পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩২৮

স্বাধীনতা সংগ্রা নিশ্চয়ই শুরু হয়ে গেছে। অন্ততঃ বিবিসি থেকে সকালে সে আভাসই দেয়া হয়েছেবাঙ্গালী মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছে- ওরা গোপন বেতার থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা ঘোষনা করেছেবিবিসি তার উদ্ধৃতি দিয়েছে। গোপন বেতার থেকে দাবী করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু মুক্তিবাহিনীর সাথে আছেন। বঙ্গবন্ধু খবর শুনে কিছুটা নিশ্চিত হলাম (যদিও পরে তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি)।

 রেসকোর্স- শাহবাগের মোড় পেরিয়ে কাঁটাবন বস্তির পাশে পৌছিলাম- এ পথ আসতে কতক্ষণ লেগেছিলো বলতে পারবো না। বস্তির পাশের রাস্তার ওপর দেখলাম রক্তমাখা বেশ ক'টি পায়ের ছাপ। রাস্তার ওপর বেশ ক'টি ব্যারিকেড চিহ্ন করতে এসে গুলী খেয়েছে। ক'জন মরলো কে জানে। রক্তমাখা পায়ের ছাপগুলোও বস্তির দিকে এগিয়ে গেছে। আরো দশ পায়ের মত সামনে এসে দেখতে পেলাম ফুটপাতে আর রাস্তায় মাঝখানের নর্দমায় একটি রক্তের নহর। রাস্তায় থেকে ড্রেনে জমে থাকা রক্তস্রোতে জমাট বেধে ঁথক থক করছে- ক’জন রীববন্ধু সেদিন সেখানটায় আত্মহুতি দিয়ে ছিলেন- কি নাম তাদের - নিজের দেশে মোহাজের এসব বীরদের পৈতৃক ভিটেই বা ছিলো কোথায়?

 এই মুমূর্তে আমার আর কোন অনূভূতি নেই- নেই কোন উপলদ্ধিও। আমি হাঁটছি... হাঁটছি নিজের ঘরের পানে হাঁটছি আমার নিজের এবং আমার আত্মজ-আত্মজাকে বাঁচানো এক স্বার্থপর দুর্দমনীয় মনোবৃত্তি নিয়ে আর আমার চলার পথের এসব দৃশ্যগুলো কেবল দেখছি আর দেখছি। পুরানো রেল লাইনের (মহসীন হলের পিছনে) ওপারকার বস্তিগুলো ও তখন এক বিরাট ধ্বংসস্তুপ- বস্তির ছোট ছোট ঘরগুলো পুড়ে সুন্দর ছাইয়ের স্তুপে পরিণত হয়েছে। ক’জন ওরা এখানে মরলো তার হিসাবই বা কে রাখে।

 এলিফ্যাণ্ট রোড আর ল্যাবরেটরী রোডের সংযোগস্থলে দেখলাম বেশ ক'জন পাষণ্ড রাস্তায় টহল দিচ্ছে। আমি অনেকটা টহলে টহলে তাদের সামনে দিয়ে পার হচ্ছি। হঠাৎ একটি বিক্ষুদ্ধ কণ্ঠে থমকে পেছনে ফিরে চাইলাম। দেখলাম পাকিস্তানী সামরিক পোশাকের আবরণে বন্দি একজন বলছেন স্পষ্ট বাংলায়ঃ শালারা আমরা তো গেছি- তোদের দিনও আর বেশী বাকী নেই। এবার যেতে হবে। বুঝলাম কোন বাঙ্গালী হয়তো নিজেকে বাঁচানোর জন্যই তাদের সাথে টহল দিতে এসেছেন একান্ত অনিচ্ছায়। কথাগুলো বলেছেন, তার কোন পাঞ্জাবী হার্মাদ সহকর্মীকেই। সেই বাঙ্গালী সৈনিকটি আজ আর বেঁচে আছেন কিনা কে জানে।

 বিজ্ঞান গবেষণাগারের কাছে এসে শুনলাম পাশের বাড়ীতে দু'টি লাশ রয়েছে। আগের রাতে পাষগুরা ওদের হত্যা করেছে বাড়ীর ভেতর ঢুকেই। এখানেই মীরপুর রোডের ওপর এ পাষণ্ড দাঁড়িয়ে মাইক দিয়ে ঘোষনা করছে, কারফিউ বিকেল চারটা পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে। এই ঘোষণায় আমার চলার গতিও কিছুটা শিথিল হলো। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম রায়ের বাজারস্থ আমার বাসার দিকে। প্রায় বারোটায় বাসায় পৌঁছিলাম। বাসায় পৌঁছে নতুন করে আবার আতঙ্কগ্রন্থ হলাম।

 সাতাশে মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল করার পর রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম, যেন মানুষের মিছিল। হাজার হাজার মানুষ উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছেন- কারো বা কোলে বাচ্চা, পিঠে বোঝা- হাতে ধরা রয়েছেন পত্নী বা কন্যা। সমস্ত লোক ছুটে পালাচ্ছেন শহর থেকে গাঁয়ের দিকে। কেননা তাঁদের ধারনা জল্লাদ বাহিনী হয়তো বা শহরেই চালাবে তাদের তাণ্ডবলীলা- গ্রাম পর্যন্ত হয়তো পৌছুবে না কিন্তু কালক্রমে ওদের ও ধারণা মিথ্যে বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে। ইয়াহিয়া -টিক্কার নরখাদকরা শহরের চাইতেই গ্রামেই শেষের দিকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল বাংলাদেশের ৬৬ হাজার গ্রামের মধ্যে ৩০ হাজার গ্রাম ওরা পুড়িয়েছে- চালিয়েছে মানব ইতিহাসের সব চাইতে জঘন্য ও ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড।