রূপসী বোম্বেটে/প্রথম খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ


এইবার আমরা “রূপসী বোম্বেটে” মিস্‌ আমেলিয়া কার্টার ও তাঁহার অনুচরগণের অনুসরণ করিব।

 যে জেলে রাত্রিশেষে সমুদ্রে মাছ ধরিতে গিয়া দুইখানি ফ্ল্যাটকে একখানি জাহাজের দিকে যাইতে দেখিয়াছি,—সে একবারও সন্দেহ করে নাই যে, সেই ফ্ল্যাটে সাল্‌ভেরিনর প্রেসিডেণ্টকে দুই কোটী মুদ্রাসহ চুরী করিয়া লইয়া যাওয়া হইতেছে। এমন কি, মিঃ ব্লেক ভিন্ন অন্য কেহ তাহার উক্তিতে আস্থা স্থাপনও করেন নাই।

 প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনকে ফ্ল্যাটের উপর হইতে জাহাজে উত্তোলিত করা হইল; স্বর্ণমুদ্রাগুলি জাহাজের ধনাগারে রক্ষিত হইলে অমেলিয়া জাহাজ চালাইবার আদেশ দিলেন। এতক্ষণ পর্য্যন্ত বোম্বেটেজাহাজ ‘ফ্লোর-ডি-লিজ্‌’-এর উপরে কোনও আলোক ছিল না; জাহাজের প্রতি তীরস্থ কোনও লোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়, এই অভিপ্রায়েই জাহাজের উপরের সমুদয় আলোক নির্ব্বাপিত করা হইয়াছিল। জাহাজ চলিতে আরম্ভ করিলে তাহার ল্যাম্পগুলি পুনঃ-প্রজ্বলিত হইল; এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই জাহাজ দ্রুতবেগে মুক্ত সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হইল!

 ফ্লোর-ডি-লিজ্‌ প্রথমে দক্ষিণ দিকে চলিল। ঠিক সেই সময়ে স্মিথ সমুদ্রে পড়িয়া হাবুডুবু খাইতেছিল; এবং অদূরবক্ত কর্সেয়ার জাহাজের ডেকে বসিয়া ‘টাইগার’ দূর সমুদ্রের দিকে চাহিয়া কাতর ভাবে আর্ত্তনাদ করিতেছিল। মিঃ ব্লেক টাইগারের আর্ত্তনাদের কারণ স্থির করিতে না পারিয়া অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিলেন। ফোর-ডি-লিজ্‌ দ্রুতবেগে ম্যাগিলান্ উপসাগরের অভিমুখে ধাবিত হইল।

 ফ্লোর-ডি-লিজ্‌কে পথিমধ্যে ভাল্‌পারেসোর বন্দরে ভিড়াইলে, আমেলিয়া সেখানে লণ্ডন হইতে প্রেরিত একখানি টেলিগ্রাম পাইলেন। তিনি টেলিগ্রামখানি খুলিয়া পাঠ করিলেন, “ওরিনকোর কাজ শেষ। আজ রাত্রে বি—ও ফরসা। সকল বাধা বিঘ্নের অবসান। মালিককে সংবাদ দাও; আর কি করিতে হইবে জানাও।”

 আমেলিয়া টেলিগ্রামখানি পাঠ করিয়া হঠাৎ গম্ভীর হইয়া হইয়া উঠিলেন, তাঁহার মুখে আনন্দ বা উৎসাহের কোনও চিহ্ন পরিলক্ষিত হইল না; তাঁহার চক্ষুতে বিষাদের ছায়া পড়িল। তিনি বিষ মনে টেলিগ্রামখানি তাঁহার মাতুল গ্রেভিসের হাতে দিলেন।

