সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/সিরাজদ্দৌলার কি হইল?

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ।

সিরাজদ্দৌলার কি হইল?

 সিরাজদ্দৌলার কি হইল? মহাসভার সমক্ষে সাক্ষ্য দিবার সময়ে লর্ডক্লাইব বলিয়া গিয়াছেন যে, “তিনি তাহার কিছুই জানিতেন না, কেবল পরদিবস মীরজাফরের মুখে শুনিয়াছিলেন যে, তাঁহাকে নিশীথে গোপনে হত্যা করা হইয়াছে!”[১] সমগ্র মুসলমান-ইতিহাস অধ্যয়ন করিয়া ষ্টুয়ার্ট স্বপ্রণীত বাঙ্গালার ইতিহাসে লিখিয়া গিয়াছেন যে, “দেশীয় লেখকেরা কেহই ইহার জন্য ক্লাইবের স্কন্ধে কোনরূপ দোষারোপ করেন নাই!”[২] আমরা কিন্তু ‘রিয়াজ-উস্ সালাতিন’ নামক বিখ্যাত দেশীয় ইতিহাসে দেখিতে পাইতেছি যে, “ইংরাজ সেনাপতিদিগের এবং জগৎশেঠের উত্তেজনাবলেই সিরাজদ্দৌলা নিহত হইয়াছিলেন!”[৩] ষ্টুয়ার্ট এই গ্রন্থ আদ্যোপান্ত অধ্যয়ন করিয়া স্বপ্রণীত ইতিহাসে ইহার ভূয়সী প্রশংসা করিয়া[৪] অবশেষে এরূপ অলীক সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন কেন, তাহা বুঝিতে না পারিয়া মহাত্মা বিভারিজ আক্ষেপ করিয়া গিয়াছেন![৫]

 ইংরাজ ইতিহাস-লেখকদিগের মধ্যে অনেকেই ক্লাইবের কলঙ্কমোচনের জন্য সবিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের পক্ষে এরূপ ব্যবহার নিতান্ত অস্বাভাবিক নহে। তাঁহাদের সিদ্ধান্ত এই যে, সিরাজদ্দৌলার হত্যাকাণ্ডে ক্লাইবের কিছুমাত্র সংস্রব ছিল না। কিছুমাত্র সংস্রব না থাকিলে ক্লাইবের দোষক্ষালনের জন্য এরূপ আগ্রহ কেন,—তাহা কিন্তু সবিশেষ কৌতূকাবহ। অবস্থানুসারে ক্লাইবের নামেও কলঙ্করটনা হওয়া বিচিত্র নহে,—বোধ হয় এই জন্যই তাঁহারা এতদূর আগ্রহ প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন!

 যে সকল অবস্থানুসারে ক্লাইবের নামেও কলঙ্করটনা হইবার সম্ভাবনা, সেগুলি বড়ই গুরুতর। পলাশিক্ষেত্রে জয়লাভ করিয়াই মীরজাফর উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিলেন, কিন্তু পরিণামদর্শী কর্ণেল ক্লাইব তাঁহাকে বিজয়োৎসবের অবসর না দিয়া তৎক্ষণাৎ সিরাজদ্দৌলার কারাবোধের জন্য উত্তেজনা করেন। মীরজাফর রাজধানীতে উপনীত হইলেও ক্লাইব সহসা রাজধানীতে পদার্পণ না করিয়া কয়েক দিবস নগরোপকণ্ঠেই কালযাপন করেন;—কেহ কেহ বলেন যে, ইহার মধ্যেও ক্লাইবের গূঢ় উদ্দেশ্য নিহিত ছিল।[৬] ক্লাইব যেরূপ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়া গিয়াছেন, তাহাতে কেহই এরূপ তর্ক করিতে পারেন না যে, তিনি অকারণে মীরজাফরকে উত্তেজনা করিয়াছিলেন। ইতিহাসে যাহাই লিখিত হউক না কেন, পলাশির যুদ্ধ যে যুদ্ধাভিনয় মাত্র[৭] ক্লাইবের মনে সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, সিরাজদ্দৌলা পলায়ন করিবার অবসর লাভ করিলে নিশ্চয়ই ইংরাজের চিরশত্রু ফরাসিদলে যোগদান করিয়া ইংরাজদিগের সর্ব্বনাশ সাধন করিবেন। তিনি আত্মপক্ষ সবল করিবার জন্যই যে সিরাজদ্দৌলাকে কারারুদ্ধ করিতে ব্যাকুল হইয়াছিলেন, তাহাতে আর সন্দেহ হয় না। এই সিদ্ধান্ত সত্য হইলে, তাঁহার উত্তেজনাই যে সিরাজদ্দৌলার হত্যাকাণ্ডের মূলকারণ সে বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না! পরবর্ত্তী ঘটনা দ্বারা এই সিদ্ধান্ত আবার দৃঢ়তর হইয়া উঠে। ক্লাইব নিজেই বলিয়া গিয়াছেন যে,—যদিও কিছু মাত্র আবশ্যক ছিল না, তথাপি মীরজাফর তাঁহার নিকট উপনীত হইয়া এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া জানাইয়াছিলেন যে, সিপাহীদিগের ক্ষেপিয়া উঠিবার উপক্রম দেখিয়া সিংহাসন রক্ষার্থই সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করা প্রয়োজন হইয়াছিল!”[৮] ক্লাইবের কথার আভাসে বোধ হয়, তিনি এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা আদৌ আবশ্যক মনে করেন নাই![৯]

 যাঁহারা অন্ধকূপহত্যার জন্য সিরাজদ্দৌলাকেও অপরাধী করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের একটি প্রধান তর্ক এই যে,—স্বয়ং অন্ধকূপহত্যার আদেশ দেওয়ার প্রমাণ না থাকিলেও সিরাজদ্দৌলা যখন তজ্জন্য কাহাকেও তিরস্কার করেন নাই, তখন তাঁহার পরবর্ত্তী ব্যবহার দেখিয়াই মনে হয় যে তিনিও ইহার মধ্যে লিপ্ত ছিলেন।[১০] এরূপ তর্কপদ্ধতি অবলম্বন করিতে হইলে, ক্লাইবের পরবর্ত্তী ব্যবহার দেখিয়া কিরূপ সিদ্ধান্ত করিব? তিনিও ত সিরাজদ্দৌলার হত্যাপরাধের জন্য আকারে ইঙ্গিতে কোনরূপেই মীরজাফরকে কিছুমাত্র তিরস্কার করেন নাই; বরং প্রকারান্তরে বলিয়া গিয়াছেন যে ইহার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করিলেও ক্ষতি ছিল না। ক্লাইবের বাক্য এবং কার্য্য সমালোচনা করিলে কি স্বভাবতই বিশ্বাস হয় না যে, তিনিও সিংহাসনরক্ষার্থ সিরাজদ্দৌলার হত্যাকাণ্ড সমর্থন করিয়া গিয়াছেন?

