সময় অসময় নিঃসময়/প্রান্তিক বাঙালির বিহ্বল বয়ান

উইকিসংকলন থেকে

প্রান্তিক বাঙালির বিহ্বল বয়ান

 না, কোনও ধরনের নাটকীয়তা তৈরি করার জন্যে এমন শিরোনাম দিইনি। কিংবা ‘আমাকে দেখুন’ বলে নাকিকান্না জুড়ে দেওয়ার ইচ্ছেও নেই। বিশ শতকের শেষ কয়েকটি দশকে এত বেশি সংশয় ও আঁধি তৈরি হয়েছে যে বিহ্বলতাও উপযুক্ত শব্দ নয়। কৃষ্ণবিবর এখন আগ্রাসী জীবনের প্রতিটি স্তরে। যন্ত্র-প্রযুক্তির অতিবিজ্ঞাপিত উদ্ভাসন, বিশ্বায়নের তুমুল কোলাহল, আত্মবিস্মৃতির উৎকট মাদক আমাদের শেকড় উপড়ে ফেলছে অহরহ। চৈতন্যে মড়ক এখন; ভ্রুক্ষেপ কিছুতেই নেই কারও। চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো বহুদিনকার বিশ্বাস ভেঙে পড়তে থাকলেও গণ্ডারের চামড়ায় আঁচড়টি পর্যন্ত পড়ে না। জ্ঞানী কুচক্রীদের ভিড়ে হারিয়ে গিয়ে প্রলাপ বকলেও কোনও অস্বস্তি হয় না। অন্তর্ঘাতকের ছুরির আস্ফালন দেখতে দেখতে এখন আর ডি এক্স বিস্ফোরণ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তবু সেই পুরনো পি পু ফি শু নীতি আঁকড়ে রয়েছি। মেনে নিচ্ছি মূখের প্রগলভ ঔদ্ধত্য; এমন কি আমাদের মাথার উপরের ছাউনি আর পায়ের নিচের জমি কেড়ে নিতে চাইলেও কোনও আপত্তি করছি না কেউ।

 একুশ শতকের প্রথম দশকও শেষ হতে চলেছে। বিশ শতক ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দ নিয়ে পণ্ডিতেরা অনেক কথাই লিখেছেন, বলেছেন। কিন্তু এক হাজার বছরের সাংস্কৃতিক অর্জন জাতিসত্তার অভিজ্ঞান যে নিতান্ত অবহেলায়, মাত্র কয়েক দশকের আত্মঘাতী অবিমৃষ্যকারিতায়, ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি: এ বিষয়ে তেমন কোনও সচেতনতাই দেখলাম না। বিশ শতকে পৃথিবীর অন্যত্র কিন্তু ইতিহাসের ভ্রান্তি সংশোধিত হতে দেখেছি। বহুধাবিচ্ছিন্ন যাযাবর ইহুদিরা নিজেদের রাষ্ট্র পেয়েছে; অতলান্ত বিস্মৃতি থেকে তুলে এনে মৃতপ্রায় ভাষার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে। দ্বিধাবিভক্ত জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় সীমানা পুনর্নির্ধারিত হয়েছে; ঔপনিবেশিক চক্রান্ত মোকাবিলা করে ভিয়েতনাম বিভাজনকে অস্বীকার করেছে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মরীচিকায় বিভ্রান্ত বাঙালি আর হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্বের চক্রব্যুহ থেকে বেরোতে পারল না। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট আর্যাবর্ত-কেন্দ্রিক ভারতীয় রাজনীতি বাংলাকে দেশবিভাজনের হাঁড়িকাঠে বলি দিয়েছে। বঙ্গভঙ্গ-মন্বন্তর-দাঙ্গা পেরিয়ে-আসা বাঙালি বুঝতেই পারেনি, কী চিরস্থায়ী সর্বনাশের বন্দোবস্ত করছে আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক সমাজ। ভারত ভেঙে পাকিস্তান হল, লক্ষ লক্ষ বাঙালি কয়েক পুরুষের ভিটেমাটি ও ঐতিহ্য থেকে উৎখাত হয়ে অর্জন করল ‘উদ্বাস্তু’ বিশেষণ।