 গ্রেভিস টেলিগ্রামখানি পাঠ করিয়া আনন্দে উৎফুল্ল হইল; সহর্ষে বলিল, “সু-খবর বটে! উপযুক্ত লোকের হাতেই এই গুরুতর কার্য্যের ভার দেওয়া হইয়াছিল; তাহারা নির্ব্বিঘ্নে সকল কাজ শেষ করিয়াছে। রবার্ট ব্লেক ও তাহার সাগরেদ স্মিথ আর আমাদের কোনও অনিষ্ট করিতে পারিবে না।—এখন আমরা নিশ্চিত হইতে পারি।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “বাধ্য হইয়া আমাদিগকে এমন নিষ্ঠুরের কাজ করিতে হইল, এজন্য আমি বড়ই দুঃখিত হইয়াছি। আমি কোনও দিনও নরহত্যার পক্ষপাতিনী নহি। মিঃ ব্লেক অসাধারণ লোক; যদি তিনি আমার শক্রতায় প্রবৃত্ত না হইতেন, তাহা হইলে তাঁহাকে এ ভাবে অকালে প্রাণ হারাইতে হইত না। তাঁহার মৃত্যুতে আমি আত্মীয়-বিয়োগ বেদনা অনুভব করিতেছি। যদি তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইতেন, আমার দলে যোগ দিতেন, তাহা হইলে তাঁহার সহায়তার পৃথিবীতে কোন্ কার্য্য আমার অসম্ভব হইত? এমন শক্তিসম্পন্ন উদার হৃদয়,প্রতিদ্বন্দ্বী আর কখনও পাইব না।”

 আমেলিয়া উঠিয়া তাঁহার কেবিনে প্রবেশ করিলেন, এবং দ্বার রুদ্ধ করিয়া একখানি পিত্তল নির্ম্মিত খট্টায় দেহ-র প্রসারিত। করিলেন। তাঁহার নয়নযুগল হইতে মুক্তা-বিন্দুর ন্যায় অশ্রু বর্ষিত হইতে লাগিল।

 মিঃ ব্লেকের হত্যা-সংবাদে আমেলিয়ার, এরূপ ভাবান্তর লক্ষ্য করিলে তাঁহার অনুচরগণ নিশ্চয়ই বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইত; কারণ, তাহারা জানিত না, মিঃ ব্লেকের সহিত পূর্ব্বে একাধিকবার তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল; এমন কি, আমেলিয়া তাঁহার রূপ গুণে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার প্রেমে আত্মহারা হইয়াছিলেন। তিনি আকার ইঙ্গিতে মিঃ ব্লেককে তাঁহার মনের ভাবও জানাইয়াছিলেন। কিন্তু মিঃ ব্লেক মানব-হিতব্রতে জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন, বিবাহে তাহার প্রবৃত্তি ছিল না। ‘রূপসী বোম্বেটে’কে বিবাহ করিবার ইচ্ছা ত দূরের কথা! প্রেমের প্রত্যাখানে আমেলিয়া ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন, মিঃ ব্লেকের প্রতি বিরক্তও হইয়াছিলেন। কিন্তু আজ তিনি বুঝিতে পারিলেন, ব্লেককে তিনি ভুলিতে পারেন নাই। যে প্রেম তাঁহার হৃদয়ে অন্তঃশলিলা ফন্তুর ন্যায় প্রবাহিত হইতেছিল, মিঃ ব্লেকের মৃত্যু-সংবাদে তাহা। তাঁহার নারী-হৃদয়’ প্লাবিত করিয়া নয়ন-পথে অশ্রুর নিঝর মুক্ত করিল।

 মিঃ ব্লেকের মৃত্যু সংবাদে রাইমারেরও আনন্দের সীমা রহিল না। যে ব্লেকের ভয়ে সে ইংলণ্ড হইতে পলায়ন করিয়াছিল, আমেলিয়ার গুপ্তচর তাহার প্রাণসংহার করিয়াছে। কি আনন্দের সংবাদ। —এত দিনে সে নিষ্কণ্টক হইল।

 প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন ফ্লোর-ডি-লিজ্‌ জাহাজের একটি ক্ষুদ্র কামরায় বন্দীভাবে অবস্থিতি করিতেছিলেন, আমেলিয়া এ পর্য্যন্ত তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন নাই; জাহাজ ভাল্‌পারেসোর বন্দর পরিত্যাগ করিয়া সমুদ্রপথে অগ্রসর হইলে, তিনি পিয়ারসনের সহিত আলাপ করিবার জন্য তাঁহাকে ডেকের উপর আনিতে আদেশ করিলেন।

 তখন রাত্রি কাল। আমেলিয়া তাঁহার জাহাজের কর্ম্মচারীগণকে দূরে, যাইতে আদেশ করিয়া মিঃ পিয়ারসনের প্রতীক্ষায় বসিয়া রহিলেন।

 একজন কর্ম্মচারী পিয়ারসনকে তাঁহার সম্মুখে রাখিয়া প্রস্থান করিল। ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলোকে প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন আমেলিয়াকে সম্মুখে উপবিষ্ট দেখিয়া বিস্মিত হইলেন; এই অলোকসামান্য রূপসীর রূপ-জ্যোতিতে তাহার চক্ষু ধাঁধিয়া গেল!

