সাহিত্যে নারী: স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টি/২

উইকিসংকলন থেকে

সাহিত্যে নারী চরিত্র:

স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টি

(২)

সাহিত্যে নারী চরিত্র সৃষ্টি—

 সচরাচর উপমার ছলে সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। সাধারণ ভাবে এ কথা সত্য হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়। কোনো বিশেষ সময়ের সাহিত্যে সমসাময়িক সমাজের ছায়া পড়ে, এবং সেই সাহিত্য প’ড়ে আমরা সেই যুগের সমাজের যে ছবি দেখতে পাই তার তথ্যে অসম্পূর্ণতা থাকলেও ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশী স্পষ্ট ক’রে এবং সত্য ক’রে আমরা সেই গত যুগকে তার মধ্যে ফিরে পাই। অথচ সাহিত্যে যে সব সময়ে কেবল সমাজের প্রতিলিপি এবং অনুলিপিই আমরা পাই তাও নয়, সমাজের বাস্তব জীবনের বাইরে তার চিন্তাধারার, তার অবরুদ্ধ আশা-আকাক্ষার অব্যাহত প্রসার, আমাদের চোখে পড়ে। যা’ ঘটেনি কিন্তু ঘটা উচিত ছিল, তাহা, যা’ ঘটেছে তারই পাশাপাশি বসে যায়, অর্থাৎ সাহিত্যিকের কাছে আমরা অনেক সময়ে সমাজের অগ্রলিপি বা ভবিষ্যদ্বাণীও পাই।

 দর্পণের সঙ্গে তুলনা না দিয়ে সাহিত্যকে চন্দ্র এবং সমাজকে সূর্য ব’ললেই বোধ হয় উপমা সার্থক হয়। আমরা জানি, সূর্যের আলোই চাঁদের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে চাঁদের আলো হ’য়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে, তবু এও জানি, যে সে এক হয়েও এক নয়। অন্ধকারের সমুদ্রগর্ভে সমাজের সূর্য যখন ডুবে যায়, দৈন্যে, দ্বন্দ্বে, বিদ্বেষে, ক্লান্তিতে জীবন যখন অসহনীয় হ’য়ে ওঠে, তখন সাহিত্যের চন্দ্র সেই নিবিড় অন্ধকারকে তার স্নিগ্ধজ্যোতি দিয়ে সহনীয় এবং মনোরম ক’রে তোলে! অর্জুনের লক্ষ্যভেদে আমরা বরমাল্য লাভ করি, রামায়ণের সীতার ও মেঘদূতের যক্ষপত্নীর অশ্রুজলে আমাদের ব্যক্তিগত শোকাশ্রু ধুয়ে যায়। একদিকে সমাজের সূর্যের আলোয় আমরা তথ্যের জগৎকে আগাগোড়া সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাই, দৈনন্দিন জীবনের প্রতি প্রান্তের প্রতি ক্ষুদ্র বস্তুটি তার ভালো মন্দ, ঐশ্বর্য, দৈন্য এবং মালিন্য নিয়ে একসঙ্গে আমাদের চোখে পড়ে, সমাজের সূর্যালোক আমাদের কর্মক্ষেত্রে কঠিন সংগ্রামে প্রবৃত্ত হ’তে আহ্বান করে, অপরদিকে সাহিত্যের চন্দ্রালোক তার অপরূপ মায়াপ্লাবনে সেই তথ্যের জগতকে সৌন্দর্যে স্নান করিয়ে নিয়ে আসে,—তার সমস্ত বিকৃতি, বিরোধ, দৈন্যকে অস্পষ্ট ক’রে, আবৃত ক’রে তার অন্তর্নিহিত মহিমাকে এবং সৌন্দর্যকে স্ফুটতর ক’রে তোলে, এক অনির্ব্বচনীয় উপায়ে আমাদের মানবজীবনের গূঢ়তর সত্যের সম্মুখীন ক’রে দেয়। তার শীতল কৌমুদীধারায় আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়, আমাদের শ্রান্ত উদ্বিগ্ন চিত্ত শান্তি লাভ করে। তবে, পরিপূর্ণ দিবালোকেও চাঁদ সূর্যকে আবৃত ক’রে গ্রহণ ঘটাতে পারে এই যা’ তার দোষ! কুসাহিত্যিকের লেখা কল্পিত সহিত্য কু-চিত্র দিয়ে সমসাময়িক স্বদেশের এবং সজ্জন সমাজেরও মুখ কালো ক'রে দিতে পারে, শুধু আজকের জন্য নয়, চিরদিনের জন্যই তাকে কলঙ্কিত করতে পারে।

 বিভিন্ন দেশের সাহিত্যে যে সব নারী-চরিত্রগুলি আমরা দেখতে পাই, তার মধ্যে অধিকাংশই পুরুষের সৃষ্ট। কোথাও তাঁরা ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধি ও রুচি অনুযায়ী নূতন করে ঢেলে সেজেছেন, কোথাও যতদূর সম্ভব বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে চেষ্টা করেছেন। যে চরিত্রগুলি সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসুত সেগুলিতে সমসাময়িক সমাজ-চিত্র এবং লেখকের পছন্দ-অপছন্দ স্পষ্টই বোঝা যায়, কোনো চরিত্রে প্রথমটি কোনো চরিত্রে দ্বিতীয়টি বেশী ফুটেছে। বস্তুতান্ত্রিক লেখক যেখানে নির্মমভাবে তথ্য প্রকাশ করতে গিয়ে নারীর মনের আঁস্তাকুঁড় ঘেটেছেন, আদর্শবাদী লেখক হয়তো সেইখানেই সহৃদয় ভাবে সত্য সন্ধান করতে গিয়ে দেবমন্দিরের সন্ধান পেয়ে ধন্য হয়েছেন। এই দু'দলের মধ্যেই প্রতিভাশালী ব্যক্তি জন্মেছেন, তাঁদের প্রতিভার তারতম্য অনুসারে তাঁরা সমাজের হিত এবং অহিত দুইই করেছেন।

 সাহিত্যে নারী-চরিত্র সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা প্রথমেই দেখতে পাই অপ্রাকৃত এবং অতিপ্রাকৃত দেবী এবং অপদেবীর ভিড়। পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্যে যে সব কল্পলোকবাসিনীদের সন্ধান পাওয়া যায়, তাঁদের মধ্যে অনেকেই মানবী নন। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কয়েক জন নিঃসন্দেহ বাস্তবলোকচারিণী ঐতিহাসিক ব্যক্তি হ'লেও কবি কল্পনা তাঁদেরও ওপর অবাস্তব মহিমার রং চড়িয়ে তাদের দেবী এবং অপদেবীদের স্বগোত্র ক'রে ছেড়েছে। এ না হ'লে বোধ হয় তাঁরা সেযুগের ধর্ম্মসাহিত্যে পাংক্তেয় হ'তেন না। এই দেবীকৃত মানবীরা ছাড়া ঋষি এবং কবিদের মনঃকল্পিত দেবী-অপদেবীদের ঘিরেই বিভিন্ন দেশের প্রাচীন সাহিত্য গড়ে উঠেছিল। মানব-মনের শৈশবাবস্থায় সেদিনে নদী-পর্বত, বৃক্ষ-লতা, পশুপক্ষী থেকে আরম্ভ ক'রে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির মধ্যে মানুষ স্বতঃই দৈবীলীলা প্রতাক্ষ করত। ভাবুকের কল্পনায় এরা কেউ পুরুষ, কেউ বা নারীমূর্তি ধারণ করে মানুষের শুভাশুভ নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই সব দেবী বা অপদেবীদের চরিত্র পার্থিব নারী-চরিত্রের ছাঁচেই গড়া,— কেউ বা স্নেহময়ী, অন্নদা, জ্ঞানদা, সুখদা,—কেউ বা ভয়ঙ্করী, কোপন, নররক্তলোলুপা। কাউকে পূজা দেওয়া হ'ত ভক্তিতে, কাউকে পূজা দেওয়া হত ভয়ে। বিভিন্ন দেশের পুরাণের দেবী, দানবী, অপ্সরী, কিন্নরী, গন্ধর্বকন্যা, নাগকন্যা, বনদেবী, জলদেবী, ভূমিদেবী, যক্ষিণী, রাক্ষসী, পিশাচী, ডাকিনী থেকে আরম্ভ করে রূপকথার পরী, হুরী, পেত্নী, শাঁখচুন্নি পর্যন্ত বহু বিভিন্ন স্তরের বহু বিচিত্র রূপের শুভাশুভকারিণীর সন্ধান আমরা পৃথিবীর প্রাচীন লিখিত এবং অলিখিত অভিজাত এবং গণ সাহিত্যে দেখতে পাই। এদের মধ্যে কেউ বহুদর্শী ঋষির মানসী প্রতিমা, কেউ বা কুসংস্কারান্ধা গ্রাম্যবধূর কপোল-কল্পনা, স্রষ্টার বা স্ত্রীর জ্ঞানবুদ্ধি অনুসারে কেউ বা মহিমাময়ী রাজরাজেশ্বরী, কেউ বা গ্রাম্য কুরুচি ও কুনীতির কুৎসিত প্রতিমূর্তি। সাহিত্যের ইতিহাসে এঁদের স্থান নিতান্ত নগণ্য নয়, সেইজন্য এঁদের সম্বন্ধে দু’চার কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। প্রসঙ্গতঃ এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। ভারতীয় এবং বহির্ভারতীয় দেবদেবীদের মধ্যে একটা বড় প্রভেদ আমাদের প্রথমেই চোখে পড়ে, সেটা এই যে,—ভারতের বাইরের দেবদেবীদের ব্যক্তিত্ব যেমন স্পষ্ট, পৃথক্‌ এবং সুনিদিষ্ট, ভারতের দেবদেবীদের ব্যক্তিত্ব কোনোদিনই তেমন নয়। গ্রীসের দেবরাজ-পত্নী হীরা, যুদ্ধ ও জ্ঞানদেবী আথেনা, প্রেমদেবী আফ্রোদিতি, শিকারের দেবী আর্তিমিস্ প্রমুখের জীবনকাহিনী বিভিন্ন, পার্থক্য সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট। ভারতের বৈদিক দেবী ইড়া, ভারতী, সরস্বতী, অদিতি, বাকদেবী, দুর্গা, গায়ত্রী, সাবিত্রী প্রমুখের পার্থক্য সে রকম সুস্পষ্ট নয়। কোথাও তাঁরা বিভিন্ন ন'ন, মূলে তাঁরা একই চিন্ময়ী শক্তির নামান্তর মাত্র। ঐশী শক্তির একত্বে বিশ্বাস, বহুর মধ্যে একের প্রকাশকে স্বীকার ও পূজা নিবেদন ভারতীয় সাধনার বৈশিষ্ট্য; তাই ভারতীয় চিন্তাধারা এককে বহুরূপে ভাবতে কোথাও কোনো বাধা পায় না, এর মধ্যে কোনো অসঙ্গতি লক্ষ্য করে না। আপাত-বিরোধী বহুর মধ্যে এককে উপলব্ধি করা তার কাছে স্বভাবসিদ্ধ।

 ভারতবর্ষের বৈদিক সাহিত্যকে পৃথিবীর প্রাচীনতম সুলিখিত সাহিত্য বলা যেতে পারে। বেদের দেবতা মোট তেত্রিশ জন[১] ব’লে উল্লেখ থাকলেও যোগ করলে তাঁদের সংখ্যা অনেক বেশী হয়, কারণ একই দেবী কোথাও তিন নামে, কোথাও পাঁচ নামে বিভিন্ন রূপে পূজা পাচ্ছেন। দু'একটা নমুনা দিই—ইড়া দেবী মনুর কন্যা এবং পুরুরবার মা, ভরত বংশের আদি মাতা বা কুলদেবতা বলে তিনি ভারতী নাম নিলেন; এ দিকে পুণ্যতোয়া সরস্বতী নদী তার তীরবাসী ঋষিগণের কৃতজ্ঞ চিত্তের সমর্থন পেয়ে দেবীপর্যায়ে উন্নীত হয়ে ভারতীর সঙ্গে একার্থক হ'লেন। অম্ভৃণ-ঋষিকন্যা দেবীসূক্ত-রচয়িত্রী বা দেবীও এঁদের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেলেন! অর্থাৎ একটি কল্পলোক বাসিনী জ্ঞানরূপিণী বিদ্যাদায়িনী চিন্ময়ী দেবতার নাম এবং রূপ-গুণের খোরাক যুগিয়েছেন দু’জন ইতিহাস প্রসিদ্ধা মানবী এবং একটি জনপদকল্যাণী নদী! ঋষি-কবির কল্পনায় অনুরঞ্জিত হ'য়ে এই ইড়া বা সরস্বতী কোথাও সর্বব্যাপিনী সর্বেশ্বরী ব্রহ্মস্বরূপিণী ব'লে সম্পূজিতা হয়েছেন, কোথাও সোমরস চুরি করে এনে দেবলোককে অমরত্ব দান করায় অমরত্বকামী মানুষের প্রার্থনা তাঁর উদ্দেশ্যে প্রধাবিত হচ্ছে, ঘি মাখানো পুরোডাশের টুকরোয় তাঁকে আবাহন ক'রে ঋত্বিক্ এবং যজমানে মিলে ভক্ষণ করছেন। বৈদিক যুগের যজ্ঞকুণ্ড যাজ্ঞিকশ্রেষ্ঠ দক্ষের নাম থেকে ‘দক্ষতনয়া নাম নিলেন, ক্রমে তিনি যজ্ঞাগ্নির সঙ্গে অভিন্না বিবেচিত হয়ে ‘কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা' প্রভৃতি সাতটি জিভ বার করে হব্য-বাহিনী দুর্গারূপে বলি গ্রহণ করতে লাগলেন (গৃহ্য সংগ্রহ ১১।১৩।১৪)। দুর্গার অর্চনায় সামবেদের অগ্নিপূজার মন্ত্র: “ও ঁঅগ্ন! আয়াহি” প্রভৃতি আজও তার সাক্ষী দিচ্ছে। বৈদিক-রুদ্রের সঙ্গে অগ্নি ছিলেন অভিন্ন। বাজসনেয়ী সংহিতায় অম্বিকা রুদ্রের ভগ্নী, তৈত্তিরীয় আরণ্যকে উমা রুদ্রের স্ত্রী, আবার দুর্গা বৈরোচনী অর্থাৎ সূর্য বা অগ্নির স্ত্রী। ক্রমে দুর্গা দক্ষকন্যা এবং কেনোপনিষদের, হিমবৎকন্যা হৈমবতী উমা এক হয়ে গেলেন। অনার্য দেবতা ‘শিব’ আর্য দেবতা রুদ্রের সঙ্গে অভিন্ন হ'য়ে যাবার পর শবর পূজিতা বিন্ধ্যবাসিনী, বৌদ্ধদেবী চণ্ডী প্রমুখও সর্বশক্তি-সমন্বিতা শিবঘরণী দুর্গাদেবীর সঙ্গে ক্রমে একার্থিকা হয়ে গেছেন। শত শত গ্রাম্য অনার্য দেবতা এই ভাবে আর্য দেবতাদের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে গেছেন, তাঁদের বিভিন্ন জীবনেতিহাস এবং পূজাপদ্ধতি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আজও প্রায় অক্ষুণ্ণ আছে, কিন্তু তাঁদের একত্রে কেউ কখনও ভুলেও অবিশ্বাস করে না। বৈদিক যুগেই তাঁরা ঋষিদের দয়ায় এবং দূরদর্শিতায় আর্যসমাজে স্থান পেতে আরম্ভ করেন, পৌরাণিক যুগে ক্রমে বৈদিক দেবতাদের স্থানচ্যূত ক'রে অথবা তাঁদের নাম মাত্র অবশিষ্ট রেখে তাঁরা হিন্দুসমাজের অমরাবতীতে একচ্ছত্র অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছেন। যাই হোক, বৈদিকযুগের এই সব দেবীচরিত্রের মধ্যে আমরা তদানীন্তন নারী চরিত্রের ছবি স্পষ্টই দেখতে পাই, এ কথা অস্বীকার ক'রে লাভ নেই। ঋষি-কবিদের কাব্যপ্রেরণার মূল উৎস বাস্তব বা কাল্পনিক জড় প্রকৃতি বা জীবন্ত মানুষ যাঁরাই হৌন, তাঁদের সৃষ্ট চরিত্রগুলির রূপ-চিত্রণে মাধুর্য ও মহিমার যে অপরূপ সমন্বয় আমরা দেখতে পাই, তার তুলনা জগতে বিরল। তাদের মানসী প্রতিমাগুলি পৃথিবীর যে কোন দেশের যে কোন শ্রেষ্ঠ কবির বিরচিত রূপসৃষ্টির পাশে সগৌরবে স্থান পেতে পারে। দু'একটি উদাহরণ দেব। হোতা ইড়া দেবীকে ডেকে বলছেন: “অয়ি দেবি! তোমার রূপ সুন্দর, বর্ণ সুন্দর, বর্ষণশক্তি সুন্দর, তুমি এস,—আমাদের এই সুসজ্জিত যজ্ঞ-গৃহের অভিমুখে এস,—আমাদের ব্রতের প্রতি অনুকূল হ'য়ে আমাদের শীর্ষে কল্যাণ হস্ত অর্পণ করো। তুমি ইড়া, তুমি অদিতি, তুমি সরস্বতী, তুমি আনন্দময়ী, তুমি আনন্দদায়িনী, তুমি সুন্দরী,[২] আমরা তোমার পূজা করি, তুমি আমাদের প্রতি দাও;— আমরা তোমাকে ডাকছি, তুমি আমাদের ডেকে নাও,[৩] এই যজ্ঞে যে আশীর্বাদ চাইছি, তা সত্য হোক।[৪]... অয়ি ইড়ে! তুমি আমাদের প্রিয়া, তুমি বিঘ্নঘাতিনী, কল্যাণদায়িনী, তুমি আমাদের প্রার্থনা পূর্ণ করো।”

 উষা দেবীর আহবান-সঙ্গীতে গাম্ভীর্য এবং মাধুর্যের অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। কবি বর্ণনা করেছেন, কি ভাবে রাত্রিশেষে উষার আগমনে জীবজগৎ জেগে ওঠে। তাঁর প্রতি আগমনে জীব দিনে দিনে জরার দিকে এগিয়ে চলে, কিন্তু চিরযুবতী ঊষার সৌন্দর্যের বিন্দুমাত্র হানি হয় না। তাঁর রমণীয় কান্তি অন্ধকার দূর করে, তিনি জ্যোতি দিয়ে আকাশের দ্বার খুলে দেন। সুন্দরী যুবতীর মতো তিনি সূর্যের কাছে এসে দাঁড়ান। গৃহকর্ত্রী যেমন নিজে জেগে বাড়ীর সকলকে জাগিয়ে তোলেন, তেমনি উষা সকলের আগে জেগে জগতের সকলের চোখ থেকে ঘুমকে দূর করে দেন। তিনি একহাতে ফুলের কুঁড়ির পাপড়ি খুলে খুলে তাদের ফুটিয়ে তোলেন, আর এক হাতে মৌমাছিদের মধু খেতে আসবার জন্য ইঙ্গিতে আমন্ত্রণ জানান। কোথাও পৃথিবীর বন্দনায় ঋষি বলছেন: “আমি পৃথিবীর পুত্র,—এই ধরণী আমার মা!” কোথাও বর্ণনা করেছেন, “পৃথিবী এবং তাঁর দুহিতা দ্যুলোক ক্ষীরদায়িনী ধেনুর মতো অন্তরীক্ষে মিলিত হয়ে পরস্পরকে রসপান করাচ্ছেন।”[৫] বাদ্গেবীর রচিত দেবীসূক্তে যে মহিমময়ী মূর্তি প্রত্যক্ষ করি, যিনি রুদ্রের ধনু বিস্তার ক'রে যুদ্ধ করেন, উর্দ্ধলোকে পিতা দৌকে যিনি প্রসব করেছেন, সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে যার গর্ভ, বিশ্বভূবনে যিনি অনুপ্রবিষ্টা, দ্যুলোক স্পর্শ ক'রে যার দেহ উঠেছে, বিশ্বভুবন নির্মাণে প্রবৃত্ত হ'য়ে বায়ুর মত যিনি সর্বত্র প্রবহমান, ভূলোকে দ্যুলোকে সর্বত্র সর্বভূতে যিনি আপন মহিমায় বিরাজিতা, সেই মহাদেবীর মহাকল্পনা সুদূর অতীতের এক আর্যনারীর কীর্তি;—এ কথা স্মরণ করলে আজও আমরা গৌরব অনুভব না করে পারি না। ইড়া, ঊষা, ইন্দ্রাণী, সরমা, যমী, সাবিত্রী, সর্পরাজ্ঞী, সরণ্যু, প্রমুখ দেবী-অপদেবী ছাড়া বেদে মানবী-চরিত্রের বর্ণনাও বড় অল্প নেই। বেদরচয়িত্রী ব্রহ্মদিনীদের নাম আমরা অন্যত্র বলেছি, ঘোষা, অপালা, বিশ্ববারা, শাশ্বতী, লোপামুদ্রা, বাক্, শ্রদ্ধা, রোমশা প্রমুখ পার্থিব নারীর যে প্রত্যেকেই একদিন ভারতে সশরীরে বর্তমান ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁদের রচিত বেদমন্ত্রগুলি। তাঁদের বর্ণনায় কবির কৃতিত্ব অল্প। বৃহদ্দেবতায় উক্ত সাতাশ জন ব্রহ্মবাদিনীর মধ্যে দেব-যোনি, সর্প-যো-ি, কুকুর-যোনি-ধারিণীও আছেন, তবে তাঁদের কথাবার্তায় আচার-আচরণে মনুষ্যসুলভ দোষগুণই প্রকাশ পেয়েছে, এমন কি অনেক ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে হীনতাও প্রকটিত হয়েছে। বেদের যুগে যে সব কাহিনী প্রচলিত ছিল, তাদের মধ্যে সত্যের সঙ্গে কল্পনা এমনভাবে মিশেছে যে, ওর মধ্যে অনেকগুলি চরিত্র বাস্তব না কাল্পনিক তা’ আজ জোর ক'রে বলা শক্ত। যেমন কদ্রূ-সুপর্ণীর বিবাদের গল্পে আমরা দেখি, পরাজিতা সুপর্ণীকে কদ্রূ এই শর্তে দাসীত্ব থেকে মুক্তি দেবেন যে, তার সন্তান তৃতীয় দ্যুলোক থেকে সোম নিয়ে আসবে। সুপর্ণীর কন্যা গায়ত্রী পক্ষীরূপে গিয়ে সোম আনলে, কৃশানু গন্ধর্বের বাণে ক্ষতবিক্ষত হ'য়েও ছাড়লেন না। তার্ক্ষ্য পক্ষী তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন। অন্যত্র দেখি গন্ধর্ব বিশ্বাবসু গায়ত্রীকে পথে আটকালেন, তখন সরস্বতী স্বয়ং গন্ধর্বদের ছলনা ক'রে সোম নিয়ে এলেন। পরবর্তী যুগে সুপর্ণী বিনতা, সোম অমৃত এবং তার্ক্ষ্য ও গায়ত্রী মিলে ‘গরুঢ়’ হয়েছেন, বলা বাহুল্য। শতপথব্রাহ্মণে উর্বশী পুরূরবার গল্প আমরা প্রথম পাই, মহাভারতের এবং কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশীর’ নায়ক-নায়িকার মূল রূপ এইখানেই পাওয়া যায়। অতীত ভারতের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ভরতের মাতা শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্মন্তের প্রণয়কাহিনীও শতপথব্রাহ্মণে মেলে। দুষ্মন্তের মূল চরিত্র সত্যই ঘৃণ্য, অবোধ তাপস বালিকার সর্বনাশ সাধন ক'রে রাজ্যে ফিরে এসে তিনি যে কেবল সজ্ঞানে সভামধ্যে তা’ অস্বীকার করেছিলেন তাই নয়, সতী নারীকে অপমান করতেও কুণ্ঠিত হ'ননি। বৈদিক এবং পৌরাণিক শকুন্তলা ও কালিদাসের শকুন্তলার মতো শুধু মাধুর্যর প্রতিমূর্তি ‘ললিতলবঙ্গলতা’ জাতীয় নারী ছিলেন না, সভামধ্যে দৃপ্তস্বরে রাজাকে ধিক্কার দিয়ে তিনি স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। অবশ্য অভিজ্ঞান হারানোর কৈফিয়ৎ দিয়ে কালিদাস এঁদের দুজনের চরিত্রকেই যে সুন্দরতর করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। কুকু বমাতা সরমা ইন্দ্রের দূতী হ'য়ে ‘পনিদের কাছ থেকে গরু আদায় করতে গেছেন, সূর্যকন্যা সূর্যার জন্য নাসত্য বা অশ্বিনীকুমারেরা দেবতাদের সঙ্গে বাজি রেখে সূর্য পর্যন্ত রথ ছোটাচ্ছেন, অর্চনানা ঋষির ছেলে শ্বাবাশ্ব যজ্ঞ করতে গিয়ে রথবীতি রাজার মেয়েকে দেখে প্রেমে পড়েছেন এবং সন্ন্যাসী হ'য়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মুদগল ঋষির গোধন শত্রুতে হরণ করতে এসেছে দেখে মুদগলপত্নী ইন্দ্রসেনা রথে চড়ে তাদের, আক্রমণ করে পরাজিত করছেন, লেখরাজপত্নী বিশপলার পা যুদ্ধক্ষেত্রে পাখীর পালকের মতো শক্রর অস্ত্রাঘাতে খসে যাচ্ছে, বিবাহরাত্রে ত্বষ্টার কন্যা সরণ্যু বিবাহসভা থেকে পালিয়েছেন, তার বদলে নকল ‘কন্যা’ দান ক'রে সুর্যকে ভোলানো হ'চ্ছে, এই রকম কতই না বিচিত্র চিত্র বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায়। ঐ সবের মধ্যে শর্যতি রাজার মেয়ে সুকন্যার বিয়ের গল্পটি উল্লেখযোগ্য। আদরিণী রাজকন্যা তাঁর পিতার সঙ্গে মৃগয়ায় গেছেন, এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে এক বল্মীকস্তূপে লতাগুল্মের ফাঁকে দুটি চকচকে জিনিষ দেখে কৌতূহল বশে কাঠি দিয়ে খোঁচা মারলেন। ধ্যানস্থ চ্যবন ধ্যান ভঙ্গে সুকন্যাকে দেখছিলেন, তিনি অন্ধ হলেন। অনুতপ্তা রাজকন্যা অজ্ঞানকৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ সেই অন্ধ বৃদ্ধ বনবাসীকে বিয়ে করে বনবাসিনী হ'য়ে রইলেন। অবশেষে অশ্বিদ্বয়ের পূজা করে তিনি স্বামীর দৃষ্টিশক্তি এবং যৌবন ফিরিয়ে এনেছিলেন। পরমরূপবান্ অশ্বিনীকুমারেরা তাঁকে পরীক্ষা করবার জন্য প্রলোভন দেখিয়েছিলেন, তাতে কালিদাসের উমার মতোই মহীয়সী সতী নারী ঘৃণাভরে তাঁদের দূর হয়ে যেতে বলেন, তাঁর অন্ধ কুরূপ বৃদ্ধ স্বামীর চেয়ে জগতে তাঁর কাছে কাম্য কেউ নেই, এই কথা দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করেন। বৈদিক ও পৌরাণিক যুগের প্রথম দিকে এইরকম অনেকগুলি মহীয়সী নারী-চরিত্র আমরা দেখতে পাই। একদিকে কুষ্ঠরোগাক্রান্তা ঋষিকন্যার রোগমুক্তির জন্য এবং স্বামীলাভের জন্য আকুল প্রার্থনা, অপরের বিয়ে দেখে দেখে ধৈর্যহীনা অবিবাহিতা নারীর রূপযৌবন-সম্পন্ন স্বামীর জন্য দেবারাধনা, ইন্দ্রপত্নীয় সপক্ষীবিদ্বেষ এবং দাম্পত্যরহস্য জ্ঞানের গর্ব, তুকতাক, ছলনা, বশীকরণ, স্বার্থের জন্য, বিত্তের জন্য, হানাহানি এবং দেবকৃপালাভের প্রচেষ্টা, আর একদিকে রাজকন্যাদের কোথায়ও পিতৃকল্যাণ কামনায়, কোথাও আবার স্বেচ্ছায় নির্ধন বনবাসী তপস্বীদের বরণ করে চির-দারিদ্র্য ব্রত গ্রহণ, পতির জন্য পত্নীর অপূর্ব আত্মত্যাগ এবং সুদীর্ঘ সাধনা পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যকন্যা সূর্যার রচিত অনেকগুলি বৈদিক মন্ত্র আজও হিন্দুরা বিবাহের সময় ব্যবহার করেন, তার মধ্যে সে যুগের বধূর সম্মান ও সেদিনের সমাজের ছবি আমরা সুস্পষ্ট রূপেই সুব্যক্ত দেখতে পাই। ঋগ্বেদের ঋষি নববধূকে আশীর্বাদ করে বলছেন: “তুমি শ্বশুরের কাছে সম্রাজ্ঞী হও, শাশুড়ীর কাছে সম্রাজ্ঞী হও, ননদ দেবর সকলের কাছে সম্রাজ্ঞী হও।[৬] সংসারের কর্ত্রী হ'য়ে তুমি সংসারে প্রবেশ করে।[৭] এই সংসারকে পরিচালনা করবার জন্য সর্বদা সতর্ক থেকো[৮] সুমঙ্গলী নববধূর জন্য সকলের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে তার সৌভাগ্য কামনা করা হয়েছে, তাঁকে আশীর্বাদ করা হয়েছে;—“ইন্দ্রাণীর মতো নিত্য শোভন বোধনে প্রবুদ্ধ হ’য়ে জ্যোতির্ভূষিতা ঊষার সঙ্গে তুমি নিত্য প্রতি-জাগরিতা থেকো।[৯] সিন্ধু যেমন দাক্ষিণ্যগুণে নদীদের সাম্রাজ্য পেয়েছে, তুমিও তেমনি আপন মহত্ত্ব ও দাক্ষিণ্যগুণে পতিগৃহে সম্রাজ্ঞীর পদ লাভ কোরো।[১০] নারীর এই “সম্রাজ্ঞী-রূপ” সেদিন কেবল গৃহমধ্যে আবদ্ধ ছিল না, ঘরে বাইরে পুরুষকেও মহত্ত্বে বীরত্বে প্রেরণা দিয়ে ভারতের পুরুষকে জগতের শীর্ষস্থানীয় করে তুলেছিল। ঋষিপত্নীরা শুধু বেদরচনা এবং অধ্যাপনাই করতেন না, প্রয়োজন হলে রথারূঢ়া হ'য়ে সৈন্য পরিচালনা করে “সহস্র-জয়িনী” হতেন। শত্রুর অস্ত্রে বীর নারীর পা উড়ে গেলে, দেবতারা তাঁকে লোহার পা গড়িয়ে দিয়েছিলেন। উপনয়ন, ব্রহ্মচর্য পালন প্রভৃতি সকল নারীর জন্য সেদিন বিহিত ছিল, তবু যাঁর যেদিকে সামর্থ্য ছিল তাঁর কোথাও কোনো বিষয়ে বাধা ছিল না। ভালোমন্দের মিশ্রণে বৈদিকযুগের চরিত্রগুলির সঙ্গে আধুনিক ভারতের নারী-চরিত্রের খুব বেশী অমিল নেই। সপত্নীবিদ্বেষিণী কদ্রূ, স্বামীপরিত্যাগিনী সূর্যপত্নী সরণ্যুর মতো মেয়েও সেযুগে একান্ত দুর্লভ ছিল না।

 বেদের পরে স্মৃতির যুগে এবং রামায়ণ-মহাভারতের যুগে আমরা যেসব নারী-চরিত্রের পরিচয় পাই, তার মধ্যে সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, শৈব্যা, চিন্তা, বিদুলা, দ্রৌপদী, কুন্তী, গান্ধারী প্রমুখ রাজকন্যা রাজবধূদের এবং সুলভা, মৈত্রেয়ী, গার্গী, অরুন্ধতী, অনসূয়া, লোপামুদ্রা প্রমুখ ব্রহ্মবাদিনী বা ঋষিপত্নীদের আমরা সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র বলেই মনে করি। পাণ্ডিত্যে, তেজস্বিতায়, মহত্ত্বে, ত্যাগে, বীর্যে ভারতীয় পুরাণের এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কেরা পৃথিবীর যে কোনো দেশের সাহিত্যে নারীর আদর্শ বলে গৃহীত হতে পারেন। তবে আমাদের বিশ্বাস এই চরিত্রগুলি বাস্তব আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে আছে বলেই এঁদের সৃষ্টির সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ব্যাস-বাল্মীকির নয়! কবিরা তাঁদের স্রষ্টা নয়, প্রচারক মাত্র, তাঁদের যশোগাথাকে ছন্দোবদ্ধ করে স্থায়িত্ব দিয়ে তাঁরা নিজেদের গুণগ্রহিতার পরিচয় দিয়ে ধন্য হয়েছেন মাত্র।

 ভারতবর্ষের বাইরে মিশর, ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশের সভ্যতাকে ভারতের বৈদিক সভ্যতার সমসাময়িক ব'লে অনুমান করলে খুব অসঙ্গত হবে না। ঐসব দেশের প্রাচীন সাহিত্যে রাজনৈতিক চিঠি-পত্র, অনুশাসন, দিগ্বিজয়ের কাহিনী প্রভৃতির বাইরে আমরা যে পৌরাণিক কাহিনী এবং রূপকথাগুলি পাই, তার মধ্যেও প্রথমতঃ দেবী এবং অপদেবীদের প্রাধান্যই দেখতে পাওয়া যায়। এঁদের পর দেবীকৃত মানবীদের স্থান। মিশরে আকাশ দেবী ‘ন্যুট্’ পৃথিবীদেবের ঔরসে চারটি সন্তানের জন্ম দেন, তার মধ্যে তার কন্যা ‘আইসিস’ স্বামী ওসিরিস কনিষ্ঠ ভ্রাতা সেটের হস্তে নিহত হলে, মন্ত্রপ্রভাবে তাঁকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং পুত্র হোরাসকে স্বামী হন্তাকে বিনাশ করতে প্ররোচিত করেন। এই আইসিস মিশর দেশের মহাশক্তির প্রতীক। আইসিস তাঁর ভাই ওসিরিসকে বিয়ে ক'রে পৃথিবী শাসন করেছিলেন, ব'লে প্রথিত আছে। ওসিরিস তাঁর ভাই সেটের হাতে নিহত হ'লে, আইসিস মন্ত্রপ্রভাবে স্বামীকে পুনর্জীবন দান ক'রে পাতালপুরীর রাজা করে দেন, তারপর গোপনে পুত্র ‘হোরাসকে প্রসব এবং পালন ক'রে উপযুক্ত বয়সে তাঁকে স্বামীহন্তা সেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠান। ‘হোরাস’ সেটকে পরাজিত করে পৃথিবীর সাম্রাজ্য কেড়ে নিলেন, সেট দেবসভায় তার জন্ম সম্বন্ধে সন্দেহ . প্রকাশ করেও কিছু করতে পারলেন না। হোরাস এবং ওসিরিসের সঙ্গে ‘আইসিস্’ অতীতে যে কেবল মিশরে এবং গ্রীস, রোম ও পূর্ব এশিয়ায় পূজা পেয়েছেন, তাই নয়, আজও বিভিন্নরূপে পৃথিবীর দেশে দেশে পূজা পাচ্ছেন। পণ্ডিতেরা বলেন, যে যীশুখৃষ্ট জীবিতকালে তার গর্ভধারিণী মায়ের চেয়ে ধর্মবন্ধুদের বেশী আপন জন বলে স্পষ্টবাক্যে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর সেই অনাদৃতা মা মেরী যে আজ ‘স্বর্গের রাণী’, ‘ঈশ্বরজননী’ প্রভৃতি নাম নিয়ে সহস্র সহস্র খৃষ্টীয় ধর্মমন্দিরে ভক্ত ক্যাথলিকের পূজা-অর্ঘ্য লাভ করছেন, এ সেই আইসিস দেবীর দয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি তাঁর পিতৃ-পরিচয়হীন পুত্র হোরাসকে নিয়ে খৃষ্ট এবং খৃষ্টমাতারূপে আজও অর্ধ-পৃথিবীর হৃদয়-সিংহাসনে অটলভাবে বিরাজ করছেন। আইসিস্ ছাড়া ‘হ্যাথর’, ‘নিট' সর্পদেবী ‘বুটো’, শকুনি দেবী ‘নথবেট’ প্রভৃতি বহু পশু এবং পক্ষী প্রতীক দেবী সেদিন মিশরবাসীর কল্পনা থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন। সম্রাটরা তাঁদের জন্য আকাশচুম্বী মন্দির তুলেছিলেন, সেই সব মন্দিরে বহু নারী-পুরোহিতা এবং দেবদাসী সেদিনে তাঁদের চিত্তবিনোদনের এবং পূজার জন্য দিবারাত্রি পরিশ্রম করতেন। দেবদেবীদের পর ছিল দেবীকৃত মানবীদের স্থান। সম্রাজ্ঞী হাটসেপসুট বা হাতাশু, নেগরতিতি, ক্লিওপেট্রা প্রমুখ জীবিতকালেই প্রজাদের কাছে দেবত্ব অর্জন চেষ্টা করেছিলেন। এরা প্রত্যেকেই ভিত্তিচিত্রে নিজেদের কিছু না কিছু কাহিনী লিখে রেখে গেছেন, তবে ঐ সব নারীদের কারো কারো পার্থিব দেহ পর্যন্ত আজকের দিনে আমরা পাচ্ছি, সুতরাং তাঁদের সাহিত্যের সৃষ্টি বলে ধরা চলে না। এঁদের বাদ দিলে যেসব পার্থিব নারীর সন্ধান পাওয়া যায়, তাঁরা অনেকেই রূপকথার নায়িকা। সিনুহির ‘ভ্রমণবৃত্তান্তে’ ‘হতভাগ্য রাজপুত্রের নাহরিন রাজকন্যা লাভে'র গল্পে আরও অনেকের মধ্যে মাঝে মাঝে কবিকল্পনার অপরূপ সৃষ্টি দেখতে পাওয়া যায়।

 এই সব লিখিত সাহিত্য ছাড়া শিল্প-সাহিত্য সেদিনের মিশর নারীকে আমাদের কাছে সুপরিচিত করেছে, তাদের জীবনযাত্রার সহস্র উপকরণ, ভিত্তিচিত্রে, ভাস্কর্যে, ক্রীড়াপুত্তলিকায় তাঁদের বিচিত্র ভঙ্গীতে বহু সহস্র বৎসরের পুরাতনী নারীকে আমাদের আত্মীয় করে তুলেছে। চিত্রলিপির অনুশাসনে আজও আমরা সেদিনের নারীর সম্মানের,—মাতার সম্মানের আভাস পাচ্ছি;— “মায়ের আহার বিহার সম্বন্ধে যত্ন নিয়ো। ছোটোবেলায় মা তোমাকে সযত্নে মানুষ করেছেন, তুমিও তেমনি সযত্নে তাঁকে প্রতিপালন করবে। তিনি দশমাস তোমায় গর্ভে ধারণ করেছেন, তিন বৎসর স্তন্যসুধাপান করিয়েছেন, সে কথা ভুলো না। যৌবনে যখন সংসারী হবে, নিজে যখন পুত্রকন্যার পিতা হবে তখনও নিজের শৈশবের কথা মনে রেখো। মাতার প্রতি শ্রদ্ধাবান হওয়া প্রত্যেক সন্তানেরই কর্তব্য।”

 মিশরের পরেই ব্যাবিলন আসিরিয়ার স্থান। ব্যাবিলনে এক সময়ে অরুরু, ইথার প্রমুখ দেবীর পূজার বহুল প্রচলন ছিল। ঐ দেশে ‘গিলগামেস’ নামক মহাকাব্য রচিত হয়; তা'তে দেবী ইস্থারের কোপে পড়ে ‘ইরেক’ রাজ্যের রাজা গিলগামেশের যে দুর্গতি হয় তারই কাহিনী লিখিত আছে। দেবী “ইস্থার” সুপুরুষ গিলগামেসকে দেখে প্রেমে পড়েছিলেন, কিন্তু গিলগামেসের কাছে তার প্রার্থনা নিস্ফল হওয়ায় দেবীর শাপে গিলগামেস রূপযৌবন হারিয়ে পথের ফকির হলেন। শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের রাণী “সবিতু” দেবীর দয়ায় শান্তিদ্বীপে গিয়ে পূর্বপুরুষ-প্রদত্ত মন্ত্রপূত অন্নাহার করে গিলগামেস রূপযৌবন ফিরে পেলেন এবং দেশে ফিরে দেবীকে পূজা-অর্চনায় সন্তুষ্ট করে সুখে স্বচ্ছন্দে রাজত্ব করতে লাগলেন। ‘ইস্থারে'র প্রণয়-পাত্রদের অনেককেই অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়েছিল, এই খামখেয়ালী কোপনা দেবীটিকে তুষ্ট করবার জন্য সেদিন অনেক ছন্দোবদ্ধ স্তবের উদ্ভব হয়েছিল, যার মধ্যে চাটুবাদের সঙ্গে সঙ্গে কবিত্বের অভাব নেই।

 এর পর আসে গ্রীকসাহিত্যের কথা। ট্রয়যুদ্ধের অনেক পরে— আনুমানিক আটাশ শ’বৎসরের আগে মহাকবি হোমার তাঁর অমর কাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসিউস’ রচনা করেন। তার অনেক পূর্বেই গ্রীসের কল্পনারাজ্যে বহু দেবী দানবী বাসা বেঁধেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দেবরাজপত্নী ‘হীরা' প্রণয়দেবী ‘আফ্রোদিতে’, জ্ঞান এবং যুদ্ধের দেবী ‘আথেনা’ মৃগয়ার দেবী ‘আর্তিমিস’, ‘ভূমিদেবী ডিমিটার’, ঊষার দেবী ‘অরোরা' এবং গার্হপত্য অগ্নির দেবী ‘হেষ্টিয়া'। ‘হীরা’ চরিত্রহীন দেবরাজ 'জিউসে'র সদা-সন্দিগ্ধ-চিত্তা প্রতিহিংসাপরায়ণা পত্নী, জিউস যে সব দেবী এবং মানবীর সঙ্গে প্রেমে পড়েন, হীরা তাদের সঙ্গে ক্ষমাহীন সংগ্রাম ঘোষণা করেন। জিউস রাজহংসরূপে স্পার্টার রাজকন্যা লিভার সঙ্গে প্রণয় করেছিলেন, তাঁর শিশু পুত্র ‘হিয়াক্লিস'কে হত্যা করবার জন্য হীরা অজগর পাঠিয়েছিলেন গাভীরূপিণী ‘ইয়োকে’ অস্থির ক'রে দেশ দেশান্তরে ঘুরিয়েছিলেন, অ্যাপোলো এবং আর্তিমিসের মা ‘লাটোনা’ হীরার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষে ভেলস্ দ্বীপে আশ্রয় পান। জিউস্ অন্য দেবীদের সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হ'লে ‘ইকো' নাম্নী এক ছলনাময়ী বনদেবী হীরাকে ভুলিয়ে রাখতেন; হীরা তাঁর ষড়যন্ত্র ধরতে পেরে তার বাকশক্তি হরণ করলেন, কেবল অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করবার শক্তি রইল তাঁর। ‘নার্সিসাসে'র নিস্ফল প্রেমে শেষে এই ইকোর তনুক্ষয় হল, অতনু প্রতিধ্বনিরূপেই তিনি রয়ে গেলেন জগতে। হীরা, আফ্রোদিতে প্রমুখের মধ্যে সোনার আপেল নিয়ে ঝগড়া হ’ল, কথা হল যিনি শ্রেষ্ঠা সুন্দরী তিনিই আপেলটী পাবেন। ইলিয়াসের রাজপুত্র প্যারিস আফ্রোদিতের পক্ষে রায় দিয়ে তাঁর কৃপায় মেলিনাস পত্নী অপূর্ব সুন্দরী হেলেনের প্রণয় লাভ করলেন ঘৃণ্য উপায়ে, সঙ্গে সঙ্গে হীরার কোপে তাঁর স্বদেশ ইলিয়াসের সর্বনাশ সাধিত হ’ল। এই হীরার চরিত্রও তার স্বামীর চেয়ে খুব ভাল ছিল না। তাঁকে ইক্সিয়নের সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত দেখে দেবরাজ ছলনা করে তার অনুরূপ মায়ামুর্তি ইক্সিয়নের কাছে পাঠান, সেই মায়ারূপিণীর গর্ভে সেণ্টারদের জন্ম হ'লে দেবরাজ ইক্সিয়নকে অনন্তকালের জন্য নরকের ঘূর্ণমান বহ্নিচক্রে বেঁধে দেন। দেবতাদের সঙ্গে মানব-মানবীদের প্রেম তখনকার নিত্য ঘটনা ছিল, এ বিষয়ে ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে গ্রীকপুরাণের বিশেষ প্রভেদ নেই। বহুদিনের সংসর্গের ফলে ভারতীয় পুরাণে গ্রীকপুরাণের কুৎসিততর দেব-চরিত্রের ছাপ পড়াও অসম্ভব নয়। তবে সুখের বিষয় দেব-চরিত্রকে পুরাণকাররা জননীমূর্তিতেই বরাবর ঊর্দ্ধে অবস্থিতা রেখেছেন। ইন্দ্রের গৌতমরূপে অহল্যাগমন জিউসের ‘ইলেট্রিয়ন’ বেশে ‘অ্যাল্কমিনি’ গমনের রূপান্তর হওয়া অসম্ভব নহে। ‘ভানাইর’ দেব-যোনিজ পুত্র মাতামহকে হত্যা করবে এই ভবিষ্যদ্বাণীতে বিচলিত হয়ে আর্গসরাজ ‘আক্রিসিউস্’ কন্যাকে দুর্গে বন্দিনী ক'রে রাখলেন, সেখানে সে যখন ‘পার্সিউস'কে প্রসব ক'রল, তখন মাতা-পুত্রকে সিন্দুকে ভরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হ'ল। দৈবক্রমে বহু বিপদ উত্তীর্ণ হ'য়ে পার্সিউস মাতামহকে হত্যা করলেন। এর সঙ্গে ভারতবর্ষের, শ্রীকৃষ্ণ কর্ত্তৃক মাতুল কংসের হত্যার চৌচাপটে মিল দেখা যায়। সুপুরুষ ‘এণ্ডিমিয়ন’কে তার অজ্ঞাতসারে চুম্বন করবার জন্য তাকে পর্বত-সানুদেশে ঘুম পাড়িয়ে চন্দ্রদেবী সেলিনের প্রেমনিবেদন, প্রণয়দেবী আফ্রোদিতের মানুষ আডোনিসের কাছে ও আদ্বিসিসের কাছে আত্মনিবেদন, পাতালপুবীর রাজা প্লুটো কর্ত্তৃক পার্সিফোনি হরণ, ক্রীতদাস মহাবীর হিরাক্লিসের কাছে রাণী ও স্কার্লির প্রণয় জ্ঞাপন, ইলিয়াম রাজকুমারী কাসাণ্ড্রাকে কামনা ক'রে না পেয়ে অ্যাপোলোর অভিশাপ, আরিযাডনির কাছে ব্যাকাসের প্রণয়প্রার্থনা, জিউসের ঈগল বেশে অ্যাক্টিরিয়ার কাছে ও বৃষরূপ য়ুরোপার কাছে প্রণয়ভিক্ষা, নেপচুনের পতিঘাতিনী অ্যামিয়োনির কাছে ও আর্নির কাছে প্রেম নিবেদন, মানুষ ইউলিমিসকে ভালবেসে নিস্তব্ধতার দেবী ক্যালিপ্সোর তাঁর দ্বারা প্রত্যাখ্যাতা হ'য়ে তাঁকে সাত বৎসর বন্দী ক'রে রাখা প্রভৃতি গ্রীকপুরাণের সাধারণ ঘটনা। মৃগয়া দেবী আর্তিমিসের যেমন কোনো প্রণয়ঘটিত দুর্বলতা ছিল না, তেমনি কোনো দয়ামায়াও ছিল না। এক হতভাগ্য শিকারী অসতর্ক অবস্থায় তাকে দেখে ফেলার অপরাধে হরিণে রূপান্তরিত হ'য়ে নিজের পোষা কুকুরদের মুখে খণ্ড বিখণ্ড হ'য়ে প্রাণ হারিয়েছিল। সেদিনের গ্রীসের সমাজ যেভাবে গঠিত ছিল, তার দেব-দেবীদের মধ্যে তার জীবন্ত প্রতিমূর্তি আমরা সুস্পষ্ট দেখতে পাই। শৈশবে পরিত্যক্ত পিতৃঘাতী ইডিপাস্ তাঁর গর্ভধারিণী মা জেকোষ্টাকে না জেনে বিয়ে করেছিলেন, পরে সমস্ত জানতে পেরে জেকোষ্টা আত্মহত্যা করলেন। ব্যাকাস্ দেবতার পুরোহিত ‘কোরিসুস্’ সুন্দরী ‘ক্যালিবোয়ে’কে প্রণয় নিবেদন ক'রে প্রত্যাখ্যাত হ'লেন। ক্রুদ্ধদেবতার অভিশাপে মহামারী এল, ভবিষ্যদ্বাণী হ’ল, ‘ক্যালিরোয়েকে’ বলি না দিলে দেবরোষ শান্ত হবে না। হতভাগিনীকে দেশের লোক ধরে নিয়ে এল, বলিদানের ভার পড়ল ‘কোরিসুসে'র ওপর। কোরিসুস প্রেম-পাত্রীর রক্তপাত না করে বেদীর সামনে নিজেই আত্মহত্যা করলেন, ক্যালিরোয়ে অ্যাটিকায় পালিয়ে গেলেন, শেষে অনুশোচনায় নিজেও আত্মঘাতী হলেন। একদিকে দুর্নীতির বন্যা, আর একদিকে গভীর প্রেমের এবং ত্যাগের পুণ্যধারা ভারতীয় পুরাণের মতো গ্রীকপুরাণেও ওতপ্রোতভাবে প্রবহমান। অর্ফিউসের বীণার তানে চরাচর মোহিত হ'ত, তাঁর পত্নী ইউরিডিস্ সর্পদংশনে নিহত হলে শোকোন্মত্ত অর্ফিউস্ মৃত্যুপুরীতে গিয়ে প্রেতলোকপতি প্লুটোকে বীণাস্বরে মোহিত ক'রে পত্নীর জীবন ভিক্ষা পেলেন, শুধু শর্ত রইলো মৃত্যুপুরীর সীমানা ছাড়িয়ে নরলোকে না পৌছানো পর্য্যন্ত অর্ফিউস্ অনুগামিনী পত্নীর দিকে ফিরে চাইতে পারবেন না। ধৈর্যহীন অর্ফিউস নরলোকে পৌছাবার পূর্ব মুহূর্ত্তে ‘ইউরিডিস’ আসছেন কি না দেখবার জন্য পিছন ফিরে চাইলেন এবং তাঁকে জন্মের মতোই হারালেন। ব্যাকাস দেবের পূজার উৎসবে উন্মত্ত থ্রেসের নারীরা অর্ফিউসের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে, তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। এই সব প্রকৃত প্রেমিকদের পাশে পতিব্রতা লাওডামিয়া এবং আলসিষ্টিসের কাহিনী স্মরণযোগ্য। দুর্দ্দান্ত বন্যজন্তু-বাহিত রথে চড়ে এসে মহাবীর অ্যাডমিটাস্ আলসিষ্টিসের পাণিগ্রহণ করেন। ভাগ্যদেবতারা বলেছিলেন অ্যাডমিটাসের জন্য অন্য কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় যদি জীবন দেয়, তবে অ্যাডমিটাসের মৃত্যু হবে না। আলসিষ্টিস্ স্বামীর জন্য স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করলেন, কিন্তু হিরাক্লিস্ তাকে পুনর্জীবন দান করেছিলেন। লাওডামিয়ার সকরুণ প্রার্থনায় দেবতারা তাঁর স্বামী পোটিসিলাউসকে তিন ঘণ্টার জন্য পুনর্জীবন দান করেন, স্বামীর দ্বিতীয়বার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সতীর স্বেচ্ছামৃত্যু হয়। পার্থিব প্রণয়ের বহু মধুর এবং করুণ কাহিনীর মধ্যে হিরো, ডিডো, আরিয়াডনি এবং থিসবির কাহিনী উল্লেখযোগ্য। থিসবি পিরামুসকে ভালবেসেছিলেন, বাপ মা তাদের বিয়ের মত দিলেন না। থিসবি প্রণয়ীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেন, কিন্তু সিংহ দৈখে ভয় পেয়ে বস্ত্র ত্যাগ করে ফেলে পালিয়ে আসেন; পিরামুস তাঁহার কাপড় এবং সিংহের পায়ের ছাপ দেখে তাঁকে মৃত মনে করে আত্মহত্যা করেন। থিসবি সৈই স্থলে প্রত্যাবৃত্ত হয়ে পিরামুসের মৃতদেহ দেখে আত্মঘাতিনী হ'ন। আবিডস্ নিবাসী লিয়াণ্ডার সেষ্টসের পূজারিণী হিরোকে ভালবেসেছিলেন, দিনের বেলা তাঁদের দেখা-সাক্ষাতের সম্ভাবনা ছিল না, হেলেসপণ্টের জলপ্রণালীর দু’পারে দু’জনের বাস। এশিয়ার যুবক রাত্রে সাঁতার কেটে সমুদ্রের পরপারে য়ুরোপে প্রণয়িনীর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, আবার রাত্রেই সাঁতার কেটে ফিরে আসতেন। হিরোর জানালায় প্রদীপ জ্বলত, বহু দূর থেকে তার আলো তাঁকে পথ দেখাত। একদিন ঝড়ের রাত্রে হিরোর জানালায় দীপ নিভে যায়, লিয়াণ্ডার মধ্যপথে পথভ্রষ্ট হয়ে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে ডুবে মারা যান। হিরো সেই সংবাদ পেয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কাহিনীটি হয়তো সত্য, কারণ আবিডসে আজও তাঁদের কথা লোকে ভোলনি, তবে কাহিনীটি কোনো কবির কল্পনা হলেও আশ্চর্য হ'বার কিছুই নেই। ‘ডিডো কার্থেজের স্থাপয়িত্রী, টায়ারের অসমসাহসিকা রাজকন্যা, অকুলসমুদ্রে পাড়ি দিয়ে উত্তর আফ্রিকায় নূতন উপনিবেশ স্থাপন ক'রে তিনি অক্ষয় কীর্ত্তি রেখে গেছেন। ভার্জিলের ‘ইনিড্’ কাব্যে দেখা যায় ডিডো রোম সম্রাটদের পূর্বপুরুষ ইলিয়ামের রাজকুমার ইনিয়াসের প্রণয়ে প্রত্যাখ্যাতা হ'য়ে তাঁর বিদায় গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যা করছেন। কাব্যের সৃষ্টি হিসাবে ‘ডিভো'র কাহিনী আমাদের মর্মস্পর্শ করে, যদিও তলিয়ে দেখলে কবির নীচতায় স্তম্ভিত হ'তে হয়। কার্থেজ ছিল রোমের প্রতিদ্বন্দ্বী, জ্ঞানে বিজ্ঞানে বাণিজ্যে তার চেয়ে বহু প্রাচীন গৌরবের অধিকারী, সেই কার্থেজের মহীয়সী স্থাপয়িত্রীকে এক অজ্ঞাতকুলশীল রোমক সম্রাটের দেবানুগৃহীত পূর্বপুরুষের কাছে প্রণয়ভিখারিণীরূপে চিত্রিত করে তাকে চিরদিনের জন্য অপমানিত করবার যে চেষ্টা ভার্জিল রাজানুগ্রহলোভে করেছিলেন, তার তুলনা কেবল ভারতবর্ষের ভারতচন্দ্রেই মেলে! ভারতচন্দ্র আশ্রয়দাতা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী বর্ধমানরাজকে হেয় করবার জন্য এক পুরাতন কাহিনীর কলঙ্কিনী নায়িকাকে বর্ধমানের রাজকন্যা ‘বিদ্যায়’ রূপান্তরিত ক'রে শুধু বর্ধমানেরই নয়, বাংলার কবিপ্রতিভার অবমাননা করেছেন।

