বিষয়বস্তুতে চলুন

সাহিত্যে নারী: স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টি

উইকিসংকলন থেকে

সাহিত্যে নারী: স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টি

সাহিত্যে নারী: স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টি

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে

শ্রীমতী অনুরূপা দেবী কর্ত্তৃক প্রদত্ত লীলালেক্‌চারস্‌ ১৯৪৪

শ্রীমতী অনুরূপা দেবী প্রণীত

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক প্রকাশিত

মূল্য ছয় টাকা

JUNE 1949.

Printed by K. V. APPAROW,
at the Metropolitan ptg. and Pblg. House, Ltd.
90 Lower Circular Rd., Calcutta.

উ ৎ স র্গ

আমার পুত্র

৺ অম্বুজনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,

এম, এ (পাটনা) এম, এ, (কলিকাতা)

পি, আর, এস, বি, এল

কে

মা

নিবেদন

সুদীর্ঘকাল কাগজের অভাবের অজুহাত এবং দুই বৎসর মুদ্রাযন্ত্রের অধীনে থাকার পর এতদিনে “সাহিত্যে নারী” মুক্তি লাভ করলো, কিন্তু যে দু’জন এর প্রধান পাঠক ছিল, এই দীর্ঘকালে তাদের আমি হারিয়েছি, সে ক্ষতি আমার পক্ষে অপূরণীয়। একজন আমার পুত্র অম্বুজ, অপর আমার ভাই বিশ্বনাথ ফণ্ডের প্রেসিডেণ্ট, বর্ত্তমান এডুকেশন সম্পাদক নীরবকর্ম্মী প্রগাঢ় পণ্ডিত আমার ভ্রাতা বটুকদেব মুখোপাধ্যায়, এম, এ। সুধীবৃন্দের সহানুভূতি লাভ সমর্থ হ’লে আমার শ্রম সার্থক হ’বে।

পরম স্নেহাস্পদ সুলেখক ও সুবিদ্বান প্রভাত মোহনের আপ্রাণ সহায়তা না পেলে এ বই কোনদিনই লেখা হ’ত না।


১৩৫৬
লেখিকা

সাহিত্যে নারী: স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টি

ভূমিকা

 শ্রীযুক্ত রণেন্দ্র মোহন ঠাকুর ও শ্রীমতি সুলাজিনী দেবীর একমাত্র কন্যাসন্তান এবং আশুতোষ চৌধুরীর পুত্রবধু ও আর্য্যকুমার চৌধুরীর পত্নী লীলা দেবীকে প্রথম দেখি মাসিক পত্রের পৃষ্ঠায় তাঁর একটী আলোকচিত্রের মধ্য দিয়ে। চিত্রটির নাম করণ করা হয়েছিল, “শিল্পী"।

