সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/প্রথম অঙ্ক/ষষ্ঠ গর্ভাঙ্ক

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ গর্ভাঙ্ক[১]

কলিকাতা—ফোর্ট উইলিয়ম-ব্যারিক

ড্রেক, হলওয়েল ও কৃষ্ণদাস

ড্রেক। তোমার বাবার দ্বারাই আমাদের সমস্ত কুত্তায় যাইতে বসিয়াছে। তোমার বাপ আমাদের দুশমন, not friend.
কৃষ্ণদাস। সাহেব, আমার পিতার কোন অপরাধ নাই।
হল্‌ওয়েল। তুমি বাক্য অধিক জানো, হামি জানে! কিন্তু এক এক করিয়া আমার কথার উত্তর দাও। তোমার বাবা, গভর্ণর ড্রেক সাহেবকে লিখিয়াছিল কি না, যে সিরাজ নবাব হইল তো কি হইল? নবাবের বড় মাউসি ঘেসেটীবেগমের পুষ্যি ছানা সিরাজের ভাই এক্রামদ্দৌলার নাবালক লেড়্‌কাটাকে হামি নবাব কর্‌বে। নবাবের চাচী ঘেসেটীবেগমের টাকা আর তোমার বাবার চালাকি এই দুই একত্রিত করিয়া, সিরাজকে গদি হইতে নামাইবে। এখন কি হইল
কৃষ্ণ। সাহেব, আমার পিতা প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।
ড্রেক। Fool, প্রাণপণ কাকে বলো! যেখন নবাবী ফৌজ ঘেসেটীবেগমের লালকুঠিতে আসিল, একঠো গুলি ছাড়িয়াছিলো? একঠো তলোয়ার খাপ হইতে বাহির হইয়াছিল? তোমার বাবা কুত্তাকা মাফিক ভাগ্‌লে; যে ঘেসেটীবেগমের সাথ দোস্তি করিয়াছিলো, সে ঘেসেটীবেগমের হাল কি হইবে তাহাও ভাবিলো না। এস্‌কা নাম বেইমানি
কৃষ্ণ। সাহেব, আমার পিতা কি জানেন যে, তাঁরা প্রস্তুত হ’তে না হ’তে সিরাজ আক্রমণ কর্‌বে।
হল। এ কথা কি তোমার বাবা বলিয়াছিলো যে তিনি না প্রস্তুত আছে? প্রস্তুত না আছে জানিলে কি গভর্ণর ড্রেক সাহেব নবাবে দূতের অপমান করিত, না প্রথম যখন দূত গিয়াছিল ঐ ওক্‌তে পেরিং পয়েণ্ট ভাঙ্গিয়া দিত; কেল্লা মেরামতি করিত না, নবাব যেমন যেমন বলিয়াছিল, সব কাম তেমন তেমন করিত।
কৃষ্ণ। বাবার ত্রুটি হ’য়েছে, বাবার ত্রুটি হ’য়েছে আমি স্বীকার পাচ্ছি।
ড্রেক। তুমি স্বীকার পাইতেছ তো হামি খোস হইয়া গেল। দেখো, ফের্‌বি যখন নবাব দূত পাঠাইল, তখন বি তোমার বাপ কিছু বলে না।—ফের ড্রেক সাব, নবাবকা অপমান করিল।
কৃষ্ণ। হ্যাঁ—শেষে রামরাম সিংহের ভাই রাজারাম সিংহ এসেছিল বটে, কিন্তু সে ফিরিওয়ালার বেশে এসেছিল, একথা লিখেতো নবাবের নিকট কৈফিয়ত দিয়েছেন।
ড্রেক। হাঁ, আামরা লিখেছি; সে তোমার বাপের সলা না, হাম্‌রা লিখা জানে। লেকেন তোম বাপ-বেটা দুশ্‌মন আছে, এ ইংরাজ লোক ভুলিবে না।
কৃষ্ণ। আমরা চিরদিনই আপনাদের আশ্রিত, আমরা চিরদিনই আপনাদের বন্ধু।
হল। হাঁ, বুড়া নবাব আলিবর্দ্দীর আমলে যখন তোমার বাবা ঢাকার নোয়াজেসের দাওয়ান ছিলো (ও উল্লুক নামে ঢাকার সর্দ্দার ছিল, কিছু দেখিত না, মুর্শিদাবাদে মতিঝিলে রেণ্ডি নিয়ে আস্‌নাই করিত) তেখন তোমার বাবা প্রজা লুটিয়া টাকা লইয়াছে আর আমাদের উপর কি জুলুম করিয়াছে, তাহা তোমার স্মরণ থাকিতে পারে। না স্মরণ থাকে, আমি তোমায় ইয়াদ করিয়া দিতেছি।
কৃষ্ণ। সাহেব—সাহেব—