 কোথায় গেল সেইসব বাস্তুহীন জনতা? আসামে-মেঘালয়ে-ত্রিপুরায়-পশ্চিমবঙ্গে। বাষট্টি বছর পরেও এঁরা ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক পরিসরে জলবিভাজনরেখা ডিঙিয়ে যেতে পারেননি। স্থানীয় ও বহিরাগত—এই দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচিত্র দ্বন্দ্বের ইতিবৃত্ত এখনও তেমন করে বিশ্লেষিত হয়নি। যদি হয় কখনও, দেখা যাবে, স্থানীয় মানুষ যেখানে বাংলা ভাষায়, কিংবা কোনও উপভাষায় কথা বলেন—সেইসব ক্ষেত্রেও বিড়ম্বনার শেষ নেই বাস্তুহীন মানুষের জন্যে। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিনিময়ের বদলে অদ্ভুত প্রতিরোধের মোকাবিলায় শক্তি ক্ষয় করতে হয়েছে তাঁদের। দীর্ঘ সংগ্রাম ও অধ্যবসায়ের পরে যখন এঁরা নতুন বসতি করেছেন, তখনও ‘উদ্বাস্তু, ইংরেজি-নবিশ বাচনে ‘রিফুজি’, বিশেষণ গায়ে লেগে রয়েছে ডাকটিকিটের মতো। এঁদের জন্যে বরাদ্দ হয়েছে শ্লেয-বিদ্রপ-তাচ্ছিল্য-অবহেলা-অপমান। আমরা এবং ‘ওরা’র বেড়া পাকাপোক্ত হয়েছে প্রতিটি নির্বাচনে। ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে এদের লোক-দেখানো কদর এবং সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে। সামাজিক সমস্যা অবধারিত ভাবে রূপান্তরিত হয়েছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যায়। দেশবিভাজন খ্রিস্টিয়দের আদি-পাপ এর মতো ছায়া ফেলে এখনও। কোনও দিন কিন্তু কেউ প্রশ্ন করেনি, বাঙালি হয়েও বঙ্গভূমির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ থেকে কেন তাদের চলে আসতে হয়েছিল: সাধ করে কি কয়েক পুরুষের অর্জন ও অভ্যাস থেকে সরে এসেছিলেন তারা!

 কিন্তু যেখানে অন্যভাষার মানুষেরা রয়েছেন, সেখানে অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর, আরও বেদনাময়। আসামে বারবার বঙ্গালখেদা আন্দোলন হয়, নামটাই শুধু আলাদা। কতবার যে ঘর পুড়েছে আশ্রয়সন্ধানী বাঙালির, কতবার যে উদ্বাস্তু হয়েছেন তারা—এর কোনও ইয়ত্তা নেই। অপরাধ একটাই: এঁদের মাতৃভাষা বাংলা। কিছু কিছু পণ্ডিত গবেষক নিরাপদ ছোঁয়া-বাঁচানো দূরত্ব থেকে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞজনোচিত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে গর্বোদ্ধত বাঙালির দখলদারি মনোভঙ্গিতে উত্যক্ত হয়েই নাকি বঙ্গালখোর মতো ‘স্বাভাবিক’ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এইসব বিজ্ঞজন অবশ্য এই খবর রাখার প্রয়োজনও বোধ করেন না যে গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং মাতৃভাষায় পড়াশোনা করার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে গিয়ে শান্তিরক্ষক পুলিশের গুলিতে আসামের শিলচর শহরে শহিদ হয়েছিল কেউ কেউ। ১৯৬১ সালের ১৯ মে এগারো জন শহিদদের কথা পশ্চিমবঙ্গের সচেতন মানুষেরা জানতেন না এই সেদিন পর্যন্ত। গত চার-পাঁচ বছর ধরে এই দিনটি উদ্যাপন করছেন কেউ কেউ। তার আগে পর্যন্ত ‘ভাষাশহিদ দিবস’ বলতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বুঝতেন শুধু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে। আসামে যে বিপুল সংখ্যক বাঙালি থাকেন, কলকাতা-কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত এর হদিশ জানতেন না।

 আমাদের বাংলা ভাষা যে শুধুই মান্য চলিত নয়, এ ভাষায় রয়েছে অজস্র লোকায়ত বিভঙ্গ—প্রকৃতপক্ষে বঙ্গভাষী মানুষজনের বসতভূমিতে, জেলায় জেলায় মহকুমায় মহকুমায় ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে যায় বলে উপভাষা-বিভাষার সমৃদ্ধি অতুলনীয়—এখবর রাখেন না পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গেই বীরভূম-পুরুলিয়া-মুর্শিদাবাদ-মালদহ-কোচবিহারে কত না উপভাষার লাবণ্য-বিহার! আসামে-ত্রিপুরায় এবং অবশ্যই বাংলাদেশের জেলায়-উপজেলায় বাঙালির ভাষা-উপভাষা-বিভাষার সমৃদ্ধি পৃথিবীর ভাষাভুবনে বাংলাকে অনন্য করে তুলেছে। কিন্তু কলকাতা-কেন্দ্রিক কিছু বাঙালির কাছে মান্য চলিতের বাইরে সব কিছুই দূরবর্তী ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য অপর।‘ওরা’ ব্রাত্য, ওদের উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্য করা চলে। এমন কী, ‘ওদের’ অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও ক্ষতি নেই কিছু।

