সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/পঞ্চম অঙ্ক/ষষ্ঠ গর্ভাঙ্ক

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ গর্ভাঙ্ক

মুর্শিদাবাদ—নবাব-দরবার

মীরজাফর, রাজবল্লভ, মাণিকচাঁদ, সভাসদগণ ইত্যাদি

রাজ বঃ। জাঁহাপনা, মোহনলাল ধরা পড়েছে।
মীর জাঃ। সে পড়ুক, এ দিকে সর্ব্বনাশ! ক্লাইব এখনই টাকা নিতে আস্‌বে। অত টাকা তো রাজকোষে নাই;—কি হবে? টাকা না পেলে সে অগ্নিমূর্ত্তি হবে।
রাজ বঃ। জনাবকে তো বলেছিলেম, যে গুপ্ত হত্যাকারী পাঠিয়ে বধ করুন।
মীর জাঃ। মহারাজ উন্মাদের ন্যায় কথা বল্‌ছেন। ক্লাইবকে বধ করে, এমন কেউ বাঙ্গ্‌লায় জন্মগ্রহণ করে নাই। আর ফিরিঙ্গিরা জনে জনে ক্লাইব। টাকার দাবী হ’তে কিছুতে এড়ান পাওয়া যাবে না।
নেপথ্যে। জয় কোম্পানী বাহাদুরের জয়, জয় ক্লাইব সাহেবের জয়!
মীর জাঃ। ঐ আস্‌ছে।

ক্লাইব, ওয়াল্‌স ও উমিচাঁদের প্রবেশ

ক্লাইব। নবাব বাহাদুর, সেলাম।
মীর জাঃ। (সিংহাসন হইতে উঠিবার উপক্রম করিয়া) আস্‌তে আজ্ঞা হয়—আসুন—আসুন।
ক্লাইব। নবাব বাহাদুর গদী হইতে উঠিবেন না। আমাদের তরফ হইতে সমস্ত কার্য্য হইয়াছে, জনাব গদী পাইয়াছেন, আপনার তরফে যাহা কর্ত্তব্য, তাহা করুন,—আমাদের টাকা চুকাইয়া দিন। Mr. Wolls, read the treaty.
(ওয়াল্‌সের আসল সন্ধিপত্র বাহির করণ)
উমি। ও তো সন্ধিপত্র নয়, ও তো সন্ধিপত্র নয়,—সে যে লাল কাগজ। আমার নিকট তার নকল আছে, এই দেখুন।
ক্লাইব। এ কি জাল কাগজ আনিয়াছেন? আপনি অতি ধূর্ত্ত!
উমি। অ্যাঁ—অ্যাঁ, ওয়াটস সাহেব ত্রিশলক্ষ টাকা লিখে দিয়েছেন, আপনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন।
ক্লাইব। ওয়াট্‌স সাহেব কি করিয়াছে, হামি জানি না। উমিচাঁদ বাবু, হামাদিগকে অল্পই বুঝিয়াছেন। তোমার মত লোক যদি হামাদিগকে ভুলাইতে পারিত, তাহা হইলে জাহাজ ভাসাইয়া এতদূর আসিতাম না। তুমি হামাদের ভয় দেখাইয়া, টাকা আদায় করিবে ভাবিয়াছিলে। হামরা ভয় পাই না! তুমি জাল সন্ধিপত্র ধুইয়া খাও। তুমি জালিয়াৎ, জাল করিয়াছ, যাও—নচেৎ তোমার দণ্ড হইবে। কলিকাতায় হামাদের আইন চলে। সেখানে এই জাল কাগজ দাখিল করিলে, তোমার ফাঁসী হইত;— হামাদের আইনে জালের দণ্ড ফাসী। তুমি জালিয়াৎ, দরবার ছাড়িয়া চলিয়া যাও।
উমি। অ্যাঁ, অ্যাঁ—ওরে বাপ্‌রে—কি জালিয়াৎ রে!—ওরে বাপরে কি হলো!—মাগ-ছেলে মরেছিলো, সব সয়েছিলো। ওরে বুক ফেটে গেল—বুক ফেটে গেল! ত্রিশ লক্ষ টাকা—ত্রিশলক্ষ টাকা—তার উপর জহরতের সিকি!—কি হলো রে—কি হ’লো!—
ক্লাইব। Hold your tongue, you forgerer. তোমায় কলিকাতায় লইয়া গিয়া ফাঁসী দিব।
উমি। দাও, দাও,—এখনি ফাঁসী দাও!—ত্রিশ লক্ষ টাকা—ত্রিশ লক্ষ টাকা!—হা টাকা—হা টাকা! টাকা—টাকা—
(মূর্চ্ছা) 
ক্লাইব। নবাব বাহাদুর, একে পাগ্‌লা গারদে পাঠান।
মীর জাঃ। কে আছ, একে নিয়ে যাও। শিবিকাবাহনে এঁরে আবাসে রেখে এসো।

