সীতার বনবাস/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

লক্ষ্মণ নিষ্ক্রান্ত হইলে পর, রাম ও সীতা, বিশ্রামভবনে প্রবেশ করিয়া, অসঙ্কুচিত ভাবে, অশেষবিধ কথোপকথন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সীতার নিদ্রাকর্ষণের উপক্রম হইল। তখন রাম বলিলেন, প্রিয়ে, যদি ক্লান্তিবোধ হইয়া থাকে, আমার গলদেশে ভুজলতা অর্পিত করিয়া, ক্ষণকাল বিশ্রাম কর। সীতা, কোমল বাহুল্লী দ্বারা, রামের গলদেশ অবলম্বন করিলে, তিনি অনির্বচনীয় স্পর্শসুখের অনুভব করিয়া বলিতে লাগিলেন, প্রিয়ে, তোমার বাহুলতার স্পর্শে আমার সর্ব্ব শরীরে যেন অমৃতধারার বর্ষণ হইতেছে, ইন্দ্রিয় -সকল অভূতপূর্ব্ব রসাবেশে অবশ হইয়া আসিতেছে, চেতনা।: বিলুপ্তপ্রায় হইতেছে; অকস্মাৎ আমার নিদ্রাবেশ, কি মোহাবেশ, উপস্থিত হইল, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। সীতা, রামমুখবিনিঃসৃত অমৃতায়মান বচনপরম্পরা শ্রবণগোচর করিয়া, হাস্যমুখে বলিলেন, নাথ, আপনি চিরানুকূল ও স্থিরপ্রসাদ। যাহা শুনিলাম, ইহা অপেক্ষা, স্ত্রীলোকের পক্ষে, আর কি সৌভাগ্যের বিষয় হইতে পারে! প্রার্থনা এই, যেন চির দিন এইরূপ স্নেহ ও অনুগ্রহ থাকে।  সীতার মৃদু মধুর মোহন বাক্য কর্ণগোচর করিয়া, রাম বলিলেন, প্রিয়ে, তোমার কথা শুনিলে, শরীর শীতল হয়, কর্ণকুহর অমৃতরসে অভিষিক্ত হয়, ইন্দ্রিয় সকল বিমোহিত হয়, অন্তঃকরণের সজীবতা সম্পাদিত হয়। সীতা লজ্জিত হইয়া বলিলেন, নাথ, এই নিমিত্তই সকলে আপনাকে প্রিয়ংবদ বলে। যাহা হউক, অবশেষে এ অভাগিনীর যে। এত সৌভাগ্য ঘটিবে, ইহা স্বপ্নের অগোচর। এই বলিয়া, সীতা শয়নের নিমিত্ত উৎসুক হইলে, রাম বলিলেন, প্রিয়ে, এখানে অন্যবিধ শষ্যার সঙ্গতি নাই; অতএব, যে অনন্যসাধারণ রামবাহু, বিবাহসময় অবধি, কি গৃহে, কি বনে, কি শৈশবে, কি যৌবনে, উপধানস্থানীয় হইয়া আসিয়াছে, আজও সেই তোমার উপধানকার্য্য সম্পন্ন করুক। এই বলিয়া, রাম বাহু প্রসারিত করিলেন; সীতা, তদুপরি মস্তক বিন্যস্ত করিয়া, তৎক্ষণাৎ নিদ্রাগত হইলেন।

 রাম, স্নেহভরে কিয়ৎ ক্ষণ সীতার মুখনিরীক্ষণ করিয়া, প্রীতিপ্রফুল্ল নয়নে বলিতে লাগিলেন, কি চমৎকার। যখনই প্রিয়ার বদনসুধাকরে, দৃষ্টিপাত করি, তখনই আমার চিত্তচকোর চরিতার্থ ও অন্তরাত্মা অনির্বচনীয় আনন্দবসে আপ্লুত হয়। ফলতঃ, ইনি গৃহের লক্ষীস্বরূপা, নয়নের রসাঞ্জনরূপিণী; ইহার স্পর্শ চন্দনরসে অভিষেকস্বরূপ; বাহুলতা; কণ্ঠদেশে বিনিবেশিত হইলে, শীতল মসৃণ মৌক্তিক হারের কার্য্য করে। কি আশ্চর্য্য! প্রিয়ায় সকলই অলৌকিক প্রীতিপ্রদ। রাম মনে মনে এইরূপ আলোচনা করিতেছেন, এমন সময়ে সীতা, নিদ্রাবেশে বলিয়া উঠিলেন; হা নাথ, কোথায় রহিলে।