 এই বিমূঢ়তার একটা অভিব্যক্তি দেখেছি অতি সম্প্রতি। বাংলা ভাষার স্বয়ম্ভু অভিভাবক হিসেবে উদ্ভূত একটি বৌদ্ধিক গোষ্ঠী ফতোয়া জারি করেছেন, বহির্বঙ্গে যত বাঙালি আছেন তারা সেইসব রাজ্যের সরকারি ভাষায় নিজেদের নিঃশেষে মিলিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান। রবীন্দ্রনাথ কি এ ধরনের মনোভঙ্গিকে ‘অজগর সাপের ঐক্যনীতি’ বলেছিলেন? আসামে অসমীয়া সম্প্রসারণবাদ, বিহারে ও উত্তরপ্রদেশে হিন্দু ফ্যাসিবাদ, ত্রিপুরায় উগ্র আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ এবং পশ্চিমবঙ্গে আর্যাবর্তের ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেই বুঝি জাতীয় সংহতির চরম হবে? বাংলা ভাষা ও বাঙালি নিয়ে কথা বলার কোনও নৈতিক অধিকার এদের কাছে। আছে কি? নেই, কারণ এদের জন্যেই বাঙালির পরিসর ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। স্বেচ্ছায়, সানন্দে নিজেদের ঘাড় এঁরা এগিয়ে দিচ্ছেন গিলোটিনের দিকে। অবশ্যই সেই গিলোটিন চালানোর দায়িত্ব তাদের হাতে রয়েছে, ইতিহাসে যারা অজস্র অসংখ্যবার বাঙালিত্বের পরিসরকে খর্ব করে এসেছে। কিছুদিন আগে বিখ্যাত-এক সাহিত্যপত্রে নামজাদা এক প্রাবন্ধিকের পিলে-চমকানো রচনা পড়লাম। তার মতে, রাষ্ট্র বা রাজ্যের সীমা তো কিছুদিন পর-পর বদলে যেতেই পারে। আবারও যদি পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র পাল্টে যায়, মহাভারত এমন কী আর অশুদ্ধ হবে! বলিহারি! নিজের হাত দিয়ে নিজেরই নাক-কান কাটতে এত দক্ষতা বাঙালি ছাড়া আর কার থাকবে। এই যুক্তিতে গোখাল্যাণ্ড হোক, ঝাড়খণ্ড হোক, গৌড় হোক, মল্লরাজ্য হোক, পশ্চিমবঙ্গ বলে কিছুই থাকুক, ক্ষতি কী? বুদ্ধিজীবীদের চুলচেরা বয়ান বিশ্লেষণ, মেধাবী বিষাদ ও উল্লাস একই রকম থাকবে। মিথিলা পুড়ে গেলেও আমার কিছুই পুড়বে না’-রাজা জনকের এই উচ্চারণে বৈদান্তিক মায়াবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইদানীং বঙ্গজ পণ্ডিতকুলের বদান্যতায় নব্যমায়াবাদের বাড়বাড়ন্ত দেখছি। এঁদের আরেকটি সর্বজনীন প্রবণতা হল, নিজের চিন্তাকে অকাট্য মনে করা এবং অন্যদের সম্পর্কে সন্দিগ্ধ ও উদাসীন থাকা; চরম বিচ্ছিন্ন গজদন্তমিনারে বসে এঁরা ভাবনার অপরতার প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখিয়ে অন্য সমস্ত অবস্থানকে অনবরত তিক্ত আক্রমণ করে যান।

