সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/দ্বিতীয় অভিযান

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় অভিযান

স্পেনের রাজা ও রাণী কলম্বাসের প্রস্তাব অনুযায়ী তাঁর আবিষ্কৃত নতুন দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করবার আয়োজনে সম্মত হলেন এবং কলম্বাস আবার দ্বিতীয় অভিযানের জন্যে প্রস্তুত হলেন।

 যদিও যে-পরিমাণ সোনা তিনি আশা করেছিলেন, সে-পরিমাণ সোনা তিনি সঙ্গে আনতে পারেন নি, কিন্তু দ্বিতীয় অভিযানে তিনি আশা করলেন যে সোনার খনির আসল সন্ধান এবার তিনি নিয়ে আসতে পারবেন। সারা স্পেনের মধ্যে রাজাজ্ঞা ঘোষিত হয়ে গেল...কলম্বাস দ্বিতীয় বার অভিযানে বেরুচ্ছেন এবং এবার তাঁর সঙ্গে যাঁরা সেই নতুন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে চায়, তাদের নিয়ে যাওয়া হবে।

 নতুন আবিষ্কারের উত্তেজনার মাথায় দলে-দলে লোক আসতে লাগলো···রাণী ইসাবেলা নিজে থেকে দ্বিতীয় অভিযানের সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলেন···নান। জাতীয় লোক এই অভিযানে যোগদান করলো···তিনটী বড়-বড় জাহাজ, এবং চৌদ্দটী ছোট জাহাজ লোক এবং খাদ্যসামগ্রী দিয়ে বোঝাই করে ২৪শে সেপ্টেম্বর তারিখে কলম্বাস দ্বিতীয় অভিযানে বেরুলেন।

 কিন্তু কলম্বাসের এত খ্যাতি ও প্রতিপত্তিতে একজন লোক বিশেষ উত্যক্ত হয়েছিলেন, তাঁর নাম হলো জুয়ান্ ডি ফোন্সেকা। তাঁরই ওপর এই অভিযানের খাদ্য-সামগ্রী জোগাড়ের ভার ছিল। গোড়া থেকেই ফোন্‌সেকা সামান্যসামান্য ব্যাপারে যেভাবে কলম্বাসের সঙ্গে ঝগড়া করতে শুরু করেন, তাতে কলম্বাস বুঝেছিলেন যে, তিনি চলে গেলে, তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করবার জন্যে স্পেনে অন্তত একজনও লোক রয়ে যাবে। কলম্বাস তাঁর এই অনুমানে যে একেবারেই ভুল করেন নি, খানিক পরেই তা প্রমাণিত হবে।

 দ্বিতীয় অভিযানে কলম্বাস গোয়াডালুপ্ বলে একটা নতুন দ্বীপে নামলেন। দ্বীপের মধ্যে নেমে তিনি যে-দৃশ্য দেখলেন, তাতে ভয়ে ও বিস্ময়ে তিনি পাথর হয়ে গেলেন! দ্বীপের ভেতর যে-সব পাতার ঘর ছিল, দেখলেন, সেগুলি অধিকাংশই ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে, আর তার ভেতরে মানুষের মৃতদেহ পচে রয়েছে, কোথাও বা পড়ে আছে শুধু কঙ্কাল! একটা ঘরে গিয়ে দেখেন, কতকগুলো মেয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে···তারাও মুমূর্ষু!

 বহু অনুসন্ধানের পর তিনি জানতে পারলেন যে, প্রথম অভিযানে যে নর-ঘাতকদের দলের সঙ্গে তাঁদের দলের লোকের সংঘর্ষ হয়েছিল, এ হলো সেই ভয়ঙ্কর নরখাদক ক্যারিবূ জাতের কাণ্ড। মেয়েদের মাংস তারা খায় না...তাদের ধারণা যে, মেয়েদের মাংস নাকি হজম হয় না...তাই পুরুষদের খেয়ে ফেলে, মেয়েদের বেঁধে ফেলে রেখে যায়···বনের পশুদের খাদ্যের জন্যে...

