সীতার বনবাস/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সীতার বনবাস।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

রাম রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন, এবং অপ্রতিহত প্রভাবে রাজ্যশাসন, ও অপত্যনির্বিশেষে প্রজাপালন, করিতে লাগিলেন। তাঁহার শাসনগুণে, স্বল্প সময়েই, সমস্ত কোশলরাজ্য সর্ব্বত্র সর্ব্বপ্রকার সুখসমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। ফলতঃ, তদীয় অধিকারকালে, প্রজালোকের সর্ব্বাংশে যাদৃশ সৌভাগ্যসঞ্চার ঘটিয়াছিল, ভূমণ্ডলে, কোনও কালে, কোনও রাজার শাসনসময়ে, সেরূপ লক্ষিত হয় নাই। তিনি, প্রতিদিন, যথাকালে, অমাত্যবর্গে পরিবৃত হইয়া, অবহিত চিত্তে রাজকার্য্যের পর্যালোচনা করিতেন; অবশিষ্ট সময়, ভ্রাতৃত্রয়ের ও জনকতনয়ার সহবাসসুখে, অতিবাহিত হইত।

 কালক্রমে, জানকীর গর্ভলক্ষণ আবির্ভূত হইল। তদ্দর্শনে, রামের ও রামজননী কৌশল্যার আহ্লাদের সীমা রহিল না; সমস্ত রাজভবন উৎসবে পূর্ণ হইল; পুরবাসিগণ, অচিরে রাজকুমার দেখিব, এই মনের উল্লাসে, স্ব স্ব আবাসে, অশেষবিধ উৎসবক্রিয়া করিতে লাগিল।  কিয়ৎ দিন পরে, মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গ যজ্ঞাবশেষের অনুষ্ঠান করিলেন। রাজা রামচন্দ্র, পরিবারবর্গের সহিত তদীয় ‘আশ্রমে উপস্থিত হইবার নিমিত্ত, নিমন্ত্রিত হইলেন। এই সময়ে জানকীর গর্ভ প্রায় পূর্ণ অবস্থায় উপস্থিত; এজন্য তিনি এবং তদনুরোধে রাম ও লক্ষণ, নিমন্ত্রণরক্ষা করিতে পারিলেন না; কেবল বৃদ্ধ মহিষীরা, বশিষ্ট ও অরুন্ধতী সমভিব্যাহারে, জামাতৃষজ্ঞে গমন করিলেন। তাঁহারাও, পূর্ণগর্ভা জানকীরে গৃহে রাখিয়া, তথায় যাইতে, কোনও মতে, সম্মত ছিলেন না; কেবল, জামাতৃকৃত নিমন্ত্রণের উল্লঙ্ঘন সর্ব্বথা অবিধেয়, এই বিবেচনায়, নিতান্ত অনিচ্ছা পূর্ব্বক, যজ্ঞদর্শনে গমন করেন।

 কতিপয় দিবস পূর্ব্বে, রাজা জনক তনয়া ও জামাতাকে দেখিবার নিমিত্ত, অযোধ্যায় আসিয়াছিলেন। তিনি, কৌশল্যাপ্রভৃতির নিমন্ত্রণগমনের অব্যবহিত পরেই, মিথিলায় প্রতিগমন করিলেন। প্রথমতঃ শ্বশ্রূজনবিরহ, তৎপরেই পিতৃবিরহ, উভয় বিরহে জানকী একান্ত শোকাকুলা হইলেন। পূর্ণগর্ভ অবস্থায় শোকমোহাদি দ্বারা অভিভূত হইলে, অনিষ্টাপাতের বিলক্ষণ সম্ভাবনা; এজন্য রামচন্দ্র, সর্ব্বকর্ম্মপরিত্যাগ পূর্ব্বক সীতার সান্ত্বনার নিমিত্ত, সতত, তৎসন্নিধানে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।

