পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/১৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S)&Wッ জোরে তাহাকে এইগুলা শুনাইতেছে, সেই জোরটুকু!— পুরাতন কথাগুলাই তাহার কানে নূতন স্বরে নূতন করিয়া বাজিতে লাগিল। কিছুই নয় বলিয়া সেগুল উড়াইবার চেষ্টা করার চেয়ে, আমি কিছুই নই এইটুকু প্রতিপন্ন করা বরং সহজ মনে হইল,—কথাগুলা এমনই তেজস্বী, এমনি প্রাণবন্ত । ভকতজী মাথা হেঁট করিয়া রহিল, আন্দু ইচ্ছামত পথে গাড়ী স্থাকাইয়া চলিল, সে প্রতিবাদ মাত্র করিল না, তাহার মনের ভিতর যে তখন কি হইতেছিল, তাহ অন্তর্যামীই জানেন। ভকত যেন অভিভূত জড় হইয়া বসিয়া রহিল। এই আন্দু সেই আন্দু! যে কুস্তির আখড়ায় ধূলা মাখিয়, সরল শিশুর মত হাসিয়া পেল করে? এ সেই লোক ? ভকতের সারা মনটা যেন কেমন বিকল হইয় আসিল । গঙ্গার ধারের নির্জন রাস্ত দিয়া গাড়ী ছুটিয়া চলিয়াছে, আন্দু মাত্র রাশটি ধরিয়া আছে, আর রোথের সহিত প্রাণ খুলিয়া কথা কহিতেছে ভকত কিন্তু একেবারে নিঝুম। রাস্তার ধার হইতে একজন লোক ডাকাডাকি করিয়া গাড়ী থামাইতে বলিল। আলু চাহিয়া দেখিল, শন্থ মাড়োয়ারী। শম্ভু মাড়োয়ারী এখানকার একজন প্রসিদ্ধ আড়তদার। বিষয়সম্পত্তি একসময় যথেষ্টই ছিল, কুসংসর্গে পড়িয়া সবই খোয়াইয়াছে, এখন আছে শুধু ঠাটটুকু। বয়স প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছিয়াছে, তবু নেশা এখনো ছুটিল না। আন্দু শুনিয়াছিল, বালক লছমীভকত ইহার সঙ্গে মিশিয়াই এমন দ্রুতবেগে উৎসন্নে চলিয়াছে। তাহাকে মধ্যপথে দেখিয়া এখন সে লছমী ভকতের সোজাপথে ভ্রমণের অনাবশ্বক কৈফিয়ংটার মৰ্ম্ম স্পষ্ট বুঝিল । গাড়ী থাৰ্মাইল । তাহার সর্বাঙ্গ জলিতেছে, তথাপি সে মাথা নোয়াইয় নমস্কার করিল। শম্ভু মাড়োয়ারীর কপালে রক্তচন্দনের প্রকাও ফোট, মাথায় টিকির উপর জরির ফুলকাটা মখমলের টুপী, পায়ে জরির লপেটা, গায়ে আদ্ধির পাঞ্জাবী, কাধে বেনারসী চাদর, হাতে আবলুশ কাঠের গৌধীন ছড়ি। মাড়োয়ারী গাড়ীতে উঠি আলুকে বলিল, “একি সাহেব, তুমি যে বড় এরাস্তায় এলে।” আন্দু বলিল “আজে ষ্ট্য, বুঝতে পারিনি, বাকা রাস্তায় এসেছি।” প্রবাসী-আষাঢ়, ১৩২২ [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড লছমীভকত কোন উচ্চবাচ্য না করিয়া একটু সরিয়া তাহাকে বসিতে জায়গা দিল। মাড়োয়ারী এই নাবালকটির আসন্ন অভিভাবকের মত সদম্ভে জাকিয়া বসিল । গাড়ী পুনশ্চ ছুটিল। মাড়োয়ারী বুঝিল গাড়ী আজ ঠিক গন্তব্যপথে ছুটিতেছে না। সঙ্গে আন্দু রহিয়াছে, সুতরাং কথাটা খোলসা করিয়া জিজ্ঞাস করিতে ও দ্বিধা বোধ করিল। অগত্য পকেট হইতে চামড়ার সিগার-কেস বাহির করিয়া