 এই সকল ব্যবহারের সহিত ‘রিয়াজ-উস্-সালাতিনের’ সুস্পষ্ট অভিযোগ সম্মিলিত করিলে, কেমন করিয়া বলিব যে, সিরাজদ্দৌলার হত্যাকাণ্ডে ক্লাইবের বীরচরিত্র কলঙ্কিত হয় নাই? তাঁহাকে পলাশিবিজেতা মহাবীর বলিয়া যাঁহারা জয়মাল্য সমর্পণ করিবার জন্য সগৌরবে জীবনচরিত রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা কিন্তু কেহই “রিয়াজ-উস্-সালাতিনের” অভিযোগের সমালোচনা করিবার চেষ্টা করেন নাই।

 ইতিহাস-লেখকেরা সিরাজদ্দৌলাকে পরমপাষণ্ড দুর্ব্বৃত্ত নরাধম (অথচ) রণভীরু কাপুরুষ সাজাইবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। ক্লাইব নিজে ইহাতে আস্থা স্থাপন করিতেন কিনা তাহা সবিশেষ সন্দেহের বিষয়। সিরাজদ্দৌলা কিরূপ প্রকৃতির তেজস্বী যুবক, তাহার হৃদয়নিহিত ইংরাজবিদ্বেষ কতদূর বদ্ধমূল শত্রুসংহারে কত অদম্য হৃদয়বেগ,—ক্লাইব তাহার যথেষ্ট পরিচয় প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি সেই জন্য সিরাজের সহিত ফরাসি সেনার বাহুবল মিলিত হইবার সম্ভাবনা দেখিলেই শিহরিয়া উঠিতেন, এবং মসিয় লাকে সিরাজদ্দৌলার দরবার হইতে তাড়িত করিবার জন্য যথেষ্ট কৌশল-জাল বিস্তার করিতেও ত্রুটি করিতেন না। তাঁহার চক্রান্তেই মসিয় লা আজিমাবাদে তাড়িত হইয়াছিলেন।[১১] গমনকালে মসিয় লা সিরাজদ্দৌলাকে সাবধান করিতে ত্রুটি করেন নাই, সিরাজদ্দৌলাও বলিয়াছিলেন “আবশ্যক বুঝিলেই তাঁহাকে পুনরায় আহ্বান করা হইবে। এ সকল কথা ইংরাজদিগের নিকট লুক্কায়িত ছিল না; সুতরাং সিরাজদ্দৌলা পলায়ন করিবার অবস্র লাভ করিলেই যে মসিয় লায়ের সহিত মিলিত হইয়া ইংরাজের সর্ব্বনাশ করিবেন, ক্লাবের সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহের কারণ ছিল না। এই জন্যই সিরাজদ্দৌলাকে কারারুদ্ধ করা ক্লাইবের লক্ষ্য হইয়া উঠিয়াছিল, এই জন্যই প্রথম সন্দর্শনের শিষ্টাচার শেষ না হইতেই তিনি মীরজাফরকে উত্তেজনা করিয়াছিলেন, এবং বোধ হয় এই জন্যই তাঁহার উত্তেজনাক্রমে সিরাজ কারারুদ্ধ ও নির্দ্দয়রূপে নিহত হইলেও তদুপলক্ষে তিনি কোনরূপ ক্ষমা প্রার্থনা করা প্রয়োজন বলিয়া স্বীকার করেন নাই।

 ক্লাইব ইতিপূর্ব্বে মাদ্রাজে সেনাচালনা করিবার সময়েও ঠিক এইরূপ একটি দুর্ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল! ১৭৪৮ খৃষ্টাব্দে সুবিখ্যাত মুসলমান সুবেদার নিজাম উল্-মোল্‌কের পরলোকগমনের পর দাক্ষিণাত্যে তুমুল অন্তর্বিপ্লবের সূত্রপাত হয়। পরসাম্রাজ্যলিপ্‌সু রাজনীতিবিশারদ ফরাসি সেনাপতি দ্যুপ্লে বাহাদুর সেই অন্তর্বিপ্লবের ছিদ্রলাভ করিয়া কর্ণাটের নবাব এবং হায়দ্রাবাদের নিজামকে গৃহতাড়িত করিয়া চান্দা সাহেবকে কর্ণাটে এবং মীরজাফরকে হায়দ্রাবাদে রাজসিংহাসনে বসাইয়া দিয়া দাক্ষিণাত্যে ফরাসিরাজশক্তি সুদৃঢ় করিবার আশায় দ্যুপ্লেফতেহাবাদ নামে নগর পত্তন করিয়া তথায় এক অত্যুচ্চ বিজয়স্তম্ভ গঠন করেন। ইংরাজেরা তাঁহার গতিরোধ করিবার জন্য কর্ণাটের সিংহাসনপ্রার্থী মহম্মদ আলির পক্ষাবলম্বী হইয়া কর্ণেল ক্লাইবকেই সেনাচালনার ভার প্রদান করেন। ক্লাইব মহারাষ্ট্রবাহিনীর সহায়তা লাভ করিয়া, অল্পদিন মধ্যেই দ্যুপ্লেফতেহাবাদের জয়স্তম্ভ ধূলিসাৎ করিয়া ফেলিলেন; কিন্তু চান্দা সাহেব জীবিত থাকিতে রণকোলাহল শান্তিলাভ করিল না। ইহার কিছুদিন পরে ইংরাজ ও মহারাষ্ট্রবাহিনীর সমবেত অধ্যবসায়ে হতভাগ্য চান্দা সাহেব অকস্মাৎ কারারুদ্ধ হইয়া গোপনে নির্দ্দয়রূপে নিহত হইলেন। ক্লাইবের নামে কলঙ্ক রটনার সম্ভাবনা দেখিয়া তাঁহার স্বদেশীয় ইতিহাসলেখকেরা লিখিয়া গিয়াছেন,—“ক্লাইব ইহার কিছুই জানিতেন না! বোধ হয় মহম্মদ আলির চক্রান্তেই চান্দা সাহেব নিহত হইয়াছিলেন।”[১২] সিরাজদ্দৌলার হত্যাপরাধও যে এইরূপে একাকী মীর- জাফরের সপ্তদশবর্ষীয় হতভাগ্য পুত্র যুবরাজ মীরণের স্কন্ধে নিক্ষিপ্ত হয় নাই, তাহা কে বলিতে পারে?

