সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/কলিকাতার পুনরুদ্ধার

উইকিসংকলন থেকে

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ।

কলিকাতার পুনরুদ্ধার।

 পূর্ণিয়ার বিদ্রোহদলনের জন্য সিরাজদ্দৌলা কিছুদিন পর্যয়ন্ত ইংরাজদিগের কোন সন্ধান লইবার অবসর পান নাই। ইংরাজেরা ইতিমধ্যে অনেকের শুভদৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া কলিকাতায় পুনরাগমনের পথ সহজ করিয়া তুলিয়াছিলেন। পাত্রমিত্রগণ যখন সিরাজদ্দৌলাকে অনুনয় বিনয় করিয়া সেই কথা নিবেদন করিতে লাগিলেন, তখন তিনি সহজেই সম্মত হইলেন; সকলেই শুনিল যে, ইংরাজেরা শীঘ্রই কলিকাতায় পুনরাগমনের অনুমতিপত্র প্রাপ্ত হইবেন।

 সিরাজদ্দৌলার বাহুবল ছিল, বুদ্ধিকৌশল ছিল, প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য অদম্য হৃদয়বেগ ছিল। বালক সিরাজদ্দৌলা যখন যে আবদার ধরিয়া বসিতেন, কেহ তাহা ছাড়াইতে পারিত না, যুবক সিরাজদ্দৌলাও যখন যাহা করিতে চাহিতেন, কেহ তাহাতে বাধা প্রদান করিতে পারিত না। পাত্রমিত্রগণের কুটিল ব্যবহারে তাঁহার স্বাভাবিক স্বাধীন হৃদয় ক্রমে ক্রমে অধিকতর স্বাধীন হইয়া উঠিয়াছিল; নিজে যাহা বুঝিতেন, কেহ তাহার প্রতিবাদ করিলেই সন্দেহ হইত যে, তাহার মধ্যে হয় ত কোন গুপ্তকল্পনা লুক্কায়িত আছে। লোকের ব্যবহারে তাঁহার হৃদয়ে এই রূপে অনেক সন্দেহের বীজ নিক্ষিপ্ত হইলেও, স্বভাবসুলভ সরল বিশ্বাস বড়ই প্রবল ছিল। ধর্ম্মের নামে, ঈশ্বরের নামে, অথবা কোরাণশপথ করিয়া পরম শত্রুও যাহা বলিত, তিনি অবলীলাক্রমে তাহাতে আস্থা স্থাপন করিতেন। এরূপ সরল বিশ্বাস না থাকিলে সুচতুর সিরাজদ্দৌলাকে কেহ সহজে প্রতারিত করিতে সক্ষম হইত না। কিন্তু সিরাজ-চরিত্রের যাহা সদ্‌গুণ তাহাই তাঁহার শত্রুদলের হাতে পড়িয়া তাঁহার সর্ব্বনাশের পথ সহজ করিয়া দিল। সকলেই বুঝাইলেন যে, ইংরাজ বণিকের যথেষ্ট শিক্ষা হইয়াছে, তাঁহারা আর অতঃপর উদ্ধত স্বভাবের পরিচয় দান করিবেন না, অতএব তাঁহাদিগকে কলিকাতায় পুনরাগমন করিবার অনুমতি প্রদত্ত হউক। সিরাজদ্দৌলাও বলিলেন— তথাস্তু! শওকতজঙ্গের পরাজয়ের পর স্বার্থরক্ষার জন্যই যে দশজনে মিলিয়া ইংরাজকে আবার এদেশে আনিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন,—সময় থাকিতে সিরাজদ্দৌলা তাহার গূঢ় মর্ম্ম গ্রহণ করিবার অবসর পাইলেন না।

