লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/সুরেশের উচ্ছৃঙ্খলতা

উইকিসংকলন থেকে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।

সুরেশের উচ্ছঙ্খ‌ৃলতা

 সুরেশ লণ্ডন মিসন স্কুলের যে ভাল ছেলে ছিলেন তাহা বলা যায় না। পড়া শুনা করা অপেক্ষা দাঙ্গা হাঙ্গামা করিতে পারিলে তিনি অধিক সুখী হইতেন। মাষ্টারগণ তাঁহার ভয়ে সর্ব্বদা সশঙ্কিত রহিতেন। সুবিধা পাইলেই সুরেশ মাষ্টার মহাশয়দিগকে নানা প্রকার জ্বালাতন করিতেন। স্কুলের যত দাঙ্গাবাজ ছেলের সুরেশ দলপতি, কেবল যে স্কুলের লোক তাঁহাদের ভয় করিত এরূপ নহে, স্কুলের নিকটস্থ দোকানদার ও অন্য লোকজনও তাঁদের জ্বালায় জ্বালাতন হইয়া উঠিয়াছিল। সুরেশ প্রত্যহ ৯॥০ টার সময় নিয়মিতরূপ বাড়ী হইতে স্কুলে রওনা হইতেন, কিন্তু মাসের মধ্যে অন্ততঃ কিছুদিন শিক্ষকগণ তাঁহার টিকি দেখিতে পাইত না। কলেজের নিকট একটা তাঁহাদের আড্ডা ছিল, দুই প্রহরে তাঁহারই ন্যায় অন্যান্য বালকগণ সকলে একত্রিত হইয়া সেইখানে তাস জাষা প্রভৃতি খেলিত, পড়া শুনার কাছ দিয়াও যাইত না। সুরেশ তাহাদের সকলের কর্ত্তা, দলপতি; যত রকম নষ্টামির সদ্দার।

 সুরেশের এ ভাবে তাঁহার পিতা মাতা যে বিশেষ প্রাণে

বেদনা পাইতেন, তাহা বলা বাহুল্য। মায়ের নিকট তিনি বড়ই আদরের ছেলে ছিলেন, পারতপক্ষে তাহার মেহময়ী জননী তাঁহাকে কিছু বলিতেন না, কিন্তু পিতা গিরিশচন্দ্র বিশ্বাস কিরূপে চক্ষের উপর পুত্রকে অধঃপাতে বইতে দিবেন, তিনি বুঝাইয়া, ধমকাইয়া, মারিয়াও পুত্রকে পড়া শোনায় মন দেওয়াইতে পারিলেন না। ইহাতে তাহার পিতায় হৃদয়ে যে নিতান্তই কষ্ট হইবে, ইহা আর অধিক কথা কি?