 আত্মহননে মাতোয়ারা ও চূড়ান্ত একদেশদর্শী এইসব বুদ্ধিজীবীরা যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির যুক্তি দেখান, তারা কি ইতিহাস ও ভূগোলের সব অনুপুঙ্খ লক্ষ করেন কিংবা একই যুক্তি পশ্চিমবঙ্গ বহির্ভূত বাঙালির ক্ষেত্রেও (আসাম-ত্রিপুরা) প্রয়োগ করেন? বোধহয় না। গোর্খাল্যাণ্ডের সীমানা সমভূমি পর্যন্ত যাতে প্রসারিত হতে পারে, সেই লক্ষ্যে অত্যন্ত প্রণালীবদ্ধ ভাবে নতুন বসতি তৈরি করা হয়েছিল। এ বড় বিপজ্জনক চতুরতা যার শেষ কোথায় তা বলা কঠিন। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা সংস্কৃতির সত্যকে আচ্ছন্ন করে বলেই তো সংকট ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে যা ছিল মূলত বৌদ্ধিক বিচারের বিষয়, উপভাষাতত্ত্ববিদ ভাষা-বিজ্ঞানীর গভীর বিশ্লেষণে যার সমাধান হতে পারত-জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুটিল চক্রান্তে তা-ই পর্যবসিত হল বাংলার অঙ্গচ্ছেদ ঘটানোর দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায়। নিজবাসভূমে পরবাসী হওয়ার তীব্র গ্লানিময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাদের কোনওদিন যেতে হয়নি, তারাই ইদানীং আগুন নিয়ে খেলছেন। বুঝতে পারছেন না যে, এতে অচিরেই নিজের নাক-কান খোয়াতে হতে পারে এবং পরিণামে আবহমান বাংলার যাত্রাভঙ্গও ঘটে যাবে। কোনও সন্দেহ নেই যে বিশ শতকে ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিগত ভাবে নিজেদের জন্যে দুরূহতম সংকটের বলয় রচনা করেছে। সেদিকে নজর দিয়ে আমরা নতুনভাবে সামূহিক পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারতাম। আমাদের স্বাতন্ত্র ও অনন্যতার কারণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে প্রচ্ছন্ন রয়েছে। সেইসব অনুশীলনের প্রয়োজন ছিল খুব। কিন্তু তা আমরা করছি না। ঔপনিবেশিক চক্রান্তে বাংলার রাষ্ট্র-সীমা হতে নির্বাসিত শ্রীভূমির সংলগ্ন বরাক উপত্যকার অধিবাসী হিসেবে কোনও কোনও বাঙালি রয়েছেন বিচিত্র অবস্থানে। যেন ‘ঘরেও নহে পারেও নহে যে জন আছে মাঝখানে জাতীয় পরিসরে থাকার ফলে ঔপভাষিক অঞ্চলের অধিবাসীদের বারবার নিজেদের অনস্বীকার্য বাঙালিত্ব সম্পর্কে প্রমাণ দাখিল করতে হয়। শুধু অসহিষ্ণু ও পীড়নপ্রবণ সরকারের কাছে নয়, নিজের মাতৃভাষার অন্য শরিকদের কাছেও। এই গ্লানির অসহনীয়তা মান্য চলিত-ভাষী সংস্কৃতি-কেন্দ্র সংলগ্ন জনেরা কোনও দিন বুঝতে চান না। তবু এটাও মূল সমস্যার তুলনায় গৌন। বরং যে-তীব্র সংকট বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎকেই বড় প্রশ্ন-চিহ্নের মুখখামুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সে-বিষয়ে এখনই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। খণ্ডিত হোক বা সীমাবদ্ধ, উনিশ শতকে বাঙালি জীবনে যে রেনেসাঁস এসেছিল আর সেই সূত্রে দেখা গিয়েছিল দীপায়ন ও যুক্তিবাদ, শতাব্দীর শেষ দুটি দশকে সেইসব স্তিমিত হয়ে প্রকট হয়ে উঠেছিল হিন্দু পুনরুত্থানবাদ। বিশ শতকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নানা ধরনের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি সহস্র ধারায় বিকশিত হল ঠিকই; কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের পটভূমিও দৃঢ়তর হল। এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় প্রতীচ্যের শিক্ষা-ব্যবস্থায় ও মূল্যবোধে দীক্ষিত বাঙালি লেখাপড়া করেও কেবল হিন্দু বাঙালি বা মুসলমান বাঙালি হল। শুধু বাঙালি’ পরিচয়ে দাড়ানোর জন্যে যে ধর্ম-নিরপেক্ষ চেতনাকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে কর্ষণ করা দরকার ছিল, তা করা হল না। বীভৎস দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করে বাঙালি নিজের মাতৃভূমিকে দ্বিখণ্ডিত হতে দিল এবং হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্বকে বরণ করে নিল। ১৯৫২ সালে কেউ কেউ ভুল শোধরানোর পালা শুরু করলেন যা ১৯৭১-এ যৌক্তিক পূর্ণতা পেল। কিন্তু মৌলবাদের শেকড় না উপড়ানোর ফলে বাঙালিত্ব-বিরোধী অপশক্তি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠল। বিশ শতক পেরিয়ে যখন একুশ শতকে এলাম, দেখা গেল, পূর্বপাকিস্তানের বা তার থেকে জন্ম-নেওয়া বাংলাদেশে ইতিহাস যেন উল্টোপাকে ঘুরতে শুরু করেছে।

