ছেলেবেলা/৩

উইকিসংকলন থেকে

কাল রাত্তির থেকে মেঘের কামাই নেই। কেবলই চলছে বৃষ্টি। গাছগুলো বোকার মতো জবুস্থবু হয়ে রয়েছে। পাখির ডাক বন্ধ। আজ মনে পড়ছে আমার ছেলেবেলাকার সন্ধেবেলা।

 তখন আমাদের ঐ সময়টা কাটত চাকরদের মহলে। তখনো ইংরেজি শব্দের বানান আর মানে-মুখস্থর বুক-ধড়াস সন্ধেবেলার ঘাড়ে চেপে বসে নি। সেজদাদা বলতেন, আগে চাই বাংলাভাষার গাঁথুনি, তার পরে ইংরেজি শেখার পত্তন। তাই যখন আমাদের বয়সী ইস্কুলের সব পোড়োরা গড়্ গড়্ করে আউড়ে চলেছে I am up আমি হই উপরে, He is down তিনি হন নীচে, তখনাে বি এ ডি ব্যাড, এম এ ডি ম্যাড পর্যন্ত আমার বিদ্যে পৌঁছয় নি।

 নবাবি জবানিতে চাকর-নোকরদের মহলকে তখন বলা হ’ত তােশাখানা। যদিও সেকেলে আমিরি দশা থেকে আমাদের বাড়ি নেবে পড়েছিল অনেক নীচে, তবু তােশাখানা দফ্‌তরখানা বৈঠকখানা নামগুলাে ছিল ভিত আঁকড়ে।

 সেই তােশাখানার দক্ষিণভাগে বড়াে একটা ঘরে কাঁচের সেজে রেড়ির তেলে আলাে জ্বলছে মিট্‌মিট্ করে, গণেশ-মার্কা ছবি আর কালীমায়ের পট রয়েছে দেয়ালে, তারই আশেপাশে টিক টিকি রয়েছে পােকা-শিকারে। ঘরে কোনাে আসবাব নেই; মেজের উপরে একখানা ময়লা মাদুর পাতা।

 জানিয়ে রাখি আমাদের চাল ছিল গরিবের মতাে। গাড়িঘােড়ার বালাই ছিল না বললেই হয়। বাইরে কোণের দিকে তেঁতুল গাছের তলায় ছিল চালাঘরে একটা পাল্কিগাড়ি আর একটা বুড়াে ঘােড়া। পরনের কাপড় ছিল নেহাত সাদাসিধে। অনেক সময় লেগেছিল পায়ে মােজা উঠতে। যখন ব্রজেশ্বরের ফর্দ এড়িয়ে জলপানের বরাদ্দ হল পাঁউরুটি আর কলাপাতামােড়া মাখন, মনে হল আকাশ যেন হাতে নাগাল পাওয়া গেল। সাবেক কালের বড়ােমানুষির ভগ্নদশা সহজেই মেনে নেবার তালিম চলছিল।

