্তাব করিলেন যে, গবর্ণমেণ্ট যদি বালিকাস্কুলের গৃহনির্ম্মাণার্থ ৫০০ পাঁচ শত টাকা দেন, তাহা হইলে তিনি নিজে আর ৫০০ পাঁচ শত টাকা দিতে পারেন, এবং তাহার ব্যয় নিৰ্বাহার্থ গবর্ণমেণ্ট মাসিক ৪৫ টাকা দিলে তিনি ১৫ টাকা চাঁদা তুলিতে পারেন। অনেক লেখালিথির পরে গবর্ণমেণ্ট সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিলেন।

 শিবচন্দ্র বাবু তাহাতে নিরুদাম না হইয়া, স্বীয় চেষ্টায়, স্বীয় অর্থে স্বীয় ভবনে, ১৮৬০ সালে একটা বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন। কিছুদিন পরে তাঁহারই প্রদত্ত ভূমিখণ্ডের উপরে, তাঁহারই ব্যয়ে ঐ বিদ্যালয়ের জন্য একটা গৃহ নির্ম্মিত হইল। তাহাতে বালিকা-বিদ্যালয় উঠিয়া গেল এবং এখনও সেইখানে আছে।

 কেবল তাহা নহে, ১৮৬২ সালে তিনি শিক্ষিত নারীদিগের ব্যবহারার্থ “শিশুপালন” নামে একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়া মুদ্রিত করলেন। পরে ১৮৬৭ সালে “অধ্যাত্মবিজ্ঞান” নামে প্রেততত্ত্ব বিষয়ে একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছিলেন।

 অগ্রে কোন্নগরে ইষ্টইণ্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির ষ্টেশন ছিল না। কোন্নগরবাসাদিগকে হয় বালী ষ্টেশনে, না হয় শ্রীরামপুর ষ্টেশনে গিয়া গাড়িতে উঠিতে হইত; তাহাতে তাঁহাদের বিশেষ অসুবিধা হইত। এই অসুবিধা দূর করিবার মানসে তিনি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নিকটে কোন্নগরে একটা ষ্টেশন করিবার জন্য আবেদন করেন। ঐ আবেদনের ফলস্বরূপে ১৮৫৬ সালে কোন্নগরে ষ্টেশন খোলা হয়।

 তাঁহারই আবেদন অনুসারে ১৮৫৮ সালে কোন্নগরে একটা ডাকঘর স্থাপিত হয়।

 কোন্নগরে ম্যালেরিয়া জ্বর দেখা দিলে, তাঁহারই প্রযত্নে গবর্ণমেণ্ট একটা চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি স্থাপন করেন। তিনি সেজন্য একটা বাড়ী, ডিসপেন্সারির ব্যবহারার্থ বিনা ভাড়াতে দেন। ঐ ডিসপেন্সারির দ্বারা কোন্নগরের লোকের মহোপকার সাধিত হইয়াছিল। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কিঞ্চিৎ হ্রাস হইলে, ১৮৮১ সালে গবর্ণমেণ্ট ঐ ঔষধালয়টী তুলিয়া দেন। ১৮৮৩ সালে শিবচন্দ্র বাবু নিজের ব্যয়ে একটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধালয় স্থাপন করেন। উহা হইতে প্রতিদিন প্রাতে দরিদ্রদিগকে বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ করা হইত। এই কার্য্যটা তিনি জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত চালাইয়াছিলেন।

 ধর্ম্ম ও সমাজ সংস্কার বিষয়েও তিনি উদাসীন ছিলেন না। তিনি তাঁহার সংক্ষিপ্ত আত্ম-জীবন-চরিতে লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন যে, যৌবনকালে যখন তিনি ডিরোজিওর শিষ্যদল ভুক্ত ছিলেন, তখন হইতেই তাঁহার প্রাচীনধর্মের প্রতি বিশ্বাস বিলুপ্ত হয়; এবং তিনি অন্তরে অন্তরে একেশ্বর-বাদী হন। কিন্তু বহুবৎসর কর্ম্মসূত্রে নানাস্থানে ভ্রমণ করিবার সময়ে সে অস্তরের বিশ্বাস অন্তরেই থাকে; তদনুসারে কার্য্য করিবার বিশেষ সুবিধা পান নাই। পরে ১৮৪৩ সালে যখন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়া ইহাকে বলশালী করিয়া তোলেন এবং স্বৰ্গীয় অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয়ের সম্পাদকতার অধীনে যোগ্যতাসহকারে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ সম্পাদিত হইতে থাকে, তখন, ১৮৪৪ সালে, তিনি উক্ত পত্রিকার গ্রাহক শ্রেণীভুক্ত হইয়া পরম্বহ্মের উপাসনা আরম্ভ করেন। সেই সময়ে তিনি বালেশ্বর হইতে বদলী হইয়া মেদিনীপুরেয় ডেপুটী কালেক্টর হইয়া আসেন।

 ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অনুরাগ বর্দ্ধিত হওয়াতে তিনি ১৮৪৬ সালে মেদিনীপুরে একটা ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন এবং উৎসাহ সহকারে ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচারে প্রবৃত্ত হন। ১৮৫০ সালে কলিকাতার সন্নিহিত আলিপুরে যখন চব্বিশ পরগণার ডেপুটা কালেক্টর হইয়া আসেন, তাঁহার কিঞ্চিৎ পরেই বিধিপূর্ব্বক ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া আদি ব্রাহ্মসমাজের সভ্যরূপে পরিগণিত হন। কেবল তাহা নহে, আপনার স্ত্রী পুত্র পরিবার সকলকে ঐ ধর্ম্মের আশ্রয়ে আনিবার জন্য ব্যগ্র হন; এবং ঈশ্বর প্রসাদে সে চেষ্টাতে কৃতকার্য্যও হইয়াছিলেন।