ড্রেক। Silence! হামাদের মাল জাহাজ আটক করিল, এজেণ্টদিগকে কয়েদ করিল, ফের নবাব যখন মর্‌বে শুন্‌লে, তেখন কাশিমবাজারে ওয়াট্‌স্‌ সাহেবকা পাশ বলিল—‘সিরাজদ্দৌলা নবাব হইবে না, তোমার বাবা যাকে নবাব করিবে সেই নবাব হইবে।’ তুমি কলিকাতায় পলায়ন করিয়া আসিলে, ইংরাজ খোলা বাহুতে তোমাকে receive করিল, তোমার বাপের বেইমানি সব ভুলিয়া গেল।
কৃষ্ণ। হ্যাঁ—আপনাদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।
ড্রেক। হাঁ—হাঁ তা বুঝেছি। But look here, তোমার বাবা যে রাজবল্লব সেই রাজবল্লব আছে। এদিকে ঘেসেটী বেগম জানানায় বন্দী হইল, আর ইংরাজের উপর নবাব রাগিল। এখন কি নয়া সলা করিতেছ বলো? নবাব তাহাকে কিছু বলিল না কেন?
কৃষ্ণ। সাহেব, মুর্শিদাবাদ হ’তে আমি কোন পত্র তো পাইনি।
ড্রেক। ঝুট্ মৎ বলো। আমাদিগের চক্ষু বন্ধ করিতে পারিবে না,—তোমার মনস্থ ফলিবে না, তুমি কলিকাতা হইতে যাইতে পারিবে না।
কৃষ্ণ। সাহেব, আমি ক’ল্‌কাতায় আপনাদের, আশ্রয় গ্রহণ করেছি, ক’ল্‌কাতা হ’তে কোথায় যাব?
ড্রেক। কেন তোমার বাবার নিকট যাইবে না? তোমার বাবার কারণ হাম লোক নবাবকা দুশ্‌মন হুয়া, আর তোমার বাবা নবাবের দোস্ত হুয়া, হামাদের বিরুদ্ধে নবাবকে লইয়া আসিতেছে। যদি সকল সত্য না বলো, তোমায় কয়েদ থাকিতে হইবে।
কৃষ্ণ। সাহেব, কি কথা আমি তো কিছুই জানিনে।
ড্রেক। জাননা, তোমায় আমি বলিয়া দিতেছি। এই পত্র দেখ, কেস্‌কা জানো? Spy রামরাম সিং উমিচাঁদকে লিখিয়াছে। এ চিঠি যে ব্যক্তি লইয়া আসিয়াছে, সে ব্যক্তি তোমার বাবার চরের মত চালাক নয়, এই নিমিত্ত আমদের নিকট ধরা পড়িয়াছে। তোমার বাবা খুব চালাক আদমি। আর মিথ্যা বলিও না, সকল খবর হামাদিগের দাও, নচেৎ তোমায় কয়েদ করিয়া রাখিব। তোমায় কয়েদ করিয়া তোমার বাবার দুশ্‌মুনির শোধ লইব।
কৃষ্ণ। সে কি সাহেব! আপনি আমার আশ্রয়দাতা, আপনারা না আশ্রয় দিলে, নবাব হয়তো প্রাণবধ ক’র্‌তো।
ড্রেক। সেই নিমিত্ত তোমার বাবা হামাদের বিরুদ্ধে নবাবকে সঙ্গে আনিতেছে।
কৃষ্ণ। সাহেব, সে কি কখন হয়? এই মিথ্যা সংবাদ আপনাকে কে দিয়াছে?
ড্রেক। উমিচাঁদের প্রতি এই রামরাম সিংয়ের চিঠি পাঠ করো। (পত্র প্রদান করিয়া) বড় আওয়াজে পাঠ কর।
কৃষ্ণ।
(পত্র পাঠ)
“সময় থাকিতে কলিকাতা হইতে সরিয়া পড়ুন। নবাব সসৈন্যে কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিয়াছেন। এবার ইংরাজের আর রক্ষা নাই। মীর জাফর, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ প্রভৃতি সেনানায়কগণ নবাব-সৈন্য পরিচালনা করিতেছে।”
ড্রেক। বস্ করো। Rascal, what have you got to say now? তোমার বাবা হামাদিগকে মারিতে আসিতেছে আর তুমি হামাদের চক্ষু বন্ধ করিবার নিমিত্ত বলিতেছ,—তোমরা হামাদের দুশমন নও।
কৃষ্ণ। সাহেব, আমি সত্য বল্‌ছি, আমি কোন সংবাদ অবগত নই।
হল। চোপ্‌রাও you sooty devil. The fiend উমিচাঁদের হাল এখনি দেখিবে। দুইজনে কারাগারে যাইয়া সল্লা করো।

