শকুন্তলা (আদি ব্রাহ্মসমাজ সংস্করণ)/দুষ্মন্ত

উইকিসংকলন থেকে

দুষ্মন্ত।

 যে দেশে ঋষির তপোবন ছিল, সেই দেশের রাজার নাম ছিল—দুষ্মন্ত। সেকালে এতবড় রাজা কেউ ছিল না। তিনি পূব দেশের রাজা, পশ্চিম দেশের রাজা, উত্তর দেশের রাজা, দক্ষিণ দেশের রাজা, সব রাজার রাজা ছিলেন। সাত-সমুদ্র তের-নদী—সব তাঁ’র রাজ্য। পৃথিবীর এক রাজা—রাজা দুষ্মন্ত। তাঁ’ কত সৈন্য সামন্ত ছিল, হাতিশালে কত হাতি ছিল, ঘোড়াশালে কত ঘোড়া ছিল, গাড়ি খানায় কত সোনা রূপার রথ ছিল, রাজমহলে কত দাস দাসী ছিল; দেশ জুড়ে তাঁ’র সুনাম ছিল, ক্রোশ জুড়ে সোনার রাজপুরী ছিল, আর ব্রাহ্মণকুমার মাধব্য সেই রাজার প্রিয় সখা ছিল।

 যেদিন তপোবনে মল্লিকার ফুল ফুটল সেই দিন সাত-সমুদ্র তের-নদীর রাজা—রাজা দুষ্মন্ত, প্রিয়সখা মাধব্যকে বললেন—“চল বন্ধু, আজ মৃগয়ায় যাই।” মৃগয়ার নামে মাধব্যের যেন জ্বর এল। গরিব ব্রাহ্মণ রাজবাড়িতে রাজার হালে থাকে, দুবেলা থাল থাল লুচি মণ্ডা, ভার ভার ক্ষীর দই দিয়ে মোটা পেট ঠাণ্ডা রাখে, মৃগয়ার নামে বেচারার মুখ এতটুকু হ’য়ে গেল, বাঘ ভালুকের ভয়ে প্রাণ কেঁপে উঠল। ‘না’ বলবার যো কি, রাজার আজ্ঞা! অমনি হাতিশালে হাতি সাজল, ঘোড়াশালে ঘোড়া সাজল, কোমর বেঁধে পালোয়ান এল, বর্ষা হাতে শীকারী এল, ধনুক হাতে ব্যাধ এল, জাল ঘাড়ে জেলে এল। তারপর সারথী রাজার সোনার রথ নিয়ে এল, সিংহদ্বারে সোনার কপাট ঝন্‌ঝনা দিয়ে খুলে গেল।

 রাজা সোনার রথে শীকারে চল্লেন। দুপাশে দুই রাজহস্তি চামর ঢোলাতে চল্লো, ছত্রধর রাজছত্র ধরে চল্লো, জয়ঢাক বাজতে বাজতে চল্লো, আর সর্ব্বশেষে প্রিয়সখা মাধব্য এক খোঁড়া ঘোড়ায় হট্‌হট্‌ করে চল্লেন।

 ক্রমে রাজা এ-বন সে-বন ঘুরে শেষ মহাবনে এসে পড়লেন। গাছে গাছে ব্যাধ ফাঁদ পাততে লাগল, খালে বিলে জেলে জাল ফেলতে লাগল, সৈন্য সামন্ত বন ঘিরতে লাগল, বনে সাড়া পড়ে গেল।

 গাছে গাছে কত পাখী, কত পাখীর ছানা পাতার ফাঁকে ফাঁকে কচি পাতার মত ছোট ডানা নাড়ছিল, রাঙা ফলের মতো ডালে দুলছিল, আকাশে উড়ে যাচ্ছিল, কোটরে ফিরে আসছিল, কিচমিচ করছিল। ব্যাধের সারা পেয়ে, বাসা ফেলে কোটর ছেড়ে, কে কোথায় পালাতে লাগল। মোষ গরমের দিনে ভিজে কাদায় পড়ে ঠাণ্ডা হচ্ছিল, তাড়া পেয়ে—শিং উঁচিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে গহন বনে পালাতে লাগল। হাতি শুঁড়ে করে জল ছিটিয়ে গা ধুচ্ছিল, শালগাছে গা ঘষছিল, গাছের ডাল ঘুরিয়ে মশা তাড়াচ্ছিল, ভয় পেয়ে—শুঁড় তুলে, পদ্মবন দ’লে, ব্যাধের জাল ছিঁড়ে পালাতে আরম্ভ করলে। বনে বাঘ হাঁকার দিয়ে উঠল, পর্ব্বতে সিংহ গর্জ্জন করে উঠল,সারা বন কেঁপে উঠল।

 কত পাখী, কত বরা, কত বাঘ, কত ভালুক, কেউ জালে ধরা,পড়ল, কেউ ফাঁদে বাঁধা পড়ল, কেউ বা তলোয়ারে কাটা গেল; বনে হাহাকার, পড়ে গেল। বনের বাঘ বন দিয়ে, জলের কুমীর জল দিয়ে, আকাশের পাখী আকাশ ছেয়ে পালাতে আরম্ভ করলে।

 ফাঁদ নিয়ে ব্যাধ পাখীর সঙ্গে ছুটল, তীর নিয়ে বীর বাঘের সঙ্গে গেল, জাল ঘাড়ে জেলে মাছের সঙ্গে চল্লো, রাজা সোনার রথে এক হরিণের সঙ্গে ছুটলেন। হরিণ প্রাণভয়ে হাওয়ার মতো রথের আগে দৌড়েছে, সোনার রথ তা’র পাছে বিদ্যুতের বেগে চলেছে। রাজার সৈন্য সামন্ত, হাতি, ঘোড়া, প্রিয়সখা মাধব্য, কতদূরে কোথায় পড়ে রইল। কেবল রাজার রথ আর বনের হরিণ নদীর ধার দিয়ে, বনের ভিতর দিয়ে, মাঠের উপর দিয়ে ছুটে চল্লো।

