পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাণিক গ্রন্থাবলী

খাইয়াছে এমনি মুখ করিয়া শ্যামার আশেপাশে ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করিয়া বাহির হইয়া গেল! বাড়ি ফিরিল একদিন পরে।

 এত কাল পরে আবার মার খাইয়া শ্যামাও নম্র হইয়া গিয়াছিল, শীতল বাড়ি ফিরিলে সে যেভাবে সবিনয় আনুগত্য জানাইল, প্রহৃতা স্ত্রীরাই শুধু তাহা জানে এবং পারে। তবু অশান্তির অন্ত হইল না। পরস্পরকে ভয় করিয়া চলার জন্য দারুণ অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটিতে লাগিল।

 শ্যামা বলে, বেশ ভদ্রতা করিয়াই বলে — তুমি এমন মন খারাপ করে আছ কেন?

 শীতলও ভদ্রতা করিয়া বলে — টাকাটা যদ্দিন না শোধ হচ্ছে শ্যামা—

 হঠাৎ মাসিক উপার্জন একেবারে অর্ধেক হইয়া গেলে চারিদিকে তাহার যে ফলাফল ফুটিয়া ওঠে, চোখ বুজিয়া থাকিলেও খেয়াল না করিয়া চলে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেন একটা শত্রুতার সৃষ্টি হইতে থাকে।

 শেষে শ্যামা একদিন বুক বাঁধিয়া টাকা তুলিবার ফর্মে নাম সই করিয়া তাহার সেভিংস ব্যাঙ্কের খাতাখানা শীতলের হাতে দিল। খাতায় শুধু জমার অঙ্কপাত করা আছে, সত্যভামাকে দিয়া পাঁচটি সাতটি করিয়া টাকা জমা দিয়া শ্যামা শ-পাঁচেক টাকা করিয়াছে, একটি টাকা কোনোদিন তোলে নাই।

 — টাকাটা তুলে কমলবাবুকে দাও গে। ধারটা শোধ হয়ে যাক, টাকা থাকতে মনের শান্তি নষ্ট করে কি হবে? আস্তে আস্তে আবার জমবে-খন।

 খাতাখানা লইয়া শীতল সেই যে গেল সাতদিনের মধ্যে আর সে বাড়ি ফিরিল না। শ্যামা যে বুঝিতে পারিল না তা নয়, তবু একি বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় যে তার অত কষ্টের জমানো টাকাগুলি লইয়া শীতল উধাও হইয়া গিয়াছে? একদিন বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি গিয়া শ্যামা কমল প্রেসে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করিয়া আসিল। সে আসিয়া খবর দিল প্রেসে শীতল যায় নাই। শীতল গাড়ি চাপা পড়িয়াছে অথবা তাহার কোনো বিপদ হইয়াছে শ্যামা একবার তাহা ভাবে নাই, কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া শীতলকে ভালরকম চিনিত না বলিয়া হাসপাতালে, থানায় আর খবরের কাগজের আপিসে খোঁজ করাইল। গাড়ি-টাড়ি চাপা পড়িয়া থাকিলে শীতলের একটা সংবাদ অবশ্যই পাওয়া যাইত শ্যামাকে এই সান্ত্বনা দিতে আসিয়া বিষ্ণুপ্রিয়া অবাক হইয়া বাড়ি গেল। শ্যামা যেভাবে তার কাছে স্বামীনিন্দা করিল, ছোটজাতের স্ত্রীলোকের মুখেও বিষ্ণুপ্রিয়া কোনোদিন সে-সব কথা শোনে নাই।

৬৪