 প্রথম অভিযানে কলম্বাস যে জায়গা থেকে ফিরে এসেছিলেন, সেখানকার তিনি নাম দিয়েছিলেন, ‘নাভিডাড’ (Navidad)। সেখানে তিনি নিজে থেকে একটী ছোট দুর্গ তৈরী করিয়েছিলেন এবং তাঁর দলের কয়েকজন লোককে তাঁর প্রতিনিধি-স্বরূপ সেই দুর্গে রেখে গিয়েছিলেন।

 নাভিডাডে ফিরে এসে তিনি দেখেন যে, তাঁর দুর্গ ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে এবং যে-সব লোকদের তিনি রেখে গিয়েছিলেন, তাদের একজনও জীবিত নেই...সোনার অনুসন্ধানে তাদের মধ্যে কেউ এই দ্বীপের ভেতরে গিয়ে আর ফিরে আসে নি, কেউ বা ক্যারিবদের আক্রমণে মরে ভূত হয়ে গিয়েছে...অবশিষ্ট যারা বেঁচে ছিল, তারা মরেছে অসুখ-বিসুখের জ্বালা-যন্ত্রণায়।

 কলম্বাস অন্য জায়গায় গিয়ে উপনিবেশ স্থাপনের জন্যে আর একটা নতুন শহর গড়ে তুলতে চাইলেন, রাণীর নামে সেই নতুন শহরের নাম হলো ইসাবেলা···সেখানেই নতুন ঔপনিবেশিকরা সব নামলেন...নতুন উদ্যমে আবার ঘরবাড়ী সব তৈরী হতে লাগলো...

 ইসাবেলায় থাকতে থাকতে কলম্বাস খবর পেলেন যে, সেখান থেকে প্রায় চার দিনের পথ একটা জায়গা আছে, সেখানে প্রচুর পরিমাণে সোনা পাওয়া যায়। তাঁর সঙ্গে ওজেদা বলে এক দুঃসাহসিক যুবক ছিল। কলম্বাস ওজেদার ওপর সেই ভার দিলেন। ওজেদা লোকজন নিয়ে সেই সোনার সন্ধানে বেরিয়ে গেল।

 ওজেদা যখন সেই দেশে গিয়ে উপস্থিত হলো, সে দেখলো, সত্যিই সেখানকার নদীর জলে স্বর্ণ-রেণু রয়েছে···কয়েক দিন সেখানে থেকে সেই স্বর্ণ-রেণু সংগ্রহ করে ওজেদা ফিরে এলো...কিন্তু ফিরে আসবার পথে ওজেদাও সেই নরখাদক ক্যারিবদের অত্যাচার দেখে এলো...

 কলম্বাস স্থির করলেন যে, এই ক্যারিবদের ধ্বংস করতে না পারলে, উপনিবেশ স্থাপন করা নিরাপদ হবে না...তখন তিনি তাঁর দলের লোকদের এই নরখাদকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবার হুকুম দিলেন...

 কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে উৎসাহের বশে যে-সব লোক এসেছিল, তাদের মধ্যে একটা দল ভেঙে পড়লো...তারা ভেবেছিল, তারা যেখানে যাচ্ছে, সেখানে দাঁড়ালেই পায়ে সোনার ধূলো লাগবে...কিন্তু তার বদলে তারা যখন দেখলো, অতি নিদারুণ অবস্থার মধ্যে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে এবং যে-কোন মুহূর্ত্তে হয়ত নরখাদকদের আক্রমণে তাদের পেটে চলে যেতে হবে...তখন তারা গোপনে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো...এবং কলম্বাস যখন জাহাজের আশেপাশে চারদিকে সোনার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, সেই সময় তারা স্থির করলো যে, একখানা জাহাজ নিয়ে তারা স্পেনে পালিয়ে যাবে, এবং সেখানে গিয়ে কলম্বাসের সমস্ত কথা যে ধাপ্পা তা প্রচার করবে।

 তাদের আয়োজন কার্য্যকরী হবার আগেই কলম্বাস তাদের ষড়যন্ত্রের সংবাদ পেলেন এবং কালবিলম্ব না করে, ষড়যন্ত্রকারী প্রত্যেককে কারারুদ্ধ করে রাখলেন। কলম্বাসের রুদ্র মূর্ত্তিতে সকলেই তখন বিষম ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে গেল।