 ১৮৬৩ সালে রাজ কার্য্য হইতে অবসৃত হইয়া যখন স্বীয় বাসগ্রামে বাস করিলেন, তখন সেখানে একটা ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করিয়া ব্রাহ্মধর্ম্ম সাধন ও প্রচারে প্রবৃত্ত হইলেন। এই সমাজ অদ্যাপি বিদ্যমান রহিয়াছে। ১৮৬৬ সালে উন্নতিশীল ব্রাহ্মদল আদি ব্রাহ্মসমাজ হইতে বিছিন্ন হইলে, তিনি ঐ দলের সহিত হৃদয়ের যোগ স্থাপন করিয়াছিলেন; এবং তাঁহাদের অবলম্বিত পদ্ধতি অনুসারে আপনার পুত্রের বিবাহ দিয়াছিলেন। তৎপরে ১৮৭৮ সালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ যখন স্থাপিত হইল, তখন তিনি ইহার নেতৃবর্গের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন। বহুবৎসর ইহার সভাপতির কার্য্য করিয়াছিলেন। ইহার উন্নতি বিষয়ে তাঁহার অবিশ্রান্ত মনোযোগ ছিল। ব্রাহ্মপদ্ধতি অনুসারে পুত্রের বিবাহ দেওয়াতে তাঁহার আত্মীয় স্বজন ও তাঁহার স্বগ্রামবাসী বন্ধুগণ তাঁহাকে একঘরে করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাতে তিনি একদিনের জন্যও দুঃখিত ছিলেন না, বা একদিনের জন্য গ্রামবাসীদিগের হিতেচ্ছা তাঁহার হৃদয়কে পরিত্যাগ করে নাই। তিনি সমভাবে সকলের কল্যাণ চিন্তা করিতেন এবং গ্রামের সর্ব্ববিধ উন্নতিতে সহায় হইবার চেষ্টা করিতেন।

 জীবনের অবসানকালে তিনি কলিকাতাতে বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আসিয়া প্রতিষ্ঠিত হন। এইখানেই ১৮৯৭ সালের ১২ নবেম্বর বুধবার মানবলীলা সম্বরণ কয়েন।

 এরূপ সাধুপুরুষের অবসানকাল যেরূপ হয় শিবচন্দ্র দেবের অবসানকাল সেইরূপই হইয়াছিল। ভাটার জল যেমন অল্পে অল্পে নামিয়া যায়, তাঁহার জীবননদীর জল যেন তেমন অল্প অল্পে কমিয়া গেল। জীবনের সঙ্গনী সহধর্ম্মিণীর ক্রোড়ে মাথা রাখিয়া, পুত্র কন্যা দৌহিত্রগণে পরিবেষ্টিত হইয়া, বন্ধুবান্ধবের সহিত দেশহিতকর নানা বিষয়ে আলাপ করিতে করিতে শাস্তিতে শাস্তিধামে প্রস্থান করিলেন। তিনি আমাদের মধ্যে সদাশয়তা, মিতাচারিত পরহিতৈষণা, কর্ত্তব্যপরারগতা ও ধর্মভীরুতার আদর্শস্বরূপ ছিলেন। সত্য সত্যই ডিরোজিওবৃক্ষের এই ফলটী অতি মধুর হইয়াছিল।
হরচন্দ্র-ঘোষ।

 ইনি কলিকাতার ছোট আদালতের সুবিখ্যাত জজদিগের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি বলিয়াই সাধারণের নিকট পরিচিত; ইনিও ডিরোজিও বৃক্ষের একটা উৎকৃষ্ট ফল ও রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবন-সুহৃদগণের মধ্যে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি। অনুমান ১৮০৮ সালে ইহার জন্ম হয়। শৈশবকাল হইতেই ইহার জ্ঞান-পিপাসা ও আত্মোন্নতির ইচ্ছা অতিশয় ৱলবতী দৃষ্ট হইয়াছিল। সেকালে বাঙ্গালী ভদ্র গৃহস্থদিগের মধ্যে সন্তানদিগকে পারসী শিখাইবার রীতি ছিল। ইংরাজী শিক্ষার দিকে কেহ বিশেষ মনোযোগ করিতেন না। কিন্তু বালক হরচন্দ্র কেবল পারসী শিখিয়া সন্তুষ্ট না থাকিয়া ইংরাজী শিখিবীর জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন। এরূপ শোনা যায়, নিজের ব্যগ্রতা ও চেষ্টার গুণে তিনি নব-প্রতিষ্ঠিত হিন্দুকালেজে ভর্ত্তি হইয়াছিলেন। হিন্দুকালেজের যে সকল বালক ডিরোজিওর দ্বায়া আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার শিষ্যমণ্ডলাভূক্ত হন, হরচন্দ্র ঘোষ তন্মধ্যে একজন প্রধান। চিরদিনই তাঁহার প্রকৃতিতে এক প্রকার ধীরচিত্ততা ও স্থিতিশীলতা ছিল। তিনি ডিরোজিওর শিক্ষার অনেক গুণ পাইয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার অপরাপর বন্ধুদিগের ন্যায় ধর্ম্ম ও সমাজসংস্কারে উৎসাহ প্রদর্শন করেন নাই।

 একাডেমিক এসোসিএশন স্থাপন বিষয়ে তিনি একজন প্রধান উদ্যোগী ছিলেন; এবং উক্ত সভাতে বক্তৃতাদি করিতেন। এরূপ শোনা যায়, তাঁহার বিদ্যা-বুদ্ধি ও দক্ষতার পরিচয় পাইয়া লর্ড উইলিয়াম বেটিঙ্ক মহোদয় তাঁহাকে নিজের সঙ্গে পশ্চিমে লইয়া যাইতে চাহিয়াছিলেন। হরচন্দ্র কেবল স্বীয় জননীর প্রতিকূলতা বশতঃ সে পদ গ্রহণ করিতে পারেন নাই। কিন্তু তিনি লর্ড উইলিয়াম বেটিঙ্কের সঙ্গে যাইতে না পারিলেও উক্ত মহামতি রাজপুরুষের চিত্ত হইতে অন্তর্হিত হন নাই। ১৮৩২ সালে যখন এ দেশীয় দিগের জন্য মুন্সেফী পদের সৃষ্টি হইল, তখন গবর্ণর জেনেরাল হরচন্দ্রকে বাকুড়ার মুনসেফ নিযুক্ত করিলেন। তিনি বাকুড়াতে পদার্পণ করিবামাত্র লোকে বুঝিতে পারিল যে একজন উন্নতচেতা, সত্যপ্রিয়, কর্ত্তব্যপরায়ণ মানুষ আসিস্বাছেন। হরচন্দ্র আদালতের চেহারা, হাওয়া ও কার্য্যপ্রণালী পরিবর্ত্তিত করিয়া ফেলিলেন। রীতিমত ১০টা ৫টা কাছারি আরম্ভ হইল: হরচন্দ্র স্বহস্তে সাক্ষীর জবানবন্দী লিখিতে লাগিলেন; সর্ব্বসমক্ষে আপনার রায় লিখিতে ও ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। সর্ব্বশ্রেণীর লোকের বিচারকার্য্যের প্রতি প্রগাঢ় আস্থা জন্মিল। সে সময়ে লোকে উৎকোচগ্রহণকে পাপ বলিয়াই মনে করিত না। কিন্তু হরচন্দ্র ঘোষ এমনি ধর্ম্মপরায়ণতার সহিত বিচারকার্য্য করিতে লাগিলেন যে শুনিয়াছি তাঁহার এক শত টাকা বেতনে কুলাইত না বলিয়া কলিকাতা হইতে তাঁহার খরচের জন্য মধ্যে মধ্যে টাকা লইতে হইত।