 ক্লাইব যে কিছুই জানিতেন না তাহা প্রমাণ করিবার জন্য কেহ কেহ লিখিয়া গিয়াছেন যে,—“সিরাজদ্দৌলাকে যে দিবস মুরশিদাবাদে আনয়ন করে সেই দিন-তৎক্ষণাৎ-কাহাকেও কিছু না জানাইয়া দুৰ্বও মীরণ তাঁহাকে গোপনে নিহত করেন। মীরজাফর এবং ক্লাইব তখন ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে অবস্থান করিতেছিলেন,সুতরাং পূর্ব্বতীরস্থিত মীরণের রাজা, প্রাসাদে কখন্ কি হইয়া গেল, তাহা ক্লাইব অথবা মীরজাফর কেহই কিছু মাত্র জানিবার অবসর পাইলেন না!” কথাগুলি সত্য হইলে ইহা ক্লাইবের সাক্ষাৎ সম্বন্ধে অপরাধী না হইবার পক্ষে উৎকৃষ্ট প্রমাণ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। কিন্তু ইতিহাসলেখকদিগের এই সকল কথা কতদূর সত্য তাহার আলোচনা করা কর্তব্য।

 ক্লাইব এবং মীরজাফর উভয়েই ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে এবং মীরণ পূর্ব্বতীরে অবস্থিতি করিতেছিলেন,—এই বিষয়ে ইতিহাসে কোনরূপ মতদ্বৈধ দেখিতে পাওয়া যায় না। এইরূপ অবস্থান করিবার সময়েই রাজমহল হইতে সংবাদ আসিল যে সিরাজদ্দৌলা কারারুদ্ধ হইয়াছেন। এই সংবাদে চক্রান্তকারিগণ উৎফুল্ল হইতে পারেন, কিন্তু সিপাহীগণ হাহাকার করিয়া উঠিল, এবং কিছু কিছু অসন্তোষের লক্ষণ প্রকাশ করিতে লাগিল![১৩] ইহা হইতে স্পষ্টই বোধ হয় যে, যাহারা সিরাজদ্দৌলার কারাবোধের জন্য উদ্গ্রীব হইয়া কালগণনা করিতেছিলেন, তাঁহারা সিরাজকে রাজধানীতে আনয়ন করিবার জন্য যথোপযুক্ত শরীর-রক্ষক নিযুক্ত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। মীরণ ভিন্ন আর কে উপযুক্ত পাত্র? সুতরাং মীরণকেই রাজমহলে প্রেরণ করা হইল। অন্য লোকে হয়ত উৎকচলোভে বা নাগরিকভয়ে সিরাজ- দৌলাকে ছাড়িয়া দিতে পারে, মীরজাফরের উত্তরাধিকারী মীরণের প্রতি সেরূপ সন্দেহের কারণ নাই বলিয়াই বোধ হয় তাহাকে প্রেরণ করা হইয়া- ছিল! মুর্শিদাবাদ হইতে রাজমহল গমন ও তথা হইতে সিরাজদ্দৌলাকে লইয়া পুনরায় মুর্শিদাবাদে প্রত্যাগমন করিতে দুই দিবসের আবশ্যক; এই দুই দিবসের মধ্যেও কি এত বড় গুরুতর কথা আদৌ ক্লাইবের কর্ণগোচর হয় নাই?

 সিরাজদ্দৌলা কবে মুর্শিদাবাদে আনীত হইয়াছিলেন সে বিষয় এখনও রহস্যময় হইয়া রহিয়াছে। ক্লাইব, জ্ঞান এবং মুতক্ষরীণ-লেখক সাইয়েদ গোলাম হোসেন সকলেই একবাক্যে বলিয়া গিয়াছেন যে, সিরাজদ্দৌলাকে যেমন মুর্শিদাবাদে আনয়ন করিল অমনি কাহাকেও কিছু না জানাইয়া মীরণ তাঁহাকে হত্যা করিয়া ফেলিলেন;—সুতরাং কাহারও কিছু জানিবার সন্তা- বনা রহিল না। কিন্তু ক্লাইব, স্ক্রাফটন এবং গোলাম হোসেন, এই তিনজন সমসাময়িক দর্শক রাজধানীতে উপস্থিত থাকিয়াও তাহাদের এই উক্তি সমর্থন করিতে পারেন নাই। ক্লাইব বলেন,—সিরাজদ্দৌলা আনীত হইয়া সেই তারিখেই নিহত হন;[১৪] গোলাম হোসেন বলেন, সিরাজদ্দৌলা ৩রা জুলাই মুর্শিদাবাদে আনীত হইয়া সেই তারিখেই নিহত হন;[১৫] স্ক্রাফটন বলেন, সিরাজদ্দৌলা ৪ঠা জুলাই মুর্শিদাবাদে আনীত হইয়া সেই তারিখেই নিহত হন।[১৬] সমসাময়িক ব্যক্তিদিগের মধ্যে এরূপ অনৈক্য দেখিয়া সহজেই তাহার কারণ অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা হয়। সিরাজদ্দৌলার মুর্শিদাবাদে আগমনও তাহার হত্যাকাণ্ড যে একদিনেই সংঘটিত হইয়াছিল এবং তজ্জন্যই কেহ কিছু জানিবার অবসর পান নাই, এই কথা বলিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া ইহারা বিশেষ গোলযোগে পতিত হইয়াছেন।[১৭]