 রূপের পূজারী জগতে কে’ নয়? মানুষ থেকে ক্ষুদ্র পতঙ্গেরাও মৃত্যুরূপী অগ্নিশিখার রূপে আকৃষ্ট হয়ে আত্মোৎসর্গ করে। ঐ ছবি যদি চিত্রকরের কল্পনা প্রসূত চিত্র হ’ত, অতটা আকর্ষণীয় হত’না, ফটো-চিত্রটী এতই আকর্ষণীয় যে তার পরিচয় না জেনে স্থির থাকা গেলনা। “ভারতবর্ষের” কল্যাণে তাঁকে নানান ভাবাভিব্যক্তিতে আমরা মধ্যে মধ্যে দেখতেই পেতাম। কখনও “প্রতীক্ষা পরায়ণা,” কখনও “উপাসিকা,” কখনও ‘পূজারিণী” এই সকল লীলা-সুন্দর অবস্থানে মূর্ত্তিগুলি সুন্দরতর হয়ে উঠেছিল। ঐ চিত্ররূপ দেখতে আমার অত ভাল লাগার মধ্যের একটা নিগূঢ় কারণও অবশ্য বর্ত্তমান ছিল। আমার প্রিয় বন্ধু বেলার (রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা মধুরীলতা) সঙ্গে ওঁর মুখের বেশ একটুখানি সৌসাদৃশ্য ছিল, হয়ত সেই জন্যই ভিতরে ভিতরে ঐ চিত্র-কন্যাটি আমায় একটু বিশেষ ভাবেই আকৃষ্ট করে থাকবে। তারপর লীলা দেবীর সঙ্গে আমার বহুবার দেখা সাক্ষাৎ ঘটেছে। প্রথম দেখা হয় স্নেহাস্পদা প্রীতিলতা কাঞ্জিলালের বাড়ীতে। বেলারই মত মিষ্ট স্বর, আমার লেখা উপন্যাস সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করেন সে কথাও বলেন। সঙ্গীত সম্মীলনীতে আমারই লেখা “সাগরিকার" অভিনয় দেখতে গিয়ে এবং পরে আরও ঐ রকম কয়েক স্থানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। ওঁর ছবি দেখে দেখে আমার মনে ওর সুন্দর মূর্ত্তিটি যে মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল, তাই প্রথম দিনে দেখেই ওঁকে চিনতে আমার বাধেনি। পরে যেখানেই দেখেছি, সহস্রের মধ্যে ঐ দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। একটা কেমন যেন স্নেহ পড়ে গিয়েছিল। ছবি মানুষের কতটুকুই বা পরিচয়, মানুষ তার অনেকখানি উপরে, একথা সত্যি হ'লেও একটি বিষয়ে লীলা দেবীর ছবির সঙ্গে লীলা দেবীর বিশেষ একটা সাদৃশ্য বেশ দেখতে পাওয়া যেত, সেটা তাঁর চিত্রের মতই প্রশান্ত নিরবতা। কথা তিনি খুবই কম কইতেন, শুধু তাই নয়; চোখের দৃষ্টিতেও কেমন যেন একটা সুদুর নিরাসক্ত উদাসীনতা;—যা'তে করে তাঁকে খুব বেশী নিকটে টানবার ভরসা হয়না, ঈষৎ সম্ভ্রমের সঙ্গে নীরবে প্রতীক্ষা করতে হয়। অথচ আমি তাঁর থেকে যতটা দূরের মানুষ, কতটুকুই বা আমাদের দেখাশোনা, আশ্চর্য্য হই যে, সে হিসাবে আমি তাঁকে নিকটবর্তী করে নিয়েছিলুম। কোথায় যেন মনের গহন-গুহায় নিহিত একটা মানসিক সাদৃশ্য থাকে, কর্মবন্ধন থাকে, মানুষের অবচেতন মনের তলায় কি যে কখন চাপা পড়ে থাকে, সব সময় সেটা স্পষ্ট ক'রে বলা যায়না, নিজেই শুধু অনুভব করা চলে। প্রিয়তরের সাদৃশ্য এবং ওঁর ঐ নিস্পৃহ ঔদাস্য ঐ দুটো জিনিষে মিলে আমার তখনকার ভাবপ্রবণ মনকে হয়ত অতটাই উনি আকর্ষণ করে থাকবেন। ওঁর মধ্যে সংসার বহির্ভূত একটা ভাব-দ্যোতনা দেখতে পেয়েছিলাম। ভাব প্রবণদের মনের গঠনতো একটু সৃষ্টি ছাড়া হয়েই থাকে! এমনও হয়েছে, তাঁর হাসি এবং কথায় অকস্মাৎ আমার চির অপগতা প্রিয় বান্ধবীকে আমি যেন দেখতে পেয়েছি। তাই যেখানে দেখা হয়েছে, লীলা দেবীকে চোখ থেকে সরাতে পারিনি। তাঁকে শেষ দেখেছি নদীয়ার রাজবাটীতে। পূর্ণিমা দেবীর বিবাহের প্রতিভোজনে। প্রথম দেখেই চমকে উঠেছিলুম। নিরঞ্জনের পর দেবী প্রতিমার দিকে চাইলে মনের মধ্যে যে ভাব আসে, ঠিক সেই রকম মনোভাব নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলাম। সেই লীলাই বটে, অথচ সেই প্রথম দৃষ্ট ছবির মত, বিসর্জনের প্রতিমার মত, দেহে যেন ওঁর প্রাণ নেই! জীবনে সমস্ত পেয়েও যিনি জীবনে শান্তি পাননি, যেন সেই সমস্ত সুখ ও দুঃখ থেকে বিযুক্ত হয়ে তাঁর অন্তরাত্মা ভবভূতির সীতার মতই ছায়াময়ী রূপে মর্ত্ত্যধামে বিচরণ করছেন, কায়াময়ী লীলা যেন সে প্রতিমার মধ্যে নেই। সেই স্তব্ধ নীরব মূর্তিটীর পাশে ব্যথাজড় চিত্ত নিয়ে বহুক্ষণ নীরবে বসে রইলেম, সেদিনের আনন্দোৎসবে আর ভাল করে যোগ দিতে পারলেম না। কিছুকাল পরে যখন সংবাদ পত্রে “বিজয়াদশমীর’’ সংবাদ পেলেম খুব বেশ আশ্চর্য্য হইনি। সেই দিনই দেখেছিলেম বিসর্জন তাঁর হয়েই গেছে! নিরাসক্ততার চরমে পৌঁছে মানুষ বেশী দিন বাঁচতে পারেনা। একমাত্র সন্তান হারা জনক জননীর ব্যথা অন্তরে অনুভব করে বারে বারেই চোখ মুছেছিলেম। মনে মনে লীলাকে আশীর্বাদ করেছিলেম, ‘‘এই নব জীবনে তুমি চির শান্তির অধিকারিণী হয়ো’’।