 আমেলিয়া যখন জাল পরিচয়-পত্র লইয়া সাল্‌ভেরিটায় উপস্থিত হইয়াছিলেন, তখন প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনই তাহাকে সম্ভ্রান্ত সমাজে পরিচিত করেন।—সেই যুবতী আতিথ্যের মর্য্যাদা বিস্মৃত হইয়া তাহার প্রতি এরূপ ব্যবহার করিবেন প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন তাহা স্বপ্নেও ভাবেন নাই। তাঁহারই রূপবতী অতিথি তাঁহার এই বিপদের মূল, ইহা বুঝিতে পারিয়া তিনি বড়ই মর্ম্মাহত হইলেন; হঠাৎ তাঁহার ক্রোধানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। কিন্তু সে সময় সে স্থানে ক্রোধ প্রকাশ নিস্ফল বুঝিয়া তিনি আত্মসংবরণ করিলেন; তথাপি বিদ্রুপের প্রলোভন সংবরণ করিতে পারিলেন না। তিনি বিদ্রুপপূর্ণ স্বরে বলিলেন, “ধন্যবাদ আপনাকে! আমি জানিতাম না আপনি এমন উদার ভাবে আমার আতিথ্যের প্রতিদান করিবেন! আপনি যখন আমার প্রিয় বন্ধুর স্বাক্ষরিত পরিচয়-পত্র লইয়া সাল্‌ভেরিটায় উপস্থিত হন। তখন আমি একবারও সন্দেহ করি নাই যে, তাহা জাল পরিচয়-পত্র। পুরুষ জালিয়াৎ অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু নারী জালিয়াৎ বোধ হয় এই প্রথম দেখিলাম। উপন্যাসে পাঠ করিয়াছি, খলতায় নারী সর্পকেও পরাজিত করে; এখন বুঝিতেছি, আপনার মত রূপসীর খলতায় শয়তানকেও লজ্জায় মুখ ঢাকিতে হয়।”

 প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন কথাগুলি বলিতে বলিতে বিলক্ষণ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি বোধ হয় আরও কিছুকাল বক্তৃতা করিতেন, কিন্তু আমেলিয়া তর্জ্জনী উদ্যত করিয়া তাহাকে ক্ষান্ত হইতে ইঙ্গিত করিলেন; তাহার পর সুস্পষ্ট ঘৃনার স্বরে বলিলেন, “ধীরে, মহাশয়, ধীরে! আপনার এখন উত্তেজিত হইয়া লাভ নাই। আমার উপর রাগ করিয়া আপনি প্রলাপ বকিবেন না। আপনি বলিতেছেন, আমার মত রূপসীর খলতায় শয়তানকেও লজ্জায় মুখ ঢাকিতে হয়; এ কথা সত্য হইলে আপনারই মুখ ঢাকিয়া কথা বলা উচিত ছিল।” অনন্তর আমেলিয়া একটি সিগারেট ধরাইয়া, নিশ্চিন্ত ভাবে কয়েক বার ধূম উদগীরণ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আমি সর্প অপেক্ষা অধিক খল হইতে পারি, শয়তান অপেক্ষাও নির্লজ্জ হইতে পারি, কিন্তু আপনার তিরস্কার শুনিবার অভিপ্রায়ে আপনাকে বাঁধিয়া আনি নাই; আপনাকে ধরিয়া আনিবার অন্য উদ্দেশ্য আছে। মিঃ জেমস্‌ পিয়ারসন, যে পর্যন্ত আমার সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয়, তত দিন আপনি আমার অতিথি। যে “জিমি’ পিয়ারসন একদিন অষ্ট্রেলিয়ায় জিগ্‌স খনির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ছিল, যে পিয়ারসন একদিন বিশ্বাসঘাতক তস্করের ন্যায় প্রভু-পত্নীর সর্ব্বস্ব লুষ্ঠিত করিয়া তাঁহার অকালমৃত্যুর কারণ হইয়াছিল; সেই নারীহন্তা বিশ্বাসঘাতক ভৃত্যকে তাহার প্রভুকন্যা স্বহস্তে গ্রেপ্তার করিয়া আনিয়া যদি তাহার বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত দণ্ড দানে উদ্যত হইয়া থাকে, তবে আশা করি পরমেশ্বর তাহার সে অপরাধ মার্জ্জনা করিবেন।”