 বাঁকুড়া বাসকালে কেবল ষে তিনি দক্ষতার সহিত রাজকার্য্য চালাইতে লাগিলেন তাহা নহে। ডিরোজিও মণ্ডলী হইতে তিনি এই দৃঢ়বিশ্বাস হৃদয়ে বদ্ধমূল করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন যে শিক্ষা ভিন্ন এদেশের দুৰ্গতি দূর হইবার উপায়ান্তর নাই। তাই নিজ কার্য্যে প্রতিষ্টিত হইয়া বসিয়াই সেই বিশ্বাস কার্য্যে পরিণত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। নিজ বারে একটা ইংরাজী স্কুল স্থাপন করিয়া সেখানে বালকদিগকে শিক্ষা দিবার প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। আবার নিজ জ্ঞানের উন্নতিসাধনেও মনোযোগী রহিলেন।

 এক বৎসর অতীত হইতে না হইতে কার্য্যদক্ষতার গুণে তিনি সদর আমীনের পদে উন্নীত হইলেন। বাঁকুড়াতে সুখ্যাতির সহিত ছয় বৎসর কার্য্য করিয়া হরচন্দ্র ১৮৩৮ সালে হুগলীতে বদলী হন। ১৮৪৪ সালে প্রিন্সিপাল সদর আমীন হইয়া ২৪ পরগণাতে আসেন। ১৮৫২ সালে তিনি কলিকাতা পুলিস-কোর্টে জুনিয়ার মাজিষ্ট্রেটের পদ প্রাপ্ত হয়। ১৮৫৪ সালে কলিকাতা ছোট আদালতের জজের পদে উন্নীত হন।

 কিন্তু তিনি অপর লোকের ন্যায় কেবল আপনার পদবৃদ্ধি ও অর্থাগম লইয়াই ব্যস্ত থাকিতেন না। কলিকাতাতে অবস্থান কালে তিনি দেশের সর্ব্ববিধ উন্নতির সহায়তা করিতেন। মহাত্মা বেথুন যখন বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করেন, তখন তিনি তাঁহার কমিটীভূক্ত হইয়া বিশেষরূপে সহায়তা করেন। মহাত্মা ডেবিড হেয়ারের মৃত্যু হইলে যখন তাঁহার স্মৃতিচিহ্ন স্থাপনের উদ্যোগ হয়, তখন তিনিই ঐ কমিটীয় সম্পাদক হইয়া সে কার্য্য সমাধা করেন।

 প্রভিভাশালী ও জ্ঞানানুরাগী ব্যক্তিদিগকে সহায়তা করিতে তিনি অতিশয় ভালবাসতেন। হিন্দুপেট্রিটের সুবিখ্যাত সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালকে তিনি এক সময়ে পুত্র-নির্ব্বিশেষে সহায়তা করিয়াছিলেন। অপরাপর অনেক দরিদ্র সস্তানকে তিনি অর্থ ও সামর্থ্যের দ্বারা পালন করিতেন।

 ১৮৬৮ সালের ৩রা ডিসেম্বর হরচন্দ্র ইহলোক পরিত্যাগ করেন। তাঁহার দেহান্ত হইলে, দেশীয় ও বিদেশীয় সকল শ্রেণীর লোকের উপরই যেন একটা শোকের ছায়া পড়িল। ১৮৬৯ সালে ৪ঠা জানুয়ারি কলিকাতা টাউনহলে তাঁহার স্মরণার্থ এক সভা হয়। ঐ সভাতে নিযুক্ত কমিটীর চেষ্টাতে অর্থ সংগৃহীত হইয়া তাঁহার এক মর্ম্মর-মূর্ত্তি নির্ম্মিত হয়, তাহা ১৮৭৬ সালে কলিকাতা ছোট আদালতের দ্বারে স্থাপিত হয়। এখনও উহা আদালত গৃহকে সুশোভিত করিয়া রহিয়াছে।

প্যারীচাঁদ মিত্র।

 ১৮১৪ সালে কলিকাতাতে প্যারীচাঁদের জন্ম হয়। ইহার পিতায় নাম রামনারায়ণ মিত্র। তৎকাল-প্রসিদ্ধ রীতি অনুসারে কিছুদিন গুরুমহাশয়ের পাঠশালে পড়াইয়া ইহার পিতা ইহাকে পারস্য ভাষা শিখাইতে আরম্ভ করেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে সে বন্দোবস্ত রহিত হইল। আত্মীয় স্বজনের পরামর্শে ইহাকে হিন্দুকালেজে দেওয়াই স্থির হইল। তদনুসারে ১৮২৯ সালে ইনি হিন্দুকালেজে ভর্ত্তি হইলেন। সেখানে সমুদয় পরীক্ষায় সুখ্যাতির সহিত উত্তীর্ণ হইয়া পুরস্কার ও বৃত্তি পাইয়াছিলেন।

