পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মশায়ের পদধূলিও মাঝে মাঝে পড়তে থাকল, যে বাড়িতে আমার পিতামাতার থিয়সফি নিষ্ঠার দরুণ মাদাম ব্লাভাটস্কি ও কর্নেল অল্‌কটের প্রায়ই গতিবিধি হতে লাগল, যে বাড়ি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, আশুতোষ চৌধুরী, লোকেন পালিত ও অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবী-সহ মাতুলকুলের আবালবৃদ্ধবনিতা প্রায় সমস্ত আত্মীয়-আত্মীয়ার স্মৃতিভারে নমিত ছিল—সে বাড়ি আজ গুঁড়া হয়ে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীটের ধূলায় ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সে বাগানবাড়ির বকুলবীথি, পুকুর চাঁদনি ও ফলফুলের উপবনে যোড়াসাঁকোর শহুরে ছেলেমেয়েদের নতুন নতুন প্রাকৃতিক আবিষ্কারের বিস্ময়, পাড়ার বৌঝিদের মল ঝমঝম করে খিড়কি দরজা দিয়ে জল তুলতে আসা, তার পুকুরে কবি রবির সাঁতারকাটা ও ঘাটে উঠে কল্পনার বীণার ঝঙ্কারে নতুন নতুন কবিতা ও গান ফোটান, সে বাড়ির তেতালার ছাদের ঘরে বড়মামার প্রজ্ঞাঘন জীবনের অনুকূল নীরব প্রশান্ততা—এই সবই কর্পোরেশনের স্টীম রোলারের নীচে পড়ে চিরকালের জন্যে গেছে অন্তর্হিত হয়ে।

 বঙ্কিমের স্মৃতি প্রসঙ্গে “বন্দে মাতরম্‌” গান ও মন্ত্রের স্মৃতি ভেসে না উঠে যায় না। সে গান বঙ্কিম-ভক্তিতে ডোবা আমার প্রাণে প্রথম ফোটেনি। তার ফোটানতে ছিল রবীন্দ্রের হাত। জীবনের প্রথম দিকে কাব্য বা সঙ্গীতের রসগ্রাহিতায় রবীন্দ্রের আত্মপর বিচার ছিল না। যে কবির যেটি ভাল লাগত সেটিতে নিজের সুর বসিয়ে, গেয়ে ও গাইয়ে তার প্রচার করতেন। কোন কোন বৈষ্ণবপদাবলীতে, যেমন, “ভরা বাদর, মাহ ভাদর” এবং বিহারী চক্রবর্তীর দু-চারটি গানেও তাঁরই সুর দেওয়া “গাছে ফুল শোভা যেমন”, “পাগল মানুষ চেনা যায়’’, ‘‘বুঝতে নারি নারী কি চায়” ইত্যাদি, এমন কি “বাল্মীকি প্রতিভায়” বিহারী চক্রবর্তী রচিত একটি গান একেবারে সশরীরে সন্নিবিষ্ট।

 রবীন্দ্রনাথই “বন্দে মাতরম”-এর প্রথম সুর বসিয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া সুরে ঐ দুটি পদে গানটি সর্বত্র চলিত হল। একদিন মাতুল আমায় ডেকে বললেন—“তুই বাকিটুকুতে সুর দিয়ে ফেল্‌ না।” ওরকম ভার মাঝে মাঝে আমায় দিতেন। তাঁর আদেশে “সপ্তকোটিকণ্ঠ কলকলনিনাদ করালে” থেকে শেষ পর্যন্ত ভাবের সঙ্গে ও গোড়ার সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুর দিয়ে ফুটিয়ে নিলুম। দুই একটা জাতীয় উৎসবে সমস্বরে বহুকণ্ঠে বহুজনকে গাইতেও শেখালুম। সেই থেকে সভাসমিতিতে সমস্তটাই গাওয়া হতে থাকল।

৪৭