 ক্রীটের রাজকুমারী আরিয়াডনি এবং কলচিস্ রাজকুমারী মিডিয়া যথাক্রমে বিদেশী গ্রীক যুবক থিসিউস এবং জ্যাসনের রূপমোহে মুগ্ধ হ'য়ে তাদের জন্য ভ্রাতৃহত্যা এবং পিতার অপমানের কারণ হয়েছিলেন, পরে দু'জনেই পতি-পরিত্যক্তা হ'ন। অ্যারিয়াডনিকে থিসিউস্ প্রত্যাবর্ত্তনের পথেই স্যাক্সসদ্বীপে পরিত্যাগ করেন। সুবাদেবতা ব্যাকস্ তাঁকে গ্রহণ করায় তাঁর বিশেষ ক্ষতি হয়নি। যাদুকরী মিডিয়াকে ভ্রাতৃহত্যা এবং পিতৃদ্রোহিতার জন্য ঘৃণা করলেও জ্যাসন প্রথমে তাঁকে ত্যাগ করতে সাহস করেননি, ভয়ে এবং কৃতজ্ঞতায় তিনি তাঁকে পত্নী বলে স্বীকার করেছিলেন, তাঁর গর্ভে জ্যাসনের কয়েকটি সন্তানও হয়েছিল। কিছুদিন পরে গ্লাউস নাম্নী এক সুন্দরীর মোহে জ্যাসন মিডিয়াকে ত্যাগ করলে মিডিয়া নিজ হস্তে জ্যাসনের ঔরসজাত নিজের সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করেন এবং বিষদিগ্ধ পরিধেয় পাঠিয়ে গ্লাউসকে নিহত করেন। জ্যাসন শোকোন্মত্ত অবস্থায় আত্মহত্যা ক'রে মিডিয়ার প্রতিহিংসা থেকে মুক্তি পান। গ্রীসের মহাকাব্যের নায়িকা ভুবনমোহিনী হেলেন ছিলেন রাজা মিনিলাসের পত্নী, ইলিয়াসের রাজকুমার প্যারিসের প্ররোচনায় তিনি গৃহত্যাগিনী হ'ন। প্যারিসকে শাস্তি দেবার জন্য গ্রীকরাজারা সসৈন্যে সমবেতভাবে ইলিয়াস আক্রমণ করেন, দীর্ঘকাল অবরোধ ও যুদ্ধের পর ছলনার সাহায্যে ট্রয় ধ্বংস ক'রে মিনিলাস হেলেনকে উদ্ধার করেন। ইলিয়াসের যুদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা, তার ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়; হেলেনও নিঃসন্দেহ ঐতিহাসিক চরিত্র, তবে বাস্তবের ওপর কল্পনার রং যে চড়েনি একথা বলা চলে না। হোমারের ‘ইলিয়াড’ কাব্যকে প্রায়শঃই রামায়ণ এবং মহাভারতের সঙ্গে তুলনা করা হয়, কিন্তু এদের মধ্যে আকাশ-পাতালের মতই প্রচণ্ড প্রভেদ। ইলিয়াডে যুধ্যমান উভয় পক্ষে সাহায্যকারী দেবদেবীদের প্রচুর সংখ্যক দেখতে পাই, যোদ্ধাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন দেব বা দেবীপুত্র এবং দেবানুগৃহীত ব্যক্তিবর্গ। রামায়ণের সঙ্গে ‘ইলিয়াডে'র মিল যৎসামান্য, অমিলটাই প্রকাণ্ড। রামায়ণে এক সত্যসন্ধ মহাত্যাগী রাজকুমার তাঁর সাধ্বী-পত্নীর উদ্ধারের জন্য রাক্ষসপুরী ধ্বংস করেছেন, আবার সেই লক্ষ্মীস্বরূপা পুণ্যবতী নারীকে লোকাপবাদের ভয়ে বারম্বার প্রত্যাখ্যান করেছেন, এমন কি নিরপরাধিনী জেনেও অসহায় অবস্থায় লোকাপবাদে তাঁকে বর্জন করতেও বাধ্য হয়েছেন। ইলিয়াডে এক দুশ্চরিত্রা স্বেচ্ছাচারিণীর জন্য গ্রীকরাজারা ইলিয়াস বিধ্বংস করেছেন, হেলেন প্রথমে প্যারিসকে, তারপর তাঁর মৃত্যু হ'লে ডিইফোবাসকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীরূপে বাস করেছেন, তারপর যখন গ্রীকপক্ষের জয় নিশ্চিত বুঝেছেন, তখন ডিইফোবাসকে বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক ধরিয়ে দিয়ে নিজে নিরীহ নির্দোষী সেজে স্বামীর ক্ষমা লাভ করেছেন এবং অবশিষ্ট জীবন তাঁর সঙ্গে মুখে স্বচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে গেছেন। আদর্শ বটে। গ্রীক পক্ষের প্রধান বীর একিলিস একটি রূপসী বন্দিনীকে না পেয়ে অভিমান করে যুদ্ধ ছেড়ে বসে আছেন এ দৃশ্যও দেখা যায়। এই কাহিনীর সঙ্গে রামায়ণের একত্র নাম করতেও আমরা লজ্জিত হই। মিনিলাসের ভাই গ্রীকপক্ষের প্রধান সেনাপতি আগামেমনন যুদ্ধজয়ের পর দেশে ফিরে দুশ্চরিত্রা পত্নী ক্লিটেমনেষ্ট্রার হাতে প্রাণ হারান, আবার ওডিসিউসের সাধ্বী পত্নী ‘পেনিলোপি' দীর্ঘ বিশবৎসর ধ'রে সহস্র প্রলোভন এবং দুর্দ্দান্ত পাণিপ্রার্থীদের উন্মত্ত আবেদন অগ্রাহ্য করে স্বামীর পথ চেয়ে আছেন! এই রকম ভালো মন্দ শত সহস্র ছোটো বড়ো বাস্তব এবং কল্পিতচরিত্র গ্রীকপুরাণ এবং প্রাচীন গ্রীকসাহিত্যে দেখতে পাই। প্রমিথিউস মানবের কল্যাণের জন্য স্বর্গ থেকে অগ্নিকে চুরি করে মর্ত্তে নিয়ে এলেন, প্রতিহিংসাপরায়ণ দেবরাজ মানুষকে শাস্তি দেবার জন্য সৃষ্টির প্রথম নারী ‘প্যাণ্ডোরাকে পাঠালেন সর্বগুণান্বিতা সুন্দরী রূপে। ‘এপিমিথিউসে’র অনুরোধে প্যাণ্ডোরা তাঁর পাণিগ্রহণ করলে তাঁর সঙ্গের দেবদত্ত যৌতুকের পেটিকাটি খোলা হ'ল। জগতের যত কিছু রোগ, শোক, ঘৃণা, বিদ্বেষ, লোভ, মোহ তার ভিতর সঞ্চিত হয়েছিল, বেরিয়ে এসেই দেখতে দেখতে চারিদিক ছড়িয়ে পড়ল। বাক্সর তলায় একমাত্র পড়ে রইল আশা, তার মাধুর্য্য দিয়ে মানুষের দুঃখ-কষ্ট একটুখানি লাঘব করবার জন্য। প্রাচীন গ্রীসের ভ্রাতৃ-প্রেমের আদর্শ দেখা যায় রাজকন্যা আণ্টিগনির মধ্যে। রাজরোষ উপেক্ষা করে তিনি ভাই পালিনিসিসকে কবর দিয়েছিলেন, সেজন্য তাঁকে জীবন্ত সমাহিত হ'তে হয়। গ্রীকপুরাণে সপত্নীপুত্রকে হত্যার জন্য থিসিউস-পত্নীর তার নামে কুৎসিত কলঙ্ক আরোপ, কুহকিনী সার্সির পতিহত্যা, সাইরেনদের মধুর কণ্ঠস্বরে ভুলিয়ে নিরীহ নরহত্যা উল্লেখযোগ্য কদর্য চিত্র। একদিকে স্বামীর উপর প্রতিহিংসা নেবার জন্য ‘প্রোকু’ নিজের ছেলেকে কেটে তার মাংস স্বামীকে খাওয়াচ্ছেন, এই লোমহর্ষণ চরিত্র-চিত্র যেমন দেখা যায়, তেমনি আর একদিকে সন্তানগর্বে দেবতাকে অবজ্ঞা করে ‘নায়োবি’ দেবরোষে তেরোটি সন্তানের মৃত্যু দেখে কেঁদে কেঁদে পাথর হ'য়ে গেছেন, সেই পাথরে শুধু নিরন্তর অশ্রুর ঝরণা ঝরছে, এই করুণ কথা-চিত্রও পাই। ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে তুলনায় গ্রীক পুরাণে ‘মন্দ চরিত্র’ অনেক বেশী এবং তা' অতি কদর্য! পিতৃঘাতিনী ‘স্কাইলা’, পতিঘাতিনী ‘আসিওনি', ‘ক্লিটেমনেষ্ট্র প্রভৃতির দল গ্রীসে যত সুলভ, ভারতে তেমন নয়, বরং তুলনাই হয় না। উর্বশীর অভিশাপও ভারতে বার বার ঘটেনি! বঙ্গ-সাহিত্যের ছোটখাট দেবীর ভক্তদলের পতন অবস্থার সহায়তা নিয়ে পূজালোভে অনেকের উপর অত্যাচার করলেও মানবের রূপমোহে গ্রীকদেবীদের মতো কদর্য্য মনোবৃত্তির আদৌ অধিকারিণী ছিলেন না। চণ্ডী, মনসা, শীতলা যিনিই হোন না কেন, নিজ নিজ সতীধর্ম্মে অচলা থেকেই শুধু প্রতিহিংসাবৃত্তিরই চরিতার্থতা করেছেন, নিজের পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যে; এই পর্য্যন্ত! এদেশে চরিত্রহীন ইন্দ্রের পত্নী পতিব্রতা ইন্দ্রাণী।

 রোমান কল্পনারাজ্যে গ্রীসের প্রভাব এত বেশী এবং অনুকরণস্পৃহা এত প্রবল যে, তাকে গ্রীক কল্পনারাজ্যেরই অক্ষম রূপান্তর বলা চলে। দেবদেবীরা তো অধিকাংশই গ্রীস এবং মিশরের, এমন কি পারস্যের আমদানী। জিউসকে জুপিটার, হীরাকে জুনো, আর্তিমিসকে ডায়ানা, আখেনাকে মিনার্ভা, আফ্রোদিতেকে ভিনাস প্রভৃতি রোমান নাম দিয়ে রোম নিজস্ব করে নিয়েছিল মাত্র, সেই জন্য এদের পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। ‘কামিনা' প্রভৃতি সুপ্রাচীন দেশজ দেবীদের রোম গ্রীক ‘মিউজ’দের রূপান্তর বলে স্বীকার করে প্রকারান্তরে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গ্রীসের দাসত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল। রোমের মহাকাব্য ‘ইলিয়ার্ড’ আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বৎসর আগের রচনা, তাকে নিছক কবিকল্পনা বললে অত্যুক্তি হবে না। ইনিয়াস রোমক সম্রাটদের পূর্বপুরুষ, তিনি ইলিয়াসের রাজকুমার, গ্রীকদের আক্রমণে স্বদেশ ধ্বংস হওয়ায় তিনি দেশে দেশে ঘুরে শেষে সাত বৎসর পরে একদিন টাইবার নদীর তীরে রাজা ল্যাটিনাসের রাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন। রাজকন্যা ল্যাভিনিয়ার মা—'আমাতা' তার সঙ্গে ‘টার্ণাসে’র বিয়ের ঠিক করেছিলেন, রাজা ইনিয়াসকেই কন্যা দান করতে সম্মত হলেন। দ্বন্দ্বযুদ্ধে টার্ণাসকে হত্যা করে ইনিয়াস রাজ-কন্যাকে লাভ করলেন! রাণী আমাতা ইনিয়াসকে জয়ী হ'তে দেখে তাঁর প্রতিজ্ঞাভঙ্গের ক্ষোভে আত্মহত্যা করলেন। এই যুদ্ধে ভলসিয়ান বীর নারী ক্যামিলার মৃত্যু বর্ণনা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। গ্রীসের অগ্নিদেবী হেষ্টিয়া রোমে ‘ভেষ্টা’রূপে পূজা পেতেন, তাঁর মন্দিরে অনির্বাণ অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে রাখার জন্য কুমারী দেবদাসীর দল নিয়োজিত ছিলেন। রোমের সমাজ যখন প্রচণ্ড ঐশ্বর্যমদে অন্ধ এবং বিলাসস্রোতে মগ্ন হ'য়ে অত্যন্ত কলুষিত হয়েছিল, সেদিনও সেই চিরকুমারী পূজারিণীরা তার সামনে ত্যাগের এবং পুণ্যের দীপশিখা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। রোমের পরবর্তী যুগের বহু ভালোমন্দ নারী চরিত্রের সন্ধান আমরা জানি, যাঁরা সম্পূর্ণ ইতিহাসের বিষয়ীভূত, তাঁদের কথা এ প্রসঙ্গে আলোচ্য নয়।

 সমসাময়িক আর দু’একটি জাতির প্রাচীন সাহিত্যের উল্লেখ না করলে কাহিনী অসম্পূর্ণ থাকবে। ইহুদীদের ‘ওল্ড টেষ্টামেণ্ট’ ইতিহাস এবং উপকথার অপূর্ব সমন্বয়, খৃষ্টীয় এবং মুসলিম সমাজের লোকেও এই বইখানিকে তাদের নিজেদের সাহিত্য বলে মনে করে থাকেন, অন্ততঃ তার প্রাচীন কাহিনীকে সত্য বলে স্বীকার করেন। ওল্ড টেষ্টামেণ্টের গোড়ায় সৃষ্টির প্রারম্ভে আদিমাতা 'ইভ’ বা ‘হাওয়া বিবিকে’ দেখতে পাই, শাস্ত্রমতে তাঁর অনুরোধে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে আদি পিতা ‘আদম’ সস্ত্রীক স্বর্গভ্রষ্ট হয়েছিলেন। তারপর থেকে বিভিন্নযুগের কাহিনীর মধ্য দিয়ে ইহুদী নারীর বহু চিত্র ঐ বইখানিতে দেখা যায়, মাত্র কয়েকটি উল্লেখ ক'রব। রাজা ডেভিডের প্রপিতামহী ‘রুথ’ তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তার শ্বাশুড়ী ‘নাওমি’র জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, পুত্রহীনা বৃদ্ধা তার পুরস্কার স্বরূপ তাঁকে এক বৃদ্ধ জ্ঞাতির বাড়ী পাঠিয়ে তাঁর হৃদয় জয়ের কলা-কৌশল শিখিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ছেড়েছিলেন। স্যামসনের প্রিয়া ‘দেলিলা’ সেই মহাবীরকে বিশ্বাসঘাতকতা করে শত্রুহস্তে সমর্পণ করেছেন। নারীর জন্য পুরুষ মহাপাপ করছে এবং ইন্দ্রিয়সংযমের অভাবে নারী শ্বশুর এবং পিতাকে পর্যন্ত কামনা করছে, রাজ্যলাভের জন্য পুত্রহত্যা করছে, এসব দৃশ্য সেদিনের চরম নৈতিক অবনতিরই সাক্ষ্য দেয়! নিঃসন্তানা হানা’র দেবতার কাছে সন্তান উৎসর্গ করার মানত এবং পুত্র স্যামুয়েলকে দান, তারই মধ্যে একটু ভিন্ন আদর্শের আভাস দিয়েছে। ইহুদী পুরাণের দুটি বিখ্যাত চরিত্র ‘বাথসেবা এবং ‘সেবার রাণী'। ‘বাথসেবা’কে পাবার জন্য রাজা ডেভিড বিশ্বাসঘাতকতা ক'রে তাঁর স্বামীকে হত্যা করান। সেবার রাণী ডেভিডের পুত্র সলোমনের সঙ্গে দেখা করতে এসে স্বেচ্ছায় তাঁকে আত্মদান করেন। ইথিওপিয়ার রাজারা আজও সেবার রাণীর বংশধর বলে পরিচয় দেন এবং দিতে লজ্জিত হ'ন না।

 গ্রীক রোমানদের পর যে সব জাতি পাশ্চাত্ত্যজগতে প্রাধান্য লাভ করেছে তাদের অর্থাৎ ইংরাজ জার্মান প্রভৃতি জাতির মুল পুরাণকে নরওয়ের পুরাণ বলা চলে। তা’তে যেসব দেবী এবং মানবীদের দেখা পাই, তাদের মধ্যে স্বর্গের রাণী ‘ফ্রিয়া’ বা সৌন্দর্যদেবী ‘ফ্রিয়া’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর রণরঙ্গিনী সঙ্গিনী 'ভ্যালকি’দের নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতেন এবং সম্মুখসমরে যে সব বীর প্রাণ দিত, তাদের নিজের সভায় নিয়ে এসে ‘হাইদ্রুন’ ছাগলের দুধ এবং ‘সেহ্রিমনি’ শূকরের অক্ষয় মাংস খাওয়াতেন। ফ্রিয়ার এক ছেলে আলোকদেবতা ‘বলডার’, আর এক ছেলে অন্ধকারের অন্ধদেবতা ‘হোডার'। হোডার খেলাচ্ছলে ‘মিসলটোর’ তীর ছুড়ে ভাইকে হত্যা করলে তাঁকে বাঁচাবার অনেক চেষ্টা হয়েছিল। অদৃষ্টদেবী ‘ভলা', মৃত্যুদেবী ‘হেলা’ প্রভৃতি নিষ্ঠুর প্রতিহিংসাপরায়ণা দেবীদের সঙ্গে এই সূত্রে আমাদের পরিচয় হয়। হেলা বললেন, পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী যদি বল্ডারের জন্য কাঁদে, তবে তাকে ফিরিয়ে দেবেন, কিন্তু দানবী ‘থক্’ বা ছদ্মবেশী দেবতা ‘লোকি’ বল্ডারের জন্য কাঁদতে রাজি না হওয়ায় তিনি জীবন ফিরে পেলেন না। শেষে পৃথিবীদেবী ‘রিণ্ডা'র গর্ভে দেবরাজ ওডিনের ‘ভ্যানি’ নামক পুত্র জন্ম নিলে, সে অন্ধকারের দেবতা বৈমাত্রেয় ভাই হোডারকে হত্যা করে বল্ডারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলে। বলা বাহুল্য ভারতীয়, এমনকি,—গ্রীক পুরাণের পাশেও এই সব বর্বর জাতির কাহিনী নিতান্তই বালসুলভ বলে মনে হয়।

 এর অনেক পরের যুগে আরব পারস্যের কবি-কল্পনায় ধরাপড়া একটি নারীরত্নের কথা এই সঙ্গেই আমরা উল্লেখ করছি।

 ভারতের বাইরে যে কয়েকটি কল্পিত নারীচরিত্র পৃথিবীর সকল দেশের মানব মানবীর আপন জন রূপে অভ্যর্থিত হয়েছে, তার মধ্যে বহু অভিজ্ঞ পণ্ডিতের মতে বিশ্ব সাহিত্যে আরব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দান “আলফ লয় লহবা” বা একাধিক সহস্র রজনী। ‘আরব্য উপন্যাসে’র ‘শাহার জাদী’ চরিত্র সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠ নারীদের অন্যতম। পারস্যরাজ শাহরিয়র নিজের প্রিয়তমা পত্নীর দুশ্চরিত্রতায় সমস্ত নারীজাতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্রতি রাত্রে একটি সুন্দরীকে বিয়ে করতেন এবং সকাল বেলা তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দিতেন। সমগ্র নারীজাতিকে এইভাবে হত্যা করে তিনি রাজ্যের ব্যাভিচার দূর করার দুশ্চেষ্টায় নিরত ছিলেন, কিন্তু বুদ্ধিমতী মন্ত্রিকন্যা শাহার জাদী তাঁর এই মহদুদ্দেশ্যে বাধা প্রদান করলেন। তিনি স্বেচ্ছায় রাজাকে বিবাহ করলেন এবং তাঁর ভগ্নী ‘দীনার জাদী'কে লক্ষ্য করে এক হাজার এক রাত্রি ধরে কত বিচিত্র কাহিনীর রস রচনা দিয়ে নারীঘাতী রাজাকে নারী-মহত্ত্বে মুগ্ধ করলেন, ও শেষ পর্যন্ত তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিকৌশলে রাজার মধ্যের দুর্দ্ধর্ষ প্রতিহিংস্র বুদ্ধি পরাভূত হয়ে তাঁর কাছে নতি স্বীকার করল।

 প্রাচীন পারস্যের লেখিকাদের সম্বন্ধে আমরা বেশী কিছু জানি না, আরবের প্রাচীন কবি ‘খানশা’র মতো খ্যাতিলাভ অন্ততঃ তাঁরা কেউ করেন নি। ‘রাবেয়া'র পরে বহু সুপণ্ডিতা ধর্মজ্ঞা নারী পারস্যে দেখা দিয়েছিলেন, তাঁদের নামও এখানে দেওয়া গেল না। আধুনিক লেখিকাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশী খ্যাতিলাভ করেছেন তাঁদের নাম ‘পারবীন খানুম এ'তে শামী’ এবং ‘ফজলেবাহার খানুম ইরান-উদ্দৌলা’ তাঁর কবি নাম 'জান্নৎ। শামীর ভাষা সরল এবং ভাব সহজবোধ্য, ফজলেবাহার বা ‘জান্নতের গজলগুলিতে মধ্যযুগের মরমীয়া সাধকদের অন্তগূঢ় প্রকাশভঙ্গী একদিক দিয়ে সেগুলিকে যেমন মর্মস্পর্শী করেছে, অপর দিকে সাধারণের পক্ষে সেগুলিকে খানিকটা দুষ্পাচ্য করেছে। দু’জনের লেখা থেকে দু’টি নমুনা দে'ব। শামীর লেখাটি স্থিরবুদ্ধি এবং চিন্তাশীলতার পরিচায়ক:

শামী—

“জানো কি তোমরা—নারী ও পুরুষ—কার কি কাজের ভার?
একজন এর তরণী, বন্ধু, অপরে কর্ণধার।
কাণ্ডারী যদি হয় হুঁশিয়ার, তরী যদি দৃঢ় হয়,
ঝঞ্ঝাতুফানে জলাবর্তেতে বলো তবে কিবা ভয়?
কালসমুদ্রে উঠুক ঊর্মি,—কি করিবে, এরা দোঁহে,
নিজ নিজ কাজ, যদি করে আজ অবিচল আগ্রহে?
আজ যে কন্যা—সেই হবে জেনো আগামী দিনের মাতা।
সুসন্তানের মহিমা-সৌধ জননীরই হাতে গাঁথা।”

জান্নৎ—

“একদা প্রভাতে বুলবুল, কাঁদি’ কহিল মোরে,
যদি বসন্ত এসে থাকে আজি ভুবন ভ'রে,—

বনে-বনান্তে যদি লেগে থাকে খুশীর ঢেউ,—
‘লালা'[১১] কেন লুটে বুকে ল’য়ে ক্ষত—বলো না কেউ?
যদি এসে থাকে সুখের সময় সবারি—তবে
কেন ‘বানা’[১২] শোকবাস পরি’ সরিয়া র’বে?”

 জগতে একসঙ্গে যে সবাইকে সুখী করা সম্ভব নয়, উৎসবের আনন্দের পাশে দুঃখের অশ্রু যে চিরদিন অপরিহার্য এই সহজ সত্যটিকে কবি মর্মস্পর্শী ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। আধুনিক পারস্য নারীর কবিপ্রতিভার পরিচয়স্বরূপ এই দুইটি কবিতাই যথেষ্ট বলে মনে হয়।

 অহল্যা দেবযানী প্রমুখের কর্মোত্তর ফলাফলের মধ্যেই তাদের কৃত কর্মের প্রত্যুত্তর দেওয়া রয়েছে। শেষ প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা না করে শেষ উত্তর বজ্রানলে লিখা হয়ে গেছে। 'দময়ন্তী’ ‘চিন্তা’ ‘সুনীতি’ শর্ম্মিষ্ঠাও আছেন, ‘উর্বশী’ ‘রম্ভা' 'তিলোত্তমা'দেরও অভাব নেই, কিন্তু মহীয়সী মহাভাগারাই সর্ব্বত্র পূজনীয়া। দার্শনিকদের মধ্যে সাংখ্যকার নিষ্ক্রিয় পুরুষকে বৃহন্নলারূপে নির্বাসিত রেখে প্রকৃতির উপরেই পূর্ণ দায়িত্ব চাপিয়েছেন। আবার বৈদান্তিক;—“অব্যক্তনামী পরমেশশক্তি অনাদ্যবিদ্যা ত্রিগুণাত্মিকা পরাঃ।”

“কার্যানুমেয়া সুধিয়ৈব মায়া যা জগৎ সর্বমিদং প্রসূয়ত্যে।”

 এইরূপে তার “মায়ামূর্ত্তি”কে সর্ব্বদোষাকর বলে তাঁর অস্তিত্বই বিলুপ্ত করেই দিয়েছেন। বৈদান্তিক সন্ন্যাসীরা তো ভূত ছাড়াবার মন্ত্রোচ্চারণের মতই;—'নার্য্যা পিশাচ্যা’ ‘দ্বারং কিমেকং নরকস্য নারী’ ‘প্রাণভৃতা শৃঙ্খলা’ প্রভৃতি কটূ-কাটব্যের শেষই রাখেন নি। তাঁরা তা’ না করবেনই বা কেন? মাতৃত্যাগী, কুমারসন্ন্যাসীর পত্নীর প্রেম ও পুত্রীর শ্রদ্ধা লাভ না করে, প্রলোভিকার পরিচয়ই হয়ত জীবনে একমাত্র পেয়ে থাকবেন, কিন্তু গৃহী-ঋষিরা বা বৈদিক আচার্য্যেরা রীতিমত নারী-পূজা মাতৃ-পূজার সাধনা করে গেছেন। বেদের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যে আজও তা’ স্পষ্ট হয়ে থেকে হিন্দুর ‘সমাজ’ ‘ধর্ম’ নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষের জীবনে নারীর প্রয়োজনীতা ও সাহচর্য্য যে অবশ্য প্রয়োজনীয়, সে কথা তাঁদের প্রবর্তিত সমুদয় গার্হস্থ্য বিধানে ও আইনে কোথায়ও তাঁরা এতটুকু বিস্মৃত হননি। “স্ত্রিয়ঃ সমস্ত সকলা জগৎসু”—মহাপ্রকৃতিকে এইরূপে বিশ্লেষণ করে গার্হপত্য স্থাপয়িতারা তাঁকে “যা দেবী সর্ব্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা” বলে সভক্তি বন্দনা করেছেন। তাঁদের মতে “গৃহিণী গৃহমুচ্যতে”, তাঁদের মতে পত্নী পতির শুধু সহধর্মিণীই নন, তিনি,—“গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ।”

 তাঁরা বলেছেন: সতী স্ত্রীর এত তেজ যে, দুর্বৃত্ত স্বামীকেও,

“ব্যালগ্রাহী যথা ব্যালান্ বলাদুদ্ধরত বিলাৎ।
তদবৎ পতির মাদায় স্বর্গেণ সুখমেধতে।”

 সাপুড়ে সাপকে যেমন গর্ত থেকে টেনে বার করে, তেমনি করে তাঁকে অধর্ম থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ। নারীকে তাঁরা বাল্যে, কৈশোরে, যৌবনে, প্রৌঢ়ে, বার্ধক্যে কোন অবস্থায় নিরাত্মীয় হয়ে জীবিকার্জনের জন্য পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ক্ষেত্রে দাঁড়াতে দিতে একান্তই নারাজ! পিতা পতি পুত্র ব্যতিরেকেও আত্মীয়েরা এই জন্যই তাঁদের ভরণভার গ্রহণ করতে আইনতঃ বাধ্য। নারীকে এত মর্যাদা অন্য কোন সমাজ কোনদিন দেয়নি। চীনে জাপানে ইউরোপে প্রাচীন রোমে গ্রীসে বিশেষ করে ইংলণ্ডে নারী বহুস্থানে অমর্যাদার মধ্যেই এই সেদিন পর্যন্ত আইনতঃ বদ্ধ ছিল। কোথাও পুরুষের সম্পত্তিরূপে, কোথাও তার অধীনা সেবিকারূপে। আবার কোন কোন সমাজের ধর্মগুরু নারীর পৃথক্‌ আত্মা আছে বলেই স্বীকার করেন না।

 বৌদ্ধনিরসনকারী কুমারিল ভট্টই ‘অহল্যা’ ‘দ্রৌপদী' 'কুন্তী’ প্রভৃতি সম্বন্ধীয় অস্বাভাবিক অনার্যোচিত পরিস্থিতির প্রকৃত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রচার করে নারীমর্যাদার কলঙ্ক মোচন করেছিলেন। বুদ্ধ সাধারণত নারীবিদ্বেষী বলে প্রখ্যাত হলেও নারীকে ধর্মরাজ্যে সমানাধিকার দিয়ে শ্রমণী ভিক্ষুণীরূপে বহু মহীয়সী নারীর দীক্ষিত হ’বার সহায়তা তিনি করেছিলেন। মহম্মদও নারীকে নিজের আত্মার মত ভালবাসতে নির্দেশ দিয়েছেন। যিশু, নর-নারীকে পৃথক করেননি, বৌদ্ধবাদের মধ্যেও বহু বাস্তব ও কল্পনা কল্পিতাদের মহত্তর ও নিকৃষ্টতম পরিচয় ‘থেরিগাথা’ ও অবদানের মধ্য দিয়ে পাওয়া গেছে। তার মধ্যে বহু দেবী, বহু মানবী, বহু দানবী, এমন কি নরকল্পনার নিকৃষ্টতম সৃষ্টিও দেখা দিয়েছে।

 সংস্কৃত কাব্য নাট্য সাহিত্যের পূর্বে আমাদের ব্যাসবাল্মীকির স্রষ্টাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। ঐতিহাসিক ভিত্তি ছেড়ে দিয়ে আমরা তাদের সাহিত্যিক ভিত্তির উপরেই আলোচনা ন্যস্ত করছি। রামায়ণের প্রত্যেকটি চিত্র যে মহা কবির যাদু তুলিকায় তুলিত হয়েছিল, আজও তার তুলনা নেই। কৌশল্যা পত্নীত্বে মাতৃত্বে সত্যসন্ধ পতির সত্যার্থ-গ্রহণে সর্বত্রই পরিপূর্ণ নারীচিত্র। পতির অর্ধাঙ্গিনীরূপে তাঁর সত্যকে নিজ সত্য বলেই স্বীকার করে নিয়ে প্রাণাধিক পুত্রকে বনবাসী হ'তে অনুমতি দান,—এ নারীচিত্র কোন্ কবি-কল্পনায় স্থান পেয়েছে? কৈকেয়ীর অন্ধ পুত্র-বাৎসল্য সংসারের মহা অকল্যাণকর হলেও মোটেই অস্বাভাবিক নয়। সুমিত্রা ছায়ানুগা;—পুত্রকে সপত্নীপুত্রের হাতে নিঃস্বার্থ ও নিঃস্ব হয়েই তিনি দান করেছেন। বধূ উমিলারা, নিতান্তই শান্তশীলা, তাই ‘কাব্যে উপেক্ষিতা'। সীতা কিন্তু তা ন'ন। তাই আদর্শের দিক দিয়ে হিন্দু নারীর চিরবরণীয়া। সমাজ যুগে যুগে পরিবর্ত্তিত হয়েছে কিন্তু বাল্মীকির সীতা মহিমার সূর্যমণ্ডলে চির অবস্থিতা অথচ কর্তব্য পরায়ণা সীতা তাঁর পতির উপদেশেও পতির অনুবর্তন থেকে বিরতা থাকেন নি, রীতিমত তর্ক করে নিজ মত বজায় রেখেছেন। কিন্তু প্রজার ইচ্ছায় ঐ সম্রাজ্ঞী-সীতাই আবার পতির কর্তব্যকে তাঁর সম্পর্কে অন্যায় হচ্ছে জেনেও তাঁর প্রদত্ত রাজদণ্ডকে সামান্য প্রজার মতই নির্বাধে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।

 সে যুগের অনার্য জগতেরও সুষ্ঠু ইতিহাস দুদিক থেকে দুই ভাবের নারীচরিত্রে ফুটে উঠেছে, রাবণের ও বালির সংসারে অসংযম ও শক্তিমদমত্ততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে এবং তারই অনিবার্য ফলে চরম উত্থান-পতনের ইতিহাসে। দেখা যায়, রাবণপরিবারে এই দৃষ্টান্ত চরম পরিণতি লাভ করেছিল, যাকে লক্ষ্য করে দুরদর্শী নীতিকার বলেছেন;—

“অতোঽসপত্নান্ জয়তে, সমূলেন বিনশ্যতি।”

 বালি-পরিবারেও প্রায় ইহারই অনুরূপ দৃশ্যই দেখা যায়, যথা;—বিতাড়িত কনিষ্ঠ ভ্রাতার পত্নী ‘রুমা’কে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং বলবান্ রাজা গ্রহণ করেছেন, তাতেও লোকনিন্দা বা প্রজাদ্রোহ ঘটেনি! অপর পক্ষে সুগ্রীব রাজা হয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃ-জায়া বিদুষী ও রাজ-নাতিজ্ঞা ‘তারা’কে তার পাটরাণী করাতেও রাজ্যের প্রজাবৃন্দ নির্বিচারেই সেই অনাচার মেনে নিয়েছে। এখানে স্পষ্টতঃ দেখা যাচ্ছে, সে দেশের ও সেই সমাজের সেইরূপই প্রথা ছিল।

 আজও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বদিকে কোন কোন সমাজে এই প্রথা বর্তমান আছে। অথচ ঠিক সেই একই সময়ে লক্ষ্মণ ভ্রাতৃজায়া সীতা দেবীর চরণপদ্ম দর্শনে ধন্য হচ্ছেন, মুখ দর্শন করতেও কুণ্ঠানুভব করে থাকেন।

 পূর্বে বলেছি, কল্পিত-পারস্যের নারী তাদের কল্পিত-সর্বনাশের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বাঁচলো একটা নারীর বুদ্ধিকৌশলে! এই জগৎ বিখ্যাত পুস্তকটী[১৩] প্রাচীন আরবের মরুবাসী মূর থেকে প্রাচীন ও নবীন ধর্মের সংমিশ্রিত ও আরব্য পারস্য সভ্যতার বহু চিত্র ও বিচিত্রতর তাদের পূর্বতন সমাজ, রাষ্ট্র, বাণিজ্য প্রভৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ‘পারস্য সুন্দরী' 'বেদৌরা', ‘আবুর পত্নী’ এবং আলিবাবার সুবিখ্যাত ‘মর্জিনা' 'ইবনেহোসেনে'র পত্নী খলিফা কন্যা রোসেনা প্রমুখ পতিপ্রাণা কূটবুদ্ধিশালিনী উচ্চাঙ্গের নারীদের দেখা ওর মধ্যে আমরা পাই, আবার অতি হীনচরিত্রারাও যে সে যুগে কিছু কম ছিলেন না, তাও ওতে দেখা যায়। ‘মায়াবিনী রাণী’ একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত! ‘পারস্য উপন্যাসে’ নারীর অ-কল্যাণী মূর্তিই আমরা বড় বেশী দেখি, তবে সর্বদেশে সর্বকালে ও সবজাতির মধ্যেই ভালমন্দ পাশাপাশি বর্তমান আছে। সমাজ-পরিস্থিতি যখন যেরূপ থাকে, ভাল বা মন্দের সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি হয় মাত্র।

 মহাভারতের বিরাট সমাজে বহু রাজবংশ ব্রাহ্মণকুল এবং আর্য্যতরেয় জাতির ঐতিহাসিক ও সমাজিক চারিত্রিক পরিচয় আমরা পেয়েছি। কিন্তু সে যুগ রামায়ণের যুগের চেয়েও রূপকের জটিল জালে সমধিক কুহেলিকাচ্ছন্ন। সত্যবতীর জন্ম ও কুন্তীর মাতৃত্ব একান্তই অবিশ্বাস্য! সেদিনে এবং তার বহু দিন পরেও এমন কি, এই সেদিনেও শক্তিমানের জন্মকথা কোথাও প্রায় নৈসর্গিক আকারে থাকতে পায়নি!

 দেবতা ও ঋষি মানব ও মানবীকে তাঁদের স্বেচ্ছা-সুখে শাপ, বর এবং ত্যাগ গ্রহণ যথেচ্ছভাবেই করে গেছেন দেখা যায়। ঐ উদ্ভট ব্যাপারগুলি যদি সত্য হ'তো, তা হলে তা'কে লুকিয়ে রাখাই হ'তো স্বাভাবিক। সগর্বে সুপ্রচারিত করা হ'ত না। পূর্ণ-যৌবনা দ্রৌপদীর যজ্ঞকুণ্ডের আহৃতাগ্নির মধ্য থেকে জন্মও যেমন বিশ্বাস্য, পঞ্চপতিত্বও তেমনি প্রামাণ্য! একটা মানতে গেলে আর একটাকে ছাড়া চলে না। দেখা যায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরেরই ধর্মপত্নী তিনি। ‘ভিক্ষান্নের মত’ কুরুরাজবংশের শ্রেষ্ঠ স্থানীয়রা তিব্বতীয় বর্বর প্রথা গ্রহণ করলেও প্রবল সমাজ ও অন্যান্য রাজন্যবর্গ তা মেনে নিতেন না। বিশেষতঃ অতবড় শত্রুপক্ষ যেখানে বর্তমান। তবে দ্রৌপদী যে কবির একটি অতুলনীয় নারীসৃষ্টি একথা একটুও অত্যুক্তি নয়! তার পূর্বে বা পরে আর কেহ এ চিত্র অঙ্কিত করতে পারেন নি। যেমনি দৃপ্ত সিংহিনীর মত তেজস্বিতা, তেমনি সর্বশাস্ত্রে ও কূট রাজনীতিতে অখণ্ড অধিকার, তেমনি আবার নারীধর্মে ভগবদ্ভক্তিতে এবং অতিথিসেবায়, রন্ধনাদিতে অসাধারণ পারদর্শিতা দশভুজা দুর্গার মতই যেন এ মেয়ে দশকর্মান্বিতা। পাণ্ডবের সমস্ত সুখ-সম্পদে দ্রৌপদী তাঁদের সর্বোত্তম ঐশ্বর্য্য, শ্রীকৃষ্ণের মতই কৃষ্ণাকেও যেন তাঁর সম পর্যায়ে ধরা চলে।  সুভদ্রা গান্ধারী কুন্তী সত্যবতী ভারত-চিত্রের বরণীয়া নারী। কর্তব্যের অটুটতায় পরোপকার বৃত্তির চরমোৎকর্ষে, সুদৃঢ় ধর্মবিশ্বাসে এই সকল নারীর জগতে আদর্শস্থানীয়া গান্ধারীর মত কুন্তীর মত মা-ই যথার্থ জননীপদবাচ্যা।

 মাতৃচরিত্র অঙ্কনে মহাভারতকার জগতের সাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

 প্রকৃত মাতৃপদবাচ্যা ভারতনারীদের যে সব পরিচয় পৌরাণিক সাহিত্যে পাই, তাঁদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নয় এবং যাঁরা অখ্যাতপরিচয় থেকে গেছেন, নিশ্চয়ই তাঁরা আরও বহুতরাই ছিলেন। মদালসা সর্ববিদ্যা বিশারদা, তিনি পুত্রগণকে অধ্যাত্মবিদ্যা দান করে পরলোকে উচ্চ স্থানাধিরোহণের সহায়তা করেছেন।

 পরপুত্রের প্রাণরক্ষার জন্য কুন্তীর নিজের পুত্র ভীমকে রাক্ষসের মুখে প্রেরণ করার মধ্যে কত বড় মহত্ত্ব নিহিত রয়েছে আজকের দিনের মা আমরা তার কি বুঝবো!

 গান্ধারী দুর্মদ সমর সাগরে ঝম্পপ্রদানোদ্যত মাতৃআশীর্বাদাকাঙ্ক্ষী পুত্রকে এই বলে আশীর্বাদ করলেন; “যতো ধর্মস্ততে জয়ঃ”—অর্থাৎ ধর্মহীনের পক্ষে জয় লাভ সম্ভবপর নহে। অথচ তাঁর নিজ পুত্রের পক্ষই যে অধার্মিক পক্ষ সে কথা তিনি ভালই জানতেন।

 পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক যুগের সাহিত্যে আমরা আরও বহু মহীয়সী নারীর সাহিত্যিক চিত্র দেখতে পেয়েছি। ভবভূতির সীতা তার মধ্যে অন্যতম। ভবভূতির শ্রীরামচরিত্র রামায়ণের রাজধর্মের অমোঘ শাসনে শাসিত রাজা রাম নহেন, তাঁর রাজবেশের অন্তরালে এই রূপটা তিনি তাঁর কাব্যে প্রকটিত করেছেন;—

অনির্ভিন্নগভীরত্বাদন্তর্গূঢ়ঘনব্যথঃ
পুটপাকপ্রতীকাশো রামস্য করুণো রসঃ।”

 সীতা বিরহ জনিত রামের শোক পুটপাকের মত হৃদয়কে দগ্ধ করলেও তাঁর একান্ত স্থৈর্য স্থির গম্ভীর প্রকৃতির জন্য তাঁর অন্তরের কঠিন নিগুঢ় বেদনা বাইরে কেউ জানতে পারে না। মুরলার মুখোচ্চারিত ভগবতী লোপামুদ্রার রামচরিত্রের এই গভীর অনুভূতি এবং পূর্বস্মৃতির মধ্যে প্রবিষ্ট হ'লে অকস্মাৎ হয়ত তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ধ্বসে পড়ে কোন সর্বনাশই ঘটিয়ে ফেলবে, সহানুভূতিপূর্ণ চিত্তের এমনও আশঙ্কাঙ্কিত প্রেমিক শ্রীরামচন্দ্র। তাই তাঁর সহধর্মিণীকেও আমরা তাঁরই অনুরূপ বিরহবেদনার মূর্ত্ত-প্রতীকরূপেই রামচন্দ্রের নিকট অদৃশ্যা হলেও আমাদের নিকট দৃশ্যমান শরীরধারিণী বিরহব্যথা এবং মূর্ত্তিমতী করুণ রস স্বরূপা দেখি এবং গভীরতর সহানুভূতি অনুভব ক'রে থাকি। কবি তাঁকে এইভাবে আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন;—

“পরিপাণ্ডু দুর্বল কপোল সুন্দরম্, দধতী বিলোলকবরীকমাননম্,
করুণস্য মূর্তিরথবা শরীরিণী, বিরহব্যথেব বনমেতি জানকী।”

 কবি তমসার মুখে অটুট রাজধর্মপরায়ণ, প্রজারঞ্জনার্থ পত্নী-ত্যাগী শ্রীরামচন্দ্রকে ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা বলেই অভিমানভরে সীতার কাছে উল্লেখ করেছেন, এ'ও যেমন স্বাভাবিক, আবার মেঘনিনাদে উৎকণ্ঠিত ময়ূরীর মত শ্রীরামচন্দ্রের কণ্ঠস্বর শুনে উচ্চকিত সীতা দেবীর কণ্ঠোচ্চারিত, “আমি কণ্ঠস্বরেই বুঝিয়াছি আর্য্যপুত্রই কথা কহিতেছেন!” এই নিরভিমান সম্বন্ধ স্বীকারসূচক বাক্যও তেমনই তাঁরই পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়েছে। এখানে মানবচিত্তবৃত্তিতে অভিজ্ঞ কবি অতি সুন্দর দুটি ভাব প্রকাশ করে দেখিয়েছেন, প্রেমাস্পদের পদধ্বনি কণ্ঠস্বর অন্যের কাছে তুচ্ছ হলেও প্রেমিকার পক্ষে যতদিনেরই অদর্শন হোক, অতি পরিচিতই থেকে থাকে। আর একটি প্রকৃত উচ্চমনা আর্য্যমহিলার চরিত্রিক অভিজ্ঞতা তাঁর লেখায় দেখা যায়, সেটী এই, পতিগতপ্রাণা উদারহৃদয়া ক্ষমাশীলা সতী পতির প্রতি যতই অভিমান পোষণ করুন না কেন, তাঁর সঙ্গে নিজ সম্বন্ধ এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেন না। অবচেতন চিত্তের মধ্যে নিজের অজ্ঞাতসারে গভীর ভালবাসার বারিধি পোষণ করে বসে থাকেন।

 এতটুকু ধ্বনিতেও সেখানে প্রতিধ্বনি জেগে ওঠে, তরঙ্গহিল্লোল প্রবাহিত হয়।

 এর পর যখন তমসার মুখে ‘ইক্ষ্বাকু বংশীয়’ ইত্যাদি শুনলেন, তখন যেন তার সহসাই মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ, তা বটে, তাঁরও ত’ ওই লোকটির প্রতি নিগুঢ় অভিমানের যথেষ্ট কারণ বর্তমান রয়েছে, অতটা হর্ষোচ্ছ্বাসিত হয়ে “আর্য্যপুত্র বলে সম্বোধন করাটা ত’ ঠিক হয়নি! তখন যেন ভেবে চিন্তেই বল্লেন, “দিট্টিআ অপরিহীন রাঅ ধর্মোকখু সো রাঅ।” “সেই রাজার রাজধর্ম পালনের ব্যতিক্রম হয়নি।”

 এখানেও নারী চিত্তবৃত্তির কিরূপ গূঢ় রহস্যময় পরিচিতি সূক্ষ্মদৃষ্টি কবির দ্বারা সম্ভবপর হয়েছে। যার রাজধর্মের অমোঘ দণ্ডতলে নিজে তিনি পিষ্ট হচ্ছেন, তার সেই ধর্মপালনে যে তিনি বিন্দুমাত্র ত্রুটি করছেন না, এই অভিব্যক্তিতে শুধু অভিমান প্রকাশই নয়, আত্মসন্ত্বনাও প্রচুরতর রূপেই নিহিত রয়েছে।

 জননী ধরিত্রীও একবার তাঁর নির্যাতিতা দুহিতাকে;— “হা আর্য্যপুত্রকে মনে পড়িল”, এই খেদোক্তি শুনে সকোপে ধমক দিয়েছিলেন;—“আঃ কস্তবার্য্যপুত্র”?

 “কে তোর আর্য্যপুত্র?”

 পঞ্চবটীর পূর্বস্মৃতি স্মরণে শ্রীরামচন্দ্র “হা’দেবি দণ্ডকারণ্যবাসপ্রিয়সখি!” বলে অবসন্নবৎ পতিত হ'লে বিপদ আশঙ্কিতা সীতা তমসার চরণ ধরে কাতর হয়ে বলে উঠেছেন;—“ভগঅদে তমসে! পরিত্তাহি পরিত্তাহি জিআয়োত অজ্জউত্তং।” “ভগবতী তমসে! আর্য্যপুত্রকে বাঁচাও বাঁচাও।”

 আর তখন ‘রাজা’ বলবার কথা মনে পড়েনি। পরক্ষণেই সীতা হস্তস্পর্শে সম্বিৎ প্রাপ্ত রামচন্দ্রের নিকট থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, সন্দিগ্ধ অভিমানে বলছেন, “ভগবতি তমসে! এস আমরা সরে যাই, বিনা অনুমতিতে আমি তার সম্মুখবর্তিনী হয়েছি দেখলে মহারাজা আমার প্রতি কুপিত হবেন।”

 এখানে আবার স্বামীর রাজপদটাই প্রবল অভিমান মিশ্রিত হয়ে দেখা দিল, যে রাজপদ তাঁকে তাঁর থেকে বিযুক্ত করেছে তার প্রতি তাঁর স্বতই একটা তীব্র অভিমান থাকা স্বাভাবিক। রামচন্দ্রকে ‘প্রিয়ে জানকি!’ বলে শোক করতে দেখেও অসহায় অভিমানে তীব্র করেই বলেছিলেন,—“আর্য্যপুত্র! নিশ্চয়ই এ অ-সদৃশ কথা সেই সেই ব্যাপারের পর,”—এই কথা কয়টি সতী স্ত্রীর একান্ত সুসঙ্গত লজ্জাভিমান-প্রণোদিত, কিন্তু স্বামীকে 'প্রিয়ে জানকি!’ উচ্চারণ করতে শুনেই ‘মহারাজা’ ‘আর্য্যপুত্রে' পুনঃপ্রত্যাবর্তন করেছে। আবার নিজের অভিমানকে ধিক্কার দিয়ে সাশ্রুনেত্রে বলে উঠেছেন;—

 “হায়! আমি বজ্রময়ী, জন্মান্তরে দুর্লভ এমন প্রিয়ভাষী স্নেহময় আর্য্যপুত্রের প্রতি কি নির্দয় হলেম!”

 সংস্কৃত কাব্য-নাটকের চরিত্র নিয়ে আলোচনা দু'চার কথায় করা যায় না। এই সব অমূল্য রত্নরাজি সদৃশ চরিত্ররত্নের বিশ্লেষণ আবহমান কাল ধরে অসংখ্যবার হয়ে গেছে, আরও হবে, আমি শুধু এইটুকুই বলবো যে নারী চরিত্র সংগঠনে বিশ্লেষণে দূরদর্শী ও মনীষী পুরুষ কবিরা যে অদ্ভুত সূক্ষ্ম দৃষ্টির পরিচয় রেখে গেছেন, যুগযুগান্ত ধ'রেই লোক তার অনুবর্তন করতে বাধ্য হবেই হবে।

 ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ কাব্যেও কবির সূক্ষ্ম দৃষ্টি যথাযথ চরিত্র সংগঠন কার্যে নিপুণতার পরিচয় দিয়ে দেখিয়েছেন, তিনটি তরুণী নারীর মধ্যে অপ্সরা-সম্পর্কিতা শকুন্তলাই সংযমচ্যূতা হয়েছিলেন, মুনিকন্যাদয় সুরূপ রাজার প্রতি প্রেমাসক্ত হননি।

 রক্তসম্পর্ক যে কত প্রবল ঐ ইঙ্গিতেই তা’ পরিস্ফুট হয়েছে। অপ্সরীকন্যা বলে তার এই সংযমহীনতা একথা স্পষ্ট করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। অথচ দেব ও ঋষি সম্পর্কিতা বলে শকুন্তলার মধ্যে সতী-তেজ সামান্য ছিলনা। আমরা কবি বর্ণিত পতিত্যক্তা শকুন্তলার এই বেশ বাসের মধ্য দিয়েই সে পরিচয় পেয়েছি।

 “বসনে পরিধূসরে বসানাং নিয়ম ক্ষাম মুখী ধৃতৈকবেণী,”

 পতিবিরহিণী যক্ষবন্ধু কাব্যজগতের অনবদ্য সৃষ্টি! সত্যই যেন “সৃষ্টিরাদ্যা বিধাতুঃ”।

 বর্ষমাত্র কালের জন্য নির্বাসিত পতি বিরহে সেই যক্ষ ললনার যে বিরহ বিধূর পরিম্লান পদ্মিনীর মত অশ্রু আবিল করুণ ক্লান্ত মুখখানি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে তুলনা করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কঠোর প্রভু আজ্ঞায় নির্বাসিত ও বন্দীকৃত পতিদের পত্নীরূপে সমস্ত আর্য্যাবর্ত ও দাক্ষিনাত্যবধূদিগের অবস্থা স্মরণ করে আমাদের অশ্রু সম্বরণ করা দুরূহ হয়ে ওঠে।[১৪]

 জানিনা তাদের জীবনের উপর এই অভিশাপ ভার কত যুগ ধরেই নিদারুণ রূপে চেপে থাকবে।[১৫]

 রত্নাবলী নাটকের বাসবদত্তা রাজা উদয়নের পট্টমহিষী বা পট্টমহাদেবী। নারী জনোচিত কর্ত্রীজনোচিত সতী জনোচিত একটি অপূর্ব সৃষ্টি! রাজা তাঁর রূপের প্রশংসা করে চাটু বাক্য প্রয়োগ করেন, তিনি ভ্রুক্ষেপও করেন না, এই পরিজন বৎসলার প্রত্যেক আজ্ঞাটি সযত্নে সুপালিত হয়, বাজী রেখে হেরে গিয়েও উওেজিত না হয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে থাকেন, “আর নবমল্লিকা দেখবার প্রয়োজন নেই, তোমার হাসি মুখই আমার পরাজয় সূচিত করছে!” এমন কি স্বামীকে অন্যাসক্ত জেনে কুপিত হলেও তৎক্ষণাৎ মুখ নত করে আত্মগোপন ও বাষ্প ব্যাকুল নেত্রকে অসীম মনোবলে শুষ্ক করে নে'ন। কটূকথা ওষ্ঠাধর ভেদ করে না। ঈষৎ ভেদকারী দৃষ্টিপাত মাত্র ক'রেই মাথা ধরার ছল করে সরে চলে যান। এ চরিত্র কাব্য ছেড়ে জগতেই দুর্ল্লভ! এমন আত্মদমনশীল, ধৃষ্টতায় উপেক্ষাকারিণী, অনুগ্রহপরায়ণা পরিজনবৎসলা মানুষী-দেবী,—যাঁর চরণ স্পর্শ করে পরিজনেরা শপথ গ্রহণ করে;—সূক্ষ্মদৃষ্টি দিয়ে না দেখতে জানলে এ চরিত্র সৃষ্টি করা যায় তার পক্ষে সম্ভবপর নয়।[১৬]

 তবে কথা এই যে এ চরিত্র শ্রীহর্ষের নিজস্ব পরিকল্পনা নহে, তৎপূর্ববর্তী মহা কবিদের পদাঙ্কানুসরণ প্রচেষ্টা তাঁর প্রত্যেক চরিত্রেই পরিস্ফুট এবং হয়ত সেটা একেবারেই অসঙ্গত ব্যাপারও নয়, যুগ-পতিদের কর্ম-প্রভাব মানুষের জীবনে এবং যুগকবিদের কাব্য-প্রভাব পরবর্তীদের রচনার মধ্যে জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে ছায়াপাত করবেই। মহাকবি ভাসের ‘স্বপ্ন বাসব দত্তা’র সুস্পষ্ট আভাষ আমরা পরবর্তী মহাকবি কালিদাসের ‘মালবিকা অগ্নি মিত্রে’ দেখতে পাই। আবার কালিদাসের সঙ্গে শ্রীহর্ষকবি ‘ছায়েব’ অনুবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। ‘মালবিকা' 'ধারিণী দেবী’ প্রভৃতি ‘রত্নাবলী’তে আরও বিকাশ প্রাপ্ত হলেও ভিতরের কাঠামো সেই একই। অথবা এই সব আর্য্য সমাজের আদর্শ নারীচরিত্র স্বাভাবিক ক্রমেই কতকটা সমপর্যায়ে এসে পড়তে বাধ্য, যদি একই বিষয়বস্তু নিয়েই কবি তাঁদের চরিত্র-চিত্রণে আত্মনিয়োগ করেন। সংস্কৃত নাট্যেও বর্তমান কালের চিত্রনাট্য কলায় যেমন দেখা যায়,—মনে হয় দর্শকেরা একঘেয়েমীই পছন্দ করতেন!

 রত্নাবলী চরিত্রে কবি কতকগুলি জটিলতার সমাবেশ ক'রে তাকে সাধারণ প্রলুব্ধা নায়িকার শ্রেণীতে অবনমিত করেননি। সিংহল রাজকন্যা রত্নাবলীকে রাজনৈতিক কারণে কৌশাম্বী রাজমন্ত্রী কূটনৈতিক যৌগন্ধরায়ণ কৌশাম্বীরাজ উদয়নের জন্য প্রার্থনা করেন, কিন্তু সিংহল পতি তার ভাগিনেয়ী অবন্তীরাজদুহিতা বাসবদত্তার রূপ গুণ তেজস্বীতার কথা স্মরণ করে তাঁর হাতে কন্যা দান করতে সম্মত হননি, কিন্তু পরে যৌগন্ধরায়ণের প্রচারিত বাসব দত্তার মিথ্যা মৃত্যু সংবাদে নিজ মন্ত্রীকে সঙ্গে দিয়ে জল পথে সুন্দরী কন্যারত্নটিকে বিয়ে দে'বার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। দৈব বশে জাহাজ ডুবিতে রত্নাবলী আত্মজনবিযুক্তা হয়ে দাসীরূপে পট্টমহিষীর নিকট প্রেরিতা হলেন। প্রেরক তাঁকে সমুদ্রতীরে কুড়িয়ে পাওয়ার কথা লেখাতে তাঁর নাম রাখা হলো সাগরিকা। পরিচয় তাঁর কেউ নে’য়ওনি, তিনি দে'নওনি।

 সাগরিকা দেখলেন যে ঘরে তিনি রাণী হতে পারতেন সেই ঘরেই তিনি দৈব দুর্বিপাকে দাসীরূপে প্রবিষ্ট হয়েছেন। 'দত্তা-কন্যা’ মনে মনে পূর্ব থেকেই উদয়নকে পতিরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন, এখন চোখে দেখে তাঁর সেই অ-দেখা প্রেম সত্যকার গভীরতা লাভ করা কিছুই এমন বিচিত্র নয়।

 তথাপি স্বভাব কোমলা দুর্ভাগিনী রাজকন্যা গোপনে দর্শন পিপাসা মিটাবার আশায় উদয়নের ছবি আঁকেন, আর আপনার অদৃষ্টকে ধিক্কার দেন, ছবি আঁকতে আঁকতে ঐ সর্বকলা বিশারদা নৃপসুতা আপন মনেই সঙ্গীত রচনা করতে করতে গুঞ্জন স্বরে গান করেন;—

“দুর্ল্লভ জন অনুরায়ো লজ্জা গুরুই পরবশো অপ্পা
পিঅ সহি বিসমং পেম্মং মরণং স্মরণং বরিঅ মেক্বং।”[১৭]

 সুশিক্ষিতা সারিকার মধ্য দিয়ে রত্নাবলীর এই ভীরু সকরুণ প্রেমকাহিনী প্রেমাস্পদের কর্ণগোচর না হ'লে নীরবেই তা' তার হৃদয়গুহার গোপন অন্ধকারে চির নিরুদ্ধ থেকেই যেত।

 সংস্কৃতকাব্যে এমন সব নারীচরিত্র কতই আছে, তাদের সম্যক পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। ভাসে কালিদাসে ভবভূতিতে মাঘে বাণভট্টে শ্রীহর্ষেই নয়, আরও কত ছোট বড় খ্যাত অখ্যাত লেখকের লেখনী কত ক্ষুদ্র বৃহৎ চরিত্রই না সৃষ্টি ক'রে তদানীন্তন ছোট বড় সমাজের একটি একটি আলেখ্য আমাদের সঙ্গে সুদূর অতীতের সম্বন্ধ সূত্র দিয়ে বেঁধে রেখে গেছেন। আমরা দেখে আশ্চর্য্য হয়ে যাই যে আজও আমরা তাঁদের সেই আমোঘ প্রভাব থেকে নিজেদের বিমুক্ত করতে পারিনি। অথচ কেন পারিনি, এর সন্ধান করতে গেলে দেখা যায়;— তাদের সৃষ্টি নরনারীর সম্বন্ধীয় পরিকল্পনায় কোনখানে অসম্পূর্ণতা রেখে দেননি, যেখানকার পাদপূরণ একান্ত নূতন করে করা যাবে।

 রাজা রাজড়া ছেড়ে জনসাধারণের জীবনচিত্র আমরা দেখতে পাই ভাসের চারুদত্তে এবং তারই বিশদ রূপ ব্যাখ্যা পরবর্তী শূদ্রক রচিত মৃচ্ছকটিক নাটকে। নায়িকা বসন্তসেনা নানা কলাবতী ও অশেষ গুণবতী। বঙ্কিম চন্দ্রের 'হীরা'র ন্যায় পদ্মপলাশলোচনা, মহাভারতের কৃষ্ণার ন্যায় সম্ভবতঃ নব কিশলয়শ্যামা সুন্দরী, এই গণিকাকন্যা মাতাকর্তৃক পুরুষাস্তর ভজনে আদিষ্টা হলে উত্তর দেন;—“মা যদি আমার বেঁচে থাকা চান, তবে এমন কথা যেন আর না বলেন।” বসন্তসেনা চারুদত্তকে ভালবাসে, সে অপবিত্র কুলে জন্ম নিলেও সুপবিত্রা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কতকগুলি বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে যাদের বহুতর চিত্র দিয়েছেন, সেই ‘সতী-অসতী'দের আদি জননী হলেও নিজস্ব গুণে এই বসন্তসেনা একটি অনবদ্য নারী চরিত্র।

 “আকরে পদ্মরাগানাং জন্ম কাচমনেঃ কুতঃ” এই প্রবাদ বাক্যকে ব্যর্থ করে পঙ্কোত্থিতা পঙ্কজিনীর মত সে বিকশিত ও সুরভিত হয়ে আছে। কিন্তু না! তাই বা বলি কি করে?