 এক দিবস, রামচন্দ্র জানকীসমীপে উপবিষ্ট আছেন; এমন সময়ে, প্রতীহারী আসিয়া বিনয়নম্র বচনে নিবেদন করিল, মহারাজ, মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রম হইতে সংবাদ লইয়া, অষ্টাবক্র মুনি আসিয়াছেন। রাম ও জানকী, শ্রবণমাত্র; অতিমাত্র ব্যগ্র হইয়া বলিলেন, তাঁহাকে ত্বরায় এই স্থানে আন। প্রতীহারী, তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্রস্থান পূর্ব্বক, পুনর্বার অষ্টাবক্র সমভিব্যাহারে তাঁহাদের সম্মুখে উপস্থিত হইল। অষ্টাবক্র, দীর্ঘায়ুরস্তু বলিয়া, হস্ত তুলিয়া আশীর্বাদ করিলেন। রাম ও জানকী প্রণাম করিয়া বসিতে আসনপ্রদান করিলেন। তিনি উপবিষ্ট হইলে, রাম জিজ্ঞাসিলেন, ভগবান্ ঋষ্যশৃঙ্গের কুশল? তাঁহার যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইতেছে? সীতাও জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন, আমার গুরুজন ও আর্য্যা শান্তা সকলে কুশলে আছেন? তাঁহারা আমাদিগকে মনে করেন, না এক বারেই ভুলিয়া গিয়াছেন?

 অষ্টাবক্র, সকলের কুশলবার্ত্তাবিজ্ঞাপন করিয়া সমুচিত সম্ভাষণ পূর্ব্বক, জানকীকে বলিলেন, দেবি ভগবান্ বশিষ্ঠ, দেব আপনারে বলিয়াছেন, ভগবতী বিশ্বম্ভরা দেবী তোমায় প্রসব করিয়াছেন; সাক্ষাৎ প্রজাপতি রাজা জনক তোমার পিতা; তুমি সর্ব্বপ্রধান রাজকুলের বধূ হইয়াছ; তোমার বিষয়ে আর কোনও প্রার্থয়িতব্য দেখিতেছি না; অহোরাত্র এইমাত্র প্রার্থনা করিতেছি, তুমি বীরপ্রসবিনী হও। সীতা শুনিয়া লজ্জায় কিঞ্চিৎ সঙ্কুচিত হইলেন। রাম যার পর নাই হর্ষিত হইয়া বলিলেন, ভগবান্ বশিষ্ঠ দেব যখন এরূপ আশীর্বাদ করিতেছেন, তখন অবশ্যই আমাদের মনোরথ সম্পন্ন হইবে। অনন্তর, অষ্টাবক্র রামচন্দ্রকে বলিলেন, মহারাজ, ভগবতী অরুন্ধতী দেবী, বৃদ্ধ মহিষীগণ ও কল্যাণিনী শান্তা ভূয়োভূয়ঃ বলিয়াছেন, সীতা দেবী যখন যে অভিলাষ করিবেন, যেন তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদিত হয়। রাম বলিলেন, আপনি তাঁহাদিগকে আমার প্রণাম জানাইয়া বলিবেন, ইনি যখন, যে অভিলাষ করিতেছেন, তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদিত হইতেছে; সে বিষয়ে আমার, এক মুহূর্ত্তের জন্যও আলস্য বা ঔদাস্য নাই।