 সুরেশ গাধা ছেলে ছিলেন না। তিনি যে খুব বুদ্ধিমান তাহা তাঁহার শিক্ষকগণ বলিতেন; একটু যত্ন করিয়া লেখা পড়া করিলে তিনি যে পণ্ডিত হইতে পারেন, তাহা তাঁহার পিতা, আত্মীয় স্বজন, শিক্ষক প্রভৃতি সকলই জানতেন, কিন্তু পড়াশোনা করিবার ছেলে সুরেশ নহেন, পড়ার নামে তাহার গায় জ্বর আসতি, স্কুলে বাড়ীতে সর্ব্বদাই তিনি কিছু না কিছু অকর্ম্ম করিতেন। দাঙ্গা হাঙ্গামা করিবেন, না পড়া শোনা করিবেন। মাষ্টারেরা হার মানিয়াছেন, তাঁহার পিতা তাঁহাকে দুই চক্ষে দেখিতে পারেন না, বাটীর কেহই তাঁহাকে দেখিতে পারিত না। এই সময়ে তাঁহার খুল্লতাত কৈলাসচন্দ্র বিশ্বাসের সহিতই তাঁহার সম্প্রীতি ছিল, আর কেহ তাঁহাকে দেখিতে পারিত না। তিনিও কাহাকে দেখিতে পারিতেন না। সুরেশের পিতা এখন জীবিত আছেন। তিনি নাথপুরে থাকিয়া ধর্মালোচনায় কালাতিপাত করেন, তাঁহার খুল্লতাত কৈলাস বাবুও জীবিত আছেন। তিনি এক্ষণে পেনসন লইয়া কড়েয়ায় বাড়ীতে আনে। সুরেশ এ পর্যন্ত বরাবরই কৈলাস বাবুর নিকট চিঠিপত্র লিখিয়া থাকেন।  এই সময়ে লণ্ডন মিশন কলেজের প্রিন্সিপাল আসটন সাহেব ছিলেন। তিনিও সুরেশকে ভাল করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনিও কিছু করিয়া উঠিতে পারেন নাই। ঘরে বাহিরে সর্ব্বত্র সুরেশ লাঞ্ছিত হইতেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁহার দৃক্‌পাত নাই। অবশেষে পিতা নিতান্ত উৎপীড়ন আরম্ভ করায় সুরেশ পিতার সহিত সাক্ষাৎ হইবে ভয়ে মধ্যে মধ্যে ৫।৭ দিন আর বাড়ী যাইতেন না। অনেক খ্রীষ্টান বালকের সহিত তাঁহার বন্ধুত্ব জন্মিয়াছিল, তিনি বাড়ী না গিয়া ইহাদের বাসায় আহারাদি করিয়া রাত কাটাইতেন। কাজেই খৃষ্টানের প্রতি তাঁহার পূর্ব্বে যে ভাব ছিল, তাহা এক্ষণে আর ছিল না। তিনি এক্ষণে বিনা দ্বিধায় খ্রীষ্টানদিগের সহিত আহার বিহার করিতেন, হিন্দুধর্ম্মে তাঁহার আস্থা ছিল না,—তিনি অন্য বিষয়েও যেরূপ উচ্ছৃঙ্খল হইয়াছিলেন, ধর্ম্ম আচার ব্যবহার, আহার বিচার সকল বিষয়েই সেইরূপ উচ্ছৃঙ্খল হইয়া ছিলেন। এই সময়ে খ্রীষ্টান মিশনারীগণ এ দেশীয়গণকে খ্রীষ্টান করিবার জন্য বিশেষ যত্ন করিতেন, সুরেশকেও খ্রীষ্টান করিবার জন্য যে প্রয়াস পাইয়াছিলেন, তাহা বলা বাহুল্য। আমরা এই স্থানে মিশনারী ও মিশন সম্বন্ধে দুই একটী কথা বলিব।

 মিশনারী সাহেবদিগের দ্বারা দেশের যে উপকার হয় নাই, এ কথা আমরা বলি না, তবে বিলাতের লোকের বিশ্বাস যে যাহারা মিশনারী হইয়া এ দেশে আইসেন, তাঁহারা আত্মোৎসর্গ ও স্বার্থত্যাগের চুড়ান্ত দৃষ্টান্ত দেখাইয়া থাকেন। তাঁহারা মনে করেন মিশনারী সাহেবেরা এ দেশে বড়ই কষ্টে কালযাপন করেন। একথা যে সত্য নহে, তাহা বলা বাহুল্য মাত্র। এ দেশে মিশনারী সাহেবেরা অতি সুখে সচ্ছন্দেই কালাতিপাত করিয়া থাকেন। খ্রীষ্টানদেশবাসীগণ মুক্ত হস্তে মিসনের জন্য অর্থ দিয়া থাকেন, তাঁহাদের বিশ্বাস কুসংস্কারাবিষ্ট, অন্ধকারে মগ্ন, কাষ্ট-প্রস্তর-পূজক ভারতবাসীগণকে প্রকৃত সত্যধর্ম্ম প্রদানের জন্য মিশনারীগণ এ দেশে আসিয়া থাকেন, এই মহৎকার্য্য সাধনের জন্যই তাঁহারা অবারিতরূপে অর্থব্যয় করিয়া থাকেন, কিন্তু ইহার যে কিছুই হয় না, তাঁহাদের অর্থ যে কেবল অপব্যয় হয়, তাহাই সপ্রমাণ করিবার এ আমরা প্রয়াস পাইব।