 সিরাজদ্দৌলাকে যখন মুর্শিদাবাদে আনয়ন করিল, তখন তাহাকে পশ্চিমতীরবর্তী হিরাঝিলের রাজপ্রাসাদে মীরজাফরের নিকট উপনীত করাই সম্ভব, না তাহাকে পূর্ব্বতীরবর্তী মীরণের রাজবাটীতে আনয়ন করাই সম্ভব? যাহারা ক্লাইবের দোষক্ষালনের জন্য ব্যাকুল, তাহারা বলেন যে, সিরাজকে আদৌ পশ্চিমতীরে আনয়ন করা হয় নাই, সুতরাং ক্লাইবাহার আগমন- সংবাদও জানিতে পারেন নাই। প্রকৃতপক্ষে সিরাজদ্দৌলাকে কোথায় আনয়ন করিয়াছিল, তাহার উপরেই প্রকৃত তর্ক নির্ভর করিতেছে। অর্ম্মিলিখিত আদিম ইতিহাসে দেখিতে পাইতেছি যে, “কারারক্ষিগণ সিরাজ- দ্দৌলাকে নিশীথ সময়ে দস্যু তস্করের ন্যায় শৃঙ্খলাবদ্ধকলেবরে মীরজাফরের সম্মুখে উপনীত করিয়া দিল;—যে রাজপ্রাসাদে কিছুদিন পূর্ব্বে সিরাজদ্দৌলা অখণ্ড প্রতাপে রাজগৌরব সম্ভোগ করিতেন, সেই রাজপ্রাসাদেই তাহাকে বন্দিবেশে প্রবেশ করিতে হইল! মীরজাফরও ইহা দেখিয়া বিগলিত হই- লেন সিরাজ তাহার নিকট পুনঃ পুনঃ জীবনভিক্ষা করিতে লাগিলেন, মীরজাফর সে দৃশ্য সহ করিতে না পারিয়া স্থানান্তরে লইয়া যাইতে আদেশ প্রচার করিলেন!”[১৮]

 সিরাজদ্দৌলা স্থানান্তরে নীত হইলেন বটে, কিন্তু মীরজাফর তাঁহার ভাগ্যনির্ণয়ের জন্য তৎক্ষণাৎ মন্ত্রণা করিতে বসিলেন। এই সময়ে রাজ- কার্যোপলক্ষে পাত্রমিত্রগণ সকলেই হিরাঝিলের রাজপ্রাসাদে উপস্থিত ছিলেন; মীরজাফর তাহাদের সকলেরই পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। ইংলণ্ডীয় মহাসভার মন্তব্য পুস্তকে প্রকাশ যে, সকলেই একবাক্যে সিরাজ- দ্দৌলাকে নিহত করিবার পরামর্শদান করেন।[১৯] কিন্তু অর্ম্মিলিখিত ইতিহাসে এই মন্ত্রণাসভার সবিস্তার বর্ণনা প্রদত্ত হইয়াছে। অর্ম্মিলিখিয়া গিয়াছেন যে,—“যাহারা ইতিপূর্ব্বে সিরাজদ্দৌলার নাম শুনিলেই থর থর করিয়া কাঁপিয়া উঠিতেন এমন অনেক লোকে এখন সময় পাইয়া তাহার নামে অবজ্ঞা প্রকাশ করিতে লাগিলেন; কেহ কেহ স্বার্থরক্ষার জন্য নূতন নবাবকে নরহত্যার প্রশয় দিতে সাহস পাইলেন না। অনেকে মীরজাফরকে বশীভূত রাখিবার জন্য সিরাজদ্দৌলাকে জীবিত রাখাই যুক্তিসিদ্ধ মনে করিতে লাগিলেন; ইহারা সকলেই একবাক্যে বলিলেন যে, সিরাজকে যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ করা হউক। মীরণের মত তাহা নহে। সিরাজদ্দৌলা জীবিত থাকিলে সর্ব্বদাই রাজবিপ্লব উপস্থিত হইয়া মীরজাফরের সিংহাসন আপদ- সঙ্কুল করিবে বলিয়া যে সকল কূটনীতিপরায়ণ ব্যক্তিদিগের ধারণা, তাহারা মীরণের পক্ষ সমর্থন করিয়া সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করিবার জন্য পরামর্শদান করিলেন। তাহাদের পরামর্শই অবশেষে কার্য্যে পরিণত হইল![২০]  এই সকল বর্ণনা পাঠ করিলে, এই সকল অবস্থা বিবেচনা করিলে, মীর- জাফরের সপ্তদশবর্ষীয় হতভাগ্য পুত্র মীরণকে অপরাধী করিতে সাহস হয়। মীরণের দুৰ্বত্ত চরিত্রই যদি সিরাজদ্দৌলার হত্যাকাণ্ডের একমাত্র কারণ হইত, তবে মীরণ তাঁহাকে রাজমহলে অথবা পথিমধ্যে যে কোন- স্থানে হত্যা করিলেই ত সকল গোলযোগের মূলোচ্ছেদ করিতে পারিতেন। সিরাজদ্দৌলার ভাগ্যনির্ণয়ের জন্য পাত্রমিত্র লইয়া মন্ত্রণা করিবার প্রয়োজন হইত না!

 সিরাজদ্দৌলাকে কারারুদ্ধ করিবার জন্য যাহাদের সর্বাপেক্ষা অধিক আগ্রহ, তাহাকে রাজমহল হইতে মুর্শিদাবাদে আনয়ন করিবার প্রস্তাব যাহাদের নিকট সুপরিচিত, সেই ইংরাজ সেনাপতি কর্ণেল ক্লাইব তখন মীরজাফরের পৃষ্ঠরক্ষার জন্য তাঁহার সহিত ভাগীরথীর পশ্চিম তীরেই অব- স্থিতি করিতেছিলেন। তিনি তখন সর্ব্বেসৰ্বা,—তাহার কৃপাকটাক্ষের প্রতীক্ষায় স্বয়ং মীরজাফর পর্যন্তও তটস্থ। তাঁহাকে কিছুমাত্র না জানা- ইয়া মীরজাফর কি এরূপ গুরুতর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিতে সাহস পাইয়া- ছিলেন?