দুটি সিগারেট লইয়। একট। লছমী ভকতকে দিল, দ্বিতীয়টি নিজে মুখে ধরিল ; কি ভাবিয়া পুনরায় আর-একটি সিগারেট লইয়া আন্দুর দিকে হাত বাড়াইয়া বলিল, “নাও, তুমি একটা নাও, জন্মট সার্থক কর।” চাবুকমৃদ্ধ মুষ্টি কপালে ঠেকাইয়া আন্দু বলিল “সিগারেট আমি পাই না, কালে ভদ্রে কখনো এক আধ টান সঙ্গ করে খেয়েছি। এখন সৰ্থ চুকে গেছে।" মাড়োয়ারী জেদের সহিত বলিল “আহা খেয়েই দেখন একটা ।” আন্দু হাসিয়া বলিল, “থেয়ে আর দেখব কি ? সে ত পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, চোখে দেখব শুধু চমৎকার ধোয়৷ ও আপনি রেখে দিন।" ভকত একদৃষ্টে আন্দুর মুখপানে চাহিয়া রহিল। মাড়োয়ারী অগত্য সিগারেট যথাস্থানে রাথিয়া, দেশলাই জালিয়া নিজের মুখে অগ্নিসংস্কারে প্রবৃত্ত হইল। ভকত সিগারেট হাতে চুপ করিয়া বসিয়া রহিয়াছে দেখিয়া ঠোটে সিগারেট চাপিয়া অস্পষ্ট স্বরে বলিল “কই খেলে না ?" ভকত শুষ্ক মূপে বলিল না, "বড় মাথা ধরেছে।” মাড়োয়ারী বলিল, “রোদে রোদে কোথায় ঘুরবে ? বেলাও তো হল, কোথাও জিরুবে চল ।” আন্দু ভকতের মুখপানে চাহিল। ভকত ত্রস্তস্বরে বলিল “না না, যে রাস্তায় যাচ্ছ সেই রাস্তাতেই ঢল।" মাড়োয়ারী যেন বিষম ধাধায় পড়িল। সে একবার ভকতের মুখপানে একবার আব্দুর মুখপানে বিশ্বয়পূর্ণ নয়নে চাহিতে লাগিল, কিছুই বুঝিতে পারিল না। ইহার উভয়েই যেন নিজেদের অগোচরে কি একটা কিছু করিয়া বসিয়াছে, উভয়েরই এমনিতর ভাবখানা। ভকত্বের ৩য় সংখ্যা ] প্রতিবেশী খোচাধুচি যুক্তিসঙ্গত নহে দেখিয়া চুপ করিয়৷ রহিল। হঠাৎ আন্দু ভকতের হাতে অশ্ববল্প ও চাবুক দিয়া গাড়ী হইতে লাফাইয়া পড়িল। ভকত ব্যগ্র ব্যাকুলতায় বলিল “কোথায় যাচ্ছ ?” আন্দু মাথা নাড়িয়া হাসিমুখে বলিল "চলে যান গাড়ী হাকিয়ে, আমি আমার কাজে চলুম।" আন্দুর সেই শাস্তমুখের সহজ কথাটি দেবতার আদেশের মত ভকতের বক্ষে যেন মহা নিৰ্ভীকতার বর্শ পরাইয়া দিল। তাহার অন্তরের মধ্যে এতক্ষণ যে অনুতাপ পূৰ্বীকৃত হইয়া উঠিয়াছিল, এতক্ষণে তাহাতে যেন পরম সাশ্বনা আসিল ; স্পৰ্দ্ধা ও গ্লানির দ্বন্দ্বের এতক্ষণে বিবেকের বিচারে নিঃসংশয় মীমাংস হইয়া গেল ; তাহার মনে হইল আন্দু তাহার জীবনস্বত্র লইয়। এতক্ষণ জট ছাড়াইতেছিল, এবার তাহার সমস্ত গ্রন্থি নিযুক্ত করিয়া তাহার হাতে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে সমর্পণ করিয়া ভকত আদেশ দিল, "চলে যাও!” ভকত আশ্বস্তচিত্তে সোৎসাহে ঘোড়ার পিঠে চাবুক কৰিয়া তীরবেগে গাড়ী ছটাইল। পিছুদিকে মুখ ফিরাইয়৷ একবার চাহিল, দেখিল আন্দু একটি নবজাত ছাগশিশুকে বুকে করিয়া লইয়া যাইতেছে, ছানাটি এতক্ষণ রাস্তার ধারে মাতৃহারা