বিষয়বস্তুতে চলুন

সময় অসময় নিঃসময়/কী লিখি, কী লিখতে চাই

উইকিসংকলন থেকে

কী লিখি, কী লিখতে চাই

সময় যখন জহ্লাদ

গিলোটিন নির্মম উদাসীনতায় কাজ করে চলেছে। ধড় থেকে মুণ্ড আলাদা হয়ে পড়ছে, প্রকরণ থেকে অন্তর্বস্তু, বয়ান থেকে অন্বিষ্ট। কেউ বা ইচ্ছে মতো কুড়িয়ে নিচ্ছে মুণ্ড এবং যে-কোনও ধড়ে জুড়ে দিচেছ। তেমনি প্রকরণ এবং বয়ান যেন স্বয়ম্ভু; যে-কোনোভাবে তাদের প্রয়োগ করা চলে। দৈনন্দিন জীবনে মাটি ও আকাশের অনুপাত হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আঁধি-প্লাবন-ভূমিকম্প-হিমানি সম্প্রপাত ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সত্তার যথাপ্রাপ্ত আকরণগুলিকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছে। পাশাপাশি স্থপতি স্বয়ং আত্মস্থাপত্য ধ্বংসের নেশায় উন্মাদ, বিভোর। এখন কেন্দ্র নেই কোননা, পরিধিও নেই। যে-কোনো বিন্দুতে আরম্ভ হতে পারে, শেষ হতে পারে যেখানে-সেখানে। হনন-উৎসবে মত্ত পৃথিবী। অস্তিত্ব আর জ্ঞান কৃষ্ণবিবরের গ্রাসে; সমস্তই আপাত এখন, সব কিছু গোলকধাঁধা।

প্রতিবাস্তবের কুহক

কখনও মনে হয় বার্গম্যানের চিত্রনাট্যের ভেতরে ঢুকে পড়েছি, কখনও বা লুই বুনুয়েলের চিহ্নায়িত দৃশ্যকল্প কল্লোলিত হতে দেখি। জীবন-জগৎ-বাস্তব সম্পর্কে ধারণা ক্রমাগত রূপান্তরিত হয়ে গেছে এতদিন। জটিলতা ও গ্রন্থিলতা তৈরি হয়েছে। নিয়মমাফিক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ধারণার কাঠামোও চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে যাচ্ছে অকল্পনীয় দ্রুততায়। জগৎ মুছে যাচ্ছে প্রতিজগতের সন্ত্রাসে, জীবন ডুবে যাচ্ছে প্রতিজীবনের চোরাবালিতে, প্রতিবাস্তবের তীব্র আবর্ত গিলে খাচ্ছে বাস্তবকে। সভ্যতা প্রমাণিত হচ্ছে খোলস বলে, বর্বরতাই তার শাঁস। তাই সন্ত্রাসকে এখন হার মানতে দেখছি। আরও বড়ো সন্ত্রাসের কাছে। বিশ্ব একনীড় হচ্ছে মানবিকতার উত্তাপে নয়, প্রতাপের চরম উদ্ধত আগ্রাসনে। এখন কে আর বলে ধানসিঁড়ি নদীর কথা, কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। আমাদের লেখালেখি কি কুহকের কথকতা করবে এখন, যখন জীবনের পাঠকৃতি থেকে গলে-গলে পড়ছে পুঁজ-কফ-শ্লেষ্ম-পিত্ত মাখানো নিরাবেগ মেধা।

