শিক্ষানবিশের পদ্য/মৃত্যু

উইকিসংকলন থেকে

মৃত্যু।


 শমন কখন আসে, কখন যে ধরে,
কোথায় ধরিবে কবে,—কেহ তা জানে না।
এই দেখ বরকন্যা, নববিবাহিত,
কার্ত্তিকপুরুষ আর, সোণার প্রতিমা,
বাপ মার আদরের, যতনের ধন;
শ্বশুর শাশুড়ী সুখী হেরে নববধূ;
কতই উৎসব গৃহে কতই আনন্দ,
কে জানে কপাল কথা? সকলেই অন্ধ
এই দেখ বরকন্যা ফুলশয্যাগৃহে
শোয়ায়ে পালঙ্কে, গন্ধ-কুসুমআস্তরে
আনন্দে রমণীবৃন্দ হুলুধ্বনি করি
চলিলেন ভিন্ন গৃহে; সুষুপ্ত দম্পতি।
প্রভাতে ক্রন্দনরবে আবরিছে বিশ্ব,
শমনের সর্পাঘাতে মরিয়াছে ছেলে।
ফুলশয্যাগৃহ হতে বিধবা কন্যারে
ধরাধরি করি সবে করিল বাহির;
এখন ঘুমের ঘোর রহিয়াছে চক্ষে।

নবপতিসনে রাত্রিজাগরণে—
প্রভাতে ঘুমায়ে ছিল,
গৃহ মধ্যে গোল, রোদনের রোল,
কাল ঘুম ভেঙ্গে গেল,
নীলবর্ণ মরাপতি পাশেতে দেখিল;
"কি হলো গো” বলে বালা মূর্চ্ছিতা হইল—;
ধরাধরি করি সবে বাহির করিল।
কালিকার ঘটা কই? কই সে আনন্দ?
কে জানে কপাল কথা? সকলেই অন্ধ।

কত যে যন্ত্রণা সহে গর্ভিণী রমণী,
—উদরে সুখদ ভার—শরীর অবশ,
—খেয়ে বসে সুখ নাই—অন্নে নাহি রুচি,
—ভূমেতে অঞ্চল পাতি দেয় গড়াগড়ি,
এত যে যাতনা সহে কিসের লাগিয়া?
আশা তার কাণে কাণে দিয়াছে কি বলে,
ভুলিয়াছে সব দুখ গর্ভিণী কামিনী;
সন্তান করিয়া কোলে নাচাইবে তারে,

চাঁদ মুখে মা বলিবে আধ আধ রবে,
শুনিবে যখন আহা! কবে সেই দিন
হবে, জুড়াবে জীবন পুল্রবতী নারী?
দশ মাস দশ দিন। আসিল সময়,
অচিরাৎ পূর্ণ তার হইবে কামনা।
গর্ভযন্ত্রণায় নারী অস্থির জীবন,
চারি দিক ভ্রমে আর করে ছট্‌ফট্‌,
নাহি পারে তিষ্ঠিবারে এক স্থানে আর,
বিরস বিরল বিন্দু নয়ন ভাসায়,
কাণে কাণে আশা আসি তখনো কহিছে,
"হইল দুখের শেষ এই লো কামিনী"।
হইল দুখের শেষ না বাড়িল যে দুখ;
শরীর যন্ত্রণা শেষ, প্রসূত তনয়,
কুমার কুমার নব সোণার পুতুল,
নয়ন মুদিয়া ছিল নবীনা প্রসূতা
তাড়াতাড়ি কোলে করি লইল তনয়,
সোণার পুতুল কিন্তু দেহে নাই প্রাণ!
আশা যা বলিয়াছিল মিথ্যা হল সব,

না শুনিবে চাঁদ মুখে আধ মাম্মা রব।

 ঐ দেখ যুবক এক কেমন সুন্দর,
বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, বিশাল মানস,
অটল মানস তার, অচল বচন,
বিচারে পণ্ডিত অতি, আচারে পবিত্র,
সদা দেশ হিতে রত, সুচারু চরিত্র,
ন্যায় শাস্ত্রে অদ্বিতীয়, অথচ রসজ্ঞ,
সংস্কৃতের পারদর্শী, বিদেশী ভাষায়
উপাধি পাইয়া খ্যাত ভারত মণ্ডলে,
প্রাচীন গণিত পথ বহুশ্রম সাধ্য,
বলিয়া, দেখায় পথ অতীব নূতন,
হেন ছেলে পেয়ে, ধেয়ে গিয়ে, কোলে লয়ে,
চুম্বিয়া সে চাঁদ মুখ, সুখেতে বাড়ায়ে দুখ,
নীরবেতে বঙ্গ মাতা কাঁদিতে লাগিল;
চুম্বনে সুখ বা দুখ, রোদনে দুখ বা সুখ,
সেই মাতা সেই পুল্র সেকথা বুঝিল।
ভাবে যুবা মাতৃস্নেহে অভিভূত হয়ে,

