সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/আজব জীব

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৯১-২৯২)
আজব জীব

 কি ভাই সন্দেশ, বড়ো যে দেখেও দেখছ না? আমায় চেন না বুঝি? তোমার ঘরের কাছেই আমায় কত দেখেছ তবু পরিচয় জান না? আচ্ছা তা হলে পরিচয় দেই।

 আমায় এখন যেরকম দেখছ আগে কিন্তু সেরকম ছিলাম না। এখন কেমন দুপায়ে ভর দিয়ে চলে বেড়াই; তখন অন্য অন্য জন্তুরা যেমন চার পায়ে চলে আমিও তেমনি করে চলতাম। তোমাদের এই ডাল ভাত মাছ মাংস এ-সব কিছুই খেতে পারতাম না। তখন আমার পায়ে একরকম ধাতুর তৈরি বেড়ি আটকানো ছিল, হাতেও সেইরকম হিল।

 আমাদের বাসা তুমি দেখেছ—কেমন অদ্ভুত বল দেখি? খানিকটা কাঠ আর পোড়মাটি, লোহা বালি আর মাটির গুঁড়ো, এইরকম সব জিনিস দিয়ে আমরা বাসা বানাই। বাসায় ঢুকবার আর বের হবার জন্যে, আলো আর বাতাস আসবার জন্যে বাড়ির গায়ে নানা জায়গায় ফাঁক থাকে, ইচ্ছা করলে সে ফাঁকগুলো বন্ধ করে দেওয়া যায়।

 আমরা অনেকরকম জিনিস খাই। নানারকম ফলমূল শিকড়, এ-সব তো খাই-ই, তার উপর আমাদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে নানারকমের ঘাসের বীজ। আমরা সেই-সব যত্ন করে সংগ্রহ করে তা থেকে কতরকমের যে খাদ্য বানাই, শুনলে অবাক হবে। একরকম জন্তু আছে, আমরা তার দুধ খেতে খুব ভালোবাসি। তাই অনেক সময়ে সেইরকম জন্তু ধরে এনে আমাদের বাড়িতে বেঁধে রাখি। একরকম গাছ হয় দেখতে অনেকটা বাঁশের মতো, আমরা তার থেকে রস বার করে সেই রস জমিয়ে খেতে খুব ভালোবাসি।

 আমরা কি পারি জান? কোনো কোনো ফলে লম্বা-লম্বা আঁশ থাকে, সেই আঁশের জট ছাড়িয়ে আঁশগুলোকে পাকিয়ে তা থেকে আমরা নানারকম জাল বুনি। অন্যান্য আঁশাল জিনিস থেকেও এরকম জাল বোনা যায়। পোকার বাসা, জানোয়ারের লোম, কতরকম জিনিস থেকে যে আঁশ সংগ্রহ হয়, আমিও তার সব খবর জানি না। এই আমার গায়ে দেখ-না কতরকম জালের টুকরা জোড়া দিয়া আমার মা কেমন সুন্দর গা-ঢাক্‌নি বানিয়েছেন। এইরকম জালের মধ্যে চাপ চাপ আঁশ ভরে তার উপর শুতে যা আরাম।

 আমাদের মধ্যে নানারকম অদ্ভুত প্রথা দেখতে পাওয়া যায়। যারা আমাদের চাইতে বড়ো তাদের সঙ্গে দেখা হলে আমরা সামনের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে দুটো হাত একসঙ্গে ওঠাই ও নামাই-নাহয় মাটি পর্যন্ত হাত নামিয়ে একেবারে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি। কেন করি তা আমি বলতে পারি না।

 কি বললে? তবু চিনতে পারছ না? ভাবছ আমি কোথাকার অদ্ভুত জীব? তা নয় গো তা নয়। আমি আফ্রিকার হটেন্‌টট্‌ও নই, মালয় দেশের বনমানুষও নই, আমি নিতান্তই তোমাদের বাঙালির ঘরের ছেলে—সন্দেশের পাঠক। পরিচয়টা ভুল হয়েছে বলছ? আর একটিবার মন দিয়ে পড়ে দেখ, আগাগোড়া সমস্তই ঠিক বলা হয়েছে দেখতে পাবে।

সন্দেশ-বৈশাখ, ১৩০০