হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/বঙ্গদেশীয় অঙ্গনাদিগের স্বাধীনতা

উইকিসংকলন থেকে

বঙ্গদেশীয় অঙ্গনাদিগের স্বাধীনতা।

 হায়! কি ভ্রান্তিমূলক বাক্য, আমাদিগের বঙ্গদেশীয় মহাত্মাগণের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি বলেন; ‘‘অবলাগণকে বিদ্যাভ্যাস করাইলে, তাহারা আর অন্তঃপুররূপ পিঞ্জর বদ্ধ হইয়া থাকিতে ইচ্ছা করিবে না, এবং অন্যান্য দেশীয় যোবাগণের ন্যায় স্বেচ্ছা-মত সর্ব্বত্র গমনাগমন করিতে ইচ্ছুক হইবে, ও ইউরোপীয় বর-বর্ণিনীগণের তুল্য ভাব ধারণ করিয়া সকল পুরুষের সহিত বাক্যালাপ করণে প্রবৃত্ত হইবে। এইরূপে তাহারা সর্ব্বত্র গতায়াত ও সর্ব্ব বিষয়ে দৃষ্টিপাত করিয়া আপনাপন অবস্থার প্রতি বিরক্ত হইবে, এবং অধীনতা-শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইতে ইচ্ছা করিবে। অতএব নারীগণকে বিদ্যা শিক্ষা করান কোন ক্রমেই যুক্তি সিদ্ধ নহে।” আহা! হিন্দুধর্ম্মাভিমানী মহদাশয়গণ কি যুক্তিই করিয়া থাকেন; বিদ্যার কি আকর্ষণী শক্তি আছে যে তদ্দ্বারা নারীগণকে বাহির করিবে; আর নারীগণ যে স্বাধীনতা ইচ্ছা করিবে, তাহারই বা প্রমাণ কি? একাল পর্য্যন্ত ত কোন দেশীয় কামিনীগণ স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয় নাই, তবে বঙ্গদেশীয় মহিলাগণ কি প্রকারে স্বাধীনতা ইচ্ছা করিবে। জগদীশ্বর স্ত্রী জাতিকে যে প্রকার স্বভাব ও ক্ষমতা প্রদান করিয়াছেন, তাহাতে বিশেষরূপেই প্রতীয়মান হইতেছে যে, নারীগণের অধীনতা ঈশ্বরাভিপ্রেত। সুতরাং অবলাগণ সবলা হইয়া কখনই স্বাধীনতা অবলম্বন করিতে পারিবে না। বিদ্যা শিখিলে ও স্বেচ্ছামত সর্ব্বত্র গমনাগমন করিলে যদ্যপি স্বাধীনতা প্রাপ্ত হইত, তবে এত দিনে ইউরোপীয় মহিলাগণ অবশ্যই রাজকীয় কোন প্রধান পদে অভিষিক্ত হইয়া স্বদেশের গৌরব বৃদ্ধি করিত। অতএব নারীগণ কোন কালেই স্বাধীনতা প্রাপ্ত হইবে না। নারীগণ আশ্রয় ব্যতিরেকে কখনই শোভা পায় না। নিরাশ্রয়া নারীর কোন স্থানেই সমাদর নাই। অতএব যদি স্বাধীনতাই না হইল, তবে নারীগণের সর্ব্বত্র গতায়াতের আর সম্ভাবনা কি রহিল, যে তাহারা স্বেচ্ছামত সর্বত্র গমনাগমন করিতে ইচ্ছা করিবে।