 সীতার স্বপ্নভাষিত শ্রবণগোচর করিয়া, রাম বলিতে লাগিলেন, কি চমৎকার! চিত্রদর্শনে, প্রিয়ার অন্তঃকরণে যে অতীত বিরহভাবনার আবির্ভাব হইয়াছিল, তাহাই, স্বপ্নে অস্তিত্বপরিগ্রহ করিয়া, যাতনাপ্রদান করিতেছে। এই বলিয়া, সীতার গাত্রে হস্তাবর্ত্তন করিতে করিতে, রাম, প্রেমভরে প্রফুল্লকলেবর হইয়া, বলিতে লাগিলেন, আহা! অকৃত্রিম প্রেম কি পরম পদার্থ! কি সুখ, কি দুঃখ, কি সম্পত্তি, কি বিপত্তি, কি যৌবন, কি বার্দ্ধক্য, সকল অবস্থাতেই একরূপ ও অবিকৃত। ঈদৃশ প্রণয়সুখের অধিকারী হওয়া অল্প সৌভাগ্যের কথা নহে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই, এরূপ প্রণয় জগতে নিতান্ত বিরল ও একান্ত দুর্লভ; যদি এত বিরল ও এত দুর্লভ না হইত, সংসারে সুখের সীমা থাকিত না।

 রামের বাক্য সমাপ্ত না হইতেই, প্রতীহারী, সম্মুখে আসিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, মহারাজ, দুর্মুখ দ্বারদেশে দণ্ডায়মান, কি আজ্ঞা হয়। দুর্মুখ অন্তঃপুরচারী অতি বিশ্বস্ত ভৃত্য। রাম, নূতন রাজ্যশাসন বিষয়ে প্রজা গণের অভিপ্রায় অবগত হইবার নিমিত্ত, তাহাকে নিয়োজিত করিয়াছিলেন। সে, প্রতিদিন, প্রচ্ছন্ন ভাবে, ঐ বিষয়ের অনুসন্ধান করিত, এবং যে দিন যাহা জানিতে পারি, রামের গোচর করিয়া যাইত। এক্ষণে উহাকে সমাগত শুনিয়া, রাম প্রতীহারীকে বলিলেন, হরায় উহারে আমার নিকটে আসিতে বল। দুর্মুখ আসিয়া, প্রণাম করিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। রাম, তাহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হে দুর্মুখ, আজ কি জানিতে পারিয়াছ, বল? দুর্মুখ বলিল, মহারাজ, কি পৌরগণ, কি জনপদগণ, সকলেই বলে, আমরা রামরাজ্যে পরম সুখে আছি।

 এই কথা শুনিয়া, রাম বলিলেন, তুমি প্রতিদিনই প্রশংসা বাদের সংবাদ দিয়া থাক; যদি কেহ কোনও দোষকীর্ত্তন করিয়া থাকে, বল, তাহা হইলে প্রতিবিধানে যত্নবান্‌ হই; আমি, স্তুতিবাদশ্রবণবাসনায় তোমায় অনুসন্ধান করিতে পাঠাই নাই। দুর্মুখ, অন্য অন্য দিন, স্তুতিবাদ মাত্র শুনিয়া আসিত, সুতরাং, যাহা শুনিত, তাহাই অকপটে রামের নিকটে জানাইত। সে দিবস, সীতাসংক্রান্ত দোষকীর্ত্তন শুনিয়া, অপ্রিয়সংবাদপ্রদান অনুচিত, এই বিবেচনায়, গোপন করিয়া রাখিয়াছিল। এক্ষণে, রাম দোষকীর্ত্তনকথার উল্লেখ করিবামাত্র, সে চকিত ও হতবুদ্ধি হইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিল; পরে, কথঞ্চিৎ বুদ্ধি স্থির করিয়া, শুষ্ক মুখে বিকৃত স্বরে বলিল, না মহারাজ, আমি কোনও দোষকীর্ত্তন শুনিতে পাই নাই। সে এই রূপে অপলাপ করিল বটে; কিন্তু, তাহার আকারপ্রকার দর্শনে, রামের অন্তঃকরণে বিষম সন্দেহ, উপস্থিত হইল। তখন তিনি, সাতিশয় চলচিত্ত হইয়া, আকুল বচনে বলিতে লাগিলেন, তুমি অবশ্যই দোষকীর্ত্তন শুনিয়াছ, অপলাপ করিতেছ কেন? কি শুনিমাছ বল, বিলম্ব করিও না; না বলিলে, আমি যার পর নাই অসন্তুষ্ট হইব, এবং, এ জন্মে, আর তোমার মুখাষলোকন করিব না।

