বিষয়বস্তুতে চলুন

সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/দেশ-বিদেশের গল্প/দুষ্টু দরজি

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১০৪-১০৬)

দুষ্টু দরজি

 এক দরজি ছিল, তার মতো ভালো সেলাই আর কেউ জানত না। একদিন তাদের রাজপুত্রের বড় সখের পোশাক ছিঁড়ে গেল, তাই তিনি সেটা দরজির বাড়ি রিফু করতে পাঠিয়ে দিলেন।

 দরজি বসে বসে পোশাক সেলাই করছে আর ভাবছে—‘আহা, এমন একটি পোশাক যদি আমি পরতে পেতাম, তবে না জানি আমাকে কেমন দেখাত!’ ভাবতে ভাবতে তার ভারি লোভ হল—আস্তে আস্তে পোশাকটা তুলে গায়ে দিল। তারপরে আয়নাটি সামনে ধরে বলল—“বাঃ, এ যে ঠিক রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে! এখন আমাকে দেখে কে দরজির ছেলে বলে বুঝবে?” এই না বলে, বাক্স থেকে তার পুঁজিপাটা বের করে নিয়ে রাতারাতি চুপচাপ সে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল।

 সে যেখানে যায় তার সুন্দর চেহারা আর দামি পোশাক দেখে লোকে মনে করে যে নিশ্চয়ই কোনো রাজা-রাজড়ার ছেলে হবে।

 চলতে চলতে একদিন তারই বয়সী একটি লোকের সঙ্গে তার আলাপ হল। সে লোকটি বলল, “আমি সুলতানের ছেলে, আমার নাম ওমার। আমার জন্মের সময় গণক বলেছিল যে বিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত নিজের রাজ্যে থাকলে আমার ভয়ানক বিপদ হবে। সেইজন্য বাবা আমাকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানেই আমি মানুষ হয়েছি। এখন বিশ বছর হয়ে গিয়েছে তাই দেশে ফিরে যাচ্ছি।” দরজি জিজ্ঞাসা করলো, ‘‘আচ্ছা, তুমি তো বড় হয়ে সেখানে কখনো যাও নি; কি করে সব চিনবে?” ওমার বলল, “এই রাস্তা ধরে কিছুদূরে গেলে একটা মসজিদ দেখা যাবে, সেখানে বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। এই যে তলোয়ার দেখছ, এটা মামা দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে বাবার এই কথা আছে যে এই তলোয়ার দেখিয়ে আমি বলব ‘যার আশায় বসে আছেন, আমিই সেই’ আর বাবা উত্তর করবেন, ‘আল্লা তোমার মঙ্গল করুন’—তা হলেই চেনা যাবে।” এইরকম গল্প করতে করতে দুজনে একটা সরাইখানায় ঢকলো। সেখানে খেয়ে দেয়ে দুজনে শুয়ে রইল। দরজিটার কিন্তু সারারাত হল হল না—সে ভোর না হতেই উঠে ওমারের তলোয়ারটি নিয়ে চুপচাপ সেখান থেকে পালাল।

 খানিকদূর গিয়ে দরজি দেখতে পেল যে একটা মস্ত মসজিদের সামনে অনেক লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাঝখানে একজন বুড়ো লোক বসে আছেন, তাঁর চেহারা আর পোশাক দেখেই সে বুঝলো, ইনিই নিশ্চয় সলতান। সে সোজা গিয়ে তাঁর পায়ের কাছে তলোয়ারটি রেখে সেলাম করে বলল, “যার আশায় বসে আছেন আমিই সেই”—অমনি সুলতান তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আল্লা তোমার মঙ্গল করন।” সঙ্গের লোকেরা তখন আনন্দে কোলাহল করতে করতে বাড়ি যাবার আয়োজন করতে লাগল।

 এমন সময় ওমার হাঁপাতে হাঁপাতে সেইখানে এসে হাজির। সে চিৎকার করে বলল, “ওর কথা শুনো না—ও একটা জোচ্চোর—আমিই আসল সুলতানের ছেলে।” দরজি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আরে, ওটা একটা দরজির ছেলে—পাগল কিনা তাই

অমন যা তা বলে।” সুলতান বললেন—“পাকড়াও দেখি—ওটাকে পাগলা গারদে রেখে দেওয়া যাবে।” বলতেই সুলতানের লোকেরা তাকে ধরে বন্দী করে ফেলল।

