লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/সমুদ্র যাত্রা
একবিংশতি পরিচ্ছেদ।
সমুদ্র যাত্রা।
যে জাহাজ সুরেশ চাকুরী লইয়া চলিলেন সেই জাহাজ অনেক সাহেব মেম যাইতেছিলেন। সাহেবদিগের মধ্যে কতক গুলি সওদাগর, কতকগুলি চাকুরে, মেমদিগের মধ্যে কেহ কেহ স্বামী সমভিব্যাহারে দেশে যাইতেছিলেন, কেহ কেহ বা স্বাস্থ্যের কেহ কেহ বা দেশ বেড়াইবার জন্য চলিয়াছেন।
জাহাজের নাবিকদিগের মধ্যে অধিকাংশই ইংরেজ; জনকয়েক দেশী খালাসী আছে। সুরেশ কোনমতেই এই সকল লোকের সহিত মিশিতে পারেন না; যে সকল ইংরেজ নাবিক ছিল, সুরেশ প্রথম প্রথম তাহাদের সহিত মিশিতে পারিলেন না। তিনি আসিষ্টাণ্ট ষ্টুয়ার্ডের পদ পাইয়াছেন, ইহাতে তাহারা সন্তুষ্ট নহে, তবে তিনি কাপ্তেন সাহেবের প্রিয়পাত্র, কাপ্তেনের ভয়ে কেউ তাঁহার কোন অনিষ্ট করিতে সাহস পাইত না। কাহারও সহিত মিশিতে না পারি, কাহার সহিত কথা কহিতে না পাইয়া, বহুসংখ্যক লোক জাহাজে থাকা সত্ত্বেও তিনি যেন একাকী, এরূপ অবস্থায় সুরেশ বড়ই কষ্টে দিন কাটাইতে লাগিলেন। তিনি এরূপে দেশ ছাড়িয়া আসিয়া ভাল করেন নাই, মনে মনে ইহা ভাবিয়া সময় সময় অনুতপ্ত হইলেন; কিন্তু তিনি প্রথমে তাহার জীবন যেরূপ দু;খময় ভাবিয়াছিলেন, কয়েক দিন পরে দেখিলেন প্রকৃত পক্ষে তাহা নহে। আরোহীদিগের নিকট তাঁহার চাকুরীর খাতিরে নানা কার্য্যের জন্য যাইতে হইত। আরোহীদিগের পরিচর্যা করাই তাহার চাকুরীর প্রধান কার্য। কাজেই প্রায়ই তাহাকে তাহাদের সহিত কথা বা কহিতে হইত। অনেক আরোহী তাহাকে সর্বোতভাবে চাকরের ন্যায় ব্যবহার করি তেন, প্রায়ই তাঁহার সহিত কথা কহিতেন না; কিন্তু অনেকে তাহার বয়স অল্প, পরিচ্ছদ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, হাবভাব ভদ্রলোকেরা, তাঁহার ইংরাজি কথা ইংরাজের ন্যায় দেখিয়া তাহার সহিত কথা বার্ত্তা কহিতেন; কয়েকজন মেমও তাঁহার সহিত সস্নেহ ব্যবহার করতে লাগিলেন। মেয়েরা তার সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে উৎসুক হইতেন; এবং তাহার সহিত কথাবার্তা কহিয়াও বিশেষ আমোদ লাভ করিতেন। সাহেব দিগের মধ্যেও অনেকে তাহাকে দেশীয় বলিয়া ঘৃণা করিতেন না। যদিও তাহারা সুরেশকে সদ্বংশজাত বলিয়া জানিতেন না, তাকে খালাসী খানসামার জাতি মনে করিতেন, তবুও তাকে নিতান্ত চাকরের ব্যবহার করতেন না। সুরেশ প্রথমে জাহাজে কয়দিন যেরূপ মানসিক ক্লেশ বোধ করিয়াছিলেন, পরে পরিবর্তে এর বিশেষ আমোদে ও মুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন।
এতদিনে তাঁহার জীবনের আশা মিটিতে চলিল। তিনি যেই লণ্ডনের নিকট হইতেছেন। যে বিলাত দেখিবার এ তিনি কয়বৎসর উন্মাদের ন্যায় কলিকাতার রাজপথে ঘূরিতে ছিলেন, সেই বিলাত আর কয়েকদিনের মধ্যে তিনি দেখিতে পাইবেন! সেই বিলাতের রাজপথে তিনি বেড়াইতে পারিবেন। এ চিন্তায় তাহায় হৃদয় পূর্ণ হইয়া তাহার প্রাণ মন উৎফুল্লিত হইয়া উঠিতেছিল। তিনি ভাবলেন জাহাজস্থ সাহেব মেমগণ যখন তাহাকে এত যত্ন করিলেন, তাঁহারা যখন তাঁহার সহিত এত সদ্ব্যবহার করিলেন, তখন তিনি অনায়াসেই বিলাতে একটা চাকুরী জোগাড় করিতে পারিবেন। হয়ত কোন সদাশয় ইংরাজ তাঁহার ভবিষ্যত উন্নতির পথ উদঘাটিত করিয়া দিবার জন্য তাকে অর্থ সাহায্য করিতে পারেন। এই সফল মুখের চিন্তায় সুরেশ বড়ই সুখে দিন কাটাইতেছিলেন। তাহার সহকর্মচারিগণ এবং নাবিকগণ প্রথমে তাহার সহিত ভাল ব্যবহার না করলেও পরে তাহারা তাহাকে বিশেষ যত্ন করিয়াছিলেন। তাহাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করিয়া সকলেই তাহাকে আদর যত্ন করিতেন, তাহাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য সকলেই চেষ্টা পাইতেন। ইংরাজ নাবিকগণের ন্যায় মন খোলা লোক সংসারে আর নাই, ইহারা সকলের সঙ্গেই মিশামিশি করি। আমোদ প্রমোদ করিয়া থাকে। সুরেশ ইহাদের সহিত জাহাজে এতই বড় সুখে ছিলেন।
জাহাজে পথে কোন বাধা বিপত্তি ঘটিল না। ক্রমে নিরাপদে জাহাজ লণ্ডনে আসিয়া উপস্থিত হইল। আরোহীগণ দেশে পৌছিয়া কালবিলম্ব না করিয়া সকলে ব্যগ্র হইয়া জাহাজ হইতে নামিয়া স্বস্ব গন্তব্যস্থানে চলিয়া গেলেন। সুরেশ জাহাজের উপর দাঁড়াইয়া জগতের শ্রেষ্ট সহর লণ্ডন নগরের দিকে বিস্ফারিত নয়নে চাহিয়া রহিলেন।