সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/আলিপুরের বাগানে

উইকিসংকলন থেকে
আলিপুরের বাগানে

 আলিপুরের চিড়িয়াখানায় আমাদের একটি বন্ধু আছেন। আমরা যখনই আলিপুর যাই অন্তত একটিবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ভুলি না। দেখা করবার সময় শুধু হাতে যাওয়াটা ভালো নয়, তাই বন্ধুর জন্য প্রায়ই কিছু উপহার নিয়ে যাই। তিনিও তাঁর সাধ্যমত নানারকম তামাশা কসরত ও মুখভঙ্গি দেখিয়ে আমাদের আপ্যায়িত করেন।

 অনেকে চিড়িয়াখানায় গিয়ে গোড়া থেকেই বাঘের ঘরটা দেখবার জন্য ব্যস্ত হন। সাপ, কুমির, উটপাখি, গণ্ডার আর হিপোপটেমাস—কেউ কেউ এদেরও খুব খাতির করে থাকেন। কিন্তু যে যাই বলো বাগানে ঢুকতে না ঢুকতেই আমাদের মনটা সকলের আগে বলতে থাকে, বন্ধুর বাড়ি চল্, বন্ধুর বাড়ি চল্। বন্ধুর সঙ্গে কেন যে আমাদের এত ভাব, তা যদি শুনতে চাও, তা হলে তাঁর নামের পরিচয়, গুণের পরিচয়, বিদ্যার পরিচয়, সব তোমাদের শুনতে হয়।

 বন্ধুটির নাম হচ্ছে শ্রীযুক্ত ওরাংচন্দ্র ওটান। আফ্রিকা নিবাসী, আলিপুর প্রবাসী। অমন অমায়িক চেহারা, অমন ঢিলেঢালা প্রশান্ত স্বভাব অমন ধীর গম্ভীর মেজাজী চাল, সমস্ত আলিপুর খুঁজে আর কোথাও দেখবে না।

 কত যে ভাবনা আর কত যে হিসাপত্র সর্বদা তাঁর মাথার মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তাঁর ঐ প্রকাণ্ড কপালজোড়া হিজিবিজি রেখাগুলো দেখলেই তা বুঝতে পারবে। যখন তিনি চিৎপাত হয়ে শুয়ে, মুখের মধ্যে আঙুল দিয়ে, পেট চুলকাতে থাকেন, আর তাঁর কালো কালো হ্যাংলা মতন চোখ-দুটি মিটমিট করে তাকিয়ে থাকে, তখন যদি তার মনের মধ্যে কান পেতে শুনতে পারতে, তা হলে শুনতে সেখানে অনর্গল হিসাব চলছে—“আর চারটে কলা, আর দু ঠোঙা বাদাম আর কতগুলো বিস্কুট, আর ঐ নাম-জানি না গোল-গোল-মতন অনেকখানি —ইত্যাদি। যখন তিনি খাঁচার ছাত থেকে গরাদ ধরে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো ঝুলতে থাকেন আর দুলতে থাকেন—যেন সংসারের কোনো কিছুতে তাঁর মন নেই—তখন যদি তাঁর মনের কথা শুনতে, তা হলে শুনতে পেতে, তিনি কেবলই ভাবছেন, কেবলই ভাবছেন, এই লোকটার পাগড়ি নাহয় ঐ লোকটার চাদর, নাহয় এই সাহেবটার টুপি, নাহয় ঐ বাবুটার ছাতা-নেবই নেব, নেবই নেব।’

 একদিন আমরা চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখি, ওরাংবাবু দোলনা বেঁধে দোল খাচ্ছেন। কোখেকে কি করে, কার একটা পাগড়ি তিনি আদায় করেছেন, আর সেইটাকে ছাতের গরাদের উপর থেকে ঝুলিয়ে অপূর্ব দোলনা তৈরি হয়েছে। তিনি দুহাতে তার দুই মাথা ধরে মনের আনন্দে দুলছেন। তাঁর মুখখানা যেন সদানন্দ শিশুর মতো, নিজের বাহাদুরি দেখে নিজেই অবাক।

 হঠাৎ তার কি খেয়াল হল, পাগড়ির একটা দিক ছেড়ে দিয়ে তিনি গেলেন মাথা চুলকোতে। অমনি পাগড়ির একটা মাথা ভারী হয়ে নেমে পড়ল, আর আরেক মাথা আলগা পেয়ে সুড়ৎ করে গরাদের উপর দিয়ে ছিলে বেরিয়ে এল। ব্যাপারখানা বুঝবার আগেই ওরাংবাবু

মেঝের উপর চিৎপাত। আর কেউ হলে অপ্রস্তুত হত, কিন্তু বন্ধু আমাদের অপ্রস্তুত হবার পাই নন। তিনি পড়েই একটা ডিগবাজি খেয়ে উঠলেন আর এমনভাবে ফিরে দাঁড়ালেন যেন আগাগোড়া তিনি ইচ্ছা করেই আমাদের তামাশা দেখাচ্ছিলেন। তার পর অনেকখানি ভেবে আর অনেক বুদ্ধি খরচ করে আবার তিনি দোলনা খাটালেন। কাপড়টাকে গরীদের উপর দিয়ে গলিয়ে তার দুটো মাথাকেই যে ধরে রাখতে হয়, এটা বুঝতে তাঁর কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল। তিনি পাগড়িটাকে ঝুলিয়ে এক মাথা ধরে টানেন, আর হুস্ করে দোলনা খুলে আসে, তাতে প্রথমটা বেচারার ভারি ভাবনা হয়েছিল।