"অনাথিনী জননীর করিব উদ্ধার,
পুল্র হয়ে কার্য্য আমি করিব মাতার,
দেখিবে সকল লোক বঙ্গের গৌরব,
ফুটিবে বঙ্গের ফুল ছুটিবে সৌরভ।”
অকস্মাৎ ভাবে যুবা "হায় একজনে
পারে নাকি করিবারে বঙ্গের উদ্ধার?”
বিষাদে ভাঙ্গিল সাধ জীবনে অসাধ;
দ্বাররুদ্ধ গৃহমধ্যে লম্বমান দেহ,
গলদেশে কাল পাশ বিস্কারিত চক্ষুঃ
কপালে উঠিয়া আছে, জিহ্বা বহির্গত।
কোথা কমনীয় যুবা কোথা দেখ এই
আত্মহার ভয়াত্মক উৎকট বিকট
লম্বমান দেহদণ্ড! কোথায় এখন
বঙ্গের উদ্ধার আর মাতৃমুখোজ্জল।
হায়রে অভাগী তুই দুর্দ্দশা দেখিয়া
পলাইল কোল ছাড়ি তোর যাদুধন!
নীরবেতে বঙ্গমাতা কাঁদিতে লাগিল;
বিরলে সরল গালে অশ্রুধারা দিল;

এবার সুখে বা দুখে সকলে বুঝিল।

 “এই দেখি প্রভাকরে ভুবন উজ্জ্বল করে,
ক্ষণেক বিলম্ব পরে সব তমো আচ্ছাদিত;"
পরে দেখি অকস্মাৎ হয় বৃষ্টি ঝঞ্ঝাবাত
ঝঞ্ঝণায় বজ্রপাত, পাপী অতি ভীতচিত।
পাতশার পুল্রসনে শুভবিবাহবন্ধনে
রাজপুত কন্যাদানে করিয়া স্বীকার,
যেমন নামিতেছিল, কড়ক্কড়ে থমকিল,
উজ্জল আঘাতে ভূমে দেহ গড়াইল।
শাজাদার শ্বশুর হওয়া হলনা এবার।
"আশ্চর্য্য জগতকার্য্য বাক্যমনো পথাতীত"
ভাবিয়া শমনভাব হয় পাপী ভীতচিত।

 নগরে উঠিল রব বাবুর মহলে,
দিল্লীর নর্ত্তকী এক আসিল সহরে,
যেন বিদ্যাধরী, নাম ধরিয়া “দরিয়া"
দরিয়ার মত যায় দেশ ভাসাইয়া।

শনিবারে দিনস্থির করি কুতূহলে
দরিয়ার মোয়াফেলে মাতিল সকলে;
আহা কি অপূর্ব্ব শোভা বাবুর বাগানে!
আমোদিছে নাসারন্ধ দেখ কোন স্থানে
পলান্ন, পিষ্টক, পূরী, পূপ, সূপ, পেটি,
কালিয়া, কোরমা, কোপ্তা, কাবুলি কাবাব;
বাক্সবন্দী বিলাতীয় বারুণী কোথায়;
কোথা বা ভৃত্যের দলে মৃদুমৃদু হাসিছে,
ঠাকুরের নিরঞ্জন দিবানিশি টাঁকিছে;
বাইজি ভেড়ুয়া হোথা পাশাপাশি বসিছে।
আসিল রজনী। নাচ আরম্ভ হইল;
সুন্দর বৈটকখানা বড় বড় ঝাড়
ঝুলিছে; জ্বলিছে বাতি; চৌদিকে শোভিছে
বিশাল দৰ্পণ চারু, তার প্রতিবিম্ব
উপহাসি দেখাইছে বাবুর সমাজে
সেই মত কত গুলি চিত্র নাট্যালয়।
গোলাপে বেড়িয়া জাঁতি, যূথিকা, মতিয়া,
সৌরভে পূরিয়া গৃহ করিছে বিরাজ।

আতর গোলাপ পাশ; অতি দীর্ঘ নল
ধরিয়া সুবর্ণ হুক্কা করিতেছে দম্ভ;
চলিছে দরিয়া মরি! দরিয়ার মত
চলিতেছে স্রোতঃ; আর ভাসিছে দুকূল;
উঠিছে তরঙ্গ মৃদু মধুর লহরী
বক্ষেতে আকাশ ভাব; তীরছায়া নীরে;
চলিতেছে কণ্ঠস্রোতঃ স্বৰ্গ মন্দাকিনী,
উঠিছে তরঙ্গ মৃদু মধুর লহরী;
স্বরেতে স্বৰ্গীয় ভাব; অনুরাগ রাগে।
প্রভাতা হইল বিভাবরী। কোথা বাবু?
হয়ে বিষণ্ণ বদন যত সব ভৃত্যগণ
বাহির করিল শব ধরাধরি করি!
রাত্রি জাগরণে, আর অমিত ভোজনে,
বারুণী সেবনে, মৃত বিসূচিকা রোগে।
পাণ্ডুর বরণ দেহ, চক্ষুঃ হায়! স্থির,
না দেখে লোচন নৃত্য সেই বাইজির।
কালিকার উৎসব কই? কই সে আনন্দ?
হায়! কেজানে কপাল কথা? সকলেই অন্ধ।