গভীর গভীরতর অসুখ এখন

আমরা বয়ে যাচ্ছি। দশকের পর দশক, শতকের পরে শতক ধরে। বয়ে যেতে-যেতে নিজেদের সময়ের সংরূপ নিজেরাই নির্মাণ করছি, পরিসরের সংজ্ঞা তৈরি করছি। সব কিছুর সম্মিলিত চাপ শুষে নিচ্ছে আমাদের লেখা। শুষে নিয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছে না তার হয়ে ওঠা, সম্ভাব্য কোনও মাত্রাবোধের প্রতি ইশারাও করছে। কিন্তু তবু কিছু কিছু অন্ধবিন্দু অবারিত হয়ে পড়ছে। আমরাই আমাদর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়ছি অহরহ। সুখের শরিক অসুখ, স্মৃতির শরিক বিস্মৃতি, গতির শরিক স্থিতি, মুক্তির শরিক রুদ্ধতা। কী ব্যক্তি-সত্তায়, কী সামূহিক সত্তায় কৃষ্ণবিবরের উপস্থিতি প্রকট হয়ে পড়ে তাই চূড়ান্ত উদ্ভাসনের মুহূর্তে। এই কূটাভাস আগেও ছিল; কিন্তু ইতিহাস-প্রত্যাখ্যানের আধুনিকোত্তর প্রবণতা সাম্প্রতিক কালে ওই কূটাভাসকে সমুৎপন্ন সর্বনাশের বার্তাবহ করে তুলেছে। বিমানবায়নের বিকট হিংস্র চেহারা বিশ শতকের শেষ দুটি দশকে উত্তরোত্তর নির্বাধ হতে দেখেছি। তবে ইদানীংকার নির্মানবায়ন প্রক্রিয়া ধূসরতম নেতির আকারগ্রাসী পরিণাম-গ্রাসী উপলব্ধিকে যেভাবে সক্রিয় করে তুলছে, তাতে সভ্যতা-সংস্কৃতি-লিখনবিশ্ব জুড়ে ব্যাপ্ত নিশ্চিহ্নায়নই সর্বেসর্বা। কী লিখব এখন, কেন লিখব, কার জন্যেই বা লিখব।

চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ

লেখা ঘটে যায়, হয়ে যায়। তবু। সময়ের চক্রকে ক্লান্ত বিধুর বিপর্যস্ত হয়েও লেখা ‘ঘটনা’ হতে পারে। এখনও। কেননা, মালার্মে কবিতার ঘটনাস্থল হিসেবে যা উল্লেখ করেছিলেন, তা তো এখনও সত্য- “On the empty paper protected by its whiteness' (Sur le vide papier que sa blancheur defend)। লিখিত শব্দাবলী জন্ম নেয়, ঘটে যায়। শূন্য সাদা কাগজের সুরক্ষিত পরিসরে কালো-কালো আখরেরা ফুটে ওঠে, ভরিয়ে দেয় তৃপ্ত ও অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার চিহ্নায়কে। মীমাংসা নয়, জিজ্ঞাসা জেগে থাকে। আরও আরও চিন্তাবীজ ছড়িয়ে দিয়ে। বাচনের আলো নয় কেবল, ছায়া আর অন্ধকার প্রসারিত হয় ক্রমশ। তবু কিছুই শেষ কথা হয় না, হতে পারে না। বহু অতৃপ্তিকে পেছনে রেখে সম্ভাব্য তৃপ্তির দিকে এগিয়ে যায় লেখা, এই মাত্র। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, এই অনুভবের ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে তেরো শতকের ইতালীয় কবি গুইদো কাভালকান্তি যেন সহযাত্রী। তার একটি সনেটের প্রারম্ভিক দুটি পঙক্তি এরকম:

“We are the sad, dismayed pens,
the Scissors and the sorrowing knife"!

কলমের বিষণ্ণতা আর বিবিক্ততা তবে কি চিরকালীন? পর্বে-পর্বান্তরে পটভূমির বদল ঘটে শুধু!

