পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/২২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২১২ বিভূতিরচনাবলী ওর ভাবার্থটাও ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। বুঝেছেন কি না ? এ সব ক্ষেত্রে মাস্টার মশাই কোন কথা বলতেন না বড় একটা । কাকাকে তিনি বেশ সমীহ করে চলতেন। তিনি বড় একটা বুদ্ধির অঙ্ক কষতে পারতেন না। একদিন কাকার সামনে তিনি একটা অঙ্ক এক্স দিয়ে কষছিলেন। কাকা বললেন, সব গোলমাল হয়ে গেল মাস্টার মশাই । তিনি বললেন, কেন ? কাকা বললেন, ও অঙ্ক তো আলজেব্রার প্রসেস অনুযায়ী আপনি করতে পারবেন না । যাই হোক, তিনি কিন্তু কোন উপায়েও আমায় অঙ্কটা বুঝিয়ে দিতে পারলেন না। তিনি চলে যাবার পর কাকা বললেন, মাস্টার তত সুবিধের নয়। এমন সময়ে বিশ্বকৰ্ম্ম পূজা এল। আমরা বললুম, মাস্টার মশাই, আমাদের ঘুড়ি-লাটাই কিনে দিতে হবে । তিনিও রাজী হলেন কারণ তিনি সম্প্রতি মাইনে পেয়েছিলেন। তিনি আমাদের সেন্ট জেমস স্কোয়ারের দক্ষিণ কোণের একটা মনোহারী দোকান থেকে এক টাকার প্রায় ঘুড়ি লাটাই কিনে দিলেন। কিন্তু আমাদের.তিনি যা কিনে দিতেন সে সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলা নিষেধ ছিল। এসব লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দিতেন। রেবার জন্মদিনে তিনি তিন টাকা দামের একটা কলের রেলগাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কাউকে বোলো না যেন ঘূণাক্ষরে । বিশ্বকৰ্ম্ম পূজার দিন চারেক পর একদিন শ্ৰীনাথ দাস লেনে মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে দেখা। আমি নমস্কার করলুম। তিনি বললেন, এই যে, পিণ্ট, যে। কোথায় চলেছে ? আমি বললুম, আপনি কোথায় থাকেন মাস্টার মশাই ? তিনি বললেন, এইখানেই । —চলুন না দেখে আসি । কি জানি কেন মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি দেখবার জন্তে আমি অত্যন্ত উত্তলা হলুম। তিনি দ্বিধায় আমায় নিয়ে গেলেন তার অপূৰ্ব্ব গৃহে। টিনের চাল দেওয়৷ একথান মেটে বাড়ির দোতলায় একখানা ছোট ঘরে থাকেন। সরু ভাঙা সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে ভয় করে । ফালি বারান্দাটা মানুষের ভারে সামান্ত কাপে । আস্তে আস্তে র্তার পিছু পিছু র্তার ঘরের দিকে গেলুম । তিনি গিয়ে তার ঘরের তাল খুললেন । অপরিষ্কার ও অপরিসর ঘর। দেওয়ালে কতকগুলো ক্যালেণ্ডার টাঙানে। একপাশে একথান। বিবেকানন্দের ছবি । মেঝের ওপর একটা খাটিয়া পাত, তার ওপর আবার একটা কালো ও তেল-চিট্‌চিটে বালিশ। মাস্টার মশাই আমায় বসিয়ে ‘আসছি বলে কোথায় চলে গেলেন সহসা । আর আমি তার ঘরখানা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলুম। বড় দুঃখ হ’ল তার দারিদ্র্যক্লিষ্ট অবস্থা দেখে । ঘরের মধ্যে আর একখানা কাপড়ও নেই। যদিও বা একখানা আছে তাও শতছিন্ন এবং অত্যন্ত কালো। একটি জামা ও একখানি মাত্র কাপড়ে তাকে দিন কাটাতে হয়। আমার বড় অমুকম্পা জাগল তার প্রতি। তাকে যে আমি এত ঘৃণা করতুম তা একেবারে বিশ্বত হলুম। হঠাৎ যেন আমি একেবারে বদলে গেলুম। এমন সময়ে মাস্টার মশাই এক ঠোঙ্গ খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন । আমি ব্যথিত মুরে বললুম, ও সব আবার কেন মাস্টার মশাই । তিনি আমার কথা শুনে একটু যেন আশ্চৰ্য্যান্বিত হলেন । আমতা আমতা করতে লাগলেন, না-না, এ আর এমন কি ?