হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/বিবাহের পর কামিনীগণের শ্বশুরালয়ে গমন

উইকিসংকলন থেকে

বিবাহের পর কামিনীগণের শ্বশুরালয়ে গমন ও তৎকালীন তাহাদিগের মনোগত ভাব ও কার্য্যের বিষয়।

 মহিলাগণ বিবাহান্তে পিত্রালয়ে কিয়ৎকাল অবস্থিতি করিয়া তৎপরে শ্বশুর সদনে গমন করে, ইহাকেই লোকে নবধ্বাগমন অথবা দ্বিরাগমন কহে, এইকালে বালিকাগণ কেবল পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগিনী প্রভৃতি আত্মীয়গণের নিকটেই অবস্থিতি করিতে ইচ্ছা করে, এবং তাহাদিগের সংসর্গ পরিত্যাগ করিয়া কোন কার্য্য বশতঃ এক দিবসের নিমিত্ত যদি কোন স্থানে গমন করিতে হয়, তবে তাহাতে উহারা বিসন্ন হয় অতএব কি প্রকারে তাহারা একেবারে অতি দীর্ঘ কালের নিমিত্ত অথবা চিরকালের নিমিত্ত শ্বশুরালয়ে গমন করিতে ইচ্ছুক হইবে? তৎকালে তাহারা শ্বশুর সদনের নাম শ্রবণেই একেবারে সশঙ্কিত হয়, এবং সেই নব বালিকাগণের কুসুম সদৃশ সুকোমল হৃদয় অভ্যন্তরে ঐ চিন্তাই অহর্নিশি দেদীপ্যমান থাকে,এবং সেই চিন্তা বশত তাহাদিগের মুখ পুণ্ডরীকের মনোহর প্রভা মলিন হইতে থাকে। আহা! বালিকাগণ তৎকালে কোথায় প্রফুল্ল হৃদয়া ও হাস্য বদনা হইয়া জনক জননীর আনন্দ বর্দ্ধন করিবে, না তদ্বিপরীত ভাবের আবির্ভাব হয়। আহা! পিতা মাতাগণ সেই প্রাণসম তনয়াগণের মুখচন্দ্র ম্লান দেখিয়া এবং তাহারা শ্বশুরালয়ে গমন করিয়া কি প্রকারে সহবাস করিতে সমর্থা হইবে এবং তাঁহাদিগের অদর্শন জনিত দুঃসহ যন্ত্রণাই বা কি প্রকারে সহ্য করিতে পারগ হইবে, তদ্বিষয় চিন্তা করিয়া অতিশয় ব্যাকুলিত হয়েন, এবং কন্যাগণও পিতা মাতার চিত্ত চাঞ্চল্য দর্শন করিয়া আরো অধিক পরিমাণে চঞ্চল হইতে থাকে। আহা! কি কষ্টদায়ক কার্য্য, পিতা মাতাগণ আগত্যা সেই বালিকাগণকে বল পূর্ব্বক শ্বশুরালয়ে প্রেরণ করিয়া অতি কষ্টে প্রাণ ধারণ করেন, এবং কন্যাগণও পিতা, মাতা, ভ্রাতা প্রভৃতি আত্মীয়গণের দর্শন বিরহে অতীব শোকাকুল হৃদয়ে শ্বশুর সদনে গমন পূর্ব্বক চৌর্য্য অপরাধের বন্দির ন্যায় অন্তঃপুর রূপ কারাবদ্ধ হইয়া অতি দীনের ন্যায় দিনপাত করিতে থাকে। আহা! একে অত্যল্প বয়স্কা বালিকা, তাহাতে আবার সর্ব্ব বিষয়ে অশিক্ষিতা, সুতরাং তৎকালে তাহারা নিতান্তই বন্য পশুবৎ অতি অজ্ঞানাবস্থায় থাকে এবং লোকে যাদৃশ ছল বল সহকারে আরণ্যানী মধ্য হইতে পশু সঙ্কুল ধৃত করিয়া লোকালয়ে আনয়ন পূর্ব্বক তাহাদিগকে বশতাপন্ন করিবার নিমিত্ত বহুবিধ কৌশল প্রকাশ করিয়া থাকে, ইহাদিগকেও প্রায় তদনুসারেই বাধ্য করিতে হয়, এবং পশুগণকে যেমন সহসা বাধ্য করিতে কেহ সমর্থ হয় না,তদ্রপ বালিকাগণকেও সহসা বাধ্য করিতে কেহ সক্ষম হয় না এবং পশু পক্ষিগণ যেমন পিঞ্জর বদ্ধ হইয়া আহার নিদ্রা পরিত্যাগ পূর্ব্বক শুদ্ধ স্বস্থানের চিন্তা করে এবং সেই স্থানে প্রস্থান করিবার নিমিত্ত পিঞ্জরের চতুষ্পার্শ্ব অবলোকন করিতে থাকে,ইহারাও প্রায় তদ্রপ, ইহারা অবগুণ্ঠনবতী হইয়া গৃহরূপ পিঞ্জর বদ্ধ হওত তাহার চতুর্দ্দিক নিরীক্ষণ করে এবং শয়নাশনাদি পরিত্যাগ করিয়া কেবল অহর্নিশি পিতৃ আলয়ের চিন্তায় মগ্ন থাকে ও তৎ স্থানে গমনের দিন গণনা করিতে থাকে, এবং তৎকালে তাহাদিগের শ্বশুর