লেখার সত্য, লেখার অবভাস

একুশ শতকে পা রাখার আগেই চারদিক থেকে ধেয়ে এসেছিল ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির বার্তা। কী ধরনের বাস্তব বলব একে? প্রতীত নাকি ধারণাগত নাকি প্রতিভাসিত! যা-ই বলি, বহু শতক ধরে নিঃসপত্ন ও তর্কাতীত বাস্তব এখন অভূতপূর্ব প্রত্যাহ্বানের মুখোমুখি। কতভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেখতে পাব, এ বিষয়ে জল্পনা না-করেও এইটুকু নিশ্চয় বলা যায় যে আমাদের লিখনবিশ্ব আগের মতো থাকবে না আর। বাস্তব’ শব্দটি নিছক পরিস্থিতির দ্যোতক নয়; বহুমুখী তাৎপর্যের বিচ্ছুরণকেন্দ্র হিসেবে তা অজস্র উৎস ও পরিণতির সংসোজকও বটে। প্রতিভাসিত বাস্তবতার কথা বলি যখন, ইতিহাস-ভূগোল-দর্শন-সমাজতত্ত্ব প্রসূত যাবতীয় প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ তাসের প্রাসাদের মতো ধ্বসে পড়তে থাকে। এমন কী, সময় আর পরিসরের মতো সর্বজনমান্য চিন্তাবীজও অধিসময় আর অধিপরিসরের ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। এতদিন যাদের সত্যভ্রম কিংবা অবভাস ভেবেছি এবং সত্য থেকে তাদের পার্থক্য-প্রতীতি বহু অধ্যবসায়ে গড়ে তুলেছি—সেই সবই কি অবান্তর হয়ে যাবে এখন? এখনকার লেখার টানা ও পোড়েন কীভাবে নির্ণীত হবে তবে! কবিতা-উপন্যাস-ছোটগল্প দেড়শতকে যতটা পাল্টে গেছে, তাতে মনে হয়, আগামী দিনগুলিতে পরিবর্তন শব্দটা হয়তো প্রতিভাসিত বাস্তবতার সর্বাত্মক আক্রমণের বহর বোঝাতে ব্যর্থ হবে। লেখায় অবভাসের প্রাধান্য যদি সত্যকে সিংহাসনচ্যুত করে, পাঠকৃতিতে বা বয়ানে পাঠক-সাপেক্ষতার পর্যায় কি শেষ হচ্ছে? পুরনো অর্থে লেখক-সাপেক্ষতা ফিরে আসবে না হয়তো, সূত্রধার-সত্তার উপর প্রতিভাসিত আলো নিক্ষিপ্ত হবে আবার।