 অনন্তর অষ্টাবক্র বলিলেন, দেবি জানকি, ভগবান ঋষ্যশৃঙ্গ সাদর ও সস্নেহ সম্ভাষণ পূর্ব্বক বলিয়াছেন, বৎসে, তুমি পূর্ণগর্ভা, এজন্য তোমায় আনিতে পারি নাই, তন্নিমিত্ত আমি যেন তোমার বিরাগভাজন না হই; আর, রাম ও লক্ষণকে তোমার চিত্তবিনোদনার্থে রাখিতে হইয়াছে; আরব্ধ যজ্ঞ সমাপিত হইলেই, আমরা সকলে, অযযাধ্যায় গিয়া, তোমার ক্রোড়দেশ এক বারে নব কুমারে সুশোভিত দেখিব।, রাম শুনিয়া, স্মিতমুখ ও হৃষ্টচিত্ত হইয়া, অষ্টাবক্রকে জিজ্ঞাসিলেন, ভগবান্ বশিষ্ঠ দেব আমার প্রতি কোনও আদেশ করিয়াছেন? অষ্টাবক্র বলিলেন, মহারাজ, বশিষ্ঠ দেব আপনারে বলিয়াছেন, বৎস, জামাতৃযজ্ঞে রুদ্ধ হইয়া, আমাদিগকে, কিছু দিন, এই স্থানে অবস্থিতি করিতে হইবে। তুমি বালক, অল্প দিন মাত্র, রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছ; প্রজারঞ্জনকার্য্য সর্ব্বদা অবহিত থাকিবে; প্রজারঞ্জনসম্ভূত নির্মল কীর্ত্তিই রঘুবংশীয়দিগের পরম ধন। রাম বলিলেন, আমি ভগবানের এই আদেশে সবিশেষ অনুগৃহীত হইলাম; তাঁহার আদেশ ও উপদেশ সর্ব্বদাই আমার শিরোধার্য্য। আপনি তাঁহার চরণারবিন্দে, আমার সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত জানাইয়া বলিবেন, যদি প্রজালোকের সর্ব্বাঙ্গীণ অনুরঞ্জনের জন্য, আমার স্নেহ, দয়া, বা সুখভোগ বিসর্জ্জন দিতে হয়, অথবা প্রাণপ্রিয়া জানকীর মায়াপরিত্যাগ করিতে হয়, তাহাতেও আমি কিছুমাত্র কাতর হইব না। তিনি যেন সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বেগ থাকেন; আমি প্রজারঞ্জনকার্য্যে, ক্ষণ কালের জন্যও, অলস বা অনবহিত নহি। সীতা শুনিয়া সাতিশয় হর্ষিত হইয়া বলিলেন, এরূপ না হইলেই বা, আর্যপুত্র রঘুকুলধুরন্ধর হইবেন কেন?

 অনন্তর, রামচন্দ্র সন্নিহিত পরিচারকের প্রতি অষ্টাবক্রকে বিশ্রাম করাইবার আদেশ প্রদান করিলেন। অষ্টাবক্র, সমুচিত সম্ভাষণ ও আশীর্বাদপ্রয়োগ পূর্ব্বক বিদায় লইয়া, বিশ্রামার্থ প্রস্থান করিলে, রাম ও জানকী পুনরায় কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইতেছেন, এমন সময়ে, লক্ষণ আসিয়া বলিলেন, আর্য্য, আমি এক চিত্রকরকে আপনার চরিত্র চিত্রিত করিতে বলিয়াছিলাম; সে এই আলেখ্য প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছে, অবলোকন করুন। রাম বলিলেন, বৎস, দেবী দুর্মনায়মানা হইলে, কি রূপে তাঁহার চিত্তবিনোদন করিতে হয়, তাহা তুমিই বিলক্ষণ জান; তা জিজ্ঞাসা করি, এই চিত্রপটে কি পর্য্যন্ত চিত্রিত হইয়াছে? লক্ষণ, বলিলেন, আর্য্যা জানকীর অগ্নিপরিশুদ্ধিকাণ্ড পর্য্যন্ত।