 রামের নির্ব্বন্ধাতিশয় দর্শনে সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া, দুর্মুখ মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, আমি কি বিষম সঙ্কটে পড়িলাম! কি রূপে রাজমহিষীসংক্রান্ত জনাপবাদ মহারাজের গোচর করিব? আমি অতি হতভাগ্য, নতুবা এরূপ কার্য্যের ভারগ্রহণ করিব কেন? কিন্তু যখন, অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া, ভারগ্রহণ করিয়াছি, তখন প্রভুর নিকটে, অকপটে, প্রকৃত কথাই বলা উচিত। এই স্থির করিয়া, সে কম্পিতকলেবর হইয়া বলিল, মহারাজ, যদি আমায় সকল কথা যথার্থ বলিতে হয়, আপনি গাত্রোখান করিয়া গৃহান্তরে চলুন; আমি সে সকল কথা, প্রাণান্তেও, এখানে বলিতে পারিব না। রাম, শুনিবার নিমিত্ত, এত উৎসুক হইয়াছিলেন যে, সীতার জাগরণ পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিতে পারিলেন না; আস্তে আস্তে, আপন হস্ত হইতে তাঁহার মস্তক নাইলেন, এবং, দুর্মুখকে সমভিব্যাহারে লইয়া, সত্বর সন্নিহিত গৃহান্তরে প্রবেশ করিলেন।

 এই রূপে গৃহান্তরে উপস্থিত হইয়া, রাম, সাতিশয় ব্যগ্রতাপ্রদর্শন পূর্ব্বক, দুর্মুখকে বলিলেন, বিলম্ব করিও না, কি শুনিয়াছ, বিশেষ করিয়া বল; তোমার আকার প্রকার দেখিয়া, আমার অন্তঃকরণে নানা সংশয় উপস্থিত হইতেছে। সে বলিল, মহারাজ, যে সর্ব্বনাশের কথা শুনিয়াছি, তাহা মহারাজের নিকট বলিতে হইবে এই মনে করিয়া, আমার সর্ব্ব শরীরের শোণিত শুষ্ক হইয়া যাইতেছে। কিন্তু যখন, পূর্ব্বাপর পর্য্যালোচনা না করিয়া, ওরূপ কার্য্যের ভার লইয়াছি, তখন অবশ্যই বলিতে হইবে। আমি যেরূপ শুনিয়াছি, নিবেদন করিতেছি, আমার অপরাধগ্রহণ করিবেন না। মহারাজ, প্রায় সকলেই, একবাক্য হইয়া, অশেষ প্রকারে, সুখ্যাতি করিয়া বলে, আমরা রামরাজ্যে পরম সুখে বাস করিতেছি; কোনও রাজা, কোশল দেশে, শাসনের এরূপ সুপ্রণালী প্রবর্ত্তিত করিতে পারেন নাই। কিন্তু, কেহ কেহ, রাজমহিষীর উল্লেখ করিয়া, কুৎসা করিয়া থাকে। তাহারা বলে, “আমাদের রাজার চিত্ত বড় নির্বিকার; একাকিনী সীতা এত কাল রাবণগৃহে রহিলেন; তিনি, তাহাতে কোনও দ্বৈধ বা দোষবোধ না করিয়া, অনায়াসে তাঁহারে গৃহে আনিলে। অতঃপর, আমাদের গৃহে স্ত্রীলোকদিগের চরিত্রে দোষ ঘটিলে, তাহাদের শাসন করা সহজ হইবে না; শাসন করতে গেলে, তাহারা, রাজমহিষীর উল্লেখ করিয়া, আমাদিগকে নিরুত্তর করিবে। অথবা, রাজা ধর্মাধর্ম্মের কর্ত্তা; তিনি যে ধর্ম অনুসারে চলিবেন, আমরা প্রজা, আমাদিগকেও, সেই ধর্ম্ম অবলম্বন করিয়া, চলিতে হইবে।” মহারাজ, যাহা শুনিয়াছিলাম, অবিকল নিবেদন করিলাম, আমার অপরাধমার্জ্জনা করিবেন। হা বিধাতঃ! এত দিনের পর, তুমি আমার দুমুখনাম অর্থ করিয়া দিলে! এই বলিয়, বিদায় লইয়া, রোদন করিতে করিতে, দুর্মুখ তথা হইতে প্রস্থান করিল।