 মীরজাফর নিজে সিরাজদ্দৌলার ভাগ্যনির্ণয়ের তর্ক বিতর্কে কোন পক্ষেই সম্মতিজ্ঞাপন করেন নাই।[২১] যাহারা তাহার পাপপথের সহচর তাহাদের মধ্যেও অনেকে স্বার্থরক্ষার জন্য সিরাজদ্দৌলাকে জীবিত রাখিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, তথাপি সিরাজদ্দৌলা নিহত হইলেন কেন? কাহার অনু- রোধ প্রবল হইল?—যাঁহারা কূটনীতিবিশারদ তাঁহাদের মতেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছিল তদ্বিষয়ে ইংরাজ-ইতিহাস-লেখকদিগেরও কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু সেই কূটনীতি বিশারদ কে? যাহার পরামর্শে বা ইঙ্গিতে নীরজাফরের আত্ম-হৃদয়ের স্নেহমমতা ভাসিয়া গিয়াছিল, অবশেষে তাহাকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নিরস্ত করিয়া সিরাজদ্দৌলাকে নিহত করিবার অদেশ প্রচারিত হইয়াছিল, তাহার নাম গোপন করিবার জন্যই কি ইতি- হাসলেখকেরা সপ্তদশবষীয় মুসলমানশিশুর নামে রাজহত্যার দূরপনেয় কলঙ্ক নিক্ষেপ করেন নাই? আদ্যোপান্ত সমস্ত অবস্থা বিচার করিলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, সকলেই জানিতেন, কিন্তু কেহই তাহা দন্তস্ফট করিতে সাহস না পাইয়া ইতিহাসের মর্যাদা পদবিদলিত করিয়া গিয়াছেন; সেই জন্য একমাত্র রিয়াজ উস্-সালাতিনের অভিযোগ ভিন্ন ক্লাইবের নামে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে হত্যাপরাধের কিছুমাত্র প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায় না।

 এই সকল অবস্থা বিবেচনা করিলে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে ক্লাইবের বিরুদ্ধে প্রমাণ নাই বলিয়াই তাহাকে সম্পূর্ণ নিরপরাধ বলিতে পারা যায় না। তিনি ইচ্ছা করিলে যে অনায়াসেই সিরাজদ্দৌলার জীবনরক্ষা করিতে পারিতেন, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। তিনি তজ্জন্য কিছুমাত্র চেষ্টা করা দূরে থাকুক, প্রকারান্তরে মীরজাফরের কার্য্য সমর্থন করিবার জন্য বলিয়া গিয়াছেন যে, সিংহাসন রক্ষার জন্যই এরূপ হত্যাকাণ্ড আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছিল! যাহার, নিকট জালসন্ধিপত্র এবং উমাচরণকে প্রতারণা করা কিছু মাত্র অন্যায় কার্য বলিয়া প্রতীয়মান হয় নাই, বরং “আবশ্যক হইলে আরও একশত- বার সেরূপ কার্য্য অনুষ্ঠিত হইতে পারিত, তাহার নিকট যে সিংহাসন- রক্ষার্থ সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করা বিশেষ দোষাবহ বলিয়া বোধ হইবে, তাহার সম্ভবনা কোথায়?

 যাহারা সাধারণ ইষ্টসিদ্ধির উদ্দেশ্যে পরস্পরের সহায়তা করিবার জন্য। কোনরূপ গুপ্ত চক্রান্তে মিলিত হয়, তাহারা সভ্যসমাজের বিচারে একে অপরের কৃতকার্যের জন্য অপরাধী হইয়া থাকে। ইংরাজ বাঙ্গালী গুপ্ত- চক্রান্তে মিলিত হইয়া সিরাজদ্দৌলার সর্বনাশ সাধনরূপ ইষ্টসিদ্ধির উদ্দেশ্যে পরস্পরের সহায়তা করিয়া সমরজয় করেন। তার পর সিরাজদ্দৌলাকে রক্ষা করা বা তাহার জীবনদান করা দূরে থাকুক, একজন তাহাকে কারা- রুদ্ধ করিবার জন্য অপরকে উত্তেজিত করেন, সেই উত্তেজনায় সিরাজদ্দৌলা কারারুদ্ধ হইয়া ক্লাইবের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে নিহত হইয়া থাকিলেও ক্লাই- বের কলঙ্কমোচন হয় না! সামরিক ব্যাপারে ন্যায় অন্যায় বিচার করিবার প্রয়োজন না থাকিতে পারে—স্বার্থই যাহার একমাত্র লক্ষ্য, সেখানে সকল কার্য্যই প্রশংসিত হইতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের নিকট ন্যায় অন্যায়ের মর্য্যাদা চিরদিন অক্ষুন্ন রহিবে। সিরাজদ্দৌলা অন্যায়রূপে নিহত হইয়া- ছিলেন কি না একমাত্র ইতিহাসই তাহার বিচারক। যদি কখন এ দেশের ইতিহাস যথাযথরূপে সঙ্কলিত হইতে পারে, তবে সে ইতিহাস সভ্যজগতের নিকট মুক্তকণ্ঠে প্রচার করিয়া দিবে,—ক্লাইব এবং মীরজাফর উভয়েই কূটনীতিবিশারদ মহাবীর; কিন্তু উভয়েই রাজবিদ্রোহী, উভয়েই বিশ্বাস- ঘাতক, উভয়েই রাজহন্তা!

 ভাগীরথীর পূর্বতীরস্থিত বর্তমান মুরশিদাবাদের একাংশের নাম জাফরা- গঞ্জ।[২২] নবাব আলিবর্দীর স্নেহানুপালিত মীর মহম্মদ জাফর আলি খা এই স্থানে বহুব্যয়ে বাসভবন নির্মাণ করিয়াছিলেন সেই সূত্রে স্থানের নামও ‘জাফরাগঞ্জ’ বলিয়া প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছে। একসময়ে জাফরাগঞ্জ এবং হিরাঝিলের সৌধশোভার মুরশিদাবাদের নাগরিকসৌন্দর্য্য সবিশেষ বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। সে পুরাতন ঐশ্বর্য্যগৰ্ব খর্ব্ব হইয়াছে, ভাগী- রথীর উভয়কূলের পূর্ব্বশোভা তিরোহিত হইয়া গিয়াছে; তৎসঙ্গে জাফরা- গঞ্জের নবাববাটীও কথঞ্চিৎ শ্রীহীন হইয়া পড়িয়াছে! কিন্তু পলাশি এবং জাফরাগঞ্জ বাঙ্গলার ইতিহাসে চিরপরিচিত হইয়া রহিয়াছে;—পলাশিতে সিরাজদ্দৌলার পরাজয়, জাফরাগঞ্জে সিরাজদ্দৌলার হত্যাকাণ্ড!

