সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/কুৎসিত ষড়যন্ত্র

উইকিসংকলন থেকে

কুৎসিত ষড়যন্ত্র

কয়েক মাস সমুদ্রে ব্যর্থভাবে ঘুরে তিনি যখন ইসাবেলায় ফিরে এলেন তখন দেখেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীরা বহুদূর অগ্রসর হয়েছে।

 কলম্বাস সঙ্গে করে যে সব সৈনিক এনেছিলেন, মারগারিট ছিলেন তাঁদের নায়ক। কলম্বাসের অনুপস্থিতিতে ফাদার বয়েলের প্ররোচনায়, তিনি তাঁর লোকজন নিয়ে দিয়িগোর বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র অভিযানের আয়োজন করেন। কলম্বাসের ভাই বার্থলোমিউ যথাসময়ে সেই বিদ্রোহের খবর জানতে পেরে মারগারিটকে প্রতিরোধ করবার জন্যে প্রস্তুত হন।

 মারগারিট জানতো যে বার্থলোমিউ কলম্বাসের মতই সাহসী এবং বীর···তাই তিনি ইসাবেলা আক্রমণ না করে, বন্দরে তাঁদের দলের যে-সব জাহাজ ছিল, তাই নিয়ে স্পেনের অভিমুখে যাত্রা করলেন। উদ্দেশ্য—স্পেনে ফিরে গিয়ে, কলম্বাসের সম্বন্ধে কুৎসা রটনা করে রাজ-অনুগ্রহ থেকে কলম্বাসকে বঞ্চিত করা। আর একদিকে নরখাদকদের নেতা ক্যানাবো তাঁর লোকজন নিয়ে ফোর্ট সেণ্ট টমাস অবরোধ করলো। দিনের পর দিন সেই নরখাদকদের সঙ্গে অবরুদ্ধ স্পেনিয়ার্ডদের যুদ্ধ চলতে লাগলো। স্পেনিয়ার্ডদের সুবিধা ছিল যে, তাদের হাতে ছিল বন্দুক। ক্যানাবো যখন দেখলো যে বন্দুকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এরকম যুদ্ধে তার লোকেরা জিততে পারে না, সে তখন তার লোকজন নিয়ে প্রত্যাবর্ত্তন করলো। মারগারিট চলে যাওয়াতে তাঁর দলের সৈন্যরা নায়ক-শূন্য হয়ে নিরীহ ইণ্ডিয়ানদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার শুরু করে দিল। এহেন অবস্থায় কলম্বাস ইসাবেলায় ফিরে এলেন।

 স্পেনে ফিরে গিয়ে, মারগারিট ও ফাদার বয়েল সেই বিদেশী ইতালীয়ানের নামে ভয়ঙ্কর সব কুৎসা রটনা করতে লাগলেন এবং সে-ব্যাপারে তাঁরা ফোন‍্সেকার দলের কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্য পেলেন। তাঁদের চেষ্টার ফলে রাজা ও রাণীর কাছেও এই সব কুৎসা গিয়ে উঠলো।

 কলম্বাস যে স্বর্ণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি তা পাঠাতে পারেন নি। সেই জন্যে রাজা ও রাণীর মন ইতিমধ্যেই ভারাক্রান্ত হয়ে ছিল। তারপর যখন তাঁরা শুনলেন যে, কলম্বাস সেখানকার লোকদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন করছেন এবং নিজের জন্যে কলসী-কলসী সোনা সঞ্চয় করে রাখছেন, তখন রাজা ও রাণীর মন তিক্ত হয়ে উঠলো। তাঁরা অপর পক্ষের কথা শোনবার আগেই নিজেদের মনে কলম্বাস-সম্বন্ধে বিরূপ হয়ে রইলেন; এবং কলম্বাসের গতিবিধি ও কাজ সম্বন্ধে নিজের চোখে দেখে রিপোর্ট করবার জন্যে তাঁরা তাঁদের একজন বিশ্বস্ত উচ্চ রাজকর্ম্মচারীকে পাঠালেন।