 প্যারিচাঁদের অন্তরে জনহিতৈষণা স্বভাবতঃ এরূপ প্রবল ছিল যে নিজে ইংরাজী শিখিতে শিখিতে নিজ পল্লীর অপরাপর বালকদিগকে সেই বিদ্যাবিতরণের বাসনা প্রবল হইল। তদনুসারে স্বভবনে একটা অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলিয়া পল্লীর বালকদিগকে শিক্ষা দিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এই বিদ্যালয় কত দিন ছিল বলিতে পারি না। কিন্তু এরূপ শুনিয়াছি যে প্রথম প্রথম তাঁহার সহাধ্যায়ী বন্ধু রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার, শিবচন্দ্র দেব ইহাতে শিক্ষকতা করিতেন এবং মহাত্মা ডেবিড হেয়ার ও ডিরোজিও ইহার পরিদর্শক ছিলেন।

কালেজ হইতে উর্ত্তীর্ণ হইয়া ১৮৩৫ সালে তিনি কলিকাতা পাবলিক লাইব্রেরির ডেপুটী লাইব্রেরিয়ানের পদে নিযুক্ত হন। ঐ বৎসরেই এই লাইব্রেরী স্থাপিত হয়। এই লাইব্রেরী কিছুদিন এসপ্লানেডে মে ষ্ট্রং নামক একজন ইংরাজের ভবনে থাকে। তৎপরে কিছুদিনের জন্য ফোর্ট উইলিয়ম কালেজের বাটীতে উঠিয়া যায়। তৎপরে সার চার্লস মেটকাফের স্মৃতিচিহ্ল স্বরূপ বর্ত্তমান মেটকাফ হল নির্ম্মিত হইলে ১৮৪৪ সালে সেই হলে উঠিয়া আসে। ডেপুটী লাইব্রেরিয়ানের পদ হইতে প্যারীচাঁদ নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ও কার্য্যদক্ষতা প্রভৃতির গুণে একাদিক্রমে লাইব্রেরিয়ান, সেক্রেটারি ও কিউরেটারের পদে উন্নীত হইয়াছিলেন এবং ঐ পদেই চিরদিন প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

 অন্য লোক হইলে কেবলমাত্র অর্থোপার্জ্জনের জন্য এ পদকে ব্যবহার করিত; কিন্তু প্যারীচাঁদ লাইব্রেরিটী হাতে পাইয়া আপনার জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন; এবং নানা বিষয়ে গবেষণা আরম্ভ করিলেন। বালক কাল হইতেই তাঁহার যেমন জ্ঞানলাভ-স্পৃহা ছিল, তেমনি জ্ঞানবিতরণ-স্পৃহাও ছিল, ইহা পূর্বেই প্রদর্শিত হইয়াছে। তাঁহার সেই জ্ঞান-বিতরণ-স্পৃহা এখনও বলবতী দৃষ্ট হইল। তিনি একদিকে যেমন জ্ঞান-সঞ্চয় করিতে লাগিলেন, অপরদিকে সংবাদপত্রাদিতে লিখিয়া সেই জ্ঞান বিতরণ করিতে লাগিলেন। প্রথমে তিনি তাঁহার বন্ধু রসিককৃষ্ণ মল্লিকের সহিত মিলিয়া “জ্ঞানান্বেষণ” পত্রিকা সম্পাদন করিতেন। তৎপরে রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি একত্র হইয়া যখন ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর” নামে এক সংবাদপত্র বাহির করেন, সে সময়ে তিনি তাঁহার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। এতদ্ভিন্ন বেঙ্গল হরকর, ইংলিসম্যান, কলিকাতা রিভিউ প্রভৃতিতে সর্ব্বদা লিখিতেন।

 কিন্তু একটা বিশেষ কার্য্যের জন্য বঙ্গসাহিত্যে তিনি চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছেন। একদিকে পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগয়, অপরদিকে খ্যাতনামা অক্ষয়কুমার দত্ত, এই উভয় যুগপ্রবর্ত্তক মহাপুরুষের প্রভাবে বঙ্গভাষা যখন নবজীবন লাভ করিল, তখন তাহা সংস্কৃত-বহুল হইয়া দাঁড়াইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয় বাবু উভয়ে সংস্কৃত-ভাষাভিজ্ঞ ও সংস্কৃত-ভাষানুরাগী লোক ছিলেন; সুতরাং তাঁহারা বাঙ্গালাকে যে পরিচ্ছদ পরাইলেন তাহা সংস্কৃতের অলঙ্কারে পরিপূর্ণ হইল। অনেকে এরূপ ভাষাতে প্রীতিলাভ করিলেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ লোকের নিকট, বিশেষতঃ সংস্কৃতানতিজ্ঞ শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের নিকট, ইহা অস্বাভাবিক, কঠিন ও দুর্ব্বোধ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। সে সময়ে পাঁচজন ইংরাজীশিক্ষিত লোক কলিকাতার কোনও বৈঠকখানাতে একত্র বসিলেই এই সংস্কৃত-বহুল ভাষা লইয়া অনেক হাসাহাসি হইত। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকরের ন্যার পত্রেও সেই উপহাস বিদ্রুপ প্রকাশিত হইত। অক্ষয় বাবু যখন সংস্কৃতকে আশ্রয় করিয়া, “জিগীষা” “জিজীবিষা", প্রভৃতি শব্দ প্রণয়ন করিলেন, তখন আমরা কলিকাতার যে কোনও শিক্ষিত লোকের বাটীতে যাইতাম শুনিতে পাইতাম “জিগীষা” “জিজীবিষা” প্রভৃতি শব্দের সহিত চিট্‌টীমিষা’ শব্দ যোগ করিয়া হাসাহাসি হইতেছে।