 ধর্মতত্ত্বের মতই কর্মতত্ত্ব বড় সূক্ষ্ম, আমরা আজও তার হিসাব মিলাতে শিখিনি। তখন স্বপ্নেও জানতেম না যে আমার সেই গোপন আকর্ষণ আজ প্রত্যক্ষ হয়ে তাঁর জীবন স্মৃতির সঙ্গে আমার নামকে একত্র বিজড়িত করে আমাকেই তাঁর প্রথম স্মৃতি পূজা করাবে! লীলা দেবীর বাহ্যরূপই নয়; মধুর শান্ত স্বভাবই নয়; তাঁর অন্তরের সমুজ্জ্বল কবি-প্রতিভা, সাহিত্য সাধনার প্রতি একান্ত অনুরাগ, সকল দিক দিয়েই তাঁর জীবনটিকে নারী সুলভ সৌকুমার্যে মণ্ডিত করেছিল। এতটা দেবদত্ত ঐশ্বর্য্যের একত্র সমাবেশ প্রায় দেখা যায়না, অথচ আশ্চর্য্য এই যে, জগতে এ জিনিষের ও সমুচিত মূল্য দিতে মানুষ পেরে ওঠেনা! তাঁর “ধ্রুবা” ‘‘রূপহীনার রূপ’’ উপন্যাস দু’খানির মর্মকথা বড় করুণ ও হৃদয় স্পর্শী। পড়তে পড়তে ভাঙ্গা বুকের একটী অতি করুন কান্নার অস্ফূটগুঞ্জন শুনতে পাওয়া যায়। ধ্রুবার পরিণাম যেন আমাদের মনে সবিস্ময়ে এই প্রশ্ন জাগায়; এ কল্পনা না দূরদৃষ্টি? এমন একটি সৌন্দর্য্য সুষমামণ্ডিত ভাব বিকশিত সুন্দর জীবন যেন অকরুণ ভাগ্য দেবতার অনেকখানি হেলা ফেলায় অকালে নষ্ট হয়ে গেছে, একথা মনে হলে দুঃখ রোধ করা যায় না। ফুটন্ত পদ্মটিকে টেনে তুলে ছিঁড়ে ফেলা হলো, ভাল করে বিকশিত হতে দিলেন না, এই বলে অকরুণ বিধাতাকে নিন্দা করতে ইচ্ছা করে। কবি রজনী কান্তের এই বিলাপ বাণীটি কানে ভেসে আসে;—

“ফুটিতে পারিত গো ফুটিলনা সে,
নীরবে ঝরে গেল, অকালে মরে গেল,
প্রাণ ভরা আশা সমাধি পাশে।”

 উপন্যাসের মধ্যে এবং কবিতা পুস্তক ‘কিশলয়ে’ লেখিকার যে পরিচয় পাওয়া যায় সেইটাই তাঁর সুস্পষ্ট পরিচয় পত্র। জগতের ক্ষুদ্র সুখ দুঃখকে নাড়া চাড়া করতে করতে অবশেষে সহসাই যেন জগদতীতের পদপ্রান্তে স্থান গ্রহণ করতে পেরেছেন। যেমন “শিল্পীর’’ মডেল থেকে “প্রতীক্ষা কারিণী” এবং তার পরেই হঠাৎ “পূজারিণী” “উপাসিকায়’’ পরিণতা হয়েছিলেন!

“কেন তাড়াতাড়ি কাজ সারা আর—
নাই উদ্দাম প্রাণের ঢেউ,
মোর তরে আজ অধীর আবেগে—
পথ চেয়ে আর নাইত কেউ।’’
“নিভে যায় শোকানল কালের মায়ায়,
স্মৃতির আগুন কভু নে’ভেনা ত হায়!”

“প্রতীক্ষিতার” বুকভাঙ্গা বিলাপমর্ম্মর পার হয়ে এসে যেখানে আমরা শুনতে পেলেম

“গাঁথবনা আর আমার মালা, বাঁধবনা না আর প্রেমের গান,
ভরবনা না আর ফুলের ডালা, রাখবনা মান অভিমান।’’

যেখানে শুনি;—

‘‘সোনার নূপুর রতন কেয়ুর এ সব তোরা নে’রে নে’
ফুলের মালা তাবিজ বালা আধেক গাথা সেরে নে।’’

তখনি মনে পড়ল এই জিনিষটিই সেই সুশান্ত মুখে ফোটবার এই প্রতীক্ষিত হয়েছিল। তাঁর মুখের যে ভাবটি আমায় সত্য করে আকৃষ্ট করেছিল, সে শুধু তাঁর বাইরের রূপই নয়, সে বস্তুটি তাঁর এই নিস্পৃহভাবটুকু। তাঁরই কথায় বলি;—