 ভুল ইতিহাস যখন রচিত হতে থাকে, সমাজ-প্রযুক্তির বিধি অনুযায়ী তাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ হয়ে নব্বই এর দশকে পৌছাতে পৌছাতে সংস্কৃতি-সেনানী ও বুদ্ধিজীবীরা বারবার তেমন হস্তক্ষেপ করেছেন। ইতিহাসের বিপ্রতীপ গতি তারা মেনে নেননি। কিন্তু অতি সম্প্রতিকালে সমাজ-সংবিদ থেকে উঠে-আসা কোনও ইতিবাচক সামূহিক প্রতিক্রিয়া যেন দেখা যাচ্ছে না। সময়-মন্থনের প্রক্রিয়াও কি স্তব্ধ হয়ে গেল তবে? বিশ্বব্যাপ্ত মৌলবাদ যে এককেন্দ্রিক নয়া উপনিবেশবাদের প্রশ্রয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বাঙালিত্ব কি বাংলাদেশে তার কাছে। সাময়িকভাবে হলেও হার মেনেছে? এ তো গেল বাংলা ভাষাভাষীদের একটা বড় তরফের সংকট। অন্য বড় তরফের সমস্যা তৈরি হয়েছে এইজন্যে যে তাদের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক বীক্ষায় নিঃশব্দে একটা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটে গেছে। বিনা প্রশ্নে সর্বজনীন মান্যতা পেয়ে গেছে সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কিত এই পরাপাঠ যে তা মূলত হিন্দু বাঙালির সাহিত্য। এইজন্যে ইউসুফ জুলেখাই হোক বা মীর মশারফ হোসেন ও কায়কোবাদ কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—পশ্চিমবঙ্গে রচিত সাহিত্যের ইতিহাসে এদের জন্যে বরাদ্দ হয় নামমাত্র পরিসর। আসলে সচেতনভাবে বাঙালিকে খুঁজলেও অবচেতন ভাবে হিন্দু বাঙালি কিম্বা মুসলমান বাঙালিদের খোঁজা হয়। সত্যি কথা বলতে কী, খোঁজা হয় শুধু মুসলমান কেননা মুসলমান ও বাঙালি—এই দুটি শব্দকে পাশাপাশি ব্যবহার করার রেওয়াজ এই সেদিন পর্যন্ত ছিল না। নইলে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র কি লিখতেন বাঙালিদের সঙ্গে মুসলমানদের ফুটবল খেলার কথা?

 মুশকিল এখানেই যে বাঙালি তার নিজস্ব সমৃদ্ধ লোকায়ত ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিতে শেখেনি। শিষ্টজনদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে লোকজীবন তো কৃষ্ণ মহাদেশ! এত বিশাল-সমান্তরাল পরিসর সম্পর্কে নামমাত্র কৌতূহল ছিল বলে সৃষ্টি ও নির্মিতিতে এক ধরনের কূপমণ্ডুকতা ও একবাচনিকতা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। অথচ সেখানেই ছিল হিন্দু-মুসলমানদের পক্ষে নির্দ্বিধায় পরস্পরের শরিক হওয়ার সুযোগ। শেকড়ে জলের সহযোগ ছিল না বলেই হয়তো মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিপূরণের তাগিদে কল্পিত আকাশের কৃত্রিম নির্মাণ দেখা গেল। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার মোহে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্বর্তী সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রতি মনোযোগী হলেন না কেউ। হিন্দু বাঙালি আর্য-মহিমায় নিষ্ণাত হয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইল; রাজপুত ও মারাঠা বীরদের গৌরব-কাহিনি প্রচার করে সমকালীন গ্লানি থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নিল। ফলে বাঙালিত্ব নয়, হিন্দুত্ব হল তার স্বাজাত্যবোধের ভিত্তি। স্বভাবত নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে যারা নিকট আত্মীয়, সেই মুসলমানদের ভাবতে শিখল বিজাতীয় শত্রু বলে। অন্যদিকে মুসলমান বাঙালি যে কয়েক পুরুষ আগে বর্ণাশ্রম প্রথার পীড়নে কিংবা রাজধর্ম গ্রহণ করে বৈষয়িক সমৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থে ধর্মান্তরিত হয়েছে—এই তথ্য ভুলে গিয়ে সুদূর অতীতের মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে মিথ্যা আত্মীয়তা গড়ে তুলতে চাইল। আরবি ও পারসিক কাহিনির ছায়ায় খুঁজে নিতে চাইল। মানসিক আশ্রয়। সাহিত্যের নির্মিতি আর জীবনের যথাপ্রাপ্ত বাস্তব হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালির পক্ষে এত দ্বিমেরু-বিষম ছিল যে কোনওভাবেই এদের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করা সম্ভব ছিল না।