 রাম শুনিয়া সাতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া বলিলেন, বৎস, তুমি আমার সমক্ষে আর ও কথা মুখে আনিও না; ও কথা শুনিলে, অথবা মনে হইলে, আমি সাতিশয় কুণ্ঠিত ও লজ্জিত হই। কি আক্ষেপের বিষয়! যিনি জন্মপরিগ্রহ করাতে জগৎ পবিত্র হইয়াছে, তাঁহাকে আবার অন্য পাবন দ্বারা পূত, করিতে হইয়াছিল। হায়! লোকরঞ্জন কি দুরূহ ব্রত। সীতা বলিলেন, নাথ, সে সকল কথা মনে করিয়া, আপনি ‘অকারণে ক্ষুব্ধ হইতেছেন কেন? আপনি তৎকালে সদ্বিবেচনার কর্ম্মই করিয়াছিলেন; সেরূপ না করিলে, চিরনির্মল রঘুকুলে কলঙ্কস্পর্শ হইত, এবং আমারও অপবাদবিমোচন হইত না। সীতার বাক্য শ্রবণগগাচর করিয়া, রামচন্দ্র দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগ পূর্ব্বক বলিলেন, প্রিয়ে, আর ও কথায় কাজ নাই; এস, আলেখ্য দেখি।

 সকলে আলেখ্যদর্শনে প্রবৃত্ত হইলেন। সীতা, কিয়ৎ ক্ষণ, ইতস্ততঃ - দৃষ্টিসঞ্চারণ করিয়া জিজ্ঞাসিলেন, নাথ, আলেখ্যের উপরিভাগে ঐ সমস্ত কি চিত্রিত রহিয়াছে? রাম বলিলেন, প্রিয়ে, ও সকল সমন্ত্রক জৃস্তক অস্ত্র। ব্রহ্মাদি প্রাচীন গুরুগণ, বেদরক্ষার নিমিত্ত, দীর্ঘ কাল তপস্যা করিয়া, ঐ সকল তপোময় তেজঃপুঞ্জ পরম অস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। গুরুপরম্পরায় ভগবান কৃশাশ্বের নিকট সমাগত হইলে, রাজর্ষি বিশ্বামিত্র তাঁহার নিকট হইতে ঐ সমস্ত মহাস্ত্র পাইয়াছিলেন। পরম কৃপালু রাজর্ষি, সবিশেষ কৃপাপ্রদর্শন পূর্ব্বক, তাড়কানিধনকালে আমায় তৎসমুদয় দিয়াছিলেন। তদবধি, উহারা আমার অধিকারে আছে, তোমার পুত্র হইলে তাহাদের আশ্রয়গ্রহণ করিবে।

 লক্ষ্মণ বলিলেন, দেবি, এ দিকে মিথিলাবৃত্তান্তে দৃষ্টিপাত করুন। সীতা দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, তাই ত, ঠিক যেন আর্য্যপুত্র হরধনু উত্তোলিত করিয়া ভাঙ্গিতে উদ্যত হইয়াছেন, আর পিতা আমার, বিস্ময়াপন্ন হইয়া, অনিমিষ নয়নে নিরীক্ষণ করিতেছেন। আ মরি মরি! কি চমৎকার চিত্র করিয়াছে। আবার, এ দিকে বিবাহকালীন সভা; সেই সভায় তোমরা চারি ভাই, তৎকালোচিত বেশ ভূষায় অলঙ্কৃত হইয়া, কেমন শোভা পাইতেছ! চিত্র দেখিয়া বোধ হইতেছে, যেন সেই প্রদেশে ও সেই সময়ে বিদ্যমান রহিয়াছি। শুনিয়া, পূর্ব্ব বৃত্তান্ত স্মৃতিপথে আরূঢ় হওয়াতে, রাম বলিলেন, প্রিয়ে, যথার্থ বলিয়াছ, যখন মহর্ষি শতানন্দ তোমার কমনীয় কোমল করপল্লব, আমার করে সমর্পিত করিয়াছিলেন, যেন সেই সময় বর্ত্তমান রহিয়াছে।