 এইভাবে বিদ্রোহীদের দমন করে কলম্বাস সঙ্গে প্রায় চারশো লোক নিয়ে ওজেদা যে জায়গায় নদীর জলে স্বর্ণরেণু দেখে এসেছিল, সেখানে যাত্রা করলেন। স্পেন থেকে আসবার সময় তিনি সঙ্গে করে খনি-খাতকদের নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে এসে দেখলেন যে, নদী থেকে সোনা সংগ্রহ করতে যথেষ্ট সময় নেবে এবং তাঁর আশা হলো যে নিশ্চয়ই নদীর তীরের কাছে কোথাও মাটির নীচে সোনার খনি আছে।

 একদল লোক নিয়ে তিনি স্থানে স্থানে মাটি খুঁড়তে আরম্ভ করে দিলেন। সেই সময় তিনি মনে মনে ভাবলেন, যখন এতগুলে। লোককে সেখানে থাকতে হবে, তখন সর্ব্বাগ্রে সেখানে একটি দুর্গ তৈরী করা দরকার। তাই তিনি প্রথমে আগেকার মত একটা ছোট-খাটো দুর্গ তৈরী করালেন। দুর্গ তৈরী হলে তিনি সেই দুর্গের নাম দিলেন ফোর্ট সেণ্ট টমাস। তারপর ওজেদাকে সেই দুর্গের ভার দিয়ে তিনি আবার ইসাবেলায় ফিরে এলেন।

 কয়েক মাস অনুপস্থিতির পরে ইসাবেলায় যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন দেখেন, সেখানে ঘোর অরাজকতা শুরু হয়ে গিয়েছে। কোথা থেকে এক বুনো জ্বর প্রায় মড়কের মত ছড়িয়ে পড়েছে। যারা অসুস্থ হয়ে শুয়ে পড়ে নি, তারা তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে, সেখানকার আদিম অধিবাসীদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার শুরু করে দিয়েছে, আর তার ফলে আদিম অধিবাসীর। যে-যার সরে পড়েছে। কাজেই সারা দেশে তখন খাদ্যের এক দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে।

 ঐ সব অসভ্য লোকেরা নিজেরা নানা ফল-মূল আহরণ করে উপহার-স্বরূপ নিয়ে আসতো আর সামান্য কিছু চকচকে জিনিষের বিনিময়ে সেই সব খাদ্য তারা দিয়ে যেতো। এখন আর সে-সব খাদ্য তারা আনে না, কাজেই এমন অভাব!

 কলম্বাস সঙ্গে করে যে-সব খাদ্য নিয়ে এসেছিলেন, তা-ও দিনের পর দিন কমে আসছিল। কলম্বাস চেষ্টায় ছিলেন, ঔপনিবেশিকদের দিয়ে চাষবাস করাবেন; কিন্তু তারা নিজেরা খাটতে না চেয়ে ইণ্ডিয়ানদের দিয়ে, সেই খাটুনী খাটিয়ে নিতে চাইছিলে।···এইসব কারণে কলম্বাস দেখলেন যে ঔপনিবেশিকদের সঙ্গে সরল-প্রাণ সেই ইণ্ডিয়ানদের বেশ একটা শত্রুতা গড়ে উঠছে এবং তার জন্যে ষোলো আনা দায়ী, তাঁরই দলের যত সব পরিশ্রমপরাম্মুখ সুখান্বেষী লোকজন।

 কলম্বাস বুঝলেন, তারা জানেনা যে, সাত-সমুদ্র তেরো নদী পারে এসে যদি ঐশ্বর্য্য নিয়ে যেতে হয়, তাহলে নিজেদের করতে হবে পরিশ্রম, খাটাতে হবে বুদ্ধি এবং যাদের মধ্যে এসে পড়া গিয়েছে, তাদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে হবে। কাজেই কলম্বাস সেই অলস জনতাকে শিক্ষা দেবার জন্যে আইনজারী করলেন, প্রত্যেক লোককে সেই উপনিবেশের কল্যাণের জন্যে, নিজের হাতে চাষ করতে, কিম্বা শস্য ভাঙতে, কিম্বা যা হোক কিছু পরিশ্রম করতে হবে; যে তা করবে না, তাকে সাধারণ ভাণ্ডার থেকে খাদ্য দেওয়া হবে না।