উমিচাঁদকে ধৃত করিয়া সৈনিকদ্বয়ের প্রবেশ

ড্রেক। Ah! here you are. Good morning উমিচাঁদ! তোমার দোস্তকে দেখিতেছ? দুইজনে মিলিয়া কলিকাতা হইতে যাইবে, আমরা তোমাদের ঘোড়ার ডাক বসাইয়া দিবে।
উমি। সাহেব, আমি কোম্পানি বাহাদুরের প্রজা। বিনা অপরাধে আপনাদের লোক আমার প্রতি জুলুম করেছে, আমায় বন্দী ক’রে এনেছে, আমি কোন দোষে দোষী নই!
ড্রেক। হাঁ—হাঁ—বুঝিয়াছি। নবাব কলিকাতা অক্রমণে আসিতেছে কিনা,—তোমরা হামাদের দোস্ত, তোমাদের প্রতি অত্যাচার হইবে, এই নিমিত্ত কেল্লার বিচে তোমাদের রাখিবে।
উমি। আমার অপরাধ কি—আমার অপরাধ কি?
ড্রেক। তুমি দুশমন! তোমাদের কয়েদখানায় অবস্থান করিতে হইবে।
উমি। বিনা অপরাধে আমার প্রতি এরূপ অত্যাচার কেন ক’চ্ছেন? আমায় বন্দী করেছেন, আমার বাড়ী লুট করেছেন, আমার পরিবারবর্গের কি অবস্থা তা জানি না।
ড্রেক। তাহাদের নিমিত্ত ফোর্টে স্থান আছে। এখনো বলিতেছ, কি কসুর? কারাগারে কৃষ্ণদাসের নিকট শুনিবে। Who is there?

জনৈক সৈনিকের প্রবেশ

Take them to prison.
কৃষ্ণ। সাহেব—সাহেব—বিনা অপরাধে—
ড্রেক। Damn your eyes, silent you bloody nigger! (সৈনিকের প্রতি) Away with them.
উভয়কে লইয়া সৈনিকদ্বয়ের প্রস্থান
হল। Let’s go and train the recruits.
ড্রেক। Woe me, they have never held a pen-knife!
দূতের প্রবেশ
দূত। হুজুর হুজুর—
ড্রেক। Hang your হুজুর! ক্যা খবর কহো?
দূত। নবাব-সৈন্য ডবল্ কুচে এসে বরাহনগরে ছাউনি পেতেছে।
ড্রেক। Sound bugle. To the Pering point—to the Pering point.
উভয়ের প্রস্থান

  1. পঞ্চম গর্ভাঙ্কের টীকা দেখুন।