 আমাদের এই মাদুর-পাতা আসরে যে চাকরটি ছিল সর্দার তার নাম ব্রজেশ্বর। চুলে গোঁফে লােকটা কাঁচা-পাকা— মুখের উপর টান-পড়া শুকনাে চামড়া, গম্ভীর মেজাজ, কড়া গলা, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা। তার পূর্ব-মনিব ছিলেন, লক্ষ্মীমন্ত, নাম-ডাক-ওয়ালা। সেখান থেকে তাকে নাবতে হয়েছে আমাদের মতো হেলায়-মানুষ ছেলেদের খবরদারির কাজে। শুনেছি, গ্রামের পাঠশালায় সে গুরুগিরি করেছে। এই গুরুমশায়ি ভাষা আর চাল ছিল তার শেষ পর্যন্ত। ‘বাবুরা বসে আছেন’ না ব’লে সে বলত ‘অপেক্ষা করে আছেন’। শুনে মনিবরা হাসাহাসি করতেন। যেমন ছিল তার গুমোর তেমনি ছিল তার শুচিবাই। স্নানের সময় সে পুকুরে নেমে উপরকার তেল-ভাসা জল দুই হাত দিয়ে পাঁচ-সাত বার ঠেলে দিয়ে একেবারে ঝুপ্ করে দিত ডুব। স্নানের পর পুকুর থেকে উঠে বাগানের রাস্তা দিয়ে ব্রজেশ্বর এমন ভঙ্গিতে হাত বাঁকিয়ে চলত যেন কোনোমতে বিধাতার এই নোংরা পৃথিবীটাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারলেই তার জাত বাঁচে। চালচলনে কোন্‌টা ঠিক, কোন্‌টা ঠিক নয়, এ নিয়ে খুব ঝোঁক দিয়ে সে কথা কইত। এ দিকে তার ঘাড়টা ছিল কিছু বাঁকা, তাতে তার কথার মান বাড়ত। কিন্তু এরই মধ্যে একটা খুঁত ছিল গুরুগিরিতে। ভিতরে ভিতরে তার আহারের লোভটা ছিল চাপা। আমাদের পাতে আগে থাকতে ঠিকমতো ভাগে খাবার সাজিয়ে রাখা তার নিয়ম ছিল। আমরা খেতে বসলে একটি একটি ক’রে লুচি আলগোছে দুলিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করত, ‘আর দেব কি?’ কোন্ উত্তর তার মনের মতো সেটা বোঝা যেত তার গলার সুরে। আমি প্রায়ই বলতুম, ‘চাই নে।’ তার পরে আর সে পীড়াপীড়ি করত না। দুধের বাটিটার ’পরেও তার অসামাল রকমের টান ছিল, আমার মোটে ছিল না। শেল্‌ফওয়ালা একটা খাটো আলমারি ছিল তার ঘরে। তার মধ্যে একটা বড় পিতলের বাটিতে থাকত দুধ আর কাঠের বারকোশে লুচি তরকারি। বিড়ালের লোভ জালের বাইরে বাতাস শুঁকে শুঁকে বেড়াত।

 এমনি করে অল্প খাওয়া আমার ছেলেবেলা থেকেই দিব্যি সয়ে গিয়েছিল। সেই কম খাওয়াতে আমাকে কাহিল করেছিল এমন কথা বলবার জো নেই। যে ছেলেরা খেতে কসুর করত না তাদের চেয়ে আমার গায়ের জোর বেশি বৈ কম ছিল না। শরীর এত বিশ্রী রকমের ভালো ছিল যে, ইস্কুল পালাবার ঝোঁক যখন হয়রান করে দিত তখনো শরীরে কোনোরকম জুলুমের জোরেও ব্যামো ঘটাতে পারতুম না। জুতো জলে ভিজিয়ে বেড়ালুম সারাদিন, সর্দি হল না। কার্তিক মাসে খোলা ছাদে শুয়েছি— চুল জামা গেছে ভিজে— গলার মধ্যে একটু খুস্-খুসুনি কাশিরও সাড়া পাওয়া যায় নি। আর, পেট কামড়ানি ব’লে ভিতরে ভিতরে বদ-হজমের যে একটা তাগিদ পাওয়া যায় সেটা বুঝতে পাই নি পেটে, কেবল দরকারমতো মুখে জানিয়েছি মায়ের কাছে। শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন ব’লে মনে হয় নি। তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, ‘আচ্ছা, যা, মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়াতে হবে না।’

 আমাদের সেকেলে মা মনে করতেন ছেলে মাঝে মাঝে পড়া কামাই করলে এতই কী লোকসান। এখনকার মায়ের হাতে পড়লে মাস্টারের কাছে তো ফিরে যেতেই হ’ত, তার উপরে খেতে হত কান-মলা; হয়তো-বা মুচকি হেসে গিলিয়ে দিতেন ক্যাস্টর অয়েল— চিরকালের জন্যে আরাম হ’ত ব্যামোটা। দৈবাৎ কখনো আমার জ্বর হয়েছে— তাকে কেউ জ্বর বলত না, বলত গা-গরম। আসতেন নীলমাধব ডাক্তার। থার্মোমিটার তখন চক্ষেও দেখি নি; ডাক্তার একটু গায়ে হাত দিয়েই প্রথম দিনের ব্যবস্থা করতেন ক্যাস্টর অয়েল আর উপোস। জল খেতে পেতুম অল্প একটু, সেও গরম জল; তার সঙ্গে এলাচ-দানা চলতে পারত। তিন দিনের দিনই মৌরলা মাছের ঝোল আর গলা ভাত উপোসের পরে ছিল অমৃত।