উমিচাঁদকে লইয়া দুইজন প্রহরীর প্রস্থান {{hi|নেপথ্যে উমি। টাকা—টাকা—হা টাকা—হা টাকা! মোহনলাল ও করিমকে বন্দী করিয়া রায়দুর্লভ ও প্রহরীগণের প্রবেশ

রায়দুঃ। জনাব, এই মোহনলাল;—আর এই করিমচাচা, নবাবের বেশে আমাদের দূতকে প্রতারিত ক’রেছিল।
মীর জাঃ। করিমচাচা, তুমি এরূপ প্রতারক, আমার ধারণা ছিল না। তোমার প্রাণদণ্ড হবে।
করিম। মেরে তো ফেল্‌বে, দেহটা একবার হাতীর পিঠে ঘোরাবে না? শেষাশেষি পুরো নবাবীটে ক’র্‌তে দাও।
মীর জাঃ। বেইমান, তোমার এখনো ব্যঙ্গ?
করিম। বেইমানি তো আমার একচেটে নয়, আমি তো হেথায় হংস মধ্যে বকো যথা। বেইমানির যদি সাজা থাক্‌তো, তাহলে সারি সারি মুণ্ড গড়াতো।
মীর জাঃ। এরে শূল দণ্ড দাও।
ক্লাইব। হামরা উপস্থিত আছি, ঐ দণ্ডটা মকুব করুন।
মীর জাঃ। সাহেব, তোমার অনুরোধ রক্ষা কর্‌লেম, কিন্তু এ নেমকহারাম শূলের যোগ্য। যাও, এর প্রাণবধ করো।
করিম। চাচা, বড় উচ্চপদ দিলে। বেইমানিতে যদি তোমাদের উপর গিয়ে থাকি, তাহ’লে আমার বাহাদুরী বটে। (ক্লাইবের প্রতি) সাহেব, সেলাম, বড় জবর লোক তুমি। বাঙ্গলা কি, সমস্ত ভারতই তোমাদের।
ক্লাইব। Thank you for your good wishes.
করিমকে লইয়া প্রহরীর প্রস্থান
মীর জাঃ। মোহনলাল, এখন তোমার সে গর্ব্ব কোথায়? সে দম্ভ কোথায়?
মোহন। বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, কুলাঙ্গার, মুসলমান-কুল-কলঙ্ক, আমার দম্ভ সমানই আছে। লজ্জাহীন, নীচাত্মা, গোলামী গদীতে ব’সে হুকুম দিচ্ছ? যার গদী তারে ছেড়ে দে, ক্লাইব সাহেবকে দে,—যার পদে দেশ, মান, মর্য্যাদা, মনুষ্যত্ব সকলই বিক্রয় করেছিস্—তারে গদী দিয়ে পদপ্রান্তে ব’স। কৃতদাস, পরাধীন কুকুর, জীবনে-মরণে আমার সমান দম্ভ রইলো! বঙ্গবাসী-হৃদয়ে আমার চির আসন রইলো! ঘাতকের অস্ত্রে হত হ’য়ে আমার দম্ভ নষ্ট হবে না! তুমি ক্লাইবের ভারবাহী গর্দ্দভ হ’য়ে থাকো!
মীর জাঃ। শীঘ্র ল’য়ে যাও, বধ করো।
ক্লাইব। মোহনলাল, আপনি বীরপুরুষ। আপনাকে খোলোসা দিবার আমার এক্‌তার নাই, কিন্তু হামি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি—you are a brave soldier. সত্যই বলিয়াছেন, মৃত্যুতে আপনার গৌরব খর্ব্ব হইবে না,—you are a patriot!
মোহনলালকে লইয়া প্রহরীর প্রস্থান
এখন তো জনাবের দুশ্‌মন সব মরিল। এখন আমাদের টাকা চুকাইয়া দেন। Mr. Walls, whats’ the amount?