 বসন্তসেনার মা ব্যবসার দিক দিয়ে কন্যাকে উৎসর্গ করতে অনিচ্ছুক না থাকলেও তার চিত্তবৃত্তির দিকে একটুও উদাসীন ছিল না, তার কয়েকটি কথার মধ্য দিয়েই তা প্রকাশ পেয়েছে। এমন কি নিজের অসাধারণ রূপগুণবতী লোক ললামভূতা দুহিতার হত্যাপরাধে ধৃত চারুদত্তকে বিচারালয়ে দেখে বলে উঠেছে “আমার কন্যা উপযুক্ত পাত্রেই হৃদয়দান করেছে।”

 তাঁকে নিজকন্যার হত্যাপরাধ থেকে বাঁচাবার জন্য বসন্তসেনার অঙ্গচ্যুত অলঙ্কারগুলি চিনতে পেরেও না চেনার ভাণ করেছে এবং বিচারককে সুস্পষ্ট বলেছে;—“আমার কন্যার জন্য আমারইত বাদী হ’বার অধিকার, আমি এই মামলা পরিচালনা করতে চাই না, চারুদত্তকে মুক্তি দিন।”

 পরিশেষে সেই দীর্ঘশ্বাস;—“বাছারে আমার!”—অপূর্ব এবং বিচিত্র। একেই বলে চিত্রণ! কত ক্ষুদ্রের মধ্যে তুচ্ছের মধ্যে কত বড় বড় প্রাণ যে লুকান রয়েছে, তাদের সেই গোপনতা থেকে লোক-লোচনের গোচরে এনে সকলের জন্যই আদর্শ স্থাপন করা বড় লেখকের কর্তব্য। শুধু ক্ষণিকের ক্ষীণধারা রসসৃষ্টির মূল্য কটুকু? কাদম্বরীর উপনায়িকা মহাশ্বেতা বিশ্ব সাহিত্যের মধ্যের একটি অনবদ্য সৃষ্টি। আদ্যানারীর মতই শুভ্র পবিত্র জ্যোতিস্নাত অনবদ্যাঃ। এ চিত্রের প্রতিলিপি বা অনুলিপি আমরা পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। তার পত্রলেখাও বিচিত্র চরিত্রা। এই যুবরাজ-বান্ধবী মাটীর না পাষাণের? এমন নারী ত কখন কেহ দেখেছে বলে মনে হয় না। আগুনের পার্শ্ববর্তিনী এই ঘৃতভাণ্ড-স্বরূপা নারী জন্মান্তরীণ কোন উগ্র তপ প্রভাবে এমন সুসংযত নির্বিকার! এই তরুণী সত্যই বিশ্বের সবিস্ময় শ্রদ্ধাকর্ষণ কার উপযুক্তা? সংস্কৃত কাব্যনাট্টে তৎকালিক নর-নারীদের কবি-কল্পনার ছাঁচে ঢালা বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রচিত্র আমরা সাগ্রহে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, মানব মানবী মগধর্মকে গ্রহণ করতে স্বভাবক্রমে বাধ্য হলেও তাদের আকৃতির মত প্রকৃতিও সেই চিরন্তনীই থেকে থাকে।

 বত্রিশ সিংহাসনে, বেতালপঞ্চবিংশতিতে বহু নিকৃষ্ট চরিত্রের নারীর সৃষ্টি দেখা যায়, ভালমন্দ চিরদিনই আছে, একথা খুবই সত্য, তথাপি মন্দর প্রভাব সমাজে না বাড়লে সাহিত্যে কুচরিত্রের আমদানী মনে হয় কম থাকে। উপদেশ ও দৃষ্টান্তের তখনই বেশী দরকার হয় যখনই পূর্ববর্তীদের নৈতিক শাসন অক্ষুণ্ণ থাকছে নাা দেখা যায়।

 বিশালভঞ্জিকা, প্রবোধচন্দ্রোদয় প্রভৃতি আধ্যাত্মিক চরিত্র নিয়ে লেখাা কালিদাসের কুমারসম্ভবের ‘উমা’ ‘মেনা’ ‘রতি' মেঘদূতের বিরহিণী ‘যক্ষ-জায়া’ এঁদের কথা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং চিরদিনই হবে। প্রতি ক্ষুদ্র নরনারী ও তাঁর অমর তুলিকায় অমর হ'য়ে রয়েছে।

 ভারতীয় সাহিত্যের তপোবনে ও উপবনে, সংস্কৃতে, পালিতে, প্রাকৃতে ও বাংলায় এবং পারিভাষিক অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় এ পর্যন্ত বহু নারীচরিত্র নিছক নরকল্পনায় প্রসূত হয়েছে; তার মধ্যে সর্বপ্রথম কোন্ ভক্ত-হৃদয়-সরসীতে, কোন কবি-কল্পনার মানসসরোবরে শ্রীরাধারূপিণী রাধাপদ্মটী ফুটে উঠেছিল, জানা নেই, কিন্তু সেই অপূর্ব সৃজনী-শক্তির আন্তরীক প্রশংসা না করে থাকা যায় না। এই রাধা দেবী নহেন, তিনি মানবী। গোপরাজকুলে এঁর জন্ম,—জন্ম অবশ্য মানবীয় ক্রমে নয়; রাধা-পদ্মের মধ্যে অযোনিজা-কন্যারূপেই। সীতা প্রমুখের সঙ্গে এঁর জন্মসূত্রে মিল থাকলেও কর্মসূত্রে মিল আদৌ নেই। গোবিন্দদাসের মতে, তিনি—
“ব্রজরমণীগণমুকুট মণি”,
 অনন্তদাসের মতে,—
“কনকলতা জিনি, জিনি সৌদামিনী”—
 উদ্ধবদাসের মতে তাঁর রূপ,—
“অবণী উয়ল থির বিজুরি জিনি”—

 জয়দেবের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে এই বলে তোষণ করছেন;−

“ত্বমসি মম ভূষণম্ ত্বমসি মম জীবনম্, ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্।
ভবতু ভবতীহ ময়ি সততমনুরোধিণী তত্র মম হৃদয়মতি যত্নম্।”

 রাধা ভগবানের হ্লাদিনী শক্তির প্রতিমূর্ত্তি; পুরুষ-বিযুক্তা প্রকৃতির গভীর রহস্যময় স্বরূপ সন্ধান ভক্তসাধক রাধার মধ্যেই কি অপূর্ব ইঙ্গিতে প্রদান করেছেন! বিশ্বসাহিত্যের উচ্চতম বহু অধ্যায় প্রেম সাধনায় চির-বিজয়িণী ‘থির বিজুরি কাঁতি' ‘নমূঞা বদনী ধনি’, যিনি কথা কইলে মনে হয়;—‘অমিয় বরষে যেন শরদ পূর্ণিমা নিশি’,—যাঁকে ইক্ষণ করে সহস্র গোপিনীর প্রার্থিততম শ্যামচন্দ্র কবি বিদ্যাপতির মুখ দিয়ে বলেছেন;—

“যাঁহা যাঁহা পদযুগ ধরই, তাঁহি তাঁহি সরোরুহ ভরই,
যাঁহা যাঁহা ঝলকত অঙ্গ, তাঁহা তাঁহা বিজুরি তরঙ্গ।
কি হরন্স অপরূপ গোরি, পৈঠল হিয়া মাহ মোরি॥”

 তাঁকে উপলক্ষ করে রচিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ত কথাই নেই; ব্রজবুলির কল্যাণে ভারতীয় সাহিত্যেরও ইনি অপূর্ব গৌরবোজ্জ্বল এক সম্পদ। সেই সর্বসমাদৃতা কিশোরী, কবি শিরোমণি চণ্ডীদাসের শ্রীরাধা ‘শ্যাম’ এই নামটুকুই গুরুমন্ত্রের মত যেন কার কাছ থেকে শুনতে পেয়েছেন,—সম্ভবতঃ মন্ত্রসিদ্ধ গুরুই তিনি হবেন, নতুবা মন্ত্রশক্তির এমন অব্যর্থ প্রভাব হয় কি করে? সখির গলা ধরে বলছেন।—

“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম!
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো,
আকুল করিল মোর প্রাণ,
না জানি কতেক মধু শ্যাম নামে আছে গো,
বদন ছাড়িতে নাহি পারে,
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো,
কেমনে পাইব সই তারে?”

 আবার জল আন্‌তে গিয়ে চাক্ষুষ সাক্ষাৎ ঘটতেও বাকি রইল না। আর কি রক্ষা আছে! ব্যাকুল বিস্ময়ে জানাচ্ছেন;—

“সই, কি হেরিনু যমুনারি কুলে,—
ব্রজকুলনন্দন হরিল আমার মন, ত্রিভঙ্গ দাঁড়ায়ে তরুমূলে।”

বিদ্যাপতির রাধা প্রিয়-সন্দর্শন-সুখে উচ্ছ্বসিতা হয়ে বলেন;—

“আজু রজনী হাম ভাগ্যে পোহায়িনু, পেখনু পিয়ামুখচন্দা।
জীবন যৌবন সফল করি মানিনু, দশদিক ভেল নিরদন্দা।
আজু মঝু গেহ গেহ করি মানিনু আজু মঝু দেহ ভেল দেহা,
আজু বিহি মোরে অনুকূল হোয়ল, মিটল সবহুঁ সন্দেহা।”

 আবার ক্ষণপরেই মন খুঁৎ কাড়ছে;—

“সজনি, ভাল করি পেখন না ভেল,
মেঘমালা সঞে তড়িৎলতা জনু হৃদয়ে শেল দেই গেল।”

 বিরহ অবস্থায় গোবিন্দদাসের রাধা প্রকৃতির যে সমস্ত সুখময় উপাদানকে উপদ্রব ভেবে সাভিমান তিরস্কার জানিয়েছিলেন;—

“সেই মুখচাঁদ নয়নে নাহি হেরল, নয়ন দহন ভেল চন্দা,—
সেই মধুর বোল শ্রবণে না শুননু মধুকর ধ্বনি ভেল মন্দা।”

 সেই তিনিই এখন আনন্দে ভরে গিয়ে কেমন উদারতার ছড়াছড়ি করছেন, দেখুন;—

“সেই কোকিল অব লাখ ডাকই লাখ উদয় করু চন্দা,—
পাঁচ বাণ অব লাখ বাণ হউ মলয় পবন বহু মন্দা”

 এই গভীর প্রেম যখন অনাদৃত হয়েছে বলে মনের মধ্যে সন্দেহ জাগে, তখন প্রেমিকার অভিমানের সীমা থাকে না। জ্ঞানদাসের রাধা বিশ্বাস হন্তা প্রেমিকের সন্দেহজনক ব্যবহারে ভগ্নচিত্তে আত্মাভিব্যক্তি করছেন,—

“বন্ধুর লাগিয়া সব তেয়াগিনু লোকে অপযশ কয়,
এ ধন আমার লয় অন্যজনা ইহা কি পরাণে সয়?
সই, কত না ধরিব হিয়া,
আমারই বঁধুয়া আন্ বাড়ী যায়, আমারই আঙিনা দিয়া।
যেদিন দেখিব আপন নয়নে আনজন সঙ্গে কথা,—
কেশ মুড়াইয়া বেশ দূর করি ভাঙিব আপন মাথা।”

 কি আশ্চর্য! এই রাধা মেয়েটীর গ্রাম্য নারীর মত কলহ কাকলীর সঙ্গে গালি দিতেও যে বাধে না;—

“আমার বন্ধু হিয়া এমন করিলে, না জানি সে জন কে?
আমার হৃদয় যেমন করিছে, এমনই হউক সে।”

 এ-ও বলেছেন। তা’ অভিমান তো হতেই পারে। প্রিয়মিলনের জন্য কত ক্লেশ, কত বাধাই যে কাটাতে হয়েছে, সঙ্কেত ভূমে আগমনে কি কম কষ্টটা স্বীকার করতে হয়েছে ওঁকে! কবিশেখরের রাধার;—

‘‘গগনে অব ঘন, মেহ দারুণ, সঘনে দামিনী ঝলকই,
কুলিশ পাতন, শবদ ঝনঝন, পবন খরতর বহয়ই।
সজনি, আজি দুরদিন ভেল,
হামারি কান্ত নিতান্ত আগুসরি, সঙ্কেত কুঞ্জহি গেল।
তরল জলধর, বহিছে ঝরঝর, গরজে ঘন ঘন ঘোর
শ্যাম নাগর, একলি কৈছনে, পন্থ হেরই মোর।”

 এমন কত ঋতুর কত বাধা ঠেলে যদি নরোত্তমদাসের রাধার মত শূন্য কুঞ্জে প্রহর গুণে রাত কাটিয়ে আক্ষেপ করতে হয়;—

“বন্ধুর সঙ্কেতে আমি এ বেশ বানানু গো”,
সকল বিফল হল মোয়।”

 তার উপর যদি সমানুভূতিপূর্ণ চিত্ত নিয়ে প্রিয় সখি পাশেই ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে বলরামদাসের রাধা কি করে হতাশচিত্তে না বলেন;—

“ত্যজ সখি নিঠুর নটবর আশ,
যামিনী শেষ হ’লে সকলই নৈরাশ,
তাম্বুল চন্দন গন্ধ উপহার, দূরহ ডারয় যামুন পার।”

তা’ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধাও ঠিক এই কথাই তো বলেছেন;—

“এ ধন যৌবন সকলি অসার, ছিণ্ডিয়া ফেলব গজ মুকুতার হার,
মুছিয়া ফেলব সিঁথির সিন্দুর।” ইত্যাদি

 আর ঐ সব প্রিয় সম্ভার ত আর সহজে সংগৃহীত হয়নি, বর্তমান কালের ব্ল্যাক্-মার্কেটে কেনার মতই ‘কত না যতনে কতনা গোপনে’ জোগাড় করে আনতে হয়েছিল! কাজেই একান্ত অসময়ে আসা প্রিয়তমকে বাহুবন্ধনে গ্রহণ না করে বলরাম দাসের রাধা যদি আশাহতার মর্মজালায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে তীব্রকণ্ঠে বলেই থাকেন;—

 “ধিক রহুঁ মাধব তেহারি সোহাগ, ধিক্‌ রহুঁ যো ধনী তাহে অনুরাগ”—তো খুবই অন্যায় করেন নি!

 আবার এতেই কি মেটে! এত আর শুধু মুখের প্রেম নয়, প্রাণের যে! তাই রাইয়ের এখন;—

 “মান গিয়ে বিরহ এলো, ধনীর কৃষ্ণ মুখ মনে প’লো’’

 কিন্তু তখন ও এই অভিমানিনীর মদীয়তার শেষ হয়নি। সখিদের গঞ্জনার উত্তরে চন্দ্রশেখরের রাধা ভ্রুকুটিবদ্ধ ললাটে ঠোঁট ফুলিয়ে প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন;—

“পায় পড়ল হরি, পায় পড়ল হরি, পায় পড়ল হরি তো’র,
সবে মিলি ঐছন বোলসি পুনঃ পুনঃ, কোইনা বুঝল দুঃখ মোর।
দুঃখ কাহে কহব মায়ী, পায়ে পড়ল বলি, কিয়ে হাম তৈখনে
অম্বরে উঠায়ব ধাই?”

 কিন্তু এ মান কতক্ষণই বা থাকে? প্রাণাধিকের মন-গলান “প্রিয়ে চারুশীলে! মুঞ্চ ময়ি মানমনিদানম্‌” এবং তা’তে ও মানিনীর মান ভাঙ্গাতে না পেরে পরিশেষে সেই সর্ব-কবিজনসম্মত “দেহি পদপল্লবমুদারম্‌ ‘‘বলে চরণতলে লুটিয়ে পড়া; এতে ও যার দুর্জ্জয় মানের পাহাড় ভাঙ্গেনি, প্রিয়তমের একটুখানি অদর্শনমাত্রেই পুরুষোত্তম দাসের সেই রাধার অবস্থা নিদারুণতর হয়ে উঠলো,আর্তকণ্ঠে বললেন;—

“কালিন্দী পৈঠি পরাণ ত্যজিতে যব,
এই মনে অভিলাষে, দারুণ হুতাশে,
আপন শির হাম আপনিহি কাটনু,
কাহে করমু হেন মান।”

 গোবিন্দদাসের রাধিকা ত আকুল উচ্ছ্বাসে কেঁদেই উঠলেন;—

“কি ছারমিছার মানের লাগিয়ে বঁধুর হয়েছিলাম!”

 আবার আকুল ব্যাকুল হ’য়ে কাঁদছেন, আর বলছেন;—

‘আমার বঁধুর মতন মধুর, এমন বঁধু কার বা আছে?”

 জয়দেবের রাধার খুব কঠিন বিরহ-বিকারের সংবাদ সখিদূতীরা প্রত্যাখাত প্রার্থিতকে শোনাতে ছুটলো। রাধার অবস্থা তখন উঠে হেঁটে ছুটে যাবার মতই নেই। আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে অর্বাচীন কবির রাধা বলছেন;—

“দারুণ মানের ভরে করেছি তার অপমান।
মানেতে হইয়া হত কুবাক্য বলেছি কত’’

 সুযোগ্যা সখী গুরু-মন্ত্রদাতা পরম বান্ধবের মতই এই বিরহ-পারের মিলন-সেতু রচনা করে সহানুভূতি উদ্রেককর এই বার্তা গিয়ে শোনাচ্ছেন,—

“রাধিকা বিরহে তব কেশব—
কৃশতনুরিবভারম্‌।
হরিরিতি হরিরিতি জপতি অশেষম্‌—
বিরহবিহিত মরনেন নিকামম্‌।”

বিরহিনীর বিরহ-দুর্দ্দশা বর্ণনা করতে বিদ্যাপতির সখিরাও বড় একটা কম যান না। তাঁরা কত বিভঙ্গেই তাঁদের সখির অবস্থা বর্ণনা করছেন দেখুন না;—

“মাধব কত পরবোধব রাধা,
হা হরি, হা হরি, কহতহি বেরি বেরি, অব জিউ করব সমাধা।
ধরণী ধরিয়া ধনি যতন হি বৈঠত, পুনহি উঠতি নাহি পারা।”

ঘনশ্যাম দাসের সখিরাও আবার এইসঙ্গে যোগ দিয়ে দিলেন;—

‘‘সুচির বিরহে যব ক্ষীণ কলেবর—
বিগলিত ভূষণ বেশ,
আছয়ে তোহারি পরশরস লালসে—
কেবল জীবন শেষ।”

 এই ত কাণ্ড! অথচ যেই প্রিয় সন্দর্শন হ’ল, আর মান অভিমান রইল না; চণ্ডীদাসের রাধা গদ্‌গদ্‌স্বরে বলতে লাগলেন;—

“বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে,
দেখা না হইত পরাণ গেলে,
এতেক সহিল অবলাবলে,
ফাটিয়া যাইত পাষাণ হ’লে।”

বলতে বলতেই মনে হ’ল এ বড় স্বার্থপরের মত কথা বলা হচ্ছে। অম্‌নি সামলে নিয়ে ক্ষীণ হাসিটুকু হেসে অথচ রাধামোহনের দৃষ্টি দিয়ে দেখলেই দেখতে পাওয়া যাবে,—দরশনে নয়নে নয়নে বহু লোর”, এবং ‘‘গদগদ কানু কন নিকসত বাত,” তা’ কোনরকম ক’রে কুশলবার্ত্তাটা নিলেন;—

“দুঃখিনীর দিন দুঃখেতে গেল, মথুরানগরে ছিলে ত ভাল?”

আবার বলছেন,—

“শুনহে পরাণ বঁধু!
কতদিন পরে পেয়েছি তোমারে, চাহিয়া রহিব শুধু।”

 বৈষ্ণব সাহিত্যের রাধা সাহিত্যোদ্যানের অপূর্ব সৌরভে পরিপূর্ণ গৌরবোজ্জ্বল রাধা-পদ্ম,—বিশ্ব-প্রকৃতির, তথা বিশ্ব-নারীর প্রতীক। এ প্রেম যেমন মধুর তেমনই রহস্যময়। ভক্ত কবিগণ স্বয়ং রাধাভাবে বিভোর হ’তে পেরেছিলেন বলেই তাঁদের লেখনী হ’তে নিঃসৃত হ’তে পেরেছিল সেই সব অমিয় মধুর মহত্তর বাণী;—

“বঁধু, তুমি সে আমার প্রাণ
দেহমন আদি তোমারে সঁপেছি কুলশীল-জাতি মান।’’
এবং
“অনেক সাধের পরাণ বঁধুয়া নয়নে লুকায়ে থোব,
প্রেমচিন্তামণি রসেতে গাঁথিয়া হৃদয়ে তুলিয়া লব।”

 মর্ম দিয়ে নারীচরিত্রের নিগুঢ়তম বার্তা না বুঝ্‌লে পুরুষকবিদের করুণরসাত্মক এই সব অপূর্ব রচনা বহু শতাব্দী ধরে লক্ষ লক্ষ নর-নারীর চিত্ত বিগলিত করে রাখতে পারত না।

‘জনম অবধি হাম রূপ নেহারিনু, নয়ন না তিরপিত ভেল,
লাখ লাখ যুগ হিয়া পর রাখনু, তবু হিয়া জুড়ন না গেল।”

 বিদ্যাপতির এই পদ অতৃপ্ত মানবাত্মার এবং সর্বস্ব-সমর্পিতা সতীচিত্তের প্রতিধ্বনি।

 প্রেমময়ী রাধা প্রেমাষ্পদের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন, মৃত্যুকে বরণ করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। তিনি জানেন প্রেমই নারীর প্রাণ, তাই বলেছেন;—

“বঁধু কি আর বলিব আমি
জীবনে মরণে  জনমে জনমে
প্রাণনাথ হইও তুমি।
তোমার চরণে  আমার পরাণে
বাঁধিলে প্রেমের ফাঁসি
সব সমর্পিয়া এক মন হইয়া
নিশ্চয় হইলাম দাসী।”

 প্রেমের পরাকাষ্ঠা লাভ তখনই হয়, প্রেমিক যখন অন্তর থেকে বলতে পারে;—

“শ্যাম অনুরাগে এ দেহ সঁপিনু তিল তুলসী দিয়া।”

 কৃষ্ণ-বিরহিনী রাধার সমস্ত সংসার শূন্যময়। জীবন যৌবন সমস্তই ব্যর্থ, চোখের সামনে তিনি দেখছেন সমস্তই যেন কৃষ্ণময় হয়ে গেছে;—

‘কৃষ্ণ কাল, তমাল কাল, ভাই তমাল বড় ভালবাসি”—

বলে তমাল বৃক্ষকেই নিবিঢ় আলিঙ্গনে নিবদ্ধ করছেন, কাঁদছেন আর স্বগতই সন্দেহাকুলচিত্তে বলছেন;—

“কৈছে গোঙাওব হরি বিনা দিন রাতিয়া?”

 আবার ভাবে বিভোর হয়ে বলছেন;—

‘‘যাঁহা যাঁহা অরুণ চরণ চলি যাত,
তাঁহা তাঁহা ধরনী হই মজু গাত।
এ সখি বিরহ সরণ নিরানন্দ
ঐ ছনে মিলই যব গোকুল চন্দ।”

 —তাঁর চরণ যেখানে পড়বে আমার অঙ্গ যেন সেখানকার মৃত্তিকা হয়, মৃত্যুর পর সখি গো, আমি আবার গোকুলচন্দ্রকে ফিরে পাব।

 বৈষ্ণব কবি জগতের চিরন্তনী নারীর মধ্য দিয়ে সম-নিষ্ঠ সাধকের ভগবৎ মিলন-মঙ্গলের নীতিমাল্য রচনা করেছেন। নারীপ্রেমের নৈষ্ঠিক একত্মতা তাঁদের অজ্ঞাত থাকলে এ সৃষ্টি সফলতা লাভ করতো না। অন্যত্র অনেক কিছুই সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও রাধা সৃষ্টি হয়নি।[১৮]

 ময়নামতী চরিত্র বাস্তব ঐতিহাসিক চরিত্র বলেই অনেকের বিশ্বাস, তবে সাহিত্যে তাঁর আসল রূপ কিছু বদলেছে কি না বলা শক্ত। তাঁর স্বামী তাঁকে বিশ্বাস করতেন না, সিদ্ধযোগী হাড়িপার সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা তাঁর ছেলে বৌ পর্যন্ত ভাল চোখে— দেখেন নি। রাজ্যেশ্বর পুত্রকে তিনি সন্ন্যাস নিতে বাধ্য করেছিলেন, তার মধ্যে মদালসা বা ধ্রুব-জননী সুনীতির মত কোন মহৎ আদর্শ ছিল না। তিনি সুপণ্ডিতা ছিলেন এবং প্রভুত্বের ও প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে অনিচ্ছুক পুত্রকে রাজ্যত্যাগ করিয়ে হাড়ির অনুচর করেছিলেন, কিন্তু পাঠকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারেন নি। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যের দেবীচরিত্রগুলিকে যদি নারীচরিত্র রূপে ধরা হয়, তা’হলে আমাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হতাশ হতে হবে। দুর্গা, মনসা, মঙ্গলচণ্ডী প্রভৃতি দেবীরা সকলেই ছলে বলে কৌশলে অন্যের ভক্তকে ভাঙ্গিয়ে নিজের পূজা আদায় করতে ব্যস্ত। তার জন্য কোন কিছুতেই তাঁদের আটকায় না। দেবীর ভক্ত মহাপাপী হলেও পার পেয়ে যায় আর যিনি তাঁর পূজা দিতে অস্বীকৃত হন, তিনি ভালো লোক হলেও তাঁর দুর্গতির পরিসীমা থাকে না। এই যুগের মানবী চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কবিকঙ্কণের চণ্ডী-কাব্যের নায়ক কালকেতুর পত্নী ফুল্লরা এবং ধনপতির পত্নী লহনা ও খুল্লনা, মনসামঙ্গলের লক্ষ্মীন্দরের পত্নী বেহুলা। ধর্মমঙ্গলের লাউসেনের মা রঞ্জাবতী, পত্নী কলিঙ্গা এবং কানাড়া, কানাড়ার দাসী ধূমণসী এবং কালুডোমের পত্নী লখাই,—প্রভুর কার্যে যে দুই পুত্র পতি এবং অবশেষে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল, এই সকল চরিত্রগুলির মধ্যে সাহিত্যের ভিতর দিয়ে তাৎকালীন সমাজের চিত্র অনেকটাই পাওয়া যায়, তবে অতিরঞ্জনের একটা বিশেষ ছাপ প্রত্যেকটি চরিত্রেই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে; যা হলে ভালই হতো, তবে হয়েছিল কি না;—অর্থাৎ যতটা বলা হয়েছে ঠিক ততটাই হয়েছিল কি না;—তাতে সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ বর্তমান আছে। সমস্তটাই অপ্রাকৃত না হলেও অতি প্রাকৃত নিশ্চয়ই।

 এ-দেশে ছড়াগানের ছড়াছড়ি, ব্রতকথারও শেষ নেই! “জয়মঙ্গলবারের” জয়াবতীর উপাখ্যানে, “মনসার ভাসানে” লক্ষ্মীন্দর ও বেহুলার কাহিনীতে ইতুকথার উম্‌নো ঝুম্‌নোর গল্পগাথায়, বিভিন্ন লক্ষ্মীপূজায় ও ষষ্ঠীপূজায় নারী-দেবী ও নারীমানবীদের অনেক কীর্ত্তিকলাপ বাংলার ঘরে ঘরে আজও বিঘোষিত হচ্ছে। লহনা ও খুল্লনার কলহ-চিত্রে সে-কালের সতা-সতীনের ঘরকন্নার ছবিগুলি সুপরিস্ফুট। আবার তাদের রাঁধা-বাড়ার খাওয়ান দাওয়ানর ছবিগুলিতে বাংলার নারীর চরিত্র-চিত্র অতি সমুজ্জ্বল। শুভচণ্ডী বা সুবচনীর খোঁড়া হাঁসের কথায় দরিদ্রা বাল্‌তি বাম্‌নীর ভক্তিনিষ্ঠায় পরিতুষ্টা দেবী মাহাত্ম্যের এবং সত্যনারায়ণের ব্রতকথায় বণিককন্যা কলাবতীর ভক্তিতে দেবপ্রসন্নতা লাভ প্রভৃতি নানা বিষয়ের মধ্য দিয়ে আমরা তাৎকালীন সমাজকে মধ্যে মধ্যে সুস্পষ্ট রূপে দেখতে পেয়েছি। লহনার সখি লীলাবতী একটি দুমুখো সাপ, দাসী দুর্বলা মন্থরারই সমপর্যায়ের, এঁরা যুগে যুগেই যে অবতীর্ণা হ’ন, তা’ আমরা দেখেছি। জলপথে বণিকরা বাণিজ্য করতে যেতেন, ঘরে থাকতেন তাঁদের বিরহিনী তরুণী স্ত্রীরা। তাঁরা মনের দুঃখে “বারমাস্যা” অর্থাৎ বারমাসের দুঃখগাথা তৈরী করে দরদী পেলেই শুনিয়ে দিতেন। এই রকমের অশ্রু-ভেজা বিরহগীতি প্রাচীন সাহিত্যে যথেষ্টই আছে। পল্লী-সাহিত্যের এই সকল গান আধুনিক প্রেমগীতির সঙ্গে একই পর্যায়ের এবং প্রাচীন বৈষ্ণবসাহিত্যের রাধাকৃষ্ণের বিরহগীতির মতই মর্মব্যথার স্বতঃস্ফূর্ত্তি। জগতের সমস্ত প্রিয় বিরহিতদের অন্তর্বেদনা নিয়ে এরাও সৃষ্ট হয়েছে।

 শচীনন্দন দাসের রাধা সখির কাছে তাঁর বিরহী জীবনের বারমাসের অসহ্য কষ্ট ব্যক্ত করছেন, তার সবটাই নয়, আমরা এখানে সামান্য একটুখানি মাত্র তুলে দিচ্ছি; শুনলে আপনারাও সহানুভূতি না ক’রে থাকতে পারবেন না;—

“ইহ মত্ত দাদুরী নোল, দামিনী চমকি ঝলকিত কাঁতিয়া,—
মেহ বাদর বরিখে ঝরঝর, হামারি লোচন ভাতিয়া
দেই ছোড়ি নহি, বাহিরায় সো মুখ চাঁদ অবমেহি পেখিয়া।”

 সীতার বারমাস্যায় বনবাসের ক্লেশ বর্ণিত হয়েছে, এটি ঠিক অন্যান্য বারমাস্যার লক্ষ্মণাক্রান্ত নয়। সীতা দেবী সখিজনের কাছে অতীত দিনের বনবাসক্লেশের কথা বলছেন;—

“বৈশাখ মাস হইল বাড়িল দিন আর,—
প্রখর হইল রৌদ্র অতি খরতর।
চলিতে না পারি দেখি কমললোচন,
বৃক্ষ নিচে বৈসে কান্দে দুঃখের কারণ।”

 শ্রীমন্ত সদাগরের সিংহলদেশীয়া পত্নী সুশীলা তাঁহাকে গৃহ প্রত্যাবর্তনে নিবৃত্ত করবার জন্য বারমাসের সুখভোগের নানা প্রলোভন দেখিয়েছিলেন;—

“বৈশাখে চন্দনাদি তৈল দিব সুশীতল করি,
সাঙ্গালি গামছা দিব ভূষণে কস্তুরি।
জৈষ্ঠে পুষ্পশয্যা করে দিব চাঁদোয়া টাঙ্গায়ে
হাস্যপরিহাসে যাবে সজনী গোঙায়ে।”

 কবিকঙ্কণের ফুল্লরা বা খুল্লনার বারমাস্যা এ-জাতীয় নয়। শ্রীরাধার ও খুল্লনার বারমাস্যা প্রকৃত বিরহকাব্য। এদের অনুসরণে বাংলায় বহু বারমাস্যা রচিত হয়েছে। ফুল্লরার বারমাস্যা কোটি কোটি দারিদ্র্য অধ্যুষিত দুর্ভাগিনী ভারতনারীর স্বরূপ চিত্র;—

 ভাঙ্গা কুঁড়্যা ঘর, তালপাতার ছাওনা,—

“ভেরেণ্ডার থাম ওই আছে মধ্য ঘরে,
প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।’’

“বৈশাখের অগ্নিসম খরা তরুতল নাহি মোর করিতে পসরা,
পায়ে পোড়ে খরতর রবির কিরণ,
মাথায় দিতে নাহি আঁটে খুঙার বসন
বৈশাখ হইল বিষ গো বৈশাখ হইল বিষ,
মাংস নাহি খায় সর্বলোক নিরামিষ।
পাষণ্ড জ্যৈষ্ঠমাস, পাষণ্ড জ্যৈষ্ঠমাস,
বেঙচের ফল খাইয়া করি উপবাস।

মাংসের পসরা লইয়া ফিরি ঘরে ঘরে
কিছু ক্ষুদ্র কুঁড়া পাই উদর না পুরে
ভাদ্রপদ মাসে বড় দুরন্ত বাদল
বৃষ্টি হইলে কুঁড়্যায় ভাস্যা যায় জল।”

অভাগিনী ফুল্লরার দুঃখের সীমা নেই। সবাই দেবীর প্রসাদ খায়, বৃথা মাংসের চাহিদা আশ্বিনে থাকে না। হেমন্তের শীতে ফুল্লরা শ্রেণীর হতভাগ্য নরনারীদের বস্ত্রাভাবে যে কত দুঃখ সে তারা ছাড়া আর কে বুঝবে? পৌষ মাসের শীতে হরিণ মাংসের বদ্‌লা পাওয়া পুরাতন খোস্‌লা তা’ এমন ধূলি ধূসরিত হয়ে গেছে, যে গায়ে দিলে চোখ চাইবার উপায় থাকে না। এই তো তাদের দশা। ফাল্গুন চৈত্রেও ঐ একই কাহিনী। পায়ে তাপ, মাথায় রোদ উদরে ক্ষুধার দাহন। বাংলার,—তথা ভারতের মূর্তিমতী দুঃখ ভারাতুরা নারী! চির বুভুক্ষায় কঙ্কাল সার, মৃত্যু-সীমানার মধ্যে প্রবিষ্ট হ’তে পাদ মাত্র বাকী, অথচ কোন মহামন্ত্রের সিদ্ধিতে লোভ মোহের অতীত বুদ্ধি, অন্তর ঐশ্বর্যে মহীয়সী গরীয়সী। অতুল ঐশ্বর্যের প্রলোভনেও একান্ত অনড়। এরা ধর্মকে পশুমাংসের মত ওজনদরে বেচেনা। পশু বলি দেয় এবং সেই সঙ্গে নিজের পশুত্বকেও এরা বলি দিয়ে দিয়েছে। উচ্চ শ্রেণীর মত, দুলালী ধনীকন্যাদের মত সে শিক্ষিতা হয়নি। তাই বুদ্ধি বুঝি তার এমন অপরিপক্ক? নিজের ভাল বোঝবার সাধ্য হয়ত তার নেই। পতি-পত্নীর সমান অধিকার সে জানেনা। দারিদ্র্যে পিষ্ট হয়েও সে স্বামীকে ছেড়ে পালায় না। উলটে সুন্দরী নারীর প্রলোভনে পড়ে তার ঐশ্বর্যের লোভে পাছে স্বামী ধর্মচ্যুত হয়, সেই ভয়ে কাঁদতে বসে। আবার সেই সজল চক্ষের বাড়বাগ্নি জ্বেলে স্বামীকে কঠোর কণ্ঠে তীব্র ভর্ৎসনা করে;—

“কি লাগিয়া বীর এবে পাপে দিলে মন?
যেই পাপে নষ্ট হইল লঙ্কার রাবণ।
পিঁপিড়ার পাখা ওঠে মরিবার তরে,
কাহার ঘোড়শী ভার্য্যা আনিয়াছ ঘরে?”

 আবার ছদ্মবেশিনী দেবীকেও উপদেশ দেয়;—

“তোরে আমি বলি ভাল,  স্বামীর বসতি চল,
পরিণামে পাবে বড় দুখ।
শুন হের মূঢ় মতি  যদি ছাড় নিজ পতি
কেমনে তরিবে লোক মুখ॥

স্বামী সন্তোষে বসায়ে খাটে,  অপরাধে নাক কাটে,
দণ্ডরাজা বনিতার পতি।
শুন গো শুন গো সই,  হিত উপদেশ কই,
ইতিহাসে কর অবগতি॥

তোরে দেখি যে উত্তম জাতি,  দেবতা সমান কাঁতি
কার্য্য কর নিচের সমান।
ছাড়িয়া পতির পাশ,  আইলা পরের বাস
আপনার কি সাধিতে মান!”

 ব্যাধ-পত্নী চরিত্রের সর্বাঙ্গীন পরিপূর্ণতা আমাদের অতি বিস্ময়ে জানিয়ে দেয়, ভারতীয় সমাজের সর্বনিম্নস্তরেও সে সব দিনে সতীধর্মও ধর্ম-প্রাণতা কতখানিই প্রসার লাভ করেছিল।

 বেহুলার পাতিব্রত্য ও অসম সাহসিক প্রচেষ্টা সর্বজন সুবিদিত। লক্ষ্মীন্দরের মাতা সনকা সমস্ত সন্তান হারিয়েও স্বামীর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধতা না করে সহধর্মিণী শব্দের মর্য্যাদা রক্ষা করেছিলেন।

 দেবী দত্ত ধন পেয়ে কালকেতু নগর পত্তন করে রাজা হ’য়ে বসেছেন। পাঁচজনের কাণ ভাঙ্গানীতে কলিঙ্গেশ্বর যুদ্ধে কালকেতুকে বন্দী করালে। ফুল্লরা গলায় কুঠার বেঁধে কোটালের কাছে মিনতি জানাচ্ছেন, সেখানেও তার একটী অতি সুন্দর ছবি দেখতে পাওয়া যায়;—

“না মার না মার বীরে নির্দ্দয় কোটাল।
গলার ছিঁড়িয়া দিছি শতেশ্বরী হার॥

গো মহিষ ধান্য লহ অমূল্য ভাণ্ডার।
সেবক করিয়া রাখ স্বামীকে আমার॥

বিচারিয়া দেখ অপরাধ নাহি করি।
নিজে ধন দিয়া চণ্ডী বসাইল পুরী॥”

 বিপদে, সম্পদে ফুল্লরা স্বামীর সত্যকার সহধর্মিণী। আর একটী বাংলার খাঁটী সমাজ চিত্র চণ্ডীকাব্যের ধনপতি সওদাগরের উপাখ্যানে। লহনা খুল্লনা দুই সতীনের ঝগড়া বিবাদে দুর্বলা রূপী মন্থরাদাসীর উভয় পক্ষের কান-ভাঙ্গানী, ফলে প্রবলের হাতে দুর্বলের নির্য্যাতন, পরিশেষে ধর্মের জয়। স্বামী বশ করার ঔষধ পত্র করা, বেশ প্রসাধন, রাঁধা বাড়ার ফর্দ, সব মিলে অনতিক্রান্ত বর্তমানকেই যেন চোখের সাম্‌নে দেখা যায়।—

‘‘দু সতীনে প্রেমবদ্ধ দেখিয়া দুর্বলা।
হৃদয়ে ধরিল চেড়ীর কালকূট জ্বালা॥”

 এইখানেই রামায়ণের মন্থরার মতই সে গেল লহনার কাছে, বিষ ঢালতে;—

“শুদ্ধমতি ঠাকুরাণী নাহি জান পাপ।
দুগ্ধ দিয়া কি কারণে পোষ কাল সাপ॥”

 অষ্টাদশ শতাব্দীর কবিগণের মধ্যে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর স্বনামধন্য। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক সকল প্রকার ছবিই তিনি এঁকেছেন। বঙ্গবীর প্রতাপাদিত্যের উত্থানপতন, নদিয়ারাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের কাহিনী, শিব-শক্তির সম্মিলন গাথা থেকে অতি কুৎসিত নর্ম-সাহিত্যের মধ্য দিয়ে নারীপুরুষের জঘন্য স্বেচ্ছাচার সমস্তই তিনি নির্বিকারচিত্তে নির্বিচারে বঙ্গভারতীর পদপ্রান্তে প্রদান করেছেন। বহু দেবী ও মানুষীচিত্রই তিনি দোষে গুণে এঁকেছেন। অতি মধুর ভক্তিরসাত্মক সঙ্গীত ও তাঁর অনেকগুলি আছে।

 ভারতচন্দ্রের মধ্যে ভাষার ওস্তাদি যে পরিমাণে ছিল, মৌলিক চরিত্র সৃষ্টির শক্তি সে পরিমাণে ছিল না। বড় আদর্শ সৃষ্টি করতে না পারলেও তিনি বাংলার আদর্শ জননী মেনকাকে, আদর্শ যোগী শিবকে অনেকখানি ছোট করেছেন। যথা মেনকা;—

“ঘরে গিয়ে মহাক্রোধে ত্যজি লাজ ভয়,
হাত নাড়ি গলা ছাড়ি ডাক ছেড়ে কয়;
ওরে বুড়া আঁটকুড়া নারদ অল্পেয়ে!
হেন বর কেমনে আনিলি চক্ষু খেয়ে?”

 পড়িলে আমাদের চিরপরিচিত “যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী”-র মেনকাকে যেন ভুলে যেতে হয়। ভবানন্দ পত্নীদের বর্ণনায় পূর্ববর্তী কবিকঙ্কনের ছাপ পড়েছে। সেই দু-মুখোসর্পরূপিণী দাসীর কুমন্ত্রণা দুর্বলাকে মনে পড়িয়ে দেয়। বাঙ্গালীর ঘরের দুঃখের ছবি, বাঙ্গালীর মেয়ের রুদ্ধ অন্তরবেদনা তাঁর বর্ণনায় হরপার্বতীর গার্হস্থ্যচিত্রে, নারীগণের পতিনিন্দায় সুন্দরতমরূপে প্রকাশ পেয়েছে। ভারতচন্দ্রের এই চিত্রটিকেই তাঁর রচনার সর্বোৎকৃষ্ট অংশ বলা যায়,—

“অন্নপূর্ণা উত্তরিল গাঙ্গিনীর তীরে,
পার কর বলিয়া ডাকিল পাটনীরে”

ইত্যাদির পর তাঁর আত্মপরিচয়ে—

“গোত্রের প্রধান পিতা মুখ্যবংশজাত,
পরম কুলীন স্বামী বন্দ্যোবংশখ্যাত।
অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ,
কোন গুণ নাই তাঁর কপালে আগুণ।
কু-কথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ,
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।”

ইত্যাদিতে প্রকৃতিও পরমেশ্বরের সাক্ষাৎ পরিচয় একান্ত উপভোগ্য!

 কোন কবি তাঁর কালকে অতিক্রম করতে পারেন না। কালের হাওয়া তার রুচিপ্রবৃত্তিকে সংগঠিত করে থাকে; তাই “বিদ্যাসুন্দর” সেদিনে ও তার পরবর্ত্তী অনেকদিন ধরেই বাঙ্গালী সমাজে সমাদৃত ছিল; যাত্রা ও অপেরার প্রধানতম বিষয়বস্তু ছিল। তর্জ্জা এবং কবির লড়াইয়ে সে সময় বহু অশ্লীল রচনা শিক্ষিত সমাজে সমাদৃত থেকেছে। অবশ্য “বিদ্যাসুন্দরের” উপাখ্যান ভারতচন্দ্রের স্বকপোলকল্পিত নয়; তাঁর বহু পূর্ব থেকেই সে কাহিনী বাংলা সাহিত্যে চলে এসেছে; তবে কথা এই আধ্যাত্মিক আবরণ দিলে যে বস্তু সাহিত্যে সমাদৃত হয়, তার নিরাবরণ রূপই কুৎসিত হয়ে ওঠে আত্মিক ব্যাপারে;— যথা, স্বদেশী ডাকাতি এবং খাঁটি দস্যুবৃত্তিতে যেমন প্রভেদ। তা’ সত্ত্বেও ভারতচন্দ্রের বহুমুখীন শক্তিকে তুচ্ছ করা যায় না। শিব বিবাহের বর দেখতে মেয়েদের হুড়াহুড়িতে কুমারসম্ভবের সপ্তম স্বর্গ মনে পড়িয়ে দেয়।

 আমাদের দেশের মেয়েদের মধ্যে অনেকেরই মনে মনে বিশ্বাস আছে এ দেশে মেয়েরা চির অনাদৃতা। এ অভিমান যে কি রকম ভিত্তিহীন মনু-বিধান থেকে প্রাচীন কবিদের রচনার মধ্য দিয়ে তার বিরুদ্ধ প্রমাণই রয়েছে। নীতিকারেরা বাল্যে কৈশোরে যৌবনে বার্ধক্যে কোন অবস্থাতেই মেয়েদের খেটে খাবার বিধান দেন নি। “ধনরত্নসমন্বিতা বিদুষী কন্যাকে” “বিদ্বান বরে” সমর্পণ পিতা ও ভ্রাতার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। আবার বাঙ্গালী কবিরা আগমনীর গানে গানে পতিগৃহবাসিনীদের কি করুণ সুরেই না আহ্বান জানিয়ে শারদাকাশ মুখরিত করে রেখেছেন! যদিও এ সব গান মাতৃহৃদয়েরই অভিব্যক্তি, কিন্তু রামপ্রসাদ, দাশরথী রায়, কমলাকান্ত, রাম বসু প্রভৃতি পুরুষেরাই ত এদের রচয়িতা। পিতৃহৃদয়ের কন্যাবাৎসল্য নারীচিত্তের স্বাভাবিক স্নেহদৌর্বল্যের মধ্য দিয়ে কল্পিত হয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে মাত্র। কচি মেয়ের আদর আবদার থেকে প্রবাসী নন্দিনীর জন্য ভয় ভাবনা, অদর্শন জনিত দুঃখ পরিতাপ এবং দর্শনে বিপুল আনন্দোচ্ছ্বাস, পুনর্বিদায়ের বিচ্ছেদাতঙ্ক সমস্তটা জড়িয়ে নিয়ে আগমনী ও বিজয়ার চিত্রাবলী বঙ্গসাহিত্যের আর একটি অপরিমেয় মাধুর্যপূর্ণ অধ্যায়। রামপ্রসাদের গিরিরাণী আদরিনী কন্যার আবদারে অভিভূত হয়ে স্বামীর কাছে অনুযোগ করছেন;—

“গিরিবর! আর আমি পারিনা হে, প্রবোধিতে উমারে!
উমা কেঁদে করে অভিমান, নাহি করে স্তনপান,
নাহি খায় ক্ষীর ননী সরে।
অতি অবশেষ নিশি, গগনে উদয় শশী,
বলে উমা ধরে দে’ উহারে।”

 সপ্তমীতে গিরিপুরে পতিগৃহবাসিনী কন্যা আসছেন। কন্যাবিরহকাতরা জননীর কাছে ছুটে গিয়ে পিতা নিজের মুখে সেই প্রার্থিত সন্দেশ বিতরণ করছেন;—

“আজ শুভ নিশি পোহাল তোমারে,
এই যে নন্দিনী এল, বরণ করিয়া আন ঘরে।
মুখশশী দেখ আসি, দূরে যাবে দুঃখ রাশি,
ও চাঁদ মুখের হাসি, সুধারাশি ঝরে।”—রামপ্রসাদ।

 কমলাকান্তের গিরিপুরেও ঠিক এই একই ব্যাপার! বাপ মেয়ে আন্‌তে গেছলেন, এসে পৌঁছেছেন, কর্মব্যস্ত মায়ের কাছে ঐ সংবাদ পরিজনেরা দিতে ছুটেছে;—

“কি কর, কি কর গৃহে দেখ না আসিয়ে গো,
গিরিবর এল গৃহে উমারে লইয়ে গো।”

 আবার নিজ কৃতকার্যতায় সানন্দচিত্ত গিরিবরও গৃহিণীকে হাসিমুখে বলছেন;—

“এই নাও গিরিরাণি তোমার উমারে,
ধর ধর হরের জীবনধন।
কতনা মিনতি করি, তুষিয়া ত্রিশূলধারী,
প্রাণ উমা আনিলাম নিজ পুরে।”

 তা’ গিরি আনন্দ প্রকাশ করবেন না! নিজের মনের ব্যথা মনেই রেখেছেন, পুরুষকারের কিছুমাত্র কমি নেই, কিন্তু কন্যাগতপ্রাণ মায়ের কান্না শুনতে শুনতে যে তাঁর কর্ণ বধির হয়ে গেছে! রোজই মেয়েকে স্বপ্নে দেখেন, দাশরথি রায়ের মেনারাণী কাক-কোকিলের আগে উঠে ঘুমন্ত স্বামীকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিত্যই বলেন;—

“গিরি গৌরী আমার এসেছিল,
স্বপ্নে দেখা দিয়ে, চৈতন্য হরিয়ে
চৈতন্যরূপিণী কোথায় লুকাল!”

 আবার কোন্ সময়ে ছুটে এসে ব্যগ্র হয়ে বলেন;—‘‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী”, বলেন;—

“গিরি হে, গিরীশপুরে দ্রুত যাও।
সম্বৎসর হল গত, সময় হল আগত,
কণ্ঠাগত প্রাণে বাঁচিনে,—বাঁচাও।”

 আবার স্বামীর প’রে দারুণ অভিমান করে রামবসুর মেনকা এ’ও বলে বসেন,—

“মা হওয়া যে কত জ্বালা যাদের মা বলার আছে, তারাই জানে।
তিলেক না হেরিয়ে মর্ম্মব্যথা পাই, কর্ম্মসূত্রে সদাই টানে।”

 দাশু রায়ের উমা-জননী নবম্যাদিকল্পারম্ভে চণ্ডীপাঠে নিযুক্ত পুরোহিত মহাশয়কে সম্বোধন করে দারুণ ক্ষোভে মনের কথা কইছেন;—

“হে দ্বিজ তোমারে কই, কই এলো মন্দিরে আমার ব্রহ্মময়ী?
তোমার চণ্ডী সাঙ্গ হ’ল, আমার চণ্ডী কই?”

 এমন সব কত চির-আগমনীর গানে গানে কন্যা মিলনাকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল জননীদের অভিব্যক্তি ও উদগ্রীব জনকের প্রতীক্ষা শারদাকাশে চিরপ্রতিধ্বনিত হ'য়ে এসে আজও মাতৃজাতির অন্তরকে বিমথিত করছে, সে শুধু ‘মা হওয়ায় জ্বালা' যাদের ঘটেছে তারাই জানে!

“কই সে গিরি কই সে আমার প্রাণের নন্দিনী।
সঙ্গে তব অঙ্গনে কে’ এলো রণরঙ্গিনী?”

 শুনলে মনে হয় যেন পল্লীবাসিনী মায়ের সামনে রুজলিপষ্টিক-স্নো-পাউডারে ছোপান, ‘বব্’ করা, ছাগলাদ্য-জুতার হিলে দীর্ঘাকৃতা, টান জর্জেটসাড়ী গায়ে লপটানো, সহরের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল মহিলাটি এসে দাঁড়িয়েছেন! অথবা ঐ চক্রবেড়ে সাড়ির পরিবর্তে চরম আধুনিকার মত সট সার্টই বা পরে এসেছেন! তা মেয়ে যে বেশেই আসুক মায়ের বুকে এলেই হোল। প্রথমটা একটু চমকানি লাগবেই ত! কিন্তু ‘তারা-হারা’ হয়ে মায়ের ‘নয়নতারা’ ওযে অন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। আবার তাইকি মায়ের প্রাণে স্বস্তি আছে, জামাইয়ের রকম-সকম কোন দিনই ত ভাল নয়, পাঁচজনায় পাঁচ কথা বলতে ত ছাড়ে না; কেঁদে গিয়ে পতিকে নালিশ করেন;—

“এই খেদ হয়, সকল লোকে কয়, শ্মশানবাসী মৃতুঞ্জয়।
যে দুর্গা নামে দুর্গতি খণ্ডে, সেই দুর্গার দুর্গতি একি প্রাণে সয়?
লম্বোদর নাকি উদরের জ্বালায় কেঁদে কেঁদে বেড়ায়,
হয়ে ক্ষুধার্ত্তিক সোনার কার্তিক লুটায় ধূলায়।”

 তাই মেয়ে আসতে অন্তরে ভরা দুর্বিষহ সন্দেহ জ্বালা হঠাৎ প্রকাশ করে ফেলেন;—

“কেমনে পরের ঘরে ছিলি উমা বল মা তাই?
কত লোকে কত বলে শুনে প্রাণে মরে যাই।
ছাই মেখে অঙ্গে, আমাই বেড়ান ভূতের সঙ্গে,
ওমা তুমিও নাকি তারই সঙ্গে সোনার অঙ্গে মাখ ছাই?”

 বলতে বলতে উত্তেজনা এসে গেল, বড়লোকের গিন্নির মত গরীব জামাইকে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে সরোষে বলে উঠলেন;—

“এবার নিতে এলে পরে বলবো উমা ঘরে নাই।”

 মায়েরই ত প্রাণ! মেয়ের মুখে সঠিক সংবাদটী পেতেই সুখ দুঃখের সাথী পতিকে সেই সুসংবাদটা দিতে হর্ষস্মিত মুখে ছুটে গেছেন;—

“মঙ্গলার মুখে কি মঙ্গল শুনতে পাই!
উমা অন্নপূর্ণা হয়েছেন কাশীতে, রাজরাজ্যেশ্বর হয়েছেন জামাই।
শিবে এসে বলে মাগো শিবের সেদিন আর নাই।
যারা পাগল পাগল বলে, বিবাহের কালে সবাই দিলে ধিক্কার,
এখন সেই পাগলের সব, অতুল বৈভব, কুবেরের ভাণ্ডার।”

 মেয়েজামাইয়ের ঐশ্বর্যের পরিচয় তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিচ্ছেন, আর সবার কাছে তাই ছড়িয়ে দিচ্ছেন! সাত হাত বুক করে সঙ্গে সঙ্গে আশীর্বাদ ও করছেন;—

“হোক্ হোক্ উমা সুখী হোক্ সদাই হ'ত মনে।”

 এমন কত ছবির পর ছবি, মাতৃহৃদয়ের আনন্দ বিষাদের ক্ষণ-পরিবর্ত্তিত চলচ্চিত্র কত কবিই যে প্রাণের রসে রঙ্গিয়ে এঁকেছেন। মহারাজ নন্দকুমারের মেনকা অভিমানভরে বলছেন;—

“এ বার মেয়ে হয়ে বুঝাইব মায়ের মায়া কেমন ধারা।”

 বৈষ্ণব সাহিত্যে দুইভাবের নারী-পরিচিতি আমরা লাভ করেছি,—প্রিয়া এবং মাতা। মা যশোদায় আমরা বিশ্বমাতার যে রূপ বিশ্বের ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠিতা তাঁকেই দর্শন করি। মাতৃচিত্তের অমূল্য বাৎসল্য রসকে যশোদার মধ্য দিয়ে ভাবপ্রবণ বৈষ্ণব কবিরা সাহিত্যের উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সমগ্র মানব-জননীদের প্রতীকরপে। মা চিরদিন সন্তানকে কোল ছাড়া, চোখ-ছাড়া করতে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন, পুত্র সঙ্গীদের সঙ্গে পথে বেরুচ্ছেন, এই গ্রামেরই প্রান্তসীমায়,—গোষ্ঠসীমায় হয়ত যাচ্ছেন, তাতেই ভয় ভাবনার অন্ত নেই। বড় শিংওয়ালা গরুর সামনে যেন না যান, রোদ না লাগান, ক্ষুধা পেলে কোঁচড়ে বাঁধা ক্ষীর ছানা যেন খান, এমন সাতশো কথা মাথার দিব্য দিয়ে বলছেন, ফিরতে একটু দেরী হলেই কেঁদে হাট বাঁধাচ্ছেন। প্রত্যুষ থেকে মায়ের আর কোন্ চিন্তা, কোন্ কাজ? গোবিন্দদাসের যশোদা সকাল বেলা ছেলেকে ভাকছেন;—

“আলস ত্যজি উঠহ যদু রায়,
আগত ভানু রজনী চলি যায়।”[১৯]

এমন সময়—

“অরুণ উদয় বেলা  সব শিশু হয়্যা মেলা
সভে গেল নন্দের দুয়ার।”

তখন—

“আনন্দিত নন্দরাণী  সাজাইল নীলমণি
নানা আভরণ পীতবাস।”

আবার—

“গোষ্ঠে যায় হরি  চূড়া বান্ধে মন্ত্র পড়ি
পীঠে দিল পাটকি ডোর।
ধড়ার আঁচল ভরি  খাইতে দিল ক্ষীর-ননী
কাঁদে রাণী হইয়া বিভোর।”

 তা’ কান্না পায় বই কি, সারাদিন ছেড়ে থাকতে হবে ত! মায়ের পক্ষে এ ব্যাপারটি ঠিক হাসবার মত নয়, এ নিয়ে অন্যে যতই হাসুক না কেন! সারাদিনই ঘর বার করেছেন, এখন;—

“সাঁঝ সময়ে গৃহে আওত যদুপতি, যশোমতী আনন্দ চিত,
দীপহি আলি, থারিপর ধরকত, আরতি করতহ’ গাও ত গীত।”

তার পরে—

‘‘বদন মুছাই, মুছি মুখমণ্ডল বোল ত মধুরিম বাণী,
কতই যতন করি, যশোমতী সুন্দরী, বসাইল মন্দিরে আনি।
সুবাসিত তৈল, সুশীতল জল দেই, মাজাই যতন হি অঙ্গ।
কুন্তল মাজি, আজি পুনঃ বান্ধল চূড়, তাহে কুসুম সুরঙ্গ।
মৃগমদ চন, অঙ্গে সুলেপন; যতনে পিন্ধাওলি বাস।
সুবাসিত কুসুম হার উরে লম্বিত, ইত্যাদি—”

 তার পর ভোজনপর্ব! কিন্তু তৎপূর্বে নরোত্তমদাসের যশোদা স্নেহ-বিহ্বল সহাস্যমুখে ছেলেকে ঈষৎ আদর-গলানো একটু অনুযোগও করে নিলেন;—

“নন্দদুলাল, বাছা যশোদাদুলাল,
এতক্ষণ গোঠে থাকে কাহার ছাওয়াল?”