 যখন বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয় বাবুর সংস্কৃত বহুল বাঙ্গালার ভার দুর্ব্বহ বোধ হইতে লাগিল, তখন ১৮৫৭ কি ৫৮ সালে, “মাসিক পত্রিকা” নামে এক ক্ষুদ্রকায় পত্রিকা দেখা দিল। প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকার এই পত্র সম্পাদন করিতেন। ইহা লোকপ্রচলিত সহজ বাঙ্গালাতে লিখিত হইত। স্ত্রীলোকে বালকে যেন বুঝিতে পারে এই লক্ষ্য রাখিয়া লেখকগণ লিখিতেন। এই জন্য মাসিক পত্রিকা পড়িতে সকলে এক প্রকার আনন্দ অনুভব করিত। কখন পত্রিকা আসে তজ্জন্য উৎসুক হইয়া থাকিত। ইহারই কিছুদিন পরে টেকচাঁদ ঠাকুরের “আলালের ঘরের দুলাল” প্রকাশিত হইল। প্যারীচাঁদ মিত্রই এই টেকচাঁদ ঠাকুর। আলালের ঘরের দুলাল একখানি উপন্যাস। কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদারের প্রণীত “বিজরবসন্ত” ও টেকচাঁদ ঠাকুরের “আলালের ঘরের দুলাল” বাঙ্গালীর প্রথম উপন্যাস। তন্মধ্যে বিজয়বসন্ত তৎকাল-প্রচলিত বিশুদ্ধ সংস্কৃত-বহুল বাঙ্গালাতে লিখিত। কিন্তু আলালের ঘরের ছলাল, বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগ আনয়ন করিল। এই পুস্তকের ভাষার নাম ‘আলালী ভাষা’ হইল। তখন আমরা কোনও লোকের ভাষাকে গাম্ভীর্য্যে হীন দেখিলেই তাহাকে আলালী ভাষা বলিতাম। এই আলালী ভাষার উৎকৃষ্ট নমুনা ‘হুতমের নক্সা”। যাঁহার ইচ্ছা হয় পাঠ করিয়া দেখবেন তাহা কেমন সরস, মিষ্ট্র ও হৃদয়গ্রাহী। এই আলালী ভাষার সৃষ্টি হইতে বঙ্গসাহিতোর গতি ফিরিয়া গেল। ভাষা সম্পূর্ণ আলালী রহিল না বটে কিন্তু, ঈশ্বরচন্দ্রী রহিল না, বঙ্কিমী হইয়া দাঁড়াইল। এজন্য আমার পূজ্যপাদ মাতুল, সোমপ্রকাশ সম্পাদক, খ্যাতনামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয় সোমপ্রকাশে কতই শোক করিলেন। কিন্তু আমার বোধ হয় ভালই হইয়াছে; জীবন্ত মানুষ ও ভাষা যত কাছাকাছি থাকে, ততই ভাল।

 যাহা হউক প্যারীচাঁদ মিত্র বঙ্গসাহিত্যে এই যুগান্তর আনয়ন করিলেন। তৎপরে তিনি ‘অভেদী” “যৎকিঞ্চিৎ, “বামাতোষিণী” “রামারঞ্জিকা", “আধ্যাত্মিকা” প্রভৃতি অনেকগুলি উৎকৃষ্ট বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। তাহাতে কিন্তু আলালী ভাষা ব্যবহার করেন নাই, বরং বঙ্কিমী ভাষাই ব্যবহার করিয়াছেন।  কিন্তু কেবল বঙ্গসাহিত্যেই প্যারীচাঁদ মিত্রের কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় নাই। তিনি ও তাঁহার ভ্রাতা কিশোরীচাঁদ মিত্র উভয়ে তৎসমকালীন শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের মধ্যে ইংরাজী লেখা সম্বন্ধে অগ্রগণ্য ছিলেন। ইহা অগ্রেই বলিয়াছি প্যারীচাঁদ প্রথমে তাঁহার বন্ধু রসিককৃষ্ণ মল্লিক ও রামগোপাল ঘোষের সহিত সমবেত হইয়া তাঁহাদের প্রচারিত “জ্ঞানাম্বেষণ” নামক দ্বিভাষী পত্রিকাতে লিখিতেন; তদ্ভিন্ন ইংলিসম্যান, কলিকাতা রিভিউ প্রভৃতি ইংরাজ সম্পাদিত পত্রিকাতেও সর্ব্বদা লিখিতেন। এতদ্ভিন্ন ইংরাজীতে মহাত্মা ডেবিড হেয়ারের জীবনচরিত, রামকমল সেনের জীবনচরিত ও গ্রাণ্ট সাহেবের জীবনচরিত প্রণয়ন করিয়াছিলেন।

 তাঁহাতে যেমন সাহিত্যানুরাগ তেমনি বিষয়কর্ম্মে দক্ষতা দৃষ্ট হইয়াছিল। তিনি একদিকে কলিকাতা পাবলিক লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ানের কর্ম্ম করিতেন, অপরদিকে তাঁহার বন্ধু তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তীর সহিত সম্মিলিত হইয়া বিষয় বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হুইয়াছিলেন। নাবাবিধ দ্রব্যের আমদানী ও রপ্তানীর কাজ করিতেন। এই কারবারে তাঁহাকে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয়। কিন্তু তাহাতে তিনি ভগ্নোদ্যম হন নাই। ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তীর মৃত্যু হইলে, তিনি আপনার দুই পুত্রকে অংশীদার করিয়া নিজে কারবার করিতে প্রবৃত্ত হন। এই কারবারে তিনি ষথেষ্ট উন্নতি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার সাধুতা ও সত্যপরায়ণতার প্রতি কলিকাতার বণিক-সমাজের এমনি বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, তিনি একাদিক্রমে অনেকগুলি কোম্পানির ডাইরেক্টার পদে বৃত হইয়াছিলেন।

 একদিকে যেমন বৈষয়িক উন্নতি, অপরদিকে তেমনি স্বদেশের হিতসাধনে মনোযোগ। যৌবনে বাল্যসুহৃদ রামগোপাল, রামতনু প্রভৃতির সহিত সম্মিলিত হইয়া “সাধারণ জ্ঞানার্জন সভার” সভ্যরূপে উৎসাহের সহিত কার্য্য করিয়াছিলেন। প্রৌঢ়াবস্থাতেও সোসিয়াল সারেন্স এসোসিএশন, এগ্রি হার্টকলচরাল সোসাইট, ডিষ্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটী, স্কুলবুক সোসাইটী, পশুদিগের প্রতি নিষ্ঠুরতানিবারিণী সভা প্রভৃতি বহু সভা সমিতির সভ্য ছিলেন। কেবল ষে নাম মাত্র সভ্য ছিলেন তাহা নহে, তাঁহার সভ্য থাকার অর্থ ছিল সভার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য পরিশ্রম করা। আমরা অনেক সময়ে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া ভাবিতাম, কিরূপে তিনি এত সভাতে যোগ দিয়া হৃদয় মনের সহিত সকলেরই উন্নতির জন্য পরিশ্রম করিতে পারেন।  ১৮৬৮ সালে তিনি বঙ্গদেশের ব্যবস্থাপক সভার সভ্যরূপে মনোনীত হন। এই পদে দুই বৎসর প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া কায়মনে স্বদেশের কল্যাণ-সাধনের চেষ্টা করিয়াছিলেন।