 কিন্তু মানসিক বিরুদ্ধতা কোনও পক্ষই কিছুতে কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। কেননা হিন্দু হিন্দুই রয়ে গেল এবং উত্তরোত্তর আরও ‘শুদ্ধতর’ হিন্দু হয়ে ওঠার জন্যে আর্যাবর্তের ক্রমবর্ধমান চাপের কাছে বাঙালিত্বের স্বাভাবিক অভিজ্ঞানগুলি মুছে ফেলতে লাগল। আর, মুসলমান সমাজের নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক মুনাফার জন্যে, তাদের দেশজ শেকড় ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায়, মাতৃভাষা সম্পর্কেও বিরুদ্ধতা তৈরি করতে থাকলেন। সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আত্মজিজ্ঞাসা জাগিয়ে দেওয়ার বদলে আত্মবিস্মরণ সংক্রমিত করার মরিয়া চেষ্টা চলতে লাগল। কী মুসলমান কী হিন্দুধর্মতন্ত্রের কাছে সংঘবদ্ধ সমর্পণ শুধু অন্ধতা ও অসহায়তা উৎপাদন করে। ধর্মকে যারা কাজে লাগায়, বদ্ধতাই তাদের অস্ত্র ও অন্বিষ্ট; একমাত্র সদর্থক ভাষা-চেতনাই দিতে পারে মুক্তি। তাই ভালো বাঙালি যে হতে পারে, সে-ই ভালো মানুষ হয়ে ওঠে। হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্বের দিকে বেঁকে গেলে সেই পথ চোরাবালিতেই শেষ হয়। বাঙালি যে আন্তর্জাতিক মানবচেতনার উপাসনা করে, নিছক হিন্দু বা মুসলমান হয়ে উঠলে তা কখনও সম্ভব নয়। এইজন্যে নয়া ঔপনিবেশিক প্রতাপের বিশ্বকেন্দ্র গত তিন-দশক ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে চতুরভাবে হিন্দু ও ঐশ্লামিক মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। খাটি বাঙালি যে কখনও মৌলবাদী হতে পারে না, তা বাঙালির ইতিহাস ঠিক মতো অনুশীলন করলেই বোঝা যায়। তাই আর্যাবর্ত-মধ্যপ্রাচ্য-সাম্রাজ্যবাদী প্রতীচ্য—এই তিন অক্ষশক্তির একটাই লক্ষ্য: বাঙালিত্বকে ধ্বস্ত করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তুষের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া। বাঙালি চেতনায় যাবতীয় মিথ্যার প্রকৌশলের বিরুদ্ধে একটা সহজাত প্রতিরোধ আছে বলেই ওই অক্ষশক্তি পশ্চিমবঙ্গে, বাংলাদেশে ও বাঙালির অন্যভুবনে তাদের আক্রমণকে কখনও শিথিল করে না। তবু সর্বাত্মক বিদূষণের বিরুদ্ধে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ যে আজও প্রতিরোধের লড়াই-এ নেতৃত্ব দিচ্ছে, এতেই বাঙালির প্রবল আত্মিক শক্তি প্রমাণিত। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি—এর কারণ, রাজনৈতিক লড়াই ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে গরিষ্ঠ সংখ্যক বাঙালি তখন শানিততর করে চলছিলেন। চলমান ইতিহাসের অস্থির পটভূমিতে দাঁড়িয়েও বাঙালির প্রগতি-ভাবনা এখনও চেতনাকেন্দ্র সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত নয়। বহুস্তর বিন্যস্ত সংগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন পরিধি ও ভিন্ন ভিন্ন উপকেন্দ্র সম্পর্কে মনোযোগী হয়েও মূল ভাবকেন্দ্রকে চিরজাগ্রত রাখার ব্যাপারে প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গ অমনোযোগী ছিল না কখনও।

 বস্তুত এইজন্যে প্রত্যাশাও অনেক। কোথাও অন্ধবিন্দুর আশঙ্কা লক্ষ করলে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই হয়। ভারতীয়ত্ব নির্মাণ করতে হয়, কিন্তু বাঙালিত্ব সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। চৈতন্য থেকে লালন পর্যন্ত যে-ধারা প্রবহমান, তাতে বাঙালিত্বের আধার ও আধেয়কে বিশ্বমানবিক চেতনায় উত্তীর্ণ করা হয়েছে। ভারতীয়ত্বের ধারণায় বাঙালি যে অভূতপূর্ব বস্তুগত ও চিন্তাগত উপাদান সরবরাহ করেছে, সেই ইতিহাস অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে বুঝব, এর রাজনৈতিক অন্তর্বস্তু যতটা প্রকট, সাংস্কৃতিক অন্তর্বস্তু ততটা নয়। ভারতীয় সংস্কৃতির বোধকে ক্রমাগত চেষ্টায় নির্মাণ করতে গিয়ে বারবার উদ্ধত প্রতাপের কবলে পড়তে হয়েছে। অথচ এই গুরুতর বিষয়টি নিয়ে কেউ কখনও আন্তরিক বিশ্লেষণ করেননি। এতে সবচেয়ে বিপদ যাদের হয়েছে, সেইসব ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বাঙালিদের কথা আগে লিখেছি। এবার আরও একটু স্পষ্ট করে লিখতে চাই, আসাম-ত্রিপুরা-মেঘালয়- বিহার-উড়িষ্যাউত্তরপ্রদেশ সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী সেইসব বাঙালিদের কথা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা ধার করে বলা যায়—এদের ঘর নেই—আছে তাবু অন্তরে বাহিরে। এদের জন্যে নির্দিষ্ট কোনও মানচিত্র নেই। তাই এরা কেবল সমাজতত্ত্ববিদদের অন্তর্দেশীয় প্রব্রজনের বিষয়।

