পাতা:বৃহৎ বঙ্গ - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আখ্যা প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন। জয়দেবকৃত কৃষ্ণশ্লোকে তাঁহাকে “কংসদানবঘাতিন” বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে।

শৈব রাজাদের অনেকেই যজ্ঞে পশুবলির প্রতিবাদী ছিলেন। নরকের বিরুদ্ধে ইহাই প্ৰধান অভিযোগ ছিল। স্বয়ং শিব দক্ষের যজ্ঞ নষ্ট করিয়াছিলেন। সমস্ত বাঙ্গলাদেশ এক সময়ে কৃষ্ণ এবং যজ্ঞানুষ্ঠানকারী ব্ৰাহ্মণদের বিরুদ্ধবাদী ছিল। দেশ ব্যাপিয়া সেই সময়ে ভোলানাথের ধ্বজা উড়িতেছিল; কৃষ্ণ-সমশ্রিত ব্ৰাহ্মণ্যধৰ্ম্ম এদেশে সে যুগে সমাদৃত হয় নাই। পরবর্তী কালে যজ্ঞ-নিষেধকারী, সাম্য-প্রচারক, করুণাখনি বুদ্ধদেবকে শিব তাহার সামাজ্য ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। বহুযুগ পরে যখন এ দেশ কৃষ্ণকে স্বীকার করিল, তখন তাহাকে শঙ্খচক্ৰগদা ছাড়িয়া এ দেশের মাটিতে পদাৰ্পণ করিতে হইয়াছিল। বাঙ্গালী তাঁহার হাতে একটি বাঁশী দিয়া তাঁহার আনুগত্য স্বীকার করিল। এ দেশ কখনই ঐশ্বৰ্য্যকে গণ্য করে নাই; বল দিয়া এ দেশ কখনই জয় করা যায় নাই; বাঁশীর সুরেপ্রেমের আহ্বানে বাঙ্গালী চিরকাল সাড়া দিয়াছে।

জরাসন্ধের চরিত্রে বৃহৎ বঙ্গের ক্ষত্ৰনীতি অতি উজ্জ্বলভাবে প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে। কৃষ্ণের নীতি ও জরাসন্ধের নীতি দুই ভিন্ন সামগ্রী। ইন্দ্রপ্রস্থের নীতি "মারি অরি, পারি যে কৌশলে।" কৃষ্ণ ধৰ্ম্মাবতার সাধুচরিত্র যুধিষ্ঠিরের মুখে মিথ্যা কথা কহাইয়া গুরুবধ করাইয়াছিলেন; ক্ষাত্ৰনীতি উল্লঙ্ঘন করিবার ইঙ্গিত দিয়া অন্যায় ভাবে ভীম কর্তৃক দুৰ্য্যোধনের হত্যা ঘটাইয়াছিলেন; ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে স্বীয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়াছিলেন; ছদ্মবেশে গিরিব্ৰজপুরে প্রবেশপুৰ্ব্বক উপবাসী জরাসন্ধের এবং কৌশলে দিবাবসানের চাতুরী খেলিয়া জয়দ্রথের হত্যার কারণ হইয়াছিলেন।

এগুলি মহাভারতের উপকথা মাত্র। কিন্তু পূৰ্ব্বভারতের যাহা কিছু কাব্যকথা ও গল্প তাহদের সকলের মূলে সনাতন ধৰ্ম্মাশ্রিত মহানীতির পরিচয় জাজ্বল্যমান। মহাভারতেও জরাসন্ধের চরিত্র বিশ্লেষণ করিলে আমরা তাহাই দেখিতে পাইব।

জরাসন্ধের ক্ষাত্রনীতি

যুগে যুগে রাজনৈতিক আদর্শ ও ক্ষাত্রধৰ্ম্মের মূলভাবের পরিবর্তন হইয়াছে সত্য, কিন্তু সমুদ্র যেমন তাহার সিকতাভূমি লঙ্ঘন করে না,-মহারাজ জরাসন্ধ তদ্রুপ সেই যুগে আচরিত ক্ষাত্ৰনীতি উল্লঙ্ঘন করেন নাই। প্রথমতঃ জরাসন্ধ যদুবংশীয়দের প্রবল প্ৰতাপ সম্বন্ধে সমস্ত বিদিত হইয়াও স্বয়ং যুদ্ধকামী বা সাম্রাজ্যবৃদ্ধির ইচ্ছুক হইয়া বিনাকারণে কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন নাই। এমন কি যখন কৃষ্ণ জরাসন্ধ-জামাতা কংসকে নিধন করেন—তখনও মগধ-সম্রাট দ্বন্দ্ব করিতে উদ্যত হন নাই। কিন্তু যখন তাঁহার প্রিয় কন্যা অস্তি তাঁহাকে স্বীয় স্বামি-হত্যার প্রতিশোধ লইতে ক্রমাগত উত্তেজিত করিয়া করুণ আৰ্ত্তনাদে রাজপ্রাসাদ মুখরিত করিয়া তুলিলেন, তখন তিনি যুদ্ধের আয়োজন করিলেন। প্ৰথম অভিযানে যদুবীরেরা তাহার অসামান্য শক্তির পরিচয় পাইয়াছিলেন, তথাপি তাহা ব্যর্থ হইয়াছিল; কিন্তু অস্তি তাহাকে বসিয়া থাকিতে দেন নাই, ক্রমাগত উস্কাইয়া পুনঃ পুনঃ যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করাইয়া জরাসন্ধের সামরিক অভিযানগুলির ইন্ধন যোগাইয়াছিলেন।