 সমুদ্র-তরঙ্গে বিপর্য্যস্ত হয়ে সেই রাজকর্ম্মচারী যখন ইসাবেলায় গিয়ে পৌঁছলেন, তখন ইসাবেলার চারদিকে গোলমাল। সেই গোলমালের মধ্যে তিনি কলম্বাসের ওপর হুকুম জারী করতে লাগলেন এবং তাঁর প্রত্যেক কাজে সন্দেহ করে তাঁকে বাধা দিতে লাগলেন। ক্রমশ ব্যাপার এমনি হয়ে এলো যে, কলম্বাস নিজে ফিরে এসে রাজা ও রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে স্পেনের অভিমুখে রওনা হলেন।

 কলম্বাস ফিরে এলেন; কিন্তু এবার যখন কলম্বাস ফিরে এলেন, তখন আর তাঁকে অভিনন্দন করতে তটভূমিতে উন্মাদ জনতা চীৎকার করে উঠলো না, নগরে-নগরে অভিনন্দনের জন্যে রাজাজ্ঞা প্রচারিত হলো না। সাধারণ লোক উত্তেজনা চায়, তারা দিনের পর দিনের অধ্যবসায়, অন্তরের নিভৃত নিষ্ঠা, এসব জিনিসকে অভিনন্দন করতে সহসা চায় না। তার ওপর কলম্বাসের শত্রুপক্ষ যে-সব কুৎসা রটিয়েছিল, তা তারা ষোলো আনাই বিশ্বাস করে নিয়েছিল।

 পরের নিন্দার চেয়ে মুখরোচক জিনিস, সাধারণ মানুষের কাছে আর কিছু নেই। কাল যাকে তারা দেবতা-জ্ঞানে পূজা দিয়েছে, আজ তার নামে জঘন্যতম কুৎসা রটনা করে; বিচার করে দেখবার ধৈর্য্যটুকু পর্য্যন্ত তাদের থাকে না।

 রাজসভায় রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড ও রাণী ইসাবেল। তাঁকে সমাদর করলেন বটে কিন্তু সে সমাদরের মধ্যে তেমন কোন প্রাণের উত্তাপ ছিল না। রাজসভা থেকে কলম্বাস শুনলেন, গুঞ্জনধ্বনি হচ্ছে, যার মর্ম্ম হচ্ছে, কলম্বাস এমন কি আর করেছে···তারা ইচ্ছে করলে সবাই তা করতে পারতো!

 কলম্বাসকে সম্মান দেখাবার জন্য একটা ভোজের আয়োজন হলো বটে, কিন্তু তাও যেন প্রাণশূন্য! কলম্বাস লক্ষ্য করলেন, ভোজে আয়োজনের অভাব নেই...সমারোহের অভাব নেই...অজস্র প্রাচুর্য্য চারদিকে উপ্‌ছে পড়ছে...তবু তাতে আন্তরিকতার অভাব! বরং এমন দু’চারটি কথাবার্ত্তা তাঁর কানে এলো, যা তাঁর কাছে জঘন্য বিদ্রূপ বলেই মনে হলো!

 তিনি শুন্‌লেন, নিমন্ত্রিত সভাসদ‍রা পরস্পর কথাবার্ত্তা বলছেন···তাঁদের একজন বল্লেন, কলম্বাস কি এমন একটা কাজ করেছে যার জন্য এত সমারোহ! অপর একজন তার জবাব দিলেন...সে আর বলো কেন ভাই? এ যেন কত বড় একটা আবিষ্কার! জীবনে সাগর-জলে ভাসেনি, এমন লোক কোথাও আছে নাকি! তুমি না হয় গিয়েছ দশ মাইল, আমি গিয়েছি বিশ মাইল, কেউ বা গিয়েছে পঁচিশ মাইল! যা শুধু এই মাইলের পার্থক্য। তা ছাড়া এতে আর বাহাদুরীটা কোথায়? কলম্বাস নয় কিছুটা বেশী পথই সাগর-জলে গিয়েছিল! চেষ্টা করলে...হয়তো তুমিও পারতে...আমিও পারতাম...আর কোনো লোকও পারতো।