 এই ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদে মীরজাফরের পূর্ব্বজীবন অতিবাহিত হইয়াছিল। সিংহাসনে পদার্পণ করিয়া তিনি হিরাঝিল অধিকার করায়, জাফরাগঞ্জ যুবরাজ মীরণের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছিল; সেই সময় হইতে মীরণের বংশধরগণ এই রাজ প্রাসাদে বাস করিয়া আসিতেছেন।

 মীরজাফরের মন্ত্রণাসভায় সিরাজদ্দৌলার ভাগ্যনির্ণয় সুসম্পন্ন হইলে, তাঁহাকে জাফরাগঞ্জে রাজপ্রাসাদের একটা অন্ধতমসাচ্ছন্ন নিমতল নিভৃত কক্ষে গোপনে কারারুদ্ধ করা হয়।[২৩] জাফরাগঞ্জের রাজপ্রাসাদ সিরাজ- দ্দৌলার অপরিচিত নহে; -পলাশিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বেও তিনি মীর- জাফরের মতিভ্রম দূর করিবার জন্য ইলামের গৌরবরক্ষার্থ আত্মগৌরব তুচ্ছ করিয়া স্বয়ং শিবিকাররাহণে মীরজাফরের নিকট উপনীত হইয়াছিলেন। সে দিন তাহার আগমন-সংবাদে জাফরাগঞ্জের সেনা এবং সেনানায়কগণ ব্যস্ত সমস্ত হইয়া কত আগ্রহের সহিত সসম্মানে সঁহাকে প্রত্যভিবাদন করিয়াছিল! আজ সিরাজদ্দৌলা শৃঙ্খলিতচরণে সেই চিরপরিচিত তোরণদ্বার উত্তীর্ণ হইবার সময়ে, কেহ অভ্যাসবশতঃও অভিবাদন করিল না; সেই বিচিত্র অট্টালিকার প্রত্যেক কক্ষবাতায়ন হইতেই যেন প্রবল প্রতিহিংসাতাড়িত বিকট অট্টহাস্য ধ্বনিত হইয়া উঠিল। সিরাজদ্দৌলা ইহার জন্য প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছিলেন; তথাপি সে সময়ে তাঁহার অধীর হৃদয়ে কত কি ভীষণচিন্তা জাগিয়া উঠিয়াছিল, তাহা কে বলিতে পারে?

 একাকী অন্ধকার কারাকক্ষে নিপতিত হইয়া বোধ হয় জীবনের আশা আবার জাগিয়া উঠিয়াছিল! শত্রুহস্তে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও বন্দীকৃত হইয়াও যে এতদিন জীবিত রহিয়াছেন, ইহাতেই বোধ হয় সিরাজদ্দৌলা ভাবিয়াছিলেন যে, মীরজাফর হয়ত আত্মহৃদয়ের স্নেহ মমতা বিসর্জ্জন দিতে না পারিয়া কোনরূপে তাঁহার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করিয়া জীবনরক্ষা করিবেন।

 সিরাজদ্দৌলাকে জীবনদান করিতে সাহস হইল না; রাজসিংহাসন নিরাপদ করিবার জন্য আত্মহৃদয়ের স্নেহ মমতা বিসর্জ্জন দিতে হইল; স্পষ্টতঃ না হউক, প্রকারান্তরে সিরাজদ্দৌলাকে নিহত করিবার জন্যই তাঁহাকে মীরণের তত্ত্বাধীনে জাফরাগঞ্জে কারারুদ্ধ হইতে হইল! কিন্তু হায়! যাহাকেই এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করিবার জন্য আহ্বান করা হইল, সে-ই শিহরিয়া উঠিতে লাগিল; কেহই সহজে সম্মত হইল না। সিরাজদ্দৌলা নামে ইতিহাসে যত কলঙ্ক স্থানলাভ করিয়াছে, মুরশিদাবাদের লোকে ততদূর জানিত না; তাহারা জানিত সিরাজদ্দৌলা দেশের রাজা, ফিরিঙ্গীর শত্রু, আলিবর্দ্দীর স্নেহপুত্তল, সুকুমারকান্তি তরুণ যুবক, অশান্তত—যৌবনোন্মত্ত—উচ্ছৃঙ্খল—প্রবল প্রতাপান্বিত সুবাদার, সুতরাং তাঁহার বর্ত্তমান দুর্দ্দশা দেখিয়া লোকে তাঁহার দোষের কথা বলিয়া গিয়া ভাগ্যবিবর্ত্তনের কথা লইয়াই হাহাকার করিতেছিল।[২৪] এরূপ অবস্থায় সম্রান্তবংশীয় মুসল- মান মাত্রেই যে তাহাকে হত্যা করিতে অসম্মত হইয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।[২৫]

 এ জগতে কোন কার্যই অসম্পন্ন থাকিয়া যায় না। সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করিবার জন্যও অবশেষে একজন দুরাত্মা অর্থলোভে শাণিত খরসান গ্রহণ করিল! এই ব্যক্তির নাম মুহম্মদী বেগ—আবাল্য আলিবর্দী এবং সিরাজদ্দৌলার স্নেহানুকম্পায় প্রতিপালিত হইয়া তাহার ঘৃণিত জীবন অব- শেষে অর্থলোভে পাপপঙ্কে নিমগ্ন হইল।[২৬] সিরাজের মাতামহী একটি অনাথা মুসলমান বালিকাকে সন্ততিনির্ব্বিশেষে প্রতিপালন করিয়া মহম্মদী বেগের সহিত বিবাহ দিয়া দয়াপ্রকাশে ইহাদিগের গ্রাসাচ্ছাদনের সুব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন।[২৭] তদুপলক্ষে মহম্মদী বেগ সিরাজের সংসারে অনেক প্রকার উপকার লাভ করিয়াছিল। হতভাগা সমস্ত পূর্ব্বকথা বিস্মৃত হইয়া প্রভুহত্যার জন্য অগ্রসর হইল। বলা বাহুল্য যে, যাহারা ন্যায় ও ধর্মানু- সারে সিরাজদ্দৌলার সিংহাসনরক্ষার্থ ঈশ্বর এবং মনুষ্যের নিকট দায়ী হই- যাও পাকে চক্রে সিংহাসন কাড়িয়া লইয়া অন্নদাতা রাজাধিরাজকে দস্য তস্করের ন্যায় হত্যা করিবার জন্য নির্মম হৃদয়ে কারারুদ্ধ করিয়াছিল, তাহাদের আদেশ মস্তকে ধারণ করিয়া স্নেহানুপালিত মহম্মদী বেগ যে প্রতিপালকের মস্তকে খঘাত করিবে ইহাতে আর বিস্ময়ের কথা কি?