 চিত্রপটের স্থলান্তরে অঙ্গুলিনির্দ্দেশ করিয়া, লক্ষণ বলিলেন, এই আর্য্যা, এই আর্য্যা মাণ্ডবী, এই বধু শ্রুতকীর্ত্তি; কিন্তু তিনি, লজ্জাবশতঃ, ঊর্ম্মিলার উল্লেখ করিলেন না। সীতা বুঝিতে পারিয়া, কৌতুক করিবার নিমিত্ত, হাস্যমুখে উর্মিলার দিকে অঙ্গুলিপ্রয়োগ করিয়া, লক্ষ্মণকে জিজ্ঞাসিলেন, বৎস, এ দিকে এ কে চিত্রিত রহিয়াছে? লক্ষ্মণ, কোনও উত্তর না দিয়া, ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, দেবি, দেখুন দেখুন, হরশাসনের ভঙ্গবার্ত্তাশ্রবণে ক্রোধে অধীর হইয়া, ক্ষত্রিয়কুলান্তকারী ভগবান্ ভৃগুনন্দন, আমাদের অযোধ্যাগমনপথ রুদ্ধ করিয়া দণ্ডায়মান আছেন; আর, এ ‘ দিকে দেখুন, ভুবনবিজয়ী আর্য্য, তাঁহার দর্পসংহার করিবার নিমিত্ত, শরাসনে শরসন্ধান করিয়াছেন। রাম আত্মপ্রশংসাবাদশ্রবণে অতিশয় লজ্জিত হইতেন; এজন্য বলিলেন, লক্ষ্মণ, এই চিত্রে আর আর নানা দর্শনীয় আছে, ঐ অংশ লইয়া আন্দোলন করিতেছ কেন? সীতা রামবাক্যশ্রবণে আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, নাথ, এমন না হইলে, সংসারের ললাকে, একবাক্য হইয়া, আপনার এত প্রশংসা করিবে কেন?

 তৎপরেই অযোধ্যাপ্রবেশকালীন চিত্র নেত্রপথে পতিত হওয়াতে, রাম অশ্রুপূর্ণ লোচনে গদগদ বচনে বলিতে লাগিলেন, আমরা বিবাহ করিয়া আসিলে, কত উৎসবে দিনপাত হইয়াছিল; পিতৃদেবের কতই আমোদ, কতই আহ্লাদ; মাতৃদেবীরা, অভিনব বধূদিগকে পাইয়া, কেমন আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়াছিলেন; সতত, তাহাদের প্রতি কতই যত্ন, কতই বা মমতাপ্রদর্শন, করিতেন; রাজভবন নিরন্তর আহ্লাদময় ও উৎসবপূর্ণ হইয়াছিল। হায়! সে সকল কি আহ্লাদের, কি উৎসবের, দিনই গিয়াছে! লক্ষণ বলিলেন, আর্য্য, এই মন্থরা। রাম, মন্থরার নামশ্রবণে অন্তঃকরণে বিরক্ত হইয়া, কোনও উত্তর নাদিয়া, অন্য দিকে দৃষ্টিসঞ্চারণ পূর্ব্বক বলিলেন, প্রিয়ে, দেখ দেখ, শৃঙ্গবের নগরে, যে তাপসতরুর তলে, পরম বন্ধু নিষাদপতির সহিত সমাগম হইয়াছিল, উহা কেমন সুন্দর চিত্রিত হইয়াছে!

 সীতা দেখিয়া হর্ষ প্রদর্শন করিয়া বলিলেন, নথি, এ দিকে জটাবন্ধন ও বক্ললধারণ কেমন সুন্দর চিত্রিত হইয়াছে, দেখুন। লক্ষ্মণ আক্ষেপ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “ইক্ষ্বাকুবংশীয়েরা, বৃদ্ধবয়সে, পুত্রহস্তে রাজ্যভার ন্যস্ত করিয়া, অরণ্যে বাস করেন; কিন্তু আর্য্যকে, বাল্যকালেই, কঠোর আরণ্য ব্রত অবলম্বন করিতে হইয়াছিল। অনন্তর, তিনি রামকে বলিলেন, আর্য্য, মহর্ষি ভরদ্বাজ, আমাদিগকে চিত্রকূটে যাইবার পথ দেখাইয়া দিয়া, যাহার কথা বলিয়াছিলেন, এই সেই কালিন্দীতটবর্ত্তী বটবৃক্ষ। তখন সীতা বলিলেন, কেমন নাথ, এই প্রদেশের কথা মনে হয়? রাম বলিলেন, প্রিন্স, কেমন করিয়া বিস্মৃত হইব? এই স্থলে তুমি, পথশ্রমে ক্লাহ ও কাতর হইয়া, আমার বক্ষঃস্থলে মস্তক দিয়া, নিদ্রা গিয়াছিলে।