 যখন গহন বনে এই শিকার চলছিল তখন সেই তপোবনে সকলে নির্ভয়ে ছিল। গাছের ডালে টীয়াপাখী লাল ঠোঁটে ধান খুঁটছিল, নদীর জলে মনের সুখে হাঁস ভাসছিল, কুশবনে পোষা হরিণ নির্ভয়ে খেলা করছিল; আর শকুন্তলা, অনসূয়া, প্রিয়ম্বদা—তিন সখী কুঞ্জবনে গুন্‌গুন্‌ গল্প করছিল।

 এই তপোবনে সকলে নির্ভয়, কেউ কারো হিংসা করে না। মহাযোগী কণ্বের তপোবনে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। হরিণ-শিশু ও সিংহ-শাবক এক বনে খেলা করে। এ বনে রাজাদেরও শিকার করা নিষেধ। রাজার শিকার—সেই হরিণ ঊর্দ্ধশ্বাসে এই তপোবনের ভিতর চলে গেল। রাজাও অমনি ধনুঃশর ফেলে ঋষিদর্শনে চল্লেন।

 সেই তপোবনে সোনার রথে পৃথিবীর রাজা, আর মাধবীকুঞ্জে রূপসী শকুন্তলা,—দুজনে দেখা হ’ল!

 এদিকে মাধব্য কী বিপদেই পড়েছে! আর সে পারে না! রাজভোগ নাহলে তা’র চলে না, নরম বিছানা ছাড়া ঘুম হয় না, পাল্‌কী ছাড়া সে এক পা চলে না, তা’র কি সারাদিন ঘোড়ার পিঠে চড়ে ‘ওই বরা যায়, ওই বাঘ পালায়’ করে এ-বন সে-বন ঘুরে বেড়ান পোষায়? পল্বলের পাতা-পচা কষা জলে কি তা’র তৃষ্ণা ভাঙ্গে? ঠিক সময় রাজভোগ না পেলে সে অন্ধকার দেখে, তা’র কি সারাদিনের পর একটু আধপোড়া মাংসে পেট ভরে? পাতার বিছানায় মশার কামড়ে তা’র কি ঘুম হয়? বনে এসে ব্রাহ্মণ মহা মুষ্কিলে পড়েছে! সমস্ত দিন ঘোড়ার পিঠে ফিরে সর্ব্বাঙ্গে দারুণ ব্যথা, মশার জ্বালায় রাত্রে নিদ্রা নেই, মনে সর্ব্বদা ভয়—ওই ভালুক এল, ওই বুঝি বাঘে ধরলে! ভয়ে ভয়ে বেচারা আধখানা হয়ে গেছে। রাজাকে কত বোঝাচ্ছে—“মহারাজ, রাজ্য ছারেখারে যায়, শরীর মাটী হ’ল, আর কেন? রাজ্যে চলুন।” রাজা তবু শুনলেন না, শকুন্তলাকে দেখে অবধি রাজকার্য্য ছেড়ে, মৃগয়া ছেড়ে, তপস্বীর মতো সেই তপোবনে রইলেন। রাজ্যে রাজার মা ব্রত করেছেন, রাজাকে ডেকে পাঠালেন, তবু রাজ্যে ফিরলেন না, কত ওজর আপত্তি করে মাধব্যকে সব সৈন্য সামন্ত সঙ্গে মা’র কাছে পাঠিয়ে দিয়ে একলা সেই তপোবনে রইলেন।

 মাধব্য রাজবাড়িতে মনের আনন্দে রাজার হালে আছে, আর এদিকে পৃথিবীর রাজা বনবাসীর মতো বনে বনে “হা শকুন্তলা যো শকুন্তলা!” ব’লে ফিরছে। হাতের ধনুক,তূণের বাণ কোন্‌ বনে পড়ে আছে! রাজবেশ নদীর জলে ভেসে গেছে, সোণার অঙ্গ কালি হোয়েছে। দেশের রাজা বনে ফিরছে!

 আর শকুন্তলা কী করছে?—নিকুঞ্জবনে পদ্মের বিছানায় বসে পদ্মপাতায় মহারাজাকে মনের কথা লিখছে। রাজাকে দেখে কে জানে তা’র মন কেমন হ’ল! একদণ্ড না দেখলে প্রাণ কাঁদে, চক্ষের জলে বুক ভেসে যায়। দুই সখী তা’কে পদ্মফুলে বাতাস করছে, গলা ধরে কত আদর করছে, আঁচলে চোখ মোছাচ্ছে, আর ভাবছে—এইবার ভোর হ’ল, বুঝি সখীর রাজা ফিরে এল।

 তারপর কি হ’ল?

 দুঃখের নিশি প্রভাত হ’ল, মাধবীর পাতায় পাতায় ফুল ফুটল, নিকুঞ্জের গাছে গাছে পাখী ডাকল, সখীদের পোষা হরিণ কাছে এল।

 আর কি হ’ল?—

 বনপথে রাজা-বর কুঞ্জে এল।

 আর কি হ’ল?

 পৃথিবীর রাজা আর বনের শকুন্তলা—দুজনে মালা বদল হ’ল। দুই সখীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হ’ল।

 তারপর কী হ’ল?—

 তারপর কতদিন পরে সোণার সাঁঝে সোণার রথ রাজাকে রাজ্যে নিয়ে গেল, আর আঁধার বনপথে দুই প্রিয়সখী শকুন্তলাকে ঘরে নিয়ে গেল।