 উন্মুক্ত খরসান হস্তে দুর্দান্ত মহম্মদী বেগ কারাকক্ষে প্রবেশ করিবামাত্র সিরাজদ্দৌলা উন্মত্তবৎ ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। মুহূর্তের মধ্যে সকল আশা বিলীন হইয়া গেল; মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুদেগে সৰ্বাঙ্গ ব্যাপিয়া এক অব্যক্ত আকুল আর্তনাদ ধ্বনিত হইয়া উঠিল। সিরাজ আর্ত্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেনঃ-

 “কে? মহম্মদী বেগ? তুমি! তুমি! তুমিই কি অবশেষে আমাকে হত্যা করতে আসিয়াছ? কেন? কেন? কেন? ইহারা কি আমাকে বহুবিস্তৃত জন্ম- ভূমির নিভৃত নিকেতনে যৎসামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করিতে পারিল না।”

 পরক্ষণেই সিরাজদ্দৌলার তেজস্বী হৃদয়ের আত্মগরিমা প্রবুদ্ধ হইয়া উঠিল। তিনি মহম্মদী বেগের নিকট আর কারোক্তি করিলেন না; তাহার মুখের ভীষণ সংকল্পের পাপ কথায় কর্ণপাত করিলেন না, নিজেই বলিয়া উঠিলেন -

 “না–না–আমি বাঁচিতে পারি না! তাহা কদাচ হইতে পারে না! আর কোন অপরাধে না হউক! হোসেন কুলী! তোমাকে যে নিধন করিয়াছি, তাহার প্রায়শ্চিত্তের জন্যই এ জীবনের অবসান হউক!”[২৮]

  পরে মহম্মদী বেগের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন,-“আইস রই-রহ-জল দাও—একবার অন্তিমের দেবতার নিকট এ জীবনের শেষ কর্ত্তব্য সম্পন্ন করিয়া লই!”[২৯]

 সিরাজদ্দৌলা নিরুদ্বেগে জীবনের শেষ কর্তব্য সম্পন্ন করিতে পারিলেন;—দুরাত্মা মহম্মদী বেগ ভগবানের পবিত্র নামের পুণ্যপ্রভাব সহ্য করিতে পারিয়া, সিরাজদ্দৌলার অন্তিম প্রার্থনা শেষ হইতে না হইতেই, প্রচণ্ডবেগে তাঁহার স্কন্ধে খাঘাত করিল![৩০] নিদারুণ প্রহার-যাতনায় মর্মপীড়িত হইয়া সিরাজদ্দৌলা রুধিরাক্ত কলেবরে কমধ্যে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িলেন; মহম্মদী বেগ উন্মত্তের ন্যায় তাহার উপর উপর্যুপরি খঙ্গাঘাত করিতে লাগিল!

 “আর না-আর না-আর না-হোসেনকুলী! তোমার আত্মা শান্তিলাভ করুক।”[৩১] মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল;— সিরাজদ্দৌলার অমর আত্ম পাপপূর্ণ পৃথিবীর ক্ষুদ্র কারাকক্ষ অতিক্রম করিয়া অমরধামে প্রস্থান করিল।[৩২]

  তাহার পর কি হইল? মুর্শিদাবাদের নরনারী এই রাজহত্যার আকস্মিক সংবাদে হাহাকার করিয়া উঠিল; তাহাদিগের আকুল আর্তনাদ মুসলমানের উচ্চ অবরোধবেষ্টিত বেগমমহলে প্রবিষ্ট হইয়া সিরাজ-জননী আমিনাবেগমের কর্ণগোচর হইল! বিদ্রোহী দল তখন বিজয়োৎসবে উন্মত্ত হইয়া সিরাজের ক্ষতবিক্ষত শবদেহ হস্তিপৃষ্ঠে সংস্থাপন করিয়া, নগর প্রদক্ষিণে বাহির হইয়া- ছিল। রাজপথ লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল; সিরাজ-জননী হাহাকার করিতে করিতে লজ্জাভয়বিসর্জন দিয়া রাজপথে আসিয়া ধূলিবিলুষ্ঠিত হইয়া পড়িলেন; তাহাকে দেখিয়া শববাহক হস্তী সহসা রাজপথে বসিয়া পড়িল; —স্নেহময়ী জননী সন্তানের মাংসপিণ্ড বুকে ধরিয়া মুচ্ছাপন্ন হইয়া পড়িলেন। মীরজাফরের অনুচর কদম হোসেন তখন নানারূপ তাড়না করিয়া সিরাজ- জননী আমিনা বেগমকে পুনরায় অন্তঃপুরে কারারুদ্ধ করিয়া, সিরাজের শবদেহ সমাধিনিহিত করিবার জন্য ভাগীরথীর পশ্চিমতীরবর্তী আলিবর্দীর সমাধিমন্দিরে উপনীত করিল।[৩৩] এই ঐতিহাসিক সমাধিমন্দিরে আলিবর্দী

মহবৎজঙ্গের পূর্বপাশ্বে সিরাজের মাংসপিণ্ড নীরবে সমাধিনিহিত হইল;—এই সমাধিমন্দিরই এখন সিরাজদ্দৌলার একমাত্র শেষ নিদর্শন![৩৪]