 আমেলিয়ার কথা শুনিয়া প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের লোমাঞ্চ হইল; তিনি বিস্ফারিত নেত্রে আমেলিয়ার মুখের দিকে চাহিয়া সবিস্ময়ে বলিলেন,“আপনার কথার অর্থ বুঝিতে পারিলাম না।—আপনি কে?”

 আমেলিয়া বলিলেন, “পূর্ব্ব-কথা ভুলিয়া না থাকিলে সহজেই আমার কথার অর্থ বুঝিতে পারিতে। আমি কে, তাহা এখনও। বুঝিতে পার নাই? আমি মিঃ কার্টারের কন্যা—আমেলিয়া কার্টার, যাহাকে তোমরা ‘রূপসী বোম্বেটে’ বলিয়া জান,ও যমের মত ভয় কর।—সেই যম স্বয়ং তোমাকে গ্রেপ্তার করিয়া আনিয়াছে।”

 প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন বিস্ময়ে চক্ষু দু’টি কপালে তুলিয়া-অস্ফুট স্বরে আর্ত্তনাদ করিলেন, বলিলেন, “রূপসী বোম্বেটে! জন কার্টারের কন্যা বোম্বেটেগিরি করিতেছে!—আমি কি স্বপ্ন দেখিতেছি?”

 আমেলিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “না, স্বপ্ন নহে সত্য; ‘জিমি’ যদি ছয় বৎসরের মধ্যে জিগস্‌ খনির ডাইরেক্টরের পদ হইতে একটি স্বাধীন রাজ্যের নির্ব্বাচিত রাজা হইতে পারে, তাহা হইলে জন কার্টারের কন্যাকে সেই সময়ের মধ্যে বোম্বেটে দলের অধিনায়িকা হইতে দেখিলে ‘জিমি’ পিয়ারসনের বিস্মিত হইবার কারণ নাই। কে প্রতিভার গতি রোধ করিবে?”

 প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন বলিলেন, “আমেলিয়া কার্টার আজ বোম্বেটে সর্দ্দারণী?—কি আশ্চর্য্য!”।

 আমেলিয়া বলিলেন, “হাঁ বোম্বেটে;, আমি বোম্বেটে সর্দ্দারণী, আর তুমি কি? যে ভৃত্য প্রভুর সর্ব্বস্ব গ্রাস করিয়াছে, সে কি বোম্বেটে নয়? বোম্বেটে রাজশক্তি লাভ করিলে রাজার সম্মান পায়। প্রমাণ তুমি! প্রবলের বর্ব্বরতা শোভা পায়; নতুবা তোমার মত বর্ব্বর সালভেরিটার রাজা নির্ব্বাচিত হইবে কেন?”,,

 প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার অবস্থা বড় সঙ্কটাপন্ন; কিন্তু কি উপায়ে তিনি এ বিপদ হইতে পরিত্রাণ লাভ করিবেন, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না। ব্যাপার কি বুঝিবার জন্য তিনি আমেলিয়াকে বলিলেন, “তুমি জন কার্টারের কন্যাই হও, আর অন্য কেহ হও, তাহাতে আমার আপত্তি নাই; রূপসী বোম্বেটের উপর আমার ব্যক্তিগত আক্রোশ নাই বটে, কিন্তু তাহাকে আমার রাজ্যে গ্রেপ্তার করিতে পারিলে, তাহার দস্যুবৃত্তির উপযুক্তদণ্ড দানে কুণ্ঠিত হইতাম না। আমি ত তোমার কোনও ক্ষতি করি নাই, তবে আমাকে কেন অনর্থক বন্দী করিয়া আনিয়াছ? কেন আমার সর্ব্বনাশ করিতে বসিয়াছ?”