 এ দিকে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মীরজাফর, মাণিকচাঁদ,সকলেই সিরাজদ্দৌলার বাহুবলের ও শাসনকৌশলের পরিচয় পাইয়া ভীত হইয়া উঠিলেন। তাঁহাদিগের উভয়সঙ্কট উপস্থিত হইল। কার্য্যানুরোধে তাঁহারা সকলেই সিরাজদ্দৌলাকে চিনিয়াছিলেন; সিরাজও তাঁহাদের সকলকেই চিনিবার অবসর পাইয়াছিলেন। তাঁহার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়া নিরুদ্বেগে নিদ্রা যাওয়া অথবা তাঁহাকে পদচ্যুত করিবার জন্য প্রকাশ্যভাবে বিদ্রোহঘোষণা করা,—মন্ত্রীদলের পক্ষে উভয় পক্ষই তুল্যরূপ সঙ্কটপূর্ণ হইয়া উঠিল। সুতরাং ইংরাজদিগের আগমন-সংবাদে, তাঁহারা সকলেই কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া যাহাতে ইংরাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ঘনীভূত হয়, তাহার জন্য আয়োজন করিতে লাগিলেন। জগৎশেঠের সঙ্গে ইংরাজদিগের কথাবার্ত্তা, চিঠিপত্র, সকলই চলিতে লাগিল; নবেম্বর মাসের শেষে মেজর কিল্‌প্যাট্রিক তাঁহাকে লিখিয়া পাঠাইলেন যে, “জগৎশেঠই ইংরাজের একমাত্র ভরসাস্থল; সুতরাং ইংরাজেরা যে তাঁহার উপরেই সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করিতেছেন, এ বিষয়ে যেন শেঠজীর মনে কিছুমাত্র সন্দেহ না থাকে।”[১] শেঠজীর আর সন্দেহ রহিল না;তিনি কায়মনোবাক্যে ইংরাজদিগের কল্যাণকামনায় নিযুক্ত হইলেন।

 এদেশে একটি পুরাতন প্রবাদ আছে যে,—

“স্বকার্য্য সাধিতে খল তোষামোদ করে,
তাহে মুগ্ধ হয় যত বোধহীন নরে।”

 শেঠজী সে পুরাতন প্রবাদের মর্য্যাদা রক্ষা করিতে পারিলেন না। যে ইংরাজেরা একবৎসর পূর্ব্বেও কলিকাতায় টাকশাল স্থাপন করিয়া জগৎশেঠের আয়ের পথ সঙ্কীর্ণ করিবার প্রত্যাশায় গোপনে গোপনে বাদশাহের দরবারে অর্থবৃষ্টি করিতেছিলেন,[২] তাঁহারাই যখন কার্য্যানুরোধে শেঠজীকে আকাশ হইতেও উচ্চস্থানে উঠাইতে লাগিলেন, তখন শেঠজী একেবারে বিগলিত হইয়া পড়িলেন। ভবিষ্যতের যবনিকা যে কি ভীষণ দৃশ্যপট আবরণ করিয়া রাখিয়াছে, তাহা দেখিতে না পাইয়া, গতানুশোচনা পরিত্যাগ করিয়া হতভাগ্য উমিচাঁদও কায়মনোবাক্যে ইংরাজের কল্যাণসাধনে নিযুক্ত হইলেন। দিন যাইতে লাগিল;— কিন্তু দিন দিনই ইংরাজের আশালতা বর্দ্ধিত হইয়া উঠিতে লাগিল।

 চতুরচূড়ামণি মাণিকচাঁদ অতীব সাবধানে পদবিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তাঁহার ভরসা ছিল যে, পূর্ণিয়ার যুদ্ধেই সিরাজের সর্ব্বনাশ হইবে;—যখন তাহা হইল না, তখন তিনি গোপনে গোপনে ইংরাজের সহায়তা করিয়া, প্রকাশ্যে কলিকাতা রক্ষার জন্য বাহ্যাড়ম্বর দেখাইতে ত্রুটি করিলেন না।[৩]

 পাদরী বেণ্টু, একজন চুঁচুড়ার পাদরী সাহেব। তিনি ইংরাজদিগের অনুরোধে কয়েক সপ্তাহ কলিকাতায় বাস করিবার উপলক্ষে তথাকার গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহ করিয়া পাঠাইলেন। তাঁহার পত্রে পলতার ইংরাজেরা জানিতে পারিলেন যে, “মাণিকচাঁদ নদীর দিকে অনেকগুলি তোপ সাজাইয়া আসর জমকাইয়া রাখিয়াছেন, কিন্তু তাহার সকলই বাহ্যাড়ম্বর! দুর্গে দেড় হাজারের অধিক সিপাহী নাই। কামানগুলি অকর্মণ্য অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। টানার দুর্গে কেবল ২০০ সিপাহী আছে; হুগলীতে দুর্গমধ্যে ৫০ জন এবং বাহিরে ৫০০ জনের অধিক পল্টন দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না।”[৪]