 আমাদের বন্ধুটির নানারকম বিদ্যা আছে। তিনি পান খেতে ভারি ভালোবাসেন। পানটা হাতে দিলে, আগে সেটাকে খুলে পরীক্ষা করে দেখেন, তার পর হাতের মুঠোর মধ্যে মুড়ে টপ করে মুখের মধ্যে দিয়ে ফেলেন। যখন পানি খেয়ে তাঁর মুখখানা লাল হয়, আর গাল বেয়ে পানের রস পড়তে থাকে, তখন তিনি মাটির মধ্যে থুতু ফেসেন, আর লাল রঙের থুতু দেখে খুশি হয়ে তাকিয়ে থাকেন। একদিন গিয়ে দেখি, তিনি জবাফুলের মালা গলায় দিয়ে অত্যন্ত লাজুক ছেলের মতো চুপচাপ করে বসে আছেন। আমাদের দেখে তার কি খেয়াল হল জানি না তিনি ফুলগুলো ছিড়ে ছিড়ে খেয়ে ফেললেন। শুনেছি, তিনি নাকি লুকিয়ে সিগারেট খেতেও শিখেছেন, আর সুযোগ পেলে মালীদের হুকোতেও দু-এক টান দিতে ছাড়েন না।

 বন্ধু গান-বাজনার সমজদার কিনা, অথবা সন্দেশ’ পড়তে পারেন কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখবার সুযোগ পাই নি, কিন্তু তিনি যে সুগন্ধ জিনিসের কদর বোঝেন তার পরিচয় অনেক পেয়েছি। তুলোয় করে খানিকটা এসেন্স দিয়ে দেখেছি, সেই তুলোটুকু নাকে ঠেকিয়ে শুকতে শুকতে আরামে তার দুই চোখ বুজে আসে, জোরে জোরে নিশ্বাস টানতে টানতে, তিনি চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়েন। অনেকক্ষণ এঁকে এঁকে তার পর তুলোটাকে যত্ন করে তুলে রেখে দেন, আর থেকে থেকে ফিরে এসে তার গন্ধ শোকেন। একবার আমরা তামাশা দেখবার জন্য তুলোয় করে খানিকটা ঝাঁঝালো আমোনিয়া দিয়েছিলাম। সেটাকে শুকে যেরকম অদ্ভুত চোখমুখের ভঙ্গি তিনি করেছিলেন, আর যেরকম করে বারবার হতে আর রেলিঙে নাক ঘষেছিলেন সে কথা মনে হলে আজও আমাদের হাসি পায়। একবার শুঁকেও তাঁর কৌতূহল মেটে নি, খুব সাবধানে দূর থেকে আরো দু-চার বার তুলোটাকে শুঁকে, আর দু-চারবার চমৎকার মুখভঙ্গি করে, তিনি সেটাকে তার প্রতিবেশী এক বেবুনের ঘরের মধ্যে ফেলে দিলেন। সেই হতভাগা বেবুনটাও কথা নেই বার্তা নেই, ‘তুলোটুকু নিয়েই ঝপ করে মুখে দিয়ে ফেলেছে। তার পর যদি তার দুরবস্থা দেখতে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত নাক গড়িয়ে হাঁচতে হাঁচতে, আর হাঁ করে জিভের জল ফেলতে ফেলতে বেচারা অস্থির।

 এই বেবুনটার সঙ্গে ওরাং ওটানের একটুও ভাব নেই। আরেকবার ওরাং আমাদের কাছ থেকে একটা লাঠি আদায় করেছিলেন। লাঠিটা পেয়েই তিনি ব্যস্তভাবে বাইরে গিয়ে, রেলিঙের ফাক দিয়ে তাঁর নিশ্চিন্ত প্রতিবেশীর ঘাড়ের উপর এক খোঁচা। তখন যদি বেবুনের রাগ দেখতে। আমরা সেবার দুই খাঁচার মাঝখানে কলা গুঁজে দিয়ে, বেবুন আর ওরাঙের

ঝগড়া দেখেছিলাম। বোকা বেবুনটা যতক্ষণে আঁচড় কামড় আর কিল ঘুষি চালাতে থাকে, ততক্ষণে ওরাংবাবু গম্ভীরভাবে ঘাড় গুঁজে কলাটুকু বার করে নেন। কলাটি নিয়ে মুখে দিয়ে তার পর উল্লাস আর ভেংচি। বেবুনটা রাগে যতই পাগলের মতো হয়ে উঠতে থাকে, বন্ধুর ততই ফুর্তি বাড়ে।

 এ-সব কথা কিন্তু চুপিচুপি খালি তোমাদের কাছেই বললাম। তোমরা আলিপুরের কর্তাদের কাছে কক্ষনো এ-সব বোলো না। তা হলে আমাদের বাগানে যাওয়া মুশকিল হবে।

সন্দেশ—মাঘ, ১৩২৬