লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/ব্রেজিলে

উইকিসংকলন থেকে



দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ।



ব্রেজিলে।

 ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে ওয়েল সাহেবের সুবিখ্যাত হিংস্র পশুপ্রদর্শনী দলে সুরেশ কার্য্য গ্রহণ করিলেন। ঐ বৎসরেই তিনি ঐ দলের সহিত আমেরিকায় গমন করিয়া নানাস্থানে নানা ক্রীড়া দেখাইতে লাগিলেন। ইউনাইটেড ষ্টেটের সমস্ত প্রধান প্রধান স্থানে ক্রীড়া প্রদর্শিত হইল, সর্বত্রই সুরেশ বিশেষ প্রশংসা লাভ করিলেন।

 ইয়োরোপ ও ইংলও হইতে এক্ষণে মার্কিন দেশ অনেক বিষয়ে শ্রেষ্ট। মার্কিনের নিউইয়র্ক নগর এক্ষণে লণ্ডনের নিয়েই শোভা সমৃদ্ধির জন্য পরিগণিত; এরূপ সহর জগতে আয় নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না;—সভ্যতার বলে, জ্ঞানে, বিদ্যায় নিউইয়র্কবাসীদিগের সমকক্ষ আর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না। এই সুবিখ্যাত নিউইয়র্ক নগরেও সুরেশ ব্যঘ্র সিংহের সহিত অদ্ভুত ক্রীড়া দেখাইয়া সকলকে মুগ্ধ করিয়াছিলেন, চারিদিকে তাঁহার প্রশংসা হইতে লাগিল, বড় বড় সম্বাদ পত্রে তাঁহার প্রতিমূর্তি প্রকাশিত হইতে লাগিল, নিউইয়র্কের আবাল বৃদ্ধ বণিতার মুখে কেবল তাহার কথা লইয়া আন্দোলন হইতে লাগিল।

 ইউনাইটেট ষ্টেট হইতে তিনি সারকাস দলের সহিত এখনে মেক্‌সিকো, পরে দক্ষিণ আমেরিকায় বিস্তৃত সাম্রাজ্য ব্রেজিলে উপনীত হইলেন। তাহার পূর্বে আর কখন কোন বাঙ্গালী এই দূরদেশে গমন করেন নাই। ব্রেজিল সাম্রাজ্য প্রায় ভারতবর্ষের ন্যায় বৃহৎ, দক্ষিণ আমেরিকার সমস্ত মধ্যপ্রদেশ এই সাম্রাজ্য ভুক্ত। এক্ষণে প্রথমে স্পেন ও পর্টুগালবাসীগণ আসিয়া উপনিবেশ স্থাপন করেন। তাঁহারা এই দেশের আদিম নিবাসী স্ত্রীদিগের সহিত উদ্বাহসূত্রে বন্ধ হওয়ায় এক বর্ণসঙ্কর জাতির সৃষ্টি হয়,এই জাতি ক্রিরোগ নামে খ্যাত। এক্ষণে ব্রেজিলের অধিবাসীদিগের মধ্যে ইহাদের সংখ্যাই অধিক। এতদ্ব্যতীত পটুগিজ প্রভৃতি শ্বেত জাতির সহিত কাফ্রি স্ত্রীলোকদিগের বিবাহে অন্য আর এক বর্ণসঙ্কর জাতির সৃষ্টি হয়;—ইহাদিগকে মুলাটো বলে। ব্রেজিলে মুলাটোর সংখ্যাও অতিশয় অধিক। এতদ্ব্যতীত পর্টূগিজ, জারমান প্রভৃতি ইয়োরোপীয় অনেক লোক এখানে অভিনিবেশ স্থাপন করিয়াছেন।

 পর্টূগিজগণ প্রথমে এদেশে রাজ্যস্থাপন করেন, পরে যখন নেপোলিয়ন পর্টূগাল দেশ আক্রমণ করিয়া রাজপরিবারকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিলেন, তখন রাজা স্বপরিবারে স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া ব্রেজিলে প্রস্থান করেন, পরে পর্টূগালের সহিত নেপোলিয়ানের সন্ধি হইলে রাজা আর দেশে ফিৱিলেন না, তিনি সম্রাট উপাধি গ্রহণ করিয়া ব্রেজিলে স্বাধীনভাবে রাজ্য করিতে লাগিলেন, তাহার জনৈক আত্মীয় আসিয়া পর্টূগালে রাজা হইলেন। তদবধি পর্টূগিজ সম্রাটই ব্রেজিলে রাজ্য করিতে হিলেন, পরে রাষ্ট্রবিপ্লব হইয়া এক্ষণে ব্রেজিল সাধারণতন্ত্র প্রণালী অনুসারে শাসিত হইতেছে।