 তাঁহার সহধর্ম্মিণীর পরলোক হইলে তিনি অনেকটা সংসারে নির্লিপ্ত হইয়া পড়েন; এবং প্রেততত্ত্বের আলোচনাতে মনোনিবেশ করেন। তাঁহার এই স্বভাব ছিল যে, যে বিষয়ে মনোনিবেশ করিতেন তাহার আধখানা জানিয়া সন্তুষ্ট হইতেন না। যখন প্রেততত্ত্বের আলোচনাতে প্রবৃত্ত হইলেন, তখন ইংলণ্ড ও আমেরিকা হইতে ভূরি ভুরি গ্রন্থ আনাইয়া পাঠ করিতে ও প্রচার করিতে আরম্ভ করিলেন। এ বিষয়ে তাঁহার বাল্যসুহৃদ ও তাঁহার বৈবাহিক শিবচন্দ্র দেব মহাশয় তাঁহার প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন। দুই বৈবাহিকে মিলিয়া সর্ব্বদা এই বিষয়ের আলোচনা করিতেন। তাঁহারা উভয়ে প্রেত-তত্ত্ব বিষয়ে গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে ম্যাদাম ব্লাভার্টস্কি ও কর্ণেল অলকট যখন এদেশে আসিলেন, তখন তিনি তাঁহাদের স্থাপিত থিওসোফিকাল সোসাইটীতে যোগ দিলেন, এবং উক্ত সভার বঙ্গদেশীর শাখার প্রধান পুরুষ হইয়া দাঁড়াইলেন। তখন সকল প্রকার আধ্যাত্মিক বিষয়ের আলোচনাতে তাঁহার বালকের ন্যায় উৎসাহ দেখিতাম। আমাদিগকে সর্ব্বপ্রকার আধ্যাত্মিক বিষয়ের চর্চ্চাতে সর্ব্বদা উৎসাহিত করিতেন। তাঁহার কাছে বসিলে অনেক জ্ঞানলাভ করা যাইত।

 এইরূপে জ্ঞানালোচনা, সৎসঙ্গ, ও সৎপ্রসঙ্গে তাঁহার কাল এক প্রকার সুখেই কাটিয়া যাইতে লাগিল। অবশেষে ১৮৮৩ সালে দারুণ উদরী রোগে আক্রান্ত হইলেন। ঐ রোগে কিছুদিন কষ্ট পাইয়া ঐ সালের ২৩শে. নবেম্বর ইহলোক পরিত্যাগ করলেন।

 তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার স্বদেশীয় ও বিদেশীয় বন্ধুগণ সম্মিলিত হইয়া এক সভা করিয়া, তাঁহার দুই স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন কৰিয়াছেন। মেটকাফ হলে তাঁহার এক ছবি আছে, এবং কলিকাতার টাউন হলে এক প্রস্তর-নির্ম্মিত উত্তমাঙ্গ আছে।
রাধানাথ শিকদার।

 ইনিওঁ ডিরোজিও বৃক্ষের একটা উৎকৃষ্ট ফল। ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে আশ্বিন মাসে কলিকাতা যোড়াশাকোর অন্তঃপাতী শিকদার-পাড়া নামক স্থানে রাধানাথের জন্ম হয়। ইহার পিতার নাম তিতুরাম শিকদার। ইনি ভিন্ন তিতুরামের আর এক পুত্র ও তিন কন্যা ছিলেন। রাধানাথ সকলের বড়। এই শিকদারগণ ব্রাহ্মণ বংশসম্ভত এবং কলিকাতার অতি প্রাচীন অধিবাসী। মুসলমান নবাবদিগের সময়ে ইহাদের পূর্বপুরুষগণ বংশ-পরম্পর ক্রমে শিকদার বা পুলিস কমিশনরের কাজ করিতেন। ইহাদের অধীনে বহুসংখ্যক লাঠিয়াল, পাইক ও সৈনিক প্রভৃতি থাকিত। ইঁহারা দুর্বৃত্ত ব্যক্তি দিগকে ধৃত করিতে, কয়েদ করিতে ও সাজা দিতে পারিতেন। অনেক স্থলে এই শক্তির অপব্যবহার হইত, এবং যাহা লোকের রক্ষার উদ্দেশ্যে দেওয়া হইয়াছিল, তাহা লোকের পীড়নের জন্য ব্যবহৃত হইত। এমন কি এরূপ জনশ্রুতি আছে যে, কলিকাতা ইংরাজদিগের অধিকৃত হওয়ার পরেও যখন ফৌজদারী কার্য্যের ভরে মুরশিদাবাদের নবাবের হস্তে ছিল, তখনও ইহারা শিকদারের কাজ করিতেন। পরে কোনও এক বিশেষ স্থলে একজনের প্রতি অতিশয় উৎপীড়ন হওয়াতে সে দিকে ইংরাজদিগের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়; এবং সেই আন্দোলনে ইহাদের হস্ত হইতে শক্তি অপহৃত হয়।