 কিন্তু আধুনিক নব্য সম্প্রদায়ী মহোদয়গণের মধ্যে অনেকেই বলিয়া থাকেন, যে অস্মদ্দেশীয় কামিনীগণ অন্যান্য দেশীয় ভামিনীগণের ন্যায় সর্বত্র গতায়াত করিতে না পারিলে, কখনই দেশের শ্রীবৃদ্ধি সাধন হইবে না। সে কথা যথার্থ বটে, কিন্তু তাঁহারা কি প্রকারে তাহাদিগকে বাহির করিতে ইচ্ছা করেন, তাহা তাঁহারাই জানেন, যেহেতু অস্মদ্দেশীয় অঙ্গনাকুল অঙ্গনাতিক্রম করিয়া বহির্দ্দেশে পদার্পণ করিলেই কুল-মান-ভ্রষ্ট হয়, ও সর্ব্ব সন্নিধানে নিন্দাভাজন হয়, সে স্থলে সমাজাদিতে গমন করিতে তাহারা সহসা বাধ্য হইবে কেন? আর নারীগণকে কি প্রকার সজ্জায় সজ্জিত করিয়া বাহির করিতে ইচ্ছা করেন। অস্মদ্দেশীয় নারীগণ যেরূপ বস্ত্রালঙ্কার ব্যবহার করেন, তদবস্থায় তাহাদিগকে সমাজাদিতে লইয়া গেলে, সভার শোভা আরও শত গুণে বৃদ্ধি হয়। কারণ বিদ্যাধরী বেশধারিণী ঐ কামিনীগণের পদার্পণে সেই সভা অবিকল গীর্ব্বাণাধিপতির সভার ন্যায় প্রতীয়মান হয়। অতএব নারীগণকে নর্তকীবেশে কখনই বাহির করিতে পারা যায় না। তবে ইউরোপীয় অবলাগণের ন্যায় বস্ত্রাদি পরিধান করাইয়া যদ্যপি তাহাদিগকে জন-সমাজে বাহির করেন, তবে নিতান্ত মন্দ নহে। কিন্তু ইংলণ্ডীয় রমণীয় বসনাদি ধারণ করিয়া যদ্যপি তাঁহারা একেবারে বিবি হইয়া পড়েন, তখন মধ্যবিধ ও সামান্য গৃহস্থদিগের দশা কি হইবে। কারণ একটা পদ্ধতি প্রচলিত করিতে হইলে সাধারণের প্রতিই করিতে হয়, নচেৎ তাহার গৌরব থাকে না, কিন্তু সাধারণে ইহা প্রচারিত হইলেই বা কি প্রকারে রক্ষিত হইতে পারে, যেহেতু একটা কোন আশ্চর্য্য ঘটনা দর্শন বা শ্রবণ করিতে সকলেরই অভিলাষ জন্মিয়া থাকে, তবে তদ্দর্শনে স্ত্রী পুরুষ উভয়েই গমন করিলে গৃহের রক্ষণাবেক্ষণ কে করিবে, আর রন্ধনাদিই বা কে করিবে। যদি কহেন, তখন সকলে বিদ্যাবলে অতি ক্ষমতাশালী হইবে, এবং সেই ক্ষমতা প্রভাবে বিপুল অর্থ অর্জ্জন করিতে সমর্থ হইবে, ও সেই অর্থ বলে সকল কর্ম্মই নির্বাহ করিবেন। আহা! সেই পরম মঙ্গলায়ের কৃপা দৃষ্টিতে যদি এরূপ ঘটে তবে অতীব মঙ্গলের বিষয়; কিন্তু এতাদৃশ ক্ষমভাশালী কি সাধারণেই হইবে? তাহা কখনই সম্ভব নহে। আর যদি হয়, তবে তাহাতেই বা কি হইবে, যেহেতু অস্মদ্দেশীয়গণ ইউরোপীয়গণের ন্যায় একক থাকিতে ইচ্ছা করেন না, যে সাহেব সদৃশ ব্যবহার করিবেন। ইহাঁদিগকে দশ জন আত্মীয় লইয়া বাস করিতে হয়, আর ইউরোপীয়দিগের ন্যায় ইহাঁদিগের উপার্জ্জনও নহে, ইহাঁরা সম্পূর্ণ ক্ষমতাশালী হইলেও তাঁহাদিগের তৃতীয়াংশের একাংশ অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারেন কি না সন্দেহ। অতএব ইউরোপীয়দিগের তুল্য ইহাঁদিগের বনিতাগণ কখনই সভ্য হইতে পারিবে না। তবে যদি এমত হয়, যে ইহারা গোবর মাটীও ছানিবে ও সমাজাদিতেও যাইবে, তাহা হইলে আমাদিগের পক্ষেও উত্তম হয়।

 অতি প্রাচীনকালে হিন্দু অঙ্গনাগণের কিয়ৎ পরিমাণে স্বাধীনতা ছিল যথার্থ বটে, এবং তাঁহারা সর্ব্বত্র স্বেচ্ছামত গমনাগমন করিতেও পারিতেন। কিন্তু সেই পৌরাণিক মতে চলিতে গেলে তাহার প্রত্যেক গুলিই ব্যবহার করিতে হয়। একটী গ্রহণ করিয়া অপরটী কখনই পরিত্যাগ করিতে পারা যায় না। আর তৎকালীন অসঙ্গত মত সমূহ এক্ষণে গ্রাহ্যও হইতে পারে না। তখন অনেকে বংশ রক্ষা করিবার জন্য অন্যের দ্বারা পুত্র উৎপাদন করিয়া লইত, এবং এক নারী চারি পাঁচ জনের ভোগ্যা হইয়াও পরম পবিত্র ও প্রাতঃস্মরণীয় বলিয়া বিখ্যাত হইত[১]। কিন্তু এক্ষণে কেহই সেরূপ হইতে পারেন না; সুতরাং প্রাচীন মতাবলম্বী হইয়া কোন কর্ম্মই করা যাইতে পারে না।

  1. “অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
    পঞ্চ কন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনং’’॥