 কলম্বাস তাঁদের কথাবার্তা শুন্‌লেন...শুনে বুঝতে পারলেন কথার স্রোত বইছে কোন্‌দিকে! তিনি তার কোনো প্রতিবাদ করলেন না, ডিশ্ থেকে একটী ডিম তুলে নিয়ে বল্লেন, বন্ধুগণ! আপনারা কেউ এই ডিমটাকে ডিশের ওপর দাঁড় করাতে পারেন?

 সভাসদরা একে-একে সকলেই চেষ্টা করলেন...কিন্তু তাঁদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হলো...কেউ সেটি দাঁড় করাতে পারলেন না।

 তখন কলম্বাস বল্লেন, দিন, এখন ডিমটা আমায় দিন। ...এই বলে সেটী হাতে নিয়ে তার একটা দিক্ টেবিলে ঠুকে দিলেন।...ঠুক্‌তেই ডিমের সেই দিকের খোলসটা ভেঙে গেল···তারপর সামান্য চেষ্টা করতেই ডিমটীকে সেই মাথার ওপর দাঁড় করানো গেল।

 সবাই প্রতিবাদ তুল্লেন, ওরকম ভাবে সবাই পারে... আমরাও পারতুম। কলম্বাস বল্লেন, হাঁ পারতেন আপনারা সবাই...কিন্তু যদি আপনাদের মাথায় এ বুদ্ধিটুকু খেলতো! মাথায় খেলা নিয়েই হচ্ছে যত পার্থক্য, তাছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই। আপনাদের মাথায় যদি খেলতো, তাহলে আপনারাও নতুন জগৎ আবিষ্কার করতে পারতেন!

 উপস্থিত সভাসদরা কলম্বাসের কথার মর্ম্ম গ্রহণ করতে পেরে নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন।

 কিন্তু হিংসুক যারা...পরশ্রীকাতর যারা, তর্ক করে তো তাদের হৃদয় জয় করা যায় না! কলম্বাস সর্ব্বত্রই একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পেতে লাগলেন।

 ক্রমশ তাঁর মন ভেঙে পড়লো। তিনি অবশ্য অভিনন্দন নেবার জন্যে আসেন নি। যে কাজ তিনি সুরু করেছিলেন, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে আরো অর্থের প্রয়োজন, আরো লোকের প্রয়োজন, তাই তিনি আবার ফার্ডিন্যাণ্ড এবং ইসাবেলার দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু বার-বার আবেদন সত্ত্বেও, কলম্বাস তাঁদের কাছ থেকে কোন উত্তর পেলেন না।

 উত্তরের অপেক্ষায় দুটী বছর কেটে গেল, অবশেষে রাণী ইসাবেলার মনে কলম্বাস রেখাপাত করতে পারলেন। রাণী ইসাবেলাকে তিনি বোঝাতে পারলেন যে, কলসী-কলসী কাঁচা সোনা না নিয়ে আসতে পারলেও, যে সব নতুন রাজ্য তিনি স্পেনের হয়ে অধিকার করেছেন এবং করবেন, তাতে সাম্রাজ্য হিসেবে স্পেনের গৌরব এবং শক্তি বাড়বে বই কমবে না।

 রাণী ইসাবেলা সন্তুষ্ট হয়ে আবার অভিযানের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তুএবার অভিযানে লোক আর পাওয়া যায় না; কারণ, ইতিমধ্যে কুৎসার ফলে সুদূর উপনিবেশ সম্বন্ধে যে-সব কাহিনী প্রচারিত হয়েছিল, তাতে কোন লোকই আর ঘরের মায়া ত্যাগ করে যেতে চাইলো না। অবশেষে জেল থেকে কয়েদীদের জোর করে কলম্বাসের সঙ্গে পাঠানো হলো।