 আবার চুমু খেতে খেতে বলছেন;

“তোমার মুখের নিছনি লৈয়া মরে যাউক মা।”

এই সব কল্যাণী জননীকে আমরা ঘরে ঘরে নিত্য প্রত্যক্ষ করছি, কিন্তু অতি পরিচয়ে তিনি প্রায় অপরিচিত হয়েই রয়েছেন। আশ্চর্য এই যে, এই সকল অতিপরিচিত মাতৃচিত্রগুলি পুত্র রচিত, মাকে চিনতে তাদের একটুও ভুল হয়নি।

“ক্ষীর ননী ছানা সর, আনিয়াছে থরে থর,
আগে দেই রামের বদনে,
পাছে কানাইয়ের মুখে, দেয় রাণী মহাসুখে,
নিরখিয়ে চাঁদমুখপানে।”

কবিশেখরের রাধাও পক্কান্ন পাঠিয়েছেন, যশোদা মুদ্‌গসূপ, তা’তে মরিচের সুখদ ঝাল দেওয়া, আরও কি কি সব এবং চিনি-কদলীসংযুক্ত ক্ষীর সরের সঙ্গে সেগুলিও প্রেরিকার পরিচয় সহিত সকৃতজ্ঞ চিত্তে অনুরোধ করে করে ছেলেকে খাওয়াচ্ছেন। সেজ-বিছানা পেতে, কর্পূর তাম্বুল দিয়ে ছেলেকে সকাল সকাল ঘুম পাড়াচ্ছেন, আবার যে ভোরের বেলায় শ্রীদাম সুদাম দাম বসুদাম ডাকতে আসবে, বলবে;—

“বনে গেল ধেনু, আয়রে কানু বেণু বাজায়ে।”

 মায়ের নজর যে সবদিকে সমান সজাগ! পরিতাপের বিষয় প্রিয়-বিরহিতার বিলাপ-উচ্ছ্বাসে যে বৈষ্ণবসাহিত্য কলকল্লোলিত, মায়ের দুঃখ তাঁরাই বা তেমন করে কই বুঝেছেন? পরবর্তীরা ভাঙ্গাবুকের সেই অশ্রান্ত রোদনে তবু একটু কান পেতেছিলেন বলেই মধুকান তবু বলতে পেরেছেন;—

“গোকুলেতে তুমি যারে ডাকতে মা বলে,
সে কান্দে আজ পথের ধূলায় কৃষ্ণ কই বলে,

অঞ্চলে বাঁধিয়া মনী বলে কোথায় ও নীলমণি
শুনলে তার ক্রন্দনের ধ্বনি পাষাণ সেও গলে।
যতনে তায় পালন, করেছিলাম লালন,
সে করলে না প্রতিপালন,
মধু কয় এ নূতন নয়!

 সত্যই তাই, এ নূতন নয়ই ত! মাকে দরকার হয় তখনই,—যখন খবর আসে,—“গোঠে হতে আইল নন্দদুলাল”, যখন সাথীরা এসে আরজি পেশ করে;—

“ও মা নন্দরাণি, সাজিয়ে দে তোর নীলমণি”।

এখন সেই মায়ের দশা দেখে পাঁচজনে বলাবলি করে;—

“দেখতে কাঙ্গালিনীর মত, কিন্তু নয় কাঙ্গালিনী তত,
আয়রে গোপাল, গোপাল বলে, করাঘাত হানে কপালে,

মলিন বেশে এমন বরণ যেন রাজমাতা।
শুনেছি গোকুলে আছেন রাজার এক মাতা।”

তারপর মাতৃচরিত্রের আর এক অভিব্যক্তি দেখতে পাই প্রতিদ্বন্দ্বিনী দেবকীকে চ্যালেঞ্জ করায়।

যশোদা প্রতিবাদিনীকে ডেকে বলছেন—

“এস এস দেবকি! তোমায় গোপাল দেব কি?
এস দু’জনে ডাকি, কারে মা বলে দেখি।
যার গোপাল তার কোলে যাবে, তারে মা বলে ডাকবে,
তার পায়ের ধূলা মাথায় নেবে, সভাজন সাক্ষী॥”

 ক্ষীর-সরের সঙ্গে চারটি পছন্দসই গাছের ফলও এনেছেন, স্নেহবিহ্বল স্বরে বলছেন;—

“নে’রে খা’রে দে’রে বদনে,   তো’ বিনে আর খাই নাই,
বনফল শুষ্ক হ’ল বনে।”

 অবশেষে মৃতকল্পা যশোদার পুত্রবিরহদাবাগ্নির অনির্বাণ দহনে দগ্ধীভূতা মুমূর্ষু জননীর শেষ আর্ত মর্মর; এ কি শুধু একা তাঁরই বুকফাটা রক্তবিন্দু, না সমূদয় নির্যাতিতা কৃতঘ্ন-পুত্রজননীদের? এই যে কথাগুলি অতুলকৃষ্ণ মিত্রের যশোদা বলেছেন;—

“এলি কি দেখিতে গোপাল এত দিনের পরে?
তবে দেখ দেখ চেয়ে দেখ ওরে যাদুমণি!
ভূমিতে পড়িয়ে রে তোর যশোদা জননী।”

মধু কানের যশোদা অঝর্‌ঝরে কাঁদেন;—

“আর কি আসিবে সে নীলমণি?
মা বলে আসিবে কোলে, খাওয়াইব ক্ষীর-ননী।”

 মায়ের প্রাণের আশা যে যায় না। নইলে ইতিপূর্বেই ত ঐ কবির শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবাসী সাথীদের কাতর আবেদনের প্রত্যুত্তরে স্পষ্ট ভাষাতেই বলে চুকিয়েছেন;—

“আর ত’ ব্রজে যাব না ভাই, যেতে প্রাণ নাহি চায়,
ব্রজের খেলা ফুরিয়ে গেছে, তাই এসেছি মথুরায়।
বাপ পেয়েছি, মা পেয়েছি, ছেলেখেলা ভুলে গেছি,
তোমরা ক’জন মা বলে ভাই, ভুলিয়ে রেখ মা যশোদায়।”

 জগতে এমনিই হয়! মা চিরদিন মা-ই থাকে, তার কোন পরিবর্তন হয় না; কিন্তু সন্তান ততদিনই মাতৃ-অনুগত থাকে যতদিন তার মাকে প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলেই মায়ের প্রতি তারও টান যে বড় অল্প নয়, সমস্ত বাংলাসাহিত্য প্লাবিত করে তার সাক্ষ্যও বড় কম মেলে না। সে অবশ্য পার্থিব জননীর প্রতি আকর্ষণ নয়, যা ‘খুঁটে খেতে’ শিখলেই শোধ হতে পারে। সে মায়ের আবার দুটি অংশ, এক দেশমাতৃকা অপর জন্মমাতা। দেশমাতাকে “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।” বলে যুগ-যুগান্তর পূর্বের সাধক কবি তাঁর ভক্তি-অর্ঘ্য দিলেও এবং বাহান্নপীঠ-সমন্বিত বিশাল ভারতবর্ষ সতীদেহরূপিণীর রূপমূর্তি বলে স্বীকৃত হলেও নিজস্ব ভিটা, নিজস্ব গ্রাম বা বড় জোর প্রদেশমধ্যে দেশাত্মবোধ নিবন্ধ থেকে নিজ জননীর মত দেশ-জননীকেও শুদ্ধান্তঃপুরিকা করা হয়েছিল। কার্যতঃ ইদানীং সুদূর প্রতিবেশীর মাতৃভক্তি সহসা একদিন বিস্মৃআ জননীকে ভাল করে চিনিয়ে দিলে, অমনি জননীর জীর্ণদ্বারে ভক্ত সন্তানদের সমাগম হতে লাগল।

 স্বদেশী যুগে বহু স্বদেশী গানের রচয়িতা কবির সাক্ষাৎলাভ ঘটেছিল; সকলের নাম ধাম জানা ও জানানো এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সম্ভব নয়, কারণ ভারতমাতার সেই ভক্তবৃন্দ নিতান্ত সংখ্যাল্প নহেন। তা’তে ভূদেবের “মাতর্নমামি সততং সতীদেহরূপাম্‌”ও আছে, তারই অনুবর্তনে বঙ্কিমের “বন্দেমাতরম্‌”ও আছে, রবীন্দ্রনাথের “অয়ি ভুবনমনমোহিনী” থেকে “জনগণমনঅধিনায়ক জয়হে”, অশ্বিনী দত্তের “চল্‌রে চল্‌রে চল্‌রে ও ভাই, জীবন-আহবে চল” ও আছে; “দিনের দিন সবে দীন, ভারত হয়ে পরাধীন,” জননীর দ্বারে ওই শুন গো শঙ্খ বাজে‘‘, রজনীকান্তের “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে’রে ভাই, দীন দুঃখিনী মা যে মোদের তার বেশী আর সাধ্য নাই”, এ সকলি আছে। এ ছাড়া;—

‘‘শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত মোরা অভয়চরণে নম্রশির
ডরিনে রক্ত ঝরিতে ঝরাতে দৃপ্ত আমরা ভক্তবীর।”

প্রভৃতি শক্তি সাধনার চরম মন্ত্রসমূহ বহু হোতা উদ্গাতার মুখ থেকে নিঃসৃত হয়ে, “মা মা” রবে বাঙ্গালীর জীবনে ভাঁটার পরে জোয়ারের মত প্লাবন এনে দিয়েছিল। বাংলাসাহিত্যে বাঙ্গালীর একান্ত নিজস্ব তন্ত্রসাধনা যুগযুগান্তরের বিস্মৃত অতীতকে ঠেলে ফেলে হঠাৎ নিজরূপ প্রকট করেছে। সাধনায় অমরত্ব লাভ না করলে, অকাল-মৃত্যুর অধিকারের বহির্ভূত না হলে কি মহামন্ত্রের—মাতৃমন্ত্রের সাধনায় সিদ্ধ হওয়া যায়? এবার আশা দেখা দিয়েছে, ঊষাও আর অদৃশ্যা নেই! মাতৃযাগের অনুষ্ঠানে একদা মাতৃমন্ত্রের ভৈরবনাদে ভারতের,—বিশেষ করেই বাংলার আকাশ কেঁপে উঠেছিল। ইতিপূর্বে এক মায়েরই সেবা করে এদেশ ষোড়শ মাতৃকার পালে পার্বণে পূজা পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল। আজ অকস্মাৎ স্কন্ধ-ধাত্রীদের মত ধাত্রী-মাতাস্বরূপা অপর মায়ের কথা জনে জনের মনে মনে লজ্জা-সঙ্ঘাত বাধিয়ে দিলে, বাহান্নপীঠের অধিষ্ঠাত্রীদের উদ্দেশ করে আসমুদ্রহিমাচল মাতৃনামে গর্জে উঠলো। নূতন নূতন মন্ত্রসাধকরা বুক চিতিয়ে এগিয়ে এলেন, হতাশার গান ছেড়ে দিয়ে বীর্যের গান শৌর্যের গান তাঁরা গাইতে লাগলেন, এঁরা বল্‌লেন;—

‘‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে,
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁসিয়ার।”

এঁরা গাইলেন—

‘ঊর্ধে গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণীতল

অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল্‌রে চল্‌রে চল্‌।”

এঁরা কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত প্রশ্ন করলেন না,—কেন মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি?” সুসঙ্গের মহারাজ কমলকৃষ্ণের মত গাইলেন না;—

“বিরলে বিজনে বসে কে মা তুমি একাকিনী?
অবিরল নেত্রনীরে ভাসিছে বদনখানি,
আর্যাবর্ত পুণ্যভূমি    তার অধিষ্ঠাত্রী তুমি
কোন দুঃখে ম্লানমুখে নয়ননীরবাহিনী?”

হেমচন্দ্রের মত সাবধানতার সঙ্গে বলছেন না;—

“ভয়ে ভয়ে লিখি, কি লিখিব আর?
না হলে শুনিতে এ বীণা ঝঙ্কার।”

গোবিন্দ রায়ের মত অনুপায়া মাকেই ব্যর্থ প্রশ্ন করছেন না;—

“কত কাল পরে, বল ভারতরে, দুঃখসাগর সাঁতারি পার হবে?”

এ প্রশ্নের উত্তর ছেলের মুখেই ধ্বনিত হ’ল;—

“আমরা ঘুচাব মা তোর কালিমা
মানুষ আমরা নহি ত’ মেষ।
দেবী আমার, সাধনা আমার, স্বর্গ আমার, আমার দেশ।”

আনন্দচন্দ্র মিত্র ভারতমাতার প্রতিনিধিত্বে ঘুমন্ত ও অধজাগরিত সন্তানদের জানিয়ে দিলেন;—

“উঠ উঠ সবে ভারতসন্তানগণ
থেক না থেক না আর মোহনিদ্রা অচেতন।”

আবার ব্যাকুল হয়ে বলছেন;—

“চেয়ে দেখ দেখ সবে ভারতসন্তানগণ!
জননী জনমভূমি চিরবিষাদে মগন।”

রবীন্দ্রনাথ বল্‌লেন;—

‘‘একবার তোরা মা বলিয়ে ডাক
জগত জনের শ্রবণ জুড়াক্‌।”

কবি অতুলপ্রসাদ সেনও ভারত-ভূষণদের আহ্বান জানিয়ে বিলাপ করলেন;—

‘‘ভারত-ভানু কোথা লুকালে, ক’বে উদিবে পুনঃ প্রাচীর ভালে?”

আবার বর্তমানদের উদ্দেশে সঙ্গে সঙ্গেই গভীর প্রেরণা দানের সঙ্গে বলছেন;—

“বল বল বল সবে
শতবেণু বীণা রবে
ভারত আবার জগৎসভায়
শ্রেষ্ঠ আসন লবে।”

 অপর এক শ্রেণীর মাতৃপূজার পূজারী যারা তারা ঐ পূজাবেদীর চিরপ্রতিষ্ঠাতা ও নৈষ্ঠিক পূজার চির পুরোহিত। তারাই মায়ের আদরের দুলাল, চোখের মণি, কোলের গোপাল। তারা কোন স্বার্থের কোন ব্যক্তিগত সুখের উদ্দেশ্যে মাকে ভালবাসে নি, শুধু “মা” বলেই মাকে ভালবাসে। অত শত ভেবে চিন্তে বাছা বাছা ভাষা চূনে চূনে মনভুলান কথা তারা কয় না; যখন যেটা মনে আসে ফট করে বলে বসে, বাক্যসম্বরণ করবার শিষ্টাচারের ধার তাদের নেই। যেমন মায়ের ছেলে যতদিন কচি বাচ্চা থাকে মাকে কি কখন খাতির করে কথা কয়? কান্না অবদার হাঙ্গামার চোটে মা বেচারী বিব্রত সন্ত্রস্ত। তাই আমরা রামপ্রসাদের মাতৃতন্ত্রের মধ্যে কত ভাবেই না অভিব্যক্তি দেখেছি। ভাবে গদগদ হ’য়ে ‘‘লক্ষ্মী মা, সোনা মা, আমার কাছে এস মা” গোছের মিনতিও করছেন;—

“জননী! পদপঙ্কজং দেহি শরণাগত জনে।”

আবার মনের মতন না হলেই চটে মটে বলছেন;—

“করুণাময়ি! কে’ বলে তোরে দয়াময়ী?
কারো দুগ্ধে দাও বাতাসা, তারা—
আমার শাকে অন্ন মেলে কই?
কারে দিলে ধন জন মা,
হস্তী অশ্বরথচয়।
ওগো তা’রা কি তোর বাপের ঠাকুর,
আর আমি কি তোর কেহ নয়?”

আবার ছেলের হিংসুটেপনা দেখে মা যে অলক্ষ্য থেকে ভ্রুকুটি করছেন, তা’ও তো মায়ের প্রকৃতি-জানা ছেলের কাছে অজ্ঞাত নেই, তা’ আদুরে ছেলের তাতেই বা ভয়টা কিসের?

“আমি নই আটাশে ছেলে, ভয়ে ভুলবো নাকো চোখ রাঙালে,
ওমা, আমি বিষয় চাইতে গেলে,  বিড়ম্বনা কতই ছলে,
শিবের দলিল সই-মোহরে যতনে রেখেছি, তুলে।”

 আবার আধুনিক ছেলের মত উল্টো ভয় দেখাতেও ওর বাধে না! বলে;—“মায়ে পোয়ে মোকদ্দমা, ধুম হবে রামপ্রসাদ বলে”, তবে মাকে এইটুকু উপায়ও বাৎলে দিয়েছেন, মামলা করলেও;—

“তবে শান্ত হব, ক্ষ্যান্ত করে আমায় যখন তুই মা, কর্‌বি কোলে।”

 বাঙ্গালী মায়েদের আজও ছেলেমেয়েদের কাছে একচোখোমীর খোঁটা খেতে হয়, এটা প্রায়ই দেখা যায়। আর সে বিষয়ে বিশ্ব মায়ের ছেলেদের মত “শ্যামার খাস মুলুকের প্রজা’’ ত নয়, তাই মায়ের তবিলদারী প্রত্যেক ছেলেই দাবী করলে মা বেচারীরা ফাঁপরে পড়ে যান। তা’ ভক্ত ছেলে মাকে অভয় দিয়ে নিজের সার্টিফিকেট নিজেই দাখিল করতে ভোলেননি;—

“আমায় দে’মা তবিলদারী।
আমি নিমক হারাম নই শঙ্করী!”

 তা’তেও যখন দরখাস্ত মঞ্জুর হ’ল না, তখন আর মায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ রইল না, নির্ব্বেদ এসে গেল;—

“তুমি এ ভাল করেছ মা,   আমার বিষয় দিলে না,
এমন ঐহিক সম্পদ কিছু আমারে দিলে না,
কিছু দিলে না, পেলে না,   দিবে না, পাবে না,
 তায় বা ক্ষতি কি মোর মা!”

 তা ছেলের ধন হলে মার পক্ষেই ভাল, মা যদি ন্যায় হন্তারক হন, ছেলে আর ওর বেশী কি বলবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে শুনিয়ে বসে;—

“মা হওয়া কি মুখের কথা?
শুধু প্রসব করলেই হয় না মাতা।
যদি না বুঝেন সন্তানের ব্যথা,
দশমাস দশদিন যাতনা সয়েছেন মাতা,
এখন ক্ষুধার বেলা শুধালে না, এল পুত্র গেল কোথা?”

 মা যেমন ছেলেকে টানেন, ছেলে যতদিন শিশু থাকে, বালক থাকে, মায়ের প্রতি টান তারও বড় কম থাকে না। যারা মায়ের ভক্ত ছেলে তারা চির-শিশু। তাই ভারতচন্দ্র মায়ের আঁচল ধরে কাতর হয়ে বলছেন;—

“ভবানী আমারে ছাড়িও না।
সুশীলা হইয়া শিলায় জন্মিয়া
শিলাময় হিয়া হইও না।
এবার পাথারে ফেলিয়া আমারে,
দোষ বারে বারে লইও না।”

 “সংসার পাথারে পড়ে’’ হাবু ডুবু খেতে খেতে মায়ের আর এক ভক্ত ছেলে দেওয়ান রঘুনাথ ব্যাকুল হয়ে বলছেন;—

“পড়িয়ে ভবসাগরে ডোবে মা তনুর তরি,
মায়া ঝড়, মোহ তুফান, ক্রমে বাড়ে গো শঙ্করি!
একে মন মাঝি আনাড়ী,  তা’তে দু’জন গোঁয়ার দাঁড়ি,
কু-বাতাসে দিয়ে পাড়ি হাবু ডুবু খেয়ে মরি।”

 মায়ের ছেলেরা প্রত্যেকেই মায়ের মধ্যে জগতের সমূদয় ভয় মৈত্রী করুণা মুদিতার বিভিন্ন ভাব ও রূপের সমাবেশ দেখে কখনও হর্ষে বিহ্বল, কখনও ভয়ে প্রব্যথিত, এর মধ্যে থেকে সার সত্য আবিষ্কারও অনেকেই করে নিয়েছিলেন, তাঁদেরই একজন রামদুলাল এই গুহ্য সত্য ফাঁস করে দিচ্ছেন;—

“জেনেছি জেনেছি তারা, তুমি জান মা ভোজের বাজি।
যে তোমায় যে নামেই ডাকে, তাতেই তুমি হও মা রাজি।
মগে বলে ফয়া তারা, লর্ড বলে ফিরিঙ্গী যারা,
খোদা বলে ডাকে তোমায়, মোগল-পাঠান সৈয়দ গাজি
শাক্তে বলে তুমি শক্তি, শিব তুমি শৈবের উক্তি,
সৌর বলে সূর্য্য তুমি, বৈরাগী কয় রাধিকাজী।”

আবার বলছেন;—

‘‘জান না রে মন, পরম কারণ, শ্যামা সুধু মেয়েই নয়!
মেঘের বরণ করিয়া ধারণ, আবার কখন কখন পুরুষও হয়।”

 অবশ্য কোন কোন ছেলে মাকেই ছেলের সমস্ত ভাল-মন্দর জন্য দায়ী করেন নি; যেমন দাশরথি রায়, তিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছেন;—

“দোষ কারো নয় গো মা!
আমি স্বখাদ সলিলে ডুবে মরি গো শ্যামা!”

 অনুরূপ মীমাংসা অনেকেই অনেক চিন্তা-গবেষণার পর করে নিয়েছেন। দেওয়ান রঘুনাথ মায়ের “ভয়ানাং ভয়ং” এবং “গতিঃ প্রাণিনাং” এই দুই রূপেরই সমন্বয় সাধন করে নিয়ে বলছেন;—

“কে রণরঙ্গিণী, যোগিনী-সঙ্গিনী হয়ে উলঙ্গিনী নাচিছে সমরে,
ঝরে ইরশ্মদ নয়নের কোণে, ক্ষণপ্রভা খেলে দশন উপরে,
ভয়ঙ্করী মূর্ত্তি দেখে লাগে ভয়,  কিন্তু ভক্তে বিতরিছে বরাভয়,
অকিঞ্চনে কয়, সামান্য ত নয়, ব্রহ্মময়ী উদয় হয়েছেন সাকারে।”

 তা ভয়ই করুন আর যাই করুন যা করতে কোন ছেলেই মাকে ফেলে অন্যত্র হাত পাততে যান না। তা’ বাপ ভাই যিনি যতই থাকুন, সখা বন্ধু পতি যতই পাতান, চাওয়াটী কিন্তু সেই মায়েরই কাছে! “কুপুত্র যদ্যপি হয়, কুমাতা কখন নয়’ এ বচন যে বেদের বচনের সমসাময়িক বা তার চেয়েও আগের দিনের। তাই মাতৃনামের মোহমুগ্ধ এণ্টনি সাহেবটী পর্যন্ত লুব্ধচিত্তে মায়ের কাছেই ভিক্ষা চাইছেন;—

“অপাঙ্গে করুণা কর, ওগো মাতঃ মাতঙ্গি!
ভজন পূজন জানিনে মা, জেতে আমি ফিরিঙ্গি।”

 এই উপলক্ষ্যে দয়াফ খাঁর গঙ্গাস্তোত্র স্বতঃই মনে পড়ে;—

“সুরধুনি মুনিকন্যে তারয়েৎ পুণ্যবন্তম্‌
স তয়তি নিজপুণ্যৈস্তত্র কিং তে মহত্ত্বম্‌?
যদি চ গতিবিহীনং তারয়েঃ পাপিনং মাম্‌,
তদিহ তব মহত্ত্বং তন্মহত্ত্বং মহত্ত্বম্‌॥”

 মায়ের আর এক দারুণ আব্‌দেরে ছেলে কমলাকান্ত জোর গলায় বলেছেন;—

“মা আমারে তারিতে হবে, আমি অতি দীন হীন দুরাচার,
না ভাবিয়া কারণ মজিলাম ভবে।
পতিত দেখিয়া যদি না তার ভব-জলধি,
পতিতপাবনী নামে কলঙ্ক রবে॥”

 এই ছেলের মাতৃভক্তি এমনই প্রবল ছিল যে, মুমূর্ষু অবস্থায় গঙ্গাতীরস্থ করবার বন্দোবস্ত করতে গেলে সেই অন্তিমকালেও সঙ্গীত রচনা করে গেয়ে ওঠেন;—

“আমার কিসের গরজ, কেন গঙ্গাতীরে যাব?
আমি কালীমায়ের ছেলে হয়ে বিমাতার কি স্মরণ নেবো?”

 সাতুবাবু বা আশুতোষ দেবও আর একটি কম জবরদস্ত ছেলে নন’! ইনি বলছেন;—

“অন্নদার দ্বারে আজি পাতকী পেতেছি পাত,
ফিরাইতে পারিবে না পরশিতে হবে ভাত,
চাহি আমি সেই প্রসাদ, ঘুচে যাতে জন্মের সাধ,
যে প্রসাদ খেয়ে শিব নাচেন হয়ে ঊর্দ্ধ-হাত।”

 মাকে নিয়ে ছেলেদের রঙ্গরস হাসি-তামাসাও বড় কম চলে না! অভিমান, আব্দার, ঠাট্টামস্করাও যত, আবার দৃঢ়বিশ্বাস এবং ঐকান্তিক আত্মনিবেদনও তেমনি! প্যারীমোহন কবিরত্ন বলছেন;—

“ঐ নেংটা মেয়েটা এলো, এলো সমরে,
চেয়ে দেখ ভূপ, কি বিকট রূপ,
মড়ার মাথা গলায় গাঁথা,
মড়ার আঙ্গুল কোমরে!”

 আবার সঙ্গে সঙ্গেই বলা হচ্ছে;—

‘‘এইবেলা মন ডেকে নে’রে নীলাজবরণী মাকে, নিলাম নিলাম ক’চ্ছে শমন, কখন নে’বে নিলাম ডেকে।”</poem>

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আব্দার ধরলেন;—

“দিয়ে সত্য জ্ঞানানুবোধ”,
“কর দুর্গে দুর্গতিনোধ”

শিবচন্দ্র মায়ের দশরূপে চমকিত পুলকিত হয়ে গদগদ বচনে প্রার্থনা জানালেন;—

“তারা কর গো মা পার,
মায়ানদীর মধ্যে পড়ি, ভাবি অনিবার।”

 কুমার শম্ভুচন্দ্র গাইলেন;—

“মন তুমি এই কালো মেয়ে কোন সাধনায় পেলে বল?”
 কুমার নরচন্দ্র কিন্তু রাজবাড়ীর ছেলের নাম রেখেছেন! হুকুমবরদারদের হুকুম শোনা নয় অভ্যস্ত কি না, তাই কিঞ্চিৎ ধৈর্য্যভাব, আবার মায়ের কথঞ্চিৎ বধিরতা দোষ ত’ আছেই, তাই সাড়া না পেয়ে বেজায় চটে মটে গিয়ে বলছেন;—

“কেন মিছে মা মা কর, মায়ের দেখা পাবে নাই,
থাকলে এসে দিত দেখা সর্বনাশী বেঁচে নাই।
শ্মশানে মশানে কত, পীঠস্থান ছিল যত,
খুঁজে হ’লাম ওষ্ঠাগত, কেন আর যন্ত্রণা পাই?

মা গেছে নাম-ব্রহ্ম আছে, আমার তরিবার ভাবনা নাই।”

তা’ মায়ের উপর এমন তম্বি বড় কমও নয়, কে’ না মাকে কি বলেছে;—

“এখনও কি ব্রহ্মময়ি হয় নাই তোর মনের মত?”
“যে হয় পাষাণের মেয়ে তার বুকে কি দয়া থাকে?
দয়াহীন না হলে কি লাথি মারে নাথের বুকে?”

 এমন কত কথা!

 আবার প্রশ্রয় পাওয়া আদুরে ছেলে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে উঠছে;—“নেংটা মেয়ের এত আদর জটে বেটাই ত’ বাড়ালে!”

 এ-সব বুকের পাটা কি আর আজকের যুগে তৈরী হয়? এ সাহস বড় সোজা সাহস নয়!

“রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি—
ভার্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্‌”।

 এ প্রকাশ্যে মুখে বাধলেও মনে মনে চার কাল ধরেই বলতে যে কেহই ছাড়বে না, তা’তে কোনই সন্দেহ নাস্তি।

“রোগানশেষানপহংসি তুষ্টা,
রুষ্টা তু কামান্‌ সকলানভীষ্টান্।
ত্বামাশ্রিতানাং ন বিপন্নরাণাং,
ত্বামাশ্রিতা আশ্রয়তাং প্রয়াক্তি।”

 আবহমানকাল ধরেই নর-সন্তানের অন্তরোৎসারিত এই সকল কামনা বিশ্বজননীর পাদপ্রান্তে পুঞ্জীভূত হতে থাকবেই;—

“রক্ষাংসি যত্রোগ্রবিষাশ্চ নাগা যত্রারয়ো দস্যুবলানি যত্র।
দাবানলো যত্র তথাব্ধিমধ্যে তত্র স্থিতা জ্বং পরিপাসি বিশ্বম্॥
বিশ্বেশ্বরী ত্বং পরিপাসি বিশ্বং বিশ্বাত্মিকা ধারয়সীতি বিশ্বম্‌।”

 এ মন্ত্র যুগযুগান্তর থেকেই বিশ্ববাসীর ভয়ত্রস্ত অন্তরমধ্য থেকে নানা ভাষায় নানা বর্ণে নানা ছলে উত্থিত হয়েছে, হচ্ছে, অনন্তকাল ধরেই হবে। তবে তার মধ্য থেকে কখন কখন কে’ একটা দাম্বাল শিশুর আবির্ভাব হয়ে ছন্দোবদ্ধ গতানুগতিক নিয়ম-নিবদ্ধ এই ভক্তিধারার অব্যাহত গতিকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে, তারা তো মাতৃদ্রোহী নয়, বরং মায়ের কাছে প্রশ্রয় পাওয়া তাঁর গোপাল-ছেলে। এদেশে তাঁদের সংখ্যা বড় কম নয়। মহারাজ, রাজকুমার থেকে আরম্ভ করে উলঙ্গ, অর্দ্ধোলঙ্গসন্নাসী, তান্ত্রিক-সাধক, ঘোরতামসিক বলে দৃষ্ট সংসারী সকল শ্রেণীর মধ্যেই জগতের অদ্বিতীয় মাতৃরূপের রূপসাধনা নানাভাবেই প্রকটিত হয়েছে। ঐহিক সুখসম্পদের অভিলাষ কোথাও কোথাও থাকলেও নিষ্কামতা বা মোক্ষপদ কামনাই অধিকাংশের আত্মাভিব্যক্তিতে সুপ্রকট। যেমন নাটোরের মহারাজ রামকৃষ্ট বলেছিলেন;—

‘‘মন যদি মোর ভুলে,
তবে বালির শয্যায় কালী নাম দিও কর্ণমূলে।”

 আবার আর এক মহারাজা কোচবিহারের হরেন্দ্র নারায়ণ ভূপ সহাস্যে মাকে শুনিয়ে দিলেন;—

“তার শমনে ভয় কি, মা যার শ্যামা?
অন্তে যাব তাঁর ধামে বাজাইয়া দামা।”

 বর্দ্ধমানের মহারাজাধিরাজ মহতাবচন্দ্রের ভোগৈশ্বর্যের অভাব ছিল না, তবু যা’ নেই তারই জন্য মায়ের কাছে দরবার করতে ছাড়েননি;—“চন্দ্রে মোক্ষ প্রদায়িনী হওগো ভবাণী!”

 মহারাজ যতীন্দ্রমোহন বিষয়ী লোক, আইন-আদালতের খবরটা রাখেন ভাল, নালিশ জানাচ্ছেন;—

—“শিবের মাগো অবিচার ভারী।
মাতৃধনে ছেলেয় ফাঁকি, নিজেই হ’ন তার অধিকারী।”

 রাজা সৌরীন্দ্রমোহন বিশ্বেশ্বরী মায়ের পরিবর্ত্তে তদানীন্তন ভারতেশ্বরীকে রাজসিক উপাসনায় পূজা প্রদান ক’রে সকাম সাধনার চরম দেখিয়েছেন! যথা;—

“বিশাল তড়াগনীরে শোভে যথা কমলিনী,
অয়ি মাতঃ ভিক্টোরিয়া ইংলণ্ডে তুমি তেমনি।”

এই মাতৃভক্তদের মধ্য দিয়ে সহসা এক পার্থিবজননীর ভক্ত সমাগম হয়েছিল, কান্ত কবি রজনীকান্তের মতই।[২০] তিনি রাজা মহিমারঞ্জন রায়, বিশ্বমাকে নয়, নিজের গর্ভধারিণী মাকে উদ্দেশ ক’রে তিনি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছেন;—

“ও মা সাক্ষাৎ ঈশ্বরী, আমায় গর্ভে ধরি কত না যাতনা পেয়েছ,
এ প্রাণ থাকিতে, পারিনে ভুলিতে, কত যত্ন তুমি করেছ।”

 মাকে গর্ভে ধরার গুদামভাড়া দিয়ে চুকিয়ে দে’বার নীতি সে দিনে বেশী লোকে জানতো না, বিশেষ ক’রে বড় ঘরের শিক্ষিত জনসমাজে।

 গিরীশচন্দ্র মায়ের রাঙ্গা পা-দু’খানির প্রকৃত রহস্য জানতে পেরে গাইলেন;—

“আয়, জবা আনি নইলে কি দিব পায়?
সোনা সাজে না রে মায়ের রাঙ্গা পায়।”

ঐ রাঙ্গা পায়ের উপাসক কি কম? কেউ বলছেন;—

“তুলে নে’ রাঙ্গা জবা মায়ের পায়ে সাজবে ভাল।”

কেউ বলছেন;—

“তখন আমি মনে মনে, তুলবো জবা বনে বনে,
মাখায়ে ভক্তি-চন্দনে, পদে দিব পুষ্পাঞ্জলি।”

 আবার শুধু কি অঞ্জলি পেয়েই রাঙ্গা পা-দু’খানির পার আছে? পণ্ডিত শ্যামাচরণ ঐ চরণকে ভবসাগর পার হবার জন্য তরণীর কাজেই লাগিয়ে নিলেন, বললেন;—“দে’ মা কালি, পদতরি, ভিক্ষা করি।” তা শুধু তিনি কেন, এ কথা বিস্তর লোকেই ত বলেছেন;—

“মা তোমার চরণ দু’খানি ব্যাধির ঔষধ জানি
তব নাম নিস্তারিণী, করো না মা বঞ্চনা।”

 অতুলকৃষ্ণ মিত্র ঐ রাঙ্গা পায়ের মোহগ্রস্ত হয়ে বারে বারেই পাদপদ্মে মাথা কুটছেন;—

“কোন কামনা করিনে কিছু যাচিনে শ্যামা!
ও রাঙ্গা চরণে শুধু হেরি সুষমা।”

বলছেন;—

“আমার জীবন মরণ, শান্তি শরণ, তোর মা দু’টি রাঙ্গা পায়।”

ফের বলেছেন;—
“ইহকালের সাধ মিটেছে, রাখিস পায়ে পরকালে।”

 আনন্দময় মৈত্রও নিজ নামের অর্থকে নিরর্থক করে মাকে অনুযোগ জানাচ্ছেন;—

‘‘মা হয়ে সন্তানের মায়া ছেড় না গো ভবজায়া
আমি নিরানন্দে ভেসে যাই কূল দাও চরণে গো”।

 রবীন্দ্রনাথ মিত্র শুধু মার কাছে আবেদন না করে নিজের মনের কাছেও করছেন,—“ভজ শ্যামপদ, ঘুচিবে বিপদ, মন রে আমার।” তা’ বলে মাকেও ছাড়েন নি, তাঁকেও এক হাতে ধরে আছেন;—

“অভয় পদে দিতে হবে যে মা ঠাঁই।”

 চন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়ও ঐ সুরে সুর মিলিয়ে পায়ের দাবী পেশ করছেন;—

“চন্দ্রে অন্তে স্থান দিও মা পাই যেন পদ দু’খানি।”

শুধু কি পা ধরেই টানাটানি, কৃষ্ণানন্দ স্বামী তারস্বরে ডাকছেন;—

“একবার বিরাজ মা হৃদি কমল আসনে।
তোমার ভুবনভরা রূপটী একবার দেখে নিই মা নয়নে।”

জগবন্ধু তর্কবাগীশ বলছেন;—

‘‘হৃদকমলে চিন্তা কর বরাভয়করা শিবা।”

কেউ আবার বলছেন;—

“হৃদকমল-মঞ্চে দোলে করালবদনী শ্যামা।”

পুলিনবিহারী লাল গাইছেন;—

“আয় মন বিরলে বসে শ্যামা মায়ের নাম গাই।”
রামচন্দ্র রায় গাইছেন;

‘‘তারা-নামামৃত সদা কর পান, হবে প্রাণ সুশীতল,
পাবে দিব্যজ্ঞান।”

 মাতৃভক্তিতে কেউ বা এমনি বিভোর যে, বেণীদাস শ্যামাপূজায় বসে তাঁকেই অনুনয় করে সম্বোধন জানাচ্ছেন;—

“হৃদয়-মন্দিরে দাড়াও শ্যামা রূপে শ্যাম-শশি!
পূজিব অভয়চরণে দিয়ে ভক্তি-জবা রাশি।”

 তারপর এলেন মায়ের এক ভক্ত ছেলে,—সংক্ষিপ্ত নাম তাঁর ‘রামদত্ত’। শক্তির পশরা দিলেন খুলে, ভক্তির সঙ্গে ভাষার তুফান উন্মত্ত বেগে ছুটে বয়ে গেল! গাইলেন;—

“বারে বারে যে দুঃখ দিয়েছ দিতেছ তারা!
সে কেবলই দয়া তব জেনেছি মা দুঃখহরা।”

গাইলেন;—“শ্মশান ভালবাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি।

শ্মশানবাসিনী শ্যামা নাচবি বলে নিরবধি।”

গাইলেন;—

“তনয়ে তার তারিণি! ত্রিবিধ তাপে তারা নিশিদিন হতেছি সারা,
বার বার বৃথা আর, কাঁদায়োনা অনিবার, অধম সন্তানের দুঃখ,
নাশ মা দুঃখনাশিনি!”

অথবা—

“আর কবে দেখা দিবি মা, হররমা”—

 এ সব মর্ম্মছেড়া চিত্তদোহনকরা গভীর অনুভূতিভরা আর্ত অনুযোগ অনুনয় একে মা ত’ মা, মায়ের পাষাণ বাবাও বোধ হয় তুচ্ছ করতে পারেন না! বাঙ্গালী সন্তানের এই মর্মবাণী, তার এই আত্মাভিব্যক্তি, এর তুলনা আর কোন সাহিত্যে নেই। কবিরুদ্দিন মল্লিকের “তুমি সবই দিয়েছ, তাপ পাপ রোগ শোক দুঃখ যাতনা”; তাঁর এবং নজরুল ইসলামের ‘‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন” এবং আরও কত কি। এর শেষ নেই, শেষ হবেও না। অন্ততঃপক্ষে;—

“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী”

এ বাক্যের অথবা;—

“শরণাগত-দীনার্ত্ত-পরিত্রাণ-পরায়ণে
সর্ব্বস্যার্ত্তিহরে দেবি নারায়ণি নমোহস্তু তে।”

—এই আকুল প্রার্থনার।

 এই “সর্ব্বস্বরূপে সর্ব্বেশে সর্ব্বশক্তিসমন্বিতা”কেই সমস্ত সুখে দুঃখে শরণ না নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারবে না, বিশেষ রোগ শোকে। দুর্গা কালী চণ্ডী বাণী লক্ষ্মী অথবা দেশ-জননী জীবধাত্রী ধরিত্রীই সর্বজীবের কোন না কোন প্রকারে সান্তনার উপায়। জীব যে মাতৃ-মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই জন্ম নিয়েছে!

 এ সব ছাড়া আরও এক প্রকারের নারী-চিত্র আমরা কদাচ নর-রচনার মধ্য দিয়ে পাই; সাহিত্যে একঘেয়েমির মধ্যে যা’ একটু রসের জোগান এনে দেয়। এগুলি ব্যঙ্গচিত্র;—

“বাড়ীর গিন্নি আজ চল্লে কোথায় উদাসিনী হয়ে?
তোমার এত সাধের পাকা হাঁড়ি যাওনা দুটো নিয়ে।”

প্যারীমোহন কবিরত্ন বলছেন;—

“যার পয়সা নেই তার মরণ ভাল সংসারে।
পয়সা ভিন্ন হয় না ধন্য মান্যগণ্য কে করে?
দরিদ্র হইলে পতি, প্রাণ-প্রেয়সী রসবতী,
রোষান্বিতা হয়ে অতি, পতির পাশে ঘেঁষে না,
সদাই বলে বাঁচি মলে।”

 সে যুগের বহু সুহৃদয় কবি ভারতনারীর দুঃখ-দুর্দ্দশায় পরিতাপ ও অশ্রুপাত ক’রে তাদের প্রতি বহু সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। আনন্দচন্দ্র মিত্রের এই গানটী সেদিনের শিশু বিবাহের বিধবাদের উদ্দেশ্যে রচিত হলেও আজও সমাজের কোন কোন স্তরে বিধবাদের অবস্থা এর চেয়ে খুব উন্নত হয় নি;—

‘ভারতশ্মশান মাঝে আমি রে বিধবাবালা,
বিষের মুরতি করে বিধি আমায় পাঠাইলা,
জানি না কেমন পতি, মনে নাইরে সে মূরতি,
তথাপি যুবতী হয়ে পেটে অন্ন নাই দু’বেলা।”

 ইংরাজী কাব্যগ্রন্থে বিচিত্রিতা নারীদের বহু চরিত্র দৃষ্ট হয়। তা’ এত বেশী যে একটীমাত্র প্রবন্ধে তা’ নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়া হাস্যজনক। মিল্টনে নারীচিত্র তেমন কিছু নেই। বায়রণের “লিওনোরা” প্রভৃতিতে সুন্দর নারীচিত্র আছে। দেশদ্রোহী প্রেমপাত্রকে কঠোর ধিক্কারে লিওনোরার কঠোরতর প্রায়শ্চিত্তে বাধ্য করা নারীমহিমার একটী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত,—তারপর সেই মৃত্যু-মিলন! বহু-বিলম্বিত হয়ে গেলেও সম্মিলিত হওয়াই যে তাদের ভাগ্যলিপি!

 টেনিসনের “ডোরা”য় নিষ্কাম প্রেম এবং আত্মত্যাগ, “রিচ্‌পা’’য় মৃত্যুমুখী জননীর ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলান রাজদণ্ডে দণ্ডিত পুত্রের খসে-পড়া অস্থিগুলি নিদ্রাহীন নিশীথ রাত্রে সংগ্রহ করার কাহিনী যেমন ভীষণ তেমনই সকরুণ। “লকশ্লেহেলে’’র বিশ্বাসঘাতিনী অ্যামির এবং ষাট বৎসর পরে পরলোকবাসিনীর স্মৃতি-তর্পণে স্নেহকোমল ক্ষমাময় প্রণয়ীর অন্তরভিব্যক্তি মানবচরিত্রের সুস্পষ্ট অভিব্যক্ত রূপ।

 মিসেস হেম্যানের ভাইবোনদের বিয়োগকাহিনীর করুণ ছবিটি চোখে জল আনে, অবশ্য সমব্যথীদের।

 ওয়ার্ডসওয়ার্থের “গ্রাম্যমেয়ে” পল্লীগাথায় সহৃদয়তায় ফুটে আছে। তাঁর অনেকগুলি ছোট ছোট ছবির মধ্যে মেয়েদের বেশ সহৃদয় চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।

 স্কটের “লেডী অফ দি লেকে” নির্বাসিত বনবাসী ভূতপূর্ব অভিজাত পিতার কন্যা অ্যামি চিত্র নারীত্বে সমুজ্জ্বল। আকর্ষণকারী আগন্তুকের দিকে মন ছুটতে চাইতেই তাকে বল্‌গা টেনে ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্যে বেশ একটা সুষ্ঠু সংযম ও কৃতিত্ব আছে। বার্ণসের প্রেমগাথায় নারী-স্তুতি যথেষ্ট!

 গ্যেটের ‘‘ফষ্টে”র মার্গা রেট এবং মার্থা চরিত্র হিসাবে কিছুই নয়।

 ফরাসী কবিদের রচনার সঙ্গে অপরিচয় জন্য তাঁদের কোন নারীচিত্রের সংবাদ সংগ্রহ হয় নি। তাঁদের গদ্যসাহিত্য আজ বিশ্বসাহিত্যে পরিণত হয়ে পৃথিবীর অর্ধশিক্ষিতদের নিকটেও অর্ধপরিচিত হয়ে গিয়েছে, জানি না, কেন বিশ্ব-সাহিত্যে ওঁদের কাব্যের বা কবিতার তেমন হিসাবে প্রচার নেই।

 জাপানী কবিতার বরং সমাদর দেখা যায়। ভাবপ্রবণ জাতির মধ্যে এ-যুগেও কবিতার কিছু সম্বর্ধনা সম্ভব, যেমন বাংলায়। তবে অনুবাদ-সাহিত্যের মধ্যে “গাথা”-জাতীয় কিছু পাওয়া যায় নি।

 চীনেও কাব্যচর্চা এবং কবিতার মধ্য দিয়ে নারীবন্দনা মন্দ হয় নি, কিছু কিছু অনুবাদও হয়েছে।

 তরুদত্তের ইংরাজী কবিতায় এ-দেশের পুণ্যবতীরা বিদেশে পরিচিতা হয়েছেন, যেমন সাবিত্রী, যেমন হর-পরিণীতা পার্বতীউমার ভিখারী সংসারের অর্থাভাবে কন্যারূপ পরিচয়ে ভক্ত শাঁখারীর কাছে শাঁখা পরা। কিম্বদন্তীমূলক হলেও ভক্তিরসাত্মক এই গল্পগুলির একটা বিশেষ মূল্য আছে।

 আধুনিক প্রায় সমস্ত ইংরাজী ঔপন্যাসিকদের রচনার মধ্যে সৃষ্টিশক্তির গভীর শিথিলতা দেখা দিয়েছে। যান্ত্রিক আবিষ্কারের যুগে মানুষের মনও একান্তভাবেই যেন যন্ত্রবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আধুনিক নারীরা যত্র তত্র হোটেলে রেস্তোরাঁয় পুরুষবান্ধবদের সঙ্গে গিয়ে “ককটেল,” “ক্ল্যারেট” “শ্যম্পেন,” “পোর্ট’’, অ্যাপেরিটিফ, আরও কত কিই না ফরমায়েস করছেন; একখানা কাটলেট চাখ্‌ছেন, নয়ত দু’একখানা স্যাণ্ডউইচ; রুমালে মুখ মুছে আয়না ধরে ‘‘ঠোঁটের সিন্দুর” ও পাউডরপাফ্‌, বা’র করে “মেক-আপ” মেরামত করে নিচ্ছেন, পুরুষ বান্ধবদের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিচ্ছেন;—দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম এ-সব বড় ব্যাপারের খবর কোথাও মেলে না! গতযুদ্ধের পরের সাহিত্যেও নূতন কিছু বড় রকম সাহিত্যিক-চরিত্র নারী-চরিত্র সৃষ্টি হতে দেখিনি। হীনতা যে অনেক বেড়েছে সে-টা নব্যসাহিত্যে অস্পষ্ট নেই; অথচ এত বড় দুইটা সাহিত্যিক উপাদান সামনে দিয়ে চলে গেল!

 সেক্সপীয়রের আদর্শ প্রণয়িনী জুলিয়েটের প্রণয়ীর শোকে মৃত্যু, ইয়াগোর চক্রান্তে ডেসডিমোনার স্বামী ওথেলোর হাতে নিধন, অফেলিয়া প্রভৃতি চরিত্র আমাদের সমবেদনা উদ্রেক করে; পোর্শিয়া আমাদের বিস্ময় এবং শ্রদ্ধা উদ্রেক করেন। “টেমিং অফ দি শ্রু” (উগ্রচণ্ডার বশীকরণ) নাটকে ক্যাথারিণা, ‘‘কিং হেনরী ফিফ্‌থ’’ (রাজা পঞ্চম হেনরী)-এ রাজকন্যা ক্যাথারিণের প্রেমালাপে, “টুয়েলথ নাইট” (দ্বাদশরাত্রি) নাটকে অলিভিয়া, “মচ এডো অ্যাবাউট নথিং” (বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া) নাটকের বিয়েট্রিস, “টু জেণ্টলমেন অফ ভেরোণা” (ভেরোণা নগরের দুইজন সম্ভ্রান্ত লোক) নাটকের জুলিয়া ‘‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’’ (যাদৃশী ভাবনা) এর রোজালিও এ-সমস্তই নাট্যকারের অপূর্ব্ব সৃষ্টি। তবে এঁদের মধ্যেও নিছক সত্য কবি চিত্ত দর্পণে প্রতিফলিত হয়েছিল, না কবিকল্পনা সেই বাস্তবচিত্রে রং ফলিয়েছে তা’ আমাদের পক্ষে বলা কঠিন। বিশেষজ্ঞগণের মতে তাঁর “লেভী ম্যাকবেথ’’ই নারীচরিত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে জীবন্ত এবং সর্ব্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র। তিনি রাজ্যলোভে নৃপতি ডানকানকে হত্যা করতে স্বামীকে প্ররোচিত ক’রে নারীচরিত্রের চরম অবনতির দৃষ্টান্ত স্বরূপা হয়ে আছেন।

 শেরিডানের “মিসেস ম্যালাপ” চরিত্র নির্মল হাস্যরসের উৎস; বড় বড় ভুল কথা বলে যারা পাণ্ডিত্য দেখাতে চায় আজও তাদের পরিহাস করে ইংলণ্ডে ম্যালাপ্রপ বলা হয়।

 ডিকেন্সের “পিকউইক পেপারে’’র মিসেস লিও হাণ্টার ফোতে বাবুয়ানীর আদর্শ। “অলিভার টুইষ্ট”-এর চোরডাকাতদের দলের মধ্যে কোমলহৃদয়া ন্যান্সি একটি উজ্জ্বল চিত্র; সর্বস্তরের মধ্যেই যে মহৎ চরিত্রের নরনারী থাকে তার একষ্টি সুন্দর দৃষ্টান্ত। বাস্তবজগতেও কি এ-দৃশ্য আমরা দেখতে পাচ্ছি না? “ওল্ডকিউরিঅসিটিসপ” (পুরাণো বিচিত্র জিনিসের দোকান) উপন্যাসের “ছোট নেল” ছোট হলেও তুচ্ছ নয়। এ-ছাড়া সারা গ্যাম্প, ডলি, গর্ডন তাদেরও বৈশিষ্ট্য আছে।

 রাইডার হ্যাগার্ডের “সি” (আয়েষা)-র চরিত্র অদ্ভুত রসাত্মক বলা যায়; এ-পরিকল্পনা সম্পূর্ণ নূতন।

 আলেকজাণ্ডার ডুমার “কাউণ্ট অফ মণ্টিক্রিষ্টো”তে মার্সিনেস এবং রিণি চরিত্র দু’টি সুন্দর এবং ভ্যালেণ্টাইনের সৎমা অত্যদ্ভুত মন্দ চরিত্র হলেও আশ্চর্য্য নূতন। সন্তানম্নেহে পৈশাচিক পাপ করতে যার বাধেনি সেই মা সেই সন্তানকে বিষ খাইয়ে সঙ্গে করে নিয়ে পরলোকে যাত্রা করল, এ-চিত্র যেমন নিষ্ঠুর তেমনই অদ্ভুত!

 থ্যাকারের “ভেনিটী ফেয়ার”-এর বেকী শার্প নীতিজ্ঞানবিবর্জিতা এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালিনী। জেন অষ্টেনের এলিনর বিজ্ঞতায় এবং মেরিয়ন হঠকারিতায় ও ভাবালুতার জন্য এবং গর্ব ও কুসংস্কারে ক্যাথারিণ এলিজাবেথ উল্লেখযোগ্য।

 শার্লট ব্রণ্টের “ডিলেটে’’র শিক্ষয়িত্রী ম্যাডাম—বেক-এর কথাও এখানে বলা উচিত।

 স্কটের “আইভ্যান হো” উপন্যাসের লেডী রাওয়েনা একটি মাটীর পুতুল; কিন্তু ইহুদী নারী রেবেকার চিত্র সর্বদেশের উপন্যাস-কন্যাদের আদর্শ এবং এই বাংলাদেশে সুপরিচিত। রেবেকার দুঃখে চোখের জল ফেলে নি এমন নিষ্ঠুর অল্পই আছে। ‘‘হার্ট অফ মিডলোথিয়ন” গল্পের ভ্যানী এবং এফি ডিনসের চরিত্র রবরয়ের ডায়ানা, ভার্ণন, ভিক্টর হুগোর “লে মিসারেবল’’ উপন্যাসের জাঁ ভলজ্যাঁ ব পালিতা কন্যা কঁসেট এরা নিজস্ব দোষগুণে বাস্তবচিত্র, কিন্তু একটি সিস্‌টারের চরিত্র যথার্থ অতুলনীয়! যাঁর একটী ইঙ্গিতে অভাগা “জিন্‌” পুলিসের হাত হ’তে বেঁচে গেল।

 টলষ্টয়ের “রিসারেকশন” উপন্যাসের নায়িকা সরলা গ্রাম্যবালিকা কাট্‌সা ডিমিট্রির প্ররোচনায় পাপে লিপ্ত হয়ে আশ্রয়চ্যুতা এবং সমাজচ্যুতা হ’ল, তারপর খুনের অপরাধে সাইবিরিয়ায় নির্বাসিত হয়। ডিমিট্রি পরে অনুতপ্ত হয়ে নিজের সমস্ত ধনৈশ্বর্য পরিত্যাগ করে সাইবিরিয়ায় তার সঙ্গী হল, তা’র সুপ্ত মহত্ত্ব প্রেমের এবং অনুশোচনার মধ্য দিয়ে বিকশিত হ’ল।

 বার্ণার্ড শ’র নাটকগুলিতে প্রাচীন প্রথার বিরুদ্ধে সর্বত্রই বিদ্রোহ সুপরিস্ফুট। সমাজ এবং রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ করে হয়ত তিনি ভালই করেছেন কিন্তু বিদ্রুপ করাটাই তাঁর ধর্ম হয়ে যাওয়ায় অনেক বড় জিনিসের মধ্যেও তিনি কোন মহত্ত্ব দেখতে পাননি। সতীত্বের এবং এক-পতিপত্নীত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা তাঁর লেখায় বার বার ফুটে উঠেছে। “ম্যান এবং সুপারম্যান” (মানব এবং মহামানব) নাটকে তাঁর ‘আনা’ বলেছেন, “সতীত্বের বিরুদ্ধে একটি কথা বলার অর্থ আমাকে অপমান করা।” তাতে ডন জুয়ান বলছেন, “ভদ্রে, আপনার সতীত্বের বিরুদ্ধে আমি কিছুই বলছি না, কারণ আপনার সতীত্ব একটি স্বামী এবং বারোটি সন্তানে রূপ নিয়েছে। অসতীত্বের চরমে গেলে আপনি এর চেয়ে বেশী কি করতে পারতেন?” এখানে বিবাহের মধ্য দিয়ে কামনার যথেচ্ছাচারকে তিনি আক্রমণ করেছেন, কিন্তু সে জন্য সমস্ত বিবাহবন্ধন কখনই দায়ী হতে পারে না। বিবাহের অর্থ একানুগত্যের মধ্য দিয়ে দেহমনের সংযমশিক্ষা সে কথা তিনি ভুলে গিয়েছেন। যত বড় লেখকই তিনি হোন না কেন, তিনি দেশকালের গণ্ডি-সীমাতেই নিবদ্ধ আছেন। এইখানে সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের মাতৃনামের কবিতার দুটি লাইন তুলে দিলাম,—

“ত্রাসে ক্ষোভে শোকে দুঃখে, আগে নাম উঠে মুখে,
কিবা একাক্ষরী নাম মানবতারণ!
যার শব্দে যমচরে, নিকটে আসিতে ডরে,
এ ভব অশুভঘন, বিপদবারণ।”

 এই জিনিসটি পাশ্চাত্যসাহিত্যে আমরা খুব বেশী দেখতে পাই না। তবে শোপেনহাউয়ার বলেছেন;—“She pays the debt of life not by what she does, but by what she suffers’’.