 আমেলিয়া সিগারেটটা দূরে নিক্ষেপ পূর্ব্বক পিয়ারসনের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রুক্ষস্বরে বলিলেন, “আমার কোনও ক্ষতি কর নাই? ধিক্‌, এমন নির্লজ্জ মিথ্যা কথাও তোমার মুখে বাধিল না! তুমি আর তোমার কয়েকটি অনুচর—কয়েকজন তস্কর একত্র মিলিয়া আমার মায়ের সর্ব্বস্ব লুণ্ঠন করিলে, অনায়াসে নারীহত্যা করিলে; শেষে আমাকেও পথে বসাইলে। সম্বলহীনা আশ্রয়বঞ্চিতা অনাথিনী আমি একাকিনী সংসার-সমুদ্রে ভাসিলাম!—কিন্তু দুর্জ্জনের দর্পহারী ভগবান আমাকে ত্যাগ করিলেন না। তাই আজ আমি আমেলিয়া কার্টার—দিগ্বিজয়ী জলদস্যু!—আমার প্রবল প্রতাপে আটলাণ্টিকের এক প্রান্ত হইতে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত সকল জাতির বাণিজ্য-পোতচালকগণ আজ কম্পমান আমার ভয়ে তটস্থ! আমি জননীর মৃত্যু-দিনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, তোমার বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ প্রদান করিব;—সে প্রতিজ্ঞা না করিলে তোমার মৃত কীটকে পদদলিত করিবার জন্য আমি অগ্রসর হইতাম না।—তুমি আইনকে ফাঁকি দিয়া সাল্‌ভেরিটায় পলায়নপূর্ব্বক সেখানে রাজাগিরি ফলাইতেছ; কিন্তু দর্পহারী ভগবান তোমাকে চূর্ণ করিবার জন্য সেই দূর দেশেও আমাকে পাঠাইয়াছিলেন। রাজদণ্ড যেখানে। ব্যর্থ, আমার দণ্ড সেখানে যমদণ্ডের মত অমোঘ।

 “তুমি আর তোমার চোর সঙ্গীরা-সকল শয়তানই স্বকৃত-কর্ম্মের ফলভোগ করিবে। আমি সর্ব্বপ্রথমে তোমাকেই চূর্ণ করিতে বসিয়াছি। ইতিমধ্যেই আমি তোমার মান সন্ম্রাম সব নষ্ট করিয়াছি; পৃথিবীর সকল দেশের সংবাদপত্রে তার বাহির হইয়াছে—সাল্‌ভেরিটার প্রেসিডেণ্ট জেমস্‌ পিয়ারসন রাজকীয় তহবিলের দুই কোটী টাক চুরী করিয়া ফেরার হইয়াছে।—চোরকে চোর বল বোধ হয় অন্যায় হয় নাই।”

 প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন অধীর স্বরে বলিলেন, “তুমি নারী নহ, পিশাচী; তুমি রূপসী নহ, শয়তানী।”।

