পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৮
আত্মচরিত

বৎসর বাঁচিয়া থাকিতেন, তবে দেশের লাভ হইত! গোখেল যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনের খসড়া উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহা গবর্ণমেণ্টের সহানুভূতির অভাবে এমনভাবে উপেক্ষিত হইত না। এতদিনে উহা নিশ্চয়ই দেশের আইনে পরিণত হইত।

 ফ্রুড কৃত কার্লাইলের জীবন চরিত যাঁহারা পড়িয়াছেন তাঁহারা স্মরণ করিতে পারিবেন, যে, উক্ত স্কচ দার্শনিক ও মনীষী যখন এডিনবার্গে ছাত্র ছিলেন, তখন তিনি বিষম উদরের বেদনায় ভুগিতেন। অনিদ্রারোগও তাঁহার চিরসহচর ছিল। অথচ স্বাস্থ্যের বিধি কঠোরভাবে পালন করিয়া এবং নিয়মিতভাবে ব্যায়াম করিয়া তিনি কেবল দীর্ঘজীবন লাভ করেন নাই, জ্ঞানের ক্ষেত্রেও অসাধারণ পরিশ্রম করিতে পারিয়াছিলেন। হারবার্ট স্পেনসার কার্লাইলের অপেক্ষাও রোগে বেশি ভুগিয়াছিলেন। আমি এরূপ আরও অনেক দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতে পারি। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বোধে তাহা হইতে বিরত হইলাম।

 ল্যাটিন সামান্য কিছু শিখিয়া আমি দেখিলাম যে স্মিথের French Principia (Parts I & II) কাহারও সাহায্য ব্যতীত আমি বেশ পড়িতে পারি। ফরাসী, ইটালীয়ান ও স্পেনিশ এই তিন ভাষাই ল্যাটিন হইতে উদ্ভূত; সুতরাং মূল ভাষা ল্যাটিন জানিলে, ঐ তিন শাখা ভাষা অনায়াসেই আয়ত্ত করা যায় এবং এক একটি নূতন ভাষা শিক্ষা করিতে পারিলে যেন এক একটি নূতন জগতের দ্বার উন্মুক্ত হইয়া যায়। সুতরাং আমার জীবনের এই অংশের কথা এখনও যে আমি আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করি, তাহার বিশেষ কারণ আছে। কিন্তু যত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হই না কেন, ইংরাজী সাহিত্য আমাকে যেন যাদু করিয়াছিল। কে. এম্. ব্যানার্জির Encyclopaedia Bengalensis—আমার পিতা যৌবনে পড়িয়াছিলেন। ঐ বহিতে Arnold's Lectures of Roman History, Rollin's Ancient History, এবং Gibbon's Roman Empire হইতে নির্বাচিত অংশ ছিল। ঐগুলি আমার মনের উপর আপনি প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। কয়েক বৎসর পরে বিখ্যাত রোম সম্রাটের Meditations পড়ি। গিবনের প্রসিদ্ধ রোমকসম্রাটত্রয়ের চরিত্রচিত্র (হাড্রিয়ান, এণ্টোনিনাস পিয়াস এবং মার্কাস আরেলিয়াস—ইহারা যেন ভগবানের আদেশে পর পর আবির্ভূত হইয়াছিলেন)—আমার চিন্তাক্লিষ্ট মস্তিষ্ককে অনেক সময় শান্ত করিয়াছে। আমার এই পরিণত বয়সেও, ল্যাবরেটরীতে সমস্ত দিন কাজ করিবার পর আমি লাইব্রেরীতে গিয়া একঘণ্টা ইতিহাস বা জীবনচরিত পড়িয়া বিশ্রাম লাভ করি, তার পর ময়দানে ভ্রমণ করিতে যাই।

 পূর্বোক্ত চেম্বারের Biography ব্যতীত মণ্ডারের Treasure of Biographyও আমার বড় প্রিয় ছিল। আমি ঐ বইয়ের যেখানে ইচ্ছা খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিতাম এবং পাতার পর পাতা পড়িয়া যাইতাম। একদিন ঐ বইতে আমি রামমোহন রায় সম্বন্ধে প্রবন্ধটি পাইলাম এবং দেখিলাম যে ঐ প্রবন্ধটিই স্কুল বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত Reader No. IV এ অবিকল উদ্ধৃত হইয়াছে—যদিও তাহা স্বীকার করা হয় নাই। এই রীডারই হেয়ার স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে পাঠ্য ছিল। Treasury of Biographyতে বহু মহৎ লোকের জীবনী আছে, তন্মধ্যে কেবলমাত্র একজন বাঙ্গালীর জীবনী সন্নিবিষ্ট করিবার যোগ্য বিবেচিত হইয়াছে। ইহা দেখিয়া আমার মনে বেদনাও হইল।

 যখন আমাশয় ব্যাধি হইতে আমি অনেকটা মুক্ত হইলাম, তখন আবার নিয়মিত ভাবে স্কুলে পড়িতে আমার ইচ্ছা হইল। আমি কোন্ স্কুলে ভর্তি হইব, তৎসম্বন্ধে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলাম। আমার পিতা এ সব বিষয়ে মাথা ঘামাইতেন না। আমার উপর তাঁহার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, এবং আমার পছন্দমত যে কোন স্কুলে ভর্তি হইবার জন্য তিনি আমাকে স্বাধীনতা দিয়াছিলেন। আমি প্রায় দুই বৎসর স্কুলে