ওয়াল্‌স। Seventeen million seven hundred thousand—এক কোটী সাতাত্তোর লক্ষ।
ক্লাইব। জনাব, হুকুম হয়।
মীর জাঃ। সাহেব, অত টাকা তো রাজকোষে নাই।
ক্লাইব। না থাকিল তো কি হইল? আমাদের টাকা চাই। জনাব, একঠো মজার বাত উঠিয়াছে, শুনিয়াছেন কি? এ টাকার জন্য না কি হামার প্রাণবধের হুকুম হইয়াছিল। এ ঝুট বাৎ, হামি বুঝিয়াছি। টাকা দিতে হইবে, যেরূপে হয়, টাকা দিন। আপনার নিজ জহরৎ বিক্রয় করুন, সম্পত্তি বিক্রয় করুন, কর্জ্জ করুন, টাকা দিতেই হইবে। হামরা জান দিতে অগ্রসর হইয়াছিলাম, জনাবের টাকা দিতে প্রস্তুত হওয়া উচিত ছিল।
মীর জাঃ। সাহেব, রাজকোষ যে এরূপ শুন্য, আমি কিরূপে জানবো। সমস্ত বিক্রয় ক’রে আমি অর্দ্ধেক টাকা সংগ্রহ করেছি। আর অর্দ্ধেক প্রজাদের কর আদায় ক’রে, তিন বৎসরে পরিশোধ করবো, অঙ্গীকার কচ্ছি।
ক্লাইব। অঙ্গীকার করিতেছেন! আপনার অঙ্গীকার প্রত্যয় কিরূপে করিব? নবাব সিরাজদ্দৌলার নিকট কোরাণ স্পর্শ করিয়া অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, যে তাহার পক্ষে লড়িবেন। আপনি অনেক অঙ্গীকার করেন!
রায় দুঃ। আমরা সকলে জামিন হচ্ছি।
ক্লাইব। হাঁ—জামিন হইতেছেন! শেঠজীর নিকট কর্জ্জ লইতে পারিতেন না? শেঠজীকে সরাইয়া দিয়াছেন। দুঃখিত হইলাম, আপনাদের জামিনে আমি প্রত্যয় করিতে পারিব না। আমি স্বচক্ষে রাজকোষ দেখিব, যদ্যপি সন্দেহ হয়, যে টাকা সরাইয়া রাখিয়াছেন, নবাবী গদী বেচিয়া লইর।
ওয়াল্‌স। (জনান্তিকে ক্লাইবের প্রতি) Possible there is no money, Shiraj has spuandered all.
ক্লাইব। শুনুন নবাব;—তিন বৎসরে টাকা লইতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু কাহাকে বিসওয়াস্ করিতে প্রস্তুত নই। নবাব সিরাজদ্দৌলা খারাপ ছিল মানি! কিন্তু আপনারাই তাহাকে তক্তায় বসাইয়াছিলেন, আপনরাই ঈশ্বর সাক্ষী করিয়া তাহাকে নবাব বলিয়াছিলেন, আপনারা শপথ করিয়া তাহার প্রজা হইয়াছিলেন। সে সময় ভুলিয়া গিয়াছেন!—এ অঙ্গীকারও ভুলিতে পারেন। হামার তাঁবুতে আসুন। যেরূপ বন্দোবস্ত করিতে হয়, তথায় গিয়া করিবেন। ঐ যে মোহনলাল—যাহাকে ধরিয়া আপনার দূত লইয়া গেল—সে আসিয়া জামিন হইলে, আমি প্রত্যয় করিতাম। গদী ছাড়িয়া উঠুন, আমার তাঁবুতে আসুন। আইসেন, বিলম্ব করিতে পারিব না।
মীর জাঃ। (সিংহাসন হইতে উঠিয়া) পরমেশ্বর! এই নবাবী পেলেম!
ক্লাইব। কৈ হ্যায়—নবাব বাহাদুরকা জুতা ঘুমায়ে দেও।
সকলের প্রস্থান