 জ্বরে ভোগা কাকে বলে মনে পড়ে না। ম্যালেরিয়া ব’লে শব্দটা শোনাই ছিল না। ওয়াক্‌-ধরানো ওষুধের রাজা ছিল ঐ তেলটা, কিন্তু মনে পড়ে না কুইনীন। গায়ে ফোড়া-কাটা ছুরির আঁচড় পড়ে নি কোনোদিন। হাম বা জলবসন্ত কাকে বলে আজ পর্যন্ত জানি নে। শরীরটা ছিল একগুঁয়ে রকমের ভালো।

 মায়েরা যদি ছেলেদের শরীর এতটা নিরুগী রাখতে চান যাতে মাস্টারের হাত এড়াতে না পারে, তা হলে ব্রজেশ্বরের মতো চাকর খুঁজে বের করবেন। খাবার-খরচার সঙ্গে সঙ্গেই সে বাঁচাবে ডাক্তার-খরচা; বিশেষ করে এই কলের জাঁতার ময়দা আর এই ভেজাল-দেওয়া ঘি-তেলের দিনে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, তখনো বাজারে চকোলেট দেখা দেয় নি। ছিল এক পয়সা দামের গোলাপি-রেউড়ি। গোলাপি-গন্ধের-আমেজ-দেওয়া এই তিলে ঢাকা চিনির ড্যালা আজও ছেলেদের পকেট চট্‌চটে করে তোলে কি না জানি নে; নিশ্চয়ই এখনকার মানী লোকের ঘর থেকে লজ্জায় দৌড় মেরেছে। সেই ভাজা মসলার ঠোঙা গেল কোথায়? আর সেই সস্তা দামের তিলে গজা? সে কি এখনো টিঁকে আছে? না থাকে তো তাকে ফিরিয়ে আনার দরকার নেই।

 ব্রজেশ্বরের কাছে সন্ধেবেলায় দিনে দিনে শুনেছি কৃত্তিবাসের সাতকাণ্ড রামায়ণটা। সেই পড়ার মাঝে মাঝে এসে পড়ত কিশোরী চাটুজ্জে। সমস্ত রামায়ণের পাঁচালি ছিল সুর-সমেত তার মুখস্থ। সে হঠাৎ আসন দখল করে কৃত্তিবাসকে ছাপিয়ে দিয়ে হু হু করে আউড়িয়ে যেত তার পাঁচালির পালা— ‘ওরে রে লক্ষ্মণ, এ কী অলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ।’ তার মুখে হাসি, মাথায় টাক ঝক্‌ ঝক্ করছে, গলা দিয়ে ছড়াকাটা লাইনের ঝর্‌না সুর বাজিয়ে চলছে, পদে পদে শব্দের মিলগুলো বেজে ওঠে যেন জলের নিচেকার নুড়ির আওয়াজ। সেই সঙ্গে চলত তার হাত পা নেড়ে ভাব-বাৎলানো।

 কিশোরী চাটুজ্জের সব চেয়ে বড়ো আপশোস ছিল এই যে দাদাভাই, অর্থাৎ কি না আমি, এমন গলা নিয়ে পাঁচালির দলে ভর্তি হতে পারলুম না। পারলে দেশে যা-হয় একটা নাম থাকত।

 রাত হয়ে আসত, মাদুর-পাতা বৈঠক যেত ভেঙে। ভূতের ভয় শিরদাঁড়ার উপর চাপিয়ে চলে যেতুম বাড়ির ভিতরে মায়ের ঘরে। মা তখন তাঁর খুড়িকে নিয়ে তাস খেলছেন। পংখের- কাজ-করা ঘর হাতির দাঁতের মতো চক চকে, মস্ত তক্তপোষের উপর জাজিম পাতা। এমন উৎপাত বাধিয়ে দিতুম যে, তিনি হাতের খেলা ফেলে দিয়ে বলতেন, ‘জ্বালাতন করলে! যাও খুড়ি, ওদের গল্প শোনাও গে।’ আমরা বাইরের বারান্দায় ঘটির জলে পা ধুয়ে দিদিমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় উঠতুম। সেখানে শুরু হ’ত দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে আনার পালা। মাঝখানে আমারই ঘুম ভাঙায় কে। রাতের প্রথম পহরে শেয়াল উঠত ডেকে। তখনো শেয়াল-ডাকা রাত কলকাতার কোনো কোনো পুরোনো বাড়ির ভিতের নীচে ফুকরে উঠত।