 গর্কীর “মাদারে” মাতৃচরিত্র অনবদ্য; কিন্তু ভারতীয় মাতৃচরিত্র অধিকতর উদার।

 ইবসেনের “ডলস্‌ হাউসে’’র নায়িকা নোরা স্বামীর রোগের সময় ঋণ করে, জাল করে অর্থ সংগ্রহ করে তাকে বাঁচিয়ে তুলেছিল, কিন্তু পরে সেই স্বামীই যখন তাকে অপমান করলে, তখন এক মুহূর্ত্তে তার স্বামীপুত্রের সংসার খেলাঘর বলে মনে হ’ল, সে সব ছেড়ে দিয়ে চলে গেল, স্বামীর শত অনুরোধেও তাঁর আদর্শ-বিচ্যুতির পর আর তার পক্ষে স্বামীর ঘর করা সম্ভবপর হ’ল না। তাঁর আর এক প্রসিদ্ধ নারীচরিত্র “গোষ্ঠস” (প্রেতগণ) নাটকের মিসেস অ্যালভিং অসচ্চরিত্র স্বামীর হাতে আজীবন অপমান এবং লাঞ্ছনা সয়ে নিজেকে বলি দিলেন ছেলের মুখ চেয়ে, সেই ছেলেও শেষে চরিত্রহীন এবং পাগল হ’ল, মায়ের চিরজীবনের স্বার্থত্যাগ বৃথাই গেল। আমাদের কাছে,—অন্ততঃ আমাদের চোখে তিনিই আদর্শ-জননী পদবাচ্যা।

 টমাস হার্ডির প্রথম যুগের রচিত উপন্যাসসমূহের নায়িকাগণের চরিত্রাঙ্কণে যথেষ্ট সংযমের পরিচয় পাওয়া যায়; পরে ক্রমশঃ তিনি উহাদের অধিকতর স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য এবং স্পষ্টতর ভাবেই চিত্তবৃত্তি অনুসরণ করতে দিয়েছেন। তাঁর “ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড” যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন অনেকে উহা জর্জ এলিয়টের লেখা বলে মনে করেছিলেন। “টেস অফ দি ডক্টরভিলস”-ই হার্ডির সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ উপন্যাস; ইহার এঞ্জেল ক্লেয়ারের করুণকাহিনী সকলেরই মর্মস্পর্শী। “দি মেয়র অফ কাষ্টারব্রিজ”, “জুড দি অবস্‌কিউর”, “এ গ্রুপ অফ নোবল ডেমস,” “দি উডল্যাণ্ডারস্‌” এ-সকলের নারীচরিত্রগুলিও বর্ণন-ভঙ্গীতে মনোরম।

 হল কেনের উপন্যাসে নারীচরিত্রের সহিত তুলনায় পুরুষচরিত্রগুলিই সমধিক জীবন্ত ও সমুজ্জ্বল, তথাপি অল্পাধিক ভাল ও মন্দয় সজীব নারীদের দেখা পাওয়া যায়। মাষ্টার অফ ম্যানে” জজের মেয়ে নায়িকা একটি আদর্শ স্থানীয়া নারী। “প্রডিগ্যাল সনে”র মাতৃরূপটি একান্তই মাতৃভাবাপন্ন। ‘ইটারনালসিটি’র ‘রোমা’ চরিত্রে স্পর্শমণির প্রভাব লক্ষণীয়।

 মারি করেলীর “থেলমা”, “ইটারন্যাল লাইফ,” “সরোজ অফ সেটানে’’ একই মহীয়সী নারীকে পুনঃ পুনঃ দর্শন করি। মিসেস হেনরী উডের ‘‘ঈষ্টলীনে’র ইজাবেলা বিশ্বসাহিত্যের সুপরিচিত চিত্র। বহু গ্রন্থে বহু স্বাভাবিক নারীচিত্র তিনি এঁকেছেন; মাত্র একটির উল্লেখ করলাম।

 রামনারায়ণ তর্করত্ন বা নাটুকে রামনারায়ণের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব” বাঙ্গালার প্রথম নাটক। সেদিনের কৌলীন্য পাপের প্রায়শ্চিত্তকারিণী নারীদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভুতির সঙ্গেই ইহা সৃষ্টি হয়েছিল। এইটি এবং তাঁর নবনাটক মৌলিক রচনা; তা ছাড়া রত্নাবলী, বেণীসংহার, মালতীমাধব, শকুন্তলা প্রভৃতি সংস্কৃত হতে অনুবাদ তাঁর আরও কয়েকটি নাটক আছে।

 মাইকেল মধুসূদনের নারীচরিত্রে গ্রীক সাহিত্যের প্রভাব থাকলেও তাঁর সীতা আমাদেরই চিরন্তন সীতা দেবী। সরমা সমদুঃখী কোমলহৃদয়া, ধর্মভীরু একটি সুপরিচিতা ঘরণী; প্রমীলা মহাভারতের নারীরাজ্যের অধীশ্বরীরই ছায়া দিয়ে গড়া কায়ামূর্তি;—‘‘আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে” বলে আমাদের সামনে এসে দেখা দেন, আবার পতির দেহান্তে প্রতিশোধস্পৃহা বিসর্জন দিয়ে পতিশোকাকুলা সাধারণ ললনার মতই পতি-চিতানলে প্রাণরিসর্জনও করেন। নারীরাজ্যের একচ্ছত্রা রাণী মহাভারতের প্রমীলাও অর্জ্জুনকে দেখামাত্র বীরাঙ্গনা-ধর্ম বিসর্জন দিয়ে তাঁকে পতিত্বে বরণ করতে আবেদন পেশ করলেন। চিরন্তনী নারী বর্মচর্মের ভিতর থেকে এক মুহূর্তে বেরিয়ে এল! তাঁর ‘‘শর্মিষ্ঠা” ও “কৃষ্ণকুমারী নাটকে”, “তিলোত্তমাসম্ভবকাব্যে”, “একেই কি বলে সভ্যতা” এবং “বুড়োশালিকের ঘাড়ে রোয়াঁ” প্রহসনদ্বয়ে, “ব্রজাঙ্গনা” এবং “বীরাঙ্গনা” কাব্যদ্বয়ে বহু বিচিত্র ধরণের নারীচিত্রের সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়। বীরাঙ্গনা কাব্যই মাইকেলের পূর্ণ প্রতিভার বিকাশের দৃষ্টান্তস্থল। যেমন চন্দ্রের পাশে নক্ষত্র শোভা পায় সেইমত বৈষ্ণব-প্রেমগাথা সম্বন্ধে বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস, গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাসের পার্শ্বে মধুসূদনও “ব্রজাঙ্গনা” লিখে চিরদিন সমুজ্জ্বল থাকবেন।

 প্রমীলা-দ্বয়ের কথা উপলক্ষ্যে আমাদের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদাকে। কিন্তু তাঁর কল্পনাপ্রসূতা সেই মেয়েটির কথাই আগে বলি, যে সেদিনের অঙ্গদেশের মহামন্ত্রীর কাছে আত্মপরিচয় দিচ্ছিল;

“ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিরে ভুলাতে পাঠাইলে বনে যে কয়জনা,
সাজায়ে যতনে ভূষণে রতনে আমি তারই এক বারাঙ্গনা”।

 ব্যাধবাণবিদ্ধা ত্রস্তা হরিণীর মত অন্তর্বিদ্ধ সেই মেয়েটি! তার মর্মবেদনা না বুঝে কূটনীতিজ্ঞ ‘‘হাজার পোড়-খাওয়া সুবিজ্ঞ রাজমন্ত্রীর উপহাসকুটিল হাস্যাভাসে অধিকতর আহত হয়ে অভিমানভরে সে বেচারী বলে উঠেছিল;—

‘মন্ত্রি আবার, সেই বাঁকা হাসি? না হয় দেবতা আমাতে নাই,
মাটি দিয়ে তবু গড়ে ত প্রতিমা, সাধকেরা পূজা করে ত তাই?
একদিন তার পূজা হয়ে গেলে চিরদিন তরে বিসর্জন,
খেলার পুতলি করিয়া তাহারে আর কি খেলিবে পৌরজন?”

 রঙ্গলালের ‘‘পদ্মিনী”তে পদ্মাবতের সেই চিরকাহিনী বাঙ্গালীর কানের কাছে ঝঙ্কৃত হলো। আজ সেই অতুলনীয়া রাজপুত রাণীর শৌর্য বীর্য ধৈর্য ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির কুটকৌশলকে রূপকথা বলে কথা উঠলেও মানুষের প্রাণের মধ্যে সে যে সুদৃঢ় আসন নিয়েছে, সেখান থেকে তাকে স্থানচ্যুত করা সহজ নয়। পদ্মিনী সত্য না হলেও কবি-কল্পনার যে একটি অপূর্ব আদর্শ সৃষ্টি, তাতে সন্দেহ নেই এবং বিভিন্ন নামে ও রূপে এঁরাই যে সেদিন রাজপুতানার ঘরে ঘরে অধিষ্ঠাত্রী ছিলেন তাও নিঃসংশয়িত সত্য।

 জ্যোতিরিন্দ্রনাথের “সরোজিনী” নাটকে এই পদ্মিনীই ছদ্মবেশ ধরেছেন। ‘‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়রে’’র মতই;—

“জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ।”
পরাণ সঁপিবে বিধবাবালা”।

এ গানও একদা বাংলার ছেলেমেয়েদের কণ্ঠস্থ ছিল। “অলীক প্রকাশ” ‘‘অশ্রুমতী” প্রভৃতি নাটক সেদিন মহাসমারোহে অভিনীত হ’ত। তাঁর নারীচরিত্র সুচিত্রিত হলেও প্রতাপসিংহ কন্যার প্রেমচিত্র একান্তই অসঙ্গত।

 কবি নবীনচন্দ্র সেনের ‘‘অবকাশঞ্জিনী” (দুই খণ্ডে) নানা জাতীয়া নরনারীর বাস্তব চিত্র, অর্থাৎ নিরাবরণ নারী-চিত্র এঁকে তিনি উত্তর কালের কবিদের পথপ্রদর্শন করেছেন! “কোন এক বিধবা রমণীর প্রতি’’ প্রভৃতিতে আমরা তাঁর রুচির প্রশংসা করিনি। অভাগিনী “বাল্যবিধবা’’র প্রতি প্রলোভনকারী পুরুষের নির্হৃদয়-বিশ্বাসঘাতকতার কদর্য চিত্রাবলী সুললিত শ্লোকচ্ছন্দে প্রদর্শন, কাব্যজগতের পুষ্প-বিতানে কণ্টকাকীর্ণ বিষতরুর স্থানই গ্রহন করে; তাদের আর কোন সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। মহাকাব্যে অবশ্য অনেক কিছুরই প্রবেশপথ অবারিত। খণ্ডকাব্যে এদের স্থান সৌন্দর্য সৃষ্টির (বা আর্টের) দিক থেকে বা সমাজ পুষ্টির পক্ষ থেকে কোনদিক দিয়েই শোভা বা স্বাস্থ্যপ্রদ নয়।

 তাঁর “রৈবতক”, “কুরুক্ষেত্র,” “প্রভাস”গ্রন্থে তিনি আমাদের পৌরাণিকী চিরপরিচিতাদের অর্দ্ধাবগুণ্ঠন মোচন করে তাঁদের কারু কারু প্রকৃত রূপ আমাদের চোখের সামনে ধরে দিয়ে চক্ষু সার্থক করিয়েছেন, যেমন সত্যভামা (মানের ঢেঁকি, পারিজাতহরণ কাণ্ডের প্রসিদ্ধা নায়িকা) রুক্মিণী এবং সর্বোপরি শ্রীকৃষ্ণভগিনী বৈষ্ণবী সুভদ্রা। সুভদ্রা-চরিত্র কবি মহামানব ও যুগাবতারের ভগিনীর ঠিক যেমন হওয়া উচিত, সেই ভাবেই সৃষ্টি ক’রে, নিজের সৃষ্টিতত্ত্ব-কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই পুত্রবিয়োগে সুভদ্রার মুখে শুনি;

“দয়াময়! নাহি শোক, সাধিল তোমার কর্ম্ম
পুত্র যার, শোক তার নাহি ধরাতলে।
ক্ষত্রিয়ের গুরু দ্রোণ, ভুজবলে তাঁর পণ,
ষোল বৎসরের শিশু লঙ্ঘিল যাহার,
সেই বীর-জননীর শোক কি আবার!”

 বালবিধবা পূতচরিত্রা হাস্যরহস্যময়ী অথচ মাতৃস্নেহে অভিষিক্তা সুলোচনা এবং অর্জুনের প্রতি ব্যর্থপ্রেমের পরিশেষে নিষ্কাম প্রেমে, বিশ্বপ্রেমে আত্মনিমজ্জিতা শৈল তাঁহার নিজস্ব সৃষ্টা এই দুইটি নারী চরিত্র প্রকৃতই সুন্দর! তাদের পরিচয় দু’টি কথায় দেওয়া সম্ভব না হ’লেও ঈষৎ একটু আভাস দু’টি লাইনে দেওয়া যায়;—

“হাসে নাই নিজ সুখে,  কাঁদে নাই নিজ দুঃখে,
চিরদিন প্রেমময়ী সলিলের মত,
আপন তরল প্রাণ,  পরে করিয়াছে দান,
সুলোচনা চিরদিন পরপ্রাণগত।”

 কুরুক্ষেত্রের শ্মশানভূমে সুভদ্রার “আমাদের বক্ষ-চিতা এরূপে কি নির্বাপণ হইবে মা?” এই প্রশ্নের উত্তরে শৈলজার অভিব্যক্তিতেই তার চরিত্রের পরম মহত্ত্ব প্রস্ফুটিত;—

“আমাদের কয় চিতা?
দেখ না অনন্ত চিতা ভারত মাতার বক্ষে,
পুড়ি এই চিতানলে অধর্ম তিমির রাশি,
নবধর্ম ঊষা ওই আনন্দে উঠিছে ভাসি।”

 অবশ্য তার ধর্মরাজ্য[২১] ইত্যাদি নিশার স্বপনসম বর্তমান আটলাণ্টিক চার্টারের মতই রাজনৈতিকের কূটবুদ্ধির খেলামাত্র, তার জন্য সে নিশ্চয় দায়ী নয়।

 হেমচন্দ্রের ঐন্দ্রিলা ইন্দ্র-বিজয়ী স্পর্ধিত বৃত্রাসুরের অতিদর্পিতা পত্নী, যেমন আমরা সচরাচর ধনীগৃহে বিশেষতঃ নূতন বড়লোক হওয়া সাধারণ ঘরের মেয়েদের কাহারও কাহারও ঘরে দেখতে পাই। পুত্রবধু ইন্দুবালা ঠিক এর বিপরীত চিত্র। সুকুমারী ধর্মভীরু কিশোরী মেয়েটি মনের বুকে ছোট্ট একটী ছবি এঁকে রেখে দিয়েছে। ঐন্দ্রিলার ঈর্ষাদগ্ধ সদর্প উক্তি;—

“সত্যই কি তবে শচী এতই রূপসী?
আমার অঙ্গের বর্ণ তার অঙ্গে মসি!”

 রূপ-গরবিণীর আহতচিত্তেরই যোগ্য বিষোদ্‌গার!

 প্রমথনাথের “শুম্ভনিশুম্ভবধে” কিন্তু শুম্ভপত্নী শুভ্রা আমাদের পূর্বোল্লিখিত মতকে খণ্ডন করেছেন। রূপসী তরুণীরূপধারিণী মহাশক্তি মহামায়ার প্রতি প্রেমনিবেদন করতে গিয়ে দৈত্যপতি তাঁর সংসারে ও সমাজে যে দারুণ বিপ্লব ইচ্ছা সাধে ডেকে আনলেন সেই কথার উল্লেখ করে প্রবলপ্রতাপ স্বামীর প্রতি সমুচিত ভর্ৎসনাবাণী প্রয়োগ করতে তিনি কুণ্ঠিতা নন; তাঁদের পতি-পত্নীর আলোচনার ভিতর দিয়ে তা’ সুস্পষ্ট হয়েছে। দুর্ধর্ষ বীর সেনাপতি ধূম্রলোচনের রণস্থলে পতনের সংবাদে শুম্ভ যখন বিস্ময়বিমূঢ়, তখন দৈত্যেন্দ্রাণীকে আসতে দেখে আহ্বান করে সেই অত্যদ্ভুত সংবাদ প্রদান করলে;—

−“এস শুভ্রে, শুনেছ কি সব সমাচার?
অবলা নারীর হাতে দৈত্যের সংহার।”

দৈত্যরাজমহিষী পুর্বেই সে-সংবাদ পেয়েছিলেন, বিস্ময়প্রকাশ না করে তিনি নিজ অন্তরের তীব্র জ্বালাময় সত্য প্রকাশ করলেন;—

“শুনিয়াছি দৈত্যরাজ অদ্ভুত কথন
নারীহস্তে হত আজি সে ধূম্রলোচন।
কিন্তু ভেবে দেখ নাথ, এ হেন অনর্থপাত,
স্বেচ্ছায় ঘটালে তুমি, হায় অকারণ
একটি নারীর রূপে মজাইয়া মন।”

পল্লীবাসী অনাদৃত কবি গোবিন্দদাসের প্রতি তাঁর স্বদেশবাসী যথেষ্ট অবিচার ও অন্যায় আচরণ করলেও তিনি করেন নি। দুঃখ শোক রোগাহত দরিদ্র কবি “প্রেম ও ফুল”-এ বঙ্গবাণীর চরণে যে পূজার অর্ঘ দান করেছিলেন, তারপর আরও কয়েকখানি কবিতাপুস্তকে বহু অমূল্য কবিতারত্নের মাল্য রচনা ক’রে সসঙ্কোচে বাগ্‌বাদিনীর কণ্ঠে তিনি প্রদান করেছেন; তাদের মধ্যে অনেক সাধারণ দুর্লভ বস্তু রয়েছে, কিন্তু গুণগ্রাহী সুধীজনের সে-দিকে নেত্রপাত করবার অবসর এখনও হয় নি। “প্রেম ও ফুলে’ কতকগুলি মর্মন্তুদ পারিবারিক অতি করুণ চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল—যা অর্ধ শতাব্দীতেও বিস্মৃত হতে দেয়নি। একটি কন্যা প্রমদা এবং অপরটি পত্নীর অকালমৃত্যুর শোকাবহ দৃশ্য; সেই ছবি দু’টির সঙ্গে যেন কর্ণবিদারী রোমাঞ্চকারী “বল হরি হরিবোল” ধ্বনি কাণে ভেসে ওঠে; প্রথমটির একাংশ;—

“আবার সে উচ্চরোল ঘন ঘন হরিবোল,
প্রাণময়ী প্রমদারে কোথা নিয়ে যায়,
দিব না দিব না নিতে, দিব না সমাধি দিতে,
কাড়িয়া সে পাগলিনী কোলে নিতে চায়।”

ইত্যাদি চোখে জল না এনে পারে না। পত্নী সারদার চিতাশয্যার পাশে দাঁড়ান কবির মর্মকথাগুলিও এই রকমই মর্মন্তুদ;—

“কি দেখিতে আসিয়াছ ওহে শশধর!
তোমার অধিক শোভা, ততোধিক মনোলোভা,
শোয়ায়ে দিয়েছি আজ চিতার উপর।”

কন্যা মণিকুন্তলার উল্লেখ করে;—

“মা-মরা দুঃখিনী মেয়ে বড় যন্ত্রণার
মা-মরা দুঃখিনী মেয়ে, এ-ঘরে ও-ঘরে যেয়ে,
দেখে ইতি উতি কোথা জননী তাহার
সারদার শেষচিহ্ন “মণিই” আমার।”

 এইসব শোকাশ্রুপূর্ণ কবিতার পর এর ঠিক উল্টাসুরে “কুসুমের বনে পাওয়া কুসুমকে’’ নিয়ে যে কাব্য, তা’তে বিস্মিত বা সস্মিত হ’বার কোন কারণই নেই, সাহিত্যিক বা বাস্তব নারীর তার সঙ্গে কোন গৌরবের সংযোগ নেই। তাঁর শেষবীণার তারের ঝঙ্কারে আমরা শোকসঙ্গীতের রেষই আবার শুন্‌তে পাই, কিন্তু সে ব্যক্তিগত শোকের কান্নাহাটি বিলাপমর্মর ছাপিয়ে সেই অগ্নি-কষা বাঙ্গালীর বুকের মাঝখানে সপাৎ করে ঘা দিয়েছিল;− “স্বদেশ, স্বদেশ করিস কা’রে এ-দেশ তোদের নয়”,—এবং কেন নয়, সে-কথাও তিনি ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

 ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে জাতীয় জাগরণের ঊষালোকে বাঙ্গালী নূতন করে নারীজাতীর মাহাত্ম্য উপলব্ধি করল। বাইরের জগতে অধীনতার অপমান, তার নিরুপায় অক্ষম অবস্থা তাকে যত বেশী পীড়া দিতে লাগল; ততই সে নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে একটা কিছু অবলম্বন খুঁজছিল—যা দুর্বিসহ লজ্জা থেকে এবং আত্ম-অবিশ্বাস থেকে তাকে বাঁচাতে পারে। সেই সময়ে তার দৃষ্টি পড়ল তার অতীত সাহিত্যে, চিরাগত ধর্মে এবং তার সর্বংসহা শক্তিরূপিণী গৃহলক্ষ্মীর প্রতি। এই নারীর নীরব অথচ প্রবল নিষ্ঠার মধ্যে সে তার মুক্তির পথ আবিষ্কার করল, নিজের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ খুঁজে পেল। নবযুগের বাংলাসাহিত্য সে-দিন তাই সহসা নারীস্তুতিতে মুখর হয়ে উঠেছিল। বিহারীলাল “সারদা”রূপে যাঁকে অন্তরবাসিনী এবং অন্তঃপুরকল্যাণী কন্যা মাতা এবং বধুরূপে দেখে বলছেন;—

“মানবের কাছে কাছে, সদা সে মোহিনী আছে,
যে যেমন তার ঘরে, তেমনিই মুরতি ধরে।”

 যাকে পেয়ে পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে বলেছেন;—

“তুমি লক্ষ্মী সরস্বতী, আমি ব্রহ্মাণ্ডের পতি,
হোক গে এ বসুমতী, যার খুসি তার”

বলেছেন,

“তুমি মোর অমূল্যরতন, যুগযুগান্তরে তপের ফল,
তব প্রেমস্নেহ অমিয়সেবন দিয়েছে জীবনে অমর বল।”

 তাঁকেই সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার সজ্ঞানশ্রদ্ধায় “মহিলা”-কাব্যে বলেছেন;—

‘‘সবিলাস বিগ্রহ মানস সুষমার, আনন্দের প্রতিমা আত্মার
সাক্ষাৎ কার যেন ধ্যান কবিতার, মুগ্ধকারী মূরতি মায়ার।”

 বলেছেন;—

নর-পশু বনচারী, গৃহস্থ করিল নারী।
ছিল নর জড়ের প্রকার,
আদি নারী দিয়া তার সুখ আস্বাদন,
বিকাশিল বোধ কলি তার।
যদি মৃত্যু এনে থাকে মহিলা ধরায়,
সে ক্ষতি সে করেছে পূরণ,
যমযানে জরাজীর্ণে লোকান্তরে যায়,
নারী করে প্রসব নূতন।”

কোন দুঃখ ধরা ধরে, নারী যায়ে নাহি হরে?
মর্ত্তে মূর্ত্তিমতী মায়া অঙ্গ অঙ্গনার।

 কবি অক্ষয়কুমার বড়ালের নারী কোন রূপক রূপিণী নয়; নারীর জীবন্ত মূর্ত্তি।

“প্রাণান্তক জীবনসংগ্রামে তুমি বিধাতার আশীর্ব্বাদ
নিত্য জয় পরাজয়ে পাছে পাছে ফিরিতেছ
অঞ্চলে লইয়া সুখসাধ।”

 তিনি অসুন্দরকে সুন্দর করেন, লক্ষ্মীছাড়াকে লক্ষ্মীশ্রী এনে দেন;—

“আমি জগতের বাস, বিশ্বগ্রাসী মহোচ্ছ্বাস,
তুমি হেসে বসে বামে, সাজাইয়া ফুলদামে,
কুৎসিতে শিখালে শিবে হইতে সুন্দর।

তোমারই প্রণয়স্নেহ, বাঁধিল বিশালগেহ,
পাগলে করিল গৃহী, ভূতে মহেশ্বর।”

আবার বলেছেন;—

‘‘লয়ে প্রেম সুধারাশি,  এস দেবী, এস দাসি,
এস সখি, এস প্রাণপ্রিয়া।
এস সুখে দুঃখ হরে,  জন্ম মৃত্যু ভেঙ্গে চুরে
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ব্যাপিয়া।
এস প্রিয়া প্রাণাধিকা,  জীবন হোমাগ্নি শিখা
দিবসের পাপতাপ হোক হতমান,
ওই প্রেমে প্রেমানলে,  ওই স্পর্শে বাহুবন্ধে,
আবার জাগুক মনে আমি যে মহান।
একেশ্বর অদ্বিতীয় অনন্ত মহান॥”

 পত্নীবিয়োগের পর তাঁর কাব্যলক্ষ্মীকে গৃহলক্ষ্মীরূপে চিনতে পেরে যে শোকগাথা কবি গেয়েছেন, নারীজাতির সেই স্তবগাথা, আর্য্যঋষিদেরই সমুচ্চারিত বাণীর তাহা প্রতিধ্বনি।

কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন বলেছেন;—

“যাদুকরি যেই এলি, অমনি দিলাম ফেলি,
টীকাভাষ্য তোর ঐ চক্ষুদীপিকায়
বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস সব বোঝা যায়।
শব্দ হয় অর্থবান, রস হয় মূর্ত্তিমান,
রস উথলিয়া উঠে প্রতি উপমায়
যাদুকরি এত যাদু শিখিলি কোথায়?”

 সেই নারীরই আবার বিধবা সধবা নানান্‌ মূর্ত্তি এঁকে গড়ে বলেছেন;—

“চক্ষে স্বপ্নকুহেলিকা, বক্ষে মরীচিকা মৃত্যুর তিমিরে,
নিঃশব্দে তাহার প্রীতি দীপহীন শিখা ধুমাইছে ধীরে।
সমস্ত জগৎ দিলে, যদি তার দেখা মিলে,
সমস্ত জগৎ যদি চাহে আরবার।”

অন্যত্র;—

“পিতা নাই, মাতা নাই, পতিপুত্র নাই, অতি অসহায়।
সকল বন্ধন ছিঁড়ে, একাকিনী কোথা ফিরে,
অনলে অনিলে শূন্যে;  কোথায়?  কোথায়?”

পুনশ্চঃ—

“জীবনে সে পায় নাই সুখ,
দুঃখে কভু ভাবে নাই দুঃখ,
রোগে শোকে হয়নি চঞ্চল,
সরল অন্তরে হাসিমুখে,
সকলি সহিয়াছিল বুকে;
কাঁদিলে যে হবে অমঙ্গল।

সুখে দুঃখে ছিল চিরসাথী,
জগতজুড়ানো জ্যোৎস্নারাশি,
জীবনের জীবন্ত স্বপন,
আপনাকে হারায়ে হারায়ে,
গিয়েছিল আমাতে জড়ায়ে,
প্রতিদিন অভ্যাস মতন।
পড়ে আছে নয়নে নয়ন,
অসঙ্কোচে করি আলাপন,

দেহে দেহে নাহিক লালসা,
হৃদে হৃদি প্রাণে প্রাণে হেন,
অতিস্বচ্ছ প্রতিবিম্ব যেন!
এক আশা ভাবনা ভরসা।

ঘরদ্বার জগৎ সংসার,
সকলি সকলি ছিল তার,
আমি নিত্য অতিথি নূতন।
দিলে পাই নিলে তুষ্ট হই,
গৃহপানে কভু চেয়ে রই,—
অনায়াস দিবস কেমন।”

 রবীন্দ্রসাহিত্যে আমরা নারীর বহু রূপকল্পনা দেখতে পেয়েছি, তাদের মহত্ত্বের কথা শুনেছি, বহু বন্দনা-গান কান ভরে পান করেছি; কিন্তু সে সবের দীর্ঘ পরিচয় এখানে দেওয়া সম্ভবপর নয়। রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে বর্তমানে বা ভবিষ্যতে কাহারই বা পরিচয় না থাকবে? নারী মহিমার সমস্ত উজ্জ্বলতর দিকটা যে তাঁর বিরাট সাহিত্যকে সমুদ্ভাসিত করে তুলেছে একথা অবিসংবাদী সত্য। তাঁর উর্বশীকে আমরা ব্যাপিকা অভিসারিকা রূপে দেখি না; দেখি;—

ঊষার উদয় সম অবগুণ্ঠিতা, তুমি অকুণ্ঠিতা
শুভ্রকুন্দ নগ্নকান্তি সুরেন্দ্রবন্দিতা, তুমি অনিন্দিতা”।

 (বেদে উষা এবং উর্বশী অভিন্না বলেই ব্যাখ্যাত হয়েছে।)

 সুধা এবং বিষ তাঁর দুই করে সমানভাবেই বিদ্যমান; শুধু বিষকন্যারূপেই তিনি অঙ্কিত হননি। অর্জুনের প্রেমার্থিনী চিত্রাঙ্গদা তপস্যালব্ধ কৃত্রিম রূপের প্লাবনে প্রেমাস্পদকে প্লাবিত করে দিয়েও শান্তি পায়নি। তার প্রেমের সার্থকতা আত্মপ্রকাশে;—

 আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী।
পূজা করি রাখিবে মাথায়, সে-ও আমি
নই, অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে, সে-ও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখ
মোরে সঙ্কটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী,
আমার পাইবে তবে পরিচয়।

 যৌবনমদদৃপ্তা বাসবদত্তার জীবনের চরমোৎকর্ষলাভই কবির বর্ণিত বিষয়, তার লাস্যলীলার চটুলতার নয়। অম্বপালির মহৎদান; “অরণ্য আড়ালে রহি কোন মতে, চিরবাসখানি ফেলি দিল পথে” সেই ভিখারিণীর শ্রেষ্ঠদান, দুর্ভিক্ষপীড়িত আর্তজনের সেবায় ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া যে সুচিন্তিত সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন যে মহৎ দৃষ্টান্ত আজকের দিনে মেয়েদের পক্ষে একান্তভাবেই অনুকরণীয়, কবিববের অমর তুলিকাপাতে এসব প্রাচীন চিত্র চিরন্তন হয়ে থাকবে।

 ‘‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা” তাঁর সর্বপ্রকার নারীচিত্রের একটি প্রতিযোগিতা; এই পরীক্ষায় ডবল প্রমোশন পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন রাণী কল্যাণী।

“বহু আছে ধনী, বহু, আছে মানী
সবাই হয় না রাণী কল্যাণী।”—

 কাহিনীর এইই হ’ল শেষ সিদ্ধান্ত। আমরাও এবিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। দানই কলির প্রধান তপস্যা। “নয়নারায়ণের’’ সেবা! কিন্তু যত দোষ থাকে থাক, ক্ষীরোদাসীকে আমরা কোন মতেই ভুলতে পারব না। তার যে-সব চোখা চোখা যুক্তিবাণ, সে সব বড় বড় তার্কিকের তর্কেরও অতীত;—

“ক্ষিধের অভাব কা’রও হয় না।
চন্দ্রপুলিটা সবার রয় না।”

 অথবা “খাবার ত’ নয় ক্ষিধের অধীন”

এ ছাড়া,—

“যেটা দিয়ে দাও সেটা যে রয় না,
এর চেয়ে কথা সহজ হয় না।”

 এসব বড় বড় কথা বিধি-বদ্ধ প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে থেকে তাকে এবং তার মন্ত্রী বা মন্ত্রিণী মালতীকে বাঙ্গালা সাহিত্যে অমর করে রাখবে।

“পুরাণো শাস্ত্রে লিখেছে শোলোক,
গরীবের মত নেই ছোটলোক।”

 এক কথাতে এতখানি প্রকাশ মার্ক্‌স সাহিত্যে বা তাঁর চেলাদের সাতশো পাতার বিস্তৃত প্রবন্ধে খুঁজে পাওয়া যায় না। বড় দুঃখেই বেচারী বলে উঠেছিল;—

“ঐ-রে হয়েছে মাথাটি খাওয়া
তোমারও লেগেছে দাতার হাওয়া?
না যাও তুমি মায়ের বাড়ীতে
এখানের হাওয়া সবে না নাড়ীতে।”

 রবীন্দ্রনাথের শতরূপা নারী প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে রঙ্গভূমে অবতীর্ণা হয়েছেন। ইদানীন্তন অনেক বড় লেখকের তিনখানি বই পড়লেই তার নারীচরিত্রগুলি আমাদের কাছে সিনেমা ষ্টারের মূর্ত্তি ধরে বসে। বহু পরিচিতাদের নূতন নূতন পরিবেশের মধ্যে—তা’ তিনি যত ভাল অভিনেত্রীই হোন সত্য করে ভাল লাগে না; বিশেষতঃ রূপসজ্জা দেখা না যাওয়ায় রেডিও-অভিনেত্রীর মতই তাঁদের সেই পূর্ব্বাপর পরিচিত বাণীরূপকে সহ্য করতে আমরা অনেক সময় বিশেষ করেই কষ্ট পাই। কিন্তু বিশাল রবীন্দ্র-সাহিত্য-সিন্ধুর অন্তর্বর্তিনীরা বিচিত্ররূপিণী, স্বপ্রকাশ, কারু সঙ্গে কারু রক্তসম্পর্কটী পর্যন্ত নেই!

 সপত্নীকন্যা “বিম্ববতী”র অনবদ্য রূপের ঈর্ষ্যায় ঈর্ষ্যান্বিতা রাজমহিষীর দুঃখের কাহিনী আমাদের মনকে বেশী বিচলিত করতে পারে না; ঈষৎ কৃপার সঙ্গে বলিয়ে নেয়;—“আহা বেচারা!” যেহেতু;—

“বিম্ববতী মহিষীর সতীনের মেয়ে
ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে।”

 বৈমাতৃক ঈর্ষ্যার সনাতন চিত্র হলেও কবিত্বের যাদুস্পর্শে নূতন। অবশেষে নিজের তাপে বেচারী নিজেই জ্বলে পুড়ে ভস্ম হ’ল; “হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলা’’র সনাতন দুর্ভোগটা রাজাকে আর ভুগতে হ’ল না।

 আর সেই ভাবতান্ত্রিক কবির যোগ্যপত্নী, সেই ছবিটি কি সুন্দর! যেখানে বোকা কবির ধনরত্ন ফেলে রাজকণ্ঠের মালা চেয়ে নিয়ে বাড়ী ফেরার আহাম্মুকিতে পাঠক-পাঠিকারা অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন, পাঠকদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত বা ইতিমধ্যে সভীতচিত্তে পুরাতন সম্মার্জনীর আবির্ভাবের আতঙ্কে রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠেছেন, এমন সময় এ-কি ইন্দ্রজাল!

 “মালাখানি লয়ে আপন গলায় আদরে পরিলা সতী,

ভক্তি-আবেগে কবি ভাবে মনে,
চেয়ে সেই প্রেমপূর্ণ বদনে,—
বাঁধা প’ল এক মাল্য-বাঁধনে,
লক্ষ্মী সরস্বতী।”

 মহাকবি ব্যতীত এ-চরিত্র, রমণীবিশেষের এই নিগূঢ় মর্মকথা আর কে লিখতে পারত? অন্যত্র এই রহস্যময় মনের সম্বন্ধে তিনিই লিখেছেন;—

“বুঝা যায় আধ প্রেম আধখানা মন, সমস্ত কে বুঝেছে কখন?”

 এই মানবচিত্ত রহস্য বুঝতে পারা এবং সেই গুহ্যতত্ত্ব নিজে বুঝে পরকে বুঝানো এইখানেই ত জগতের মহাকবিদের বৈশিষ্ট্য।

 রবীন্দ্রনাথের শিশু-চিত্র তাঁর সর্ববিষয়ক রচনার মতই একটি বৃহৎ অংশ। “শিশু”, “শিশু ভোলানাথ” প্রভৃতিই নয়, রবীন্দ্রকাব্যের বহু অংশই এদের কথায় মধুময় হয়ে রয়েছে। “মোর চার বছরের মেয়েটী”র মত শিশুচিত্তের অর্ধচেতনার মধ্যে আধ-প্রচ্ছন্ন চিত্তবৃত্তির বিশ্লেষণ থেকে বৃদ্ধভৃত্যের মনস্তত্ত্ব তাঁর নখদর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। গ্রামের কালো মেয়েকে “কৃষ্ণকলি” আখ্যা দিয়ে তার কালো হরিণ চোখ দুটির একটু তারিফ করা, “ফুলের মত কোমল তুমি অন্ধ বালিকা” বলে সোজা কথায় একটী কাণা মেয়ের উপর দরদ ঢেলে দিয়েও মরমী কবি মানসী নারীও প্রিয়াকে তাঁদের যথাপ্রাপ্য সম্মাননা দান করেছেন। তাঁর মানসীকে লক্ষ্য করে জগতের সার কথা তিনি বলেছেন, যে-কথা এই প্রবন্ধে আমি বলতে চেয়েছি, ক্ষমতার অপ্রাচুর্য্যহেতু যা হয় ত’ সম্যকরূপে বলতে পারি নি,—

‘‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার ’পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।”

তাঁর ‘নারী’কে তিনি বলেছেন;—

“তুমি এ মনের সৃষ্টি তাই মনোমাঝে
এমন সহজে তব প্রতিমা বিরাজে।


তার পরে মনগড়া দেবতারে, মন
ইহকাল পরকাল করে সমর্পণ।”

নারী তাঁর মতে, ‘‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’’ এবং তাঁর কাব্যে এবং সাহিত্যে নারীর যে দুটি রূপ তিনি দিয়েছেন, কবিতার মধ্য দিয়ে তার পরিকল্পনা তিনি নিজেই প্রকাশ করেছেন;—

“কোনক্ষণে, সৃজনের সমুদ্রমন্থনে, উঠেছিল দুই নারী
অতলের শয্যাতল ছাড়ি।
একজন উর্বশী সুন্দরী, বিশ্বের কামনারাজ্যে রাণী
স্বর্গের অপ্সরী।
অন্য জনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী, বিশ্বের জননী তাঁরে জানি
স্বর্গের ঈশ্বরী।”

 নারীর মোহময়ী রূপের পরাভব করে তার স্থিতিবিধায়িনী শক্তিরই ঊর্দ্ধতন তিনি সর্বত্র করেছেন। যে কথা সৃষ্টিতত্ত্বের মূল কথা, আদি সত্য, মহাকবির দৃষ্টিতে তা অজ্ঞাত থাকে নি। যে ‘প্রিয়া’ আজ প্রগতিসাহিত্যে নরের নারী-বেশী প্রতীকমূর্তি, কমরেড অথচ লোলুপকামনার বস্তু, তারই বিষয়ে কবি সসম্ভ্রমে নিবেদন জানাচ্ছেন;—

“শতবার ধিক আজি আমারে, সুন্দরি,
তোমারে হেরিতে চাহি এত ক্ষুদ্র করি।
তোমার মহিমা জ্যোতি তব মূর্তি হতে,
আমার অন্তরে পড়ি ছড়ায় জগতে,
যখন তোমার প’রে পড়েনি নয়ন,
জগৎ লক্ষ্মীর দেখা পাই নি তখন।”

একস্থানে তিনি নারী-বন্দনায় গাইলেন;—

“পবিত্র তুমি, নির্মল তুমি, তুমি দেবী তুমি সতী।”

 রবীন্দ্রনাথের “নারী পরিচিতি” কোন প্রবন্ধের ক্ষুদ্র এক অংশের বর্ণনীয় বিষয় হতেই পারে না, উহা বহু প্রবন্ধের বিষয়বস্তু। সে অসাধ্যসাধনে ব্রতী হব না। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধে’’র সন্ন্যাসীর মর্মভেদী শেষ বিলাপটুকু, সেই মায়াময়ী পরিত্যক্তা অনাথা মেয়েটির প্রাণশূন্য দেহটি বুকে নিয়ে ব্যর্থ ডাকাডাকি;—“বাছা, বাছা, কোথা গেলি? কি করিলি রে?” এবং ত্রিপুরাধিপতি গোবিন্দমাণিক্যের নগণ্য একজন প্রজা-কন্যার মৃত্যুশয্যাপার্শ্বে সেই কঠিন স্বীকৃতি “মা! এ রক্তস্রোত আমি নিবারণ করিব।” দস্যুদলপতি রত্নাকরের বনবালিকাকে অভয় প্রদান;—

“আয় মা আমার সাথে কোন ভয় নাহি আর।
কত দুঃখ পেলি বনে আহা মা আমার!”

 শিশুসম্পর্কীয় এই সকল চিত্র দৃঢ়বলিষ্ঠ পুরুষচিত্রের অন্তঃসলিলা স্নেহফল্গুর যে নিগূঢ়তম পরিচয় ব্যক্ত করেছে এ আর কোন সাহিত্য দিতে পারে নি। এর কাছে দুর্দান্ত দস্যু, কর্তব্যপরায়ণ ধার্মিক রাজ্যেশ্বর, সংসারবৈরাগী তপস্বীও যে বাদ পড়ে না এই সত্যই বড় সুন্দররূপে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে। অত বড় দুর্দমনীয় রঘুপতিও এই বিশ্বপ্লাবী স্নেহবন্যার সর্বনাশী খরস্রোতে ভেসে গেলেন! দেখা গেল কচিমুখের আব্দার আর ছোট্ট প্রাণের আবেদনকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না; না হ’লে আর সেই মদদৃপ্ত দাম্ভিকাচার্য রঘুপতি সহস্রবার বিতাড়িতা অপর্ণার হাত ধরে আর্তকণ্ঠে বলছেন;—“মা জননি! এ পুত্রঘাতীরে পিতা বলে যে ডাকিত, সেই রেখে গেছে ওই সুধামাখা নাম তোর কণ্ঠে, এইটুকু দয়া করে গেছে! আহা ডাক আরবার।”

 বড় বড় কথার উজানে ভেসে গিয়ে কবি “কাঙ্গালিনী মেয়ে’’ বা সেদিনের কিশোরী বঙ্গবধূকেও ভুলে যান নি;—

“বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্‌
পুরাণো সেই সুরে, কে যেন ডাকে দূরে,
কোথা সে ছায়া সখী কোথা সে জল্‌?
কোথা সে বাঁধাঘাট, অশথ-তল্‌!

কোথায় আছ তুমি, কোথায় মাগো
আর কি উপকথা বলিবি না গো?”

 পরিজনবিযুক্তা মেয়েটির বুকের ব্যথা এমনি করেই পল্লীকবির ভাটিয়ালিতেও প্রকাশ পেয়েছে।

 সতীনারীর পুণ্যকথায় রবীন্দ্র-সাহিত্য মহাপীঠের মতই পুণ্যভূমি। ধার্মিকা নারীর চিত্র মালিনীতে, ভিক্ষুণী-সুপ্রিয়ায়, আম্রপালিতে, অ-কল্যাণী নারীর চিত্র “কাশীর মহিষী করুণায়”; অসহায়া-মাতৃমূর্তি “দেবতার গ্রাসে’’র মোক্ষদায় জীবন্ত!—

“শুধু কি মুখের বাণী শুনেছ দেবতা?
শোননি কি জননীর অন্তরের কথা?”

 কি আকুল অভিমানে ভরা মাতৃহৃদয়ের এ অভিব্যক্তি!

 “বিসর্জনে’’র রাণী গুণবতীর শেষ মর্মকথা;—

 “আজ দেবী নাই,—তুমি মোর একমাত্র রয়েছ দেবতা।”

 “রাজা ও রাণী”র রাণী সুমিত্রার পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশ;—

“রাজন্‌, তোমারই আমি অন্তরে বাহিরে,
অন্তরে প্রেয়সী তব বাহিরে মহিষী।”

এবং

“পিতৃসত্য পালনের তরে রামচন্দ্র
গিয়াছেন বনে, পতিসত্য পালনের
লাগি আমি যাব।”

ইলার গভীর ও অন্তঃসলিলা প্রেমের ফল্গুধারায় বিক্রমদেবের নবজাগরণ সত্যই অপূর্ব! একনিষ্ঠ নারীপ্রেমের ইহাই অমোঘ মন্ত্র। এ’তে অন্ধেরও চোখ ফোটে। তার ভালবাসা গভীর অতলস্পর্শ, তাই সে প্রেম তরঙ্গ-ভঙ্গ-চপল নয়। সে গান গায়;—

“আমি নিশিদিন তোমায় ভালবাসি
তুমি অবসর মতো বাসিয়ো।”

 ক্ষত্র রাজকন্যার বিবাহোৎসবের মধ্যে বর মেত্রি-পতির গাঁটছাড়া খুলে ফেলে যুদ্ধযাত্রা এবং সেই আধখানা বিবাহের বধূর স্বেচ্ছায় পতিগৃহগমন করে যুদ্ধ-নিহত স্বামীর চিতাসঙ্গিনী হওয়া,—এইরূপ কত তেজস্বিনী মহীয়সীর আলেখ্যে রবীন্দ্রকাব্যসাহিত্য উদ্ভাসিত তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। ছোট ছোট কবিতাগুলিতেও তাৎকালীন সমাজচিত্র বেশ ফুটে ফুটে উঠেছে। নববিবাহিত দম্পতীর প্রেমালাপের বধূপক্ষীয় আবেদন “আরো কুল পাড়ো গোটা ছয়”, বাল্যবিবাহের একটি পরম উপভোগ্য চিত্র! অবশ্য এখনকার কনের জন্য “জীবন যৌবন করি ক্ষয়” কোন্ উপহার আহরণ করতে হবে, জিজ্ঞাসা করলে অত সস্তায় জীবন যৌবন অক্ষয় রেখে প্রিয়ার প্রীতিসাধন করা কখনই সম্ভবপর হ’ত না; কনে হয়ত বলে বসতে;—

“ডজন খানেক সাড়ি চাই, চাই সাথে সাথে পিস্‌ ব্লাউসের”।

  ধর্মপ্রচারকের মাথায় লাঠি মেরে এসে বঙ্গবীরের ঘরের স্ত্রীর উপর সদম্ভ জুলুম স্ত্রীর প্রতি কাপুরুষের নির্ম্মম ব্যবহার নির্দেশ করে দু’টী কথায় তাদের দুর্দশার ইসারা দিয়ে গেছে;—

“স্বামী যবে এল যুদ্ধ সারিয়া ঘরে নেই লুচিভাজা!
আর্যনারীর এ-কেমন প্রথা সমুচিত দিব সাজা।
কোথা পুরাতন পাতিব্রত্য সনাতন লুচি ছোকা,
বৎসরে শুধু সংসারে আসে একখানি করে খোকা।”

 প্রাথমিক ভাবে যাঁদের নাম কর্বার কথা তাঁদের ছেড়ে হঠাৎ দূরে চলে এসেছি;—

 বিদ্যাসাগরের “সীতার বনবাসে”র সীতা ছাত্রমহলের সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকের মধ্য দিয়ে পরিচয়ে এলেন। কথকতা যাত্রা গানের সঙ্গে সহরবাসীদের পরিচয় ক্রমে চলে যাচ্ছিল; তবু একটা যেন যোগসূত্র রইল।

 ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের “ঐতিহাসিক উপন্যাস” বাংলাভাষায় রচিত সর্বপ্রথম উপন্যাস। এর দুটি আখ্যানের মধ্যে একটিতে মহারাষ্ট্রকুলতিলক ছত্রপতি শিবাজীর সঙ্গে মোগলসম্রাট ঔরঙ্গজেবের কন্যা রোশেনারার প্রেমকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। বাদশাজাদীর পক্ষে দস্যবৃত্ত পর্বতারণ্যচারী একজন হিন্দুবীরের সঙ্গে প্রেম সম্ভব কি না নারীহৃদয়ের এই নিগূঢ় রহস্যের কথা কেউ জোর করে বলতে পারে না; কিন্তু তা’ যে একেবারেই অসম্ভব নয়, সে-কথা সমস্তদেশের অতীত বর্তমানের দিকে চেয়ে অনায়াসেই প্রমাণ করা যায়। আজ দেখা যায় তরুণ-তরুণীরা জাতিনীতি কুলগোত্র বিসর্জন দিয়ে অনায়াসেই স্বজাতি বিজাতি স্বধর্মী বিধর্মীকে আত্মদান করছেন। কিন্তু সমাজহিতৈষী দূরদর্শী লেখকের মাত্র সেরূপ একটি সাহিত্যিক রস-রচনার ইচ্ছা ছিল না, বরং ঘটনাচক্রে পড়ে এ-রকম অবস্থা দাঁড়ালে তাদের কর্ত্তব্য কি তাই দেখানই যেন তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এবং সেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই এরূপ জটিল আখ্যানের সৃষ্টি করেছিলেন; তা’ সহজেই বোঝা যায়। তাঁর শিবাজী এবং রোশেনারা অঙ্গুরীয় বিনিময় করে পরজীবনের জন্য প্রতীক্ষিত হয়ে থাকলেন; আত্মসুখের স্রোতে সমাজধর্মকে ভাসিয়ে দিলেন না। ভদ্রকন্যাদের জীবন ত্যাগসংযমে পূত না রাখলে যে ইতর জীবের সঙ্গে কোনই প্রভেদ থাকে না, রোশেনারা-চরিত্রে এই সত্যই সুপরিস্ফুট।[২২]

 তাঁর আর একখানি পুস্তক, পারিবারিক প্রবন্ধ” কল্পিত। নারী নয়, বাস্তব নারীদের উদ্দেশে বিরচিত এবং সর্বশ্রেণীর নারীর পথ প্রদর্শক। সঙ্কীর্ণচিত্তা মা যারা ছেলে পাছে বৌয়ের বশীভূত হয় সেই ভয়ে তার মনের দরজায় চাবি দিয়ে রাখতে চায়, বিবাহ-যাত্রাকালে ছেলেকে দিয়ে নিজের ‘‘ঘরের লক্ষ্মী”র বদলে “দাসী” আনবার প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়ে তা’ পালন করবার জন্য পীড়ন করে, বউকে ঈর্ষ্যা করে ছড়া কাটে;—

‘‘চন্দ্রমুখী মেয়ে আমার শ্বশুরবাড়ী যায়।
খ্যাঁদানাকী বউ এসে বাটায় পান খায়।”

সেই সব মায়েদের ছবি এঁকে তাদের লজ্জা দিয়েছেন। যে-সব মেয়েরা ভাবে, “যে রাঁধে সে আর চুল বাঁধে না, তাদের “বিবি এবং বাঁদী’’ হয়ে “লক্ষ্মীচরিত্র’’ অধ্যয়ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন, পুরাতন ছাঁচে নূতনরূপে নরনারীর সৃষ্টিকর্তারূপে তিনি বাস্তবের নারীকে সত্যকার পথ দেখিয়েছেন, তাদের বিভ্রান্ত করেন নি। গ্রন্থের উৎসর্গটী গদ্যে লেখা পরম কবিত্বে মণ্ডিত একটি খণ্ডকাব্য! অকাল কাল-কবলিতা প্রিয়তমা পত্নীর উদ্দেশে তাঁকে দশমহাবিদ্যার মত দশবিধ রূপে নিজ জীবনে অনুভব করে এই যে সশ্রদ্ধ প্রেমাঞ্জলি, এর মধ্যে অজবিলাপের বা বিরহী যক্ষের প্রেম-কাতরতা নেই। সতীদেহ স্কন্ধে নিয়ে ভ্রমণকারী উন্মত্ত ভোলানাথের মত বিক্ষিপ্ততা নেই, আছে অনাবিল প্রেমের সঙ্গে গভীর ভগবদ্‌বিশ্বাস, যার বলে মানুষ সর্বংসহ শক্তি সংগ্রহ করে পরলোককে প্রত্যক্ষ দর্শনে ধন্য হয়, চোখের আড়ালকে প্রাণের আড়াল ভেবে নিদারুণ দুঃখে আর্তনাদ করে না। একটুখানি নমুনা দিই;—

 “আমি কি? এবং কি জন্য হইলাম?—গাছে যেমন পাতা হয়, তেমনি হইয়াছি বই ত নয়। আমার ঐ “আমি” পদার্থটি কতকগুলি প্রাকৃতিক শক্তির সমাবেশ বই ত নয়। এখন আমার থাকাই কি?—আর না থাকাই রা কি?

 মন যে কি চায়, পায় না—কি যে চায় তা জানেই না।••• পৃথিবী শ্মশানভূমি—এখানে থেকে কাজ কি?