 দুর্মুখমুখে সীতাসংক্রান্ত অপবাদবৃত্তান্ত শ্রবণগোচর করিয়া, রাম, হা হতোহস্মি বলিয়া, ছিন্ন তরুর ন্যায়, ভূতলে পতিত হইলেন, এবং গলদশ্রু লোচনে, আকুল বচনে, বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, হায়! কি সর্ব্বনাশের কথা শুনিলাম। ইহা অপেক্ষা, আমার বক্ষঃস্থলে বজ্রাঘাত হওয়া ভাল ছিল। কি জন্য এখনও জীবিত রহিয়াছি। আমি নিতান্ত হতভাগ্য; নতুবা, কি নিমিত্তে, উপস্থিত রাজাধিকার বিসর্জন দিয়া, আমায় বনবাস আশ্রয় করিতে হইয়াছিল? কি নিমিত্তেই দুর্বৃত্ত দশানন, পঞ্চবটীতে প্রবেশ পূর্ব্বক, প্রাণপ্রিয়া জানকীরে লইয়া গিয়া, নির্মল রঘুকুল অভূতপূর্ব্ব অপবাদে দূষিত করিয়াছিল? কি নিমিত্তেই বা, সেই অপবাদ, অদ্ভুত উপায় দ্বারা নিঃসংশয়িতরূপে অপসারিত, হইয়াও, দৈবদুর্বিপাক বশতঃ পুনর্বার নবীভূত হইয়া, সর্ব্বতঃ সঞ্চারিত হইবে? সর্ব্বথা, আমার জন্মগ্রহণ ও শরীরধারণ দুঃখভোগের নিমিত্তেই নিরূপিত হইয়াছিল। এখন কি করি, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। এই লোকাপবাদ দুর্নিবার হইয়া উঠিয়াছে। এক্ষণে, অমূলক বলিয়া, এই অপবাদে উপেক্ষাপ্রদর্শন করি; অথবা, এ জন্মের মত নিরপরাধ জানকীরে বিসর্জন দিয়া, কুলের কলঙ্কবিমোচন করি; কি করি, কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। কেহ কখনও আমার মত উভয় সঙ্কটে পড়ে না।

 এইরূপ আক্ষেপ করিয়া, রাম, কিয়ৎ ক্ষণ, অধোদৃষ্টিতে মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন। অনন্তর দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগ পূর্ব্বক বলিলেন, অথবা এ বিষয়ে আর কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্যবিবেচনার প্রয়োজন নাই। যখন রাজ্যের ভারগ্রহণ করিয়াছি, সর্ব্বোপায়ে লোকরঞ্জন করাই আমার কর্ত্তব্য কর্ম্ম ও প্রধান ধর্ম্ম; সুতরাং, জানকীরেই বিসর্জন দিতে হইল। হা হত বিধে! তোমার মনে এই ছিল। এই বলিয়া, রাম মুর্চ্ছিত ও ভূতলে পতিত হইলেন।