 ইংরেজ সওদাগরগণের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে ইংরেজ মিশনারীগণ আসেন নাই। তাঁহারা এদেশে ব্যবসা করিতে আসিয়া যখন দুর্ব্বল বিলাসাশক্ত মোগল সম্রাটকে সরাইয়া ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে সাম্রাজ্য স্থাপনা করিলেন, সেই সময়ে ইংরেজ মিশনারীগণও ভারতে আসিয়া দেখা দিলেন। পরের স্বাধীনতা কাড়িয়া লইয়া কেবল স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজ্য বিস্তায় করিতে স্বাধীনচেতা ইংরেজ জাতির প্রাণে বেদনা লাগে। ভারতে রাজ্য স্থাপনা হইল, ভারতবাসীর স্বাধীনতা হৃত হইল, একটা কিছু মহৎ উদ্দেশ্য না দেখাইলে, অন্ততঃ একটা কিছু সৎ উদ্দেশ্যের কথা মনকে না বলিলে, মহৎচেতা ইংরেজ জাতির প্রাণে বেদনা লাগে, তাহাই ভারতবাসীকে কুসংস্কার হইতে উদ্ধার করিবার জন্য ইংরেজ জাতি এদেশে মিশনারী পাঠাইতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহাদের জন্য জলের ন্যায় অর্থ ব্যয় করিতে লাগিলেন, দলে দলে মিশনারী আসিলেন, লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নগরে নগয়ে মিশন স্থাপনা হইল। স্থানে স্থানে মিশনারী সাহেবদিগের বাসের জন্য রাজপ্রসাদ সদৃশ অট্টালিকা সকল নির্ম্মিত হইল। যাঁহারা ভারতবাসীকে উদ্ধার করিবার জন্য মিশনারী হইয়া আসিতে লাগিলেন,—তাহাদের স্বদেশীয়গণ তাহাদিগকে স্বার্থ ত্যাগের উজ্জ্বলতম আদর্শ মনে করিতে লাগিলেন। দূর ভারতে,—উষ্ণ প্রধান ভারতবর্ষে কৃষ্ণমূর্ত্তি বিধর্ম্মীদিগের মধ্যে বসবাসে না জানি এই সকল মহাত্মার কত কষ্ট হইবে; এই ভাবিয়া দেশের লোক যাহাতে তাঁহাদের কোন কষ্ট না হয় সে জন্য মুক্তহস্তে অর্থ প্রদান করিতে লাগিলেন। জগতের লোক বুঝিল যে, ইংরাজগণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভারত গ্রহণ করেন নাই,—ভারতবাসীকে উদ্ধার করিবার জন্য তাঁহারা এ দেশে আসিয়াছেন,—ভারতের মঙ্গল সাধনই তাঁহাদের একমাত্র অভিপ্রায়।