 মনে যখন এই ভাব, এমন সময়ে একটি দেবীমূতি আমার সম্মুখীন হইল—আমার দুই চক্ষুতে দুই চক্ষু মিলাইল—আমার হাতে হাত দিল—বলিল, “আমি তোমার।”

 ‘আমার আছে। তবে ‘আমি’ একজন! আমি থাকিব, আমি করিব, আমি বাড়িব আমি বাড়াইব। ইতি স্থিতিবিধায়িনী।

 আর পৃথিবীকে শ্মশানভূমিরূপে দেখাইল না। বর্তমান কাল দেবীর হাস্য প্রভায় রঞ্জিত হইয়া আশার ফলকে চিত্রিত ভবিষ্যৎ কালের সহিত একীভূত হইল। ধরাতলে একটি রমণীয় আরাম প্রতিষ্ঠিত দেখিলাম। ঐ আরাম দেবীর ক্রীড়াভূমি। ইতি আশ্রম-বিধায়িনী।

 কিছুরই অভাব নাই—কিছুরই অস্থিরতা নাই। সকলই যথাযথ। যাহাতে দৃষ্টি করেন তাহাই উথলিয়া উঠে। যাহাতে হাত দেন তাহাই শোভাময় হয়। ইতি গৃহলক্ষ্মী।

 দেখিতে দেখিতে একটি একটি করিয়া কয়েকটি শিশুমৃত্তি ঐ আরাম-নিকেতনে দেখা দিল। ও-গুলিকে নিতান্ত নিজস্ব জ্ঞান করিলাম। একান্তই আপনার মনে করিয়া কৃতার্থ হইলাম। ইতি বর-প্রদায়িনী-

 -কৈ?—এ কি হইল?—সেইটি—সেই সর্ব প্রথমেরটি? -সেই সাক্ষাৎ দেবতুল্য শক্তিসম্পন্নটি?—সে কোথায় গেল? —আর এখানে থাকিব না। সে যথা, গিয়াছে সেইখানেই যাইব। বাহির হই-হাত ধরিলেন—নিকটে একটি গাছ ছিল, তাহার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন। দেখাইলেন গাছটির তলায় অনেকগুলি অপৰু কুঁড়ি পড়িয়া রহিয়াছে। অপূর্ণ নয়নে বাষ্পদিগ্ধ গদগদম্বরে বলিলেন, “মুকুল যত হয় ফল তত হয় না।” তথ্য বুঝিলাম। থামিম-ইতি প্রবোধ-দায়িনী।

 এ কি হইল?—তিনি কৈ?—যে-সকলকে নিতান্ত আমার বলিয়া মনে করিতাম, তাহাদিগকেও ত’ আর তত আমার বলিয়া মনে হইতেছে না। আমি আবার জগতে ‘একা’!—আবার আমার পৃথিবী শ্মশান! যেমন হৃদয়মধ্যে এইরূপ ভাবিলাম, অমনি তথায় অশরীরী বাণী নিঃসৃত হইল—“শোকে মুগ্ধ হইও না—তুমি আর তেমন ‘একা হইতে পার না, তোমার পৃথিবী আর তেমন শ্মশান’ হইতে পারে না। তোমার হৃদয় শূন্য নাই -তুমি পৃথিবীকে কর্মক্ষেত্র বলিয়াই জানিয়াছ। ইতি হৃদয়াধিষ্ঠাত্রী-

 যে প্রকৃতিশক্তি উল্লিখিত দশবিধরূপে আমার প্রত্যক্ষ- গোচর হইয়াছেন, তাঁহার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিয়া ভক্তি এবং প্রীতিসহকারে বঙ্গবাসী স্ত্রী-পুরুষের হস্তে এই পুস্তকখানি সমর্পণ করিলাম।”

 ‘সতীধর্ম”, “স্ত্রীশিক্ষা”, “সৌভাগ্যগর্ব’, ‘‘দম্পতি-কলহ, “লজ্জাশীলতা”, গহনাগড়ান”, “কুটুম্বিতা”, “কাপুত্রের বিবাহ”, “স্বজন-প্রতিপালন” এক কথায় সমগ্র পারিবারিক প্রবন্ধ গ্রন্থখানিতে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সমগ্র উন্নত ভাবের সমন্বয়ে নারীজাতির সমস্ত কর্তব্যাকর্তব্য নির্দিষ্ট রয়েছে। উদাহরণ সমূহেও ভালমন্দ নারীর জীবন্ত দৃষ্টান্তও অনেক দেখান হয়েছে। “বৌ-টকি শ্বাশুড়ী”, অ-গৃহিণী সু-গৃহিণী প্রত্যেকটি নারীচরিত্রের বিচিত্র চিত্রে শিক্ষিত হিন্দুসমাজের বিধিবিধান নির্দিষ্ট আছে। তা মাত্র আজকের বা কালকের জন্যই নয়, চিরদিনের,সনাতনী বা পুরাতনী নহে, চিরন্তনী।

 তাঁর রূপকালঙ্কারে অলঙ্কৃত পুস্পাঞ্জলিতে মাতৃরূপের প্রথম মূতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারই টীকাভাষ্য বঙ্কিমের আনন্দমঠ।

 তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুপ্রসিদ্ধ উপন্যাস‘স্বর্ণলতা” সে-দিন বাংলা সাহিত্যে এক অপূর্ব বিস্ময়ের সঞ্চার করেছিল। ‘স্বর্ণলতায়” স্বর্ণলতার চেয়ে “প্রমদা” ও “সরলাই প্রধান চরিত্র। প্রমদার মা-টীও বড় কম যান না। বাঙ্গালীর তদানীন্তন জীবনধারা অবলম্বন করে এই যে কাহিনীটী রচিত হয়েছিল—বলতে গেলে আধুনিক বাস্তব উপন্যাসের এই প্রথম বস্তুরূপ। নারীচরিত্র না হলেও একদা নারীর ছদ্মবেশে পলায়নপর “গডাটরচণ্ড্র” লেখকের অপূর্ব সৃষ্টি!তার “হরিষে বিষাদের পদি-পিসি সার্বজনীন পিসিরূপে আজও বঙ্গসমাজে জীবিত আছেন। “অদৃষ্টের সুলোচনা, জয়দুর্গার। এরা খাঁটি বাঙ্গালার মেয়ে, এদের মধ্যে পাশ্চাত্যের ছাপমাত্র নেই।

 “যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কনেবউ” সে-দিনে পাঠক, বিশেষতঃ পাঠিকসমাজে যথেষ্ট আদর লাভ করেছিল। “বড়ভাইয়ের শৈলজা, “বিমাতা”র তারাসুন্দরী ও চারু, “ঠাকুরমার অমলা সকল চরিত্রই সে-দিনে সমাদর লাভ করেছিল।

 তারকনাথ বিশ্বাসের বিপুল, গ্রন্থাবলীর “সুহাসিনী,” “মনোরমা” প্রভৃতির কথা হয়ত অনেকেই ভুলে গেছেন।

 বঙ্কিমচন্দ্রের “কৃষ্ণকান্তের উইল”-এর প্রধান দুটি চরিত্র ভ্রমর এবং রোহিণী। ভ্রমরের মধ্যে খানিকটা সূর্যমুখীরই পুনরাবৃত্তি পাই; প্রভেদ এই যে, পরনারী-আসক্ত প্রিয়তমের উপর তীব্র অভিমান এবং ক্ষমাহীন অত্যুগ্র আদর্শবাদের জন্য ভ্রমর নিজেও সুখী হ’ল না, অপদার্থ গোবিন্দলালকে এতটুকু কোথাও অনুতাপের সান্ত্বনা দিয়ে গেল না। রোহিণী-চরিত্র প্রথম থেকেই পাঠকের যুগপৎ সমবেদনা এবং বিরাগ হাকর্ষণ করে, শেষদিকে গোবিন্দলালের হাতে মৃত্যুর পূর্বে জীবনরক্ষার তার অনুনয়-বাণী এবং নিশাকরের সহিত গোপনে সাক্ষাৎকার তার পূর্বচরিত্রের সহিত খাপ খায় না, এ-কথা কেহ কেহ বলেন বটে, কিন্তু দুষ্প্রবেশ্য মানবচিত্তগুহার অতলস্পর্শ আধারে কি যে সঞ্চিত আছে মানুষ নিজেই কি তা সকল সময়ে অনুমান করতে পারে? যে-দিনে রোহিণী ভ্রমরের অনুজ্ঞায় করুণী পুষ্করিণীতে আত্মবিসর্জন করে তার ব্যর্থজীবন শেষ করতে চেয়েছিল, দুরাকাঙ্ক্ষার সাফল্যে বধিতাশয় চিত্ত তার সেই হতাশা ক্লান্ত পূর্ব জীবনের সব কিছুর সঙ্গেই পূর্বেকার মৃত্যুভয়হীনতাকেও কেন না পরিহার করতে পারে? ইহাই ত’ তার পক্ষে স্বাভাবিক। সে একজন তুচ্ছ নারী। একনিষ্ঠা সে কোনদিনই ছিল না। হরলালের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গোবিন্দলালকে আশ্রয় করার অর্থ এ নয় যে, গোবিন্দলালকেই সে তার চিত্তপ্রাণ সতীলক্ষ্মীর একনিষ্ঠ প্রেমের মতই একান্তভাবে সমর্পণ করেছিল,—যেমন এই রোহিণী- রূপেরই উত্তরকালের অভিব্যক্তি “চোখের বালি”র বিনোদিনীর বিহারীর প্রতি প্রেমের প্রত্যাখ্যানে মহেন্দ্রকে আশ্রয় করা। “চরিত্রহীনে” কিরণময়ীর তদপেক্ষা বীভৎসতর প্রতিশোধ প্রচেষ্টায় প্রকাশ পেয়েছে। রোহিণীরও নিশাকর সম্ভাষণে এবং প্রাণভিক্ষায় দেখা যায় সেও তার প্রথম প্রেম হরলালের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার প্রতিহিংসাবশেই যেন তাদের সংসারের চালাঘরের চালের উপর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ রূপে আপতিত হয়েছিল।

 শৈবলিনী-চরিত্রে অস্বাভাবিকতা দৃষ্ট হলেও নারীর মধ্যেও যে যথেষ্ট ধ্বংসকারী শক্তি নিহিত থাকে তা আমাদের কাছে শুধু কাব্যনাট্যের মধ্য দিয়েই নয়, সংসারক্ষেত্রেও বহুবার প্রকটিত হয়েছে। “সুন্দরী” সত্যই সুন্দরী! রূপের কথা বলছি না, গুণের কথাই বলছি। আর একটি অনবদ্য ছবি কয়েকটা মাত্র রেখা দিয়ে “চন্দ্রশেখরে” বিচিত্র হয়ে উঠেছে; সে বঙ্গের শেষ স্বাধীন নবাব হতভাগ্য মিরকাশিমের একটি ক্রীত-বেগম ক্ষুদ্র দলনীর মধ্য দিয়ে। বহুপত্নীক নবাব-হারেমের ক্ষুদ্র একটি প্রান্তের ছোট চামেলী লতাটা তার স্নিগ্ধ সৌরভে আজও যেন। পাঠকের মনকে সুরভিত করে রেখেছে; ছোট্ট চামেলি ফুলটির মতই তারও সেই রকমের ক্ষীণ আয়ু। উড়িষ্যার কবি রাধানাথ রায়ের “পত্রাবলী”তে মীর কাশিমের উদ্দেশ্যে লিখিত দলনীর পত্রের শেষ কথা;—

 “দলনীর প্রাণ,—দলনীর আঁখি আলো আঁধারে ডুবিয়া যাবে।”  কপালকুণ্ডলা” নামটা মালতীমাধব” নাটকের কাপালিকার উদ্ভট নাম থেকে পরিগৃহীত; সেই পরিকল্পনায় সাগবোপকুলনিরাণী কাপালিকের প্রতিপালিতা মেয়েটা ঠিক মিরাখা নয়। একই নির্জনবাস ভিন্ন দু'জনের মধ্যে অপর কোন মিল দেখা যায় না। প্রেম এবং প্রেমপাত্র সম্বন্ধে মিরা ঘোর সংসার বাসিনীদের মতই পূর্ণ সচেতন, আর এই সরলা সন্ন্যাসিনী বঙ্গ মৃগীর মতই চির আত্মভোলা। এই চরিত্রটা উপন্যাসের মধ্যে চমৎকার একটা কাব্যের সৃষ্টি করেছে। কবিচিত্ত দিয়েই একে উপভোগ করতে হয়, তীক্ষ বিচারদৃষ্টি দিয়ে নয়।

 “কমলাকান্তের প্রসঙ্গ গোয়ালিনীর স্তুতি আমরা অনেক আগেই শুনেছি, কিন্তু স্পষ্ট করে বুঝেছি এতকাল পরে এই মহাযুদ্ধঅধ্যুষিত ভরতে তথা বাংলাদেশে বসে। দুগ্ধবতী গাভীকুল-সমন্বিত প্রসার প্রসন্নতা-লাভ যে সাধনানিষ্ঠ ও বহু সাধনালব্ধ সে-বিষয়ে কেহই আজকের দিনে দ্বিমত হবেন না।

 “দুর্গেশনন্দিনী“র দুটি প্রধান নারীচরিত্র আয়েষা এবং বিমলা। আয়েষা আবেগপ্রবণ, অসংযত; বিমলা পরিহাসতলা, উচ্ছল বাহুপ্রকৃতির অন্তরালে সতীত্বের এবং পরিপূর্ণ আত্মসংযমের মূত ছবি। আয়েষা জগৎসিংহকে চেয়েও পান নি, বিমলা পেয়েও ভোগ করেন নি। তিনি বীরেন্দ্রসিংহের বিবাহিতা পঙ্গী হয়েও চিরদুঃখিনী দাসী, তার অবজ্ঞা ও উপেক্ষাঅপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে চিরদিন আত্মগোপন করে থেকেছেন, দাসীর কর্তব্য করে। কিন্তু স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছেন তিনি যে কোন পরমসোহাগিনী পীর অপেক্ষা বেশী করেই।

 “দেবী চৌধুরাণীর দুটি প্রধান নারীচরিত্র প্রফুল্ল এবং সাগর; প্রফুল্ল দুঃখীর ঘরের মেয়ে, একমুঠো ভাতের জন্য শশুর বাড়ী এসেছিল, ধনীর আদুরে মেয়ে সাগর কদাচ কখন শ্বশুরবাড়ী আসে, শ্বশুর-শাশুড়ী তাকে পোষ মানাতে পারেন নি; কিন্তু সেই শিশুর মত সরল মেয়েটা সতীন প্রফুল্লকে স্বামীর স্নেহভাগিনী করবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। সতীনকে স্বেচ্ছায় স্বামী দেওয়ার এই আদর্শ আজ সকলের ভাল লাগতে না পারে কিন্তু সাগরের ত্যাগকে শ্রদ্ধা না করে আজও কারও উপায় নেই। ভবানী পাঠকের সাহায্যে বিবিধ বিদ্যায় পারদর্শিতলাভ করে এবং ডাকাতি করে প্রভূত অর্থের অধিকারিণী হয়েও প্রফুল্ল মনে শান্তি পেল না, শেষ পর্যন্ত পতিসেবাই নারীর শ্রেষ্ঠধর্ম ভেবে সংসারে ফিরে এল, “হারীর মায়ের পারীর মায়ের হুকুম- বরদারীতেই বাহাল হবার আকাক্ষা নিয়ে। এ আদর্শ অত্যাধুনিকাদের হয়ত বিস্মিত করবে।

 “বিষবৃক্ষের মূল চরিত্র দুটিকে প্রতিহত করে জীবন্ত হয়ে আছে হীরা। তার ব্যর্থপ্রেমের অভিশাপ সে বিষবাষ্পের মত তার চারিপার্শ্বে বিকীরণ করে নিজে গ্লানিকর বিষাক্ত অভিশপ্ত জীবনের কঠোর প্রায়শ্চিত্ত গ্রহণ করেছিল। হীরা পদ্মপলাশ- লোচনা, কুটবুদ্ধিশালিনী অথচ অতৃপ্ত প্রেমাকান্দায় আত্মহারা হীরা আমাদের সহানুভূতি না কেড়ে নিয়ে পারে না। সংসার জ্ঞানে অনভিজ্ঞ, ধর্মবোধে বঞ্চিতা কত দুর্ভাগিনীর দুর্ভাগ্য জীবনেই ত এই ব্যাপার নিয়ত ঘটছে।

 সূর্যমুখী অত্যুচ্চ আদর্শবাদিনী, স্বামীপ্রেমের বন্যায় ডুবে থেকে সর্বসুখে সুখী ছিলেন, কিন্তু পতির আদর্শে আঘাত লাগায় তাঁকে আসক্ত জেনে আত্মসংযম হারিয়ে সেদিনের মত দিনের লোকলজ্জা পরিহার করে যে-দিকে দুচোখ যায় এমনই পূর্বাপর জ্ঞান পর্যন্ত হারিরে গৃহত্যাগ করলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হ’ল। গভীর পতিপ্রেম তাঁর মনের দড়ি টেনে রইলো পুতুল নাচের পুতুলের মত। দূরে সরে যেতে না দিয়ে ফের ফিরিয়ে অনলে।

 কুন্দনন্দিনী আজন্মদুঃখিনী, অদৃষ্টের হস্তের তুচ্ছ ক্রীড়নক, তার মধ্যে ভালমন্দ এমন একটা কিছুই নেই দিয়ে সে উচ্ছঙ্খল চরিত্র তারাচরণকে বা শিক্ষিত নগেন্দ্রকে আকৃষ্ট করতে বা তাকে চিরদিন রক্ষা করতে পারে। শুধু হীরার প্রতিহিংসাপ্রদত্ত বিষের কল্যাণে মরে গিয়ে সে সাহিত্যজগতে বেঁচে রইলো।

 “আনন্দমঠ' গদ্যে লেখা একখানি মহাকাব্য। বঙ্কিমচন্দ্র নূতন গদ্যছন্দের প্রবর্তক না হলে পদ্যেই এ-পুস্তক বিরচিত হ'ত। জাতীয় জাগরণের মহাসন্ধিক্ষণে এর মূলমন্ত্রটি তিনি তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় ভূদেবের কাছেই গ্রহণ করেছিলেন, তার প্রমাণ ভূদেবের ‘পুষ্পাঞ্জলি”। কিন্তু বঙ্কিমের ভাষালালিত্যে ও শক্তিময়ী শান্তি ও কল্যাণময়ী কল্যাণীর সুকল্যাণ স্পর্শে আনন্দমঠ” সহজতর ও সুন্দরতর হয়ে উঠেছে; ভগ্নপ্রাণ বাঙ্গালীকে আশার বাণী শুনিয়েছে, তার প্রাণে আনন্দ দিয়েছে, মাতৃমঠ প্রতিষ্ঠাব্রতে ব্রতী করেছে, অশোকমন্ত্র অমোঘমন্ত্র প্রচার করেছে;— সে-মন্ত্র “বন্দে মাতরম্।”

 “আনন্দমঠ” আরও একটী নিগুঢ় তত্ত্ব আমাদের নিলুপ্ত মনোবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলবার জন্য প্রয়োগ করেছে, তা মাতৃপূজার মন্ত্রজাগরণে নারীর স্থাননির্দেশ করে। শুচিস্মিতা সাহিত্যে নারী চরিত্রঃ জী ও সৃষ্টি ত্যাগ-মহীয়সী নারীর এই মহাপূজায় পূর্ণাধিকার স্বীকৃত, কিন্তু পতিত বা পতিতা কাহারও পূজামণ্ডপে স্থান নেই। এ-পূজা পূর্ণ তান্ত্রিক পূজা, পঞ্চ মকারকে বলি দিয়ে তবে এর অধিকারী হওয়া যায়। শান্তি বঙ্কিমচন্দ্রের অপূর্ব সৃষ্টি, আজ বাংলাদেশে তেজস্বিনী মেয়েদের ছবিগুলিতে চোখ বুলালেই শান্তির প্রতিচ্ছায়া সর্বত্র দেখতে পাওয়া যাবে; যেমন ভ্রমর, কমলমণি, সূর্যমুখী, শৈবলিনীকেও দেখা যায়। শক্তিমান্ সৃষ্টিকর্তার শক্তির পরিচয় তো এইখানেই।

 এ-যুগের আর একজন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস-লেখক রমেশচন্দ্র দত্ত। তাঁর “বঙ্গবিজেতা” “মাধবীকঙ্কণ”, “জীবনসন্ধ্যা”, “জীবনপ্রভাত”-এই শতাধিক বর্ষের ইতিহাসে আমরা বহু নারীচরিত্রের স্ফুরণ দেখি। অমলা, কমলা, সরল, বিমলা, মহাশ্বেতা, হেমলতা, লক্ষ্মী, পুষ্পকুমারী এষং তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র ভীবালা। “সংসারের জ্যেঠাইমা, বিন্দু, সুধা, কালীতার, উমাতার ঘরোয়া মানুষ, নেহাৎ বাংলাদেশেরই। কিন্তু তাদের থেকে ঢের বেশী করেই তার মারাঠী, রাজপুতানীরা মনোহরণ করে নেয়।

 বঙ্কিমযুগের অন্যান্য বড় লেখকদের মধ্যে দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; দামোদর মুখোপাধ্যায়, গিরীশচন্দ্র ঘোষ প্রভৃতির নাম করতে হয়। সঞ্জীবচন্দ্রের “জাল প্রতাপচাঁদ” সে সময়কার সামান্য পূর্বের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে রচিত; “কণ্ঠমালা” ও “মাধবীলতা” উপন্যাসের শৈল ও মাধবী চরিত্র মধ্যে শৈল আধুনিক সাহিত্যের নারীচরিত্রের পূর্বরূপ, মাধবী প্রাচীনযুগের আদর্শ মেয়ে।

 দীনবন্ধুর “নীলদর্পণে’’র প্রধান নারীচরিত্র সাবিত্রী, সৈরিন্ধ্রী, সরলতা। ইংরাজকুঠিয়ালের অত্যাচারে নবীনমাধবের পিতা কারাগারের মধ্যে আত্মহত্যা করলেন, তিনি নিজে লাঠিয়ালের হাতে মারা গেলেন, মা উন্মাদ হয়ে পুত্রবধূকে হত্যা করে নিজে প্রাণত্যাগ করলেন। গ্রন্থের উদ্দেশ্য ছিল নীলকরদের অত্যাচারের প্রতি দেশের শিক্ষিত জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা; সে-উদ্দেশ্য প্রভূতরূপেই সফল হয়েছিল। দাসত্বপ্রথার বিরুদ্ধে লিখিত মার্কিন লেখিকা মিসেস হ্যারিয়েট রিচার ষ্টো’র “আঙ্কল টম্‌’স কেবিনে”র মতই “নীলদর্পণ”ও একটা বিরাট বর্ধিষ্ণু অন্যায়ের পথ রুদ্ধ করেছিল। অতিরিক্ত কান্নাকাটিতে এবং সর্বত্র সাধুভাষার ব্যবহারে নাটকটী ভারাক্রান্ত, স্ত্রীচরিত্রগুলির মধ্যে ভদ্রঘরের মেয়েরা অতিরিক্তরূপেই আড়ষ্ট, তবে তাদের ফাঁকে ফাঁকে দাসী, গ্রাম্যনারী, পদী ময়রাণী প্রভৃতি কয়েকটী নিম্নশ্রেণীর নারীচরিত্র তাদের অনাড়ম্বর কথাবার্তায় খুব সুন্দর ফুটেছে। “নবীন তপস্বিনী”তে জগদম্বা কুৎসিত কলহপরায়ণা নারীর একটি আদর্শ।

 দীনবন্ধুর সৃষ্ট সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় দুটি নারীচরিত্র “জামাই বারিকে”র পদ্মলোচনের দুই পত্নী বিন্দুবাসিনী এবং বগলামুখী ওরফে ‘বগি-বিন্দি’ একসময় বাংলাদেশে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিল। সে-যুগের সপত্নীকলহের যে অপূর্বচিত্র দীনবন্ধু এঁকেছেন তার মধ্যে হাসির খোরাক যথেষ্ট আছে, অশ্রুর খোরাকও নেহাৎ অল্প নেই। ‘‘লীলাবতী’’ নাটকে নেশাখোর হলেও তৎকাল প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থায় মুখ্য কুলীনের সঙ্গে শিক্ষিতা মেয়ে লীলাবতীর বিবাহ-ব্যবস্থা দৈবগতিকে বন্ধ হয়। এই নাটকে নারীচরিত্রের চেয়ে হেমচাঁদ, নদেরচাঁদ, শ্রীনাথ প্রভৃতি পুরুষচরিত্রগুলিই বেশী জীবন্ত এবং তদানীন্তন সমাজের নাকি ফটোচিত্রের মতই বাস্তব।

 প্রথম যুগের বঙ্গরঙ্গমঞ্চ স্থাপনকর্তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কর্মী নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “সতী কি কলঙ্কিনী’’র একটি গান, “চল চল সবে মোরা ত্বরায় যাই লয়ে বারি” একদা জনসমাজে খুব বেশী প্রচলিত ছিল। তাঁর “পারিজাতহরণে’’র রুক্মিণীচরিত্র মূলানুগত হলেও সুন্দর ফুটেছে। রুক্মিণীর গীত; ‘‘যাও হে সেখানে তোমার মন যারে চায়” এ-গানটীও আমরা পথের পথিক, নৌকার মাঝিকেও গাইতে শুনেছি, যেমন নিধুবাবুর টপ্পা বা পরবর্তী যুগের “নন্দবিদায়”, “প্রভাসমিলন” প্রভৃতির গানগুলি সর্বত্র গীত হ’ত।

 রাজকৃষ্ণ রায়ের গ্রন্থাবলীতে পৌরাণিক, সামাজিক বহুবিধ নারীচরিত্রের সাক্ষাৎ মেলে, বিশেষত্ব বলবার মত কিছু নেই।

 অমৃতলালের নাটক সে-দিনে বঙ্গ-রঙ্গমঞ্চের প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিল, সে-কথা এখনও লোকে বিস্মৃত হয় নি। তাঁর ক্রম-পরিবর্তিত বঙ্গসমাজের ব্যঙ্গচিত্র ও সরস ব্যঙ্গরস সৃজনশক্তি যে অপরিমেয় ছিল তা’ অস্বীকার করা চলে না। হয়ত কোথাও অত্যুক্তিবাদ এসে পড়তে পারে, কিন্তু তা’তে দোষ দে’বার কিছু নেই। অতিপ্রাকৃত বা অপ্রাকৃত এ-সমস্তই নাট্যকলার অঙ্গ। তাঁর “তিলতর্পণ” নাটকে যখন বাপ্পা-মহিষী তাঁর মহামহিম স্বামীর “আমি রাণা বাপ্পারাও বীরচূড়ামণি” ইত্যাদি বাহ্বাস্ফোটের সঙ্গে ‘‘আলিবর্দী নিপাতে’’র প্রতিজ্ঞা শুনছেন, তখন সহসা কান্না-সুরে তাঁর ‘মহারাজ, আমি পা রাখি কোথায়?” আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের সেই বিয়ের কনের “জীবনযৌবন ক্ষয় করে” তৃপ্তিসাধনের প্রস্তাবের উত্তর;—“আরো কুল পাড়ো গোটা ছয়।”

 নব্য-বন্যার নূতনস্রোতে ভাসমানা মেয়েদের নিয়ে তাঁর রঙ্গব্যঙ্গ সর্বত্রই যে অস্বাভাবিক হয়েছে তা’ কেউই বলবে না, কবির চিত্তে ভবিষ্যতের ছায়া পড়ে এ চিরন্তন সত্য কথা! “ফাটকে আর আটক রবো না।” এ ত মেয়েরা বলেইছে চিরদিন এবং আটক আর নেইও। “বিবাহবিভ্রাটে’’র বিলাসিনী কার্‌ফরমা সমাজে অদৃষ্টপূর্বা ন’ন। খাসদখলের বিধুঝির “বাবুকে বাঘে খাইয়াছে, পৃথিবী গোলাকার, মা দুঃখ করিবেন না।” সত্যই উপভোগ্য! শিক্ষিতা মহিলা মোক্ষদার;—“বিধুঝি, যে আমার চুল আঁচড়ে দেয়, ষ্টকিং পরিয়ে দেয়, তার যখন জ্বর হয় তখন ওঠে একশ চার, আর আমার কি না নাইনটি-নাইন!” অতি উপাদেয়। গিরিবালা চরিত্রটিতে চিরপুরাতনী নারীর সেই সনাতনী রূপ যার একান্ত অভাব ঘটলে পৃথিবী থাকলো বা গেল কিছুই এসে যাবে না! অমৃতলাল তাঁর ‘বাবু’, ‘বৌমা', ‘অবতার’ ‘কালাপানি’ প্রভৃতিতে বহু বিভিন্ন নারীচরিত্র সৃষ্টি করেছেন। “তরুবালা”র পারুলে এবং তরুবালায় মোহ এবং প্রেমের দুই পরস্পরবিরোধী ছবি সুন্দর রূপে ফুটেছে। ঠান্‌দি চরিত্রটী সত্যই সুন্দর। অমৃতলাল বহুবিধ হাস্য-সরস সঙ্গীতে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং অনেক দিক থেকেই অভাগা বাঙ্গালীর প্রাণে হাসি যুগিয়েছেন, অন্ততঃ কিছুক্ষণ সময়ের জন্যও। “ঠানদি, তোমায় সাজাব কনে”,“ও-মা গঙ্গা তোর রাঙ্গা পায়ে দে’ জননি স্থান”, “ইংরাজীতে এলে বি-এ, পাশ করেছেন ঠাকুরঝি”, “আর আমাদের সাহেব হ’বার বাকি কি?” এমন আরও কতই আছে।

 যোগীন্দ্রনাথ বসুর “চিনিবাস চরিতামৃতে’’র “রামমণি’’র সঙ্গে এ যুগের ছেলেমেয়েদের নিশ্চয়ই পরিচয় নেই; “মডেল ভগিনী”র কমলিনীর সঙ্গে ত নয়ই। আমাদের কালে এই বইগুলি যদিও আমাদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল তথাপি চোরাবাজারের কারবার ত চিরদিনই অল্পবিস্তর চলে আসছে! রামমণি এবং কমলিনী নব্যভাবে শিক্ষাপ্রাপ্তা মেয়েদের ব্যঙ্গ চিত্র; সত্যের অংশ হয়ত খানিকটা ছিল, তবে অবাস্তবতাও মনে হয় যেন যথেষ্ট! প্রথম দিকটায় বাঁধা গরু ছাড়া পাওয়ার মত নরের মত নারীর মধ্যেও কোথাও কোথাও কতকটা উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিল, এ কথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না, তবে অতটাই কি না বলা যায় না, অন্ততঃ বিশ্বাস করতে প্রাণে লাগে।

 তাঁর “শ্রীশ্রীরাজলক্ষ্মী” একখানি বিরাট উপন্যাস। “লক্ষ্মী” এবং তার মার মধ্যে জাঁ ভলজাঁর পালিত কন্যা ‘কসেট’ এবং তার দুঃখাহতা মায়ের ছায়া দেখা যায়।

 অমরেন্দ্রনাথ দত্তের শ্রীরাধিকার জবানীতে একটি গান লোক হৃদয় স্পর্শ-গৌরব লাভ করেছিল, সেটী এই;—

“হারে নিপট কপট তুয়া শ্যাম!”

 অতুলকৃষ্ণ মিত্রের নাট্যচরিত্রগুলিতে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য না থাকলেও গানের দানে তিনি যে বঙ্গসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তা অস্বীকার করা যায় না। তাঁর “নন্দবিদায়”এর প্রায় সব কয়টি গানই এককালে বাংলার নরনারীর কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল, সে গান যে তাদের সেই চিরন্তন নন্দ যশোদার, শ্রীরাধা-চন্দ্রাবলীর বিরহ-বেদনার বিলাপ তান, সে যে তাদের চির অবিস্মৃত ব্যথার করুণ-কঠিন স্মৃতি।

“আয়রে আয় কানাই বলাই, আয় নারে ভাই গোঠে যাই”
“কি কর, কি কর, শ্যাম নটবর, যাই সর গৃহকাজে”
“তুই না গেলে ও ভাই কানাই,
আর কারে নিয়ে আমরা ব্রজে যাব রে?”
“মালঞ্চে ফুল আপনি ফুটে বাস বিলাতে চায়”

এবং সকলের চেয়ে বেশী ক’রে মনে পড়ে “মাধবী কঙ্কণের” নাট্যরূপে অভাগিনী দেওয়ানা জোলেখার সেই প্রসিদ্ধ সঙ্গীত;—

‘‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পূরিল।
সকলি ফুরারে যায় মা,

স্বরগ হইতে, জ্বালারই জগতে
কোলে তুলে নিতে আয় মা।”

এ ছাড়া রাধাভাবের গোপীভাবের বহুবিধ প্রসিদ্ধ সঙ্গীত, মাতৃভাবের অনেক ভাল ভাল পদও তাঁর আছে।

 সুপ্রসিদ্ধ কাব্য নাট্য সৃষ্টি ক’রে এবং হাস্যরসের উৎস একসঙ্গে উৎসারিত করে যে শক্তিমান লেখক সেই ষড়রসের অপূর্ব নৈবেদ্য বঙ্গবাণীর পদপ্রান্তে উপচার দিয়েছিলেন, তার সমূদয় সাহিত্যনারীদের পরিচয় দেওয়া সহজ নয়; মাত্র দু’ চারটি রেখা টেনে দেখাব মাতৃমন্ত্রে তিনি সিদ্ধ থাকলেও তাঁর ন্যায়পর চিত্ত স্নেহ-দুর্ব্বলতার অনেক ঊর্দ্ধে অবস্থিত ছিল। মাকে তিনি অন্তরের অন্তর থেকে শ্রদ্ধা ঢেলেছিলেন বলেই নারীর কোন রকম হীনতা তাঁর সহ্য হয়নি। অতি গাম্ভীর্যপূর্ণ “পতিতোদ্ধারিণি গঙ্গে” বলে বাংলাদেশের জন্মদাত্রী এবং পালনধাত্রী জননী জাহ্নবীর স্তোত্রগীতি এবং

‘‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ!
উঠিল বিশ্বে সে কি কলরব, সে কি মা ভক্তি, সে কি মা হর্ষ।”

এবং এদেরই সঙ্গে সমতালে দেশপ্রেমের ও মাতৃপূজার কত না অবদান তাঁর কাছ থেকে দেশবাসী লাভ করল;—যাদের কারু কারু মূল্য শুধু এদেশেই নয়, বিশ্বের দরবারেও স্থায়ী হয়ে রয়ে গেল।

“বঙ্গ আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ
কেন গো মা তোর মলিন বয়ান,
কেন গো মা তোর মলিন বেশ?”

তারপর সব চেয়ে বড় কথা সেই যে বুক ফুলিয়ে বলা;—

“আমরা ঘুচাব মা তোর কালিমা, মানুষ আমরা নহি ত মেষ,
দেবী আমার, সাধনা আমার, স্বর্গ আমার, আমার দেশ?”

এবং

“ধনধান্যপুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা,
সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।”

 এসব গান কি শুধু মুখের কথা? নিশ্চয়ই নয়। আমরা দেখেছি এই বজ্র বিদ্যুতে ভরা মেঘমন্দ্র বাণীকে মূর্ত্ত হ’তে। এর যে একদিন প্রাণবন্ত হয়ে উঠে মরা বাঙ্গালীর কাণে সঞ্জীবনী মন্ত্র প্রদান করে তাদের প্রাণের তারে জীবনীশক্তির অনুপ্রেরণা দিয়েছিল! আজ দুর্ভাগ্য বাংলা কি তার এই চরম দুর্দ্দশার সামনে দাঁড়িয়ে সেই স্মৃতির সুরকে জীবনের তারে আবার তেমনই করে ফিরিয়ে এনে বঁধতে পারবে না? “মা”কে পূজা-নিবেদন করে ভোগের প্রসাদ ত মায়ের সন্তানেরাই উপভোগ করে। দ্বিজেন্দ্রলালের “চন্দ্রগুপ্ত”, মেবারপতন”, “প্রতাপসিংহ”, “দুর্গাদাস”,“সিংহলবিজয়” নাটকে অর্থাৎ সমগ্র দ্বিজেন্দ্র-সাহিত্যে মাতৃপূজার যে মন্ত্র জীমূতমন্দ্রে বিঘোষিত হয়েছিল, তাঁর চারণগীতিবৎ অগ্নিগর্ভ সঙ্গীতসমূহ দেশের যে উপকার করতে পেরেছিল দেশবাসী কি এত শীঘ্রই তার প্রভাব হারাবে?

 তাঁর “আবার তোরা মানুষ হ’’ সমগ্র জাতিকে দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত করে সন্তপ্ত কবির আদেশবাণীর মতই আজও বাংলার,—তথা ভারতের মেঘ-মেদুর গগনপ্রান্তে ধ্বনিত হচ্ছে। সে ‘শব্দময়’ আহ্বানকে চেষ্টা করে ঢেকে ফেলা যাবে না; এ ধ্বনি ঘুমন্তকে জাগিয়ে তোলে, মুমূর্ষুকে পাশ ফেরায়।

 অথচ ঐ একই লোক হাসির গানে মানুষের মনকে কি সহজ হাল্কা সুরেই না ভরিয়ে দিয়েছেন। মেয়েদের অত্যুচ্চ গুণের যেসব পরিচয় তাঁর “রেবা” ইত্যাদিতে দিয়েছেন, তিনিই আবার তাদের দুর্বলতাকে প্রচণ্ড কষাঘাত করতে ছাড়েন নি। বেশ তীব্র অনুযোগের সঙ্গেই “তোমরা ও আমরা”তে বলছেন;—

“বিপদে আপদে আমরাই পড়ে লড়ি,
তোমরা গহনাপত্র ও টাকাকড়ি
অমায়িকভাবে গুছায়ে পাল্কি চড়ি
দ্রুত চম্পট দাও।

তোমরা অবাধে যা খুসী বলিয়া যাও
ভয়ে আমরা স্তব্ধ রই,

আমরা বলিতে পাছে কি বেফাঁস বলি
সেই ভয়ে সারা হই।

সম্পদে ছুটে কোথা হ’তে এসে পড়,
যেন কতকাল চেনা,
তোমরা দোকানী পসারী সেকরা ডাক গো
আর আমাদের হয় দেনা।

কথায় কথায় ধরণী ভাসাও কাঁদি
আমরা যেন বা কতই না অপরাধী,
পড়িয়া যুগলচরণ ধরিয়া কাঁদি
তবুও না ফিরে চাও।

আমরা দু’টাকা জোড়ার কাপড় পরি
তোমাদের চাই সোনা দশ বিশ ভরি,
বোম্বাই বারাণসী বছর বছরই,
তবু মন ফিরে না-ও।”

আর একটি গানে বলছেন;—

“প্রথম যখন বিয়ে হ’ল, ভাবলুম বাহা বাহারে!
কি রকম যে হয়ে গেলাম, বলবো তা আর কাহারে?
শঙ্কা হ’ত পাছে প্রিয়া কখন করে অভিমান,
উর্বশীর ন্যায় পেখম তুলে হাওয়ার সঙ্গে মিশে যান।
দেখলাম পরে প্রিয়ার সঙ্গে হ’লে আরো পরিচয়,
উর্বশীর ন্যায় মোটেই প্রিয়ার উড়ে যাবার গতিক নয়!

বরং শেষে মাথার রতন, লেপটে রইলেন আঠার মতন,
বিফল চেষ্টা বিফল যতন, স্বর্গ হতে হ’ল পতন।
ভাবলুম বাহা রাহারে।

 আবার একতরফাই মক্ষিকাবৃত্তি করেন নি, দোষগুণের বিশ্লেষণটা দ্বৈতভাবেই করেছেন। “যদি জানতে চাও আমি কি রকম স্ত্রী চাই”, কিম্বা;—

“আর কিছু না পার, স্ত্রীদের ধরে মার,
কিম্বা তাদের মাথায় তুলে নাচ ভাল আরও”;—

‘‘একেবারে নিবে যাচ্ছে দেশের স্ত্রীলোক
এম-এ, বি-এ, ঘোড়সওয়ার যাহো’ক কিছু হো’ক”

এই সব নানা পদের মধ্য দিয়ে দেখা যায় মেয়েদের ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে পুরুষদের দায়িত্ব কতটা সে-সম্বন্ধে সংসার-অভিজ্ঞ কবির ভূয়োদর্শন ছিল। এক পক্ষকে তিনি কোথাও দায়িত্ব দেন নি, বিচারকের নিরপেক্ষ দৃষ্টি ঠিকই রেখেছেন। তত্রাচ মাতৃপূজার পূজারী মাতৃচরিত্রের হীনতার দিকটাকে কোথাও প্রকট করতে ভরসা করেন নি। তিনি জানেন নারীর কল্যাণময় মাতৃরূপই সন্তানের দ্রষ্টব্য, তার পাপের পশরা হাটের মধ্যে ভেঙ্গে দেখালে ছেলেরই লজ্জা।

 মনমোহন বসুর “প্রণয়পরীক্ষা” নাটকে দুই সতীন সরলা ও মহামায়া এবং কাজলাদাসী লহনা খুল্লনা এবং দুর্বলা জাতীয়া। তাঁর একটা নারী-গীতি উপভোগ্য, গানটী কোনও বাস্তব নারীর (নিজপত্নীর) উদ্দেশে রচিত। একটু নমুনা দেওয়া গেল;—

“এই দুঃখে দহে মন, ওরে নিজে শোন,
গৃহিণী থাকিতে গৃহে একাকী করি ভোজন।

রাম কাণার পাতের কাছে, লোকে তবু দু’বার যাচে,
কথার দোসর সবার আছে, বঞ্চিত কেবল মনমোহন।’’

আবার তাঁহার বিয়োগের কয়েকদিন পরেই লেখেন;—

“কোথায় গেলে, আমায় একা ফেলে, সংসার তুফান ঘোরে?
বিলম্ব ক’রো না প্রিয়ে সাথে নিয়ে যেতে আমারে।”

 গিরীশ চন্দ্র ঘোষের নাম বাংলার নাট্যসাহিত্যে চির-অমরতা লাভ করে থাকবে তাতে কোন সংশয় নেই। যুগে যুগে মানুষের রুচি পরিবর্ত্তিত হয়, একদা তাঁর যে-সব নাট্যাভিনয়ে রঙ্গভূমি লোকাকীর্ণ থাকতো আজ তারা নির্বাসিত হলেও তাঁর লেখনী নিঃসৃত যে-সব দেবদেবী সম্বন্ধীয় এবং প্রেমের গান জনসাধারণের মধ্যে সুপ্রচারিত হয়ে রয়েছে তা’রা কোনদিন বিলুপ্ত হ’বার নয়। তাঁর কতকগুলি নাটক আজও মহাসমাদরে অভিনীত হয়, ছায়াচিত্রেও তাহা প্রতিফলিত হয়,—যেমন ‘প্রফুল্ল’, ‘বলিদান’, ‘জনা’, ‘বিল্বমঙ্গল’। প্রফুল্ল নাটকের প্রফুল্ল, বড় বউ প্রভৃতি চরিত্র জীবন্ত। “বলিদানে” সমাজসমাজের গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। “পৌরাণিকচিত্র হলেও “জনা” কখন পুরাণ হবে না, আধুনিক চিত্রের রেখাপাত করে রেখেছে। “বিল্বমঙ্গলে’’র চিন্তামণি তুলসীদাস-পত্নীর মতই তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের পাত্রী। সমাজে এইসব দৃষ্টান্তের প্রয়োজন নিত্যকাল ধরেই রয়েছে এবং থাকবে। শরৎচন্দ্রও তাঁর সতী-অসতীদের মধ্য দিয়ে এই কথাই বলতে চেয়েছিলেন। গিরিশ-সাহিত্যের আলোচনা যথেষ্টই হয়েছে; বিশেষতঃ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে স্থানাভাব; তথাপি তাঁর ‘‘ছত্রপতি শিবাজী”র জিজাবাই, “সিরাজউদ্দৌলা’’র লুৎফউন্নিসার উল্লেখ না করলে চলে না। “মীরকাসিম” নাটকের নারীচরিত্র স্মরণ নেই, যেহেতু উক্তগ্রন্থ তিনখানি নিষিদ্ধফলরূপে নির্দিষ্ট হবার পূর্বেই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম, দ্বিতীয়বার আর চক্ষে দেখিনি।

 গিরিশচন্দ্র দ্বিজেন্দ্রলাল প্রসঙ্গে আরও দু’জন নাট্যকারের কথা এখানে বলা প্রয়োজন। অপরেশচন্দ্রের নাট্যশক্তিও নিতান্ত সামান্য ছিল না। “অযোধ্যার বেগম”এ যে চরিত্র তিনি প্রদর্শন করেছেন তা’ এ-দেশে আজকের দিনে বারবার করেই দেখতে পাওয়ার দরকার। “জিন্নৎ” একটি সুমিষ্ট নারীচরিত্র। “কর্ণার্জ্জুনের” পৌরাণিকারা মূলানুগা থেকেও সজীব এবং সুন্দরমূর্তি ধারণ করেছেন। আর এক বিষয়ে তাঁর শক্তি অনন্যসাধারণ ছিল, তা’ অপরের উপন্যাসকে নাট্য রূপ দেওয়ার কলাকৌশল। প্রত্যেকটি কথাবার্তা মূল গ্রন্থ থেকে আহরণ করে তার মর্যাদার এতটুকু হানি না করে তিনি যেমন কৃতিত্ব দেখিয়ে সাফল্যলাভ করেছিলেন সে-শক্তি অপরে দেখা যায়নি। নিজের লেখা অপরের রচনার মধ্যদিয়ে তার উদ্দেশ্য বদলে দিতে অথবা গ্রন্থকারের অঙ্কিত চরিত্র সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিতে অপর নাট্যকাররা দ্বিধাবোধ মাত্র করেন না।

 যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর “সীতা”য় অনুজ্জ্বল শ্রীরামচন্দ্র চরিত্র বহুল পরিমাণে খর্ব করা হয়েছে। শ্রীরামচন্দ্রের মহত্ত্ব বোধ হয় লেখক নিজেই ভাল করে বোঝেন নি, তা’ পরকে চেনাবেন কি করে? সীতা উদ্ধারের চেয়ে যে সীতবর্জনেই তাঁর মহত্ত্ব, ঘরের কোণে বসে সীতার অয়েলপেণ্টিং আঁকার চাইতে অশ্বমেধ যজ্ঞকালে সীতার স্বর্ণমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তাঁকে সহধর্মিণীর পদ দানে পতি রামচন্দ্র যে পত্নীর নির্দোষিতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে নিঃসন্দেহ দৃঢ়তার সঙ্গে তার প্রমাণ সেই প্রজাদেরই অগ্নিকষা, দিয়ে দিয়েছেন, রাজা হিসাবে তিনি যাদের কথায় পত্নীকে বাধ্য হয়েই ত্যাগ করেছিলেন,—এ-দিক দিয়ে নাট্যকার আদৌ ভেবে দেখেন নি। ফলে শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গেই তাঁর আঁকা ‘সীতা’ চরিত্রও ক্ষুন্ন হয়েছে।

 সরলা দেবীচৌধুরাণীর দান নারীচরিত্র সৃষ্টিতে নয়, মাতৃপূজায়। “অতীত গৌরববাহিনী মম বাণী গাহ আজি হিন্দুস্থান” জাতীয় মহাসম্মিলনক্ষেত্রে বিশাল জনসমাজে একদা এই শক্তিময়ী মহিলার লিখিত এবং সংগীত এই গৌরব-সংবাহিনী বাণী মূর্ত হয়ে উঠেছিল। সাক্ষাৎ চারুণীদেবীর মতই তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত সেই প্রাণোন্মাদিনী বাণীর সম্মোহনশক্তি সে-দিনকার সেই নিরস্ত্রযুদ্ধের যোদ্ধৃবর্গ অনুভব না করে পারেন নি। যখন তিনি বীরাষ্টমী ব্রতধারিণীও যুবজাগরণের পথপ্রদর্শিকা হয়েছিলেন তখন পুরুষের মধ্যেই বা কয়জন দেশের কথা ভাবতে শিখেছিলেন? অথচ দেখা যাচ্ছে দেশ এর মধ্যে সে-কথা ভুলে যেতেই বসেছে! কিন্তু তাঁর মর্মবাণী গোদিত হয়ে রৈল ঐ গানের ভাষায় এবং “আহিতাগ্নিকায়”। “আগুনের পরশমণি”, যাকে প্রাণে ছোঁয়াতে পারলে “জীবন ধন্য ও পুণ্য’’ হতে পারে, তারই একটু ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গমাত্র হলেও সে আগুনই, তার দাম আলেয়ার চেয়ে অনেক বেশী।

 মাতৃপূজায় প্রমথনাথ রায়চৌধুরীর দানও নিতান্ত সামান্য নয়।

‘‘তুই মা মোদের জগৎ আলো
সুখে দুঃখে হাসি মুখে,
আঁধারে দীপ তুমিই জ্বালো”

“নম বঙ্গভূমি শ্যামাঙ্গিনী
যুগে যুগে জননী লোকপালিনী।”
“শুভদিনে শুভক্ষণে গাই আজি জয়,
গাহ জয়, গাহ জয়, মাতৃভূমির গাহ জয়”।

“হের কি মহামঙ্গল রাজে
মধুমিলন বঙ্গসমাজে।”

“আপনজনে নিলে যদি চিনে,
সবার হৃদয় লহ আজি জিনে,
এক শোণিতধারা, বহে পীযুষপারা
সবার ধমনী মাঝে।”

প্রভৃতি স্বদেশী যুগের সুপরিচিত গান ছাড়া আরও বিভিন্ন কবিতা ও গান তাঁর আছে। “নারীচরিত্র” বলতে আমি শুধু নর-কল্পিতা সামাজিক নারীকেই বুঝিনি। দেশমাতা ও বিশ্বমাতা নারীজগতের আদর্শ স্বরূপা, তাঁদের কে’ কি ভাবে দেখেছে এবং দেখিয়েছে সে-ভাবে এঁর স্থানও তুচ্ছ নয়।

 রজনীকান্ত সেনের রচনার সঙ্গে এ-যুগের ছেলেমেয়েদের পরিচয় ক্রমেই কমে আসছে, খুবই দুঃখের কথা সন্দেহ নেই। তাঁর গানের সম্মোহিনী মায়া দেশবাসী এত শীঘ্র না কাটালেই গুণগ্রাহিতার পরিচয় দিত। তাঁর “মাতৃবর্ণনা” একটি অতুলনীয় সম্পদ;—

“স্নেহবিহ্বল, করুণা ছলছল,
শিয়রে জাগে কার আঁখিরে
মিটিল সব ক্ষুধা, সঞ্জীবনী সুধা,
এনেছে অশরণ লাগিরে।”

 দ্বিজেন্দ্রলালের মত তাঁরও বহু ব্যঙ্গরচনা আছে; তাদের মধ্য দিয়ে “ঘরওয়ালী” নারীচরিত্র স্থানে স্থানে বেশ ফুটে উঠেছে। পুত্রবিবাহে বরের বাপের ফর্দ এই প্রকার;—

“নগদে চাই তিনটি হাজার,
তাতেও আবার গিন্নি বেজার,
বলেন এবার বরের বাজার
চড়া কি রকম!
কিন্তু তোমার কাছে চক্ষুলজ্জা
লাগে যে বিষম।

আর পড়ার খরচ মাসে তিরিশ,
হয় না কমে বলে গিরীশ,

তা’ সে তোমার মেয়ে, তোমার গরজ, তোমার আকিঞ্চন
আমার কি ভাই, আজ বাদে কাল মু’দব দু’নয়ন।”

 আর একটি পতি তাঁর পত্নীকে বড়ই মর্মবেদনার সঙ্গে যে কথাগুলি নিবেদন করেছিলেন তার মধ্যে একটা চিরন্তন সত্য, আছে বই কি! সেটা অস্বীকার করবার উপায় দিনদিনই কমে যাচ্ছে;—

“বাজার হুদ্দা কিইন্যা আইন্যা ঢাইল্যা দিছি পায়,
তোমার লগ্যে কেমতে পারমু হইয়া উঠছে দায়।
আরসি দিছি, চিরুণ দিছি, গা মাজনের হাপান দিছি,
চুল বাদনের ফিত্যা দিছি, আর কি দেওন যায়?

 দ্বিজেন্দ্রলালও এঁদের ব্যক্তিবিশেষকে নয়, জাতিগতভাবেই প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন;—

“জেনে রেখো ভায়া নারী আসিয়াছে জগতে কি কাজ সাধিতে।
পরিতে বোম্বাই সাড়ী বেনারসী”..ইত্যাদি।

আবার এঁরা দু’জনেই মহীয়সী নারীচিত্রও নিতান্ত অল্প আঁকেন নি।

 নজরুল ইসলামের অমর কাব্যকথার মধ্যে বাস্তব নারীর খুব বড় ও খুব ছোট বহু পরিচয় না পেলেও তাঁর আদ্যানারীর যে সমস্ত বন্দনাগীতি আমরা শুনেছি, যদি সত্য করে তার মর্ম গ্রহণ করতে পেরে থাকি, তাহলে ‘স্ত্রিয়ঃ সমস্ত।” সেই পূজাতেই পূজা পেয়েছেন ভাবতে পারেন। তাঁর “দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’’ গানে যাত্রীগণকে উদাত্তকণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে ‘‘বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইবের খঞ্জর” সেই পলাশীর প্রান্তর দেখিয়ে বলেছেন “উদিবে সে রবি আমাদের খুনে রাঙ্গিয়া পুনরায় হে”; “অরুণ প্রাতের তরুণদল’’কে যে চলতে উৎসাহ দিয়েছেন সে ত’ নরনারীর ভেদ রেখে নয়? তাঁর “নারী” কবিতায় নারীজাতির একটা জীবন্ত চিত্র আমরা দেখতে পাই;—

“বিশ্বে যা কিছু মহান্‌ সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার নারী সৃজিয়াছে অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুণ্ড বলিয়া যে তোমা করে নারী হেয় জ্ঞান,
তারে বল আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর সয়তান।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ রস মধু, গন্ধ সুনির্মল।

জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী
সুষমা লক্ষ্মী নারীই ফিরেছে, রূপে রূপে সঞ্চারি।”

 কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অসাধারণ কবিপ্রতিভায় নারীর প্রতি প্রভূত শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি বর্ষিত হয়েছে। পৌরাণিক নরনারীর চিরন্তন প্রকৃতি ও তাদের সমস্ত অভাব-অভিযোগ আর্ত্তনাদ যে আজও ঠিক সমস্রোতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি যেন আমাদের হতাশাচ্ছন্ন চিত্তে কিঞ্চিৎ বলাধানও করেছেন। ব্যাধি ধরা পড়লে প্রতিকারের পথও নির্দিষ্ট হয়। তাঁর বিশিষ্ট কয়েকটিমাত্র কবিতা থেকে বিশেষ বিশেষ চিরন্তনী নারীর ঈষৎ মাত্র আভাস দেওয়া ছাড়া বেশী কিছু বলবার অবসর নেই, সেগুলি যে আলোচনা ও গবেষণার উপযুক্ত বিষয় তাতে সন্দেহ নেই। দুঃখের কথা, পাঠ্যপুস্তকের কোথাও এদের স্থান দেখি নি। বিদ্যালয়ের আবৃত্তিতে অভিনয়ে এরা স্থান পেলে না। এ-বিষয়ে আমাদের নিজেদের অমনোযোগও আছে, রুচিবিকারও কম নেই, আর আছে সর্বোপরি ভীরুচিত্তের দুর্বল সংশয়।[২৩]

 রাজয়োষে সমুদ্রগর্ভে আত্মনিমজ্জনকারী গিরিরাজপুত্র মৈনাকের রূপকে কবি যে বর্ত্তমানযুগের রাজবন্দীদের পথ-চাওয়া মায়েদের নিগূঢ় অন্তর্বেদনা প্রকাশ করেছেন সেই সহানুভূতিপূর্ণ নির্ভীকতা সামান্য নয়। মৈনাক-জননী পুত্রবিচ্ছেদবিধুরা আমাদের মায়েদের মতই বলছেন;—

“আমার উমা এলো, হায় গিরিরাজ। কই এলো মৈনাক?
কই এলো বীর পুত্র আমার, কই সে অভয়ব্রতী?
অত্যাচারের মিথ্যাচারের শত্রু উদারমতি।”

প্রবাসিনী কন্যাকে বুকে পেয়েও যে তাঁর বুকের আধখানা ভরতে পারলো না, পারা সম্ভবপর নয়; মায়ের প্রাণের এই নিগূঢ় তথ্য কতখানি সহানুভূতি প্রাণে থাকলে তবেই পুরুষ লেখক তাকে এমন নিখুঁত চিত্রে অঙ্কিত করতে পারে। সেইজন্যই কবিকে ঋষি বলা হয়। দিব্যদৃষ্টি না থাকলে মানুষের গুহানিহিত অন্তরে প্রবিষ্ট হওয়া যায় না। মাতৃচিত্তের অন্তর্ব্যথা যে অবরুদ্ধ রোষের আকারে সহসা বিলাপ-মর্মর হ’তে আকারপ্রাপ্ত হয়ে আহতা সিংহীর মত গর্জে উঠতে পারে তা-ও তিনি দেখাতে ভোলেন নি;—

“মায়ের প্রাণের এ অভিশাপ ফলতে হবে ফলতে হবে,
ত্রিভুবনের রাজা হলেও আসন তাহার টলতে হবে।
অভিশাপের ভস্ম-পুতুল বিরাজ কর সিংহাসনে,
নিশ্বাসেরও সইবে না ভর, মিলবে হঠাৎ স্বপ্ন মনে।”

মায়ের প্রাণের এ হাহাকার আমরা আজ প্রাণে প্রাণে অনুভব করছি; অন্তরের অন্তঃস্থলে কেবলই বেজে বেজে উঠছে;—

“লুকিয়ে বেড়ায় চোরের মতন বড় চোরের ভয়ে,
কেমন আছে? আছে কি না কেই বা দেবে কয়ে।”

 ‘কয়াধূ” কবিতায় আবার আমরা সেই আর্তা-জননীরই অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বাষ্পপূর্ণ নেত্র বারম্বার মার্জনা করেও শুষ্ক রাখতে পারি না। সুপ্রসিদ্ধ দেশনেতাদের কারাবরণের প্রথম যুগে (এখন এ জিনিস বেশ গা-সওয়া হয়েছে) প্রাচীন রাজপুত চারণের মতই তিনি বর্তমানের সঙ্গে তুলনীয় এক অতীত অত্যাচারের মর্মন্তুদ কাহিনীর পটভূমিকা নিয়ে এসে আমাদের মাতৃ-হৃদয়ের সামনে ধরে দিয়েছিলেন। সেই তীক্ষ্ণাগ্র সূচিমুখ বাণ আমাদের হৃদয়কে শোণিতাক্ত করেছিল, কিন্তু সে সুচিকাভরণ কি অসাড় মনোবৃত্তিকে স্থায়ী রাখতে পেরেছে? কে’ ক’দিনের জন্যই বা বলতে পারলে;—

“কার তরে এই শয্যা দাসী, রচিস্‌ আনন্দে?
হাতীর দাঁতের পালঙ্কে মোর দে’রে আগুন দে।
পুত্র যাহার বন্দীশালায় শিলায় শুয়ে, হায়,
ঘুম যাবে সে দুধের ফেনা ফুলের-বিছানায়?
কুমার যাহার উচিত ক’য়ে সয় অকথ্য ক্লেশ,
সে কি রাজার মন ভোলাতে পরবে ফুলের বেশ?
দুলাল যাহার শিকল বেড়ীর নিগ্রহে জর্জর,
জন্তুলিকা? রত্নমুকুট তার শিরে দুর্ভর।
  —নাই কিছুরই সাধ,
যে-দিকে চাই কেবল দেখি লাঞ্ছিত প্রহ্লাদ।”

আমরাও কি সেই আহতচিত্ত কবির দৃষ্টির অনুসরণ করে আজ লক্ষ লক্ষ প্রহ্লাদের সেই—

“যে-দিকে চাই মলিন অধর উপবাসীর চোখ,
যে-দিকে চাই গগন-ছোঁয়া নীরব অভিযোগ
যে-দিকে চাই ব্রতীর মূর্তি নিগ্রহে অটল।”

দেখতে পাচ্ছি না? আমাদের অন্তরাত্মা কি আজ সত্যই ডুকরে কেঁদে উঠে বলছে না;—

“বিদ্রোহ নয় বিপ্লবও নয়, ন্যায্য অধিকার।
উচিত বলে দণ্ড নে’বার দিন এসেছে আজ,
(যার জন্য) দুঃখবরণ করেছে মোর নির্দোষী প্রহ্লাদ।”

আজ সমস্ত ভারতভূমির বঙ্গভূমির মেয়েদের ক্ষুব্ধ অন্তর থেকে এই বিস্ময়বেদনা কি উথলে উঠছে না, আর তার সঙ্গে অননুভূতপূর্ব একটা আত্মগৌরবও কি সংমিশ্রিত নেই?—

“উচিত বলে দণ্ড নে’বার দিন এসেছে আজ,
উচিত বলে পরতে হবে চোর-ডাকাতের সাজ,
চিত্ত-বলের লড়াই সুরু পশু-বলের সাথ,
বন্যা-বেগের হানার মুখে কিশোর-তনুর বাঁধ!
প্রলয় জলে বটের পাতা! চিত্ত-চমৎকার!
তীর্থ হল বন্দীশালা, শিকল অলঙ্কার।
খেদ কিছু নাই, আর না ডরাই, চিত্তে মাভৈঃ রব;
উচিত বলে বন্দী ছেলে এ-মম গৌরব!
কয়াধু তোর জন্ম সাধু, মোছ রে চোখের জল,
রাজ-রোষেরি রোশনায়ে তোর মুখ হ’ল উজ্জ্বল!”[২৪]

 সত্যেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণ্য-বিদ্বেষ এবং মক্ষিকাবৃত্ত হয়ে বিরাট সমাজদেহের ক্ষত অন্বেষণ করে যথেষ্ট অসহিষ্ণুভাবে দেশমান্য প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞদেরও অযথা আক্রমণ করেছেন, কিন্তু মাতৃজাতির কোন চ্যুতি-বিচ্যুতিকেই তিনি লক্ষ্য করেন নি। অধিকাংশ কবিই তাই করেন, কিন্তু তা’তে নিরপেক্ষতা থাকে না। একতরফা অত্যাচারের কাহিনী দেখে শুনে মনে হয় বুঝি এ-দেশের মেয়েরা কসাইখানার পশুপাল, নির্বিচারে খড়গাঘাত সইবার জন্য যুপকাষ্ঠের পাশে ভিড় ক’রে আছে, তাছাড়া তাদের আর কোন পরিচয়ই নেই। তারা শুধুই অত্যাচারিতা হয় এবং ভক্ত খৃষ্টানদের মত দ্বিতীয় গালটী বাড়িয়েই রেখেছে, ভুলেও কখন অপর কোন উল্টো নীতিই অনুসরণ করে নি! তবে প্রাচীন যুগের নারীদের সম্বন্ধে তাঁর বহু রচনা সেই মনস্বিনীদের মধ্য দিয়ে আমাদের বর্তমানের সমস্যা সমাধানের পথ দেখাবার সহায় হয়েছে, গৌরববোধকে জাগ্রত করবার সহায়তা করেছে। নারী যে নারী থেকেও জগতে একটা উচ্চতম স্থান লাভ করতে পারে, তার জন্য তাকে অতলে নামতে হয় না, ইহাই হ’ল চিরযুগের প্রধানতম শিক্ষা। এ আমরা তাঁর “কয়াধু”, “গিরিরাণী”-তেই শুধু নয়, ‘‘স্কন্ধ-ধাত্রী”, “সর্বদমন” প্রভৃতিতেও পেয়েছি। ‘মল্লিকুমারী” একমাত্র জৈন-নারী-তীর্থঙ্কর, তীর্থঙ্কর হয়েও তিনি নিজের নারীত্বের মহিমা অতিক্রান্ত হতে পারেন নি, মাতৃত্ব যে তাঁকে নিজ স্নেহপাশ দিয়ে বিশ্বের সন্তানদের সঙ্গে বিজড়িত করতে ছাড়েনি, ক্ষুদ্র “স্ব”কে বৃহৎ করে মাতৃত্বের সীমাকে মাত্র প্রসারিত করেছিল, তাঁর মুখের কথায় তা’ সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে;—

“মমতার পথে মোক্ষ আমার,
সাধনা আমার ত্রিকাল ভরি,
বিত্ত আমার চিত্ত-চারিত্র,
হৃদয়ে ললাটে রত্ন ধরি।
প্রসূতি না হ’য়ে শত সন্তান
পেয়েছি হৃদয়ে নিয়েছি টানি;

প্রসবের ব্যথা যে খুসী সে নিক
পালনের ব্যথা আমারি জানি।”

 “স্কন্ধ-ধাত্রী”তে যে চিত্র দেখি, তার স্থান, কাল ও পাত্র কিছুই যেন বদলায় নি, শুধু নামরূপমাত্রই পরিবর্তিত হয়েছে। একজন ‘মা’ যখন এতটাই আশা জানাচ্ছেন;—

“বজ্রকাটা আঙ্গুলে যার জ্যোৎস্না জড়িয়ে;
পাড়িয়েছি ঘুম ঘুম-পাড়ানি মন্ত্র পড়িয়ে,
সে মোর হবে দৈত্যজয়ী?—পুরবে মনের সাধ?…
অন্যায়েরি বন্যাজালে পারবে দিতে বাঁধ?...”

 পৌরাণিক রাজাধিরাজ ভরত বা সর্বদমনের ন্যায়বিচারকে আমরা সমর্থন করতে পারি নি, তাঁর ন্যায়ের মূলে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ভুল ছিল;—

“পীয়ুষ পিয়েছে যার কাছে, আজ বিষ পিবে সেই তাহারি কাছে;’’

 তার চেয়ে রাজার ‘‘দেহের দুষ্টব্রণ”কে রাজাই স্বহস্তে অস্ত্রাঘাত করতে পারতেন, নিরুপায়া জননীকে নিজের ন্যায়বিচারের মর্য্যাদার পায়ে এত বড় অন্যায় করতে বাধ্য করা কোন্ রাজধর্মের পক্ষ থেকে সুবিচার—তা’ তো জানি না!