 এঁদের জন্যে বাঙালিত্ব অটুট রাখার কোনও পথ খোলা নেই। আসামের লোক-গণনায় স্থানীয় রাজনীতির চাপে একদল বাঙালিকে বলতে হয় আমাগো ভাষা অহইম্যা’, অন্যদের ক্ষেত্রে কোনও জিজ্ঞাসাবাদের তোয়াক্কা না করে তাদের লেখানো হয় নব অসমীয়া’ বলে। সর্বশেষ আদমসুমারিতে মোল্লাতন্ত্রের এক দাপুটে রাজনৈতিক প্রতিনিধি আসামের অভিবাসী মুসলমানদের পরামর্শ দিয়েছে, মাতৃভাষা বাংলা ছেড়ে দাও—অসমিয়া পরিচয় লেখাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ধনপ্রাণ বিপন্ন হয়, হচ্ছে। বারেবারে। প্রশাসনিক সন্ত্রাসবাদ উগ্র চেহারা নিয়ে দেখা দেয় যখন, একাধিক প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, হচ্ছে বিদেশি শনাক্তকরণের নোটিশ। কিংবা হালে বরপেটায় উগ্র অসমিয়া সম্প্রসারণবাদের ঠ্যাঙারে পুলিশবাহিনী। প্রসারী লক্ষ্যে গুলি করে মেরেছে অভিবাসী বাঙালি মুসলমানদের। এ আরেক অশনিসংকেত। বাসস্থানের, শিক্ষার ও জীবিকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় তাদের, আরও হবে একই অবস্থা মেঘালয়-মনিপুর-মিজোরাম-অরুণাচলনাগাল্যাণ্ডে। আসামে বাংলা ভাষার পাঠ্য বইতে সচতুরভাবে ভাষার শুদ্ধতায় অন্তর্ঘাত করা হয় অসমিয়া শব্দবন্ধ ও বাক্যগঠনরীতি ব্যবহার করে। উপনিবেশীকৃত মন নিয়ে প্রান্তিকায়িত বাঙালি এই বেপরোয়া বিদূষণকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। ত্রিপুরায় উগ্রপন্থীদের আক্রমণের লক্ষ্য খেটে-খাওয়া ও ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি। মেঘালয়েও তা-ই। সুতরাং বাঙালিদের সামনে দোঁ-আশলা অসমিয়ায় বা হিন্দি-ভাষীতে পরিণত হওয়া ছাড়া আর কী পথ আছে? বাঙালিত্বের কর্ষণ যখন বিপজ্জনক, হিন্দুত্ব বা মুসলমানত্বের পথই খোলা থাকে শুধু।

 বৈদ্যুতিন গণ-মাধ্যমের মধ্য দিয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান তত্ত্বের বৌদ্ধিক সন্ত্রাসে বাঙালিত্ব ও বাংলা ভাষা কোনঠাসা। তার ওপর রয়েছে ইংরেজি-মাধ্যম পাঠশালাগুলির মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে-পড়া মেকি সাহেবিয়ানার দৌরাত্ম্য। ইংরেজি তো নিশ্চয় শিখব আমরা। কিন্তু হীনমন্যতা নিয়ে বাঙালিরা ইংরেজিয়ানার পেছনে ছুটেছেন, তাতে বকচ্ছপ ও হাঁসজারুদের সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে শুধু। শৈশব জুড়ে এখন হরেক রকম কমিকস, কৈশোরে টিন-এজারদের রোমাণ্টিক অ্যাডভেঞ্চার, আর যৌবনে যৌনতা ও হিংস্রতার ককটেল। এটা অবশ্যই সর্বভারতীয় সমস্যা; কিন্তু আত্মবিস্মৃতির চক্রব্যুহে বন্দী বাঙালির জন্যে তা বিশেষ সমস্যাও বটে। বিশ শতকে দেশ স্বাধীন হল, বিচিত্র কূটাভাসে স্বাধীনতার মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে গেল তবু তারা ভারতীয়তার নির্মাণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু ‘আরণ্যক’ এর সেই স্মরণীয় বাক্যটি ফিরে ফিরে আসে: ভারতবর্ষ কোন দিকে? পচা গলা সামন্ততন্ত্র যেখানে জাতপাতধর্মান্ধতা-কুসংস্কারের অন্ধকূপ তৈরি করে রেখেছে, যেখানে হরিজন পোড়ানোর মোচ্ছব চলে,সতীদাহ প্রথা পায় রাষ্ট্রীয় প্রতাপের সমর্থন, নির্বাচনী ঢাকেকাঠি পড়া মাত্র ধর্মীয় উন্মাদনার জিগির তোলা হয়—তা-ই তো প্রকট ভারতবর্ষ। কেননা সংখ্যার জোরে এই শক্তি ইন্দ্রপ্রস্থে রাজপাট সামলায় এবং তাদের রুচি ও সংস্কৃতি মাফিক জাতীয় সংহতির বুলি কপচায়। এই ভারতীয়তায় দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে’ নেই; মাৎস্যন্যায় আছে শুধু। চৈতন্য-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-লালন যে ভারতবর্ষের নির্মাতা, বাঙালি তো তারই উত্তরাধিকারী। সাম্প্রতিক ইণ্টারনেট আর ই-মেলের জমানাকে আধিপত্যবাদীরা ব্যবহার করে গণেশের দুধ খাওয়ার বৃত্তান্ত আসমুদ্র হিমাচলে ছড়িয়ে দিতে। উপগ্রহ-প্রযুক্তিকে কাজে লাগায় অহরহ মধ্যযুগীয় অপচেতনাক বিনোদনের মোড়কে পরিবেশন করার জন্যে। এই ভারতীয়তার নির্মাণই তো হচ্ছে অষ্টপ্রহর। ইংরেজি পড়ে নানা ধরনের প্রযুক্তিতে যত কৃতবিদ্যই তোক এখনকার প্রজন্ম, বিশ্বায়িত ভোগবাদের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও বিকল্পই নেই তাদের। সুকুমার-উপেন্দ্রকিশোর কিংবা রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র, নজরুল-জীবনানন্দ, অবনীন্দ্র-সুলতান, কমলকুমার-ইলিয়াস যে বহুস্বরিক বাঙালিত্বের স্থপতি—তার তাৎপর্য অনুশীলনের তাগিদ দিন দিন কমে আসছে।