 প্রথমে তাঁহারা ভারতবাসীকে খ্রীষ্টান করা অপেক্ষা তাহাদিগকে ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত করিবার জন্য প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। তাহাদিগের কৃতজ্ঞতা পাইবার জন্য তাহাদের পীড়ার ঔষধ দিতে থাকিলেন। তাঁহারা ভাবিয়াছিলেন, ইংরাজী শিক্ষাবলে যখন তাহাদের সহস্র বৎসরব্যাপী কুসংস্কার, পুত্তলিকা পূজা, আচার ব্যবহার নষ্ট হইবে;—তখন খ্রীষ্টিয়ধর্ম্মে তাহাদিগকে দীক্ষিত করিতে আর অধিক ক্লেশ পাইতে হইবে না। এই জন্য তাঁহারা দাতব্য চিকিৎসালয় ও বিদ্যালয় স্থাপন করিতে আরম্ভ করিলেন। এদিকে দেশ ইংরাজের হইয়াছে। রাজার সমস্ত কার্য্যই রাজভাষায় সম্পন্ন হয়, এরূপ স্থলে দেশের লোকের ইংরাজী না জানিলে উপার্জ্জন হয় না,—কোন কার্য্যই চলে না। কাজে কাজে দলে দলে এ দেশের বালকগণ মিশনারীদিগের স্থাপিত স্কুল কলেজে প্রবিষ্ট হইতে লাগিল। তখন ইংরাজী শিক্ষা করিবার আর দ্বিতীয় উপায় ছিল না। তখন গবর্ণমেণ্ট এখনকার মত দেশে শিক্ষা বিস্তারের কোনই বন্দোবস্ত করেন নাই। এখনকার মত তখন এদেশীয়গণ নিজেরাও কোন স্কুল কলেজ স্থাপন করেন নাই। এদেশের লেখা পড়ার ভার কাজে কাজেই একরূপ মিশনারীদিগের হস্তে পড়িল। পাশ্চাত্য সভ্যতার স্রোত এইরূপে এদেশে প্রবিষ্ট হইল। দিন দিন সকল প্রকারে দেশের ভাব পরিবর্ত্তিত হইতে লাগিল। নানা লোভে পড়িয়া জাতি যাওয়া ভয় সত্বেও অনেকে খ্রীষ্টান হইল। এই সময়ে দেশে দুর্ভিক্ষ্য হওয়ায় পেটের দায়েও অনেকে খ্রীষ্টান হইয়া পড়িল। ধর্ম্ম-বিশ্বাস অপেক্ষা এই সকল লোক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যে খ্রীষ্টান হইয়া ছিল তাহার প্রমাণ যাহারা খ্রীষ্টান হইয়াছে তাহার অধিকাংশই নীচ জাতি ও দরিদ্র। মফস্বলস্থ অনেক খ্রীষ্টান অভিনিবেশ আমরা স্বয়ং দেখিয়াছি। এই সকল দেশীয় খ্রীষ্টান, আনড্রু, পেনড্রু গমেশ, প্রভৃতি নাম ধারণ করিয়া থাকা সত্বেও ইহারা খৃষ্টীয় ধর্ম্মের কিছুই অবগত নহে, ঘোর কুসংস্কারে নিমগ্ন ও অজ্ঞতায় পূর্ণ। ইহারা খ্রীষ্টান হইবার পূর্ব্বে যেরূপ কালী শিতলা এভৃতি হিন্দু দেব মূর্ত্তির সম্মুখে প্রণাম করিত, ঠিক সেইরূপ এখনও করে। যদি ইহাদের খ্রীষ্টধর্ম্মে বিশ্বাস থাকিত, তাহা হইলে কখনই এরূপ করিতে পারিত না। আমরা ইহাও শুনিয়াছি যে শিক্ষিত দিগের মধ্যে যাঁহারা খ্রীষ্টান হইয়াছেন, তাঁহারা এখন অনুতপ্ত। কেহ কেহ স্পষ্টই বলেন যে যখন তাঁহাদের সাংসারিক জ্ঞান ছিল না, তখন মিশনারীগণ তাঁহাদিগকে ভুলাইয়া খ্রীষ্টান করিয়াছিলেন। যত সংখ্যক খ্রীষ্টান করিতে পারা যায়, ততই মিশনারী সাহেবের আয় বৃদ্ধি হয়, এরূপ স্থলে মিশনারীগণ যে নানা কল কৌশলে এ দেশীয়দিগকে খ্রীষ্টান করিবার চেষ্টা পাইবেন, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। এরূপে খ্রীষ্টানের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া খ্রীষ্টান সমাজের কি লাভ বা উপকার হয় তাহা আমরা বুঝিতে পারি না। ভগবানের যাহা ইচ্ছা তাহাই হইবে। যখন যে দেশে যাহা তিনি করিতেছেন, তখন তাহাই ঘটিতেছে, মনুষ্যের তাহাতে হাত নাই। এক সময়ে এ দেশে খ্রীষ্টান ধর্ম্মের খুব ধুয়া উঠিয়াছিল, অনেক লোক খ্রীষ্টান হইয়াছিল,—এক্ষণে সে ঢেউ একেবারে গিয়াছে,—এখন আর বড় কেহ খ্রীষ্টান হয় না। ভারতে প্রাচীন সনাতন আর্য-ধর্ম্মেরই প্রতাপ দিন দিন বাড়িতেছে, এমন কি ইয়োরোপ ও আমেরিকার অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি হিন্দুধর্ম্মের বিশিষ্ট আদর করিতেছেন। ইয়োরোপ ও আমেরিকা যে হিন্দুধর্ম্ম অবলম্বন করিবে, এ আশা করা যায় না। প্রকৃত পক্ষে হিন্দুগণ ইয়োরোপ বাসীগণকে হিন্দু করিতে চাহেন না। তাঁহারা নির্ব্বিবাদে তাঁহাদের নিজ ধর্ম্মে থাকিতে পারিলেই তাঁহার বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েন।

 যদিও খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম এদেশে আসিয়া আমাদিগের কথঞ্চিত ক্ষতি করিয়াছে, প্রকৃতপক্ষে সে ক্ষতি এত সামান্য যে তাহাকে ক্ষতি বলিয়া গণ্য না করাও যাইতে পারে। কিন্তু এ কথাও বলিতে হইবে যে, খৃষ্টান মিশনারীদিগের দ্বারা আমাদের বিশেষ উপকার সাধন হইয়াছে। তাঁহারাই এদেশে শিক্ষা বিস্তার করিয়াছেন, তাঁহারা এদেশে ঔষধি বিতরণ করিয়া সহস্র সহস্র লোকের প্রাণদান করিয়াছেন। শত সহস্র প্রকারে তাঁহারা এদেশের উন্নতির চেষ্টা পাইয়াছেন। ভারতবাসীগণ তাঁহাদিগের নিকট কৃতজ্ঞ না থাকিলে অকৃতজ্ঞতার পরাকাষ্ঠা প্রকাশ করা হ‌ইবে