 সত্যেন্দ্রনাথের লেখনী নারীর প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদে কোন সময়েই নিশ্চল থাকেনি। “দোরোখা একাদশী’’তে,—

“উড়িয়ে লুচি আড়াই দিস্তে দেড় কুড়ি আম সহ—
একাদশীর বিধানদাতা করেন একাদশী,
এদিকে ওই ক্ষীণ মেয়েটি নিত্য একাহারী—
একাদশীর বিধান পালন করছে প্রাণে ম’রি,
কণ্ঠাতে প্রাণ ধুঁকছে, চোখে সর্ষে-ফুলের সারি।”

—এবং “স্নেহলতা”র বিবাহ-পণ দিবার জন্য পিতাকে ভিটা বাঁধা দিতে হবে শুনে পুড়ে মরার পর সমাজকে যে তীব্র কষাঘাত করেছিলেন তার জন্য বঙ্গনারীমাত্রেই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

 কিন্তু কথা এই যে, চাবুক হাতের কাছে থাকলেই যে তা’ নির্বিচারে চালাতেই হবে সেটা সভ্যতাও নয়, সুবিচারও নয়। হিন্দুসমাজের ভালমন্দ স্থূলসূক্ষ্ম সমস্ত রীতিনীতিকে এবং মহামহোপাধ্যায় সংস্কৃত শিক্ষিত মাত্রকেই চাবুকপেটা করায় আত্মপ্রসাদ হয়ত আত্ম-রুচি অনুসারে লাভ করা যেতে পারে; কিন্তু যে ন্যায়ের মর্যাদার গৌরব তিনি নিজের মনের মধ্য থেকেই করেছেন, তা’তে নিশ্চয়ই আঘাত দেওয়া হয়। কারু লেখার ভালমন্দ সমালোচনা করতে গেলেই যে তাঁকে কুৎসিত ভাষায় গাল দিতে হবে, এমন বিধান কোন দেশেরই শিষ্টাচারে নেই। তাঁর সুললিত ছন্দের, দেশপ্রেমের, নারীমাহাত্ম্য উপলব্ধির এবং নারীর প্রতি গভীর সহানুভূতির আমরা প্রশংসা করি। তথাকথিত সেই সব নারীহিতৈষী যাঁরা উচ্ছৃঙ্খল নারীচিত্র এঁকে তাদের সর্বনাশের পিচ্ছিল পথকে পিচ্ছিলতর করতে চান, তাঁদের চেয়ে আমরা এই রকম নারী-মহিমা উদ্বোধনকারীকেই প্রকৃত নারীবন্ধু বলি। নারীর নারীত্ব বজায় রেখে যে উন্নতি তারই নাম প্রগতি।

 মোহিতলাল মজুমদারের কবিতায় অনেক বিচিত্র ধরণের নারীচিত্র দেখা যায়। তাঁহার “উর্ব্বশী পুরূরবা” এবং “নুরজাহান” উল্লেখযোগ্য; “দেবদাসী” কবিতার একাংশ উদ্ধৃত করা হলো;—

“আমি দেবদাসী, দেবী নই আমি—
দাবী নাই সুধাপানে,

আমি নারী নই, নরের মোহিনী,
আমি সবাকার, মানস-মোহিনী,
আমি দেবতার ভোগের প্রসাদ,
ভক্তের পূজা-দানে।
নয়ন অন্ধ, শ্রবণ বধির-
নৃত্য-পুত্তলিকা!
বাজে করতাল,, বাজে মৃদঙ্গ,
নেচে ওঠে মোর সকল অঙ্গ,
প্রাণ নাই, তবু গান গাই আমি—
সৃষ্টির প্রহেলিকা।”[২৫]

 আধুনিক লেখকদের মধ্যে প্রভাতমোহনের রচনায় নারীর প্রতি শ্রদ্ধা নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর “ব্রতী” নাটকের যে দুটি নারী সিদ্ধার্থকে পতিরূপে কামনা করে নিষ্ফল হয়ে তাঁকে তাদের তপস্যার ফল অর্পণ করেছিল সেই নন্দা ও নন্দবালার কথা এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তাঁর “মুক্তিপথে” কাব্যগ্রন্থের “নারী” কবিতাটিতে তিনি এ-দেশের নারীকে তাদের আত্মমহিমা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, দেশের মুক্তিসাধনায় তাদের যোগ দিতে পূর্বাহ্নেই ডাক দিয়েছিলেন;—

“পতি-পুত্র ধন-জন, নারী-দেছে বিসর্জন
যে-দেশে ধর্মের মুখ চেয়ে,—
মাগো তুমি সে-দেশেরই মেয়ে।

আত্মার সম্মান করে, সব দেছে অকাতরে,
সর্বভয় যারা বিস্মরিয়া,—
বোন তুমি তাদেরই আত্মীয়া।”

 “অন্নপূর্ণা” কবিতায় তিনি নারীর সম্বন্ধে যা বলেছেন তাতে চিরন্তনী নারীর একটা সম্পূর্ণ চিত্র আমরা দেখতে পাই;—

 (১) যে-দেবী ক্ষুধার অন্ন যুগে যুগে যোগাইল জীবে,
অন্নপূর্ণা তারে মোরা বলি।
তাহার বিহারক্ষেত্র নহে কোনো সুদূর ত্রিদিবে,
মর্ত্যভূমি আছে সে উজলি।
মাতারূপে জায়ারূপে কন্যারূপে প্রতি ঘরে ঘরে,
দেশে দেশে প্রাসাদে কুটিরে।
নিখিল নরের মর্মে উপবাসী ভিখারী শঙ্করে,
অন্নপূর্ণা অল্প দিয়া ফিরে।

 (২) যে-অন্নে মিটায় নারী দেহের মনের সব ক্ষুধা,
পুরুষে সার্থক করি তুলে!
রাখিতে তাহার মান্য ধনে ধান্যে ভরিয়া বসুধা,
তাই নর আনে আত্মভুলে।
নারী লজ্জা পায় তাই সভ্যতার নেমেছে গুণ্ঠন,
মানুষের পশুত্বের পরে।
নারী সজ্জা চায় তাই বসুন্ধরা করিয়া লুণ্ঠন,
পুরুষ চরণে দেছে ধরে।

 (৩) স্নেহ দিয়া সেবা দিয়া স্বপ্ন দিয়া নারী বাঁধে ঘর,
তারা লক্ষ্মী, তারা প্রেমময়ী।

তারা শক্তি দেয় বুকে, তারা হাতে দেয় ধনুঃশর,
তাই নর ত্রিভুবনজয়ী।
হাসিমুখে অকাতরে সৃষ্টিসিন্ধুমন্থনের বিষ,
সঙ্গোপনে তারা করে পান।
মানুষের ঘরে ঘরে তাই ভরে আজো অহর্নিশ,
আনন্দের অমৃত অম্লান।”

 জসিমুদ্দিনের কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলার গ্রাম্য নারীর সুখদুঃখের অভাব-অভিযোগের, আনন্দের স্মিতহাস্য ও অশ্রুসজল নেত্রের যে ছবির পর ছবি আমাদের মনের মধ্যে ফুটে ওঠে, তা’ আমাদের বাস্তব জীবনের মতই সমানভাবে হাসায় কাঁদায়। নারীর চিত্তগহনে ঢুকে অতি সহজ সুন্দর ভঙ্গীতে তিনি তাদের যে-সব মনের কথা প্রকাশ করে দিয়েছেন, তা’ দেখেও তারাও অতিমাত্রায় বিস্মিত হবে। তার একটি চিত্র এই;—

“এ-গাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান
ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে রয় সে পেতে কান।”

খুনদায়ে পলাতক পতির হতভাগিনী পত্নীর এই করুণ চিত্রখানি;—

“ঘরের ভিতরে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নকসী কাঁথা,
সিলাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা।
পাতায় পাতায় খস খস করে শুনে কান খাড়া করে
যারে চায় সে-তো আসেনাকো শুধু ভুল করে করে মরে।
তবু যদি পাতা খানিক না নড়ে ভাল লাগে না তার।
আলো হাতে করে দূর পানে চায় দ্বার খুলে বার বার।”

পতিবিরহিণী বঙ্গবধূটি দুঃখের দহনে দগ্ধ হয়ে হয়ে অবশেষে যখন ঝরে পড়বার অবস্থায় পৌঁছেচে, তখন শ্রীরাধিকার মতই—সে, “মরিলে তুলিয়ে রেখ তমালের ডালে”র মতই একটী করুণ আর্জি সোনা-মাকে করছে;—

“এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর ’পরে
ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এর বুকে যাবে ঝরে।
সে যদি আবার ফিরে আসে কভু, তার নয়নের জল
জানি জানি মোর কবরের মাটি ভিজাইবে অবিরল।”

তার ‘কবর’ কবিতাটি রক্তের রংয়ে আঁকা, এর সঙ্গে তুলনায় মনে পড়ে মিসেস হেমান্সের সেই বিখ্যাত কবিতা;—

“দে গ্রু ইন্ বিউটি সাইড বাই সাইড, দে ফিল্ড্‌ ওয়ান হোম উইথ গ্লি,
দেয়ার গ্রেভস্ আর সিভারড্‌ ফার এণ্ড ওয়াইড্‌ বাই মাউণ্টেন রিভার এণ্ড দি সি।”

 রবীন্দ্রনাথের গদ্যসাহিত্যও সব দিক দিয়ে পদ্যসাহিত্যের মতই বিশাল, বরঞ্চ পরিধির হিসাবে বিশালতর। আমরা এখানে তাঁর গল্প উপন্যাস নাট্যসাহিত্যের মধ্যবর্তিনী নারীদেরই একটা রেখাচিত্র মাত্র দিয়ে যাচ্ছি। পূর্বেই বলেছি এ-ছাড়া তাঁর সাহিত্যিক চরিত্রের বিস্তৃত আলোচনা করবার মত স্থান বা শক্তি আমাদের নেই। রবীন্দ্রনাথের এক একটি ছোট গল্প কাব্যগাথার মতই চমৎকারিত্বপূর্ণ এবং কবিতার মতই সুখপাঠ্য। “কাবুলীওয়ালা” গল্পে খুকী মিনি শিশু-চিত্রের আর একটী অভিনব দান, “ছুটি”র ফটিকচাঁদ, “অসমাপ্ত”র চঞ্চলা মেয়ে মৃন্ময়ী, “পোষ্টমাষ্টারের রতনের ছোট মনের বিশ্লেষণ তদানীন্তন বঙ্গসাহিত্যে নূতন আলোকসম্পাত করেছিল। “মেঘরৌদ্র’’-এর বদ্রাওনের নবাবপুত্রীর প্রণয়কাহিনী যেমনই সকরুণ তেমনই নারীমহিমা দীপ্ত। নারী যে পুরুষের মহত্ত্বের দ্বারেরই উপাসিকা এই তথ্যটি এই দেওয়ানা নবাবজাদীর অতিকরুণ ক্লান্ত জীবনকথার মধ্য দিয়ে উজ্জ্বলরূপে প্রকটিত হয়ে উঠেছে।

 আমাদের ঘরে ঘরে প্রতিবেশীর গৃহাঙ্গনে, গ্রামের মধ্যে, সহরের পথের ধারে ধারে কতই অকথিত, অমীমাংসিত রহস্য ও মিলন-বিরহাত্মক সুখদুঃখের ইতিহাস প্রাত্যহিক জীবনে সংগঠিত ও সংঘটিত হয়ে উঠছে,—এই সবের মধ্য থেকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন কবি এবং কথাকার অতি সহজে ঘটনা সংস্থান করে নিয়ে কেমন করে মানবচিত্তকে চমৎকৃত করে দিতে পারেন বলতে গেলে রবীন্দ্র নাথই তার প্রথম পথপ্রদর্শক। গণসাহিত্য আজ যাকে বলা হয়, ফরাসী এবং রুষ সাহিত্যিকরা যে-পথ জনসাধারণের জীবনদ্বন্দ্বের মধ্য থেকে খুঁজে নিয়েছিলেন, সে-পথের যাত্রারম্ভ বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প দিয়েই সুরু হয়েছিল। অবশ্য প্রাচীন বাংলায় আমরা বহুপূর্বেই এই গণ-সাহিত্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ে ভালভাবেই এসেছি। রাজা মহারাজদের আশেপাশে শুধু পাত্রমিত্র সেনাপতি বয়স্য বণিক নয়, সেখানে অতি সামান্য নগণ্যদেরও, যেমন দাসদাসী, অস্পৃশ্যজাতীয় পরিবারবর্গের সুখদুঃখের কথাচিত্রের কোনই অভাব ছিল না। ইদানীং সে-চিত্রের উপর কালের ধূলিজাল পড়েছিল এবং নূতন রংয়ে যে আলেখ্য লেখা হচ্ছিল তা’ প্রায় ধনী পরিবার অথবা রাজপুতানার রাজা রাজকুমার বা রাজকন্যাদের নিয়েই হচ্ছিল। আর এইজন্যই তাদের নিজেদের দেশের থেকেও বাংলাদেশেই টডের “রাজস্থান” গ্রন্থের প্রচার খুব বেশী হয়েছিল।

 বঙ্কিমচন্দ্র গরীব গৃহস্থের পরিচয় দু’একবার দে’বার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সে-চিত্র তেমন করে ফোটেনি এবং ‘‘প্রফুল্ল”, “রাধারাণী” বা কাণা ফুলওয়ালীর দৈন্যগ্রস্ত জীবন যেন তাদের ঐশ্বর্য-সমুজ্জ্বল পরবর্তী জীবনের ঔজ্জ্বল্য বর্ধনের সহায়তা করেই গেছে। বাস্তব জীবনচিত্র নয়। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলি মানবজীবনের বাস্তব কথা।[২৬]

 “বৌঠাকুরাণীর হাট”-এর সুরমা রাজ-সংসারের আবর্জনামাত্র! রাজকন্যা ও রাজরাণী বিভাও রাজ দ্বারের কাঙ্গালিনী মেয়ে। দু’টি চিত্রই অনবদ্য। “নৌকাডুবি”র কমলা আমাদের মন প্রথম থেকেই এমন করে কেড়ে নেয় যে, শিক্ষিতা পিতৃ-আদরিণী হেমনলিনীর শূন্য হৃদয়ের প্রতি আমাদের চেয়ে দেখবার পর্যন্ত অবকাশ থাকে না। নলিনাক্ষের সংসারবিরাগী মা হিন্দুনারীর পবিত্রতায় এবং তেজস্বিতায় সমুদ্ভাসিত, যে তেজকে যথার্থ সতীতেজ বলা যায় সেই জিনিসটীই আমরা তাঁর মধ্যে দেখতে পাই। নিবিড় সখ্যের সহানুভূতিতে “উমার মা” শৈলজাকে সহজেই আপন করতে পারা গেছে।

 অবস্থাচক্রের জটিলতায় কমলার পক্ষে দুষ্প্রবেশ্য ছিল যে পতি-পত্নীর মধ্যের একাত্মতা, সখী শৈলজার সেই আত্মহারা পতিপ্রেমই তার জ্ঞানচক্ষু ফুটিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল।

 “চোখের বালি”র বিনোদিনী রোহিণীর উত্তরাধিকারিণী এবং কিরণময়ীদের পূর্বপুরুষ(?) হলেও নারীর প্রতি অসীম শ্রদ্ধাবান লেখক তাকে পাপের পথে বার করে দিয়েও আগাগোড়া রাশ টেনে রেখেছেন; ডুব-জলে গিয়ে পড়েও সে শুধু হাবুডুবু খেয়েছে, ডোবেনি। অতি নমনীয়া ও কমনীয়া “আশা”র কাছে ক্ষমা পেয়ে সে তার দুর্বার চিত্তবিভ্রমের প্রায়শ্চিত্তে অনুতাপতপ্ত জীবন উৎসর্গিত করে দিয়ে পাঠকসমাজের কাছেও ক্ষমার্হ হয়েছিল।—ভুল করা মানব-ধর্ম!

 “অন্নপূর্ণা” “গোরা”র আনন্দময়ীরই সগোত্রা, ঘটনাচক্রের সংঘাতে পড়ে আনন্দময়ী উদারতর হয়ে উঠতে অবকাশ পেয়েছিলেন। “গোরা”র ললিতা আধুনিক সাহিত্যরথীদের আদর্শ একরোখা মেয়ে, সে ভাল কি মন্দ জানি না; যেমন যুগধর্মে জন্মাচ্ছে তারই একটি আলোকচিত্র। সুচরিতা মেয়েটি পুরাণো বাংলার, ভাগ্যচক্রের আবর্তনে যখন যেখানে গিয়ে পড়ে, সামলে নেয়।

 “চতুরঙ্গে”র “দামিনী” “শেষের কবিতা’’র লাবণ্যর কাঠামো একই জাতের; দারুণ দুস্প্রবেশ্য!

 “দুই বোন” এ-দু’খানি মডেল, একমেটে করে ছেড়ে দেওয়া, দোমেটে করা হয়নি, নেহাৎ উপরোধে লিখে দিতে হয়েছিল হয়ত। ‘মালঞ্চ”-এ সঙ্কীর্ণ নারীচিত্রের প্রতীক। বড় ভাল লাগে আমাদের “গোড়ায় গলদ”-এর ইন্দুমতীকে, হাসিখুসীভরা, সঞ্চারিণী দীপশিখার মত, ঝলকে ওঠা দীপালোকের মত মন ধাঁধিয়ে দেওয়া চমৎকার মেয়ে। “গয়লার গাই”কে চাকর বানিয়ে যে নাকালটা করেছিল, ইদানীংকার হাসতে ভুলে যাওয়া বাঙ্গালীর ঘরে আজও সে একটা সত্যকার প্রাণ খুলে হাসবার উপাদান দিয়ে রেখেছে। এমন হাস্য-সরস মধুর চরিত্র আমরা বাস্তবেও কদাচিৎ দেখেছি এবং তারা আজ তাদের সেই ব্যঙ্গ রঙ্গ-হাস্যস্রোত সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে, “ইন্দু”র মত আমাদের হাঁপ ছাড়বার কোন উপায়ই দান করে যেতে পারেনি। সত্যে ও কল্পনায় অথবা সত্যেরই প্রতিলিপিতে এইখানেই প্রভেদ।

 “ছাগলের খুরের মত খুটখুটে” জুতাপরা “এনামেল-করা-মূখী” কেটিকে আজকাল হাটে বাটে সর্বদাই দেখতে পাচ্ছি, তবে সে ঐ দুটি ঐশ্বর্যের প্রসাদে অমর হয়ে রইল! ছেলেমেয়েদের বিয়ের বয়েসে বিয়ে না দিলে যে কি রকম্‌ বিয়ে-পাগলা হয়ে ওঠে “চিরকুমার সভা”র কুমার-কুমারীগুলি তারই প্রকৃষ্টতর উদাহরণ।

 বীরবল বা প্রমথ চৌধুরীর রচনা শিক্ষিত লোকেদের জন্য, ঠিক জনসাধারণের জন্য নয়। তাঁর গল্পরচনার ঢংও নূতনতর। “চার ইয়ারি কথা”র গল্পচতুষ্টয়ের নায়িকারা চারিজনেই বিদেশিনী। বিদেশিনী চরিত্রচিত্র আমরা বিদেশী সমাজেই দেখতে অভ্যস্ত, স্বদেশীয় নরের সংস্রবে বিদেশিনীকে আমরা একটু সন্দেহের চক্ষেই দেখে থাকি, রস গ্রহণে বাধা পড়ে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের অনেক ভাল গল্পেও আমরা এই অবস্থায় পড়েছি। অবশ্য তাই বলে বীরবলের সরস রচনায় “দিদিমার গল্প” বা “বীণাবাই” প্রভৃতির কথাও বাদ পড়েনি।

 প্রভাতকুমারের নারীচরিত্র অনেক এবং বহু বিচিত্রতাপূর্ণ। ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে অপূর্ব রসসৃষ্টিই তাঁর বঙ্গসাহিত্যে অমূল্য দান। ‘দেবী’ গল্পের কথা কোনদিন ভুলতে পারা যাবে না। ঘটনাচক্রে পড়ে স্বয়ং ভগবানকে যখন ভূত হ’তে হয়, তখন বেচারী একটি পল্লী-বধূর অদৃষ্টে শ্বশুরের স্বপ্ন-দর্শনের ফলে দেবীত্ব-প্রাপ্তি এ আর বিচিত্র কথা কি? এমন ব্যাপার নাকি আজও ঘটছে। তাঁর উপন্যাস বর্ণিত বহু নারী-চরিত্র নিয়ে আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, তবে শুধু একটিরই কথা বলবো। “সিঁদুর কৌটা”র বকুলাবলিকা বা বকুরাণী আদর্শহিসাবে হয়ত খুবই বড়, সতীনারীর মহত্ত্বও হয়ত তাঁর অক্ষুন্ন আছে, মনুষ্যত্ব কতখানি রইল বলতে পারি না। সূর্যমুখী স্বামীর বিয়ে দিয়ে সেই স্বামীর ঘরে ঘর করতে পারেন নি। স্বামী-দর্শনে এসে ধরা না পড়লে ফিরেই যেতেন। স্বামীর উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতিশোধে নিজের উচ্ছৃঙ্খলতা নিশ্চয়ই সতীধর্ম নয়; কিন্তু তা’তে প্রশ্রয়দানও তাঁর ধর্মবিধানের বহির্ভূত। পতিকে পাপ পথ থেকে নিবৃত্ত করাই সতীধর্ম, সেই পথ বাধামুক্ত করা আত্মত্যাগ হ’তে পারে; কিন্তু তাতে কর্ত্তব্যপালন হয় না, কর্তব্যের পথ ক্ষুরধার।

 রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে সবচেয়ে খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলিতে বহু নারীচিত্র উজ্জ্বলবর্ণে অঙ্কিত হয়েছে। তাঁর ভাষার জোর ছিল, নিজের জীবনের বিচিত্রতা ও নূতনতর অভিজ্ঞতা ছিল, প্রতিভার সঙ্গে সহৃদয়তার মিশ্রণে তিনি অনেকগুলি জীবন্ত নারীচরিত্র সৃষ্টি করে গেছেন। পল্লীর প্রতি সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে তিনি অনেক সময় পাপীকে প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং অপরিণতবুদ্ধি যুবকসমাজকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত করেছেন, এ কথা অস্বীকার করা যায় না।

 “কাশীনাথ” গল্পের কমলা সংসারে থাকতে পারে, ঐতিহাসিক ও বাস্তবচিত্রে পাওয়া যায়, সৌভাগ্যক্রমে সংসারে দেখিনি, তবে এরকম আসামীর কথা হয়ত শুনে থাকবো।

 “বড়দিদি”তে মাধবী-চরিত্র রহস্যাবৃত হলেও মানবীয় পরিচয়ের হিসাবে নিতান্ত অস্বাভাবিক বলা চলে না।

 শরৎচন্দ্র আদর্শবাদী, নিম্নশ্রেণীর জীবনযাত্রা এবং সমাজবহির্ভূতাদের কেবলমাত্র কুৎসিত দিকটাই নয়, তার ভাল দিকটাও দেখেছেন এবং এঁকেছেন। প্রত্যক্ষ এবং বাস্তব অনুভূতিই তাঁর লেখাকে সজীব এবং সবল করেছে। রবীন্দ্রনাথের মত তিনি রসের উর্দ্ধলোকে বিচরণ করতে পারেন নি; বিশ্বজগতের অনাদি অনন্তযুগের বড় বড় কথা কোথাও ভাবেন নি, সীমাকে অসীমে মেলাবার সাধনা বা সাধ্যও তাঁর ছিল না। নিজের সঙ্কীর্ণ সীমার মধ্যে নগরের এবং পল্লীসমাজের ভীরু স্বার্থান্ধ পৌরুষহীন পুরুষের পাপের এবং অত্যাচারের বোঝ বহন করে যেখানে নারী নিঃশব্দে অন্ধকারে প্রতিদিন লুটিয়ে পড়েছে, সেখানে শরৎচন্দ্রের অকৃত্রিম সহানুভূতি আলোকসম্পাত করে সমাজকে তার সম্বন্ধে সচেতন করে তুলে তাকে সাবধান করতে চেয়েছে। তাঁর লেখার ‘মটো’ (motto) হ’ল—

“যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই
মিলিলে মিলিতে পারে লুকানো রতন।”

 “পথনির্দেশ”-এর নায়িকা হেমের চরিত্রের বিশেষত্ব পরবর্তী ললিতা, ভারতী এমন কি কমলের মধ্যেও (ঘরকন্না করবার সময়) অল্পবিস্তর দেখতে পাই; এদেরই সর্বপ্রথম সংস্করণ ‘হেম’। এই বইয়ের কতকগুলি মন্তব্য সামাজিক অল্পশিক্ষিতা নারীর পক্ষে নিতান্ত ক্ষতিকর হয়েছিল বলে জানি।

 “চরিত্রহীন”-এর কিরণময়ীতে “নৌকাডুবি”র বিনোদিনীর ছাপ সুস্পষ্ট। “রোহিণী”র প্রেতাত্মা কিরণময়ীর পরেও বহুকাল ধরে বঙ্গসাহিত্যের ভাঙ্গা-মন্দিরের অন্তবর্তী পচা ডোবা এবং বাঁশঝাড়ের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছিল; এখন যেন একটু গা-ঢাকা হয়েছে, বুঝি কেউ বা গয়ায় পিণ্ডদানই করে থাকবেন। তাঁর অপূর্বসৃষ্ট “বিরাজ বৌ” পড়ে মনে হয়েছিল, অমৃতকুম্ভে এক ছিটে গোময় প্রদত্ত হয়েছে। বিরাজের গৃহত্যাগ তার চরিত্রের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খায় না। আত্মহত্যা বরং সম্ভবপর ছিল, ও-প্রকৃতির মেয়ে এ-রকম চিন্তা অতক্ষণ ধরে মনে পুষতে পারে না।

 “পণ্ডিতমশাই” উপন্যাসের ‘কুসুম’, ‘শৈলজা’, ‘নারায়ণী’, ‘মেজদিদি’, ‘বিন্দু’ এদের সমজাতীয়া। তেজস্বিতা ও স্নেহের রৌদ্র-ছায়ায় চরিত্রগুলি উজ্জ্বল ও সুমধুর। এঁদের সুসময় অথবা দুঃসময়ে দেবর, ভাসুরপো, জায়ের-সতাতো ভাই যে কোন বাড়ীর অথবা পরের ছেলে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরতে বাধে না; আবার রাগের মুখে এঁদের মাকে বা বড় জাকে কুকথা বলা, স্বামীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, ঝনাৎ ক’রে চাবির গোছা ফেলে দিয়ে পৃথক হওয়া, এ সব ব্যাপার একই ধরণের হলেও লেখকের রচনাশক্তির যাদু দণ্ড স্পর্শে অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়েছে। ঘরে ঘরে এদের দেখা আমরা নিয়তই পেয়ে থাকি বলে বারে বারে দেখেও অসঙ্গত মনে হয় না।

 “মেজদিদি”র মেজদি বিন্দু ও নারায়ণীর সমশ্রেণীর, একই মডেল, তবে “বিন্দুর ছেলে’’র বিন্দু-চরিত্রে ভাবাধিক্য কিছু অতিরিক্ত থাকলেও চরিত্রটী অনবদ্য।  “রামের সুমতি’’র নারায়ণী শরৎচন্দ্রের একটি অপূর্ব সৃষ্টি, কাল্পনিকতাশূন্য অতি সহজ পরিচিত অথচ বিশিষ্ট একটী রূপ আছে।

 ‘‘আঁধারে আলো”র আঁধার বড় সহসাই যেন কেটে গিয়েছিল; অস্বাভাবিক তবুও বলা যায় না। ‘‘বাস্‌নায় আগুন দেওয়া’’র কথা শুনেই লালাবাবু একদিন বৈরাগ্য অবলম্বন করেছিলেন।

 “পল্লীসমাজ”-এর জেঠাইমা বিশ্বেশ্বরীর চরিত্র “গোরা”র আনন্দময়ীর ছাঁচে গড়া হলেও সুন্দর। রমা, রমার মাসী, পল্লীসমাজের কলহপ্রিয়া নারীরা বাস্তবচিত্র।

 “শ্রীকান্ত”র অন্নদাদিদির চরিত্র বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ারই যোগ্য, শরৎ সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র!

 “বৈকুণ্ঠের উইল”-এর বিমাতা ভবানীর চরিত্র নারীচরিত্রের অত্যুচ্চ পরিণতি।

 ‘‘অরক্ষণীয়া’’র জ্ঞানদা অনেকটা “মহানিশা’র অপর্ণার স্বগোত্রা। নিজেকে কোনমতে পরের গলগ্রহ হয়ে থাকা থেকে মুক্ত করতে আত্ম-পীড়নের চরমে যেতেও প্রস্তুত। দুজনেরই অন্তরে প্রেমপাত্রের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে তীব্র অভিমানই তাদের আত্মত্যাগী করেছে।

 “নিষ্কৃতি”র সমস্ত চরিত্রই চমৎকার ফুটেছে। “গৃহদাহ”এর মৃণাল মেয়েটি আমাদের পূর্বপরিচিতাদেরই যমজা, তথাপি মরুভূমে ওয়েসিস। অচলা সাহিত্যে যাই হোক, সংসারে অচলা! “দত্তা’’র বিজয়া চরিত্রটি মনোরম।

 “দেনা পাওনা”, “বামুনের মেয়ে”, “নববিধান” এদের মধ্যে বিশেষত্ব এমন কিছু দেখা যায় না। “বামুনের মেয়ে”তে কৌলীন্য প্রথার পাপের চরম দুর্দ্দশায় মন শিউরে উঠে, বলে ওঠে “ভগবান রক্ষা করো!” এদেশে যতকিছু সামাজিক ক্ষতিকর বিধান হয়েছিল, তার মধ্যে এই বৈবাহিক কৌলীন্যপ্রথাকে প্রশ্রয় দান সব চেয়ে বেশী ক্ষতিকর হয়েছে।

 ‘চন্দ্রনাথ”-এর সরযু তার শান্ত মাধুর্যে আমাদের মনের উপর যথেষ্ট দাবী করে। পিতামাতার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত এমন ক’রে কত নিরীহ সন্তানকেই করতে হয়! প্রভাতকুমারের ঘোট গল্প “কাশীবাসিনী”তে কুলত্যাগিনী অপরিচিতা জননী, হঠাৎ মেয়ে-জামাইয়ের বাসায় এসে স্নেহ-বুভুক্ষা মিটাতে গিয়ে ‘চোর দায়ে পড়া’—বাস্তবিক চোখে জল আনে। পাপ এইজন্যই নরের চেয়ে নারীর পক্ষে সাঙ্ঘাতিক। মা অবনতির চরমে পৌঁছেও মায়ের প্রাণ হারায় না; আর সেইখানেই হয় তার ভীষণ প্রায়শ্চিত্ত!

 তাঁর নায়িকারা রন্ধনবিদ্যায় অতি পটীয়সী, অথচ নিজেরা সেকালের দিদিমায়েদের মত কৃচ্ছ ব্রতপরায়ণা নিরামিষাশী বা উপবাসী। এ রকম মেয়েদের দাম যুগে যুগে খুবই চড়া, সে যে কোন শ্রেণীর মধ্যেরই হোক, তাতে সন্দেহ কি! বিশেষতঃ এই বাজারে ত কথাই নেই। তবে কথা এই, হোটেল রেস্তোরাঁয় আধুনিক মেয়েদের নির্বিকার ভোজন-বিলাস দর্শনকারী পুরুষ পাঠকবর্গ এ বিষয়ে বিশ্বাস রাখতে পারলে হয়।

 তবে শরৎচন্দ্র এ বিষয়ে পূর্ববর্তীদেরই অনুসরণ করেছেন মাত্র, কোন মৌলিক গবেষণারই পরিচয় দিতে পারেন নি। ভোজন-বিলাসী বাঙ্গালী সর্বযুগেই রান্নাঘরের খবরদারীটা বজায় রেখেছেন, তা সে ‘চলে যেতে ঢলে পড়া’, “নবনীত-দেহা” শ্রীরাধিকাই হোন, নবীন কিশোরী খুল্লনা, নববধু জয়াবতী, ব্যাধপত্নী ফুল্লরা এ বিষয়ে কারুকেই সেখানে ঢুক্‌তে দিতে আপত্তি নেই। আপত্তি ছেড়ে বরঞ্চ সাগ্রহ সম্মতিই আছে। আর তাঁরাও পিয়ানোর দু’খানা গৎ শুনিয়ে না দিয়ে বা চায়ের টেবিলে ‘ক’ চামচ চিনি চায়ে দেব” প্রশ্নে প্রেমাস্পদকে পরম আপ্যায়িত না করে, সত্যকার হাত পুড়িয়ে, রীতিমত “পুরী, পুয়া, খাজা, সরভাজা”, (রাধিকা করেছিল) এবং ‘‘চিনি, ফেনি, কলা, মাখন রসালা, রেউড়ি কদম্ব-তিলা, অমৃত-কেলিকা আদি সে লড্ডুকা, স-ঘৃত মুদ্‌গ ঝুরি” ইত্যাদি তৈরি করেন।

 তাঁরা আবার সুধু জলখাবারের থালাটী সাজিয়েই নিশ্চিন্ত নন! “সুবাসিত অন্ন ব্যঞ্জন মনোহর, পাক করিল তাঁহ গোই।” আবার “ক্ষীর সর কলা চিনি, খণ্ড নবনী” এ সব ত হামেসাই জোগাচ্ছেন! খুল্লনা, ফুল্লরা দ্রৌপদী কে’ না রন্ধন-বিদ্যায় পটীয়সী? বাঙ্গালীর পঞ্চাশ ব্যঞ্জন, তিল পিটালীর পোরে ভাজা, শাক-শুক্তানি থেকে কলাবড়া, মুগ-সামুলি, পুলিপিঠা, ক্ষীরপুলি, পায়েস, মুগতক্তি, রসবড়া এ সবের এতটুকু ত্রুটি,—রাধা খুল্লনা ফুল্লরা রঞ্জাবতী পদ্মাবতীরা কেউই প্রিয়তমদের জন্য হ’তে দেন নি। পিরু-খানসামার তৈরি কেক, চপ, কাটলেট বা স্যাণ্ডউইচ প্যাটি দিয়ে হাত নেড়ে চুকিয়ে দেন নি। শরৎচন্দ্র ও দেশের মেয়েদের অতীত ও তখনকার বর্ত্তমানের এই সমস্ত চারিত্রিক দোষ বা গুণগুলি ভাল করে লক্ষ্য করেছিলেন এবং লক্ষ্য করে মনে মনে মুগ্ধ হয়েছিলেন তাই তাঁর সাহিত্যে নারী চরিত্রের এই বিশেষ দিকটুকু ফুটিয়ে তুলেছেন, কিন্তু তা’তেই কি অতীতকে ফেরাতে পারবেন?

 “পথের দাবী”র ভারতী আমাদের সেই পূর্বাপর বহু পরিচিতাদেরই একজন, শক্তিশালী রূপকারের হাতের গুণে নেহাৎ নেত্রপীড়াদায়ক হয়নি! সুমিত্রা-চরিত্রটী নূতন হলেও ভাষাশক্তির ইন্দ্রজালেই যেটুকু ফুটেছে, নইলে এমন কিছুই সার বস্তু তাতে নেই। “পথের দাবী”র আসল দাবী যেখানে সেই সব্যসাচী-চরিত্রই আমাদের আলোচনার বাইরে।

 “শেষ প্রশ্ন”র কমল, রূপসী দাসীর রূপসী অবৈধ কন্যা, ক্ষণিক মোহ এবং দেহের ধর্মকেই সব চেয়ে বড় আদর্শ বলে সে রক্তের গুণে মেনে নিয়েছিল; তাই আর্টিষ্ট শিবনাথ যখন তাকে ছেড়ে মনোরমাকে প্রেম-নিবেদন আরম্ভ করেছিল, তখন বিনা অভিযোগে মনোরমার বাগ্‌দত্ত স্বামী অজিতকে দয়া করে তার অসহায়তা দূর করতে গে’ল। মনোরমার গৃহত্যাগ আদর্শ চরিত্র আশুবাবুকে আঘাত দিল। কিন্তু ‘শেষপ্রশ্ন’ যা’ নিয়ে সেই অসংযমে এবং আদর্শবাদে তার সমাধান কিছুই হ’ল না,—অবশ্য অত সহজে হ’বার কথাও নয়। কমলের বাগ্মিতায় বিদ্বৎসমাজ স্তম্ভিত হয়ে রইল এবং তার ধৃষ্টতা দেখে আমরাও রইলাম! তার শেষনীতি তার মত মেয়েরই উপযুক্ত এ কথা আমরা সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করি।

 শরৎচন্দ্রের নারীচরিত্রে অনেক শ্রেণীর নারীকে আমরা একত্র দেখেছি, অনেক হীনতা এবং নীচতার মধ্যেও খুবই বড় বড় আদর্শের ছাপও সোনার মত উজ্জ্বল হয়ে আছে। তারা পুরুষকে নিয়ে বাঁদর নাচায় বটে, তবে পুরুষ সংযম হারালে তাকে মাঝে মাঝে চাবুক দিতেও যথেষ্ট চেষ্টা করে এবং নিজেরাও কৃতকার্যের জন্য কোথাও অনুশোচনা কোথাও অন্য রকমে প্রায়শ্চিত্ত গ্রহণ ক’রে থাকে, কিন্তু তাঁর পথানুসরণকারীদের মধ্যে অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, প্রবোধ সান্ন্যাল, এমন কি সুবিদ্বান ডাঃ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তর লেখাতেও সেকালের ভারতচন্দ্র প্রভৃতির মত আব্রু পরদার একান্ত অভাব ছিল, যেটা এই বিংশ শতাব্দীর রুচির সঙ্গে খাপ খায়নি। শেষোক্ত লেখকের “মেঘনাদ”-এর “মনোরমা” এ বিষয়ে চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। ‘‘শুভা’’ও বড় কম যায় না। আদর্শ চরিত্র মেঘনাদকে মনোরমা কি ক’রে ক্রমে আদর্শভ্রষ্ট করল তার চিত্র এঁকে লেখক মানুষের অপরাধ-প্রবণতার জয়গান গেয়েছেন এবং ফৌজদারী আদালতের নোংরামি ভদ্র-সাহিত্যে টেনে এনেছেন অথচ তা’ থেকে কোন আশার কথা শোনাতে পারেন নি। ‘শুভা’, ‘শাস্তি’, ‘রক্তের ঋণ’ প্রভৃতি প্রথম দিকের রচনায় আমরা তাঁর কাছ থেকে যেমন আঘাত পেয়েছি, তাঁর পরবর্তী রচনার মধ্য দিয়ে সেই মর্মাঘাত আমাদের মন থেকে সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়ে গভীর কৃতজ্ঞতার সঞ্চারও করেছে। “রাজগী”র সাবিত্রী চরিত্রে আমরা প্রথম চকিত বিস্ময়ে তাঁর আধুনিক যুগের নব সাবিত্রীকে দর্শন করি। তারপর কত সতী, কত সাবিত্রী, কত মদালসা, কত উভয় ভারতীর সঙ্গে পরিচয়ে আসবার সুযোগে আসা গেল! “সতী” উপন্যাসের সুরমা, “তৃপ্তি”র মিনতি, “অভয়ের বিয়ে” এবং “তারপর”-এর সরমা, “রবীন মাষ্টার” “বংশধর”, “শেষ পথ”, “পাগল”-এর নারায়ণী, “মিলন-পূর্ণিমা” প্রভৃতি বহু বিভিন্ন উপন্যাসে প্রত্যেকটী বিভিন্ন নারী চরিত্র সৃষ্টি করে লেখক তাঁর সৃষ্টিতত্ত্বজ্ঞানের পরিচয় প্রদান করেছেন।

 চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘‘স্রোতের ফুল”, “হেরফের”, “দোটানা”, “মুক্তিস্নান”, “চোরকাঁটা”, “পঙ্কতিলক”, “ধোঁকার টাটি”, “হাইফেন” প্রভৃতি বহু উপন্যাসে বিভিন্ন চরিত্রের নারীদের সাক্ষাৎ পেয়েছি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের অন্তঃপুরের চিত্র ভালই ফুটেছে, উন্নত চরিত্র সৃষ্টির একান্ত অভাব। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের শতাধিক গল্প উপন্যাস নাটকের কয়জনের কথাই বা বলা যায়। তাঁর প্রথম যুগের ছোট গল্পগুলিতে ছোট ছোট যুঁই কুঁড়ির অভাব ছিল না। ‘‘কাজরী”তে একটি তরুণী মেয়ের মনঃস্তত্ত্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে লেখকের সূক্ষ্ম দর্শনের প্রশংসা করতেই হয়। “আঁধি”, “স্ত্রীবুদ্ধি”, “নির্ঝর” প্রভৃতিতেও কয়েকটি সুন্দর চরিত্র দেখেছি। তদ্ভিন্ন তাঁর অসংখ্য উপন্যাসের বহু শত নারী ভালয় মন্দয় সংসারচক্রের আবর্তনে আবর্তিত হচ্ছেন।

 উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের “রাজপথ” উপন্যাসে স্বদেশসেবকের গুণমুগ্ধা ধনীকন্যা সুনীতির পরিবর্তন এ যুগের পক্ষে সঙ্গত আদর্শ। বাস্তব জগতে এ ধরণের ঘটনা ঘটতে দেখাও যায়। “অস্তরাগ” উপন্যাসে বর্ণিত অস্বাভাবিক নারী-চিত্তবৃত্তিকে প্রশংসা করা যায় না; ঠিক স্বাভাবিক মনেও হয় না। “শশীনাথে’’র লীলা বলিষ্ঠ নারী চরিত্রের দ্যোতক, যাকে অবলা বলে কৃপা করা হয়, তা’ নয়। “অভিজ্ঞানে’’র সন্ধ্যাকে আমরা কিছুতেই ক্ষমা করতে পারিনি। দুর্বল স্বামীর দুর্বলতার বা অক্ষম স্বামীর অক্ষমতার পরিশোধে যে নারী তার প্রতি হিংস্র প্রতিশোধ গ্রহণ করতে আত্মবিক্রয় করে, সে যে কোন সমাজেরই আদর্শ নারী নয় বহু উচ্চাঙ্গের কলা-বিন্যাসেও তার সে ঘৃণ্য আদর্শ ঢাকা পড়ে না। তবে ঐ উপন্যাসের সিনেমা-চিত্রে বিনা অপরাধে অপরাধিনী দুর্বলচিত্ত পতির ঐ অভাগিনী পত্নীর যে পরিণাম প্রদর্শন করা হয়েছে, আমরা তাকেই সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি। আজ নারী, বিশেষতঃ “সন্ধ্যা”র মত মেয়ে যা’রা, তা’রা কিছুতেই অবলা বা অসহায়া নয়। দেশের, দশের, ধর্মের, সমাজের সেবার জন্য তাদের প্রায় সমস্ত দরজাই চৌচাপটে খোলা। এ কাহিনীর প্লট অন্ততঃ ষাট সত্তর বৎসর পূর্বেকার হ’লে অসহায়া অবলার নিরুপায়ত্ব বরং বিশ্বাসযোগ্য হ’ত, আর তা’ হ’লেও সেদিনেও নৌকাডুবির কমলা, “ইন্দিরা”র ইন্দিরা অনেকেই আত্মরক্ষার সাধারণ উপায় অবলম্বন করে অসাধারণ ফল লাভ করেছিলেন। “চোরের উপর রাগ করে ভুঁয়ে ভাত খাওয়া’’র দৃষ্টান্তই সন্ধ্যার অধঃপতনের মূল কারণ।

 পরশুরামের (রাজশেখর বসু) “গড্ডলিকা’’, ‘কজ্জলী”, ‘হনুমানের স্বপ্ন’’ বিচিত্র রস-সরস। পৌরাণিকা ও আধুনিকা নারীকে তিনি অতি পরিচিতাদের মধ্য থেকেই নির্বাচন করেছেন, অথচ অতি পরিচয়ের ভারাক্রান্ত করেন নি। ওরা ঈষৎ আড়াল দিয়েই চলে গেছে, আমরা তাদের সাড়ীর আঁচলা, চাবীর শব্দ, চুড়ির রিনিঝিনি থেকেই তাদের অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছি; মায় “কচি সংসদ”-গল্পের গৃহিণীর সদ্য-কেনা হীরের ব্রোচের ঝিলিকটাও আমাদের চোখের মণিতে ঠিকরে পড়েছে। বুঁচকীর ঘাড় বেঁকিয়ে “য্যাঃ” বলা,—যার মানে “হ্যাঁ”,—সে ব্যাখ্যা আমরাও মেনে নিয়েছি। “দেড়হাতি বাঁদীপোতার গামছা”পরা, “পাকা লঙ্কার মত ওষ্ঠাধরা”, “ভুট্টার কচিদানার মত দন্তবিশিষ্টা”, “জ্বলন্ত একটি হাউইয়ের কাঠি”র সহিত উপমেয়া “জোয়ান জিলটার”কে বিচিত্র সাড়ীপরা অবস্থায় আমরা আজকাল প্রায়ই পথে ও ঘরে দেখতে পাই; তাই ঐ বিদেশিনী মেয়েটীকে খেতে শুতে উঠতে বসতে মনে না পড়ে উপায় নেই।

 কলকাতা সহরের রাজপথ-বিচারিণী আমাদেরই ঘরের কন্যা বধূদের নিরাবরণ মাথার চুলের সিঁথিতে সিঁদুর রেখা খুঁজে না পেয়ে অধর এবং ওষ্ঠের প্রতি দৃষ্টি সন্নিবিষ্ট করি এবং স্বতঃই পরশুরামের কথা স্মরণে ভাসে, “মা, তোমার ঠোঁটের সিঁদুর অক্ষয় হোক!”

 “বনফুলের” ‘জঙ্গমের’ “ভীমজাল” ছাড়িয়ে বহু উজ্জ্বল নারীচিত্র আমাদের চোখে ভাসে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিবৈচিত্র্যের মতই সে সব সৃষ্টিও একান্ত স্বভাবগত এবং জীবন্ত। বেলা, বিনি, হাসি, উমা, সুরমা, হীনচরিত্রের উপর রঙ্গীণ ঢাকনা ঢাকা “মিষ্টি” ও “সোনা” সোহাগ গলান নামের “দিদি”রা, আর সব চেয়ে চিত্তাকর্ষণ করে অথচ একেবারেই ঘরোয়া মানুষটী সাহিত্য-সংসারে নবপ্রতিষ্ঠিত মূর্তি ভণ্টুর বৌদিদি এবং তারও চেয়ে সেই অভাগিনী রহস্যময়ী পানওয়ালী। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থবর্ণিত সকল চরিত্রেই একটা বৈশিষ্ট্যের ছাপ আছে, পৌনঃপৌনিক এক ঘেয়েমী,—যার জন্য অনেক মস্ত বড় লেখকের লেখাও বেশীক্ষণ সহ্য করা যায় না, সে জিনিসটা নেই। তাই “স্থাবর” বা “জঙ্গম” হলেও নেহাৎ অসহ্য হয় না। নারী চরিত্র সমালোচনার প্রবন্ধে অসঙ্গত না হলে একটী কথা এখানে বলি “জঙ্গম” শেষদিকে আর দেড়শো পাতার কমে কলেবর নিলেই ভাল করতো।

 সজনীকান্ত দাসের হাতের চাবুকটাতেই তাঁর সাহিত্যসাধনার সাফল্য। তাঁর স্ব-নামে রচিত গল্প বেশী পড়িনি, পড়েছি কবিতা এবং সমালোচনা এবং তাঁর সাহিত্যজগতের দাম তাতেই। “বনফুলে’’র সঙ্গে এখানে আমরা সকলেই হয়ত একমত,—“কুখ্যাতি করে যে যশ লভেছ, সুখ্যাতি করে হারাবে হে।” ‘মাতৃজাতি’কে তিনি অবশ্য যথেষ্ট খাতির করেই চলেন, নেহাৎ নিরুপায় না হ’লে চোখ ফিরিয়েই রাখেন, তবে “কমরেডের” ও “মায়ের” দাবী একসঙ্গে শোধ করা যায় না; তাই বেত্রাঘাত না করেও ঈষৎ বক্রোক্তির কঠোরতর আঘাত কালে ভদ্রে কখন করে থাকেন, পাত্রবিশেষে সেটা কার্যকরীও হ’য়ে থাকে। এ দেশে আজও মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে সৌজন্যে বাধে, বহু সহস্র বৎসরের কুসংস্কারের ফল কি না?[২৭] খুব সময়োচিত বলে তাঁর অজস্র ব্যঙ্গ-কবিতার মধ্য থেকে নারী সম্পর্ক শূন্য হলেও একছত্র মাত্র উদ্ধৃত করছি;—

“পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,  লিজ লেণ্ডের চলে কারবার
দিবে আর নিবে, চেনাবে চিনিবে, যাবে না ফিরে।”

 অপর একজন হাস্যরস সরস ঔপন্যাসিক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যয়েের “আই হ্যাজ”-এর ইরানী ও ইমানী বোন দু’টি নীরবালা নৃপবালাদের মতই কৌমারব্রতের সংহারিকা। সবচেয়ে মর্ম স্পর্শ করে পরিণত-যৌবনা রায়গৃহিণীর একান্ত অভাবনীয়ভাবে সম্মুখীন সপত্নী-বিভীষিকা। তাঁর রচনায় নারী চরিত্র একটু ঝাপ্‌সা, পুরুষচিত্রই জ্বল্‌জ্বলে।

 অন্নদাশঙ্কর রায়ের বহু রচনায় স্বদেশিনী ও বিদেশিনী অনেক নারীর পরিচয় পাওয়া যায়; অত্যাধুনিক যাদের বলা হয় তাদেরও এবং বেশ একটু সেকেলে বলে যাদের পরিচয় আছে তাদেরও। মিষ্টি লেগেছিল “সত্যাসত্য”র উজ্জয়িনীকে, তার সমস্ত খেয়ালখুসী দোষগুণসমেত। তা’বলে পরবর্তিনী উজ্জয়িনীকে এ প্রশংসা দেওয়া যায় না। পাশের বাড়ীর সর্বসুখী সুশান্ত বউটি যে স্বামী শ্বাশুড়ী নিয়ে প্রশান্ত জীবনকে উপভোগ করছিল, তার কথা মন থেকে মুছে যায়নি। আর বিদেশিনী ল্যাণ্ডলেডী মায়ের মত স্নেহশীল, যে বর্ণবিদ্বেষে নারীত্ব হারায়নি সে-ও আমাদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছে। নব্যা নারীদের উচ্ছল ও উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রগুলিকে অস্বাভাবিক বলি কি করে?—“যথা দৃষ্টং তথা লিখিতং।”

 দিলীপকুমার রায়ের কল্পিতাদের সঙ্গে সত্যকার রক্তমাংসের যে সকল নারী তাঁর লেখায় গ্রথিত হয়ে রইলেন, তাঁদের ছবিই যেন বেশী ফুটেছে। সেই অকালবর্ষার ঘনায়মান্‌ বাদলনিশীথে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া কলকণ্ঠীকোকিলা “উমা” বা হাসি, তার মা, তাঁর দেশবিদেশের “দিদি”দের রূপ-মূর্তি আমাদের সঙ্গে পরিচয় জমিয়ে নিয়েছে। তাঁর ঔপন্যাসিক নারীরা অতি সাধারণ।

 দুর্ভাগা ভারতের দুঃখময় যুগান্তের তরুণ অরুণের “তরুণের স্বপ্ন” শুধু তরুণেরই স্বপ্ন হয়ে নিশ্চয়ই থাকবে না; তরুণীদের তরুণ চিত্তকেও ভারতের অদ্বিতীয় তরুণ-বীরের জীমূত-মন্দ্রের আহ্বান দুঃস্বপ্নঘোর কাটিয়ে দিয়ে জীবন-আহবে ঝাঁপ দে’বার জন্য নিশ্চয়ই উদ্বুদ্ধ করে তুলবে,—তা’ সুভাষচন্দ্রের ‘‘তরুণের স্বপ্ন।” তাঁর সে-স্বপ্ন তিনি সফল করে তুলে ‘স্বাধীন ভারতে’ নারীর যুগযুগান্তে হারিয়ে ফেলা স্থানকে পুনরুদ্ধার করে দিয়েও ছিলেন, সেটা নিছক ‘স্বপ্ন’ই নয়;−আশ্চর্য সত্য!!!

 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরপথের পাঁচালী”র অপুর দিদি দুর্গা মেয়েটী আমাদের চোখের জলে স্নাত হয়েছে। অতিবৃদ্ধা ইন্দির ঠাকুরাণীর চরিত্র থেকে আমরা শতাব্দীপূর্বের একটি বৃদ্ধাকে তার কতকগুলি স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে দেখতে পাই; পরিণামটুকুও মর্মভেদী। চিরভাগ্যবিড়ম্বিতা সর্বজয়ার জন্য সহানুভূতিতে মন বেদনায় টনটন করে। “আরণ্যক’’ নূতনত্বে ভরপূর। “দৃষ্টিপ্রদীপে”র দৃষ্টিগুলিও অতি সুন্দর। এঁর সাহিত্যিক নারী সহজ বাস্তবতায় বাংলাসাহিত্যের গৌরবের বস্তু। “দেবযান” এবং তার “পুষ্প” মানুষকে দেবযানেই তুলে নেয়, তা’ যতটুকুর জন্যই হোক!

 তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু উপন্যাসের বিভিন্ন নারীচরিত্রের দীর্ঘ আলোচনা বর্তমান ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সম্ভব নয়। কিন্তু এ কথা আজ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলার তথাকথিত প্রগতি সাহিত্যের ধারা তারাশঙ্কর “বনফুল,” বিভূতি মুখোপাধ্যায়, বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু প্রমুখ নবীন সাহিত্যিকের প্রবল বন্যার মুখে বাঁধ বেঁধে দিয়ে প্রায় বন্ধ করে এনেছেন। তারাশঙ্কর একজন সত্যকার শক্তিমান লেখক। ইতিমধ্যেই তিনি বঙ্গসাহিত্যকে অজস্র মূল্যবান অলঙ্কারে বিভূষিত করেছেন। “কালিন্দী” ও “ধাত্রীদেবতা’’র মা, জ্যোতির্ময়ী পিসিমা, শৈলজা, রায়গৃহিণী, হেমাঙ্গিনী, সুনীতি, উমা, “গণদেবতা”র সন্তান ক্ষুধাতুর কামার-বৌ পদ্ম, উচ্চ হৃদয়বতী চরিত্রহীনা চাঁড়ালের মেয়ে দুর্গা, মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতের পৌত্রবধু জয়া নারীমর্যাদায় ও বিশিষ্টতায় কে’ই বা তুচ্ছ! ‘রাইকমল” “প্রতিমা,” “অগ্রদানী,” “পিতাপুত্র,” ‘মন্বন্তর, “বিংশ শতাব্দী” প্রত্যেক বইখানিতেই বর্তমান বাংলা তার সমস্ত সুখদুঃখ, শান্তি অশান্তি অভাব অভিযোগ সমেত যেন প্রতিকারপ্রার্থী হয়ে বাঙ্গালীর সামনে মূর্তি পরিগ্রহ করে এসে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের ভুলভ্রান্তি তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র হলেও তা’ থেকে কি না হ’তে পারে—উজ্জ্বল আলোকসম্পাতে তা সকলকার সামনেই সুস্পষ্টরূপে প্রকট হয়ে উঠেছে। আধুনিক বাংলার গলদ কোথায় এবং তা’ দুর করবার প্রচেষ্টা কি, ইনি সেইটী প্রাণস্পর্শী চিত্রে অঙ্কিত করে সকলকার সামনে ধরে পথপ্রদর্শকের কাজও করেছেন। নিছক রসসৃষ্টিতেই সব কর্তব্য সমাধা করেন নি।

 বিভূতি মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্পগুলি সুরুচিপূর্ণ বলে “নীতিপাঠ”[২৮] বা চাণক্যনীতি-জাতীয় এমন কথা কেউ বলবে না। সুখপাঠ্য হাস্যরসসিক্ত এবং সজীব। “ছোট্ট রাণুর’’ আদর-আব্দার আমাদের মনকে পরিষিক্ত করে রাখে। তাঁর উপন্যাস “নীলাঙ্গুরীয়” পড়ে আমরা সে তৃপ্তি পাইনি যা’ তাঁর গল্পগুলিতে পেয়ে এসেছি। “মীরা” অনাবশ্যকে “শেষের কবিতা’’র লাবণ্যর পথ গ্রহণ করলে এবং “নীলাঙ্গুরীয়” পাঠিয়ে দিয়ে দরিদ্র প্রেমিককে অপমানের উপর চরম অপমান করলে। ভাল বলতে পারি না এ পথকে।

 শক্তিমান লেখকদের একটি বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিত। সুন্দর হলেও একই চরিত্রের পৌনঃপৌনিকতায় প্রথম সৃষ্টির মর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়। নবনব চরিত্রসৃষ্টির গৌরব থেকেও লেখক বঞ্চিত হন। কলাবিদরা এ দিকে দৃষ্টি রাখলেই দৃষ্টিপ্রদীপের আলোয় নিজেরাই ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি দেখতে পাবেন।

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বহুসংখ্যক উপন্যাসে চিত্রিতা অনেক নারীচিত্রই আমাদের ভাল লেগেছে। ভালকে তো ভাল লাগেই, কিন্তু মন্দের মধ্যে যারা ভাল, তাদের ভাল দিকটাকে দেখিয়ে তাদের পরে মায়া জন্মে দেওয়ার যে প্রয়োজনীয়তা আছে, ইনি সে বিষয়ে ভাষার সংযম দিয়ে নৈপুণ্যের সঙ্গে তবু কতকটা লক্ষ্য রেখেছেন। শরৎচন্দ্রের সাবিত্রী, চন্দ্রমুখী, বিজলী, বৌদ্ধযুগের আম্রপালি, বসন্তসেনা, বাইবেলের মেরী ম্যাগডালেন এদের সমজাতীয়াদের আমরা নিশ্চয়ই মায়া করে থাকি, জগতের একজন মহাপুরুষই ত’ এ বিষয়ে আমাদের উপদেশ দিয়েছেন,—“পাপকে ঘৃণা করবে, কিন্তু পাপীকে নয়।”

 রামপদ মুখোপাধ্যায়ের “শাশ্বত পিপাসা” হাসিকান্নার মলয়-শিশিরে সিক্ত ছবিটী বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সংসারের প্রস্ফুট চিত্র।

 জলধর চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত নাটক “রীতিমত নাটক”-এর অধ্যাপকের আদর্শচরিত্রা শিক্ষিতা বোনটী অত্যাধুনিকতার অসংযম যা’ মধ্যে মধ্যে সংসারেও দেখা যায় তাই-ই। পত্নীর চরিত্রটী সুসংযত ও সুসঙ্গত। নাট্যজগতে চরিত্রসৃষ্টিতে শান্তাচরিত্র একান্ত একঘেয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে;—অবশ্য সমাজেও;—এবং তার কারণও যথেষ্ট রয়েছে, প্রতিবিধান নিরপেক্ষ!