 তবু এই দুস্তর মরুই শেষ কথা হতে পারে না। চলমান ইতিহাসের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন থাকে দ্বিরালাপের সম্ভাবনা, পুনর্নির্মাণের আর্তি। শুধু তাকে খুঁজে নিতে হয়। বিশ শতকের অন্তিম প্রহরে যেমন দেখা গেছে নবজাগরণের উদ্যম, শুধু চিন্তাবিত্তে ঋদ্ধ হওয়ার জন্যে নয়-বাস্তব পরিসরে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্যেও। আপনার গন্ধে আপনি বিভোর বৌদ্ধিক বর্গীয় কস্তুরীমৃগেরা থাকুন একান্ত নিজস্ব চারণভূমিতে; বহুধাবিচ্ছিন্ন সাধারণ বাঙালির কাছে জীবনচর্যা ও মননবিশ্বের নতুন স্থাপত্য-সম্ভাবনার বার্তা যদি পৌছে দেওয়া যায়—নবজাগরণ বাস্তবায়িত হবে নিশ্চয়। ঐতিহ্য ও বর্তমানের দ্বিবাচনিকতা সম্পর্কে এখনও সংশয় রয়েছে; নানা ভুবনের বাঙালির বিচিত্র জটিল সমস্যা এখনও অভিনিবেশের বিষয় হয়নি। হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব নামক মহাসন্দর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার মতো আকরণোত্তর বিন্যাস এখনও আধুনিকোত্তর পর্যায় সত্ত্বেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাঙালিত্বই যে খাঁটি ও সার্থক বিকল্প, এই উপলব্ধিতে পৌছানোর কার্যকরী পথ তৈরি করা যায়নি এখনও। নবজাগরণের উদ্যম যদি মৌলবাদসাম্রাজ্যবাদ-অভ্যন্তরীন আধিপত্যবাদের দৃশ্য ও অদৃশ্য আক্রমণ সম্পর্কে আমাদের অবহিত করতে পারে, তাহলে প্রতিরোধের সম্ভাবনা আপনি তৈরি হবে। আরোপিত সমন্বয়পন্থা নয়, স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্যপ্রীতি হতে পারে আমাদের বিশল্যকরণী। সংশয়-দ্বিধা-দোলাচল শুধু বৌদ্ধিক, লোকমনের নয়। তাই বাংলা ও বাঙালির মনের কথা বেজে উঠেছে একতারায়-দোতারায়:

‘নানা বরণ গাভীরে ভাই
একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখলাম
একই মায়ের পূত।

 সত্যি কি ‘একই মায়ের পূত’ প্রান্তিক বাঙালিরাও যাদের না আছে নিজস্ব মানচিত্র আছে আঙিনার নিশ্চয়তা? এই সংশয় সহজে দূর হয় না বলেই বয়ানে আসে বিহ্বলতা। তবু তৃষ্ণা জেগে থাকে ‘একই বরণ দুধ’ এর শরিক হওয়ার জন্যে। কোনও তাৎপর্যই সংগ্রাম ছাড়া অর্জনীয় নয়। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে নানা ভুবনের বাঙালিদের সংগ্রাম নানা ধরনের। আরোহী ও অবরোহী পথে চলতে চলতে সংগ্রামের প্রকরণ তো শিখে নিতে হয়। পুনর্বিন্যস্ত করতে হয় অস্তিত্বের প্রকল্পও।ইণ্টারনেটের অধিপরিসরে ভাষাশূন্য বুদ্বুদপুঞ্জের তীব্র মাদকে ওই প্রকল্প কি আচ্ছন্ন হয়ে যাবে অথবা নতুন আঙ্গিকে দেখা দেবে অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসা: এই প্রশ্ন মীমাংসিত হবে অদূর ভবিষ্যতে।

 আপাতত প্রত্যুত্তরযোগ্যতার নির্মাণ শুরু হোক বাঙালির বহুবাচনিক পরিসরে।