 রাধানাথ যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাঁহার পিতা বা তাঁহার বংশের কেহ শিকদারের কাজ করিতেন না। তিতুরাম আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাধানাথ ও কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীনাথকে কিছুদিন পাঠশালে ও ফিরিঙ্গী কমল বসুর স্কুলে পড়াইয়া হিন্দু কালেজে ভর্ত্তি করিয়া দেন। ১৮২৪ সালে তিনি হিন্দু কালেজে প্রবিষ্ট হন এবং সাত বৎসর দশমাস কাল তথায় অধ্যয়ন করেন। ইহার একটা উৎকৃষ্ট অভ্যাস ছিল; দৈনিক লিপি লিখিতেন। তাহা হইতে সে সময়কার অনেক বিবরণ জানিতে পারা যায়। ইহার কনিষ্ঠ সহোদর শ্রীনাথ শিকদার রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের সহপাঠী ও তাঁহার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। তাঁহার সহিত লাহিড়ী মহাশয় সর্ব্বদা ইহাদের বাড়ীতে বেড়াইতে যাইতেন, তখন রাধানাথের জননী পুত্রনির্ব্বিশেষে তাঁহাকে যত্ন করিতেন। সেই অকৃত্রিম স্নেহ ও সদাশয়তার স্মৃতি চিরদিন লাহিড়ী মহাশয়ের মনে মুদ্রিত ছিল। রাধানাথ যে শ্রেণীতেই উন্নীত হইতেন সেই শ্রেণীতেই অগ্রগণ্য বালকদিগের মধ্যে স্থান প্রাপ্ত হইতেন। প্রথম শ্রেণীতে আসিয়াই রাধানাথ তৎকালের রীতি অনুসারে ষোল টাকা বৃত্তি পাইয়াছিলেন। সমুদয় শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে গণিতের প্রতি তাঁহার বিশেষ মনোযোগ ছিল। সে সময়ে ডাক্তার টাইট্‌লার (Dr. Tytler) নামে হিন্দু কালেজে একজন প্রসিদ্ধ শিক্ষক ছিলেন। এই ডাক্তার টাইট্‌লার সে সময়কার উৎকেন্দ্র ব্যক্তিদিগের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য বলিয়া পরিগণিত ছিলেন। রামমোহন রায়ের গ্রন্থাবলীর মধ্যে ডাক্তার টাইট্‌লারের সহিত বিচার বলিয়া যে সকল বিচার দৃষ্ট হয় তাহা বোধ হয় ইহারই সঙ্গে ঘটিয়াছিল। ইহার বিষয়ে এইরূপ শোনা যায় যে ইনি সংস্কৃত ভাষা পাঠ করিতে ও শুনিতে বড় ভাল বাসিতেন। বালকেরা তাহা জানিত এবং যে বালক যে দিন পড়া প্রস্তুত করিয়া না আসিত সে সেদিন ডাক্তার টাইট্‌লারকে প্রবঞ্চনা করিবার এক উপায় বাহির করিত। তাঁহাকে শুনাইয়া কোনও সংস্কৃত উদ্ভট কবিতার এক চরণ আবৃত্তি করিত। অমনি ডাক্তার টাইট্‌লার তন্ময় হইয়া জিজ্ঞাসা করিতেন—“কি, কি, আবার বল, সমগ্র কবিতাটা বল” এইরূপে কবিতা শুনিতে ও তাহার অর্থ বুঝিতে সময়টা কাটিয়া যাইত, বালক নিষ্কৃতি লাভ করিত। সহরে এরূপ জনশ্রুতি আছে যে তিনি নাকি একবার নিজের পুত্রের ছাগলের গাড়ি চড়িয়া গড়ের মাঠে বাহির হইয়াছিলেন।

 ডাক্তার টাইটলার একজন পণ্ডিত লোক ছিলেন। গণিত বিদ্যায় তাঁহার মত সুপণ্ডিত লোক তখন কলিকাতাতে ছিল না। রাধানাথ টাইটলারের নিকটে গণিত বিদ্যাতে পারদর্শী হইয়াছিলেন। তাঁহার নিকটে নিউটন-প্রণীত সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘প্রিন্সিপিয়া' পড়িয়াছিলেন।

 ডিরোজিও যখন একাডেমিক এসোসিএশন স্থাপন করিলেন, তখন কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতির ন্যায় রাধানাথও তাহাতে যোগ দিলেন; এবং ডিরোজিওর শিষ্যদলের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি হইয়া উঠিলেন। তাঁহার দেহে যে প্রকার বল, মনে সেইরূপ সাহস ছিল। তিনি বাক্যে যাহা বলিতেন কাজেও সেই প্রকার করিতেন; কাহাকেও ভয় বা কাহারও মুখাপেক্ষা করতেন না। তিনি যে স্বীয় হৃদয়স্থিত বিশ্বাসানুসারে সর্ব্বদা কার্য্য করিতেন, তাহার একটী প্রমাণ এই যে কেহই তাঁহাকে দেশীয় রীতি অনুসারে একটা অল্পবয়স্কা বালিকার পাণিগ্রহণ করিতে সম্মত করিতে পারে নাই। তাঁহার আত্মীয় স্বজনগণের মুখে শুনিতে পাই, তিনি মাতৃভক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। বৃদ্ধবয়সেও জননীর সন্নিধানে আসিলে শিশুর মত হইয়া যাইতেন। অথচ সেই মাতার অনুরোধেও নিজের হৃদয়স্থিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে পুরাতন রীতি অনুসারে একটা আট বা দশ বৎসর বয়স্ক বালিকাকে বিবাহ করিতে সন্মত হন নাই।

 রাধানাথ যখন হিন্দু কালেজের প্রথম শ্রেণীতে পাঠ করেন তখন, অর্থাৎ ১৮৩২ সালে, জি, টি, সারভে আফিসে একটা ৩০ টাকা বেতনের কম্পিউটারের কর্ম্ম পান। পরিবারের ব্যয়নির্ব্বাহ বিষয়ে পিতার সাহায্যার্থ তাঁহাকে এই কর্ম্ম লইতে হইয়াছিল। ঐ কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া তাঁহার মনে ইংরাজী বৈজ্ঞানিক গ্রন্থসকল সংস্কৃত ভাষাতে অনুবাদিত করিবার বাসনা প্রবল হয়। তদনুসারে মনোযোগের সহিত সংস্কৃত পাঠ করিতে আরম্ভ করেন। কিন্তু তাঁহাকে অবিলম্বে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে যাইতে হয়। সেখানে তিনি বহু বৎসর বাস করিয়া নানাস্থানে কাজ করিয়াছিলেন। সেই সময়ে তাঁহার তেজস্বিতা, আত্ম-মর্য্যাদা-জ্ঞান ও কার্য্যদক্ষতা প্রভৃতি দেখিয়া ইংরাজগণ তাঁহাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করিতেন; এবং সমকক্ষের ন্যায় তাঁহার সঙ্গে মিশিতেন।