“ত্যাগের মাঝে যে সুর বাজে, মধুর সে যে সুমধুর,
ভোগের ক্ষণে সেই মধুরী, তিক্ত বিরস বিহীন সুর।’’
“অবহেলায় আপন জনে যতই আমায় ছাড়ে,
ততই আমার তোমার দিকে আরো যে টান বাড়ে,’’
—এবং—“বিলাব আমারে বিলাব,
সুরভি অধীর অনিলের সম, দিক্‌দিগন্তে মিলাব।”

অথবা—

“রেখো নিপীড়ন নির্য্যাতনেও অটুট ধৈর্য্য তপস্বিনী,
হে ললনা! তব ললিত বিলাসে
ত্যজি হও দৃঢ় ওজস্বিনী।”

 এর আর একটু উপরের ভাবে তিনি বলেছেন:—

‘‘আমার যা’ কিছু রাখিনাই বাকি! ফুরায়ে দিয়েছি দানে,
বিলায়ে দিয়েছি ছড়ায়ে দিয়েছি হারায়েছি প্রাণে প্রাণে।”

ধাপে ধাপে সুরগ্রাম ক্রমশঃই চড়ে উঠ্‌ছিল। ত্যাগমন্ত্র দীক্ষিতা “শ্রমনীর”—অজস্র ভোগের মধ্যবর্ত্তিনী—উদাসিনীর মধ্যে একদা যেটা অস্পষ্ট ছায়াচ্ছন্ন ছিল, তারই ক্রমশঃ পরিস্ফুরণ হয়ে চলেছে। কার জীবন কিসের জন্য সৃষ্ট, কিসের মধ্যে দিয়ে কে’ জীবনের কোন পরিণতি প্রাপ্ত হবে, কে’ তা’ বলতে পারে? আমাদের চক্ষে সংসারের সুখটা যত বড়, ভারতের সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা তা’ স্বীকারই করেন না। তাঁদের মতে “নাল্পে সুখমস্তি।’’ তাঁদের চরম উপদেশ;—“আত্মানং বিদ্ধি।’’ আপনাকে জানো। আত্মার সাক্ষাৎকার তো সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে মেলে না। এই ক্ষুদ্র “লীলা পরিচয়’’ আমি তাঁর জীবন এবং কল্পনার মধ্য থেকে যে ভাবে গ্রহণ করতে পেয়েছি, সংক্ষেপে সেইটুকুই জানালাম। গভীর রহস্যময় একটী মানব-জীবনের সম্যক্‌ পরিচয় এত অল্পের মধ্যে দেওয়া যায় না। ক্ষুদ্র লীলা-সাহিত্যের একমাত্র প্রাণের কথাটি শুধু যে তাঁর সকল কল্পনার মধ্য থেকে ব্যক্ত হতে চেয়েছে সেই সকলের বড় কথাটি তাঁরই বাণী থেকে আমার শেষ কথা রূপে গ্রহণ করলেম। ভক্তের ভক্তি-সাধনার যে এখানেই চরম পরিণতি;—

“কি কাজ জানিয়া তার ঐশ্বর্য্য বিভব
শুধু আমি জানি তার, সে আমার সব।”

সাহিত্যে নারী: স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টি

শ্রীমতী অনুরূপা দেবী

 মানুষের জীবনকে প্রধানতঃ দু’টো ভাগে ভাগ করা যায়। একটা দৈবায়ত্ত, আর একটা তার নিজায়ত্ত। প্রথমটাতে সে অন্যান্য ইতর জীবের মতো প্রকৃতির অধীন, প্রবৃত্তির দাস, জন্মায় মরে, খায় ঘুমোয়, সুখে হাসে, দুঃখে কাঁদে। দ্বিতীয়টাতে সে প্রকৃতির নিয়ন্তা, প্রবৃত্তির প্রভু, বিজ্ঞানের সাহায্যে সিন্ধু-পর্বত দেশকালের ব্যবধান দূর করে, বহ্নি-বিদ্যুৎকে আজ্ঞাবহ করে, মরু, মারী, শীতাতপ এবং শত্রু জয় করে, আকাশে ওড়ে, পাতালে ঢোকে: দর্শনের সাহায্যে জীবাত্মা পরমাত্মার, ইহ-পরলোকের গভীর রহস্যের সন্ধান লাভ ক'রে, রোগ, রিপু, শোক, মালিন্যের ঊর্দ্ধে উঠে শান্তি লাভ এবং অনেকের মতে মুক্তি লাভ করে। সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীতের সাহায্যে বাস্তব জগতের সহস্র দুঃখদৈন্যের মধ্যে দেশকাল নিরপেক্ষ অবান্তর আনন্দলোক রচনা ক'রে, অপার্থিব সখৈশ্বর্য উপভোগ করে, নিঃসঙ্গ অবস্থায় সঙ্গী লাভ করে, অজ্ঞান অবস্থায় জ্ঞানদাতা গুরু লাভ করে, অতীতে ভবিষ্যতে স্বদেশে বিদেশে স্নেহ প্রীতির নিগূঢ় সম্বন্ধ স্থাপন করে। মানবসভ্যতার আদিযুগ থেকে মানুষে পশুতে এই পার্থক্য লক্ষিত হয়ে আসছে। পশু অল্পেই সন্তুষ্ট, মানুষ অল্পে সন্তুষ্ট নয়। প্রাচীন ভারতের ঋষি যে-দিন বলেছিলেন, “নাল্পে সুখমস্তি-ভূমৈর সুখং” সে-দিন পৃথিবীর সবদেশের সর্বমানবের অন্তরের কামনাই তাঁর কণ্ঠে বাণীরূপ গ্রহণ করেছিল। পশুপাখীর মতো শুধু খেয়ে ঘুমিয়ে মানুষ তৃপ্তি পায় না, বাঁচতে পারে না। আম-মাংসাসী আদিম আরণ্যকও নাচে গায়, গল্প বলে, ছবি আঁকে। নিজের সৃষ্ট যে-সব ঐশ্বর্যে মানুষ অন্যতম পশু হ’য়েও তার পশুত্বকে অতিক্রম করে দেবত্বের দিকে অগ্রসর হয়েছে, সাহিত্য তাদের মধ্যে উচ্চতম;—এক কথায় বলতে গেলে সাহিত্য মানবসভ্যতার মুকুটমণি। সাহিত্য বিভিন্ন জাতির অতীত সংস্কৃতির বাহন এবং ভবিষ্য সংস্কৃতির জনক।

 পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই সভ্যতার সর্বনিম্নস্তরে শিল্পের পরেই সাহিত্য দেখা দিয়েছে। ছড়া, বচন, গাথা, রূপকথা, ব্রতকথা, মন্ত্র প্রভৃতি আদিযুগের লোকসাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করলে আর একটা সত্য স্পষ্ট হ’য়ে ওঠে, এই সব গ্রাম-প্রাকৃত সাহিত্যের অধিকাংশই নারীর রচনা অর্থাৎ পৃথিবীর সকল দেশে আদিযুগে সাহিত্যের সূত্রপাত এবং ভিত্তি স্থাপন হয়েছে নারীর হাতে। মানব সভ্যতার উষাকালে বর্বরপুরুষ যেদিন বনে বনে শিকার অ’রে বেড়াত, শক্ত এবং হিংস্রজন্তুর আক্রমণভয়ে আত্মরক্ষার উদ্যোগে এবং আহার্য সংগ্রহের চেষ্টায় যে দিন তার অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হত, সেদিন গৃহকর্মরতা নারী ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে শিশুকে ঘুম পাড়াত, অতীতের বীরত্বগাথা গেয়ে মৃগয়া প্রত্যাগত স্বামীপুত্রের অবসর বিনোদন ক’রত, প্রিয়জনের কল্যাণ এবং অপ্রিয়জনের অকল্যাণকর কামনায় তুকতাক তন্ত্রমন্ত্র এবং তরু-প্রস্তর, দেবতা-অপদেদতার পূজামন্ত্র রচনা করত। বিভিন্ন দেশে পুরুষ নারীর প্রদর্শিত পথে চলে ক্রমে ক্রমে সাহিত্যক্ষেত্রে ভাষায় ও শিল্পনৈপুণ্যে এবং ভাবের গভীরতায় তাকে অতিক্রম করেছে, এ কথা আদৌ অস্বীকার করা যায় না, তবু সেই সঙ্গে এ কথাও স্মরণযোগ্য যে, নারীর দান সাহিত্যক্ষেত্রে উপেক্ষণীয় নয়। আজও অধিকাংশ দেশের লোকসাহিত্য, পৃথিবীর সাহিত্যের শতকরা নব্বই অংশ যার অন্তর্গত, তার রচনাগৌরব অধিকাংশক্ষেত্রেই নারীর প্রাপ্য। অভিজাত, সাহিত্যেও পদলালিত্য, ব্যঞ্জনা, অর্থগৌরব কোনোদিক দিয়েই নারীর রচনা পুরুষের চেয়ে খুব বেশী পিছিয়ে নেই, অতীতেও ছিল না। দেশ ভেদে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাভেদে নারীর সাহিত্যিক প্রতিভা বিভিন্ন যুগে প্রশংসিত অথবা অবজ্ঞাত হয়েছে, কথনও সম্যক স্ফুর্তি পেয়েছে, কখনও অবরুদ্ধ এবং অপ্রকাশিত থেকে গেছে। বিভিন্নদেশে পুরুষের স্বাধীনতার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারীর স্বাধীনতার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেছে, উদারতা অনুদারতা সমাজে বেড়েছে কমেছে, সংস্কৃতির মান উঠেছে নেমেছে। কোনোযুগের নারীর বহু রচনা সাহিত্যক্ষেত্রে অমর হ'য়ে আছে, আবার কোনো যুগের নারীর অধিকাংশ রচনা বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে গেছে। যুগভেদে একই দেশে নারী বেদমন্ত্র রচনা করেছে, অদ্বৈতবাদ প্রচার করেছে, আবার লেখাপড়া শিখলে নারী বিধবা হয়, এত বড় কুসংস্কারের কথা নিজেরাই প্রচার ও বিশ্বাস করেছে। আত্ম-প্রচারে কুণ্ঠা, অন্তঃপুরের অবরোধ, গৃহকর্মের অবসরাভাব এবং সামাজিক নানাবাধার জন্য বহু সুসাহিত্যিকা সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিভার উপযুক্ত পরিচয় রেখে যেতে পারেননি। পুরুষের পক্ষপাতিত্ব এবং নারীর সহজ সংস্কার দুই-ই অল্পাধিক পরিমাণে এ ক্ষেত্রে নারীকে বাধা দিয়েছে। তার কর্মক্ষেত্রের পরিধির ক্ষুদ্রতা মোটের উপর তার দৃষ্টিকে সঙ্কীর্ণ করেছে, তার চিন্তাশক্তিকে খর্বীকৃত করেছে, তাই পৃথিবীর মহাকাব্য রচয়িতাদের মধ্যে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মধ্যে নারীর স্থান হয়নি; কিন্তু তার প্রকৃত কারণ শক্তির অভাব, না সুযোগের অভাব, তা নিয়ে মতভেদ আছে, সে তর্কের মীমাংসা কোনোদিন হবে কি না সন্দেহ। কারণ যাই হোক কার্যক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই শ্রুতি-স্মৃতির যুগ থেকে মুদ্রাযন্ত্রের যুগপর্য্যন্ত নারীর সাহিত্যসৃষ্টি কোনোদিন বন্ধ হয়নি। কখনো অম্ভৃণ ঋষিকন্যা বাগদেবীর কণ্ঠে সে নিজেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রী ব'লে ঘোষণা করেছে, কখনো মৈত্রেয়ীর কণ্ঠে অমৃতত্বের পিপাসায় পার্থিব ঐশ্বর্যকে ধিক্কার দিয়েছে, কখনো বিদুলা, দ্রৌপদীর কণ্ঠে, দুর্গাবতী, চাঁদবিবি, সরলাদেবী, মাদাম চিয়াং কাইশেক, সরোজিনী নাইডুর কণ্ঠে পদাহত কাপুরুষকে রণ-হুঙ্কারে জাগিয়ে তুলে পৌরুষে উদ্দীপিত করেছে, কখনো শীলা, বিজ্জা, মারুলা, মোরিকা মিসেস ব্রাউনিং, জেন অষ্টেন, চন্দ্রাবতী এবং সেল্‌মা গ্রাৎসিয়া প্রমুখ বহু আধুনিক নারীর রচনায় মানুষের ছোটো খাটো সুখদুঃখ প্রণয়বিরহ আশানিরাশার মনোহর ছবি এঁকে গার্হস্থ্য জীবনের দুঃখকে সহনীয় সুখকে মোহনীয় এবং অবসরকে লোভনীয় করেছে। গৃহকর্মের দায়িত্ব একদিকে যেমন নারীর সাহিত্যসৃষ্টির বাধাস্বরূপ হয়েছে, তেমনি জীবিকা অর্জনের দুশ্চিন্তা এবং দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে মধ্যযুগে, এমন কি বর্তমান যুগেও বহু নারী সাহিত্যসৃষ্টির সুযোগ লাভ করেছেন এবং করছেন, এমন কি ধনী এবং মধ্যবিত্ত ঘরের বহু নারী পুরুষের চেয়ে সাহিত্যচর্চার সুযোগ এবং অবসর বেশী পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। অনতিকাল পূর্বেও সাহিত্যসৃষ্টিকে জীবিকা অর্জনের উপায়স্বরূপ গ্রহণ করা নারীর পক্ষে অসম্ভব ছিল, তাই একদিকে শাণিতভাষার নৈপুণ্যে যেমন নারী পুরুষের সমকক্ষতা লাভ করতে পারেননি, তেমনি অপরদিকে কৃত্রিমতা, চাটুবাদ প্রভৃতির অভাবে নারীর রচনা সরসতায়, তীক্ষ্ণতায় এবং মাধুর্যে পুরুষের রচনাকে অনেকক্ষেত্রে অতিক্রমও করেছে, ব্যবসাদারী বুদ্ধি তার রচনার সহজ সারল্যকে বিড়ম্বিত করেনি। যেখানেই এর ব্যতিক্রম হয়েছে, অর্থাৎ রাজসম্মান এবং অর্থ যেখানেই নারীর রচনাকে সম্মানিত করেছে, সেখানেই অবশ্যম্ভাবী দোষ এবং গুণ, ভাষানৈপুণ্য এবং ভাবের অসারল্য দেখা দিয়েছে, এ বিষয়ে অতীতে বর্তমানে কোনো প্রভেদ দেখা যায় না।

