পাতা:প্রবাসী (দ্বাবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪র্থ সংখ্যা ] বক্তার যুক্তিপ্রণালী ছিল তেমনই দুৰ্ব্বোধ্য। বক্তৃতা আরম্ভ হবার সময় ছাত্রের দলে হল ভরা থাকলেও বেগতিক বুঝে বস্তৃতার মাঝামাঝি তার প্রায় স’রে পড়েছিল। কেবল জনকতক নিতান্ত নাছোড়বান্দা রকমের ছাত্র তখনও হলের বিভিন্ন অংশে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বসে ছিল। বক্তা খ্যাতনামা অধ্যাপক, রয়েল সোসাইটর ফেলে। র্তার ব্যাখ্যায় মৌলিকতার মোহে সকলেই তার বক্তৃতায় অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পোষাক পরা সৌম্যমূৰ্ত্তি ঋজুদেহ অধ্যাপককে সত্যদ্রষ্টা ঋষির মত বোধ হচ্ছিল । বক্তৃতা শুনতে শুনতে কিন্তু আমার মন ভেসে যাচ্ছিল বক্তৃতার বিষয় থেকে অনেক দূর, কলিকাতার ইটপাথরের রাজ্য থেকে অনেক দূর, আমার অভাগিনী বোনটি যেখানে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে সেইখানে। মাঝে মাঝে হলের খোলা দুয়ার দিয়ে জ্যোৎস্না-ওঠা বাইরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকৃতে উমারাণীর বালিকা-মুখখানি বড় বেশী ক’রে মনে পড়ছিল। আর মনে পড়ছিল তার সেই মিনতিভর দৃষ্টি, অনেক দিন পরে বাবাকে দেখতে পাবার জন্যে তার সে করুণ আগ্রহ । তার আগ্রহ-ভরা দাদা ডাকটি অনেক দিন পরে আবার বড় মনে পড়লো। ভাবলুম সত্যিই কারুর কাছ থেকে কোনো স্নেহ সে কখনো পায় নি। আজ বিজ্ঞানের গভীর তত্ত্বকথার রস আমার স্বায়ুমণ্ডলী বেয়ে সমস্ত দেহে যখন পুলক ছড়িয়ে দিচ্চে, তখন আমার মনের উন্নত আনন্দের অবস্থার সঙ্গে আমার অভাগিনী স্নেহবঞ্চিত বোনটির নির্জন জীবনের অবস্থা কল্পনা করে আমার মন যেন কঁদে উঠলো। বাইরের জগতে যখন এত বিচিত্র স্রোত বয়ে যাচ্চে, তখন সে কি শুধু ঘরের কোণে ব’সে দিনরাত চোখের জলে ভাস্বে ? জগতের আনন্দবাৰ্ত্তা তার কাছে বহন ক'রে নিয়ে যাবার কি কেউ নেই ?. বাইরে যখন এলুম তখন গোলদীর্ঘীর জলের উপর চাদ উঠেছে, কিন্তু ধোয়া-ভরা আকাশের মধ্যে দিয়ে জ্যোংস্কার শুভ্রমহিমা আত্মপ্রকাশ করতে পারছে না। আমার মস্তিষ্ক তখন বক্তৃতার নেশায় ভরপুর, পুকুরের জলের ধারে সবুজ,ঘাসের মাৰুে মাৰে মণ্ডমী ফুলের উমারাণী ৫২১ ক্ষেতগুলো আমার চোখের সামনে এক নতুন মূৰ্ত্তি ধরেছে। কিন্তু ত্রয়োদশীর অমন বৃষ্টি-ধোয় ধুইফুলের মত জ্যোৎস্নাও ধোয়ার জাল কাটিয়ে বাইরে আসতে না পেরে ব্যর্থতার দুঃখে কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে লক্ষ্য ক’রে আমার একটা কথাই কেবল মনে হতে লাগলে— এই জ্যোংস্না, এই ফুলের ক্ষেত, এই ত্রয়োদশী, এবারকারের মত সব মিথ্যা, সব ব্যর্থ . ও জোৎস্ব প্রতীক্ষায় থাকুকু সেই শুভ রাতটির, যে রাতে আকাশ-ভরা সার্থকতা ওকে বরণ কবে নেবে ফোট-ফুলের ঘন স্বগন্ধের মধ্যে দিয়ে, তরুণ-তরুণীদের অনুরাগ-নম্র দৃষ্টি-বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে, গভীর রাতের নীরবতার কাছে পাপিয়ার আকুল আত্মনিবেদনের মধ্যে দিয়ে।. বাড়ী এসে ভাবতে ভাবতে একদিন নানা কাজের ভিড়ে আমার যে বোনটিকে আমি হারিয়ে বসেছিলুম, তারই কাছে স্নেহের বাণী ব’য়ে নিয়ে যেতে আমার প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠলো। এরি কয়েকদিন পরে কলকাতা ছেড়ে বার হলুম উমারাণীর কাছে যাব ব'লে। শীত সেদিন নরম পড়ে এসেছে, ফুটপাথ বেয়ে হাটুতে হাটুতে দখিন হাওয়া অতকিত ভাবে গায়ের উপর এসে পড়ে উৎপাত করা মুরু করে দিয়েছে। পরদিন বেল প্রাধ ২টার সময় ওদের ষ্টীমার-ষ্টেশনে নেমে শুনলুম ওদের গা সেখান থেকে প্রায় ৪ ক্রোশ । হেঁটে যাওয়া ছাড়া নাকি কোন উপায় নেই, কোন রকম যান-বাহনের সম্পূর্ণই অভাব। কখনো এদেশে আসিনি, জিজ্ঞাসা করতে করতে পথ চলতে লাগলুম। কঁচা রাস্তার দুধারে মাঠ, মাঝে মাঝে লতাপাতায় তৈরী বড় বড় ঝোপ । কোনো কোনো ঝোপের মাথায় আলোক-লতার জাল, কোনো কোনো ঝোপের তাজ সবুজ ঘন-বুনানি মাথা আলে৷ ক’রে ফুটে আছে সাদা সাদা মেটে-আলুর ফুল। মাঠে মাঠে মাটর ঢেলার আড়ায়ে ঝুপূসি গাছে দ্রোণ-ফুলের খই ফুটে আছে । মাঠ ছাড়ালে গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে মাটীর পথের উপর অভ্যর্থনা বিছিয়ে রেখেছে রাশি রাশি সজনে-ফুল। গ্রামের হাওয়া আমের বোলের আর বাতাবী নেৰু-ফুলের গন্ধে মাতাল। বুনো স্কুলে, আর