 সীতা অন্য দিকে অঙ্গুলিনির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন, নাথ, দেখুন দেখুন, এ দিকে আমাদের দক্ষিণারণ্যপ্রবেশ কেমন সুন্দর চিত্রিত হইয়াছে। আমার স্মরণ হইতেছে, এই স্থানে আমি সূর্য্যের প্রচণ্ড উত্তাপে নিতান্ত ক্লান্ত হইলে, আপনি, হস্তস্থিত তালবৃন্ত আমার মস্তকের উপর ধরিয়া, আতপ নিবারণ করিয়াছিলেন। রাম বলিলেন, প্রিয়ে, এই সেই সকল গিরিতরঙ্গিণীতীরবর্ত্তী তপোবন; গৃহস্থগণ, বানপ্রস্থধর্ম্ম অবলম্বন পূর্ব্বক, সেই সেই তপোবনের তরুতলে কেমন বিশ্রামসুখসেবায় সময়াতিপাত করিতেছেন। লক্ষণ বলিলেন, আর্য্য, এই সেই জনস্থানমধ্যবর্ত্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরমগুলীর যোগে, নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কত; অধিত্যকা প্রদেশ ঘন সন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল, ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী, তরঙ্গবিস্তার করিয়া, প্রবল বেগে গমন করিতেছে। রাম বলিলেন, প্রিয়ে, তোমার স্মরণ হয়, এই স্থানে কেমন মনের সুখে ছিলাম। আমরা কুটীরে থাকিতাম; লক্ষ্মন, ইতস্ততঃ পর্য্যটন করিয়া, আহারোপযোগী ফল মুল প্রভৃতির। আহরণ করিতেন; গোদাবরীতীরে মৃদু মন্দ গমনে ভ্রমণ করিয়া, আমরা, প্রাহ্নে ও অপরাত্নে, শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের, সেবন করিতাম। হায়! তেমন অবস্থায় থাকিয়াও, কেম সুখে সময় অতিবাহিত হইয়াছিল।