 পৃথিবীর নারী রচিত সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে বসে একটা কথা প্রথমেই আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে, বিভিন্নদেশের লোকসাহিত্যের অজ্ঞাতনাম্নী রচয়িত্রীদের পরিচয় আমরা কিছুই জানি না। যে-সব রচনা ইটে, পাথরে, প্যাপাইরাসে, চামড়া বা কাগজে লিখিত হ’বার সৌভাগ্য লাভ করেছিল, অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত সমাজে খ্যাতি লাভ করেছিল, তার অধিকাংশই ধর্মবিপ্লবে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিনষ্ট হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, সেই সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি বাদ দিয়ে যে ক’টি রচনা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে, তাই নিয়ে আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

 যারা সাহিত্যসৃষ্টি করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন ধর্মপ্রাণ সাধিকা, কেউ ছিলেন চিন্তাশীলা দার্শনিকা, কেউ ছিলেন রসজ্ঞা কবি, কেউ ছিলেন সিংহবীর্যা বীরনারী, কেউ ছিলেন সুপণ্ডিতা, কেউ ছিলেন অক্ষরজ্ঞানবিহীনা। তাঁদের রচনার উদ্দেশ্য বিভিন্ন। প্রকাশভঙ্গী বিভিন্ন; কেবল এক জায়গায় তাদের মিল আছে। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের বক্তব্যকে বাঙ্ময়ী মূর্ত্তি দিয়েছেন, তাঁদের বাণীকে সর্বমানবের উত্তরাধিকার রূপে রেখে গেছেন। তাঁদের কারো রচনা পাওয়া গেছে, কা'রো শুধু নাম পাওয়া গেছে। অন্যান্য দেশের অল্প-খ্যাত অনেকের নামই আমরা দিতে পারিনি, বিখ্যাত বিদেশিনীদেরও কারো কারো নাম এবং রচনার উল্লেখ হয় তো বাদ পড়ে গেছে। ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকের দৃষ্টি আকর্ষণ ক'রে পৃথিবীর সাহিত্যক্ষেত্রে নারীর দান সম্বন্ধে সম্যক আলোচনার পথ প্রশস্ত করাই আমার উদ্দেশ্য;—কোনো বিষয়েই শেষকথা বলবার অধিকার আমার নেই। যাঁরা ভবিষ্যতের রচয়িত্রী, তাঁদের অতীত সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা থাকা বিশেষ দরকার। দুর্ভাগ্যের বিষয় আজকের দিনে আমাদের দেশের অনেক নারীরই স্বদেশের অতীত সম্বন্ধে এবং সেই সঙ্গে অতীত নারীর স্থান এবং দান সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা নেই, এককথায় আত্মবিশ্বাস নেই। এই আত্মবিশ্বাসের অভাব আমাদের পরদোষানুসন্ধিৎসু করেছে, পরানুকরণপ্রিয় করেছে। দেশে এবং বিদেশে সাহিত্যের প্রয়োজন, সমাজের সঙ্গে সাহিত্যের সম্বন্ধ, সাহিত্যের উৎকর্ষ অপকর্ষের বিচার নিয়ে বহু তর্ক ইতিপূর্বে হ'য়ে গেছে। এ নিয়ে আমার নিজের মতও আমি ইতিপূর্বে বহুবার বলেছি। আমি সাহিত্যকে সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে ‘ জড়িত ব'লে মনে করি, সমাজকে আনন্দ দেওয়া এবং পথনির্দেশ করাই তার প্রধানতম কাজ ব'লে বিশ্বাস করি। কবিরা নিরঙ্কুশ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু কবিরা মানুষ এবং সামাজিক জীব একথাও অস্বীকার করা মূঢ়তা। যে কাব্য সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর, তা’ শ্রুতিমধুর হ'লেও কু-কাব্য। সাহিত্যে অধিকারীভেদ আছে, রুচিভেদ আছে, আঙ্গিকের ভেদ আছে, যুগভেদে দেশভেদে একই বই সুখপাঠ্য এবং অপাঠ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, কিন্তু সর্বদেশকালের সাহিত্যিক বিচারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের মর্যাদা যে সমস্ত গ্রন্থ লাভ করেছে, সেই সব গ্রন্থে সমসাময়িক ইতিহাস, আনন্দ ও শিক্ষার উৎস একাধারে সম্মিলিত হয়েছে। বিশেষ ক'রে যে নারী গুহাবাসী বনচারী আদিমানবকে লজ্জা নিবারণের জন্য আচ্ছাদন ব্যবহার করতে এবং হিংসা নিবারণের জন্য ফলমূল আহার করতে শিখিয়েছিল, এককথায় সংযম ও সভ্যতা শালীনতা শিখিয়ে যে পশুকে মানুষ করেছিল, সাহিত্য-সৃষ্টির সময়ে আজ তার প্রতিনিধি যদি অসংযমের পরিচয় দেয়, সমাজকে বিপথে পরিচালিত করে, তবে বুঝতে হবে, সে তার মাতৃ-মাতামহীদের বহু সহস্র বৎসরের সাধনার উত্তরাধিকার হারিয়েছে, সে শুধু সমাজদ্রোহী নয়, আত্মঘাতিনী। আধুনিক নারীসাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেরই মননশীলতার ও শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে পরানুকরণস্পৃহা এবং অক্ষমতার পরিচয়ও অল্প পাওয়া যায় না। সংযমের ক্ষমতা যাতে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের পথে বাধা সৃষ্টি না ক'রে, এইটুকু তাদের কাছে আমার নিবেদন; অক্ষমের এবং পরানুকরণকারীদের রচিত সাহিত্য উপেক্ষা করাই শ্রেয়। নারী যেখানে নিজের মহত্ত্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, সেখানে সকল দেশের পুরুষই তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। বিশেষ করে প্রাচীন ভারত নারীকে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশী সম্মান দিয়েছিল, তার বহু প্রমাণ আছে। নারীর নিন্দাও যেমন দু’চারজন করেছেন, তেমনি নারীর প্রশংসাও তার মধ্যে বর্ণনায় বহু পুরুষ ঋষি, কবি, বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন। নারীকে পুরুষই বড়ো করেছে, তার যোগ্যতার পরিচয় পেয়ে, পুরুষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে হিংসাবিদ্বেষ বাড়িয়ে নারী কোন দিন বড়ো হ’তে পারবে না, নিজের চরিত্রের মহত্ত্বে তাকে বড়ো হ’তে হবে, যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই তাকে স্বাধিকার লাভ করতে হবে। যে প্রকৃতপক্ষে যোগ্য, তাকে কোনো বিরুদ্ধ শক্তি কোনো দিন দাবিয়ে রাখতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।