কুলস্থ কাহার প্রতি স্নেহের সঞ্চার হয় না, আর তাহাদিগের মধ্যে প্রায় সকলেই উহার অপরিচিত,সুতরাং অপরিচিত ব্যক্তিব্যহের প্রতি কিপ্রকা- রে আশু স্নেহের সঞ্চার হইতে পারে,তৎকালে শ্বশুরালয়ের প্রতি সেই বালিকাগণের স্নেহ ভাব হওয়া দূরে থাকুক, বরং তদ্ধিপরীত হইবারই অধিক সম্ভাবনা। বালকগণ যেমত বিদ্যালয়ের প্রতি অতিশয় বিরক্ত ও তদ্ধিষয়ে নিয়োগ কর্ত্তা- গণের প্রতি অতীব ক্রোধ পরায়ণ হইয়া থাকে, ইহারাও প্রায় শ্বশুর সদন ও তত্রস্থ ব্যক্তি বৃন্দর প্রতি তদনুসারেই বিরক্তি প্রকাশ করিয়া থাকে, এবং পিত্রালয়স্থ জনগণকে অনবলোকন হেতু তাহাদিগের প্রতি আরও অধিক পরি- মাণে অনুরাগ বৃদ্ধি হইতে থাকে, সুতরাং পিত্রালয়স্থ এক জন অতি সামান্য ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হইলেও তাহার সহিত পরম বনুর ন্যায় ব্যবহার করে, কিন্তু শ্বশুরালয়স্থ অতি প্রধান ও পরম আত্মীয়ের প্রতি তদ্দ্প অকৃত্রিম স্নেহপ্রকাশ করিতে কখনই পারগ হয় না, অধিক কি কহিব পরম প্রণয়া- স্পদ যে পতি তাঁহার প্রতিও তৎকালে তাহাদিগের সহের সঞ্চার হয় না, কিন্তু পিত্রালয়স্থ পশু পক্ষি এবং বৃক্ষাদিতেও অধিক যত্ন করিয়া থাকে, এবং তৎকালে তাহাদিগের পক্ষে শ্বশতুরালয়স্থ বিচিত্র প্রাসাদও জন মানব শূন্য এবং অতি ভয়ঙ্কর হিংস্র জন্তু পরিবেষ্টিত পর্ব্বত শ্রেণীর ন্যায় প্রতীয়মান হয়, এবং অত্যৎকৃষ্ট বসন ভুষণাদি অতি মনোহর অঙ্গশৌষ্ঠব সাধনও কালভুজঙ্গবৎ অতি কষ্টদায়ক বোধ হয়, এবং রাজ ভোগ সদৃশ উপভোগ্য দ্রব্য সমূহ তাহাদিগের বিষতুল্য বোধ হয়, ও দুগ্ধ ফেন সন্নিভ অতি শোভাকর শয্যা সমূহ তাহাদিগের পক্ষে কপকাবৃত প্রান্তরবৎ অতি কষ্টদায়ক হয়, এবং স্বামীর অমৃত তুল্য সমধুর বচন সমূহ তাহাদিগের পক্ষে বম্রাঘাত সদৃশ অসহনীয় হয়, কিন্ত পিত্রালয়ের অতি জঘন্য পর্ণকুটীরও তাহাদিগের পরম শোভনীয় এবং ইন্ত্র ভবন যে অমরাবতী তাহা অপেক্ষাও সুখকর জ্ঞান হইয়া থাকে। আর বাল্যাবস্থার সেই অতি সামান্য বস্ত্রালঙ্কারাদিতেই অতি সন্তোষ প্রকাশ করে এবং পিত্রালয়ের অতি যৎসামান্য শাকান্নও তাহাদিগের সুথধা তুল্য সমধুর বোধ হয়, ও পিত্রালয়ের ভূমি শয্যাও তাহাদিগের কুসুম তুল্য অতি সুকোমল অনুভব হয়, অত- এব তৎকালীন তাহাদিগের মনোগত ভাবের যদি এরূপ বৈপরীত্য ভাব, তবে তাহারা কি প্রকারে সন্তোষ সহকারে শ্বশুরালয়ে অবস্থিতি করিতে সমর্থ হইবে। কিন্তু আবার ইহাদিগের মধ্যে যাহারা ধনি বংশে জন্ম গ্রহণ করিয়া মধ্যবিধ গৃহস্থালয়ে অথবা মধ্যবিধ গৃহে উন্তব হইয়া সামান্য গৃহস্থালয়ে পতিত হয়, তাহাদিগের যে কত দুূর পরি- মাণে ক্লেশ বোধ হয় তাহা বলিবার নহে, তাহারা পিত্রা- লয়ে অত্যতম দ্রব্য সামগ্রী উপভোগ করিয়া একেবারে বিষম কষ্টে পতিত হয়, এবং শ্বশুরালয়ে তাহারা অতি সামান্য আহারীয় গ্রহণ ও সামান্য বসন পরিধান করিয়া পরিচারিকার ন্যায় শারীরিক পরিশ্রম দ্বারা সাংসারিক কার্য্য সমুদয় নির্ব্বাহ করে এবং দৈব প্রতিকুলতা বশত যদ্যপি তাহাতে কোন ব্যাঘাত ঘটে, তবে তজ্ঞন্য তাহারা গুরু জনের নিকট প্রচুর পরিমাণে তিরস্কার রূপ পুরস্কার লাভ করে। আহা! সুখের পর দুঃখ ভোগ যে কত দূর অসহনীয় তাহা কাহার অবিদিত আছে।