 যে দেশে সুরেশ গৃহবাটী নির্ম্মাণ করিয়া বিবাহ করিয়া বসবাস করিয়াছিলেন, সে দেশের স্থূল বিবরণ তাঁহার জীবন বৃত্তান্তে অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। ভূবৃত্তান্ত পাঠে ইহার কতকটা আভাসও পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য দেশ যেরূপ উর্ব্বরা তাহাতে ইহাতে যদি সেইরূপ লোকের বসবাস থাকিত, তাহা হইলে জগতে ব্রেজিল ধনধান্যে একটী প্রধান দেশ বলিয়া পরিগণিত হইত,—কিন্তু ইহা আকারে ইয়োরোপের ন্যায় হইলেও ইহার লোক সংখা অতি অল্প। এই তিনটী সহর ব্যতীত আর সহর নাই, অধিকাংশ স্থলই ঘোর জঙ্গলে পূর্ণ,লোকালয়ের সম্বন্ধ নাই। এই বড় দেশে রেল একেবারেই ছিল না, সম্প্রতি কোন কোন স্থানে রেল হইয়াছে। ইহার প্রধান সহরের নাম রাইও-ডি জ্যানিরো। এই নগরটী আটলাণ্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত, ইহার লোকসংখ্যা সাড়ে তিন লক্ষের উপর নহে। এইটাই এ দেশের রাজধানী।

 এক্ষণে সুরেশ এই নগরে আসিয়া তাহার অদ্ভুত ক্রীড়া দেখাইতে লাগিলেন। তিনি যে এ সময়ে কেবল সরকাসই করিতেন এ রূপ নহে। “লা ক্রনিকা” নামক প্রসিদ্ধ সম্বাদ পত্রে আমরা দেখিতে পাই যে তিনি এই সময়ে নানা বিষয়ে বক্তৃতদিও প্রদান করিতেন। তিনি এই সকল বক্তৃতা যে কেবল ইংরাজীতেই দিতে লাগিলেন, এমত নহে;—ব্রেজিলে তিনি ব্রেজিলের রাজাভাষা পুর্টুগিজে সুন্দর বক্তৃতা প্রদান করিতে পারিতেন। এই সময়ে তিনি ইংরাজী, জার্ম্মাণ, স্পেনীয়, ফ্রেঞ্চ, পর্টুগিজ, ইটালিয়ন, ডানিস ও ডাচ্ এই সাতটী ভাষায় অনায়াসে অতি সুন্দর কথাবার্তা কহিতে পারিতেন। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে অবসর পাইলেই তিনি পাঠে মনোযোগী হইতেন। অঙ্কশাস্ত্র, দর্শন ও রসায়ন তাঁহার বিশেষ প্রিয় ছিল; এই সকল শাস্ত্রে তিনি যে সাতিশয় দক্ষ হইয়াছিলেন সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই; কারণ এই সময়ে তিনি নানা স্থানে এই সকল বিষয়ে বিশেষ পাণ্ডিত্য সহকারে বক্তৃতা প্রদান করিয়াছিলেন। নানা সম্বাদপত্রে তাঁহার এই সকল বক্তৃতায় বিশেষ প্রশংসাও প্রকাশ হইয়া ছিল। অভিনিবেশ থাকিলে শিক্ষার সময় কখনও শেষ হয় না এবং প্রতিভা ও আন্তরিক অনুরাগ থাকিলে অভীষ্টপথে অগণ্য বিঘ্ন অন্তয়ার যে অচিয়েই অন্তর্হিত হইয়া যায়, সুরেশচন্দ্রের জীবনের লক্ষ্য করিলে তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। আমরা একে একে দেখাইব, কত প্রতিকূলতা অতিক্রম করিয়া তিনি পরিশেষে ব্রেজিলে আপনার অবস্থিতির উপায় করি লইয়াছেন।

 ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে তিনি ব্রেজিলের রাজধানীতে আসিলেন, ব্রেজিলদেশ তাহার বড়ই ভাল লাগিয়াছিল;—ইহার প্রাকৃতিক শোভা দেখিয়া সুরেশ মুখ হইলেন,—তিনি এই দেশে বাস করিতে মনে মনে স্থিরসঙ্কল্প করিলেন। ঐকান্তিক অভিলাষ প্রায়ই অপূর্ণ থাকে না। তাঁহার এ ইচ্ছা পূর্ণ হইবার সুবিধাও ঘটিল-এই সময়ে ব্রেজিল দেশের রাজকীয় পশুশালায় পরিদর্শক ও রক্ষকের পদ শূন্য হইয়াছিল। সেই পদ পাইবার জন্য সুরেশ আবেদন করিলেন। সুরেশের ন্যায় পশুপালক ও শিক্ষককে গাইবামাত্র ব্রেজিল-রাজকর্ম্মচারিগণ তাঁহাকে তৎপদে নিযুক্ত করিলেন। তখন সুরেশ সারকাস পরিত্যাগ করিয়া ব্রেজিলের পশুশালায় সুপারিণ্টেডেণ্ট হইলেন! কর্ম্মান্তর গ্রহণে সুরেশচন্দ্র কখনও সঙ্কুচিত নছেন। জীবনে যাঁহার মমতা নাই—প্রাণের আশঙ্কা যাঁহার বাল্যকাল হইতেই দেখা ধার নাই, দুর্দ্দান্ত হিংস্রপশু সিংহ ব্যাঘ্র যাঁহার নিকট ক্রীড়নক মাত্র, কর্ম্মান্তর গ্রহণে সঙ্কুচিত হইবার কারণ তাঁহার পক্ষে অসম্ভব।