 লক্ষণ আলেখ্যের অপর অংশে অঙ্গুলিয়োগ করিয়া বলিলেন, আর্য্যে, এই পঞ্চবটী, এই শূর্পণখা। মুগ্ধস্বভাব সীতা, যেন যথার্থই পূর্ব্ব অবস্থা উপস্থিত হইল, এইরূপ ভাবিয়া, ম্লান বদনে বলিলেন, হা নাথ, এই পর্য্যন্তই দেখা শুনা শেষ হইল। রাম হাস্যমুখে সান্ত্বনা করিয়া বলিলেন, অয়ি বিয়োগকাতরে, এ চিত্রপট, বাস্তবিক পঞ্চবটী অথবা পাপীয়সী শূর্পণখা নহে। লক্ষ্মণ ইতস্ততঃ দৃষ্টিসঞ্চারণ করিয়া বলিলেন, কি আশ্চর্য্য! চিত্রদর্শনে চিরাতীত, জনস্থানবৃত্তান্ত বর্তমানবৎ প্রতীয়মান হইতেছে! দুরাচার মারীচ, হিরন্ময় মৃগের আকৃতিধারণ করিয়া, যে অতি বিষম অনর্থ ঘটাইয়াছিল, যদিও সম্পূর্ণ বৈরনির্যাতন দ্বারা তাহার যথোচিত প্রতিবিধান হইয়াছে, তথাপি স্মৃতিপথে আরূঢ় হইলে, মর্ম্মবেদনাপ্রদান করে। এই ঘটনার পর, আর্য্য মানবসমাগমশূন্য জনস্থান ভূভাগে, বিকলচিত্ত হইয়া, যেরূপ কাতরভাবাপন্ন হইয়াছিলেন, তাহা অবলোকিত হইলে, পাষাণও দ্রবীভূত। হয়, বজ্রেরও হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়।  সীতা, লক্ষ্মণের মুখে এই সকল কথা শুনিয়া, অশ্রুপূর্ণ নয়নে, মনে মনে বলিতে লাগিলেন, হায়! এ অভাগিনীর জন্য, আর্য্যপুত্রকে কতই ক্লেশভোগ করিতে হইয়াছিল। সেই সময়ে, রামেরও নয়নযুগল হইতে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্য, চিত্র দেখিয়া, আপনি এত শোকাভিভূত হইতেছেন কেন? রাম বলিলেন, বৎস, তৎকালে আমার যে বিষম অবস্থা ঘটিয়াছিল, যদি বৈরনির্যাতনসঙ্কল্প অনুক্ষণ অন্তঃকরণে জাগরূক না থাকিত, তাহা হইলে, আমি, কখনই প্রাণধারণ করিতে পারিতাম। চিত্রদর্শনে সেই অবস্থার স্মরণ হওয়াতে, বোধ হইল, যেন আমার হৃদয়ের গ্রন্থি সকল শিথিল হইয়া গেল। তুমি সকলই স্বচক্ষে দেখিয়াছ; এখন অনভিজ্ঞের মত কথা বলিতেছ কেন!

 লক্ষ্মণ শুনিয়া কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত ও লজ্জিত হইলেন; এবং, বিষয়ান্তরের সংঘটন দ্বারা, রামের চিত্তবৃত্তির ভাবান্তরসম্পাদন আবশ্যক বিবেচনা করিয়া বলিলেন, আর্য্য, এ দিকে দণ্ডকারণ্যভূভাগ দৃষ্টিগোচর করুন; এই স্থানে দুর্দ্ধর্ষ কবন্ধ রাক্ষসের বাস ছিল; এ দিকে ঋষ্যমুক পর্ব্বতে মতঙ্গমুনির আশ্রম; এই সেই সিদ্ধ শবরী শ্রমণা; এই এ দিকে পম্পা সরোবর। রাম, পম্পাশব্দ শ্রবণগোচর করিয়া, সীতাকে বলিলেন, প্রিয়ে, পম্পা পরম রমণীয় সবোবর; আমি, তোমার অন্বেষণ করিতে করিতে, পম্পাতীরে উপস্থিত হইলাম; দেখিলাম, প্রফুল্ল কমল সকল, মন্দ মারুত দ্বারা ঈষৎ আন্দোলিত হইয়া, সরোবরের নিরতিশয় শোভাসম্পাদন করিতেছে; উহাদের সৌরভে চতুর্দিক্‌ আমোদিত হইয়া রহিয়াছে; মধুকরেরা, মধুপানে মত্ত হইয়া, গুন্‌ গুন্‌ স্বরে গান করিয়া, উড়িয়া বেড়াইতেছে; হংস, সারস প্রভৃতি বহুবিধ বারিবিহঙ্গগণ, মনের আনন্দে, নির্মল সলিলে কেলি করিতেছে। তৎকালে, আমার নয়নযুগল হইতে অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা বিনির্গত হইতেছিল; সুতরাং সরোবরের শোভার সম্যক অনুভব করিতে পারি নাই; এক ধারা নির্গত ও অপর ধারা উদগত হইবার মধ্যে, মুহূর্ত্ত মাত্র নয়নের যে অবকাশ পাইয়াছিলাম, তাহাতেই কেবল এক এক বার অস্পষ্ট অবলোকন করিয়াছিলাম।