 এই কালের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহাতে তাঁহার তেজস্বিতার বিশেষ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল। একবার তিনি সারভে কার্য্যের ভার প্রাপ্ত হইয়া দেরাদুনে বাস করিতেছেন, এমন সময়ে একদিন সংবাদ আসিল যে উক্ত জেলার মাজিষ্ট্রেট ভ্যানসিটার্ট (Mr. Wansittart) মহোদয় তাঁহার সারভে আফিসের কতকগুলি কুলীকে বলপূর্ব্বক ধরিয়া লইয়া গিয়া কোন কোনও দ্রব্য বহন করাইয়া লইবার আদেশ করিয়াছেন। এই সংবাদে রাধানাথ বড়ই বিরক্ত হইয়া গেলেন। ভাবিলেন মাজিষ্ট্রেটের কুলীর প্রয়োজন হইয়া থাকিলে তাঁহাকে লিখিতে পারিতেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেব বোধ হয় কালা মানুষ বলিয়া পত্র লেখা উপযুক্ত বিবেচনা করেন নাই। তিনি বাহির হইয়া মাজিষ্ট্রেটের জিনিস পত্র সহিত স্বীয় কুলীদিগকে নিজের আফিসের প্রাঙ্গণে ফিরিয়া আসিতে আদেশ করিলেন; এবং মাজিষ্ট্রেটের আরদালৗদিগকে বলিলেন, “মাজিষ্ট্রেটের পরওয়ানা ভিন্ন, আমার কুলী দিব না।” এই কথা মাজিষ্ট্রেটেয় কর্ণগোচর হইলে, তিনি রাগিয়া আগুন হইলেন; এবং রাজকার্য্যের অবরোধ এই দোষ দিয়া তাঁহার নামে নালিস করিলেন। আর একজন সিবিলিয়ানের কাছে বিচার হইল। অনেকে রাধানাথকে মাজিষ্ট্রেটের নিকট মার্জ্জনা চাহিতে পরামর্শ দিলেন; তিনি কিছুতেই তাহাতে সম্মত হইলেন না। সিবিলিয়ানের বিচারে তাঁহার ২০০ দুই শত টাকা জরিমানা হইল। তিনি গ্রাহ্যই করলেন না; দুই শত টাকা দণ্ড দিলেন। কিন্তু ইহাতে যে আন্দোলন উঠিল তাহাতে বলপূর্ব্বক গরীব কুলীদিগকে শ্রম-সাধা কার্য্যে নিযুক্ত করিবার রীতি রহিত হইয়া গেল।
 উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে বাসকালের মধ্যে তাঁহার পদবৃদ্ধি হইয়া তিনি ৬০০ শত টাকা বেতনে সর্ব্ব প্রধান কম্পিউটারের পদে আরোহণ করেন। কেবল তাহা নহে; সারভে সংক্রান্ত গণিতে তিনি এমন পারদর্শী ছিলেন, যে কর্ণেল থু লয়ার সারভে বিষরে যে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ মুদ্রিত করেন, তাহার প্রধান প্রধান গণনা তিনি লিখিয়া দিয়াছিলেন।
 ১৮৫৩ সালে তাঁহার পিতা ইহলোক পরিত্যাগ করেন। ইহার কয়েক বৎসর পরেই তিনি পেনসন লইয়া স্বদেশে ফিরিয়া অসিলেন। এরূপ শুনিতে পাওয়া যায় তখন তাঁহার আচার ব্যবহার অনেকটা ইংরাজের মত হইয়া গিয়াছিল। ইংরাজী ধরণে থাকিতে ও খাইতে ভাল বাসিতেন। এমন কি তাঁহার বাঙ্গালার উচ্চারণও বদলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার উৎসাহ ও আত্মোন্নতি-বাসনার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই যে তিনি বঙ্গদেশে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হইয়াই মনোযোণ সহকারে বাঙ্গালা ভাষার চর্চাতে নিযুক্ত হইলেন। পণ্ডিত র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমূখ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতগণ এবং অক্ষয়কুমার দত্ত প্রভৃতি তৎপদানুযায়ী লেখকগণ বাঙ্গালী ভাষাকে যেরূপ পরিচ্ছদ পরাইয়া তুলিতে ছিলেন, তাহা তাহার চক্ষুশূল হইয়া উঠিল। তিনি বলিতে লাগিলেন যে ভাষা স্ত্রীলোকে বুঝিবে না, তাহা আবার বাঙ্গালা কি? এই ভাবটা তাঁহার মনকে এমনি অধিকার করিল ষে তিনি বাল্যবন্ধু পরম সুহৃদ প্যারীচাঁদ মিত্রকে সরল সহজ বাঙ্গালা লিখিবার জন্য প্ররোচনা করিতে লাগিলেন। উভয়ের সম্পাদকতাতে “মাসিক পত্রিকা” নামক পত্রিকা বাহির হইল; এবং অল্পদিন পরে প্যাঁরিচাদ মিত্র “আলালের ঘরের দুলাল” নামক উপন্যাস প্রচার করিলেন।
 সরল স্ত্রীপাঠ্য ভাষাতে বাঙ্গালা লেখা রাধানাথের একটা বাতিকের মত হইয়া উঠিয়াছিল। মাসিক পত্রিকাতে কোনও প্রবন্ধ লিখিয়া তিনি স্বীয় পরিবারস্থ স্ত্রীলোকদিগকে পড়িয়া শুনাইতেন, তাঁহারা বুঝিতে পারেন কি না। শুনিতে পাওয়া যায় একদিন রাত্রি প্রভাত হইবার পূর্ব্বেই প্যারীচাঁদ মিত্রের গৃহের দ্বারে গিয়া ডাকাডাকি,—প্যারি, প্যারি! উঠ উঠ, এবারকার পঞ্জিকা পড়িয়া তোমার স্ত্রী কি বলিলেন?”
 তিনি অতিশয় সহৃদয় ও স্বগণ-বৎসল লোক ছিলেন। নিজে দারপরিগ্রহ করেন নাই; ঘরে শিশু-সন্তানের মুখ দেখার সুখ হয় নাই; কিন্তু শিশুদিগকে বড় ভালবাসিতেন; আত্মীয় স্বজনের বালক বালিকাদিগকে লইয়া নিজের নিকট রাখিতেন; তাহাদের সহিত গল্প করিতে ও খেলা করিতে ভাল বাসিতেন।
 জীবনের শেষদশাতে তিনি চন্দননগর গোদলপাড়াতে গঙ্গার ধারে একটা বাগানবাটী ক্রয় করিয়া সেখানে অৰস্থিত হইয়াছিলেন। সেখানে ১৮৭০ সালের ১৭ই মে দিবসে তাঁহার দেহান্ত হয়।