 উমিচাঁদ লিখিয়া পাঠাইলেন যে, “লোকে নবাবের ভয়ে কিছু বলিতে সাহস পাইতেছে না; কিন্তু ইংরাজদিগের পুনরাগমনের জন্য খোজা বাজিদ প্রভৃতি প্রধান প্রধান সওদাগরগণ একান্ত উৎসুক।”[৫] হলওয়েল সাহেব সংবাদ পাইলেন যে, ‘কলিকাতার দুর্গ একরূপ অরক্ষিত। তাহার চারিটি বুরুজই অকর্মণ্য। কলিকাতার লোকে নিরুদ্বেগে নিদ্রা যাইতেছে। তাহাদের বিশ্বাস যে, নবাব-দরবার হইতে ইংরাজাগমনের অনুমতি হইবার সম্ভাবনা দেখিয়া কেহ আর কলিকাতা রক্ষায় মনোেযোগ দিতেছে না।’[৬] এই সকল সংবাদে ফলতার ইংরাজদল আশায় আনন্দে মাদ্রাজের সেনাদলের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

 ক্লাইব এবং ওয়াট্‌সন্ পুরাতন বন্ধু। কিছুদিন পূর্ব্বে এই উভয় বন্ধু মিলিত হইয়া মালাবার উপকূলের এক লাভজনক যুদ্ধব্যাপারে লিপ্ত হইয়াছিলেন। সেখানে সুবর্ণদুর্গের বন্দরে মহারাষ্ট্রীয়দিগের যুদ্ধজাহাজের আড্ডা ছিল; অংগ্রীয়া নামক একজন মহারাষ্ট্র-বীর তাহার নৌসেনাপতি-পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি কালক্রমে মহারাষ্ট্রশক্তিকে অঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া সমুদ্রবক্ষে যাহার তাহার অর্ণবপোত লুণ্ঠন করিয়া অর্থসঞ্চয় করিতেন। তাঁহার অত্যাচারে কি মহারাষ্ট্রীয়সেনা কি ইউরোপীয় বণিক, সকলেই সমানভাবে উত্যক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। ক্লাইব এবং ওয়াট্‌সন্ বহুসংখ্যক সেনা লইয়া নিরুদ্বেগে সমুদ্রকূলে বসিয়া রহিয়াছেন; সেই সুযোগ পাইয়া মহারাষ্ট্রীয়গণ অর্থবলে তাঁহাদের সহায়তা ক্রয় করিলেন; এবং সেই সমবেতশক্তি সুবর্ণদুর্গ চূর্ণ করিয়া ফেলিল। হিন্দুদিগের নৌ-সেনাবল প্রবল হইয়া উঠিতেছিল, এই উপলক্ষে তাহা চিরদিনের মত বিলুপ্ত হইয়া গেল। ক্লাইব এবং ওয়াট্‌সন্ যথেষ্ট অর্থ-লুণ্ঠনের অবসর প্রাপ্ত হইলেন। ক্লাইব নিজেই স্বীকার করিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহারা মোট ১৫০০০০০ টাকা পাইয়াছিলেন![৭]

 ক্লাইব এবং ওয়াটসনের যুদ্ধজাহাজ যখন উড়িষ্যার উপকূলের নিকট দিয়া ধীরে ধীরে কলিকাতাভিমুখে অগ্রসর হইতেছিল, তখন একদিন মহাবীর ক্লাইব মহামতি ওয়াটসন্‌কে ডাকিয়া পরামর্শ করিতে বসিলেন। পরামর্শের বিষয় আর কিছু নহে,বাহুবলে বাঙ্গলাদেশ লুণ্ঠন করিতে পারিলে কে কিরূপ ভাগ প্রাপ্ত হইবেন, তাহারই কথা! ওয়া্টসন্ সুবর্ণদুর্গের দৃষ্টান্ত দেখাইতে চাহিলেন; ক্লাইব তাহাতে সম্মত হইলেন না;—সে যাত্রা ক্লাইবের ভাগ কিছু কম হইয়াছিল। অনেক তর্ক, বিতর্কের পর স্থির হইল যে, সে যাত্রায় যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে, এখন হইতে ভাগ হইবে,সমান সমান![৮]