 সীতা, চিত্রপটের আর এক অংশে দৃষ্টিযোজনা করিয়া, লক্ষ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস, ঐ যে পর্ব্বতে কুসুমিত কদম্বতরুর শাখায় ময়ুরময়ুরীগণ নৃত্য করিতেছে, আর শীর্ণকলেবর আর্য্যপুত্র তরুতলে মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িতেছেন, তুমি গলদ নয়নে উঁহারে ধরিয়া রহিয়াছ, উহার নাম কি? লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্যে, ঐ পর্ব্বতের নাম মাল্যবান্‌। মাল্যবান্‌ বর্ষাকালে অতি রমণীয় স্থান; দেখুন, সব জলধৱমণ্ডলের সহযোগে, শিখরদেশে কি অনির্বচনীয় শোভা সম্পন্ন হইয়াছে। এই স্থানে আর্য্য একান্ত বিলচিত্ত হইয়াছিলেন। শুনিয়া, পূর্ব্ব অবস্থা স্মৃতিপথে আরূঢ় হওয়াতে, রাম একান্ত আকুলহৃদয় হইয়া বলিলেন, বৎস, বিরত হও, বিরত হও; আর তুমি মাল্যবানের উল্লেখ করিও না; শুনিয়া, আমার শোকসাগর, অনিবার্য্য বেগে, উথলিয়া উঠিতেছে; জানকীর বিরহ পুনরায় নবীভাব অবলম্বন করিতেছে। এই সময়ে, সীতার আলস্যলক্ষণ আবির্ভূত হইল। তখন লক্ষণ বলিলেন, আর্য্য, আর চিত্রদর্শনের প্রয়োজন নাই; আর্য্যা জানকীর ক্লান্তিবোধ হইয়াছে। এক্ষণে উঁহার বিশ্রামসুখসেবা আবশ্যক; আমি প্রস্থান করি, আপনারা বিশ্রামভবনে গমন করুন।

 এই বলিয়া বিদায় লইয়া, লক্ষ্মণ প্রস্থানোম্মুখ হইলে, সীতা রামকে বলিলেন, নাথ, চিত্র দেখিতে দেখিতে, আমার এক অভিলাষ জন্মিয়াছে, আপনাকে তাহা পূর্ণ করিতে হইবে। রাম বলিলেন, প্রিয়ে, কি অভিলাষ, বল, অবিলম্বেই সম্পাদিত হইবে। তখন সীতা বলিলেন, আমার অভিলাষ এই, পুনর্বার মুনিপত্নীদিগের সহিত সমাগত হইয়া, তপোবনে. বিহার ও নির্মল ভাগীরথীসলিলে অবগাহন করিব। সীতার অভিলাষ শ্রবণগগাচর করিয়া, রাম লক্ষ্মণকে বলিলেন, বৎস, এই মাত্র গুরুজন আদেশ করিয়া পাঠাইয়াছেন, জানকী যখন যে অভিলাষ করিবেন, তৎক্ষণাৎ তাহা পূর্ণ করিতে হইবে। অতএব, গমনের উপযোগী আয়োজন কর; কল্য প্রভাতেই, ইনি অভিলষিত প্রদেশে প্রেরিত হইবেন। সীতা সাতিশয় হর্ষিত হইয়া বলিলেন, নাথ, আপনিও সঙ্গে যাবেন? রাম বলিলেন, অয়ি মুগ্ধে, তাহাও কি আবার, তোমারে বলিতে হইবে! আমি কি তোমায় নয়নের অন্তরাল করিয়া, এক মুহূর্ত্তও সুস্থ হৃদয়ে থাকিতে পারিব? তৎপরে সীতা, সস্মিত মুখে, লক্ষ্মণের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, বৎস, তোমাকেও আমাদের সঙ্গে যাইতে হইবে। তিনি, যে আজ্ঞা, বলিয়া, গমনের উপযোগী আয়োজন করিবার নিমিত্ত, প্রস্থান করিলেন।