 সাহিত্যের স্রষ্ট্রীরূপে একদল নারী যেমন খ্যাতি লাভ করেছেন, তেমনি সাহিত্যের সৃষ্ট চরিত্ররূপে আর এক দল নারী পৃথিবীর মানব মনের অমরাবতীতে সর্ব্বদেশের সর্ব্বমানবের আত্মীয়ারূপে সঙ্গিনীরূপে এবং আদর্শরূপে স্থানলাভ করেছেন। এঁদের কারো ঐতিহাসিক সত্তা ছিল, কারো ছিল না। সীতা, সাবিত্রী, দ্রৌপদী, দময়ন্তী সম্ভবতঃ একদিন জীবিত ছিলেন, কিন্তু রাধা, পদ্মিনী, আনাকারেনিনা, বিনোদিনী, নারায়ণী, কমলা, বাণী, চারু, সুরমা, সতী, বিন্দু, মনোরমা, দলনী, ভ্রমর, কুন্দ, উমা প্রভৃতি যে কোনোদিনই মানব দেহে বিরাজিতা ছিলেন না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই, তবু এঁদের অনেকে আমাদের বহু আত্মীয়ার চেয়েও পরমাত্মীয়া। আমাদের প্রপিতামহীর সম্বন্ধে শত বৎসর পূর্বের অনেক ঘটনাই আমরা জানি না, কিন্তু বহু সহস্রাব্দী পূর্বের সীতা, শৈবার জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি ঘটনা তাঁদের সমস্ত সুখ দুঃখের সঙ্গেই ব্যাস, বাল্মীকির কৃপায় আমরা পরিচিত। বর্ত্তমান যুগেও যে সব নারীচরিত্র সাহিত্যে মূর্তি পরিগ্রহ করছে সেগুলির মধ্যে কতকগুলি অন্ততঃ বহু শতাব্দী ধরে বহু মানব মানবীর আত্মীয়তা এবং সেই সঙ্গে অমরতা লাভ করবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সুতরাং এদের মধ্যে সাহিত্য স্রষ্ট্রীদের সঙ্গে এই সব কল্পলোক নিবাসিনী সাহিত্যে সৃষ্টিদের সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করাও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কাজের সুবিধার জন্য প্রথমে সাহিত্যিকা এবং সুপণ্ডিতা অর্থাৎ “সাহিত্য স্রষ্ট্রীদের” কথা পূর্বে ব’লে নিয়ে পরে সাহিত্যে নারীচরিত্র অর্থাৎ “সাহিত্যে-সৃষ্টি”দের সম্বন্ধে কিছু বলবো, ভূমিকা দীর্ঘ হ’ল এইবার কাজের কথা আরম্ভ করি।

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

 
 

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।