 যাহারা ক্লাইব এবং ওয়াট্‌সন্‌কে বাঙ্গালাদেশে পাঠাইয়াছিলেন, তাঁহারা কোনরূপে কলিকাতার বাণিজ্যাধিকার পুনঃ সংস্থাপনের জন্যই চেষ্টা করিয়াছিলেন; এবং যাহাতে বিনা রক্তপাতে সকল কার্য্য সুসম্পন্ন হইতে পারে, তজ্জন্য দাক্ষিণাত্যের নিজাম এবং আরকটের নবাবের নিকট হইতে সিরাজদ্দৌলার নামে সুপারিশপত্র পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। আর সেই সকল আদেশ পালন করিবার জন্য যাঁহারা সসৈন্যে বঙ্গদেশে শুভাগমন করিলেন, তাঁহারা সেনা সাহায্যে বঙ্গভূমি লুণ্ঠন করিয়া কে কত অর্থ লাভ করিবেন, সেই চিন্তা লইয়াই বিভোর হইয়া রহিলেন! ইহাতে মীরজাফরের ভাগ্যবৃক্ষে কিরূপ সুধাফল ফলিত হইয়াছিল, ইতিহাসে তাহার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশিত রহিয়াছে।

 সিরাজদ্দৌলা এ সকল গুপ্তমন্ত্রণার বিন্দুবিসর্গও জানিতেন না। মেজর কিলপ্যাট্রিক বা ফল্‌তার ইংরাজদিগেরও তাহা জানিবার উপায় ছিল না; সুতরাং তাঁহারা যেন তেন প্রকারেণ বাণিজ্যাধিকার লাভ করিবার জন্যই কাকুতি মিনতি জানাইতে লাগিলেন এবং সিরাজদ্দৌলাও তাহাতে সম্মতি জ্ঞাপন করিতে ক্রটি করিলেন না।

 সকল গোলযোগের অবসান হয় হয়, এমন সময়ে সংবাদ আসিল যে, ইংরাজবণিক অনেক গোলা বারুদ লইয়া মাদ্রাজ হইতে ফলতার বন্দরে আসিয়া জাহাজ নোঙ্গর করিয়াছেন! এই সংবাদ আসিতে না আসিতেই সেনাপতি ওয়াট্‌সনের নিকট হইতে পত্র লইয়া রাজদূত উপনীত হইল।

 ওয়াট্‌সনের পত্রখানি এইরূপ:—

FROM ON BOARD HIS BRITANICK MAJESTY'S SHIP KENT

AT FULTA THE 17th December, 1756.

 “The King, my master (whose name is revered among the monarchs of the world) sent me to these parts with a great fleet, to protect the East India Company's trade, rights and privileges. The advantages resulting to the Mogul's dominions from the extensive commerce carried on by my master's subjects, are too apparent to need enumerating; how great was my surprise, therefore, to hear you had marched against the said Company's factories, with a large army, and forcibly expelled their servants, seized and plundered their effects, amounting to a large sum of money, and killed great numbers of the King my master's subjects.

 “I am come down to Bengal to re-establish the said Company's servants in their former factories and houses, and hope to find you willing to restore them their ancient rights and immunities. As you must be sensible of the benefit of having the English settled in your country, I doubt not you will consent to make them a reasonable satisfaction for the losses and injuries they have suffered and by that means put an amicable end to the troubles, and secure the friendship of my King, who is a lover of peace and delights to act in equity. What can I say more?”[৯]

  1. Consultations at Fulta, 23 November 1756.
  2. Despatch to Court, 12 February.
  3. And yet Omichand and Manikchand were at this time in friendly correspondence with the English, they (negotiated at this time between the Nawab and the English) understanding how to run with the hare and keep with the hound.—Revd, Long.
  4. Long's Selections from the Records of the Government of India, vol. I.
  5. Omichand writes from Chinsura that Coja Wazed and other merchants would be glad to see the English return were it not for the fear of the Nabob.—Revd. Long.
  6. Ibid.,
  7. The enterprise succeeded and the prize-money amounted to £150000.—Clive's Evidence before the Committee of the House of Commons, 1772.
  8. After they had been sometime at sea, a Council was held on board Admiral Watson's ship to settle the distribution of prizemoney.—Clive's Evidence.
  9. Ive's Journal.