সময়ের বুক থেকে কারা দ্রাক্ষামোচন করে রোজ

বয়ানের মৃত্যু হল, বয়ান দীর্ঘজীবী হোক: এ তো প্রতিমুহূর্তের নিরুচ্চার উচ্চারণ। যে-অভিজ্ঞতা এইমাত্র ব্যক্ত হল, তা তো হুবহু পুনরাবৃত্ত হবে না। প্রতিটি পরিস্থিতি অনন্য, অস্তিত্বের অভিজ্ঞানও অদ্বিতীয়। তাই প্রতিটি মুহূর্তে বাচন মুছে যাচ্ছে, নতুন আদলে ফিরে আসছে আবার। সময়ের মহাফেজখানায় জমা পড়ছে কত অনুপুঙ্খ; গভীর মনঃ-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাদের প্রায়োগিক সামর্থ্য বদলে যাচ্ছে। স্বর থেকে স্বরান্তরে পৌছাতে সত্তার আস্তিক্য ও নাস্তিক্য নিঙড়ে নিয়ে নিজেরই প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন মাত্রা ব্যক্ত করে চলেছে সময়। যে-উৎস থেকেই উৎসারিত হোক উচ্চারণ, অতিবাহিত পথ ও পাথেয়কে মুছে না নিলে নতুন পাঠকৃতির আবির্ভাব ঘঘাষিত হয় না। যে-পরিসরে লিখনবিশ্ব জন্ম নেয়, তা নিরপেক্ষ বিষয় এবং বিষয়ীর কাছে। পাঠকৃতির জন্ম হওয়ার পরেই কেবল আমাদের ব্যাখ্যা-ভাষ্য-টিপ্পনি তাকে কোনও-না কোনও ধারণার ছাঁচ অনুযায়ী বুঝতে চায়। কিন্তু এই সবই সাধারণ সত্য। স্বয়ং সময় যখন ইন্ধন, বহু সহস্রাব্দের ধারাবাহিকতায় গ্রথিত সভ্যতা ও সংস্কৃতি যখন অভাবনীয় অগ্ন্যুৎপাতে বিদীর্ণ-কোন লেখায় ফুটে উঠবে আমাদের হাহাকার ও বিহ্বলতা, ধ্বংস-গগাধূলির মদির আত্মবিস্মৃতি ও নিমজ্জমান সত্তার আর্তি? প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকতার পথে নয়, একথা নিশ্চয়তার সঙ্গেই বলা যেতে পারে। আজকের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আগামীকালের বয়ান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা করা হয়তো সম্ভব নয়; কিন্তু আরও নতুন নতুন চিহ্নের দাপট সম্পর্কে পূর্বানুমান বোধহয় করা চলে। নিশ্চয় ভাবতে পারি যে লেখার পরিসর হবে আরও বহুমাত্রিক ও অনেকান্তিক। এই পৃথিবীতে যখন কিছুই মৌলিক নয়, অজস্র স্বরের পারস্পরিক সংঘর্ষ ও সংশ্লেষণ যুগপৎ সত্য। পাঠকৃতিতেও একাধিক কেন্দ্রের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। উপস্থিতি আর অনুপস্থিতির দ্বিরালাপ উত্তরোত্তর অবারিত হয়ে উঠবে আগামীকালের বয়ানে।

লেখা আমাদের যুদ্ধক্ষেত্র

লেখা যুদ্ধ, লেখা যুদ্ধক্ষেত্র, লেখা জয়, লেখা পরাজয় এবং লেখাই রণকৌশল। বহুত্ব তার স্বভাবে, তার নিরন্তর পরিচর্যায়। অন্তর্ভুবনের ক্রমিক উদ্ভাসনে, বহির্জগতের নানা গ্রন্থনায়। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে লেখায়, লেখার ভিতর দিয়েই দেখতে হবে ভুবনখানি। বুঝতে হবে সময়কে, জানতে হবে পরিসরকে। লেখার গভীরে নেই কোনও দুষ্প্রবেশ্য রহস্য, নেই আধিপত্যবাদী চূড়ান্ততা, নেই নিষ্ক্রিয় রুদ্ধতা। যুক্তি-বিধি-বিজ্ঞান ঈশ্বর: কোনও কিছুই পাঠকৃতিকে স্থির বিষয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। লেখার শক্তি ও লাবণ্য তার উৎসে নেই। রয়েছে পথ থেকে পথান্তর সৃজনে। এখানেই তার মুক্তি, এখানেই তার সার্থকতা। গ্রন্থনার প্রতিটি অনুপুখে আভাসিত কোনো-একটি বৈশ্বিক দ্যোতনার তাই ভাষ্য করব না শুধু, গ্রন্থিমোচন করব। প্রতিটি বিন্দুতে প্রতিটি স্তরে আবিষ্কার করব, অন্তরালে কিছুই প্রচ্ছন্ন নেই। আমাদের মেধাবী আবেগ তীক্ষ্ণ বল্লমের মতো লেখার পরিসরকে এফোঁড় ওফোঁড় করে যাবে। কোথাও কোনও পূর্বানুমিত অর্থ তাতে প্রতিবন্ধক হতে পারবে না। সমগ্রতা যখন প্রত্যাহ্বানের মুখোমুখি, তাৎপর্যের একক ও সামূহিক বাচনের দ্বিবাচনিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাই লেখার ধর্ম। সর্বব্যাপ্ত ভাঙনের কালবেলায় এই আমাদের দ্রোহ, এই আমাদের প্রতিবাদ। এই আমাদের অঙ্গীকার। লেখা চলছে। লেখা চলবে।