 আমেলিয়া ধীর ভাবে বলিলেন, “আমি শয়তানের সহিতই শয়তানের মত ব্যবহার করি; যে পিশাচ-সে-ই আমার হস্তে পৈশাচিক দণ্ড লাভ করে।—আমি আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কয়েক খানি সংবাদপত্র সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছি, তাহা পাঠ করিলেই আমার কথা সত্য কি না জানিতে পারিবে।—এ সকল আমারই খেলা; অমি আমার এই জাহাজে বসিয়া পৃথিবীব্যাপী জাল টানি; তুমি সেই জালে আবদ্ধ হইয়া ‘চোর’ খেতাব পাইয়াছ। এখন ইহতে লোকে তোমাকে ‘চোর রাজা’ বলিবে।”  মিঃ পিয়ারসন বলিলেন, “ইহাতেও তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় নাই? আর কত কষ্ট দিবে? স্বামি তোমার অনুগ্রহ ভিক্ষা করি না; জানি, তোমার সে ভিক্ষা দানের শক্তি নাই। আমি তোমাদের সর্ব্বস্বান্ত করিয়াছি, এ অপবাদের প্রতিবাদ করিবারও ইচ্ছা নাই; কারণ, আমি তোমাদের হিতাকাক্ষী ছিলাম,এ কথা বলিলে তুমি তাহা বিশ্বাস। করিবে না। তুমি নারী, এই জন্যই তোমার হৃদয়ের দোহাই দিতেছি; তুমি একবার মেন্‌ডোজার অভাগিনী কন্যার কথা চিন্তা কর। তাহাকে শোকের সমুদ্রে ভাসাইও না; সে আমাকে ভালবাসে, তাহার হৃদয় বিদীর্ণ করিও না। আমাকে হারাইয়া সে কি বাঁচিবে?—তোমার ইচ্ছা হয়, টাকাগুলা আত্মসাৎ কর, আমার আরও অধিক কলঙ্ক প্রচারিত কর; কিন্তু একবার তাহাকে জানাও আমি তস্কর নহি, আমি তাহার প্রণয়ের অযোগ্যও নহি। তুমি বোধ হয় জান না; আমি আমার পুরাতন কপট বন্ধুগণের সংশ্রব বিষের মত ত্যাগ। করিয়াছি; আমার প্রকৃতির সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন হইয়াছে। আমি অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজের শক্তিতে যে উন্নতি লাভ করিয়াছি, যে সম্মানের অধিকারী হইয়াছি, আমি তাহার অযোগ্য নহি; ইহার। মধ্যে কোনও প্রকার প্রতারণা প্রবঞ্চনা নাই। কিন্তু তোমার ব্যবহারে আমার সে গৌরব,—মান সন্ত্রম সমস্তই নষ্ট হইয়াছে। আমার মান সম্রম, পদমর্য্যাদা আর যে ফিরিয়া পাইব, সে আশা নাই। ইহাতেও কি তুমি সন্তুষ্ট নও? মানুষের প্রতিহিংসা ইহা অপেক্ষা আর কত দূর কঠোর হইতে পারে?—মেন্‌ডোজা-কুমারী তোমার কোনও অনিষ্ট করেন নাই; তাঁহার জীবনের সুখ নষ্ট করিও না। আমার অপরাধে তাঁহার হৃদয় মরুভূমিতে পরিণত করিও না।”  আমেলিয়া বলিলেন, “আজ তুমি একটি নিরপরাধ রমণীর প্রতি দয়া দেখাইবার জন্য আমাকে অনুরোধ করিতেছ; সেই যুবতী তোমার প্রণয়িনী বলিয়াই তোমার এ অনুরোধ। কিন্তু তুমি কি আমার অনাথা জননীর প্রতি দয়া প্রদর্শন করিয়াছিলে? তোমার সহযোগী তস্করেরা তখন কি একবারও তাহাদের দুষ্কর্ম্মের কথা ভাবিয়াছিল? —তিনি ত তোমাদের কোনও অপকার করেন নাই; তাঁহার অপরাধ, তিনি তোমাদিগকে বিশ্বাসী মনে করিয়া তাঁহার স্বর্ণখনির সমস্ত ভার তোমাদের হস্তে অর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন। তোমরা সর্পের ন্যায় তাঁহাকে দংশন করিয়াছিলে। আমাকে তোমরা ভিখারিণী করিয়াছিলে; এবং আইনের সাহায্যে তোমাদের কোনও অনিষ্ট করিতে পারিব না, এই ভরসায় নিশ্চিন্ত ছিলে। তোমাদের অত্যাচারে আমি যে যন্ত্রণা সহ্য করিয়াছি, জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত তাহা আমার স্মরণ থাকিবে।—প্রতিহিংসার কথা কি বলিতেছ? তোমাদিগকে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া তোমাদের মাংস কুকুরের মুখে নিক্ষেপ করিলেও আমার মনের জ্বালা জুড়াইবে না।—তোমাদিগকে ক্ষুদ্র কীটের ন্যায় পদতলে নিষ্পেষিত করিবার জন্য আমি এত কাল ধরিয়া কি চেষ্টাই না করিয়াছি? আমি ঘৃণিত দস্যুদলে যোগদান করিয়াছি; নিজের শক্তিতে আহাদের অধিনায়িকার, পদ লাভ করিয়াছি। তাহারা আমার ইঙ্গিতে পরিচালিত হইতেছে। তাহাদের সুখ দুঃখ ক্ষতি লাভের জন্য আমিই দায়ী। তোমাকে কারারুদ্ধ করিয়া। কেবল আমার নহে, তাহাদেরও লাভ আছে; সুতরাং তোমাকে মুক্তিদানের ইচ্ছা থাকিলেও আমি তোমাকে ছাড়িতে পারিব না। ছাড়িভে পারিব না বলিয়াই, যিনি তোমাকে উদ্ধার করিতে পারিতেন। সেই ব্যক্তিকে—পৃথিবীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ মিঃ ব্লেককে হত্যা করা হইয়াছে।আমি তোমার সর্ব্বস্বান্ত করিয়াই ক্ষান্ত হইব না, যত দিন তুমি বাঁচিবে, জীবন্মৃত ভাবে দুর্ব্বহ জীবন-ভার বহন করিবে। আমার এই সঙ্কল্প কোনও কারণে ব্যর্থ হইবে না। তবে তুমি সিনর মেন্‌ডোজার কন্যার সুখ শান্তির কথা বলিতেছে; তাঁহার সম্বন্ধে কি কর্ত্তব্য, আমি তাহা ভাবিয়া দেখিব। আমি জীবনে যেরূপ অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছি, ঈশ্বর করুন অন্য কোনও রমণীকে যেন সেরূপ যন্ত্রণা সহ্য করিতে না হয়।—এখন তুমি তোমার কারাপ্রকোষ্ঠে প্রত্যাগমন কর, আপাততঃ আমার আর কিছুই বক্তব্য নাই; তোমার প্রতি কিরূপ দণ্ডের ব্যবস্থা করিব, তাহা পরে জানিতে পারিবে।”