  1. His Lordship knew nothing of it till next day.-Clive's Evidence.
  2. In justice to the memory of Colonel Clive, I think it requisite to state, that none of the native historians, impute any participation in the death of Sirajuddovla to him.-Stewart.
  3. Siraj-ud Dowla was put to death at the instigation of the English Chiefs and Jagat Seth —Riyaz-us-Salateen.}}
  4. I am indebted to it (Riyaz) for the idea of this work, and for the general out-line.— Stewart
  5. I do not understand why Stewart says that no native writer charges Clive with Complicity.-H. Beveridge, C.S.
  6. Clive purposely delayed entering Moorshidabad after the battle of Palassy—H. Beveridge, C. S.}}
  7. মুসলমান-ইতিহাস-লেখক মর্ম্মাহত হৃদয়ে লিখিয়া গিয়াছেন:—
    This is the battle in which India was lost for the Islam.— Tarikh Mansuri.
  8. Mcer Jaffier apologised for his conduct, by saying that the (Sirjadowla) had raised a mutiny among the troops. First Report, 1772.}}
  9. Macaulay dexterously uses some expressions in Clive's reports as a tribute from Mir Jaffar to the English character comment is a fair orc, but Clive's words rather imply thought Mir Jaffar's excuses superfluous, he says that “thought it necessary to palliate the matter on motives H. Beveridge, C. S.
  10. By his conduct he placed himself in the positio ory after the act-Col. Malleson's Decisive Bat p. 47
  11. Col. Clive was successful in this affair also—Tarikh-i-Mansuri.
  12. Chanda Shahib fell into hands of the Marhattas, and was put to death, at the instigation probably of his competitor Mahomet -Macaulay's Lord Clive.
  13. (When) news came to the city that Sirajadowla was taken the report excited murmurs amongst a great party of thc army encamped around, —Orme, ii. 183.
  14. Clive's Evidence,
  15. মুক্ষীণ।
  16. Scrafton's Reflections.
  17. নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাসে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় লিখিয়াছেন: “মুতক্ষরণের মতানুসরণ করিয়া আমরা সিরাজের হত্যাকাণ্ড লিপিবদ্ধ করিলাম। মুতরীণ লেখক যখন গ্রন্থ রচনা করেন তখন তিনি কোম্পানী বাহাদুরের পেন্সন- ঙ্গেী সরকারী লেখক ছিলেন। নানা কারণে ইহার নিকট সিরাজদ্দৌলা সুবিচার লাভ করেন নাই;—মীরজাফরও কৃতকার্যের জন্য তিরস্কৃত হন নাই। মুতক্ষরণের মতানুসরণ করা সকল স্কুলে সত্য নির্ণয়ের উৎকৃষ্ট পন্থা বলিয়া বোধ হয় না।
  18. In this manner, they brought him, about midnight, as a common felon, into the presence of Meer Jaffier; in the very palace which a few days before had been the seat of his own residence and despotic authority.!l is said that Jaffier seemed to be moved with compassion, and well he might, for he owed all his former fortunes to the generosity and favour of Alivcrdi, who died in firm reliance, that Jaffier would repay his bounties by attachment and fidelity to this his darling adoption, who himself, to Jaffier at least, was no criminal. -Orme, ii. 183.
  19. Meer Jaffier immediately held a council of his most intimatı friends, about the disposal of Sirajadowla; all agreed it would be dangerous to grant him his life.— First Report, 1772.
  20. Most of the principal men in the Government were at this time in the Palace, * * * All these Jaffier consulted. Some, although they had before trembld at the frown of Serajadowla, now despised the meanness of his nature more then they had dreaded the malignancy of his despotism; others, for their own sakes, did not choose to encourage their new soverign in despotic acts of blood- shed; some were actuated by veneration for the memory of Ali. verdi; others wished to preserve Sirajadowla, either as a resource 10 themselves, or as a restraint upon Meer Jaffier; all those pro- posed a strict but mild imprisonment. But the rest, who were more subtle courtiers, seconded the proposal of Meerun respecting the risks of revolt and revolution to which the Government of Jaffier would be contiunally exposed whilst Sirajadowla lived.-Orme, ii. 184.
  21. Jaffier himself gave no opinion:—Orme, ii. 184.
  22. Mir Jaffar lived at Jaffaraganj, on the left bank, i. e. on Kasimbazar island, and the descendants of his son Miran still reside there. -H. Beveridge, C. S.
  23. A small enclosure is shewn as the scene of his fate but the room or closet which once stood there, and in whidh he was confined and put to death, has disappeared. H. Beveridge. C, S. arata বর্ষের প্রবল ভূমিকম্পে জাফরগঞ্জের বাটী বিশেষরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে; বোধহয় উহা লোকলোচনের অতীত হইয়া পড়িবে।
  24. When the people beheld him in this situation, they forgot his vices, and recollected only the hardship of his present fortune, compring it with the splendour they had seen him sur- rounded with from his infancy till now.-Scott's History of Bengal, p. 371.
  25. He ordered Serajadowla to be confined and put to death, but on person of rank would undertake the murder. —Scott's History of Bengal, p. 371
  26. মুতক্ষরীণ।
  27. At length, a wretch named Mahummady Beg, who from his infancy had been cherished by Mahubut Jung and Seraja-Dowla from whose grandmother he had received a portion with his wife from charity, offered to execute the horrid deed. —Scott's History of Bengal, p. 375.
  28. Stewart's History of Benga.
  29. At length he recovered sufficiently to ask leave to make his ablutions, and to say his prayers. Orme, ii. 184.
  30. মুতক্ষরীণ।
  31. “Enough! - enough!-Hussein Cooly, thou art revenged."- Stewart.
  32. সিরাজদ্দৌলা এদেশে জন্মগ্রহণ না করিলে ইতিহাসলেখকেরা বোধ হয় তাহার প্রতি অধিকতর সহানুভূতি প্রকাশ করতে পারিতেন। ষ্টার্ট সিরাজের অন্তিম উক্তি লইয়াও পরিহাসচ্ছলে লিখিয়া গিয়াছেন-“This is, perhaps, a solitary instance of a native of Hindoostan expressing a consiousness of guilt on his death-bed. Being absolute predestinarians they lay the fault to fate; and, after a life spent in every species of atrocity, pass their last moments in tranquility.” —Stewart.
  33. The populace beheld the procession with awe and consterna. tion, and the soldiery, having no longer the option of two lords, accepted the promises of Jaffier, and refrained from tumult.- Ormed ii, 184.
  34. এই “সমাধিগৃহে দীপ জ্বালিবার জন্য এক্ষণে মাসে চারি আনা মাত্র তৈলের ব্যবস্থা হইয়াছে!”-শ্রীনিখিল নাথ রায়, বি, এ।