 প্রবোধকুমার সান্ন্যালের পরবর্তী রচনায় যুগোচিত ভাব ও ভাষার সংযম লক্ষণীয়।…‘বৌদি’ চরিত্রটী বঙ্গসাহিত্যে নূতন দান। দেশের কাজে যে সব বাস্তবনারীরা যোগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও খাঁটি সোনা ও মেকি আধলা দু’একটা মিশে মিলে আছে। বৃহৎকাণ্ডে এ রকম হয়েই থাকে, তার মধ্য থেকে যতটুকু কাজ চলে যায় ততটুকুই লাভ। দুর্ভিক্ষের ভিখারী ভিক্ষা পাওয়া ধনকে বাজিয়ে নিতে ভরসা পায় না।

 মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পুতুল নাচের ইতিকথা”য় নারীচরিত্রে বৈশিষ্ট্য আছে। ভালয় মন্দয় তারা সাধারণদৃষ্টাদের মতই, কেহ কেহ অদৃষ্টপূর্ব।

 প্রমথনাথ বিশির “জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার”-এর নারীচিত্রে করুণ আকর্ষণ করে।

 ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের একটী ক্রমশঃ প্রকাশ্য উপন্যাসের নায়িকা “মন্ত্রশক্তি”র বাণীর অতি বিকৃত কঙ্কালমূর্তি! নারী’র মধ্যে;—“নার্যা পিশাচ্যা” নেই, তা’ কে বলতে পারে, তবে যিনি আদর্শপুরুষ তিনি তেমন নারীর পিছনে পোষা বিড়ালের মত ঘুরতে যান না। যারা যায়, তা’রা নর নয়, বা-নর।

 নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস “উপনিবেশ” বাংলায় নূতন ধরণের হ’লেও বর্ণিত নারীচরিত্রে বলবার মত বৈশিষ্ট্য কিছু নেই। নানা জাতির ও নানা শ্রেণীর পুরুষচরিত্রের বৈশিষ্ট্যই কৌতুহলপ্রদ।

 বিধায়ক ভট্টাচার্য নাট্যজগতে, বিশেষতঃ ছাত্রমহলে, পরিচয়স্থাপন করেছেন। ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে স্বল্পবসর অভিনয়ের দিনে সত্যকার নাট্যকলার স্থান কোথায়? এ-কথা আধুনিক অন্যান্য নাট্যকারগণের রচনা সম্বন্ধে সমভাবেই প্রযোজ্য।

 জ্যোতির্ময় রায়ের “উদয়ের পথে”র দু’টি নারীচরিত্র দুই আদর্শের, কিন্তু দেখা গেল যে বাইরের খোলসটাই মানুষের আসল মূর্তি নয়, পারিপার্শ্বিকতার দ্বারা সেটা বিচিত্রিত হয়, ভিতরের বস্তু একই।

 পৃথ্বীশচন্দ্র ভট্টাচার্যের রচনায় মৌলিকতা আছে; বিংশশতাব্দীর নারীকে নিরপেক্ষভাবেই দেখাবার চেষ্টা করেছেন তাঁর “পথ ও পাথেয়” উপন্যাসে, উপন্যাসকারগণ এখন উপন্যাসের অযথা কলেবর বৃদ্ধির জন্য কি প্রতিযোগিতায় নেমেছেন?

 বাংল্যসাহিত্যে সৃষ্টি করা নারীচরিত্র নিয়ে যদি আলোচনা করা যায় তবে কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতের চেয়েও বড় এক গ্রন্থ হয়ে উঠে। যে দেশে হাতে হাতিয়ারে কিছু করবার নেই,[২৯] সে দেশে হাতে কলমে কল্পনাবিলাস না করে লোকে করে কি? সব লেখক লেখিকার নাম দেওয়া সম্ভব নয়; তাঁদের সৃষ্টির আদ্যন্ত পরিচয় দেওয়া আরও কঠিন। অনেক নূতন লেখক ও লেখিকা উদীয়মান হচ্ছেন। তাঁদের রচনা পদ্ধতিতে বৈদেশিক-আধুনিকতা থাকলেও[৩০] একটা নূতনতর রূপও দেখা দিয়েছে। রুচিপ্রবৃত্তির মধ্যেও রকমফের যথেষ্ট হয়েছে। এক একজন সাহসিকতার সহিত সংমিশ্রিত শক্তির পরিচয় অল্পদিন মধ্যেই দিতে পেরেছেন। মনোজ বসু তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর ‘সৈনিক’ বইখানি ১৯৪১ হইতে ১৯৪৪ অব্দের অতি পরিচিত ঘটনাবলীর একটি মনোজ্ঞ ছায়াছবি;—যা আমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলুম ও করছি, যার বিভীষিকা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমরা তাঁর ‘পান্নালালে’র মতই পালিয়ে বেড়াবার এবং দ্বারিকের মত পাগল হ’বার জোগাড় হয়েছি অথচ যা থেকে চোখ বা মন ফিরিয়ে নেওয়া অন্যায় বলেও বিবেকের কাছে লাঞ্ছিত হ’চ্ছি,—সেই তাকেই তিনি এইখানে অমর করে রেখেছেন। “উমা”, “সুপ্রিয়া, “যামিনী” এ-যুগের মেয়ে এবং সত্যই তারা যুগোচিত। অসহায় পুরুষের পাশে ততোধিক অসহায়া নারী, কতটুকু তাদের শক্তি, তথাপি তারা অনেকেই যথাসাধ্য করতে চেষ্টা করেছিল; ঘরের কোণের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বিপদের অংশ নিতে, দেশের কাজ করতে যেমন একদিন মেয়েরা সত্যাগ্রহ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার চেয়েও নৃশংস এই মারণযজ্ঞের উৎসর্গিত বলিদের জন্য সুখবিলাস ছেড়ে “সুপ্রিয়া”-দের কেউ কেউ বাহিরে বেরিয়ে এসেছিলেন। এই ধরণের নারীচিত্র আমরা আরও কোন কোন নূতন লেখকের লেখায় দেখেছি। বিপদের সম্ভাবনায় ভীত না হয়ে বাস্তব নারীদের মধ্যে কেহ কেহ যেমন দেশপ্রেমিক নেতাকে আশ্রয় দিতে পশ্চাৎপদ হননি, এঁরা তাঁদেরই চিত্র আঁকবার সুযোগ পেয়েছেন এবং তা গ্রহণ করেছেন। অতীত যুগের সাবিত্রীর মত যমভয় বিমুক্তচিত্তা কত মহীয়সী নারীও এই স্বার্থভরা হিংসাদ্বেষজর্জরিত বর্ত্তমান যুগেও সৃষ্ট হচ্ছেন, তা’ কি বিধাতার হাতে, কি মানুষের কলমের ডগায়। মহৎ আদর্শের একটা মস্ত বড় দোষ বা গুণ এই যে,—সে কালজয়ী কোন দিনই তার বিনাশ নেই, মারতে চাইলেও সে মরে না!

 এতক্ষণ পুরুষের রচনায় নারীচরিত্রের কথাই বলা হয়েছে। আবহমান কাল থেকে অসংখ্য নর লেখক নারীচিত্রকে কোন চোখে দেখে কি ভাবে তাদের চিত্রণ করেছেন, সেই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে গিয়ে আমরা দেখতে পেলুম, তাঁরা অত্যন্ত শুচিশুদ্ধ চিত্তে একান্ত শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টিতেই তাঁদের দেখেছেন এবং অত্যন্ত সাবধানতান্যস্ত চারু তুলিকাপাতে সেই মাতৃমূর্তি, কন্যা-প্রতিমা এবং প্রিয়ারূপ অঙ্কিত করেছেন। যাকে যেমন মান ও সম্মান দেওয়া উচিত তার কোন ত্রুটিই তাঁরা করেননি এবং তাঁদের চিত্রফলকে এঁদের কোনভাবই অপ্রতিবিম্বিত থাকতে পায়নি। বিদ্যা এবং অবিদ্যা নারীর শাস্ত্রীয় দু’টি রূপই তাঁদের চিত্তস্পর্শ করেছিল এবং অশুচিচিত্তা অনভিপ্রেত নারীকেও সত্যের খাতিরে তাঁদের সৃষ্টির বহির্ভূতা রাখা সম্ভব হয়নি। এর জন্য তাঁদের দায়ী কর্বার কিছুই নেই; কারণ সংসারে ভালমন্দ দুইই আছে, কেবল ভাল বা নিছক মন্দ নিয়ে সংসারচিত্র আঁকা যায় না তবে কথা এই, পাপের পঙ্কিল নগ্ন রূপকে দেখাতে গেলে সুদক্ষ শিল্পীর সাবধান হস্তের প্রয়োজন।

 অতঃপর সাহিত্যের মধ্য দিয়ে নারী তাঁদের নিজ প্রতিবিম্বকে কোন্ রূপে দেখতে সমর্থ হয়েছেন তারই একটি ক্ষুদ্র সংক্ষিপ্ত পরিচয়-রেখা আমরা টেনে দিচ্ছি। নারীর রচনায় এ পর্যন্ত কোন নারীচরিত্র নর রচিত নারী চরিত্রকে পরাভব করে বিশিষ্টরূপ পরিগ্রহ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না, পারাও অবশ্য কঠিন! তাঁরা যাদের ভালয় মন্দয় সৃষ্টি করেছেন, (পৃথিবীর সাহিত্য ঘেঁটেও) হয়ত তার বাইরে নূতন সৃষ্টির পথ পড়ে নেই। ইদানীং যদি বা কোন নূতন ভাব দেখা যায়, অনুসন্ধিৎসু চিনতে পারবেন বৈদেশিক কোন পুরুষ লেখকেরই তা’ অনুকৃতি। অবশ্য পুরাকালের কাছে নবীনকালকে চিরকালই ধারে মাল কিনতে হবে; তা’ কি নর আর কি নারী।

নারীর সাহিত্যসৃষ্টির কথা বলতে গেলে প্রথমতঃ শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবীর নাম করা প্রয়োজন। ‘দীপনির্বাণ’, “ছি মুকুল”, “মিবাররাজ”, “বিদ্রোহ”, “হুগলীর ইমাম বাড়ী”, “কাহাকে” প্রভৃতি তাঁর বহু উপন্যাসে নারীচরিত্রে নূতনত্ব খুব বেশী নেই। “ইমামবাড়ী”র “মুন্না” এবং “বিদ্রোহ”-এর “সেবন্তী” তথাপি বেশ জীবন্ত। তাঁর রচনার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ “স্নেহলতা”; যদি বলা যায় যে আধুনিক বাংলাসাহিত্যে ঐ নারীরচিত উপন্যাসটীই সত্যকার ঘরোয়া চিত্রের নূতন একটা ধারা দেখিয়েছে তবে খুব অন্যায় দাবী করা হয় না। “স্নেহলতা”র পূর্ববর্তী উপন্যাস-সাহিত্য প্রায়শঃই ঐতিহাসিক ভিত্তিতে অথবা বিশিষ্ট ধনী পরিবারের আকস্মিক বিশিষ্ট ঘটনাসম্পাতের মধ্যবর্তী হয়ে জাত হয়েছিল। ঘরকরণার খুঁটিনাটির ব্যাপারও অপূর্ব সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির বাইরেও হিন্দু গৃহস্থঘরের মানুষদের নিয়ে যে রীতিমত রোমান্সের সৃষ্টি করা চলে এ-দৃষ্টান্ত[৩১] “স্নেহলতা”ই সর্বপ্রথম বঙ্গসাহিত্যসেবীদের জানিয়েছে। অবশ্য বঙ্গসাহিত্যের আলোচনা করতে বসে কেউ এ সত্য এ পর্যন্ত স্বীকার করেননি। মেয়েদের সম্বন্ধে একটা নির্বিকারচিত্ততা এবং অজ্ঞতার ভান পূর্বাপরই দেখা যায়,[৩২] অবশ্য প্রথমকার দিকে উচ্ছ্বাসবাহুল্য একটু যে না ছিল, তা’ নয়।

 স্বর্ণকুমারী দেবীর বহু গল্প উপন্যাসের নায়িকাদের মধ্যে খুব বেশী বৈশিষ্ট্য না থাকলেও ‘‘স্নেহলতা”র ‘গৃহিণী’, ‘টগর’, ‘‘জীবনের মা” এবং রেখাচিত্র “ছোট বউ’’ এতেও একটি একটি জীবন্তমূর্তি প্রস্ফুট হয়ে উঠেছে। তাঁর “কাহাকে’’ বাংলাভাষায় সর্বপ্রথম ইঙ্গবঙ্গসমাজ নিয়ে গল্প ও উপন্যাস রচনার পথ খুলে দেয়। আজ অবশ্য সে-পথে যাত্রীর অভাব নেই, কিন্তু পথপ্রদর্শনের সম্মাননা যথাস্থানে দিতে কুষ্ঠিত হওয়া অসঙ্গত।

 স্বর্ণকুমারী দেবীর কবিতা গাথা “খড়্গপরিণয়ের” “অলকা’’র প্রাপ্ত পত্রখানি তখনকার বাংলাসাহিত্যে কাব্যলিপিকার প্রবর্তক বলা চলে; তার বহু অনুলিপি হয়েছিল। একটু নমুনা দিচ্ছি;—

−“গত নিশি স্বপনে, মরমের বিজনে,
মরি কি তোমার রূপ হেরেছিনু অলকে,
সেই ছটা মহিমা, সেই প্রেম প্রতিমা,
দেখিতে দেখিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল পলকে।
যেন হেসে হেসে লো, প্রেমময়ী বেশে লো,
সোহাগে আগুলি তুমি পথে এসে দাঁড়ালে।
কিবা ধীর তাকানি, লাজমাখা মু’খানি,
ঈষৎ পড়েছে বাঁধা অলকেরই আড়ালে।”—ইত্যাদি

 স্বর্ণকুমারী দেবীর পর অর্থাৎ সমসময়ে কয়েকজন লেখিকার লেখা বই ছাপা হয়েছিল। “সিন্ধুবালা” বা “সন্তাপিনী’’তে একটু নূতন ধাঁচের চরিত্রসৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। “বিজনবাসিনী” প্রভৃতিতে খুব সাধারণ নারীরই দেখা পেয়েছি।

 কামিনী রায়, গিরীন্দ্রমোহিনী, মানকুমারী এঁরা স্রষ্টা নারী, এঁদের লেখায় সৃষ্টা নারী বেশী নেই, যাঁরা আছেন, তাঁরা পৌরাণিকা। নারীচিত্তের কল্যাণ নির্ঝর ঐ তিনটী ধারাতেই সমাজে সংসারে ঢেলে দিতে কার্পণ্য হয় নি। তাঁদের রচনায় বহু নারীচিত্র সুখদুঃখে শোকে সান্ত্বনায় যুঁই বেল, বকুল চম্পক চামেলীর মতই ফুটে উঠেছে। এঁদের মধ্যে মানকুমারীর রচনায় বাস্তব নারীর দেখা পাই।

 (রাণী) মৃণালিনীর কল্লোলিনী”,“নির্ঝরিণী” প্রভৃতিতে তাঁর আত্মগত কয়েকটী কবিতা তদানীন্তনকালে লোকপ্রিয় হয়েছিল।

 কিছুদিন বাংলাসাহিত্যে নারীরচিত তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বই দেখা দেয়নি। তবে ছোট গল্প বা কবিতা লেখা বন্ধও ছিল না, তা’ অনায়াসে বলা চলে। আবার ১৯০২-০৩ খৃষ্টাব্দ থেকে যেন একটু হঠাৎ করেই তাঁদের সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভাব ঘটলো। অবশ্য জগতে হঠাৎ কিছু সত্যকার ঘটে না, যা’ ঘটে তার আরম্ভ অনেক আগে থেকেই হয়, যবনিকার অন্তরালে গোপনসৃষ্টি লোকচক্ষের অজ্ঞাতে চল্‌তে থাকে, তারপর সহসা একদিন সর্বসমক্ষে প্রকট হয়ে পড়ে। অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা, নির্ঝরিণী ঘোষ, আমোদিনী ঘোষ, নিস্তারিণী দেবী, তরুলতা দত্ত প্রভৃতি লেখিকাগণ লেখনী পরিচালনা করছিলেন, কিন্তু বিশেষ এমন কোন চরিত্রসৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। “ভারতী”—মাসিকপত্রকে বহন করে এই সময় কয়েকজন শক্তিশালিনী লেখিকা দেখা দিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমদিকে সকলেই ছোট গল্প লেখিকা ছিলেন; কেহ বা স্বনামে কেহ বা বেনামীতে ইতঃস্তত লেখা ছাপাতেন।

 ১৯০৯-১১ খৃষ্টাব্দের “ভারতী”তে ধারাবাহিকভাবে বাহির হ’বার পর ১৯১২ খৃষ্টাব্দে অনুরূপা দেবীর “পোষ্যপুত্র” উপন্যাস পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ইহার ‘‘শান্তি” এবং “শিবানী” নিজ নিজ অংশাভিনয়ে যে কৃতকার্য্য হতে পেরেছিল, সে-যুগের সাহিত্যসমালোচনায় তার বহুতর প্রমাণ পাওয়া যায়। “সিদ্ধেশ্বরী” ঐ চরিত্রের নারীদের একটি সাহিত্যিক জ্বলন্ত উদাহরণ, যা’ বাংলার পল্লীতে বিরাজমানা থেকে সংসার ও সংসারীকে আজও অতিষ্ঠ করে তুলছে।

 “বাগদত্তা” উপন্যাসের কমলা, গৌরী, বড়বৌ, বিন্ধ্যবাসিনী আমাদেরই ঘরকন্নার একেবারে ভিতরকার লোক। জানা ও চেনা। তবে ‘কমলা’র জীবনের বিয়োগান্ত ব্যাপারের মধ্যকার গভীর সমস্যাটাই শেষ পর্যন্ত পাঠককে চিন্তিত রাখে যা হোক একটা সমাধানের প্রত্যাশায়; যেহেতু সেটা ইহলোকের চেয়ে পরলোকেরই মুখাপেক্ষী।

 “জ্যোতিহারা”র অণিমা ঠিক যেন আমাদের ঘরোয়া মেয়ে নয়! তাই পাঠকের সহানুভূতি স্নিগ্ধ শান্ত আত্ম বিসর্জনকারিণী শারদজ্যোৎস্নার মত “জ্যোৎস্না’’র প্রতিই বেশী আকৃষ্ট হয়েছে। নাস্তিকতা নিশ্চয়ই আমরা পছন্দ করি না, তা’য় আবার কোন মেয়ের মধ্যে দিয়ে! তবে জগতে যত মত, তত পথ। ‘‘সুপ্রভাত’’ মাসিক পত্রিকায় উপন্যাসটী প্রকাশকালে এই চরিত্রটী সার জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয়ের বড় ভাল লেগেছিল, সে কথা তিনি লেখিকাকে নিজে বলেছিলেন। কোন অসাধারণ দার্শনিক পণ্ডিত প্রবরেরও[৩৩] ঐ শান্তিহীনা মেয়েটীর প্রতি উপন্যাস বর্ণিত “দাদা মশাই’’য়ের মত কৃপাদৃষ্টি পড়েছিল বলে জানা আছে।

 একজন সাহিত্য সমালোচকের বিচারে ‘‘ব্রজরাণী” “মা” উপন্যাসে দ্বিতীয় চরিত্র হলেও তা’র প্রধানতম রূপচিত্র! বর্তমান যুগেও দুর্ভাগ্যক্রমে সে “সতীনে পড়া মেয়ে”। ব্রজরাণী কোথায়ও দেবী নয়। তার সমস্ত মেয়েলি দোষের সঙ্গে ব্যর্থমাতৃত্বের অতৃপ্ত তীব্র আকাঙ্ক্ষায় কেমন করে সে সপত্নীপুত্রের প্রতি ক্রমশঃ বাৎসল্যরসে ভিজে ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিতা হ’ল, সেইটিই বিশেষ করে এই গ্রন্থে প্রদর্শিত হয়েছে। এই চিত্রে বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার হয়ত যৎসামান্য ভেজাল থাকতে পারে, কিন্তু যদি থাকে,—তা’ অতীব মৃদু মাত্রায়! মা হ’বার আগ্রহ বা মাতৃত্বের ক্ষুধা নারীকে কত উচ্চে নিয়ে যেতে পারে, ব্রজরাণী চরিত্রে তা’ সুপ্রকট। বহুনারীর মধ্যে সপত্নী পুত্রের প্রতি নিজ গর্ভজাত পুত্রবৎ স্নেহ আমরা লক্ষ্য করেছি, আবার সপত্নী সন্তানবিদ্বেষও বড় কম দেখিনি। ‘মনোরমা’ বাস্তবিকই ভারতের চিরন্তন আদর্শ নারী সীতা সাবিত্রীরই সম জাতীয়া, এ যুগের পক্ষে হয়ত একটুখানি বেশী ভাল! ব্রজরাণী ছাড়া স্পষ্টভাষিনী “শরৎশশী”কে সবাই পছন্দ করে, ব্রজরাণীও তাকে হারিয়ে তার গুণ পরে বুঝেছিল। যুগের হাওয়া অতিক্রম করেও যে আদর্শ বেঁচে থাকে, এ তারই প্রমাণ।

 “মন্ত্রশক্তির বিদ্রোহিনী “বাণী” একই সঙ্গে পাঠকের ক্রোধ উদ্রেক এবং সহানুভূতি আকর্ষণ করে; ভ্রান্ত আদর্শ ও তীব্র আভিজাত্যবোধ তাকে তার নারীধর্ম থেকে বিচ্যুত করেছিল, কিন্তু সে ভিতর থেকে খাঁটি জিনিস ছিল বলেই নিজধর্মে সুপ্রতিষ্ঠিতা হ’তে তার আটকায়নি। অবশ্য বড় দুঃখের প্রচণ্ড আঘাত সহ্য করবার পর এই মন্ত্রশক্তির পূর্ণ প্রভাব প্রকট হয়েছিল।

 একজন সাহিত্যিকের মতে “মহানিশা”র ধীরার ত্যাগমহিমায় মাথানত হয়, কিন্তু পতিতপাবনীর ভাষায় বল্‌তে ‘কৌঁসুলি মেয়ে’ অপর্ণা পাঠক পাঠিকার হৃদয় হরণ করে বেশী; তার মাছের মুড়োর ঝোল এবং চালতার গুড় অম্বল রসনায় জল আনে, দুর্মুখ দাদামহাশয়ের মুখ ততোধিক মুখরতায় বন্ধ করে দেওয়ায় মন সায় দেয় এবং যখন বিপদের বন্ধু বৃদ্ধ বিহারীকে সে নিজেকে সমর্পণ করে কথঞ্চিৎ মাতৃঋণ শোধ করবার জন্য বিশ্বাসঘাতক প্রিয়তম নির্মলকে তীব্র ভর্ৎসনা করে ফিরিয়ে দেয়, তখন হৃদয় তাকে গভীর শ্রদ্ধায় ধন্য ধন্য বলে ওঠে।”

 ‘‘পথহারা” এবং “চক্র” উপন্যাসের পূর্বে দেশের তদানীন্তন রাজনীতিকে উপন্যাস সাহিত্যের বিষয়বস্তু বোধ হয় কেহই করেন নি, অথবা অতটা খোলাখুলিভাবে করতে ভরসা করেননি, আজ মৃত বাঘকে পদাঘাত করবার সাহসকে অন্ততঃ দুঃসাহস বলা চলে না। “বিবর্তনে”র পল্লীসংস্কার চিত্র আজ বাংলা সাহিত্যে প্রচুরতরভাবেই প্রভাব বিস্তার করেছে।

 বহু সমালোচকের মতে বঙ্কিমযুগের পর উপন্যাসসাহিত্যে যখন ভাঁটা পড়ে গেল, যখন একমাত্র সব্যসাচী রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য সাহিত্যিকেরা বিদেশী উপন্যাসের অনুবাদ এবং ছোট গল্প লেখা নিয়েই বিভোর ছিলেন, ঠিক সেই যুগে (১৯০৯-১০) “প্রবাসী”তে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের “নবীন সন্ন্যাসী” এবং “ভারতী”তে অনুরূপা দেবীর “পোষ্যপুত্র” আত্মপ্রকাশ করে বাংলাসাহিত্যকে উপন্যাসের জোয়ারে প্লাবিত হ’তে সুযোগ দিয়েছিল। সেই সঙ্গেই আমোদিনী ঘোষ, নিরুপমা দেবী, ইন্দিরা দেবী, শৈলবালা ঘোষ, হেমনলিনী দেবীদেরও আবির্ভাব হয়।[৩৪]

 অনুরূপা দেবীর গল্প, উপন্যাস, নাটক, নাটিকা, বহুতর—প্রবন্ধ মিলে সংখ্যায় নিতান্ত কম নয়; কাজেই আমরা ‘রামগড়ে’র ক্ষমাপারমিতা-সাধনাসিদ্ধা, লিচ্ছবিরাজকন্যা “সুসঙ্গতা’’, দেশের জন্য আত্মদানকারিণী মহীয়সী ‘‘শুক্লা” এবং “উত্তরায়ণে’’র প্রেমাস্পদের সাংসারিক শান্তিরক্ষার্থে আত্মোৎসর্গকারিণী “আরতি’’র ও বিশিষ্ট চরিত্র স্বর্ণলতার নামমাত্র করেই নিশ্চিন্ত হলেম। “বিদ্যারণ্যে’’র অলোকা, ‘‘কুমারিল ভট্টে’’র সত্যকামা, সুজাতা, ইন্দিরা এবং “বিজয়িনী”র রেবা চরিত্রও খুব অনুল্লেখযোগ্য নয়।

 নিরুপমা দেবীর “অন্নপূর্ণার মন্দির”-এর ধনীকন্যা ও জমিদারপত্নী দুঃখিনী কমলা, আত্মঘাতিনী ‘সতী’-চিত্র পাঠককে মর্মপীড়িত করে; “জাহ্নবী দেবী”র জাহ্নবীর মত অসীম ধৈর্যে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিতে বুক যেন ভরে উঠতে থাকে, মনে পড়তে থাকে এই চিত্রই সমস্ত বাংলার স্ত্রীর ও মায়েদের সত্যকার রূপ। ভাগ্যে বিশ্বেশ্বরের সঙ্গে সাবিত্রীর বিয়েতে এই করুণ রসচিত্র সমাপ্ত হ’ল, তাই পাঠকেরা শেষ পর্য্যন্ত অশ্রু মুছে একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। অসহিষ্ণু জ্যেঠাইমাটী তাঁর ছোট জায়ের বিপরীত রূপ অথচ খুব অপরিচিত নন।

 “দিদি” উপন্যাসের সুরমা বাংলাসাহিত্যের একটি স্থায়ী চিত্র। দীপ্তিস্মতী দিদির পাশে একান্ত নির্ভরপ্রত্যাশী সরলা “চারু” মেয়েটী যেন সূর্যের পাশে চাঁদের মত,—তেমনই স্নিগ্ধ তেমই করুণ এবং এই দুটী চিত্রই বাংলা সাহিত্যে তাঁর অনবদ্য দান। এ-চিত্রের বহু অনুলিপি আজ বাংলা সাহিত্যের বহু গল্প উপন্যাসে দেখা যায়।

 বোবামেয়ে “শ্যামলী” বঙ্গসাহিত্যে নূতন সৃষ্টা। “দেবত্র”, “বন্ধু”, “বিধিলিপি”, “পরের ছেলে”, “উচ্ছৃঙ্খল” “অনুকর্ষ” প্রভৃতিতে বহু বিচিত্র নারীচিত্র দেখা যায়। তার মধ্যে বিধি লিপি’র অনন্যপূর্বা কাত্যায়নী, সুন্দর ও নূতন সৃষ্টি। “অনুকর্ষে’’র অস্থিতচিত্তা ললিতা একটী নব্যমেয়েদের প্রতীক, তার কাকীমাটী নারীত্বে মণ্ডিত।

 ইন্দিরা দেবীর ‘স্পর্শমণি”র উমা চরিত্র বঙ্গসাহিত্যে নূতন না হ’লেও তার নিজস্ব স্বভাবে একান্ত অভিনব অথচ মোটেই অবাস্তব বা অসঙ্গত নয়। উমার মত উচ্চাদর্শের কত সতীতেজোদ্দীপ্তা অথচ স্নিগ্ধ স্বভাবা পুণ্যবতী কত উচ্ছৃঙ্খল সংসার ও সংসারীকে নবজন্ম দান করছে সে কি আমরা ইতস্ততঃ দেখতেই পাচ্ছি না? এরাই ত’ বঙ্গলক্ষ্মী! “কল্যাণী” ছিন্নতন্ত্রী, সুরভরা বীণার মত অকরুণ ভাগ্যবিধাতার নির্দয় ক্রীড়নক হ’লেও নিঃস্বার্থ নীরব প্রেমের এমন একটী স্বর্গীয় ছবি যে সহানুভূতি স্বতঃই মনে জাগে।

 প্রত্যাবর্ত্তনের চঞ্চলা হিমানী মেয়েটী এবং নির্মাল্যর দু’একটী যুঁই চামেলী সিউলির মতনই ছোট্টর মধ্যে সুরভি ভরা মেয়ে দেখা গেছে।

 আমোদিনী ঘোষজায়ার “ডায়েরীর দৌত্য” “চিত্রাঙ্গদা” প্রভৃতিতে যে-সব নারীচরিত্র পাই, অনেকেই বর্তমানের পরিচিতা নব্যভাবাপন্না, নারী না বলে তাঁদের মহিলা বলাই সঙ্গত।

 শৈলবালা ঘোষজায়ার “সেখ আন্দু’, “মিষ্টি সরবৎ”, “ইমানদার”, “আড়াইচাল”, “নমিতা”, “মঙ্গলমঠ” প্রভৃতিতে পুরুষচরিত্রের বৈশিষ্ট্য দেখি, নারীচরিত্র অসম্পূর্ণ, বহুস্থলে অসংযত এবং অসঙ্গতি দোষদুষ্ট। “বিপত্তি” এবং “নমিতা”য় নারীকে এ দেশের মেয়ে বলে বেশ চেনা যায়।

 শান্তা এবং সীতা দেবীর সম্মিলিত উপন্যাস, “উদ্যানলতা” সাহিত্যে নূতনচরিত্রের আমদানী করে, লেখিকারা সে দিনের পাঠকসমাজের চিত্তকে চমকে দিয়েছিলেন। নায়িকা চপলা চঞ্চলা মেয়ে “মুক্তি”কে আমরা নিজেদের ছোটবেলায় যেন নিজেদের মধ্যেই দেখেছি, এমনই পরিচিতা লেগেছিল তাকে। পরে পরে অনেক গল্প ও উপন্যাস তাঁরা লিখেছেন, আধুনিক স্কুল কলেজের মেয়েদের জীবনযাত্রা প্রণালীর প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি নিয়ে ছবিগুলি অতি সুন্দররূপে ফুটে উঠেছে, যদিও নারী-চরিত্র মধ্যে কতকটা একঘেয়েমী এসে গিয়েছে। অন্যান্য নারী-চরিত্র কয়েকটী অতি সুন্দর এবং তাদের মধ্যে বৈচিত্রেরও কোন অভাব হয় নি। ত্যাগপূত পূণ্য চরিত্রের সঙ্গেও আমরা পরিচিত হতে পেরেছি অতি সাধারণদের আশে পাশে।

 প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর বিরাট সাহিত্যের সব কথা বলা সম্ভব নয়। তবু “পথের শেষে”, “দূরের আশায়” প্রভৃতির নায়িকাদের মধ্যে অনেক উচ্চাদর্শের ও আদর্শ লক্ষ্মী স্বরূপিনী বঙ্গবালা এবং বঙ্গবধূ আমাদের মুগ্ধ করেছেন। দেবী, সীতা, বীথি প্রভৃতি আমাদের মনের ভিতর একটা স্থান করে নিয়েছে যা’ চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। তাঁর “মাটির দেবতা”য় তরলমতি ও নীতিজ্ঞানকে কুসংস্কারবোধে বিসর্জন করা আধুনিক কতকগুলি নারীচরিত্রের ফটোগ্রাফ দেখে এদের সঙ্গে তুলনা করে স্বতঃই কণ্ঠাগ্রে আসে;—

কি ছিলে, কি হলে, কি হতে চলিলে,
অবিবেক বশে কিছু না বুঝিলে!

 কাঞ্চনমালা দেবী রচিত নারীচিত্রে বৈশিষ্ট্য খুব বেশী কিছু আছে বলে মনে হয়নি।

 গিরিবালা বসুর কতকগুলি উপন্যাস আছে, নারীচরিত্রে নূতন কিছু পাওয়া গেছে বলে মনে হয় না, তথাপি রচনা সরস ও ভাষা মার্জিত বলে পড়তে ভালই লাগে।

 সরসীবালা বসু বহু উপন্যাসের লেখিকা। নূতন কিছু বলতে বা দিতে পেরেছেন কি না সন্দেহ! অবশ্য জগতে কিছুই ব্যর্থ হয় না। চারুবালা দেবীর “সতুর মা” প্রভৃতি কয়েকখানি বইয়ে বঙ্গনারীর মর্মকথা, বিশেষ কিছু নূতনত্ব না থাকলেও পড়তে লাগে ভালই।

 মায়ালতা বসু তাঁর ‘ত্রিধারা’য় তিনটী বিভিন্ন নারীচরিত্রের সমাবেশ করে বেশ একটু জটিলতার সৃষ্টি করেছেন, তিনটী চরিত্রই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যে বিভিন্ন।

 অমলা দেবীর (কল্পিত নাম কি না জানি না) প্রত্যেক নর এবং প্রত্যেক নারী বর্তমানের জীবন্ত লোক,—যাদের নিয়ে আমরা ঘর করছি, অথচ অতি পরিচয়ের জন্য যাদের কথা লিখতে মনেই পড়ে না। নরনারীর যুগপৎ চরিত্রগুলি যেন শুধু চোখে নয়, মাইক্রোস্কোপের সামনে বীজাণুর মত বৃহত্তর হয়ে ওঠে!

 অপরাজিতা দেবীর অসমাপ্ত উপন্যাস “বঙ্গরমণী”র এবং “বিজয়ী’’র জন্য আমরা প্রত্যাশিত হয়ে পথ চেয়েছিলাম, কিন্তু আজও আমাদের সে প্রতীক্ষা পূর্ণ হয়নি। এ দুটী উপন্যাসের বধূরা ‘রুক্মিণী’, ‘সুদেষ্ণা’, ‘কৈকেয়ী চৌধুরাণী’দের চরিত্রগুলি অতি নিপুণ হস্তেই অঙ্কিত হয়েছে। আবার সুদূর বঙ্গপল্লীর মর্মরূপও চাপা নেই। “বুকের বীণা”, “আঙ্গিনার ফুল” ইত্যাদির লেখিকা অপরাজিতা দেবীর বিংশ মধ্যযুগীয় অত্যাধুনিক এবং নারীর স্বভাবজ সলজ্জভাব বহির্ভূত প্রগল্‌ভ ভাবের নারী-চরিত্র অর্থাৎ নারীর ‘‘আত্ম-প্রচার” অনেকেই পুরুষ রচিত বলে সন্দেহ করে থাকেন! রচনায় শক্তির প্রাচুর্য্য ও নূতনত্ব যথেষ্ট থাকলেও ভাষা ও ভাবের সংযম একেবারেই নেই। নারী চিত্তের গোপন রহস্য একান্তই উন্মুক্ত হয়ে গেছে। সেটা আধোমুক্ত থাকলেই মনে হয় পাঠকদের আগ্রহ উদ্রিক্ত করে।

 পুষ্পলতা দেবীর নীলিমার অশ্রুতে নীলিমা ও অশ্রু দু’টি চরিত্রই ভাল হয়েছে। “ইন্দিরা” আধুনিক ধরণের মেয়ে, ভাল মন্দর সংমিশ্রণে “ব্রজরাণী”, “সুরমা”দেরই ছাঁচে গড়া। তা’ একটা কথাই তো আছে;—

“যে-মেয়ে সতীনে পড়ে
ভিন্ন বিধি তারে গড়ে।”

 “বিনিময়ের নারীচরিত্র দুটীই দুদিক থেকে ত্যাগে পূত ও সমুজ্জ্বল। “মরুতৃষা” ১৯৪৪ খৃষ্টাব্দের একখানি বাছাই করা বই, বর্তমান বাঙ্গালী সমাজের সুন্দর চিত্র। আলেয়ার আলোকে বা মরীচিকায় বিভ্রান্ত তরুণীর তৃষিত জীবনের পরিণাম ফল প্রায়শঃই করুণ রসের মধ্যেই সমাধা হয়। তার ভ্রান্তিবিলাসে অন্যের জীবনে যে ক্ষতি আসে সেইটাই হয় সাংঘাতিক বেশী। এঁর অনেকগুলি ছোটগল্পেও নারী চরিত্রে বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, সেগুলি নেহাৎ চর্বিত চর্বণ নয়।

 আশালতা সিংহের “স্বয়ম্বরা” প্রভৃতি অনেকগুলি বড় উপন্যাস আছে। নারীচরিত্র সর্বত্রই ছায়ানুগভাবে চিত্রিত হয়েছে। আমাদের ঘরোয়া মেয়েদের মধ্যে ভদ্রসংসারে বা সমাজ অনুবর্তী থেকে যতটুকু বিশিষ্টতা অর্জন করা সম্ভব, তাঁর নায়িকারা তার চেষ্টা করেছেন।

 আশালতা দেবীর উপন্যাসে বহু, নারীচরিত্রের মধ্যে গতানুগতিকতাই দৃশ্যমান। যা’ হয়ে থাকে এবং হওয়াই উচিত তেমনি ভাবেই তাঁরা চলেছেন। অন্ততঃ অদ্ভুত রসের বা বীর্ভৎস রসের অবতারণা করে পাঠককে শিউরে বা চমকে দে’বার সাধনা করেন নি।

 বাণী রায় একজন উদীয়মান লেখিকা; নারীচরিত্রগঠন সম্বন্ধে তাঁর মতটাই এখানে উদ্ধত করছি;—

 “** নারীজীবনে সামাজিকতা ও শিক্ষার অভাব। তার ফলে আজ আমাদের দেশে কোনদিকেই নারী কোন চমকপ্রদ সাফল্যলাভ করতে পেরে উঠছে না, যদিও নবজাগরণের ফলে চেষ্টার কিছু ত্রুটি নেই। অন্ধকার পটভূমিকায় দু’একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র বিচ্ছিন্নভাবে উদিত হলেও তারকাসভা কোথায়? একটী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতে চাহিদা মেটে না, অনেক চাই।”—তবে আমরা বলি, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, সুভাষচন্দ্র বসু বা জওহরলাল নেহেরু অনেক হয় না; এবং দরকার হয় না,—সেনাপতি এক’জনই হয়, আজ্ঞানুগ সৈন্যদল তৈয়ারী করাই কঠিন! তার জন্যই চাই সামাজিকতা জ্ঞান এবং তার সর্ববিধ শিক্ষা। আজকের শিক্ষায় মেয়েদের একটু ক্ষুদ্র নিজস্ব সংসার চালাবারই সামর্থ্য জন্মে না, সমাজ চালাতে বা রাজনীতি চালাতে কত সংযম, কত ত্যাগ, কত কঠোরতার শিক্ষা পাওয়া দরকার।—

 লীলা দেবীর “ধ্রুবা” বাংলাসাহিত্যে পূর্বাপর সৃষ্টীকরা কোমল পেলব সুগন্ধি পুষ্পটীর মতই একটি অনবদ্য সুন্দর রূপচিত্র। কিন্তু এ কথা বল্লে অত্যুক্তি হবে না যে, সেটি একটি রূপককাব্যও বটে। তার মধ্যে ব্যক্ত যতটা’ হয়েছে, তার চেয়ে বেশী অব্যক্ত আছে;—যেমন রবীন্দ্রনাথের “চতুরঙ্গে’’র দামিণীতে, শরৎচন্দ্রের “বড়দিদি’’র মাধবীতে, হেমলতা দেবীর এবং লীলা দেবীরও কতকগুলি ছোট ছোট চরিত্রে রবীন্দ্রনাথের রূপক নাট্যের সুরঙ্গমা ও সুদর্শনাতে।

 অন্নপূর্ণা গোস্বামীর কয়েকটী ছোট গল্পে ও উপন্যাসে নারী চরিত্রে অত্যাধুনিকতা দোষ দেখা যায়, অনর্থক নারী চিত্রের কথাটা উন্মোচন করে তার উলঙ্গ চিত্রকে সহস্র লোচনের দ্রষ্টব্য করায় লাভটা কি?

 এখানে দু’জন নূতন লেখিকার নারী চিত্র বিশেষ উল্লেখযোগ্য মনে করি, এক আশাপূর্ণা দেবীরও অপর কাত্যায়নী দেবীর। দু’জনেই হিন্দু সংসারের মধ্য থেকে টেনে এনে বিশিষ্টা নারীদের পাঠকের সম্মুখীন করতে সমর্থ হয়েছেন। যেমন, “বলয়গ্রাসের” মহালক্ষ্মী “হেমাঙ্গিনীর সংসারের’’ হেমাঙ্গিনী প্রভৃতি।

 আধুনিক মুসলিম লেখিকাদের উল্লেখযোগ্য নারীচরিত্র রচনা চোখে পড়েনি, তাঁরা যদি হিন্দুসমাজের চিত্র না এঁকে নিজ সমাজের দু’একটি বাস্তব ছবি আঁকেন, সাহিত্যজগতে হয়ত কিছু নবতর দান দিতে পারেন। গোঁড়া-ভক্ত সম্প্রদায়ের বাইরেও তো বহু আধুনিক শিক্ষিতা মোসলেম নারীর অভ্যুদয় হচ্চে, নিজ সমাজের বহু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কি জন্য তাঁরা লেখনী পরিচালনা করেন না? “গুণ্ডার” ভয়ে নিশ্চয়ই নয়? হিন্দু সমাজের মধ্য থেকে সে চেষ্টা করা প্রায় অসম্ভব! যেহেতু “রাবণ” না হ’লে “শ্রীরাম-চরিত্র’’ ফুটিয়ে তোলা যায় না, এ দিকে,—“রাবণের’’ স-গোত্রাদি যদি তর্জ্জন করে ওঠেন, “কেন রাবণকে অমন মসিবর্ণে চিত্রিত করা হলো এবং কেন রামকে হলো না? নিছক এটা সাম্প্রদায়িক অসৎ উদ্দেশ্য!” যদি “বিভীষণে’’র উদাহরণ দেখাতে চেষ্টা করা হয়, হয়ত শোনা যাবে; ও ব্যক্তি বিধর্মীর পাদপূজক কাফের, ও নজীর নজীরই নয়।” সেই জন্যই ইচ্ছা করলেও হিন্দুর পক্ষেও দ্বার রুদ্ধ! সকল সমাজই যেমন চিরদিন ধরে করে এসেছে, আজও করছে, অর্থাৎ নিজ সমাজের দোষ গুণের বিচার বিশ্লেষণ করে অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রচেষ্টা, এ দিনের শিক্ষিতা মোসলেম নারীরা তাই করুন। যেমন;—বহু বিবাহ, অন্য ধর্মীকে জোর করে বিবাহ করা ইত্যাদি আরও কত বিষয়েই তাঁরাই তাঁদের পতি পুত্র পিতার কার্যফলে ঘরে নির্যাতীতা ও বাইরে নিন্দিতা হন, এ সকলের প্রতিকার প্রচেষ্টার আন্দোলন, সমাজ-সংস্কার জন্য করবার অধিকার তো তাঁদেরই জোর করে হাতে নে’ওয়া উচিত।

পরিশিষ্ট

 আমি পৃথিবীর ইতিহাস লিখতে বসিনি, তবে আজ সমস্ত পৃথিবী তার কমলালেবুর উপমাটী চৌচাপটে মাথায় নিয়ে সেই রকম ক্ষুদ্র হয়েই আমাদের হাতের কাছে এসে পড়েছে; দূরে সরে থাকলে বা ঠেলে রাখলেও আজ আর কারো থেকে কা’রো দূরত্ব রক্ষা হচ্ছে না। দেখা যাচ্চে, নির্বিরোধী থাকবে বল্লেও কোন নৃশংস আক্রমণ তার উপর থেকে বন্ধ থাকছে না; “জানি না” বল্লে তখনই প্রশ্ন ওঠে;—“কেন জান না”? “জান্‌তে চাই না” বল্লে আদেশ আসে, “সে বল্লে তো চলবে না, জান্‌তেই হবে।”

 বিশ্বসংসার আজ আলোড়িত হয়ে চলেছে, কোথায় এর শেষ? এই খণ্ডপ্রলয়ের পর আবার কবে, কখন, কোথা হ’তে নবসৃষ্টির নূতন ধারা আরম্ভ হবে, অথবা আদৌ হবে কি না, তা কেউই জানে না। তবে আশা এই যুগে যুগে যা’ হয়ে এসেছে, আজও তাই হবে, প্রলয়ের পর সৃষ্টি হয়, যুদ্ধের পর ক্ষণিকের জন্যও একটা সাময়িক শান্তি আসে, সেই সময় সেই যুদ্ধ ক্লান্ত জনগণ আত্মবিনোদনের জন্যও বটে এবং বিগত ব্যাপারটাকে সম্যকরূপে প্রণিধান করে নে’বার জন্যও বটে, সৃষ্টিকার্যে নিরত তার প্রধান সহায়ক হয় সাহিত্য। এমনি করেই রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়ডের সৃষ্টি হয়েছিল; এমনি করেই গত যুদ্ধের পর যুদ্ধমান দেশসমূহে বহু ইতিহাস, উপন্যাস, নাটকাদির সৃষ্টি হয়েছিল। এবারের এই পৃথিবীব্যাপী মহাপ্রলয়ের সূচনা সর্বদেশ ও সর্বজাতিকে প্রায় সমসূত্রে নিবদ্ধ করতে অংশতঃ সাফল্য লাভ করেছে। তাই মনে হয়, এর অবসানে দু’দিনের হোক, দশদিনেরই হোক, যুদ্ধবিরতির শুভ মুহূর্তগুলিতে সর্বদেশের সাহিত্যসেবী মনীষীদের সঙ্গে একত্র হয়ে নারী-সাহিত্যসেবিকারাও এবার তাঁদের নিজ নিজ প্রত্যক্ষদর্শনের অমূল্য ফলাফলকে বহু পূর্ববর্তীদের মত সার্বজনীন সাহিত্যের রূপদান করে, গদ্যে হোক বা পদ্যে হোক চিরযুগজীবী মহাকাব্য উপন্যাস গান গল্প বা নাটক রচনা দ্বারা সার্থকতা লাভ কর্‌বেন। এই যন্ত্রদানবীয় যুগধর্মের অমানুষিকতা, স্বার্থান্ধ নৃংশস লোভীদের আত্মতোষণের জন্য পরশোষণের;—যার দুর্ভিক্ষ রূপ ভয়াবহ পরিণতি, বর্তমানের জীবিত সাহিত্যিকেরা অদূর অতীতের পূর্ববর্তীদের অপেক্ষা বহুগুণেই চাক্ষুষ দ্রষ্টা হিসাবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে অবসর পেয়েছেন। কেবলমাত্র মিথ্যা বিজৃম্ভিত রিপোর্টের মধ্যেই যেন তারা ব্যর্থ হয়ে না যায়; যুগে যুগে যেমন হয়ে এসেছে, ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীদের জন্য তাদের মধ্যেও পাপ পুণ্য, ন্যায় নিষ্ঠা, অন্যায় অবিচার সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে যেন চিরভবিষ্যতের জন্য আবার মহত্ত্বর সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। আর তার মধ্যে যেন নিরপেক্ষ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে পুরুষের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সহায়তা করতে পারেন,—স্রষ্টা নারীরাও।

 “স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টির” নারীরা যেন তাঁদের পূর্বগৌরবকে চির অক্ষুন্ন রেখে দিতে সমর্থ হন।”[৩৫]

সমাপ্ত

  1. যেস্থ ত্রয়শ্চ ত্রিংশশ্চ।
  2. রন্তিরসি রমতিরসি॥
  3. উপহুতে উপহবং তে অশীয়॥
  4. সত্যা আশীরস্য যজ্ঞ ভুয়াৎ॥
  5. মাতা চ যত্র দুহিতা চ ধেনু সর্বদুধে ধাপয়তে সমাচী। ৩।৫।১২
  6. সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব, সম্রাজ্ঞী শ্বশ্ব্রাং ভব, ননান্দরি সম্রাজ্ঞী, সম্রাজ্ঞী অধি দেবৃষু॥ ঋগ্বেদ, ১০।৮৫।২৭
  7. গৃহান্ গচ্ছ গৃহপত্নী যথাসো॥ ঋ, ১০।৮৫।২৬
  8. অস্মিন্ গৃহে গার্হপত্যায় জাগৃহি॥ ঋ, ১০।৮৫।২৭
  9. ইন্দ্রাণীব সুবুধা বুধ্যমানা জ্যোতিরগ্রা উধসঃ প্রতিজাগরাসি॥ অথর্ব্ববেদ, ১৪।১।৭২
  10. যথা সিন্ধুর্নদীনাং সাম্রাজ্যংসুষুবে বৃখা। এবা ত্বং সাম্রাজ্ঞেধিপত্যুরস্তংপরেত্য। অথর্ব্ববেদ, ১৪।২।৭৫
  11. টিউলিপ ফুল, লালরং, মাঝে কালো দাগ সেই দাগটিকে ক্ষত বলা হয়েছে।
  12. ‘ভায়োলেট ফুল বেগুনি রং। উহাকে মুসলিম ও খৃষ্টান জগতের কালোরঙের শোকবস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
  13. আরব্য উপন্যাস।
  14. এই প্রবন্ধ লেখার সময় ১৯৪৩-৪৪।
  15. এত শীঘ্র শাপমুক্তি হবে তখন স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।
  16. বিবিধ প্রবন্ধ প্রথম ভাগ—ভূদেব মুখোপাধ্যায়।
  17. বিবিধ প্রবন্ধ—ভূদেব।
  18. বৈষ্ণব কবি বল্‌তে আমরা সাধারণতঃ যাঁদের বুঝে থাকি তার বাইরে অসংখ্য কবি, নাট্যকার, গীতিকার অজস্র গানে ও কথায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনা করেছেন, সে যে কত তার হিসাব করা সম্ভব নয়। বিখ্যাত পদকর্তারা ছাড়া হরুঠাকুর, রামপ্রসাদ, রাম বসু, বৈজু বাওরা, গোপাল নায়ক, সুরদাস, দাশরথি রায়, রাসু, নৃসিংহ, গদাধর মুখোপাধ্যায়, রসিক চক্রবর্ত্তী, শ্রীধর কথক, ঈশ্বর গুপ্ত, কৃষ্ণকমল গোস্বামী, নীলকণ্ঠ, গোবিন্দ অধিকারী, গদাধর, ঠাকুরদাস, এমন কি ফিরিঙ্গি এণ্টনি, রূপচাদ পক্ষী, মধুসূদন কান, রামানন্দ, রাধামোহন, যদু নন্দন, প্রেমদাস, গিরীশচন্দ্র এমন কি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও বৈষ্ণব কাব্যসাহিত্যকে তাঁদের অমৃতনিস্যন্দিনী রচনা দ্বারা সমৃদ্ধতর করতে কুণ্ঠিত হন নি। রূপচাঁদের কতকগুলি হাসির গানের মধ্যে সে কালের ইঙ্গ-বঙ্গভাষার জগাখিচুড়িতে সখিসম্বাদ কি হাস্যরসের স্রোত বইয়েছিল এখনকার অনেকেই তা’ জানেন না। তিনি হয়ত বলতে চেয়েছিলেন, রাধিকা ঠাকুরাণী সে যুগে জীবিত থাকলে ঐ রকম ভাষাই না কি ব্যবহার করতেন! একটু নমুদা দি;—

    ‘‘আমারে ফ্রড করে কালিয়া শ্যাম তুই কোথায় গেলি?
    আই এম্‌ ফর ইউ ভেরি সরি, গোল্ডেন বডি হল কালি।
    পুওর ক্রিচর মিল্ক গেল, তাদের বুকে মারলি শেল,
    নন্‌সেন্স তোর নেই আক্কেল, ব্রিচ অফ কন্‌ট্রাক্ট করলি।’’

     সখিরাও কম যান্‌ না! মথুরার দরবারে গিয়ে দ্বারীকে ঐ একই সুরে ও ভাষায় বলছেন—

    ‘‘লেট মি গো ওয়ে দ্বারী, আই উইশ্‌ টু সি বংশধারী,
    ব্রজের রাখাল তোদের কিং, ফুলুটেতে কর্‌তো সিং,
     মজায়ে রাইকিশোরী।’’

     বঙ্কিমচন্দ্রের ‘‘কাহে লো সই জিয়ত মরত কি বিধান?’’ ‘‘শ্রীমুখপঙ্কজ দেখবো বলে’’, ‘‘মথুরাবাসিনী মধুরহাসিনী’’ প্রভৃতি পদ সর্ব্বজনপরিচিত। রবীন্দ্রনাথের ‘‘বাঁশরি বাজাতে চাহি’’ থেকে তাঁর ভানু সিংহের পদাবলীর ‘‘সজনি সজনি রাধিকা লো’’, ‘‘শুনলো শুনলো বালিকা, রাখ কুসুম মালিকা, কুঞ্জে কুঞ্জে ফিরনু সখি শ্যামচন্দ্র নাহিরে’’ ইত্যাদি আরও কত না মধুর পদ বঙ্গসাহিত্য-মঞ্জুষায় সজ্জিত রাখা অমূল্য রত্ন!

  19. “যদুরায়” শব্দটা তিনি নিশ্চয়ই ব্যবহার করেন নি।
  20. ‘‘স্নেহ বিহ্বল, করুণা ছলছল,
    শিয়রে জাগে কা’র আঁখিরে!’’ ইত্যাদি…

  21. ৺মহাত্মাজীর রামরাজ্যের মতও বলা যায়।
  22. জাহানারার আত্মজীবনীতেও প্রায়-অনুরূপ ঘটনার আভাষ পাওয়া যায়। একজন হিন্দুবীরকে তিনি মনে মনে বরণ করে পূজা করেছেন।
  23. আজ শেষোক্ত বিষয়টা দূর হ’লেও পাঠ্য নির্বাচনের গুপ্ত রহস্য অনাবৃতই রয়ে গেছে।
  24. (১৯৪৯) সেদিনের সঙ্গে প্রভূত প্রভেদ সত্ত্বেও বন্দী ছেলের জন্য মায়ের চোখের জল মুছবার সময় আজও আসেনি!
  25. শ্রীমতী অনুরূপা দেবীর ‘‘দেবদাসী’’ ছোট গল্প ও নাটিকা সর্বপ্রথম এঁদের দিকে সাহিত্যিক-সহানুভূতি আকর্ষণ করেছিল মনে হয়।
  26. অবশ্য টেকচাঁদ এঁর পূর্ববর্তী।
  27. সম্প্রতি স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন বাংলা এই ভীরু কুসংস্কারের হাত ছাড়িয়ে সুসংস্কৃত হয়ে উঠেছে, এখন মাতৃত্বহীনা মাতৃজাতির উপর হাত নয়, লাঠী ও গুলি অবাধেই চলছে। ভরসা এই, মহম্মদ ঘোরীরা এখন গরুর পাল সাম্‌নে নিয়ে যুঝ্‌তে এলে হিন্দুস্থান পিছন ফিরবে না।
  28. যেমন ‘‘না-পড়া পণ্ডিতরা’’ মধ্যে মধ্যে কোন কোন বড় বড় সাহিত্যিকের উচ্চতম শ্রেষ্ঠ রচনা সম্বন্ধেও বঙ্গ টিপ্পনী করিতে দ্বিধা করেন না!
  29. সুদীর্ঘ চারি বৎসরাধিক কালের মধ্যে সে দেশের অসদ্ভাবিত পরিবর্ত্তন ঘটিয়া গিয়াছে, আজ হাতে হাতিয়ারের অভাব নেই, আর যত যা নাই থাক্‌!
  30. সমাজেও তাই।
  31. আলালের ঘরের দুলাল ও স্বর্ণলতায় একটু পুরনো দিনের মানুষদের দেখা পাই কিন্তু ওদুটীকে ঠিক রোমান্স বলা যায় না।
  32. ৺ললিতকুমার প্রভৃতি কয়েকজন নিরপেক্ষ সমালোচক ভিন্ন, বিশেষ করে আধুনিকরা ত তাঁদের সাহিত্য জগৎ থেকে নির্ব্বাসিতই করতে চান, এর কারণ কি পুরুষ সাধারণের স্বাভাবিক রক্ষণশীলতার অবচেতন মনের ছায়া হতে উৎপন্ন? দশের মধ্যে নারী সম্পর্কে আলোচনায় লজ্জিত করে? অথবা চিরন্তন পৌরূষ তাদের কাছে কোন ঋণ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয়?
  33. যিনি ঐ উপন্যাসে চিত্রিত ‘‘দাদা মহাশয়ের’’ সত্যরূপ।
  34. বঙ্গসাহিত্যের কোন ইতিহাস লেখক শ্রীমতি অনুরূপা দেবীকে ‘শরৎ-গ্রুপের লেকক’ বলে অনুণ্ঠিত চিত্তে তাঁর পুস্তকে প্রচার করেছেন, এটী তাঁর কষ্ট কল্পনা! অনুরূপা দেবীর পোষ্যপুত্রই এঁদের উপন্যাস সাহিত্যে নামার পথ দেখিয়েছে বলাই বরং সঙ্গত! ‘‘ভারতী ও ভারতবর্ষেই’’ তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। ওঁদের হাতে-লেখা পত্রিকায় অনুরূপা দেবী কখন একটী কালির আঁচড়ও কাটেননি!!
  35. আজ ভারতবর্ষ স্বাধীন, স্বাধীন ভারতের নারীদের সৃষ্টিতত্ত্বের মহত্ত্বর দায়ীত্ব গ্রহণ ও তা’ বহন করবার দিন সামনে এগিয়ে এসেছে।