 প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন আর বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করিয়া উঠিলেন; আমেলিয়ার ইঙ্গিতে একজন প্রহরী সেখানে উপস্থিত হইয়া তাহাকে কারা-প্রকোষ্ঠে লইয়া গেল। তিনি ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া সুত্র-চালিত পুত্তলিকার মত প্রহরীর অনুসরণ করিলেন।

 প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন প্রস্থান করিলে আমেলিয়া তাঁহার সুসজ্জিত কেবিনে প্রবেশ করিলেন, এবং কাগজ কলম লইয়া নিম্নলিখিত পত্রখানি লিখিলেন,

 “সিনরিটা মেন্‌ডোজাকে এতদ্বারা জ্ঞাপন করা যাইতেছে যে, তাঁহার প্রণয়ী প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ প্রচারিত হইয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কিন্তু প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন প্রথম জীবনে যে গুরুতর অপরাধ করিয়াছিল, এখন তাহাকে সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইতেছে। অপরাধ যেমন গুরুতর, প্রায়চিত্তও সেইরূপ কঠিন। সত্য কথা বলিতে কি, প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন সিনরিটা মেন্‌ডোজার পাণিগ্রহণের যোগ্য নহে; অতএব এই, দুর্জ্জনকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হওয়াই তাঁহার কর্তব্য।—সিনরিটাকে সাবধান করা যাইতেছে যে,—এই গুপ্তলিপি যদি তিনি কাহাকেও দেখিতে দেন, বা এ সম্বন্ধ কোনও কথা কাহারও গোচর করেন, তাহা হইলে প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনকে অতি সত্বর ঘাতকের হস্তে সমর্পণ করা হইবে। পত্রলেখক কোনও নিরপরাধ নারীর ক্ষতি করিতে ইচ্ছা করেন না; তাই প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের অনুরোধেই সিনরিটাকে এই পত্র লিখিত হইল। আশা করা যায় এই পত্র পাঠে সিনরিটা অনেকটা নিরুদ্বেগ হইবেন। এই পত্রের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিলে তাহা পত্রলেখকের অজ্ঞাত থাকিবে না।”

 পত্রখানি লেফাপায় পুরিয়া আমেলিয়া তাহাতে শিরোনামা লিখিলেন; তাহার পর তাহা টেবিলের উপর রাখিয়া তিনি উভয় হস্তে মুখ ঢাকিয়া গভীর চিন্তায় মগ্ন হইলেন।