হইয়া চীৎকার করিয়া ডাকিয়া ফিরিতেছিল। ভকতের স্মরণ হইল, তাহার খানিক আগে, এক ছাগীকে পথের ধারে ঐরুপ একটি শাবক লইয়া বিশ্রাম করিতে দেখিয়াছে, আন্দু বোধ হয় সেইখানেই যাইতেছে। ভকতের চক্ষু অশ্রুসজল হইল, ধন্য আন্দুর কোমল প্রাণ, একটা ছাগশিশুর কাতরতা ও তাহার কর্ণ অতিক্রম করিল না ! মাড়োয়ারী একট। অভাবনীয় বিপ্লবের স্পষ্ট স্বচনা দেখিয়া অত্যন্ত বিরক্ত হইল, খানিকদূর গিয়া বলিল "গাড়ী থামাও, আমি পাড়ের সঙ্গে দেখা করে যাব।" ভকত বিরুক্তি না করিয়া তাহাকে নামাইয়া দিয়া, গাড়ী ঘুরাইয়া ফিরিয়া চলিল। মাড়োয়ারী বুঝিল ভকত আর তাহার হাতে নাই। আলুকে অভিশাপ দিয়া সে পাড়ের বৈঠকখানায় চলিল। ভকত আসিয়া দেখিল, আন্দু মিঞা ছাগমাতার নিকট সেখ আন্দু -്.--സുഹാ ৩৬৭ পথের ধূলির উপর জাহ পাতিয়া বসিয়া হাস্যস্থদের মুখে ছাগশিশুকে ধরিয়া মাতৃদুগ্ধ পান করাইতেছে। কাছাকাছি হইয়া ভকত রাশ টানিয়া গাড়ী থামাইল। আন্দু মাথ৷ তুলিয়া বলিল ফিরে এলেন ?” ভকত বলিল “ফিরেই চলেছি, গাড়ীতে এস।” আন্দু বলিল “না, আপনি চলে যান। কার ছাগল খোজ করে বাড়ী দিয়ে যাব—” ভকত শাস্তমুখে বলিল “আন্দু সাহেব তোমায় বলতে এসেছি, আমি আজই মামার বাড়ী যাব, এখানে থাকলে ঐ সব বদসঙ্গীর টান হয়ত এড়াতে পারব না ; লক্ষ্মীছাড়ার মত আবার বদখেয়ালীতে মাতব, কিন্তু আর নয়।” ভকত ঘোড়ার পিঠে চাবুক কসিল। আন্দু আদাব দিয়া, বিহবলভাবে সেইদিকে চাহিয়া রহিল। ( & ) আন্দু যখন স্বানের জন্য গামছা আনিতে রহিমের কাছে আসিল, তখন অনেক্ষ বেলা হইয়াছে। রহিম রাগ করিয়া তাহার উপর অনেক কটুকটব্য বর্ষণ করিয়া যখন নবাবের পৌত্র বলিয়া তাহাকে অভিহিত করিল, তখন আন্দু হাসিয়া বলিল “আমি যদি নবাবের নাতী হই, তা হলে আমার চাচা নবাবের কে হয় ?” রাগের মাথায় রহিম বলিল “ব্যাট হয় ।” “কেয়াবাং !" বলিয়া আন্দু হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। "দেখলে চাচা, তাই তোমার মেজাজে এত নবাবীর গন্ধ পাই। নবাবের সঙ্গে তোমার এত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ তা কি জানি—" অপ্রস্তুত হইয়া রহিম বলিল “যাও যাও, ঢের বেলা হয়েছে, চান টান করে এস। কোথাকার ছেলেমাচুর্য জানি না, রাত্রে খাওয়া নেই ঘুম নেই, তা খেয়ালই নেই। সাহেবের সঙ্গে যারা গেছল, তারা থেয়ে দেয়ে এক ঘুম ঘুমিয়ে উঠল, আর তুমি টাে টে। করে কোথায় ঘুরছ তার ঠিক নেই। ষাও শীঘ্রি—” আন্দু মিনতি করিয়া বলিল, “চাচা, তুমি ভাত বেড়ে থেতে বস, আমি নিশ্চিন্দি হয়ে নাইতে যাই।" রহিম অসম্মতি প্রকাশ করিল। কিন্তু আব্দুর মিষ্ট মুখের পীড়াপীড়ি এড়ান বড় শক্ত কথা, অগত্য আন্দুর অল্পব্যঞ্জন