রামমােহন অত্যন্ত উৎসাহিত ও গর্ব্বিত হইয়া উঠিল। মহিষী তাহাকে ডাকাইয়া লইয়া গেলেন, নিজে উপস্থিত থাকিয়া তাহাকে আহার করাইলেন। সে তৃপ্তিপূর্ব্বক ভােজন করিলে পর তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন,—“মােহন, এই বারে তাের সেই আগমনীর গানটি গা।” রামমােহন বিভার দিকে চাহিয়া গাহিল;—
“সারা বরষ দেখিনে মা, মা তুই আমার কেমন ধারা,
নয়ন-তারা হারিয়ে আমার অন্ধ হ’ল নয়ন-তারা!
এলি কি পাষাণী ওরে,
দেখ্ব তােরে আঁখি ভােরে,
কিছুতেই থামেনা যে মা, পােড়া এ নয়নের ধারা!”
রামমােহনের চোখে জল আসিল, মহিষীও বিভার মুখের দিকে চাহিয়া, চোখের জল মুছিলেন। আগমনীর গানে তাঁহার বিজয়ার কথা মনে পড়িল।
ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। পুরমহিলাদের জনতা বাড়িতে লাগিল। প্রতিবেশিনীরা জামাই দেখিবার জন্য ও সম্পর্ক অনুসারে জামাইকে উপহাস করিবার জন্য অন্তঃপুরে সমাগত হইল। আনন্দ, লজ্জা, আশঙ্কা, একটা অনিশ্চিত, অনির্দ্দেশ্য না জানি-কি-হইবে ভাবে বিভার হৃদয় তোলপাড় করিতেছে, তাহার মুখ কান লাল হইয়া উঠিয়াছে, তাহার হাত পা শীতল হইয়া গিয়াছে। ইহা কষ্ট কি সুখ কে জানে!
জামাই অন্তঃপুরে আসিয়াছেন। হুল-বিশিষ্ট সৌন্দর্য্যের ঝাঁকের ন্যায় রমণীগণ চারিদিক্ হইতে তাঁহাকে আক্রমণ করিয়াছে। চারিদিকে হাসির কোলাহল উঠিল। চারিদিক্ হইতে কোকিল-কণ্ঠের তীব্র উপহাস মৃণাল-বাহুর কঠোর তাড়ন, চম্পক-অঙ্গুলির চন্দ্র-নখরের তীক্ষ্ণ পীড়ন চলিতে লাগিল। রামচন্দ্র রায় যখন নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িয়াছেন, তখন একজন প্রৌঢ়া রমণী আসিয়া তাঁহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া বসিল।