 এই আদেশে তাঁর দলের অধিকাংশ লোকই ভেতরে-ভেতরে ক্ষেপে উঠলো। তারা যখন নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করে কলম্বাসের সঙ্গে এসেছিল, তখন তাদের ধারণা ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকমের। কলম্বাসের চরম দুর্ভাগ্য যে তিনি যে-সব লোক নিয়ে তাঁর সাধনায় নেমেছিলেন, তারা সকলেই অতি নিম্নস্তরের মানুষ। তাঁর দলে কয়েকজন পাদ্রীও এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ফাদার বয়েল্ বলে একজন পাদ্রী কলম্বাসের এই আদেশ শুনে প্রতিবাদ করে জানালেন যে তাঁরা পাদ্রী, তাঁরা মাটি খুঁড়তে আসেন নি, তাঁদের কাজ হলো উচ্চস্তরের।

 কলম্বাস তাঁর কথা শুনলেন কিন্তু পাদ্রীদের একেবারে কাজ করা থেকে তিনি রেহাই দিলেন না। পাদ্রীদের বেলায় তিনি শাস্তির বিধান করলেন, যদি তাঁরা পরিশ্রম না করেন তাহলে শুধু একবেলার মত খাদ্য পাবেন।

 কলম্বাসের এই বিধানের ফলে সেই উপনিবেশের অধিকাংশ লোকই তাঁর শত্রু হয়ে উঠলো। কিন্তু তাঁর তখন সেদিকে ভ্রূক্ষেপই ছিল না। তাঁর মাথায় তখন পৃথিবীর মানচিত্র রাত-দিন ঘুরছিল! তিনি ভাবছিলেন, আরো কত নতুন দেশ আছে, অথচ সেখানে এখনো তিনি পৌঁছতে পারেন নি...যে ভারতবর্ষের কথা তিনি লোকমুখে, ইতিকথায় শুনেছেন, সেখানকার অন্তর্দেশে তিনি শুনেছেন, বড়-বড় রাজারা আছেন···পশ্চিমের অগ্রদূত হয়ে সেখানে তাঁকে পৌঁছতে হবে...যে সোনা-মণি-মরকতের কথা তিনি রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড এবং রাণী ইসাবেলাকে শুনিয়ে এসেছেন, এখনো সে দেশে তিনি পৌঁছতে পারেন নি—তাই তাঁর মাথায় তখন রাত-দিন ঘুরছিল, নব-নব দেশের চিত্র, নব-নব তট-ভূমির স্বপ্ন···তাই কোথায় কার মনে কি হচ্ছে, সে চিন্তাই তাঁর ছিল না...যাঁকে রাজা বলে স্বীকার করেছেন, তাঁর সামনে যে বিরাট স্বপ্ন তিনি তুলে ধরেছেন, তাকে সফল করতেই হবে। কিন্তু হায়, তখন কলম্বাসের মনে কোন ধারণাই ছিল না যে, মানুষের হাতে কি কঠিন আঘাত তাঁর জন্যে অদূর ভবিষ্যতে অপেক্ষা করছিল!

 তিনি স্থির করলেন, ইসাবেলায় বসে না থেকে তিনি নতুন দেশ আবিষ্কারের জন্যে বেরুবেন। তাঁর অবর্ত্তমানে সেই নব-গঠিত নগরীর শাসনের ভার তিনি কয়েকজন লোকের মিলিত এক কাউন্সিলের ওপর দিলেন এবং সে কাউন্সিলের সভাপতি করে গেলেন তাঁর ছেলে দিয়িগোকে।

 ওজেদার ওপর ভার রইলো ফোর্ট সেণ্ট টমাসের এবং মারগারিট নামে তাঁর আর একজন সাহসী কর্ম্মচারীর ওপর সেখানকার আশে-পাশের স্থলভূমি তদারক করে সোনার খনির সন্ধান করবার ভার দিলেন। এইভাবে সমস্ত ব্যবস্থা করে, তিনি জাহাজ নিয়ে আবার জলে ভাসলেন।