পাতা:প্রবাসী (একত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাকৃ—যাকু—বোকা ছেলে কোথাকার । কেউ কারও হতে থেয়ে কি পরকাল নষ্ট করতে পারি ?” ছি. ছি, কি জঘন্ত সন্দেহু । তীর্থস্থানে পুণ্যসঞ্চয়ের নেশা-ই, নেশা বইকি—অন্ত কোনো নেশার চেয়ে কিছুমাত্র উচ্চ ও সুন্দর বলিয়। বোধ হইল না। বিস্তীর্ণ ভারতে অসংখ্য জাতির গভীরেগা উর্ণনাভের মত সম্প্রসারিত। তার চেয়ে সূক্ষ্ম তস্থঞ্জাল অন্তঃপুরের বাতায়নে বিলম্বিত। একই গ্রামের পাশাপাশি বাড়ির দুবেলা দেখা অতি পরিচিত লোকগুলির মধ্যে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি কোন দাকে আত্মপ্রকাশ করে তাহার তথা কে নির্ণয় করিবে ? শেষ অবধি আটটা ইটের উমান তৈয়ারী হটল, আট জায়গায় গড়ি চাপিল এবং পুণাতীর্থে পুণ্যকে রক্ষা করিয়া পৃথক পৃথক্ পাত্রে গলে আনন্দে আহার-পৰ্ব্ব সমাধা হইল। পবিত্র প্রয়াগে সকল পাপের বোঝা ফেলিয়া আমর হালকা হইয়া টেনে উঠিলাম। গন্তব্যস্থান—পুষ্কর। টেনে উঠিয়াই রাঙামামীর সে কি কান্না ! বিন্দুদি, কাসর, হু’রের মা প্রভূতি র্তাহাকে সাম্বন-বাকো লাইতে গিয়া খানিক পানিক অশ্র অপব্যয় করিয়া বসিলেন । ব্যাপার আর কিছুই নহে, মনটা তাহার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনীর জন্য কাদিয়া উঠিতেছে। অশ্রুসিক্তকণ্ঠে বার-বার বলিতেছেন, “দেখ না বিন্দু মেয়ে, এমন সময় আমার পটল, গুটুকে ইস্কুল থেকে এসে খাবার চায়। পোড়ারমুখী মায়েরা কি ওঠে ? যে ঘুম আবাসীদের। আমি-ই দুধটুকু গরম করে দি, রুটি ছুগানা একটু গুড় দিয়ে বাছাদের হাতে দি, হ’ল বা মুড়িটা মুড়কীট। তারপর রাত্তিরে আমার কাছেই তারা শোয়—গল্প শুনবে ব’লে। ডানদিক বা দিক নিয়ে কত কাড়াকড়ি মারামারি ।” বিন্দুদি সাম্বন দিতে গিয়া এক ফোটা চোখের জল বাহির করিয়া কহিলেন, “আহ ! আমার ছোটমেয়ের ছেলেটাও আমনি স্থাওটে,—দিদা-দিদা বলে অজ্ঞান। তা প্রাণে পাষাণ বেঁধে এসেছি তীর্থ করতে। ঠাকুরের কাছে দিবে রাত্তির প্রার্থনা করছি—হে ঠাকুর, বাছাদের আমার গায়ে পায়ে ভাল রেখ, ফিরে গিয়ে যেন ভাল দেপতে পারি সব।” হ’রের মা শুস্ক চক্ষুতে অঞ্চল দিয়া কি বলিলেন বোঝ: গেল না । ট্রেন যেন এই সকলকে উপহাস করিয়াই ছুটিতেছিল ; পথে ভাগ্রার তাজ আমাদের আকর্ষণ জনাইল । নামিয়া পড়িলাম। পুণ্যতীর্থ-ভ্রমণ-মুথে মানব-রচিত শ্রেষ্ঠ তীর্থের ধূলিরেণু কোন প্রকৃত মানবাভিমানিনী আত্মার না চিরঅভিলাষের বস্তু ? মেয়ের তাজ দেখিয়া নমস্কার করিতেছিলেন । বিন্দুদি বলিলেন, “পোড়াকপাল : মোচলমানের রাজ্যে না ঠাকুর, না দেবতা " আমনই সকলের যুক্তকর অবনমিত মস্তকের সঙ্গে সোঞ্জ হইয়া গেল। মৃগে ফুটয় উঠিল—আতঙ্ক-বিহ্বল ভাব । জাতিপাতের আশঙ্কায় সকলে একসঙ্গে কলরব করিয়া উঠিলেন। আমি মৰ্ম্মরভিত্ত্বিগাত্রে শ্রদ্ধাপুলকিত আনমিত মস্তক স্পর্শ করিয়া ভাবিতেছিলাম,এই তীর্থ ত জাতির গণ্ডাধের। পুণ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বৃন্দাবনে ধার প্রেমময় মূৰ্ত্তি অন্তরমন লীলা-তরঙ্গে, আবেগে উচ্ছ্বাসে ভরিয়া তোলে, এখানেও সেই মহাম্বুধির একটি তরঙ্গলেখা অনাদি কালের জন্য মানবমনের শ্রদ্ধাকে আকর্ষণ করিতেছে ও করিবে । সংসারের এই যে বাড়িঘর ইটকাঠ আরামশ্রম ক্ষুধাআনন্দের আসনখানি পাতা রহিয়াছে, শুধু ইহারই স্পর্শে সে সকলের একটা স্পষ্ট সার্থকতা বা রূপ আমরা অনুভব করিতে পারি। সুতরাং অস্তুর-দোলায় চিরদোলায়মান সেই স্বন্দরকে শ্রদ্ধার আকৃচন্দনে নিত্য চর্চিত করিয়া হৃদয়ের প্রীতি নিবেদন করিব ইহা আর বিচিত্রই বা কি ? অশুভ ও অশুচির গণ্ডীর বাহিরে ইহার ভিত্তি । র্তাহারা কেহ ভিতরে নামিলেন না। মৃত্যুহীন মরণকে উপেক্ষা করিয়াই পাষাণ-চত্বরে বসিয়া হয়ত বা আপন মনেই বলিতে লাগিলেন, “মাগে, কি কাও ! এত টাকা খরচ ক’রে—”