 সকলে বাড়ি পৌঁছাতেই তো সুলতানা ছটে এলেন, কিন্তু দরজিকে দেখেই তিনি কাঁদ কাঁদ হয়ে বললেন, “এ তো আমার ছেলে নয়! তার তো এরকম চেহারা ছিল না!” সুলতান বললেন, “আরে! কচিছেলের মুখ কি আর তেমনিই থাকে? বড় হয়ে চেহারা বদলিয়ে গেছে।” সুলতানা বললেন, “না, না, আমি কতবার আমার ছেলের মুখ স্বপ্নে দেখেছি, সে মুখ মোটেই এরকম নয়।” এমন সময় ওমার হঠাৎ প্রহরীদের হাত ছাড়িয়ে এসে একেবারে সুলতানার পায়ে পড়ে বলল, “আমিই আপনার ছেলে, ও লোকটা জোচ্চোর।” তাকে দেখেই সুলতানা চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওগো, এই তো আমার ছেলে—একেই আমি স্বপ্নে দেখেছি।” তখন সুলতানের ভারি রাগ হল—তিনি ওমারকে ধরে তখনই পাগলা গারদে রাখতে হুকুম দিলেন।

 সলতানা আর কি করেন? তিনি ঘরে বসে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে রাতদিন কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ তাঁর মাথায় এক বুদ্ধি জোগাল। তিনি সুলতানকে গিয়ে বললেন, “আমার একটা সখ হয়েছে যে তোমার ছেলেকে আর ঐ পাগলা দরজিকে দুটো ওড়না বুনতে দেব—যারটা ভালো হবে, সেইটা আমার জন্মদিনে গায়ে দেব।” সুলতান বললেন, “সে তো বেশ কথা।” তারপর দরজি আর ওমার দুজনকেই ছুঁচ, সুতো, জরি, রেশম, এই-সব দিয়ে সুলতানা বললেন, “আমাকে সুন্দর একখানা ওড়না বানিয়ে দিতে হবে।”

 দরজির ছেলে ভাবল, ‘সুলতানা আমার ওপর চটে আছেন—এইবার তাঁকে খুশি করে দিতে হবে।’ তাই সে খুব যত্ন করে, সোনালি, রুপোলি ফুল, পাতা এঁকে চমৎকার একটি ওড়না বানাল। তাই দেখে সুলতানা বললেন, “বাছা, তোমার হাতের সেলাই তো বড় চমৎকার! একেবারে ওস্তাদ দরজির মতো! এমন সেলাই কোত্থেকে শিখলে বল দেখি?” তখন দরজি ভারি থতমত খেয়ে গেল।

 তারপর দুজনে ওমারের ঘরে গিয়ে দেখলেন যে সে বেচারা চুপ করে বসে আছে। সুলতানা বললেন, “আমার ওড়না কই?” ওমার মুখ ফুলিয়ে বলল, “আমি তলোয়ার চালাতেই শিখেছি, ছুঁচ চালাতে তো জানি না।” সুলতানের মনে তখন ভারি খটকা লাগল।

 সে দেশে এক আদ্যিকালের বুড়ি ছিল, লোকে বলত যে সে জাদু জানে। সুলতান অনেক ভেবে কিছু ঠিক করতে না পেরে, সেই বুড়ি জাদুকরীকে গিয়ে সব বললেন। বুড়ি তাঁকে দুটো কৌটো দিয়ে বলল, “আপনি বাড়ি গিয়ে ওদের দুজনকে বলুন এর মধ্যে একটা কৌটো পছন্দ করে নিতে। যে যা পছন্দ করবে, তাতেই বোঝা যাবে কে আপনার ছেলে।”

 কৌটো দুটি ভারি সুন্দর—দেখতে দুটোই একরকম: কিন্তু একটার ওপর লেখা আছে “টাকার সখে” আরেকটাতে লেখা আছে “বীরত্বের সম্মান”! সুলতান আর সুলতানা দরজির ছেলেকে ডেকে বললেন, “এর মধ্যে তোমার কোন্‌টি পছন্দ হয় বলতো?” দরজি অমনি খপ করে “টাকার সুখ” লেখা কৌটোটি ধরল। কিন্তু ওমার এসে “বীরত্বের সম্মান” লেখা কৌটোটি পছন্দ করল। সুলতান বললেন, “আচ্ছা নিজের নিজের কৌটো নিয়ে যাও।” যেই কৌটো দুটো হাতে নেওয়া অমনি ফট করে তার ঢাকনা খুলে গেল। ওমারের কৌটোর মধ্যে ছোট্ট সুন্দর একটি মুকুট আর  রাজদণ্ড, আর দরজির কৌটোয় একটা ছুঁচ আর সুতো!

 তখন আর কারো বুঝতে বাকি রইল না যে কে দরজির ছেলে আর কে সত্যি সুলতানের ছেলে। চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। সেই গোলমালের মধ্যে দরজির ছেলে এক দৌড়ে যে কোথায় পালাল, আর কেউ তাকে খুঁজে পেলো না।

সন্দেশ—১৩২৩