 কিয়ৎ ক্ষণ পরে চেতনাসঞ্চার হইলে, রাম নিতান্ত করুণ স্বরে বলিতে লাগিলেন, যদি আর আমার চেতনা না হইত, আমার পক্ষে সর্ব্বাংশে শ্রেয়স্কর হইত; নিরপরাধ জানকীয়ে বিসর্জন দিয়া, দুরপনেয় পাপপঙ্কে লিপ্ত হইতে হইত না। এই মাত্র, অষ্টাবক্রের সমক্ষে, প্রতিজ্ঞা করিলাম, যদি লোকরূঞ্জনের অনুরোধে, জানকীরেও বিসর্জন দিতে হয়, তাহাও করিব। এরূপ ঘটিবে বলিয়াই কি, আমার মুখ হইতে তাদৃশ বিষম প্রতিজ্ঞাবাক্য নিঃসৃত হইয়াছিল। হা প্রিয়ে জানকি! হা প্রিয়বাদিনি! হা রামময়জীবিতে! হা অরণ্যবাসসহচরি! পরিণামে তোমার যে এরূপ অবস্থা ঘটিবে তাহা স্বপ্নের অগোচর। তুমি এমন দুরাচারের, এমন নরাধমের, এমন হতভাগ্যের হস্তে পড়িয়াছিলে, যে, কিঞ্চিৎ কালের নিমিত্তও, তোমার ভাগ্যে সুখভোগ ঘটিয়া উঠিল না। তুমি, চন্দনতরুবোধে, দুর্বিপাক বিষবৃক্ষের আশ্রয়গ্রহণ করিয়াছিলে। আমি পরম পবিত্র রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছি বটে; কিন্তু আচরণে চণ্ডাল অপেক্ষা সহস্র গুণে অধম; নতুবা, ‘বিনা অপরাধে, তোমায় বিসর্জন দিতে উদ্যত হইব কেন? হায়! যদি এই মুহূর্ত্তে আমার প্রাণবিয়োগ ঘটে, তাহা হইলে, আমি পরিত্রাণ পাই। আর বাঁচিয়া ফল কি; আমার জীবিত প্রয়োজন পর্য্যবসিত হইয়াছে; জগৎ ‘ শূন্য ও জীর্ণ অরণ্য প্রায় প্রতীয়মান হইতেছে।

 এইরূপ বলিতে বলিতে, একান্ত আকুলহৃদয় ও কম্পমানকলেবর হইয়া, রাম কিয়ৎ ক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন; অনন্তর, দীর্ঘ নিশ্বাস সহকারে, হায়! কি হইল বলিয়া, নিরতিশয় কাতর বাক্যে বলিতে লাগিলেন,—হা মাতঃ! হা তাত জনক! হা দেবি বসুন্ধরে! হা ভগবতি অরুন্ধতি! হা কুলগুরো বশিষ্ঠ! হা ভগবন্‌ বিশ্বামিত্র! প্রিয়বন্ধো বিভীষণ! হা পরমোপকারিন্‌ সখে সুগ্রীব! হা বৎস অঞ্জনা হৃদয়নন্দন! তোময়া কোথায় রহিয়াছ, কিছুই জানিতে পারিতেছ না; এখানে দুরাত্মা রাম তোমাদের সর্ব্বনাশে উদ্যত হইয়াছে। অথবা, আর আমি তাদৃশ মহাত্মাদিগের নামগ্রহণে অধিকারী নহি; আমার ন্যায় মহাপাতকী নামগ্রহণ করিলে, নিঃসন্দেহ তাঁহাদের পাপস্পর্শ হইবে। আমি যখন সরলহৃদয়া, শুদ্ধচারিণী, পতিপ্রাণা কামিনীরে, নিতান্ত নিরপরাধ জানিয়াও অনায়াসে বিসর্জন দিতে উদ্যত হইয়াছি, তখন আমা অপেক্ষা মহাপাতকী আর কে আছে? হা রামময়জীবিতে! পাষাণময় নৃশংস রাম হইতে, পরিণামে তোমার যে এরূপ দুর্গতি ঘটিবে, তাই তুমি স্বপ্নেও ভাব নাই। নিঃসন্দেহ, রামের হৃদয় বজ্রলেপময়; নতুবা এখনও বিদীর্ণ হইতেছে না কেন? অথবা, বিধাতা, জানিয়া শুনিয়াই, আমায় ঈদৃশ কঠিনহৃদয় করিয়াছেন; তাহা না হইলে; অনায়াসে এরূপ নৃশংস কর্ম্ম সম্পন্ন করিতে পারিব কেন?  এই বলিয়া, গলদশ্রু নয়নে, বিশ্রামভবনে প্রতিগমন পূর্ব্বক, রাম, নিদ্রাভিভূতা সীতার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন; এবং অঞ্জলিবন্ধন পূর্ব্বক, সাতিশয় করুণ স্বরে সমোধন করিয়া বলিলেন, প্রিয়ে, হতভাগ্য রাম, এ জন্মের মত, বিদায় হইতেছে। এই বলিয়া, দুর্বিষহ শোকাহনে দগ্ধহৃদয় হইয়া, রাম গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন, এবং অনুজগণের সহিত পরামর্শ করিয়া কর্ত্তব্যনিরূপণের নিমিত্ত, মন্ত্রভবন অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।